2 of 3

২.৩৪ মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাড়ি

মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাস থেকে কয়েকটা স্টপ আগে নেমে পড়লো তুতুল। জগুবাবুর বাজারের কাছে। এর আগে তুতুল কোনোদিন কোনো বাজারের মধ্যে ঢোকেনি, আজ সে ঢুকলো। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে তার বই খাতা, কলেজে যাবার তাড়া থাকায় কোনোদিনই সে চুল বাঁধে না, একটা হলদে রঙের শাড়ি পরা, পায়ে রবারের চটি। সে মুদি দোকান খুঁজতে লাগলো।

আতপ চাল একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না। বিধবা হবার পর সুপ্রীতি আর সেদ্ধ চাল খান না, তাই দু’তিন দিন ধরে তিনি দিনের বেলা ভাতের বদলে সাবু কিংবা চিড়ে ভিজিয়ে খাচ্ছেন। মমতা, তুতুল আর মুন্নিকে তিনি মাথার দিব্যি দিয়েছেন, এ কথা কিছুতেই যেন প্রতাপের কানে না যায়। সাবু-চিড়ে খেয়ে তিনি দিব্যি আছেন, কোনো অসুবিধে নেই, অম্বুবাচীর সময়েও তো তাঁকে ভাত ছাড়াই তিনদিন কাটাতে হয়।

বাড়ির পুরুষ দু’জন খেয়ালই করে না বাড়ির মেয়েরা কী খায় না খায়। অতীন নিজের খাবারটি পেলেই খুশী। প্রতাপও দু’বেলাই আলাদা খেতে বসেন। তাঁকে যা পরিবেশন করা হয়, বাড়ির অন্যরা তাই-ই খাবে, এটাই তিনি ধরে নিয়েছেন। চালের অনটনের কথা তিনি জানেন, সেইজন্যই দিনের বেলা ভাত আর রাত্তিরে রুটি চালু হয়েছে। প্রতাপের নতুন আদালি রওনক আলি তার হাওড়া জেলার গ্রামের বাড়ি থেকে কিছু চাল এনে দেবার প্রস্তাব জানিয়েছিল, প্রতাপ রাজি হননি। বাইরের জেলাগুলি থেকে কলকাতায় চাল আনা বে-আইনি, প্রতাপ তেমন কাজে প্রশ্রয় দিতে পারেন না। যদিও রুটিতে তাঁর রুচি নেই, রুটি খেলে মন ভরে না।

তুতুল জানে তার মা একেবারেই রুটি খেতে পারেন না। রাত্তিরবেলা দুটো একটা রুটি দাঁতে কাটেন বাধ্য হয়ে, তাও জলে ভিজিয়ে নরম করে; দিনের বেলা রুটি খাওয়ার চেয়ে চিড়ে মুড়ি-সাবুও ভালো।

পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের উত্তেজনা শেষ হতে না হতেই খাদ্য-সমস্যা হিংস্র দাঁত আর রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়েছে সারা দেশের ওপর। এ বছর ফসল ভালো হয়নি। আগামী বছর খাদ্য সংকট আরও বাড়বে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বিরতি হলেও ভারতীয়দের ধারণা হয়েছে যে যুদ্ধে তারাই জিতেছে। জয়ের উন্মাদনায় চিৎকার করতে গিয়ে তারা দেখলো খালি পেটের জ্বালায় গলার জোর আসে না।

এই যুদ্ধে ব্রিটেন ও আমেরিকা পাকিস্তানের দিকে ঢলে ছিল বলে খবরের কাগজগুলিতে দিল্লির পার্লামেন্টে ঐ দুই দেশের প্রতি খুব উষ্ম প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এখন আবার সভয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে, আমেরিকা গম পাঠাবে তো? পি এল-৪৮০ প্রকল্প চালু রাখবে তো? সোভিয়েত ইউনিয়ান ভারতকে অস্ত্র ও বন্ধুত্ব দিয়ে সাহায্য করলেও নিরন্ন ভারতীয়দের খাদ্য দিয়ে সাহায্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। বিশ্বের বাজার থেকে তাদেরও গম কিনতে হয়।

প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী কলকাতার ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দিতে এসে সাম্প্রতিক দেশপ্রেমের উন্মাদনাকে কাজে লাগাবার জন্য বললেন, এখন প্রকৃত দেশপ্রেম হলো কম খাওয়া। প্রতি সোমবার দেশের সমস্ত মানুষের উপোস দেওয়া উচিত। অধিক খাদ্য ফলাতে হবে, সমস্ত পোড়ো, পতিত, অনাবাদী জমিতে ফসল ফলাতে হবে, এক ফসলী জমিকে দো ফসলী করতে হবে ইত্যাদি। এসব নিছক কথার কথা। দু’দশ বছরে এরকম উদ্যোগের ফল পাওয়া যায় না।

তুতুল জানে, তার মায়ের অ্যানিমিয়া আছে। তা ছাড়া লো প্রেসার। ইদানীং যখন তখন একটা তীব্র পেট ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েন সুপ্রীতি, অনেক পরীক্ষা টরিক্ষা করিয়েও সে ব্যথার কারণটা ঠিক ধরতে পারেনি তুতুল। গতকালই তাদের এক প্রোফেসর পেটের রোগ সম্পর্কে পড়াতে গিয়ে হঠাৎ তিক্ত ভাবে হেসে বলেছিলেন, আমি যে-সব বই দেখে তোমাদের পড়াচ্ছি, তোমরা যে-সব বই মুখস্ত করবে, তাতে কোথাও লেখা নেই যে মানুষ যখন অনিচ্ছায় অনাহারে ভোগে, খিদে আছে অথচ খাদ্য নেই, তখন তাদের কী কী রোগ হতে পারে! কোন ওষুধেই বা তাদের চিকিৎসা হবে। লালবাহাদুর তো বলে গেলেন সোমবার উপোস করতে, এদিকে গ্রামের বহু মানুষ সপ্তাহে দু’তিন দিনও পেট ভরে খেতে পায় না।

মাকে নিয়ে তুতুল চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সুপ্রীতির সেই মনের জোর, সেই তেজী ভাব একেবারেই যেন হারিয়ে গেছে, এখন সর্বক্ষণ যেন মনমরা হয়ে থাকেন। না খেলে মাকে বেশিদিন বাঁচানো যাবে না। শুধু পেট ভরাই তো বড় কথা নয়, খেতে ভালো লাগারও তো একটা প্রশ্ন আছে। সুপ্রীতি ভাত খেতে ভালোবাসেন, ফেনা ভাতের সঙ্গে একটু আলুসেদ্ধ কাঁচা লঙ্কা হলেই তিনি তৃপ্তি পান। সেই সামান্য ভাতটুকুও তাঁকে দেওয়া যাবে না। ই

কলেজের সহপাঠীদের কাছেই তুতুল জেনেছে যে র‍্যাশনের বাইরেও বাজারের মুদি দোকানে গোপনে চাল বিক্রি হয়। কিন্তু তুতুল জানে না যে সেইভাবে চাল কিনতে গেলে একটু মুখ চেনার দরকার হয়। সে বাজারের মধ্যে ঢুকে এক একটি দোকানে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, চাল আছে, আতপ চাল? দোকানদাররা অন্য খদ্দেরদের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তারপর মাথা নেড়ে বলে, চাল? আমরা চাল রাখি না। দু’একজন চেনা খদ্দের হাসে।

কয়েক দোকান ঘোরার পর একটি রোগা পাতলা ছেলে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, দিদি, কতটা চাল নেবেন? এ দিকটায় সরে আসুন। থলে এনেছেন?

তুতুল জিজ্ঞেস করলো, আতপ চাল আছে?

ছেলেটি মাথা নেড়ে বললো, আতপ চাল কোথায় পাবেন? গোটা বাজার খুঁজলেও এক দানা পাবেন না। সেদ্ধ চাল দিতে পারি।

হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে ছেলেটি বললো, তবে, কামিনীভোগ দিতে পারি, দাম অনেক বেশি পড়ে যাবে। সাড়ে দশ টাকা সের পড়ে যাবে।

তুতুল বললো, সেটাই নেবো।

যথেষ্ট বয়েস হয়েছে তুতুলের, তবু টাকা পয়সার হিসেবটা সে সদ্য বুঝতে শিখেছে। এতদিন সে বই পড়া ছাড়া আর কিছুই জানতো না। শুধু একটাই লক্ষ্য ছিল তার, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে। কলেজ যাওয়া আর কলেজে আসার বাইরে আর কোনো জীবন ছিল না তার। এই মাত্র মাস ছয়েক আগে তার জীবন বাঁক নিয়েছে অন্য একটা দিকে।

রোগা ছেলেটি তাকে নিয়ে এলো একটি কোণের দোকানে। বাইরে না দাঁড় করিয়ে নিয়ে এলো ভেতরে। একজনকে ডেকে ফিসফিস করে বললো, ও দিনুদা, এই দিদি অনেকক্ষণ ধরে ঘুরছেন, একে কিছু কামিনীভোগ দিতে হবে।

দিনু নামের সেই লোকটি জিভ কেটে বললো, এ হে, একটু আগে বললি না? আমার কাছে, যা এস্টক দিল, এ পাড়ার জজ সাহেব যে সবটাই নিয়ে চলে গেলেন।

তুতুল কুড়িটি টাকা এনেছে, সেই টাকা সে রেখেছিল অ্যানাটমি বইয়ের পাতার ভাঁজে, কাঁধের ঝোলা থেকে সে বইটা বার করলো।

রোগা ছেলেটি বললো, আর নেই? দিদিকে কথা দিয়ে নিয়ে এলুম, পরেশদার দোকানে আছে?

দিনু বললো, আজ আর কোনো দোকানে পাবি না। জজ সাহেব আরও চেয়েছিলেন, আমি নিজেই তো খুঁজে এলুম।

তুতুলের দিকে তাকিয়ে সে বললো, সেদ্ধ চাল নিন না, ভালো মাল আছে, গ্যারান্টি দিচ্ছি। কাঁকর হবে না…।

তুতুল কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো লোকটির মুখের দিকে। সেই মুহূর্তে সে একটা সিদ্ধান্ত নিল। জীবনে প্রথম সে বাজারে ঢুকে চাল কিনতে এসেছে, সে চাল না নিয়ে ফিরবে না।

সে দর দাম করতে জানে না, দশ টাকার নোট দুটি বাড়িয়ে দিয়ে সে বললো, তাই দিন!

মোটাসোটা চালের ঠোঙাটি সে তার বইয়ের ব্যাগে ভরে নিয়ে বেরিয়ে এলো। বাড়ি ফিরে সে কারুকে কিছু না বলে রান্না ঘরে গিয়ে চাল রাখবার টিনের ড্রামটির মধ্যে খালি করে দিল ঠোঙাটা। সে বেশ তৃপ্তি বোধ করলো, এই প্রথম সে এই সংসারের জন্য কিছু একটা কাজ করেছে। এবার থেকে সে প্রায়ই কিছু না কিছু করবে।

মুখ হাত ধুয়েই সে তাড়াতাড়ি চলে গেল পাড়ার লাইব্রেরিতে। সাড়ে সাতটার সময় লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যায়, এখনো এক ঘণ্টা সময় আছে। পিকলু বেঁচে থাকতে সে প্রচুর গল্প-উপন্যাস কবিতার বই পড়তো, পিকলুই এনে দিত সেইসব বই। মাঝখানে কয়েকটা বছর তুতুল পড়ার বই ছাড়া আর কিছুই পড়েনি। ইদানীং তার আবার রস সাহিত্য পাঠের তৃষ্ণাটা ফিরে এসেছে, সে নিজেই ভর্তি হয়েছে এই লাইব্রেরিতে।

রাত্তিরবেলা বিছানায় শুয়ে সে সুপ্রীতিকে বললো, মা, আজ একটা বই এনেছি, তুমি পড়বে?

সুপ্রীতি ক্লান্ত ভাবে বললেন, না, আমার বই পড়তে ইচ্ছে করছে না। তুই পড়বি তো পড়, আলো নেবাবার দরকার নেই।

তুতুল বললো, আমি তোমাকে পড়ে শোনাবো?

–কী বই রে, ওটা? আজই শুনতে হবে? আমার যে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। তুতুলের ওষ্ঠে দুষ্টুমীর হাসি ফুটে উঠলো।

সে মলাট দেওয়া বইটা খুলে বললো, এটার নাম ‘মনুসংহিতা’। খুব বিখ্যাত বই, তুমি পড়োনি নিশ্চয়ই আগে?

স্কুলে বেশি দূর না পড়লেও সুপ্রীতি বাংলা লেখাপড়া ভালোই করেছেন। মুনসংহিতার নাম জানেন তিনি। তাঁর প্রায় ডাক্তার হওয়া মেয়ে হঠাৎ মনুসংহিতা পড়ছে দেখে তিনি ক্লান্ত শরীরেও খানিকটা সচকিত হয়ে উঠলেন।

তুতুল বললো, আমাদের হিন্দু সমাজ এই বইটির নির্দেশে চলার কথা। তাই সবটা পড়ে দেখলাম। আমাদের একজন স্যার বলেছেন, মানুষের চিকিৎসা করতে গেলে সমাজ ব্যবস্থাটাও জানা দরকার। এর পর মুসলমানদের হাদিস পড়বো। এই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে আছে ভক্ষ্যাভক্ষ বিচার; শৌচ ও অশৌচ বিধি। অর্থাৎ হিন্দুরা কী খাবে না খাবে, তাও এতে বলে দিয়েছে। বিধবাদের কী খাওয়া উচিত না উচিত সেটা খুঁজে দেখলাম। এতে আলো চাল, সেদ্ধ চালের কোনো উল্লেখ নেই। তখন বোধহয় দু’রকম চাল ছিল না। মেয়েদের সম্পর্কে বা বিধবাদের সম্পর্কে কী লিখেছে জানো মা? তারা যেন সব সময় স্বামীর আরাধনা করে, পর। পুরুষের চিন্তা না করে। সৎ থাকার পবিত্র থাকার এই একটাই মাত্র ক্রাইটেরিয়ান। একটা শ্লোকে লিখেচে।

কামন্তু ক্ষপয়েদ্দেহং পুষ্প মূল ফলে শুভৈঃ
নতু নামাপি গৃহীয়াৎ প্রত্যৌ প্রেতে পরস্য তু ৷৷

অতি কষ্টে থেমে থেমে সংস্কৃতটা উচ্চারণ করে তারপর তুতুল বললো, এর তলায় বাংলা মানেও লিখে দিয়েছে : “পতির মৃত্যু হলে স্ত্রী বরং পবিত্র পুষ্প, ফল ও মূল দ্বারা অল্পাহারে দেহ ক্ষয় করবেন, তবু পরপুরুষের নামোচ্চারণ করবেন না।” তার মানে মা, বুঝলে, এই মনু নামের লোকটা বিধবাদের অল্প খাইয়ে মেরে ফেলার কথা বলছেন, যাতে বিধবারা অন্য পুরুষের নামও উচ্চারণ না করে। কী নিষ্ঠুর! সে যাই হোক, ফুল, ফল আর মূল খেতে বলেছে, মাছ-মাংস নিষেধ। ফুল-ফলের মধ্যে চাল-ডাল-গম এই সবই পড়ে। মুসুর ডাল খাওয়া বারণ তা কোথাও লেখা নেই। ঠিক তো?

সুপ্রীতি ফ্যাকাসে ভাবে হেসে বললেন, তুই এসব আমাকে বোঝাচ্ছিস কেন?

তুতুল বললো, তার কারণ, তুমি কাল থেকে সেদ্ধ চালের ভাত খাবে। শাস্ত্রে বারণ নেই! সুপ্রীতি আস্তে বলে উঠলেন, না, না, না, এতদিন খাইনি, হঠাৎ এখন সেদ্ধ চাল খেতে যাবো। কেন?

–যখন দু রকম চাল পাওয়া যেত, তখন না হয়…

–আমার সাবু খেতে কোনো অসুবিধে হয় না।

–যদি আতপ চাল আরও এক মাস দু’মাস না পাওয়া যায়?

–তাতেও কিছু হবে না। তুই এ নিয়ে ভাবিস না, তুতুল!

–মনুসংহিতার এই মনু যাই বলুন না কেন, আমার মা বিধবা বলেই তাড়াতাড়ি মরে যাবেন, তা আমি কিছুতেই সহ্য করবো না। শোনেনা মা, কাল আমার ছুটি। কাল আমি সেদ্ধ চাল আর মুসুরির ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করবো। তুমি যদি না খাও, আমিও তা হলে খাবো না। তুমি দুপুরবেলা যতদিন ভাত না খাবে, ততদিন আমিও কিছুতেই ভাত খাবো না!

–তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি?

–এটা কি পাগলের মতন কথা! বরং, তোমার এই মনু ভদ্দরলোকই পাগল ছিলেন। আর একটা শ্লোকে কী লিখেছেন জানো? সংস্কৃতটা আমি আর পড়ছি না, বাংলা মানেটা হলো এই যে, “পতি সদাচার শূন্য, পরদার রত বা গুণহীন হলেও স্বাধ্বী স্ত্রী স্বামীকে দেবতার মত পূজা করবেন।”

-–থাক, তুতুল, যাক, ওসব কথা থাক।

–আমি মামাকে কাল জিজ্ঞেস করবো, তিনি এসব মানেন কিনা! আমার তো মনে হচ্ছে এই মনুসংহিতা নামের বইটি ব্যান করা উচিত। এতদিন লোকেরা এই বই সহ্য করেছে কী। করে? একটা অপদার্থ, দুশ্চরিত্র, বদমাস লোকও যদি স্বামী হয়, তবু তার স্ত্রী তাকে দেবতার মতন পূজো করবে।

–এখন সময় বদলে গেছে। এখন কি আর লোকে ওসব মানে?

–এই সব বই পড়বারও কোনো মানে নেই। এই বইয়ের একটা কথাও ভালো নয়। তুতুল বইটি খাটের তলায় ফেলে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, মা, তুমি কেন দিন দিন এত রোগা হয়ে যাচ্ছো? কেন আর আগের মতন হাসো না?

সুপ্রীতির চোখে জল এসে গেল আনন্দে। তার নিজের জন্য নয়, তুতুলের যে হঠাৎ এই পরিবর্তন হয়েছে, তা তিনি যেন এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। এই মেয়েটাই তো পিকলুর কথা ভেবে ভেবে দিন দিন শালিকের মতন রোগা হয়ে যাচ্ছিল, কোনো সাধ আহ্লাদ ছিল না, ওর চিকিৎসার জন্য প্রতাপ কত চেষ্টা করেছেন…সেই তুতুল হাসছে, জোর দিয়ে কথা বলছে!

খুব গোপনে একটা নিষিদ্ধ কথা বলার মতন তুতুল মায়ের কানে কানে বললো, মা, আজ আমি বাজারে গিয়েছিলাম চাল কিনতে।

সুপ্রীতি শোওয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। শুধু চোখ নয়, নিজের কানকেও এবার তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না। চোখ বড় বড় করে তিনি বললেন, তুই বাজারে গিয়েছিলি।

তুতুল বললো, হ্যাঁ। বাজারে বেশি দামে চাল বিক্রি হয়। কিন্তু সেখানেও আতপ চাল নেই। যেটুকু ছিল এক জজ সাহেব কিনে নিয়ে গেছেন। তোমার মতন অনেক বিধবাই নিশ্চয়ই আতপ চাল খায় শুধু। গভর্নমেন্ট তাদের কথা চিন্তা করছে না। গভর্নমেন্টের উচিত ছিল সব কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো যে এখন থেকে সব বিধবারাই আতপের বদলে সেদ্ধ চাল খেতে পারবে। তাতে কোনো দোষ নেই!

সুপ্রীতি বললেন, অনেকে তো ভাতের বদলে রুটি খেয়ে দিব্যি থাকতে পারে।

–তোমার মতন বাঙালরা যে ভাত না খেয়ে থাকতে পারে না। তারা বুঝি আতপ চালের অভাবে না খেয়ে মরে যাবে? আমার মাকে আমি কিছুতেই মরতে দেবো না!

সুপ্রীতির বুকের মধ্যে কূল কূল করে একটা সুখের ঝরনা বয়ে যেতে লাগলো। তুতুল ঘুমিয়ে পড়লেও অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর ঘুম এলো না। অঘ্রাণ মাস, একটু শিরশিরে ঠাণ্ডা পড়েছে। এক সময় উঠে সুপ্রীতি শিয়রের কাছের জানলাটা বন্ধ করে দিলেন। তুতুল শুয়ে আছে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে। একই খাটে মা আর মেয়ে। আর কিছুদিন বাদেই মেয়ে ডাক্তার হবে, তার জন্য একটা আলাদা ঘর চাই।

তিনি একটা পাতলা চাঁদর বিছিয়ে দিলেন তুতুলের গায়ে।

পরদিন সকালে তুতুল অতীনকে ধরে বললো, এই বাবলু, তুই আমাকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটা বড় ছবি জোগাড় করে দিতে পারবি?

অতীন বললো, সে ছবি আমি কোথায় পাবো?

–তুই তো অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করিস, একটু খোঁজ নিতে পারবি না? তোকে আমি পয়সা দিয়ে দেবো?

–হঠাৎ বিদ্যাসাগরের ছবি দিয়ে কী হবে?

–আমার ঘরে টাঙাবো। তোর মনে আছে, ইডেন গার্ডেনে আমরা একবার একটা খুব বড় মেলা দেখতে গিয়েছিলাম? সেখানে পিকলুদা বলেছিল, বাঙালি মেয়েদের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কত উপকার করেছিলেন অথচ মেয়েরা রামকৃষ্ণের ছবি ঘরে টাঙিয়ে পুজো করে। সত্যিই তো, বিদ্যাসাগরের জন্যই তো আমরা স্কুল কলেজে যেতে পারছি। কাল মনুসংহিতা পড়তে গিয়ে পিকলুদার ঐ কথাটা আবার মনে পড়ে গেল!

তুতুল সকালবেলা হঠাৎ বিদ্যাসাগরের ছবির কথা তোলায় অতীন যত না অবাক হয়েছে তার চেয়েও বেশি চমকে গেল তুতুলের মুখে পিকলুর নাম শুনে। দাদার মৃত্যুর পর সে একদিনও ফুলদির মুখে দাদার উল্লেখ মাত্র শোনেনি। এমন কি তুতুল কাছাকাছি থাকলে অন্যরা পিকলুর কথা আলোচনা করতে করতেও থেমে যায়। ফুলদির মুখ চোখও আজ অন্যরকম।

আচ্ছা দেখবো ছবি পাওয়া যায় কি না, এই বলে অতীন বেরিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, তুতুল আবার তাকে জিজ্ঞেস করলো, এই, আজ তো ইউনিভারসিটি বন্ধ, তুই কোথায় যাচ্ছিস?

ইউনিভারসিটি বন্ধ থাকলেই যে বাড়ি বসে থাকতে হবে, এ তো বড় অদ্ভুত কথা। অতীন হেসে বললো, যাচ্ছি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে।

–কখন ফিরবি? শোন, আমি আজ খিচুড়ি রাধবো। তুই তাড়াতাড়ি ফিরবি কিন্তু, সবাই বসে খাবো একসঙ্গে। শোন বাবলু, তুই কয়েকটা ডিম এনে দিতে পারবি? মামা ডিম ভাজা খেতে ভালোবাসেন।

অতীন বললো, আমার যে আজ এক বন্ধুর বাড়িতে খাওয়ার কথা! আমি ডিম এনে দিয়ে যাচ্ছি তোমাকে!

অতীনের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তুতুল বললো, ও, তুই আজ খেতে আসবি না?

সঙ্গে সঙ্গে মত বদল করে অতীন বললো, ঠিক আছে, আমি ফিরে আসবো। একটা দেড়টার মধ্যে। বাবা তো দেড়টার আগে খায় না।

খাওয়ার টেবিলে নয়, বারান্দায় সতরঞ্চি ভাঁজ করে লম্বা আসন পাতা হয়েছে, যেন নেমন্তন্ন বাড়ি। তুতুল জোর করে তার মা, মাসিমা, মুন্নিকে বসিয়েছে, এমনকি অতীনও এসে গেছে। প্রতাপ লেখাপড়ার কাজ করছিলেন, দু’তিনবার ডাকাডাকির পর এসে বললেন, হ্যাঁ, শুনলাম তুতুল আজ সবাইকে খাওয়াচ্ছে। কী ব্যাপার রে, তুতুল? তোর রেজাল্ট বেরিয়ে গেল নাকি?

অনেকক্ষণ রান্নাঘরে কাটিয়েছে বলে তুতুলের মুখোনি লালচে এবং ঘামে চকচকে। চূর্ণ চুল পড়েছে কপালে। সে মুখ তুলে বললো, সে সব কিছু নয়, আজ আমি প্রথম খিচুড়ি বেঁধেছি।

প্রতাপ সকৌতুকে বললেন, ওরে বাবা, প্রথম দিনই আমার ওপর এক্সপেরিমেন্ট করবি? আগে তোর মা মামীদের ওপর পরীক্ষা করলে পারতি।

হাঁটু মুড়ে বসে প্রতাপ অতি গরম খিচুরি, চামচে করে তুলে একটু মুখে দিলেন। তারপর আরও দু’চামচ। মুখের ভাব বদলে গেল, তিনি বললেন, নারে, খারাপ হয়নি তো, ভালোই তো হয়েছে, ঝাল একটু কম। একটা কাঁচা লঙ্কা এনে দে।

অন্যদের দিকে তাকালেন প্রতাপ। অনেকদিন এরকম এক সঙ্গে খেতে বসা হয়নি। মমতাও খেতে শুরু করেছেন, সুপ্রীতি এখনও হাত দেননি। মমতা বললেন, খারাপ হয়নি, কী বলছো? বেশ ভালো হয়েছে। খিচুড়িতে ঠিক স্বাদটা আনা সহজ নয়।

প্রতাপ বললেন, সত্যি ভালো হয়েছে, দিদি খেয়ে দ্যাখো। তোমার মেয়ের হাতের গুণ আছে।

সুপ্রীতি হেসে বললেন, পাগল মেয়ের যা কাণ্ড। এর মধ্যে পেঁয়াজ রয়েছে, এ খিচুড়ি কি আমি খেতে পারি?

প্রতাপ বললেন, হ্যাঁ, তাই তো পেঁয়াজ দিয়ে ফেলেছে। তুমি খাবে কী করে? তুতুল বললো, মনুসংহিতায় কায়স্থবাড়ির বিধবাদের পেঁয়াজ খাওয়া নিয়ে কোনো নিষেধ তো নেই। ফল-মূল খেতে বলেছে, পেঁয়াজ তো একটা মূল, আলুরই মতন।

প্রতাপ চোখ গোল গোল করে হেসে উঠে বললেন, ওরে বাবা, একেবারে মনুসংহতা! তুই পড়েছিস বুঝি?

তুতুল মাথা নেড়ে সপ্রতিভ ভাবে বললো হ্যাঁ, কালই পড়েছি!

প্রতাপ বললেন, তাহলে দিদি খেয়ে নাও! তোমার মেয়ে যখন মনুসংহিতা পড়ে বিধান দিয়েছে।

সুপ্রীতি বললেন, তা হলেই বা। প্রায় দশ বছর হয়ে গেল পেঁয়াজ খাইনি, এখন আমি পেঁয়াজের গন্ধই সইতে পারি না!

প্রতাপ বললেন, এঃ হে, আমরা খাবো, তুমি খাবে না? তুই এ কী করলি রে, তুতুল? তোর। মা কী খাবে?

সবাই খাওয়া থামিয়ে অপরাধীর মতন চেয়ে রইলো সুপ্রীতির দিকে। এমনকি অতীনেরও মনে হলো, পেঁয়াজ দেওয়া খিচুরি একজন বিধবাকে খাওয়ানো সত্যিই সম্ভব নয়। এটা বাড়াবাড়ি!

তুতুল হেসে জিজ্ঞেস করলো, পেঁয়াজ খাওয়া দোষের কেন, সেটা আগে বলো? ভারতের অনেক জায়গায় যারা নিরামিষ খায়, তারাও পেঁয়াজ খায়!

মমতা বললেন, দোষগুণের কথা হচ্ছে না! তোর মা যে গন্ধটাই সহ্য করতে পারবে না! অভ্যেস চলে গেছে।

প্রতাপ বললেন, দিদি একটু মুখে দিয়েই দেখো না!

সুপ্রীতি বললেন, নারে, পারবো না! তোরা খা, দেখতেই আমার ভালো লাগছে!

তুতুল বললো, আমি পেঁয়াজ ছাড়া খানিকটা আলাদা করে রেখেছি।

প্রতাপ বললেন,বাঃ বাঃ, মেয়ের বুদ্ধি আছে। দিদি, এতক্ষণ ও তোমায় পরীক্ষা করছিল!

সুপ্রীতির খিচুড়ি বদলে দিল তুতুল। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, খাও, মুখে দিয়ে দ্যাখো আগে।

সুপ্রীতি এক গ্রাস মুখে তুলতেই তুতুল সগর্বে বললো, মামা, এই খিচুড়ি আলো চাল নয়, সেদ্ধ চাল দিয়ে বেঁধেছি!

মমতা আর তুতুল মুখ চাওয়া চাওয়ি করে হাসলো। সেদ্ধ চালের ব্যাপারটা মমতা আগেই শুনেছেন সুপ্রীতির কাছে। মমতাও নিজেও কতবার অনুরোধ করেছেন সুপ্রীতিকে।

আলো চাল সেদ্ধ চালের তফাৎটা প্রতাপ ঠিক বুঝতে পারলেন না। তিনি কোনো মন্তব্য করলেন না। তুতুল তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলো,একটা নিঃশব্দ বিপ্লব হয়ে গেল। এর পর সে মাকে মাছ-মাংসও খাওয়াবে, তাঁর চিকিৎসার জন্য দরকার। রান্না মাছ মাংস যদি খাওয়ানো না যায়, তা হলে শার্ক লিভার অয়েল, প্রোটিনেক্স অন্তত…।

খাওয়ার মাঝখানে সদর দরজায় করাঘাত হলো। এই অসময়ে কে আসবে? বাড়িওয়ালার এক জামাই ও ছোট ছেলে ইদানীং প্রায়ই এসে উৎপাত করছে, তাদের কেউ? প্রতাপের মুখ ক্রোধে রক্তিম হয়ে উঠলো।

মুন্নি এঁটো হাতে দরজা খুলে দিয়ে এসে বললো, ফুলদি, তোমাকে একজন ডাকতে এসেছে, নাম বললো, জয়দীপ।

তুতুলের মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল। অন্য সকলেও অবাক। তুতুলকে তো কেউ কখনো ডাকতে আসে না, তার সহপাঠীরাও কেউ আসে নি একদিনও।

বসবার ঘরের গায়ে লাগা এই বারান্দা, ও ঘর থেকে সব দেখা যায়। এই রকম খাওয়ার দৃশ্য বাইরের একজন মানুষ দেখে ফেলবে, এই ভেবে সুপ্রীতি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেন। যেন বাইরের কেউ এক পলক দেখেই বুঝে ফেলবে, তিনি সেদ্ধ চালের খিচুড়ি খাচ্ছেন। মুন্নি মাঝখানের দরজাটাও বন্ধ করে নি।

সেই দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো একটি যুবক। প্রায় ছ’ ফুট লম্বা, চওড়া কাঁধ, চোখ-মুখে স্বাস্থ্যের দীপ্তি। প্যান্টের ওপর হলুদ রঙের টি শার্ট পরা।

তুতুল বিব্রত ভাবে প্রতাপকে বললো, বড়মামা, এ আমাদের সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজে পড়ে, এর নাম জয়দীপ।

জয়দীপ অনাড়ষ্ট গলায় বললো, এ কী, খিচুড়ি খাওয়া হচ্ছে? বাঃ বাঃ, আমি একটু ভাগ পাবো না? খিচুড়ি আমার দারুণ ফেভারিট।

প্রতাপ বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসো। এই, ওকে একটা থালা দে!

সতরঞ্চিতে আর জায়গা নেই, জয়দীপ বসে পড়লো মাটিতেই। যেন সে এই বাড়িতে বহুবার এসেছে! সে বললো, খিচুড়ির সঙ্গে আর কী আছে, ডিম ভাজা? ফার্স্টক্লাস!

সুপ্রীতি সরাসরি না তাকিয়ে গোপনে দেখতে লাগলেন ছেলেটিকে। এর কথা তুতুল তাঁকে কোনোদিন বলে নি। অথচ দেখে মনে হচ্ছে, এই ছেলেটি তুতুলের খুবই বন্ধু। তা হলে এর জন্যেই তুতুলের ব্যবহারে হঠাৎ একটা পরিবর্তন এসেছে। আবার সে স্বাভাবিক হয়েছে! সুপ্রীতি তৎক্ষণাৎ খুব পছন্দ করে ফেললেন জয়দীপকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *