দুপুর থেকে রাত নটা পর্যন্ত কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস যাদের ঘরবাড়ি, তারা আজ সন্ধেবেলাতেই স্থানচ্যুত। তারা বেশ ক্ষুব্ধ, এখন তারা কোথায় যাবে? এই কফি হাউসের বেশ কয়েকটা টেবিল জুড়ে বসে নবীন কবি ও গল্পকারদের দল, লিটল ম্যাগাজিনের উদ্ধত, রাগী লেখকবৃন্দ, এরা কলেজ জীবন শেষ করেছে, অনেকেই কোনো চাকরি-বাকরি পায়নি, বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই তাদের। সাতজনের টেবিলে তিন কাপ কফির অর্ডার দিয়ে ভাগ করে নিয়ে সময় কাটায় দু’ ঘণ্টা, তারপর বেয়ারা এসে গজ গজ করলে আরও দু’ কাপের অডার দেয়। একজন সিগারেট ধরিয়ে অর্ধেকটা টানতে টানতেই হাত বাড়িয়ে দেয় আর একজন, আরও একজন বলে, লাস্ট সুখটানটা দিস! এদের দু’একজন টিউশানি করে কিছু টাকা রোজগার করে, যেদিন টিউশানির মাইনে পেয়ে কফি হাউসে আসে, সেদিন বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে চোখে চোখে কথা হয়ে যায়, বড় দলটার মধ্যে তৈরি হয়ে যায় একটা ছোট দল, কফি হাউস ছেড়ে তারা চলে যায় খালাসিটোলায় দেশি মদের আড্ডায়। সেসব দিনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে পেরিয়ে যায় মধ্যরাত।
ব্ল্যাক আউট শুরু হয়েছে, সন্ধেবেলা সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। মিশমিশে অন্ধকার রাস্তাঘাটের কলকাতাকে সম্পূর্ণ অচেনা মনে হয়। রাতের কলকাতার প্রধান অলঙ্কারই তো আলো। বম্বে-দিল্লির থেকেও কলকাতায় আলো বেশি, এই শহর অনেক রাত পর্যন্ত জাগ্রত থাকে। বিজ্ঞাপনের রঙীন বাতিগুলি জ্বলে সারা রাত। সেই কলকাতা সন্ধেবেলাতেই ডুবে আছে নিথর অন্ধকারে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ব্ল্যাক আউটের স্মৃতি এই প্রজন্মের অনেকেরই নেই। যে সব তরুণেরা এই শহরটিকে পাগলের মতন ভালোবাসে, তাদের এই অন্ধকার সহ্য হচ্ছে না।
কফি হাউস থেকে বেরিয়ে অবিনাশ, পরীক্ষিৎ, হেমন্ত, বরুণ, সুবিমলরা এসে দাঁড়ালো প্রেসিডেন্সি কলেজের উল্টোদিকে। সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে, আর কোথাও যাবার জায়গা নেই বলেই এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। একটা অর্থহীন যুদ্ধ এবং অনভিপ্রেত অন্ধকারের প্রতি ওরা প্রতিবাদ জানাতে চায়।
মানিকদার স্টাডি সার্কলের সদস্য তপনও ইদানীং এই নব্য সাহিত্যিকের দলে ভিড়েছে। তপন কবিতা লেখে। স্টাডি সার্কলে সে একদিন তার কবিতা পড়ে শুনিয়ে খুব লজ্জা পেয়েছিল। সুকান্ত ভট্টাচার্যর বন্ধু মানিকদা শুধু বিস্মিত নয়, রীতিমত আহত হয়েছিলেন সেই সব কবিতা শুনে। গরিবের ছেলে তপন, রিফিউজি কলোনিতে জ্যাঠামশাইয়ের সংসারে থাকে, তবু সে লিখলো প্যানপেনে প্রেমের কবিতা? দেশের যা অবস্থা, এই কি প্রেমের কবিতা লেখার সময়? অন্য কয়েকজন সদস্যও বিদ্রূপ করেছিল তপনকে।
মানিকদার স্টাডি সার্কল সে ছাড়েনি, কিন্তু কফি হাউসের এই আড্ডাটাতেও তার নেশা ধরে গেছে। দেশ, সমাজ, মা বাবা, কবিতা, মদ, নারী ইত্যাদি বিষয়ে এরা এমন তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলে যে তপন চমকে চমকে ওঠে। এরা পূর্বনির্ধারিত কোনো নীতির পরোয়া করে না, সব কিছু নিজেরা যাচাই করে নিতে চায়। এরা ধর্ম, দেশপ্রেম, কংগ্রেস গভর্নমেন্ট, আমেরিকান পালিসিকে অবজ্ঞা করে, আবার চীন-রাশিয়া বা মার্কসবাদকেও অমোঘ, অকাট্য বলে মানে না। তপনের কাছে এসব নতুন অভিজ্ঞতা।
অবিনাশ বললো, চল, কলেজ স্কোয়ারে গিয়ে বসি।
আজ সন্ধেবেলা পাওয়া যাবে কি যাবে না এই ঝুঁকি না নিয়ে দুপুরবেলাতেই কয়েক বোতল বীয়ার খেয়ে এসেছে হেমন্ত। তার মেজাজ বেশ ফুরফুরে। সে বললো, কেউ আমার একটা হাত ধরো ভাই, আমি বোমা খেয়ে মরতে রাজি আছি, কিন্তু অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পা ভাঙতে রাজি নই। শালারা রাস্তাগুলো যা করে রেখেছে না।
অবিনাশ বললো, এ বছর আর রাস্তা সারাবে না। যুদ্ধের জন্য বর্ডারের দিকে নাকি নতুন নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে, শহরের রাস্তা সারাবার টাকা নেই।
হেমন্ত বললো, আরে বর্ডারের রাস্তা তো বানাবে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট। শহরের রাস্তা সারাবে করপোরেশন। যুদ্ধের সঙ্গে করপোরেশনের কী সম্পর্ক।
সুবিমল অবজ্ঞার সুরে বললো, সব কিছুর সঙ্গেই সব কিছুর সম্পর্ক থাকে।
হেমন্ত তার কাঁধে এক চাপড় মেরে বললো, তার মানে। এটা তুই কী বললি? সব কিছুর সঙ্গে সব কিছুর সম্পর্ক থাকে, এর মানে কী?
সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বর বদলে সুবিমল বললো, ও, কোনো মানে নেই বুঝি? তা হলে ভুল বলেছি।
পরীক্ষিৎ বললো, না, সুবিমল, তুই ভুল বলিসনি। সব কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক তো থাকেই। যেমন তেলের সঙ্গে জলের একটা সম্পর্ক আছে।
অবিনাশ বললো, আগুনের সঙ্গে খিদের যেমন একটা সম্পর্ক আছে।
মাঝে মাঝে গাড়ির হেড লাইটের আলো পড়ছে ওদের গায়ে। যানবাহন পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, হেডলাইটে কালো রঙ করাও হয়নি। সেই আলোতে ওরা দেখলো রাস্তার উল্টোদিকের ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে আছে অদিতি। একা।
অবিনাশ নিজের বুকে চাপড় মেরে বিরাট দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
অদিতি আর গায়ত্রী, এই দু’জন এ বছর কফি হাউসের বিশ্ব সুন্দরী। গায়ত্রী ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী, আর অদিতি কেমিস্ট্রিতে রিসার্চ করে। গায়ত্রী ফসা, মুখের গড়ন অতি ধারালো, সে ভালো ডিবেট করে। অদিতির গায়ের রং মাজা মাজা, বেশ লম্বা এবং গম্ভীর। গায়ত্রী এবং অদিতির মধ্যে কে বেশী সুন্দর তা নিয়ে কফি হাউসে মতভেদ এবং স্পষ্ট দুটি দল আছে। কিন্তু গায়ত্রী বা অদিতি কেউই এই কবি-লেখকদের পাত্তা দেয় না, ওদের দু’জনের আলাদা, নির্দিষ্ট টেবিল ও নির্দিষ্ট বন্ধু আছে। এরা আলাপ করতে গিয়েও পাত্তা পায়নি। এই লেখকদের দলটি নারী-বর্জিত, আধো-চেনা এক-আধজন বন্ধুর স্ত্রী বা কারুর মামাতো-মাসতুতো বোন কচিৎ কখনো আসে, সাহিত্য যশোপ্রার্থিনী দু’একটি মেয়ে কখনো কখনো ওদের টেবিলে বসে, কিন্তু বিকেল শেষ হতে না হতেই চঞ্চল হয়ে ওঠে, সন্ধের পর তাদের বাইরে থাকার অনুমতি নেই। অবিনাশের মতে, যে সব গুঁড়ি-গুডি টাইপ মেয়ে বিকেলবেলা বাড়ি ফিরে যায়, তারা কবিতা-গল্প লিখতে পারবে না কোনোদিন।
হেডলাইটের আলোয় অদিতিকে দেখাচ্ছে রাজেন্দ্রণীর মতন। এই সব নারী কবিদের প্রেরণা হতে পারে, কিন্তু এরা কবিতা পড়ে না, কবিদের গ্রাহ্য করে না।
অবিনাশ বললো, ও অন্ধকারের মধ্যে একা একা কী করে বাড়ি ফিরবে? ওর সেই পাইলট বন্ধুটা আজ আসেনি।
হেমন্ত বললো, তুই ওকে বাড়ি পৌঁছে দিবি নাকি? দ্যাখ না চেষ্টা করে।
অবিনাশ বললো, আমার ইচ্ছে করছে ওর সঙ্গে এক ট্রামে চেপে খানিকটা চলে যাই।
–যা না।
–ও যদি রাগ রাগ চোখে আমার দিকে তাকায়, তা হলে যে খুব খারাপ লাগবে। ঐ মুখখানাতে বিরক্তি মানায় না।
সুবিমল বললো, অদিতি যদি আজ আমাদের সঙ্গে খানিকক্ষণ বসতো পার্কে, তারপর আমরা সবাই মিলে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারতুম।
হেমন্ত বললো, প্রস্তাবটা দিয়ে দেখবি নাকি?
আর একবার আলো পড়লো অদিতির মুখে। যেন একটা অন্ধকার মঞ্চে সে একলা দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে কোনো চাঞ্চল্য নেই, বাড়ি ফেরার জন্য কোনো দেহরক্ষীর প্রয়োজন নেই তার। এই মেয়ে কেন কবিতা লেখে না, কেন কবিতা ভালোবাসে না? কেমিস্ট্রিতে কী রস পায়?
অবিনাশরা কেউই দ্বিধা কাটিয়ে রাস্তা পার হয়ে অদিতির কাছে গেল না। একটা ট্রাম এলো, অদিতি উঠে পড়লো।
অবিনাশ আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, অদিতি যদি আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ বসতো, তাহলে পৃথিবীর একটা উপকার হতো। হয়তো আজ রাত্তিরে আমি একটা ক্লাসিক স্ট্যাণ্ডার্ডের কবিতা লিখে ফেলতুম।.
সুবিমল বললো, ভাগ্যিস পাকিস্তান যুদ্ধটা বাধিয়েছিল, তাই অন্ধকারের মধ্যে অদিতিকে দেখা গেল খানিকক্ষণ। অন্ধকারের ব্যাকগ্রাউণ্ডে সত্যি ওকে কী রকম মানিয়েছিল বল তো!
অবিনাশ বললো, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, …
হেমন্ত বললো, পাকিস্তানী বোমারুগুলো অকর্মার ধাড়ী। এত দেরি করছে কেন? এর মধ্যে দু চারটে বোমা ফেলে গেলেই তো পারতো। মনে কর, ঠিক পাঁচ মিনিট আগে যদি এখানে একটা বোমা পড়তো, কী ফার্স্টক্লাস হতো। সবাই ছোটাছুটি করছে, সেই সময় আমি অদিতির হাত ধরে বলতুম, কোনো ভয় নেই, আমি তোমাকে শেলটারে নিয়ে যাচ্ছি।
অবিনাশ বললো, মাইরি আর কি, তোকে চান্স দিতুম আর কি। সুবিমল বললো, রোজই শুনছি পাকিস্তানী প্লেন আসবে আসবে, এ আর ভালো লাগছে না। এলেই তো পারে। কলকাতার ওপর গোটা কতক বোমা ফেলে যাক না।
হেমন্ত বললো, কলকাতার এখন কিছু বোমা খাওয়া দরকার হয়ে পড়েছে। কিছু ভাঙচুর হলে শহরটা নতুনভাবে তৈরি হবে।
সুবিমল বললো, কোথায় কোথায় বোমা পড়া উচিত বল তো?
-ডেফিনিটলি বড়বাজারে। ওখানে অন্তত ডজনখানেক বেশ বড় সাইজের বোমা ফেলে মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীদের ঘুঘুর বাসা ভেঙে দেওয়া দরকার। আর রাইটার্স বিল্ডিং-ডালহাউসিতেও ডজনখানেক। আর গোটাকতক চিৎপুরে।
–চিৎপুরের ওপর আবার তোর এত রাগ হলো কেন? সাউথ ক্যালকাটাটা বুঝি বেঁচে যাবে!
এত অন্ধকারেও কলেজ স্কোয়ার সম্পূর্ণ নির্জন নয়। ফুচকা আলুকাবলিওয়ালারাও তাদের ব্যবসা বন্ধ করেনি। আকাশে ঝাঁক ঝাঁক মেঘ। তার আড়ালে একটা বড় আকারের চাঁদ দেখা যাচ্ছে দু একবার, কিন্তু মেঘের জন্য জ্যোৎস্না ফোটেনি। ওরা বসে পড়লো এক কোণে, ঘাসের ওপর। একজন কেউ বললো, একটা চাওয়ালা কাছাকাছি আছে কি না দ্যাখ না।
পরীক্ষিৎ বললো, দেখি একটা পাঁইট–ফাঁইট জোগাড় করা যায় কি না।
তপন আগাগোড়া চুপ করে আছে। ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের মতন এতবড় একটা ব্যাপার নিয়ে অবিনাশ হেমন্তরা ঠাট্টা তামাশা করে যাচ্ছে আগাগোড়া, এতেই সে হতবাক। ওপার বাংলার স্মৃতি তার এখনো টাটকা। সে যেন কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে, তাদের গ্রামের রাস্তাতেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধটা কি ভারত-পাকিস্তানের, না শেষ পর্যন্ত আবার হিন্দু-মুসলমানের?
সে চুপি চুপি হেমন্তকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি এই যুদ্ধের ওপর কোনো কবিতা লিখেছেন?
অন্যরাও তার প্রশ্ন শুনে চমকে উঠেছে, তারা হেসে উঠলো হা-হা করে। হেমন্ত হুংকার দিয়ে বললো, কী? এই বোকা…, হারামী, গাণ্ডুর বাচ্চাদের যুদ্ধ নিয়ে কবিতা? এই খোঁচাখুঁচিতে আপনার আমার কী যায় আসে মশাই? কাশ্মীর নিয়ে দিল্লি করাচী লড়ালড়ি করছে, তার জন্য আমরা কেন সাফার করবো? কাশ্মীরটা ওদের দিয়ে দেওয়া হবে নাই বা কেন? মোছলমানদের দেশ, মোছলমানরা পাবে। সোজা কথা। কাশ্মীর যদি না-ই দিতে চাস, তা হলে শুয়ারের বাচ্চারা ফটি সেভেনে পার্টিশান করতে রাজি হলি কেন?
সুবিমল বললো, পাখতুন নেতা সীমান্ত গান্ধী আবদুল গফফার খান কাল কী স্টেটমেন্ট দিয়েছেন দেখেছিস? পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাবটাই মেনে নেওয়া উচিত হয়নি, ভারতকে এখন সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।
অবিনাশ লম্বা পা ছড়িয়ে আধো কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বললো, ওসব পুরোনো কথা ছাড়। পাকিস্তান যখন হয়েই গেছে, আঠেরো বছর বয়েস এখন দেশটার, পাকিস্তান এখন একটা রিয়েলিটি, তাকে তার যা প্রাপ্য তা তো দিতেই হবে। কাশ্মীরে গণভোট করলে দেখা যাবে, ওরা সবাই পাকিস্তানে যেতে চায়।
সুবিমল বললো, তবু যাই বলিস, আমি কাশ্মীর ছাড়ার পক্ষপাতী নই। এমন সুন্দর একটা জায়গা পাকিস্তান চাইলেই দিতে হবে, এ কী মামাবাড়ির আবদার।
তপন বলে উঠলো, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে পূর্ব পাকিস্তানকে সব দিক থেকে বঞ্চিত করছে? আমি নিজে দেখেছি।
অবিনাশ বললো, আপনি মশাই নিজেকে এখনো ইস্ট পাকিস্তানী মনে করেন তাই না? ওখানে শুনেছি এখন উর্দু মিশিয়ে বাংলা লেখা হচ্ছে। সংস্কৃত তৎসম শব্দগুলো সব খুঁটে খুঁটে বাদ দিয়ে সেখানে আরবী-ফার্সী শব্দ ঢোকাচ্ছে?
তপন বললো, মোটেই না। নাজামুদ্দিনের ভাই সাহাবুদ্দীন সেরকম ফতোয়া দিয়েছিল, চেষ্টা করেছিল খুব, কিন্তু বাঙালী লেখকরা তা মেনে নেয়নি কেউ।
কী জানি ওখানকার বইপত্তর তো পাই না।
পরীক্ষিৎ ফিরে এলো একটুবাদে। সে অনেক চেষ্টা করেও বাংলা মদের পাঁইট জোগাড় করতে পারেনি, তার বদলে নিয়ে এসেছে খানিকটা গাঁজা। হেমন্তর কাঁধের ঝোলা থেকে একটা পত্রিকা বার করে নিয়ে সে ঘাসের ওপর বিছিয়ে দিল, তারপর দেশলাই কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তামাক বার করতে লাগলো সিগারেট থেকে।
অবিনাশ জিজ্ঞেস করলো, কোথায় পেলি রে গাঁজা?
–রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে। শালা কী দাম বেড়েছে রে। ছোট পুরিয়া, যেগুলোর দাম ছিল আট আনা, সেই পুরিয়াই দু’ টাকা চার আনা নিল। গাঁজাও কি যুদ্ধের কাজে লাগে নাকি?
–আলবাৎ লাগে। এই যুদ্ধটাই তো গাঁজাখোরদের যুদ্ধ। পাকিস্তানী বোমারু পাইলটগুলো গাঁজায় দম দিয়ে একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে আছে, নইলে ব্যাটারা আসছে না কেন? বোমা ফেলার কাজটা চুকিয়ে দিলেই পারে।
সুবিমল বললো, কে বলেছে ওরা কলকাতায় বোমা ফেলতে আসবে? এদিকে ওরা ফ্রন্ট খুলবে, ওরা এত বোকা নাকি? ততখানি হিম্মতও কি ওদের আছে?
–ওরা যে লাহোর আক্রমণের বদলা নেবে শুনছি? এখানকার খবরের কাগজগুলো তো খুব চ্যাঁচাচ্ছে। তা ছাড়া ক্যালকাটা বম্বিং হবার চান্স না থাকলে শুধু শুধু এখানে ব্ল্যাক আউট করতে গেল কেন?
–এসব হচ্ছে যুদ্ধের টেমপো তোলা। সোলজাররা যত না যুদ্ধ করে তার চেয়ে খবরের কাগজওয়ালারা অনেক বেশি যুদ্ধ চালায়। রোজ আট কলম ব্যানার হেড লাইন। কাগজের বিক্রি বাড়ে। আর গভর্নমেন্ট থেকেও চায় সাধারণ লোকের মধ্যে একটা কৃত্রিম দেশাত্মবোধ চাগিয়ে তুলতে। দেশের অন্য সব সমস্যা তা হলে চাপা পড়ে যাবে।
পরীক্ষিৎ-এর এই সব কথাবার্তা পছন্দ হয় না। যুদ্ধ-টুদ্ধ নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। সে এক ধমক দিয়ে বললো, কী ভ্যাড় ভ্যাড় করছিস তখন থেকে। চুপ মার তো।
তামাকের বদলে গাঁজা ভরে পরীক্ষিৎ সিগারেটটির আগের গড়ন প্রায় ফিরিয়ে এনেছে। নিজে সাজলেও প্রথমে সে নিজে ধরায় না, সে সম্মানটা সে দিল হেমন্তকে। হেমন্ত লম্বা দুটি টান দিয়ে সেটি চালান করে দিল অবিনাশকে, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তপনকে বললো, আপনি বুঝি যুদ্ধ নিয়েও কবিতা লেখেন?
তপন একটু কেঁপে উঠলো। সে সত্যিই দুটি কবিতা লিখে ফেলেছে। মানিকদাদের স্টাডি সার্কলে সে ঐ কবিতা পাঠ করতে পারবে না, ভেবেছিল এই আড্ডায় শোনাবে। কিন্তু হেমন্তর গলার আওয়াজে কৌতুকের সুর টের পেয়ে সে তাড়াতাড়ি বললো, না, না, যুদ্ধ নিয়ে নয়, আমি। আমার গ্রাম নিয়ে দু একটা লিখেছি, এই সময় আবার খুব মনে পড়ছে।
–নস্টালজিয়া? মুখস্থ থাকে তো শোনান।
পরীক্ষিৎ সঙ্গে সঙ্গে বললো, না, না, এই অন্ধকারের মধ্যে কবিতা-টবিতা চলবে না।
হেমন্ত বললো, জিনিসটা ফার্স্টক্লাস, আর একটা বানা তো পরীক্ষিৎ।
অবিনাশ জিজ্ঞেস করলো, মনে কর আমাদের এখানে অদিতি এসে বসেছে। ওর সামনে আমরা কী কথা বলতুম?
পরীক্ষিৎ বললো, তুই যে ঐ মেয়েটার জন্য হেদিয়ে মরলি রে। ওর পাইলট প্রেমিক জানতে পারলে তোকে ধোলাই দেবে।
–ঐ পাইলটটা কি যুদ্ধে গেছে? প্লেন ক্র্যাশ করে পাকিস্তানে যদি ওয়ার প্রিজনার হয়ে থাকে, বেশ হয়।
সুবিমল বললো, সে গুড়ে বালি। ও ছেলেটা আছে সিভিল অ্যাভিয়েশানে।
হেমন্ত হেসে উঠে বললো, অবিনাশ কিন্তু ছেলেটাকে মারতে চায়নি, দেখলি? শুধু মাত্র ওয়ার প্রিজনার হবার অভিশাপ দিয়েছে। আরে এ যুদ্ধ আর কতদিন, ওয়ার প্রিজনার হলে তো সে ফিরে আসবে। তখন তাকে প্যাঁদাবে।
তপন জিজ্ঞেস করলো, এই যুদ্ধ কি শিগগির থামবে?
হেমন্ত বললো, বেশিদিন চলতেই পারে না। দু’ সাইডেরই তো খেলনাগুলো ফুরিয়ে যাবে ক’দিনের মধ্যেই।
সুবিমল বললো, ইণ্ডিয়া কী ট্যাকটিকস নিয়েছে বুঝতে পারছিস না? ওয়াই বি চ্যবন আর জেনারাল চৌধুরী চায় যুদ্ধটাকে যতদূর সম্ভব প্রোলং করতে। যাতে পাকিস্তানের দম ফুরিয়ে যায়। আমেরিকা তো দু পক্ষকেই আর্মস সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়া তবু ইণ্ডিয়াকে কিছু কিছু দিয়ে যাবে। ইণ্ডিয়া নিজেও এখন টেন পরসেন্ট আর্মস বানায়। পাকিস্তানের তো নিজস্ব বলতে কিছুই নেই, ওরা কতদিন আর চালাতে পারবে?
হেমন্ত বললো, চীন দেবে। চীন এখন ওদের দিকে হেলেছে। চীন যদি এই সুযোগে সিকিম বা আসামের দিকে ইণ্ডিয়াকে আর একবার খোঁচাখুঁচি করে, তা হলে ইণ্ডিয়া বিপদে পড়ে যাবে।
সুবিমল বললো, চীন এখন ইণ্ডিয়াকে অ্যাটাক করতে পারে না। ওসব খবরের কাগজের রটনা। তা ছাড়া চীন পাকিস্তানকে কী অস্ত্র দেবে, ওদের কী স্যাবার জেট আছে, না মিগ আছে?
পরীক্ষিৎ রাগত স্বরে বললো, আবার! আবার তোরা ঐ সব ফালতু কথা শুরু করলি। এই, মোছলমানটা গেল কোথায় রে? তিন চারদিন ওকে দেখিনি।
অবিনাশ বললো, রশীদ? কোথায় যেন বাইরে যাবে শুনেছিলুম।
সুবিমল বললো, কাল আমি দুপুরে ওকে একবার দেখেছি এসপ্লানেডে।
অবিনাশ বললো, তা হলে কফি হাউসে এলো না কেন? তোরা তো কেউ রাজি হলি না, রশীদ সঙ্গে থাকলে আজ আমি নির্ঘাৎ অদিতির কাছে গিয়ে কথা বলতুম।
–তুই এখনো সেই মেয়েটার কথা ভেবে যাচ্ছিস? সে এতক্ষণ বাড়িতে পৌঁছে, কাপড়-টাপড় বদলে…পুরোনো হয়ে গেছে।
হেমন্ত বললো, অদিতি নামের মেয়ের সঙ্গে অবিনাশ নামের কোনো ছেলের কক্ষণো ভাব হতেই পারে না। আমার মতন তিন অক্ষরের নাম চাই। আজ অদিত বাই চান্স এখানে এলে ওকেও গাঁজা খাওয়াতুম। ভেবে দ্যাখ, ওর বুকের কাছ দিয়ে ধোঁয়া গড়িয়ে যেত, দেবী সরস্বতীর হাতে পদ্মফুল!
পরীক্ষিৎ চমকে গিয়ে বললো, অ্যাঁ, কী বললি?
হেমন্ত ভালো করে চাইতে পারছে না, কষ্ট করে চোখ বড় বড় করে বললো, কী বলেছি, ভুল কিছু বলেছি?
সরস্বতী কোথায় পেলি! পদ্মফুলই বা কোথায় পেলি! গাঁজার ধোঁয়াটা পদ্মফুল হয়ে গেল?
–হোক না, ক্ষতি কি? তবে, সরস্বতীর বদলে গায়ত্রী এলেও আমি কম খুশী হতুম না। গায়ত্রীও চমৎকার কীরকম টিকোলো নাক, ঠিক যেন ডবল গুঁজিয়া!
–বদলে মানে? সরস্বতীর বদলে মানেটা কী?
পরীক্ষিৎ আর হেমন্ত দু’জনেরই নেশা ধরে গেছে, অন্যরা হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। হেমন্ত অদিতি নামটা ভুলে গেছে, তার বদলে সে বলছে সরস্বতী এবং জোর দিয়ে বলতে চাইছে, সরস্বতীর বদলে গায়ত্রীরই আজ আসা উচিত ছিল, কারণ গায়ত্রীর নাকের সঙ্গে অন্য কোনো মেয়ের নাকের কোনো তুলনাই হয় না!
তপন উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি এবার চলি। আমাকে অনেক দূর যেতে হবে।
সুবিমল বললো, হ্যাঁ, দমদম, অনেক দূর, শ্যামবাজার থেকে বাস পাবেন?
তপন বললো, বাস না পেলে হেঁটে যাবো। আমার অভ্যেস আছে!
হেমন্ত বললো, গ্রামের ছেলে, হাঁটার অভ্যেস আছে। নস্টালজিক কবিতা বানাতে বানাতে…যশোর রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে-বর্ডার পার হয়ে একেবারে সরাইল পর্যন্ত…তা ভাই
অতদূরে যাবেন, দু’একটা টান দিয়ে গেলে হতো না?
পরীক্ষিৎ তপনের হাত চেপে ধরে হুকুমের সুরে বললো, হ্যাঁ, দুটো টান দিয়ে যাও! শুধু মুখে চলে যেতে নেই।
সুবিমল বললো, খালি পেটে হাঁটতে কষ্ট হবে ভাই! একটু দম নিয়ে নাও!
তপন কোনোদিন গাঁজা খায়নি। সে দ্বিধা করতে লাগলো। মানিকদা জানতে পারলে কী বলবেন? একদিন তিনি বলেছিলেন, আধুনিক কবি-সাহিত্যিকরা অবক্ষয়ী মানসিকতার শিকার! সে হাত ছাড়িয়ে নিল খানিকটা জোর করেই।
এক সময় এদের আড্ডার দল ভাঙলো। অবিনাশ বললো, আমি একবার রশীদের কাছে যাবো। ছেলেটা স্পাই-ফাই বলে ধরা পড়ে গেল কিনা তার একটা খোঁজ নেওয়া দরকার।
পরীক্ষিৎ বললো, চল আমিও যাবো তোর সঙ্গে।
রশীদ থাকে পার্ক সার্কাসের কাছে একা একটা ঘর ভাড়া নিয়ে। তার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবাই থাকে পাকিস্তানে। সাত-আট বছর আগে সে কলকাতায় বেড়াতে এসে আর ফিরে যায়নি। তার যেতে ইচ্ছে করে না।
রাত বাড়ার পর রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে এসেছে। পার্ক সার্কাসের দিকটা একেবারে ফাঁকা। মেঘ সরে যাওয়ায় অন্ধকার একটু ফিকে হয়ে এসেছে। সমস্ত বাড়ির দরজা, জানলা বন্ধ। রশীদ থাকে রাস্তার ধারে দোতলার একটা ঘরে। অবিনাশ আর পরীক্ষিৎ ছোট ছোট ইঁট কুড়িয়ে ওর জানলায় ছুঁড়ে মারতে লাগলো।
একটুবাদে জানলা খুলে রশীদ জিজ্ঞেস করলো, কে?
অবিনাশ বললো, নিচের গেট খুলে দে!
নিচে এসে রশীদ এক গাল হেসে বললো, তোরা এত রাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস? ভয়-ডর নেই?
অবিনাশ বললো, ভয়ের কী আছে? দাঙ্গা কিংবা কারফিউ তো না, শুধু ব্ল্যাক আউট! রশীদ বললো, তোরা জানিস না কী সব কারবার হচ্ছে। এরকম ফাঁকা রাস্তায় লোকজন দেখলে পাবলিক তাদের ছত্রীবাহিনী বলে পেটাচ্ছে। আমাদের কী হয়েছিল শুনিসনি? খুব জোর বরাতে বেঁচে গেছি। আয়, ওপরে আয়!
ঘরে কোনো খাট নেই, মেঝের ওপর তোশক পাতা আর চারদিকে অসংখ্য বই ও পত্র-পত্রিকা। এক পাশে একটি স্পিরিট স্টোভ, একটা সসপ্যান, দু’চারখানা কাপ-প্লেট। এই নিয়ে রশীদের সংসার। রশীদের কাছে পৌনে এক বোতল হুইস্কি আছে, সেটা দেখে পরীক্ষিৎ যেন ধড়ে প্রাণ পেল। গেলাস মাত্র একটিই, তার থেকেই চুমুক দেবে তিন জন।
রশীদ শোনালো তার অভিজ্ঞতা। শক্তি-সুনীল-শরৎদের সঙ্গে ও গিয়েছিল ঝাড়গ্রাম ছাড়িয়ে বেলপাহাড়ী নামে একটা জায়গায়। কাছেই কলাইকুণ্ডায় এয়ারফোর্সের বেস। ওখানে পাকিস্তানী ছত্রীবাহিনী যে-কোনো সময় নামবে এই গুজবে সবাই সন্ত্রস্ত। অচেনা লোক দেখলেই সন্দেহ। ওরা এসব খেয়াল করেনি, ফাঁকা মাঠে বসে মহুয়া খেতে খেতে গান গাইছিল, হঠাৎ এক বিশাল জনতা ওদের ঘিরে ধরে। ছত্রীবাহিনীর লোকেরা ফাঁকা মাঠে বসে গান গাইবে কিনা সে প্রশ্ন কারুর মনে এলো না, হিংস্র জনতা শেষ পর্যন্ত হয়তো ওদের লীৰ্চ করে ফেলতো, মাঝখানে দু’এক জনের হস্তক্ষেপে ওদের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো থানায়!
অবিনাশ ভুরু তুলে বললো, কী সর্বনাশ, রশীদ, তুই-ও ওদের সঙ্গে গিয়েছিলি কোন আক্কেলে? তুই যে সত্যিই পাকিস্তানী! ওরা যদি তোর প্যান্টুল খুলে মিলিয়ে দেখতো?
রশীদ বললো, শরৎদা আমার নাম করে দিল রতন চৌধুরী। আমাকে ওরা কিছু বলার আগে শরৎদা নিজের প্যান্টের বোতাম খুলে…
তিনজনে হাসতে লাগলো তুমুল মজায়। যেন এটা কোনো বিপদের গল্পই নয়। যেন পুরো যুদ্ধটাই একটা হাস্য কৌতুকের ব্যাপার।
পরীক্ষিৎ এক সময় পকেট থেকে অবশিষ্ট গাঁজার পুরিয়াটা বার করে বললো, আমি আজ রাত্তিরে আর বাড়ি ফিরছি না। রশীদ, আমি তোর এখানেই থাকবো।
কেউই অবশ্য আর বাড়ি গেল না। আড্ডায় আড্ডায় সময় গড়িয়ে গেল অনেকখানি। নেশার দ্রব্য সব ফুরিয়ে গেলে ওরা আবার বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। রাত এখন প্রায় দুটো। মেঘ সরে গিয়ে পরিপূর্ণ জ্যোৎস্না ফুটেছে, রাস্তা দেখতে কোনো অসুবিধে হয় না। নির্জন রাত্রির রাজপথের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে, ওরা সেই সৌন্দর্যটা ভাঙতে লাগলো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গান গেয়ে। অবিনাশ একটা গান বানালো, ওরে আয় রে উড়ে লাহোর থেকে একটা ছোট জঙ্গি বিমান, গোটা দশেক বোম্ ফেলে যা এই শহরে…। সেই গানে লাগালো একটা পরিচিত রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর।
কারফিউ আর ব্ল্যাক আউটের রাতে তফাত আছে। ব্ল্যাক আউটের মধ্যে কেউ বাইরে বেরুলেও পুলিশের আপত্তি থাকার কথা নয়। একটা পুলিশের গাড়ি ওদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে একবার গতি মন্দ করলো, তারপর আবার ওদের অগ্রাহ্য করে চলে গেল। ওরা চলেছে শ্মশানের দিকে। একমাত্র সেখানেই এত রাত্রে জীবনের স্পন্দন টের পাওয়া যাবে। সেখানে সিগারেট, গাঁজা এমনকি দেশি মদও পাওয়া যাবে। শ্মশানে ব্ল্যাক আউট নেই!