সুলতান শাহরিয়ার বললো, গল্পের যাদুকর আমির ইবন মাসদার কোনও কিসসা তুমি জান শাহরাজাদ?
শাহরাজাদ মৃদু হেসে বলে, খুব জানি। বলুন তার কোন গল্প শুনতে চান?
শারিয়ার বলে, আবু ইসার একটা কাহিনী শোনাও।
শাহরাজাদ বলতে শুরু করে :
একদিন হারুন আল রসিদের পুত্র আবু ইসা তার এক মাসতুতো ভাই আলী ইবন হিমাস-এরবাড়ি বেড়াতে এসেছিলো। আলী বিত্তশালী ব্যক্তি। অগণিত দাস দাসীর সে মালিক।
আলীর এক অসাধারণ রূপ-লাবণ্যবতী বাঁদী ছিলো। নাম তার সুর্ম।
প্রথম দর্শনেই আবু ইসা সুর্মাকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু দুঃখ মনে চেপেই সে ঘরে ফিরে আসে। আলীর কাছে প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে ইসার বিরহ-বেদনাও ততই বাড়তে থাকে। সুর্মর চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে বারবার কিন্তু ভুলতে পারে না।— আবার সে আলীর কাছে যায়। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে সে তখন তার মনের গোপন ইচ্ছা ব্যক্ত করে ফেলে।
—মেয়েটিকে খুব পছন্দ, ভাইজান। যদি তুমি ওকে বিক্রি কর, আমি দাম দিয়ে কিনে নেবো।
কিন্তু আলী সে কথায় রাজী হয় না। বলে ও আমার হারেমের সেরা সুন্দরী। এমন কি সারা আরবেও তার জুড়ি খুব বেশি নাই। তাছাড়া ওকে আমি ভোগ করার জন্যে কিনেছি-দশ হাজার দিনার দিয়ে। কেনা-বেচার কারবার করার জন্য তো রাখিনি, ভাই।
এরপর আর কথা চলে না। ব্যথিত মনে আবার সে ফিরে আসে প্রাসাদে। কিন্তু কিছুতেই সুর্মাকে মনের আড়াল করতে পারে না। শেষে একটা নতুন ফন্দী আসে তার মাথায়। তার বড় ভাই খলিফা আল-মামুনকে গিয়ে সব কথা খুলে বলে, সুর্মাকে না পেলে আমার জিন্দগী বরবাদ হয়ে যাবে, আমি ওকে চাই-হুঁ।
ভাইয়ের মনের অবস্থা বিবেচনা করে অল মামুন বলে, ঠিক আছে, ঘোড়ায় চাপে, চলো যাই দেখি তার কাছে। কী হয় দেখা যাক।
দুই ভাই ঘোড়া ছুটিয়ে আলীর প্রাসাদে এসে নামে। স্বয়ং খলিফা এসেছেন তার ঘরে-কী ভাবে তাকে আদর অভ্যর্থনা করবে, ভেবে পায় না। আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানায় আলী। তারপর বলে, আমার কি পরম সৌভাগ্য, আপনি এসেছেন। আমার গরীবখানায়।
বিরাট প্রশস্ত একখানা সভাকক্ষ। দামী দামী আসবাবপত্রে ঝকঝকে করে সাজানো। চারপাশের দেওয়ালে ঝোলানো বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা দুপ্রাপ্য সব ছবি। সারা ঘরটা বাসরাহর কাজকরা সেরা কাপেট মোড়া। বড় বড় মোটা মোটা থামের গায়ে ইমারতী নক্সা দেখে মনে হয় গ্ৰীক কারিগরদের হাতে গড়া এই বিশাল ইমারত।
খলিফা আর ইসাকে সঙ্গে নিয়ে চারপোশ ঘুরে দেখাচ্ছিল আলী। এক সময় খলিফা বললো, বাঃ বেশ। তা একটু খানা-পিনার ব্যবস্থা কর আলী। বড় খিদে পেয়ে গেছে।
আলী লজ্জিত হয়। হাতের তুডি বাজাতেই প্রায় শ’খানেক সুবেশ নারী হাতে খাবারের রেকবী নিয়ে সার বেঁধে এসে দাঁড়ালো। এক একজনের হাতে এক এক রকমের খানা। এলাহী ব্যাপার।
আহারাদি শেষ হয়ে গেলে, সরাবের পাত্র-পেয়ালা আসে। আর আসে নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে দশটি মেয়ে। সকলেরই সাজ-পোশাক এক—মিশমিশে কালো রেশমের পোশাক পরে এসে দাঁড়ালো চাঁপা কলির মতো সুতানুকরা। দশখানা সোনার কুর্শি বৃত্তাকারে সাজানো ছিলো। একে একে এসে অধিকার করে বসলো তারা। নানারকম তারের বাদ্যযন্ত্র তাদের হাতে। বাজনার তালে-তালে ধ্বনিত হতে থাকলো সুললিত কণ্ঠের সঙ্গীত লহরী।
এই দশজনের মধ্যমণি ছিলো একটি মেয়ে। আল-মামুনের দৃষ্টি নিবন্ধ হয়ে গেলো তার দিকে। প্রশ্ন করলো, কী তোমার নাম?
মেয়েটি বিনীত ভাবে বলে, আমার নাম লহরা, জাঁহাপনা। খলিফা বলে, ওই নামেরই যোগ্য তুমি। আচ্ছা লহরা, এবার তুমি একা একখানা গান শোনাও দেখি
এহি যে আমার কোমলতা
এই যে আমার চকিত চপল চাহনি
আর এই যে আমার ক্ষীণ কটি তনু;
এর লোলুপতায় লুব্ধ হয়ে আসে যারা
বিশ্বাস করি না-বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করি না তাদের।
কিন্তু ভালোবাসা যদি অন্তরীণ হয়,
আমিও মোমের মতো গলবো,
ধূপের সৌরভে মাতিয়ে দেব। প্রাণ;
সারা রাত ধরে সুদৃশ আকাশে শুকতারা হয়ে জ্বলবো,
ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবো হৃদয়, গাইবো শুধু ভালোলাগার গান…
খলিফা অল মামুন তারিফ জানায়, বহৎ খুব। তোফা! বড় চমৎকার তোমার গলা লহরা। আচ্ছা বলতো, কার লেখা এই গান?
— গীত রচনা অমর ইবন মাদি করিব অল-জুবাইদী এবং সুর দিয়েছেন মাবিদ।
মদের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে শূন্য করে নামিয়ে রাখে। খলিফা। খলিফার দেখাদেখি ইসা এবং আলী পেয়ালা নিঃশেষ করে রেখে দেয়। মেয়ে দশটি কুর্নিশ জানিয়ে বিদায় নেয়। সঙ্গে সঙ্গে আরও দশটি মেয়ে সোনার জরির কাজ করা নীল রেশমী পোশাকে সেজে প্রবেশ করে। সকলের হাতে নানারকম বাদ্যযন্ত্র সুরের ঝঙ্কার ওঠে ঘরময়। এই দশজনের মধ্যে সেরা যে মেয়ে তার দিকে নজর রাখে। খলিফা।
–তোমার নাম কী?
মেয়েটি জবাব দেয়, আমার নাম বন-হরিণী–
রাত্রির তমসা কেটে যায়, শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
তিনশো নকবইতিম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :
খলিফা বলে, তা তোমার একটা গান শুনতে চাই, বন-হরিণী—
বন-হরিণী বলে, আপনার আজ্ঞা শিরোধাৰ্য করছি, জাঁহাপনা।
গান ধরে সে :
আমি উচ্ছল, উদ্দাম, নির্ভয়
আমি এক মক্কার বন-বিহারিণী,
কোনও শিকারীই বিদ্ধ করতে পারে না আমায়।
যারা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে ব্যর্থ হয়
তারাই আমার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দোষ ধরে,
কিন্তু ওরাও মনে মনে মানে, আমার মতো
নিখুঁত নিটোল সুন্দর দেহবল্লরী
এবং আমার কালো হরিণ চোখ
কারই বা আছে–
খলিফা প্রশ্ন করে, কার লেখা বলে তো গানটা?
বন-হরিণী বলে, কথা জাবির আর সুর সুরেজ-এর।
খলিফা আর একবার সরাবের পেয়ালা শূন্য করে নামিয়ে রাখে। মেয়েগুলো বিদায় হয়। সঙ্গে সঙ্গে আসে আর একদল-তারাও সংখ্যায় দশ। সকলের হাতেই বাদ্যযন্ত্র। ওরা সকলেই পরেছে টকটকে লালরঙের সিন্ধের পোশাক। খলিফা সকলের সেরা সুন্দরীকে প্রশ্নকরে-কী তোমার নাম?
মেয়েটি জবাব দেয়, আমার নাম রমজানী।
–তোমার একখানা গান শোনাও, দেখি।
রমজানী শুরু করে :
অলঙ্কার আভরণ
তা সে লাল নীল হলদে অথবা সাদা
যে রঙেই রংদার হোক
কিছু যায় আসে না;
সব মেয়ের কাছে কদর তাদের সমান।
প্রতি রাত্রির শেষে সকাল বেলায়
যদি শয্যার পাশে
এমনি কিছু একটা কুড়িয়ে সে পায়
তার চাইতে আর কিছুই কাম্য থাকে না তার—
খলিফা জিজ্ঞেস করে, কে লিখেছে?
রমজানী বলে, গীতিকার আদি ইবন জাইদ। বহু প্ৰাচীন গান।
খলিফা পেয়ালার চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েগুলো বিদায় নেয়। একদল যায় কিন্তু আর একদল আসে। সোনালী রঙের সাজ পোশাকে সেজে দশটি মেয়ে এসে কুর্শিতে বসে পড়ে। সকলের সেরা মেয়েটিকে ডেকে খলিফা তার নাম জিজ্ঞেস করে। মেয়েটি বলে, আমার নাম শিশিরকণা।
খলিফা বলে, তোমার একটা গান শুনবো।
শিশিরকণা গাইতে শুরু করে :
আমি তার রক্তাক্ত গালের গুলাবী সরাব
বুদ হয়ে পড়ে থাকি নির্লিপ্ত নেশায়
আহা কী যে মধু কত সুখ, কী করে বোঝাই
পথে পথে ফিরি। আমি
উদাস পাগলা-প্ৰাণ
প্রেমের ভিখারী…
খলিফা করতালি দিয়ে বাহবা দেন চমৎকার। এ গান কার লেখা, শিশিরকণা?
মেয়েটি বলে, গান লিখেছেন কবি আবু নবাস আর গেয়েছেন ওস্তাদ ইশাক।
মেয়েগুলো বিদায় নিলে খলিফা আলীকে উদ্দেশ্য করে বলে, খুব আনন্দ পেলাম। এবার তাহলে চলি, আলী।
আলী বলে, আর একটুক্ষণ অপেক্ষা করুন, জাঁহাপনা। আর একটি বাঁদীকে হাজির করতে চাই আপনার সামনে। আমার প্রাসাদের সব চেয়ে সুন্দরী, শিক্ষিতা মেয়ে। দশহাজার মোহর দিকে কিনেছি তাকে। আমার বিশ্বাস সে আপনাকে মুগ্ধ করতে পারবে। যদি না পারে তা হলে তাকে বিদায় করে দেবো।
খলিফা বলে, ঠিক আছে; নিয়ে এসো তাকে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই সারা ঘর আলো করে এসে দাঁড়ালো এক পরমাসুন্দরী লাস্যময়ী নারী। খলিফা আপলকভাবে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে।
এমন রূপবতী কন্যা সচরাচর চোখে পড়ে না। ধীর পায়ে এসে সে একখানা কুশিতে বসে পড়ে।
খলিফা লক্ষ্য করে তার ভাই ইসা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ঘনঘন মদের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছে সে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে তার। দেহের রক্ত সবই বুঝি মুখে জমা হয়ে গেছে। অল মামুন জিজ্ঞেস করলো, কী, কী হলো?
ইস ঘাড় নেড়ে কোনও রকমে বলতে পারে, না, কিছু না। সুন্দরী বাঁদীর রূপের ফাঁদে তার প্রাণপাখী আটকে গিয়ে ধড়ফড় করতে শুরু করেছে। আবার জিজ্ঞেস করে, মেয়েটার সঙ্গে কী আগে তোমার আলাপ পরিচয় ছিলো?
–না। কিন্তু আসমানের চাঁদকে কে না চেনে, ধর্মাবতার!
খলিফা এবার মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী?
—সুর্মা, আমার নাম সুৰ্মা, জাঁহাপনা।
–তোমার একখানা গান শোনাও।
সুর্মা গান ধরে :
ও আমার দিল-এর মালিক
ও আমার মনের মানুষ
তুমি কী নির্মম নিষ্ঠুর
তোমার কলিজা কী পাথরে গড়া?
কিন্তু আমি তো জানি
তোমার অন্তর পল্লবিত কুসুমের মতো
মধুর নির্যাসে ভরা–
খলিফার প্রশ্নের জবাবে সুৰ্মা জানায় গানের কথা লিখেছে। খুজাই আর সুরারোপ করেছে। জুরািজুর।
আলী এতক্ষণ ধরে আবু ইসা-কে লক্ষ্য করছিলো। সুর্মাকে দেখা অবধি সে এক যন্ত্রণায় ছটফট করছে। এবার সে বললো, ভাই ইসা তুমি আমার আজ মহামান্য মেহমান। তোমাকে অসুখী রাখলে আমার গুণাহ হবে। আমি বুঝেছি, সুর্মার জন্য ত্যোমার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তুমি শান্ত হাতেই সঁপে দিচ্ছি। আশা করবো, ওকে পেয়ে তুমি সুখের জীবন গড়ে তুলতে পারবে।
আবু ইসা বলে, কিন্তু এখানে মহামান্য ধর্মাবতার উপস্থিত। কোনও দানই দান করা যায় না তার অনুমতি ছাড়া।
খলিফা মামুন বলে, আমি সানন্দে অনুমতি দিচ্ছি, ইসা। সুর্মাকে তুমি বরণ করে ঘরে নিয়ে চলো।
শাহরাজাদ বললো, এই কাহিনী থেকে আলী এবং তার সময় কালের মানুষের অতিথি সেবার কিছুটা ছবি পাওয়া গেলো।
এরপর শাহরাজাদ বলতে থাকে আর এক কাহিনী।