2 of 3

২.৩৬ স্টাডি সার্কল থেকে

স্টাডি সার্কল থেকে একটি ছোট দল যাবে বর্ধমানের মেমারিতে, থাকার ব্যবস্থা পমপমদের বাড়িতে, তবে সেই জায়গাটি কেন্দ্র করে ঘোরা হবে আরও কয়েকটি গ্রামে।

অতীন তো যাবেই এবং সে ধরেই নিয়েছে অলি যাবে না, অলিকে সে কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। তা ছাড়া ক্রিসমাসের ছুটিতে বিমানবিহারী সপরিবারে প্রতি বছরই কৃষ্ণনগরের বাড়িতে যান, এবারেও যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে, অলিই বরং অতীনকে বললো, বাবলুদা, তুমিও চলো না আমাদের সঙ্গে?

অতীন ভুরু কুঁচকে বললো তোর বাবা-মায়ের সঙ্গে আমি কৃষ্ণনগরে গিয়ে কী করবো? খোকা সেজে সরপুরিয়া-সর ভাজা খাবো? আমি তো এই শনিবার বর্ধমান যাচ্ছি, ওখানে আমাদের স্টাডি সার্কলের প্রোগ্রাম আছে।

এবারে অলির ভুরু কোঁচকানর পালা। নিয়মিত প্রতি বৈঠকে না গেলেও অলি এখন স্টাডি সার্কলের সদস্যা, সে চাঁদা দেয়।

অলি বললো, বর্ধমানে স্টাডি সার্কলের প্রোগ্রাম হচ্ছে? সে কথা আমাকে জানানো হয়নি কেন?

তিনতলায় অলির পড়ার ঘরে অতীন চেয়ারে বসে সামনের টেবিলে দুটো পা তুলে দিয়েছে, সে এরকম দ-এর ভঙ্গিতে বসতে ভালোবাসে। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, মাত্র কিছুদিন হলো সে এই ঘরে সিগারেট টানার প্রশ্রয় পেয়েছে। ঘরে সিগারেটের ধোঁয়ার বিশ্রী গন্ধ হয়ে যায়, অনেকক্ষণ সেই গন্ধটা থাকে, সেই জন্য অলি প্রথম প্রথম আপত্তি করতো। কিন্তু তা হলে অতীনকে দশ মিনিটের বেশি আটকে রাখা যায় না। সে ঝড়ের বেগে আসতো, অলির সঙ্গে দু’চারটে কথা বলতে বলতেই সে হঠাৎ পকেট চাপড়ে বলে উঠতো, ও, তোর এখানে তো সিগারেট টানা যাবে না, তা হলে আমি এখন চলি! সুতরাং বাধ্য হয়েই অলিকে সম্মতি দিতে হয়েছে।

অতীন বললো, সবাই তো যাচ্ছে না, ছোট একটা গ্রুপ, সবাই মিলে গেলে ওখানে থাকার অসুবিধে আছে।

–আমি বুঝি সেই ছোট গ্রুপের মধ্যে থাকতে পারি না?

–কেন পারবি না? তোর যদি যেতে ইচ্ছে করে তো চল!

–কে কে যাচ্ছে?

–কৌশিক, অনুপম, অরুণ, প্রীতিময়, শুভানন আর আমি। মানিকদা দু’দিন পরে জয়েন করবেন।

–পমপম যাচ্ছে না?

–পমপম তো যাবেই, ওদেরই বাড়ি, পমপম না গেলে আমাদের কে চিনবে?

–তা হলে আমিও যাবো। বাবলুদা, তুমি আমার মাকে একটু বলো,মা রাজি হলেই বাবা আর আপত্তি করবেন না।

–ওসব আমার দ্বারা হবে না ভাই। তোর মাকে বাবাকে আমি কিছু বলতে পারবো না। তুই কি কচি খুকী নাকি, অলি? নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখ।

–শুধু আমি বললে মা বাবা আমাকে একটা অচেনা জায়গায় যেতে দেবে?

–যেতে না দিলে যাবি না! তোর হয়ে আমি ওকালতি করতে পারবো না, আই অ্যাম স্যরি, সেদিন সেই রাত্তিরের পর…

অতীন টেবিল থেকে পা দুটি নামিয়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো, সিগারেটের শেষ টুকরোটা ছুঁড়ে দিল জানলা দিয়ে। সে বিদায় নেবার জন্য উদ্যত।

মাস কয়েক আগে একদিন স্টাডি সার্কল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ হাঙ্গামা ও কারফিউতে ওরা দু’জন আটকে পড়েছিল, বাড়ি ফিরতে পারেনি। বাড়িতে কোনো খবর না জানিয়ে সারা রাত বাইরে কাটালে যতখানি নাটকীয় ব্যাপার হতো, ততটা হয়নি অবশ্য। যে গাড়ি বারান্দাওয়ালা বাড়ির সামনে ওরা আশ্রয় নিয়েছিল, সেই বাড়ির সহৃদয় মালিক দরজা খুলে ওদের ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। গ্রে স্ট্রিটে সাত রাউন্ড গুলি চলেছে। রাত এগারোটার পর অবস্থা কিছুটা শান্ত হলেও সারা রাতের জন্য কারফিউ জারি হয়ে গেছে, ওদের পক্ষে দক্ষিণ কলকাতায় ফেরা সম্ভব নয়। প্রথম দিকের উত্তেজনা খানিকটা স্তিমিত হয়ে গেলে অলি তার মা বাবার চিন্তায় দারুণ মুষড়ে পড়েছিল। তাদের পরিবারে একটি কুমারী মেয়ের সারা রাত বাড়ি না-ফেরা একেবারে অকল্পনীয় ব্যাপার। একমাত্র উপায় টেলিফোনে খবর দেওয়া কিন্তু সে বাড়ির টেলিফোনটি খারাপ। পাশের বাড়িতে টেলিফোন ছিল, কিন্তু তারা কেউ সাড়া শব্দ দিচ্ছিল না। অতীন ছাদের পাঁচিল টপকে গিয়ে সে বাড়ির লোকজনদের ডেকে তোলে কিংবা তাদের মটকা ঘুম থেকে জাগায়। টেলিফোনের লাইন পাওয়া গেল, কিন্তু শুধু অতীনের কথা শুনে অলির মা কল্যাণী শান্ত হননি। তিনি অলির কণ্ঠস্বর শুনতে চেয়েছিলেন। তখন অলিকে আনার ব্যবস্থা করা হলো। তাতেও মিটলো না।

রাত দুটোর সময় পুলিসের গাড়ি চেপে মেয়েকে উদ্ধার করতে এসেছিলেন বিমানবিহারী। সরকারি মহলে তাঁর অনেক চেনা-শুনো, গভীর রাতে হোম সেক্রেটারির সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি পুলিসী সাহায্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। শান্তিনিকেতন এবং কৃষ্ণনগরের লোকদের হাতেই তো অধিকাংশ সরকারি ক্ষমতা।

সেদিনের ঘটনায় দুটি কারণে অতীন ক্ষুব্ধ হয়েছিল। কলকাতা শহরে হঠাৎ দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধা কিংবা কারফিউ জারি হওয়ার জন্য তো অতীন দায়ী নয়। অলিকেও সে জোর করে স্টাডি সার্কলে নিয়ে আসেনি। তবু অলির মা বেশ কিছুদিন অতীনকে দেখেই মুখ গোমড়া করেছেন। কথা বন্ধ করেননি, অতীনের নামে কোনো অভিযোগ করেননি, কিন্তু তাঁর শুষ্ক ভাবটা অতীনের চোখ এড়ায়নি। তা দেখে অতীন ভেবেছিল, সে আর জীবনে কোনোদিন এ বাড়িতে আসবে না। কিন্তু অলি কান্নাকাটি করে। বিমানবিহারী নিজে একদিন এলগিন রোডের সামনে অতীনকে দেখে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে বলেছিলেন, এই বাবলু, তুই আমাদের বাড়ি অনেকদিন আসিসনি কেন রে? কী হয়েছে তোর?

অতীনের দ্বিতীয় ক্ষোভের কারণ, সে রাতে বিমানবিহারী তাকে জোর করে পুলিসের গাড়িতে ফিরতে বাধ্য করেছিলেন। পুলিসের ওপর অতীনের জাতক্রোধ জন্মে গেছে, গোর্কির লেখা পড়ে সে বুঝেছে যে বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থায় পুলিস বাহিনী হলো স্রেফ বড়লোকদের দারোয়ান। এরা কক্ষনো শোষিত শ্রেণীর স্বার্থ দেখে না। সেই পুলিসের সাহায্য নেবে অতীন? সে রাজি হয়নি, সে চেয়েছিল, বিমানবিহারী নিজের মেয়েকে নিয়ে চলে যান, সে ঐ গাড়িবারান্দাওয়ালা বাড়িটাতেই রাতটা কাটিয়ে যাবে। কিন্তু বিমানবিহারী তাতে রাজি হননি কিছুতেই, তিনি তো শুধু অলিকে নিতে আসেননি, অতীনও তো তাঁর সন্তানের মতন!

অতীন ভেবেছিল, তার এই পুলিসের গাড়িতে ফেরার ব্যাপারটা শুনে স্টাডি সার্কলের বন্ধুরা তাকে ঠাট্টা করবে; কৌশিককে সে অনুরোধ করেছিল খবরটা যেন মানিকদার কানে না পৌঁছোয়, কিন্তু মানিকদা ঠিকই জেনেছেন, পুলিসের উঁচু মহলে মানিকদার কয়েকজন বন্ধু। আছে, তাদের কাছ থেকেই সম্ভবত জেনেছেন, কিন্তু কিছু উচ্চ বাচ্য করেননি।

অলি উঠে এসে অতীনের জামার একটা বোতাম ধরে গাঢ় গলায় বললো, বাবলুদা, আমি তোমাদের সঙ্গে যাবে বর্ধমানে!

অতীন নিস্পৃহভাবে বললো, সে জন্য তোকে নিজেই ব্যবস্থা করতে হবে। দ্যাখ যদি তোর বাপ-মাকে বোঝাতে পারিস।

অত কাছে পেয়েও সে অলিকে বুকে টেনে নিল না, টপ করে একটা চুমু খাবার চেষ্টাও করলো না, অলির মিনতিময় চক্ষুদুটি অগ্রাহ্য করে সে বেরিয়ে চলে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে গুন গুন করে সুর ভাজতে লাগলো পর্যন্ত।

অলিরও জেদ আছে। সে বর্ধমানে যাবেই। মায়ের কাছে এমনি এমনি বললে সে অনুমতি পাবে না, তাই সে পমপমকে ধরলো, তাকে একদিন ডেকে নিয়ে এলো বাড়িতে। মা ও বাবার সঙ্গে পমপমের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো, পমপমকে তাঁদের অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই। পমপমের চেহারা ও ব্যবহারে একটি সচ্ছল পরিবারের পালিশ আছে। দু’দিন বাদে পমপম আবার এসে অলির মায়ের কাছে প্রস্তাবটি জানালো, সে অলিকে তাদের বর্ধমানের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। কল্যাণী সরাসরি আবেদনটি অগ্রাহ্য করলেন না, রাজিও হলেন না, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেন যে তাঁদের কৃষ্ণনগরে যাওয়া সব ঠিকঠাক হয়ে আছে, তাঁর শাশুড়ি অর্থাৎ অলির ঠাকুমা এখন সেখানে আছেন, তিনি আর কতদিন বাঁচবেন তার ঠিক নেই, তিনি অলিকে না দেখলে দুঃখ পাবেন!

পমপম তীক্ষ্ণ বুদ্ধিধারিণী মেয়ে। মানুষকে যুক্তি দিয়ে জব্দ করার শিল্প সে যত্ন করে আয়ত্ত করেছে। সে নিরীহ মুখ করে কল্যাণীকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, মাসিমা, আপনি বিয়ের আগে…আপনার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ছাড়া কখনো আপনার বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেছেন?

কল্যাণী বললেন, আমাদের সময় এসব ছিল নাকি? বাড়ি থেকে এক পা বেরুতে দেওয়া হতো না। বড় বয়েস পর্যন্ত ইস্কুলে গেছি, বাড়ির খুব কাছেই ইস্কুল, তবু বাড়ির দারোয়ান পৌঁছে দিয়ে আসতো, নিয়ে আসতো! আমার বাবা…তিনি কি এই অলির বাবার মতন নাকি? কী প্রচণ্ড ভয় পেতুম বাবাকে, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস ছিল না…

পমপম বললো, কিন্তু আপনার কখনো ইচ্ছে করতো না, বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যেতে, দেওঘর-মধুপুর, কিংবা সারা দিন বোটানিকসে বা চিড়িয়াখানায়…সত্যি করে বলুন, ইচ্ছে করতো না?

কল্যাণী পমপমের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কোনো উত্তর দিলেন না।

পমপম দৃষ্টি না সরিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো, সত্যি করে বলুন, ইচ্ছে করতো না?

-–ওরে বাবারে, ওসব ভাবলেও ভয় হতো। বাবার কাছে এসব কথা বলার সাহসই হতো না।

–আপনি ভয়ে আপনার বাবাকে বলতে পারেননি, কিন্তু মনে মনে আপনার ইচ্ছে হতো কি। সেটা বলুন? কল্যাণী আবার চুপ করে গেলেন।

পমপম বললো, তার মানে আপনার ইচ্ছে হতো ঠিকই। আপনি আপনার নিজের যেসব ইচ্ছে ফুলফিল করতে পারেননি, আপনার মেয়েকে সেই সব সুযোগ দেওয়া…মেয়েকে সেই স্বাধীনতা যদি না দেন তা হলে বুঝতে হবে আপনি আপনার সেই ইচ্ছেগুলোকেই অপমান করছেন!

কল্যাণী বললেন, অন্য সময় গেলে আমার আপত্তি ছিল না, কিন্তু, ঐ যে বললুম, কৃষ্ণনগরে মা অলিকে না দেখলে দুঃখ পাবেন, তিনি আশা করে আছেন।

পমপম সঙ্গে সঙ্গে বললো, তা হলে নীতিগতভাবে আমার সঙ্গে অলিকে যেতে দিতে আপনার আপত্তি নেই? ঠিক আছে, অলি আমার সঙ্গে বর্ধমান চলুক, কয়েকদিন বাদে আমি নিজে ওকে কৃষ্ণনগরে পৌঁছে দিয়ে আসবো। আমাদের ওদিক থেকে নবদ্বীপ পর্যন্ত বাস আছে। কাটোয়া লাইনে ট্রেনেও নবদ্বীপ যাওয়া যায়, আর নবদ্বীপ থেকে গঙ্গা পেরুলেই তো কৃষ্ণনগর। আমারও দেখে আসা হবে আপনাদের কৃষ্ণনগরের বাড়িটা!

বিমানবিহারীও আপত্তি করলেন না। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পমপমদের গ্রামের বাড়ির খবরাখবর নিলেন, তারপর বললেন, বেশ তো, তোমরা দু’জনে বর্ধমান ঘুরে তারপর কৃষ্ণনগরে চলে এসো!

অনুমতি পাওয়া গেল বটে, তবু অলির মনের মধ্যে রয়ে গেল একটা কাঁটার খচখচানি। মা, বাবা কারুকেই জানানো হলো না যে তাদের সঙ্গে বাবলুদাও যাচ্ছে। ওদের সঙ্গে আর কে কে যাবে সে প্রসঙ্গই তোলেনি পমপম। বাবলুদার সঙ্গে যাওয়াটা তো গোপন করার মতন কিছু ব্যাপার নয়। পরে এটা জানতে পারলে মা, বাবা দুঃখিত ও আহত হবেন। তাঁরা ভাবতেই পারেন যে বাবলুও যখন বর্ধমানে যাবে, তখন সে নিজে এসে কল্যাণী বা বিমানবিহারীর কাছে সে কথা বলে গেল না কেন? সত্যিই তো, বাবলুদার তো বলা উচিত ছিলই, কিন্তু অদ্ভুত সেই ছেলে, সে সেই যে একবার ঘাড় বেঁকা করেছে, আর কিছুতেই সোজা করবে না, সে বর্ধমান যাওয়ার ব্যাপারে অলির কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি নয়।

অলি যাচ্ছে শুনে সুস্মিতা নামে আর একটি মেয়েও জুটে পড়লো, মূল দলটি থেকে বাদ পড়লো প্রীতিময়, কারণ তার মা অসুস্থ। ট্রেন হাওড়া ছাড়ার পর অলি সত্যিকারের একটা মুক্তির স্বাদ পেল। বাড়ির গাড়ি চেপে সে বাইরে অনেক ঘোরাঘুরি করেছে, ট্রেনেও গেছে পুরী আর বেনারস, কিন্তু এইভাবে, শুধু সমবয়েসীদের সঙ্গে দল বেঁধে কোথাও যাওয়ায় অভিজ্ঞতা তার এই প্রথম। এর অন্য আনন্দ।

ওরা চেপেছে দুপুরবেলার লোকাল ট্রেনে, কামরা বেশ ফাঁকা, জানলা দিয়ে এসে পড়েছে শীতের রোদ। অতীন বসেছে খানিকটা দূরে, কৌশিকের সঙ্গে খুব মন দিয়ে কী যেন আলোচনা করে যাচ্ছে। অলির সঙ্গে চোখাচোখি হলে তাতে যেন ফুটে উঠছে একটা রাগ রাগ ভাব, যেন অলির আসাটা তার ঠিক পছন্দ হয়নি। অলির এক একবার সন্দেহ হয়, বাবলুদা কি তাহলে তাকে ভালোবাসে না? অথচ, অলির গানের মাস্টার, তার ইংরিজির স্যার, এদের ঘোরতর অপছন্দ করতো বাবলুদা, তার কথাতেই ওদের বিদায় করা হয়েছে, অন্য কারুর সঙ্গে অলির সামান্য ঘনিষ্ঠতাও সে সহ্য করতে পারে না।

অনুপম ভালো গান করে। কয়েক স্টেশান পর কামরা আর একটু জনবিরল হলে সে উচ্চ কণ্ঠে গান ধরলো। প্রথমেই ইন্টার ন্যাশনাল, অ্যারাইজ ও প্রিজনার অফ স্টারভেশান, অ্যারাইজ ও রেচেড অফ দা আর্থ…

অন্যরাও গলা মেলালো। শেষ হতেই অরুণ বললো, এর নজরুলের অনুবাদটা জানিস! ‘জাগো, জাগো, সর্বহারা…’

অনুপম এর পর গাইলো, উই শ্যাল ওভারকাম, উই শ্যাল ওভারকাম সাম ডে…

অতীনের সঙ্গে কথা থামিয়ে কৌশিক জিজ্ঞেস করলো, অনুপম, তুই পুরোনো আই পি টি এর গান জানিস না?

অনুপম মাথা নেড়ে বললো, আমার বাংলা গানের স্টক খুব কম, ছোট বেলায় মুঙ্গেরে ছিলাম তো…

কৌশিক বললো, আমার দাদার কাছে কিছু ঐ সময়কার গান শুনেছি। আমার সেগুলো দারুণ লাগে, আমি চেষ্টা করছি :

…আমার ভিটেয় চড়লো ঘুঘু
ডিম দিল তোমাকে
সেই আজব ডিমের আজব শিশু
খাস দিল্লিতে থাকে
শুন শিশুর পরিচয়
যেমন তেমন নয়কো শিশু মস্ত মহাশয়
ওগো শুন শিশুর পরিচয়
হিটলার তাহার জ্যাঠা ছিল
মুসোলিনী মেসো-ও-ও
আর মার্কিন দেশের মার্শাল মাসি
পাঠায় খেলনা ডলার ঝুম ঝুম
নাকের বদলে নরুন পেলাম টাক ডুমাডুম ডুম
আর জান দিয়ে জানোয়ার পেলাম
লাগলো দেশে ধূম…

অতীনের গলায় সুর নেই, সে গান গাইতে পারে না। কিন্তু এই গান শুনে সে মুগ্ধ এবং অবাক। কৌশিক তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কিন্তু কৌশিক যে এইরকম গান গাইতে পারে সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। সে বললো, দারুণ তো, আবার গা তো কৌশিক, গানটা তুলে নিই…

কৌশিক প্রথম দু’লাইন দু’তিনবার গাইলো, কিন্তু অতীনের গলায় তা উঠতে চায় না। অনুপম বাধা দিয়ে বললো, এই গানের ক্লাস এখন থাক। মেমারিতে গিয়ে তুই অতীনকে আলাদা শিখিয়ে দিস। অন্য গান হোক। আর কে কে গান জানে?

সুস্মিতা বললো, অলি নিশ্চয়ই গান জানে। অলিকে দেখেই মনে হয়। অন্যরা অনেক পিড়াপিড়ি করলেও অলি মুখ খুলতে চাইলো না, সে কখনো এমনভাবে খোলা গলায় গান করেনি। অতীন এক সময় বললো, থাক, ওকে জোর করিস না। ও প্যানপ্যানানি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া আর কিছু গাইতে জানে না।

অনুপম ও অন্য দু’একজন হই হই করে অতীনের কথায় আপত্তি জানালো। তারা রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ করে, তারা রবীন্দ্রসঙ্গীতই শুনতে চায়। শুভানন বললো, দেবব্রতর গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে আমার মনটা এমন আনচান করে…অলি, তুমি এই গানটা জানেনা, এ শুধু অলস মায়া…

ট্রেন একটা স্টেশানে থেমেছে। বাথরুমের দেয়ালের গায়ে একটি বিরাট পোস্টার, অশোক সেনগুপ্তর নামে। সেদিকে সকলেরই দৃষ্টি পড়লো। অতীন জিজ্ঞেস করলো, পমপম, তোর। বাবা সামনের ইলেকশানে দাঁড়াচ্ছেন বুঝি?

পমপম বললো, খুব সম্ভবত। কোঙারকাকু এসে খুব বোঝাচ্ছেন ক’দিন ধরে…

অরুণ বললো, হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিরাট মার্কসিস্ট তাত্ত্বিক, তিনিও পার্লামেন্টারি ডেমোক্রাসির লাইন নিয়েছেন এখন। মানিকদা নাকি ওঁর কাছেই দীক্ষা নিয়েছিলেন। এখন ওঁদের বিপ্লব টিপ্লবের চিন্তা চুলোয় গেছে। “ অনুপম বললো, এই লাইনটাকে তোরা অ্যান্টি মার্কসিস্ট ভাবছিস কেন? একটা স্টেট মেশিনারি দখল করার জন্য যে-কোনো পথ নেওয়া যায়…

অরুণ অবজ্ঞার সুরে বললো, স্টেট মেশিনারি দখল, হেঃ! দিল্লিতে ক্যাপিটালিস্ট অর ন্যাশনালিস্ট বুর্জোয়াজির যে ক্লিক আছে, সেটা ভেদ করে ইলেকশানের মাধ্যমে আগামী পঞ্চাশ বছরেও ক্ষমতা দখল করা যাবে তোরা মনে করিস?

অনুপম বললো, দিল্লিতে হয়তো সহজে ক্ষমতা দখল করা যাবে না। কিন্তু একটা একটা করে স্টেট যদি দখল করা যায়, যেরকম কেরালায় হয়েছিল, সেই রকমভাবে ওয়েস্টবেঙ্গলে, পাঞ্জাবে, আসামে…

অরুণ বললো, ওয়েস্টবেঙ্গলে? তুই খোয়াব দেখছিস অনুপম? অতুল্য ঘোষ-প্রফুল্ল সেন গুষ্ঠীকে তোরা হঠাতে পারবি? জ্যোতিবাবু অপোজিশান পার্টির লিডার হিসেবে গরম গরম বক্তৃতা দিতে দিতেই বুড়ো হয়ে যাবেন!

অনুপম বললো, অতুল্য ঘোষ-প্রফুল্ল সেন কি অমর?

–ওদের বদলে কংগ্রেসের সেকেন্ড র্যাংক উঠে আসবে। তারা এখনও কমন বাঙালীদের চিনিস না, এই বাঙালীরা সুভাষ বোসের নাম শুনলেই নেচে ওঠে। তুই রটিয়ে দে, সুভাষ বোস হিমালয়ের কোনো গুহায় সাধু সেজে বসে আছে, অমনি দেখবি সব বাঙালী বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে ধেই ধেই করে নাচছে!

–তবু এই বাঙালীরা ফরোয়ার্ড ব্লককে ভোট দেয় না।

–ফরোয়ার্ড ব্লকের অগানাইজেশান নেই সেরকম। কংগ্রেস সেই সেন্টিমেন্টটা এক্সপ্লয়েট করছে। দেখবি, প্রত্যেক ইলেকশানের আগে ওরা জনযুদ্ধের সেই ব্যাপারটা খুঁচিয়ে তোলে। সুভাষ বোস যদি বাই চান্স ফিরে আসে, তাহলে এরা ইন্দোনেশিয়ার প্যাটার্নে কমুনিস্টদের খুঁজে খুঁজে বার করে খুন করবে।

–সে গুড়ে বালি। সুভাষ বোস মরে ভূত হয়ে গেছে।

কৌশিক আর অতীনের দিকে সমর্থন চাওয়ার ভঙ্গিতে একবার তাকিয়ে অরুণ পমপমকে বললো, ওসব ইলেকশান ফিলেকশানের ধাপ্পাবাজিতে আমরা বিশ্বাস করি না। পমপম, আমরা যদি তোর বাবার এগেইনস্টে কখনো কাজ করি, তুই তা হলে কী করবি?

পমপম নির্বিকার মুখে বললো, আমায় যিনি জন্ম দিয়েছেন, সব ব্যাপারেই যে তাঁকে আমার সাপোর্ট করতে হবে, এমন মাথার দিব্যি আমায় কেউ দেয়নি!

অলির এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না। সে জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। শরকাল শেষ হয়ে গেছে কবে, তবু মাঠের ধারে জলা জায়গায় এখনও ফুটে আছে কত কাশ ফুল। পুকুরগুলোতে লাল ও সাদা রঙের শালুক। সদ্য ধান কাটা হয়েছে। এক জায়গায় খড়ের স্কৃপে লুটোপুটি খাচ্ছে দু’তিনটে বাচ্চা ছেলে-মেয়ে, কী মিষ্টি তাদের হাসি। এদিকে ওদের কারুর চোখ নেই কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *