জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
কেউ জানে না রসে বশে খেলা কেমন ধারা ॥
বহুকাল পরে একটা অজ গাঁ দেখার সুযোগ পাওয়া গেল। হাঁটছি তো হাঁটছিই। সামনে বিশাল দামোদর। এখন তেমন জল নেই। ধুধু বালি। সামান্য জল চিকচিক করছে কোথাও কোথাও। বালির নদী দেখলে বুকটা কেমন করে ওঠে। আতঙ্ক হয়। আবার নদীর নাম যদি হয় দামোদর, তা হলে তো কথাই নেই। দামোদর নদীনয় নদ। দুঃখ-নদ। নদীতে নামার আগে তিনজনেই থমকে দাঁড়ালুম।
পরম সাহসী হরিশঙ্কর বললেন, একটাই ভয়, চোরাবালি। চোরাবালিতে পড়লে আর রক্ষে নেই।
ছোটদাদু বললেন, স্থানীয় মানুষ যারা পার হচ্ছেন তাদের অনুসরণ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
হরিশঙ্কর বললেন, তা হলে চল কপাল ঠুকে নেমে পড়ি। এখানে তোর অলৌকিক বিদ্যা কাজে লাগবে না। লৌকিক বিদ্যাই ভরসা। সে বিদ্যার নাম অনুসরণ। ওই যে তিনজন যেখান দিয়ে যেভাবে নামছে, আমরাও সেইভাবে নেমে পড়ি।
ঢালু গড়ানে পাড় বেয়ে ছোট ছোট আগাছা মাড়িয়ে আমরা নেমে এলুম নীচে। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ উঠে গেল অনেকটা উঁচুতে। সাদা বালি প্রখর রোদে ঝলসাচ্ছে। চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। সামনে, পেছনে, ডাইনে, বামে শুধু বালি আর বালি। নিজেকে মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা পুতুল। হাতের দিকে তাকালুম, মনে হল পোড়া কাঠ। এত কালো দেখাচ্ছে। সামনের তিনজন পরপর যেমন চলেছেন, আমরাও ঠিক সেই কায়দায় চলেছি। পাশাপাশি নয়। একের পিছনে আর এক। রোদে মাথার চাঁদি ফেটে যাচ্ছে। নেশার মতো লাগছে। বালির নেশা। সবার আগে হরিশঙ্কর, তারপর আমি, আমার পেছনে ছোটদাদু। ভয় একমাত্র আমারই করছে, কারণ আমি ভিতু। হরেক রকমের আশঙ্কায় কণ্ঠতালু শুকিয়ে গেছে। হঠাৎ যদি বান আসে, সেই বিখ্যাত দামোদরের বান, তা হলে কী হবে? কীভাবে প্রাণে বাঁচব? ফসফসে থসথসে বালিতে তো দৌড়োতে পারব না। এই প্রথম অনুভব করলুম, পথ না থাকলে পথ চলা কত অস্বস্তিকর। পথহারা। পথিক আমরা। কোনও ধরাবাঁধা নেই। কেউ পথ পেতে না রাখলে চলার সুখ কীভাবে হারিয়ে যায়! বাঁ পাশে পড়ে আছে বিশাল এক গোরুর কঙ্কাল। হাড়ের আঁচায় বাতাস বইছে ঝুমঝুম শব্দে। মৃত্যু যেন ঘুঙুর পায় নাচছে।
আমরা যখন মাঝামাঝি এসে গেছি, সামনের তিনজনের মধ্যে একজন বললেন, আজ বোধহয় ড্যাম থেকে জল ছাড়বে।
হরিশঙ্কর বললেন, শুনছিস?
ছোটদাদু বললেন, আর শুনে কী হবে? আমরা এখন মাঝনদীতে। এপারও যত দূরে ওপারও তত দূরে। জল ছাড়লে ডুবে মরতে হবে।
কথা শুনে, মরার আগেই আমি মরে গেলুম। পায়ের জোর কমে এল। বালির নদী এঁকেবেঁকে ডাইনে-বামে নিজেকে খেলিয়ে দিয়েছে। মহাতঙ্কের মহাসংকীর্তন যেন নেচে নেচে চলেছে। বুগযুগ একটা শব্দ কানে এল। কে যেন আলগোছে জল খাচ্ছে। দেখি, সামনেই বালির মধ্যে একটা গর্ত, সেখানে জল ফুটছে। উঠছে, ঢুকছে, ঢুকছে, উঠছে।
হরিশঙ্কর থেমে পড়লেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। মুখে চোখে অসীম কৌতূহল। ছোটদাদু স্মরণ করিয়ে দিলেন, ওরা তিনজন কিন্তু অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আজ জল ছাড়তে পারে।
হরিশঙ্কর সে কথায় কান না দিয়ে বললেন, সায়েন্সটা কী? ব্যাপারটা কী হচ্ছে! ও বুঝেছি, ক্যাপটিভ ওয়াটার। বালির তলায় জল আটকে আছে। রোদ আর বালির গরমে ফুটতে শুরু করেছে। এ দেশে কেন যে সোলার এনার্জিকে কাজে লাগায় না! জলের টেম্পারেচারটা হাত দিয়ে দেখব?
ছোটদাদু বললেন, কী দরকার তোর? ওখানে চোরাবালিও থাকতে পারে।
চোরাবালি নেই। তলায় একটা হার্ড সারফেস আছে। তা না হলে জল জমত না।
তুই এখন দয়া করে এগিয়ে চল।
তোরও ভয় করছে?
আমি ঠান্ডা বাতাসের গন্ধ পাচ্ছি, তার মানে জল আসছে। ওই দেখ সেই তিনজন মানুষ দুরে বিন্দুর মতো হয়ে গেছে। আমাদের পেছনে আর কেউ নেই।
হরিশঙ্কর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন, দেখে বললেন, ভয় আর বিপদ নিয়ে খেলা করতে আমি ভীষণ ভালবাসি। ও দুটো আমার প্রিয় খেলনা। যারা ভয় পায় তাদের আরও ভয় দেখাতে ভীষণ মজা লাগে, আজ সেই সুযোগ এসেছে। আহা! প্রকৃতির কী ভয়ংকর রূপ! মাথার ওপর অসীম অনন্ত ফিকে নীল আকাশ। বালির বিশাল নদী খেলে খেলে চলে গেছে এপাশ থেকে ওপাশে। প্লাবনের আতঙ্কে ভরা পরিমণ্ডল। এমন পরিবেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ না করে চলে যাব!
ছোটদাদু বললেন, ক্যালকুলেটেড রিস্ক নেওয়া চলে, ডেয়ারডেভিল হওয়া ঠিক নয়। অকারণে নিজেকে বিপদে ফেলে বোকারা। এগিয়ে চল। বেলা বেড়ে যাচ্ছে।
তোরা না থাকলে আজ আমি এই নদীগর্ভেই দিন কাটাতুম। জল এলে আমার কী হত, ভেসে চলে যেতুম। মৃত্যুকে ভয় পেলে জীবনকে উপভোগ করা যায় না।
মৃত্যুকে ভয় না পেলেও জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাওয়া বোকামি। আত্মরক্ষার পথ খোলা রেখে বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। জল এসে গেলে এই অবস্থায় আমাদের পালাবার কোনও রাস্তা নেই। ওরা যখন বলে গেল তখন আমাদের সাবধান হওয়াই উচিত। সাধ করে মরে লাভ কী! সে তো আত্মহত্যার সামিল।
হরিশঙ্কর বললেন, মৃত্যু থাকলে মৃত্যু হবে। তা বলে এমন একটা দৃশ্য ছেড়ে ভয়ে পালাব! ওরা কী জানে?
ওরা স্থানীয় লোক। আমাদের চেয়ে বেশিই জানবে।
ক্ষুণ্ণ হরিশঙ্কর হাটা শুরু করলেন। ছোটদাদু বললেন, তোর কাণ্ড দেখে আমার একটা গল্প মনে পড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণের গল্প। একটা হাতি আসছে। হাতির পিঠে মাহুত। সামনে একটি লোক পড়েছে। হাতির পিঠ থেকে মাহুত চিৎকার করছে, সাবধান! সাবধান! লোকটি শুনেছিল, সমস্ত জীবই নারায়ণ। হাতিও নারায়ণ। নারায়ণ তার ক্ষতি করবে কেন? লোকটি মাহুতের কথায় কান দিল না। হাতি এল। শুড় দিয়ে তুলে এক আছাড়। প্রায় মরোমরো। একজন এসে বললেন, বাবা, সবাই নারায়ণ এই জ্ঞানই যদি তোমার হয়েছে, তা হলে মাহুত নারায়ণের কথা কেন শুনলে না? তোকেও বলি, ওয়ার্নিং শুনতে হয়। এখন গোঁগো করে বাকি পথটুকু হেঁটে চল। এখানে দ্রুত পলায়ন ছাড়া আর কোনও বিজ্ঞান আপাতত নেই।
হরিশঙ্করের এই পলায়নটা তেমন পছন্দ হল না। তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। হঠাৎ বললেন, চাঁদের আলোর রাতে এই ধুধু বালির বিস্তারে আসন পেতে বসতে হয়। সামনে জ্বলবে ধুনি। আর সেই গান, শ্মশান ভালবাসিস বলে শ্মশান করেছি হৃদি।
ছোটদাদু বললেন, ওই গান তো তোমার ভাল লাগার কথা নয়। নেগেটিভ গান। মৃত্যুর ইঙ্গিত আছে।
হরিশঙ্কর বললেন, মৃত্যুর মতো মহান কিছু আছে! এমন একটা চলে যাওয়া, যা একেবারে একশো ভাগ সত্য। একশো ভাগ নিশ্চিত। কোনওভাবেই আর ফেরা যাবে না। থাকা আর না-থাকার মধ্যে সময়ের ব্যবধান বাড়তেই থাকবে, ক্রমশই অনন্তে গিয়ে ঠেকবে। জার্নি টু ইনফিনিটি। এই একটা কারণেই মৃত্যু আমার কাছে ভীষণ আকর্ষণীয়। সব চলার শেষ আছে, এ চলার শেষ নেই। জীবনই এই পথে পৌঁছে দেয় বলে জীবনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
তা হলে তুই আমার সঙ্গে চল, দ্বারকা নদীতে আমরা বসব আসন করে। অমাবস্যার রাতে। প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডাকবে। মড়ার মাথায় বাতাস হাহা করবে। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। অচেনা দিগন্তে ভ্রমণের মতো।
দুজনে কথা বলছেন। আমি কিন্তু ভয়ে ভয়ে ডাইনে-বামে তাকাচ্ছি। কোন বাঁক থেকে জল ছুটে আসবে তা তো জানি না। হঠাৎ দেখি ডান দিকে বহু দূরে সাদা একটা ঢেউয়ের মতো কী ফুলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আমি চিৎকার করে উঠলুম, জল আসছে।
দুজনেই সচকিত হয়ে তাকালেন। হরিশঙ্কর হাহা করে হেসে উঠলেন, আরে ওটা একটা কাপড়। দু’জনে দু’পাশ থেকে একটা কাপড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলেছে। কাপড় শুকুতে শুকুতে চলেছে। এটা জলের নদী, দুধের নদী নয়। জল এত সাদা হয় না।
অবশেষে আমরা নদীর গর্ভ ছেড়ে পাড়ে উঠে এলুম। দোকানপাট, মানুষজনের হইচই। ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। শরীর আর চলছে না। মনে হচ্ছে ধড়াস করে শুয়ে পড়ি। যেমন তৃষ্ণা, সেইরকম খিদে। ছোটদাদু মনে হয় আমার মনের তরঙ্গ ধরতে পারলেন। বললেন, এইখানে একটা ভাল দোকান দেখে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নেওয়া যাক। একটু বিশ্রামেরও দরকার। বেশ পরিশ্রম হয়েছে।
হরিশঙ্কর বললেন, ভাত খাওয়া চলবে না। হোটেলের ভাত আমি অ্যালাউ করব না।
ভাত কে খেতে চাইছে! শুকনোশাকনা।
কোনও দোকানই মনে ধরে না। পরিচ্ছন্নতার অভাব। হঠাৎ হরিশঙ্কর বললেন, হোয়াট এ ফুল! বাড়ির বাইরে এসে বাড়ির সুখ খুঁজছি, মূর্খ আমরা। যে-কোনও দোকানে ঢুকে যা খুশি তাই খাব আমরা। কোনও বাছবিচার করব না। একটা জিনিস ভেবে দেখেছিস, যেখানে যাচ্ছি আমরা, সেখানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হলে কোনও পাকা ব্যবস্থা নেই!
ছোটদাদু বললেন, খুব জানি। প্রকৃতির কাজ প্রকৃতিতেই সারতে হবে। মাঠ আর পুকুর। আর লজ্জা! নিজের চোখদুটো বন্ধ করে রাখো। আমাকে দেখো, আমি তো দেখছি না।
হরিশঙ্কর সদর্পে একটা আটচালায় ঢুকে পড়লেন। সবই আছে সেখানে। অদ্ভুত চেহারার মিষ্টি। গুড়ের রসে পাক করা কালচে রঙের বেসনের লাড্ড। ঠান্ডা জিলিপি। টক দই। প্রচুর মুড়ি। চিড়ে। ভেলিগুড়। মনমরা তেলেভাজা। এক ঝাক মাছি ছাড়া কারওকেই তেমন আনন্দিত উৎফুল্ল মনে হল না।
দোকানের মালিক পরিচ্ছন্ন খদ্দের পেয়ে বেশ উৎসাহিত হলেন। প্রমাণ মাপের একটা গামছা পরে বসে ছিলেন। নিজেকে একটু গোছগাছ করে বললেন, সবরকমের ব্যবস্থাই আছে। চিঁড়ের ফলার করতে পারেন মণ্ডা দিয়ে। এক ছড়া কলা আনিয়ে দিচ্ছি।
তেড়াবাঁকা কালোকালো লাড্ডগুলোর নাম মণ্ডা। এই অঞ্চলের লোকপ্রিয় মিষ্টান্ন, মণ্ডামেঠাই।
হরিশঙ্কর বললেন, আজ আমরা একাদশী করতে চাই।
আজ্ঞে বাবু আজ যে চতুর্দশী, পূর্ণিমা।
তাতে কী হয়েছে, একাদশী মানে আটাদশী। গরম লুচি কুমডোর ছক্কা, হতে পারে? হবে না কেন, অর্ডার দিলেই হবে। মোহনের অসাধ্য কিছু নেই। একটা হুংকার ছাড়লেন, বিমলা!
এমন একজন মহিলাকে এখানে দেখা যাবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। একেবারে সাধিকার চেহারা। ভাব-থমকানো মুখে ভাসাভাসা দুটো চোখ। উদাস যেন কোন আকাশে লগ্ন। মধ্যবয়সি। পরিষ্কার লাল পাড় শাড়ি। কপালে গোল সিঁদুরের টিপ। দু’হাতে মোটা দুটো শাঁখা। আলগা খোঁপা। আমরা তিনজনেই অবাক। এমন পবিত্র আবির্ভাব আমরা আশা করিনি। দোকানের মালিক একগাল হেসে বললেন, আমার বোন। খুব ভাল ঘরে বিয়ে হয়েছিল। তা সংসার আর করা হল না।
ছোটদাদু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সংসার করবেন কী করে! ইনি তো সংসারের নন। শক্তি, সাক্ষাৎ জগজ্জননী। এঁর স্থান তো আশ্রমে মন্দিরে হবে। সাধিকা।
বিমলা হাত জোড় করে বললেন, ওইসব বলবেন না বাবা। তবে আপনাকে আমি চিনি।
ছোটদাদু অবাক হয়ে বললেন, আমাকে?
হ্যাঁ বাবা, আপনাকে আমি তারাপীঠে দেখেছি। আজ আপনি এসেছেন আমাকে কৃপা করতে। আপনি যে কত বড় সাধক আমি নিজে দেখেছি। আপনি আমাকে একটা বজ্রনাভি রুদ্রাক্ষ দিয়েছিলেন। এই দেখুন আমার গলায়। এইটা ধারণ করার পর আমার অনেক বিপদ কেটে গেছে বাবা। এখন আর আমার কাছে আসার সাহস হয় না কারও।
বিমলা এগিয়ে এসে ছোটদাদুকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। হরিশঙ্কর নিজের মনেই বললেন, যেখানেই যাই সেইখানেই সাধন, সাধনা, রুদ্রাক্ষ, তন্ত্র, তাগা, তাবিজ। সাধারণ মানুষের পৃথিবীটা হারিয়ে গেল নাকি!
বিমলা হরিশঙ্করকে প্রণাম করার জন্যে এগিয়ে এলেন। হরিশঙ্কর তিন লাফে পেছিয়ে গেলেন, আমাকে নয়, আমাকে নয়। আমি কেউ নই। আমি সাধনভজন করি না।
বিমলা হরিশঙ্করকে ধরে ফেললেন। প্রণাম করতে করতে বললেন, সে তো আমি বুঝি। উঠে দাঁড়িয়ে হরিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে এমন সুন্দর হাসলেন হরিশঙ্করও থমকে গেলেন। এতসব কাণ্ড দেখে দোকানের মালিক মোহন আর চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না। উঁচু জায়গা ছেড়ে নেমে এলেন। বোনকে জিজ্ঞেস করলেন, এই মহাপুরুষের কথাই তুই আমাকে বলেছিলিস? যিনি দু’হাত ঘষে আগুন জ্বালাতে পারেন?
বিমলা ঘাড় নাড়ল। মোহন ছোটদাদুর দিকে তাকিয়ে আছেন অবাক হয়ে। ভাবের মানুষ। চোখে জল এসে গেছে। ছোটদাদুকে দেখছেন আর কাঁদছেন নিঃশব্দে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। বহুকাল পরে সন্তান যেন তার হারিয়ে যাওয়া পিতাকে খুঁজে পেয়েছে। এতদিনের দুঃখ-বেদনা সব ধুয়ে সাফ হয়ে যাচ্ছে চোখের জলে। মোহন নিচু হয়ে ছোটদাদুকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন। এখন এই মুহূর্তে তাকে কোনওভাবেই ভাবা যাচ্ছে না সামান্য একজন অশিক্ষিত মিঠাইঅলা। শান্ত, সংযত, ভাবগম্ভীর। থমথমে গলায় বললেন, আজ আমাদের পরম সৌভাগ্যের দিন। কিছু চাই না। যদি কিছু দেবার থাকে আমাদের দিয়ে যাবেন, অন্ধকারের লণ্ঠন, বৃদ্ধের লাঠি, বর্ষার ছাতা, শীতের কথা।
মোহন শুদ্ধ সাহিত্যের ভাষায় কথা বলছেন। এঁর জীবনের অন্য একটা দিক আছে অবশ্যই। ছোটদাদুর পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন না তাগা-তাবিজ মন্ত্র-তন্ত্রের জন্যে। শুধুই কৃপাপ্রার্থী। ভাগ্য-ভবিষ্যৎ কিছুই জানতে চান না।
বিমলা বললেন, দাদা, এঁদের আমি বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। সেইখানেই সেবা হবে।
মোহন বললেন, তাই তো করবি! এঁরা কৃপা করে এসেছেন শুধু আমাদেরই জন্যে।
হরিশঙ্করের হয়তো আপত্তি ছিল। মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছিল আমার। কারও সংসারে সহসা ঢুকতে চান না। ব্যবসায়িক লেনদেনই পছন্দ করেন। একটা চুক্তির মধ্যে এসো। প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, যাবতীয় সেন্টিমেন্ট বড়ই জটিল, অযথা সময় নষ্ট। ঘোর সংসারে অঘোর বিষয়ের কোনও দাম নেই। ফেলো কড়ি মাখো তেল। ইংরেজিতেই ভাল শোনায়, ফিনিশ ইট। পৃথিবী মানেই থকথকে দগদগে স্বার্থ। স্বার্থে আসার আগে যাবতীয় গৌরচন্দ্রিকা। আগে দেখেছি, বাড়িতে এসে কেউ খুব ভণিতা করছেন, কেমন আছ? তোমার সেই গোড়ালির ব্যথা? আমি ডেড শিয়োর, কোনও পাথরে পা পড়ে গিয়েছিল। গুপো হয়ে গেছে। ভয়ংকর ভোগায়।
হরিশঙ্কর শুনে যাচ্ছেন। ব্যাডমিন্টন খেলার মতো। বল আসছে, বল ফিরে যাচ্ছে। চলছে খেলা। হঠাৎ এক চাপ্স। বিপক্ষ বসে পড়বে।
হরিশঙ্কর হয়তো একটু মজা করবেন। বিব্রত করার জন্যে বলবেন, গোড়ালিতে তো আমার কস্মিনকালেও কিছু হয়নি।
ভদ্রলোক অমনি বলবেন, আমি গুলিয়ে ফেলেছি। নগেনের সঙ্গে তোমাকে গুলিয়ে ফেলেছি। তোমার যেন কোথায় ব্যথা হয়েছিল? গলায়?
হরিশঙ্কর আরও একটু খেলবেন, হাঁচি কাশি-সর্দি-জ্বর ব্যথা-মাথাধরা, আমার জীবনে হয়নি, হবেও না।
ভদ্রলোক হাল ছাড়বেন না। বলবেন, যদি কখনও তোমার গুলো হয়, তুমি যেরকম গোড়ালি ঠুকে ঠুকে গোরাদের মতো হাঁটো, হলেই হল। তখন কী করবে? একটা টোটকা শিখিয়ে দিই। মেয়েরা উনুনের আগুন ফেলে দেবার পর, উনুনের ঝিকের পাশে জয় মা বলে গোড়ালিটা চেপে ধরবে। বারকয়েক। ব্যথাফ্যথা সব হাওয়া। আর যদি গলায় ব্যথা হয় তা হলে…।
হরিশঙ্কর এইবার মারবেন চা। তা হলে গলাটা স্রেফ উড়িয়ে দোব। অনেকটা সময় আমার নিয়েছেন, এইবার কাজের কথায় আসুন, কী চাই বলুন তো?
ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বলবেন, বেশি না, গোটা কুড়ি টাকা হলেই হয়ে যাবে। কামিং মাস্থের বাই দা টেনথ আমি দিয়ে যাব। ভীষণ হার্ড আপ হয়ে পড়েছি হরিশঙ্কর। বৃদ্ধ মানুষ। আগের মতো আর খাটতে পারি না। ফার্মটা উঠে চলে গেল বিলেতে। ইন্ডিয়ান বিজনেস ক্লাজড। সবই শেষ হয়ে গেল। একসময় দোল-দুর্গোৎসব হত বাড়িতে। বাঙালির পতনের কাল।
হরিশঙ্করের ভেতর থেকে সেই মুহূর্তে একজন বড় মাপের মানুষ বেরিয়ে আসবে। মুখের চেহারাটা হয়ে যাবে শ্রীচৈতন্যের মতো করুণাময়। একটা বেদনা, যেন মানুষটির জীবনে নিজে ঢুকে পড়েছেন। ভদ্রলোক চেয়েছিলেন কুড়ি, একশো টাকার একটা নোট হাতে গুঁজে দিয়ে বলবেন, এটা আর আপনাকে শোধ দিতে হবে না। আমার ছেলেকে দিয়ে মাঝে মাঝে আপনার খবর নেওয়াব। আমি বাঁচলে আপনারও বাঁচার অধিকার আছে।
ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে চলে যাবেন। হরিশঙ্করের দিকে অবাক হয়ে তাকাবেন। যেন বিস্ময়কর কোনও বস্তু দেখছেন। হতাশ মুখে একঝলক আশা। বেঁচে থাকার মন্ত্র শুনেছেন কানে।
এক নয়, ছড়িয়ে আছে শত শত উদাহরণ। কত পরিবার নীরবে নিভৃতে স্মরণ করে হরিশঙ্করকে। হরিশঙ্করের দান সেইরকম, বাঁ হাতও জানতে পারে না, ডান হাত কী করছে। কেউ প্রশংসা করলে স্তাবকতা করলে হয় নিজে স্থানত্যাগ করেন, নয় তাকেই দূর করে দেন।
সেই হরিশঙ্কর নিতান্ত বাধ্য হয়েই চলেছেন বিমলার ভিটেতে। ছোটদাদুর কথা অমান্য করতে পারেন না। দোকান থেকে বেরোনো মাত্রই একটা কলরব। একটা শব্দ। সবাই ছুটছে নদীর দিকে। জল ছেড়েছে। জল ছেড়েছে।
কোনও কথা নয়, হরিশঙ্করও ছুটলেন। আমরাও পিছু নিলাম।
অপূর্ব দৃশ্য! হুহু শব্দে, দিগ্বিদিক ভাসিয়ে ছুটে আসছে জল। ভক্ত নরনারীর মতো প্রণাম করতে করতে আসছে শত শত ঢেউ। একের ঘাড়ে আর এক। প্রেম সুধারসে মাতোয়ারা কীর্তনিয়ার দল। বাজছে লক্ষ মৃদঙ্গ।