২.৩১ Nothing at all but three things

Nothing at all but three things,
Birth and copulation and death.
I’ve been born and once is enough.

ঘরে একটা মৃদু আলো জ্বলছে। মধ্যরাত। মামা আজ আর ফিরলেন না। কলকাতায় তার কত বন্ধু। শ্বশুরবাড়ি। সুন্দরী শ্যালিকা। মামা আনন্দ করছেন। জবা আমার পাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে। তার ডান হাতটা আমার বুকে। মোটা শাখা। লোহার একটা বালা। কয়েক গাছা চুড়ি। মানুষ কত যন্ত্রণাই সহ্য করতে পারে! আমার গোটা মুখটা হুহু করে জ্বলছে।

হঠাৎ মনে হল, হরিদ্বারের সন্ন্যাসী আমাকে একটা ফল খাইয়েছিলেন। বলেছিলেন, অমৃতফল। সেই ফল খেয়ে আমার কী লাভ হল! দেহ-যন্ত্রণা, দেহ-বাসনা সবই তো রয়েছে। কোনওটাই তো গেল না। জবাকে মনে হচ্ছে আমার কত কালের বিয়ে করা বউ। সব বাজে সব মিথ্যে। সবই মানুষের ইচ্ছাপূরণ কল্পনা। মানুষ ভাবে, এই হল এই হবে। কিছুই হয় না। যা হবার তাই হয়। যদি আমি সেরে উঠি ঘোরতর নাস্তিক হয়ে যাব। যা মন চাইবে তাই করব।

  ভাবামাত্রই ভেতরে একটা শব্দ হল মড়মড় করে, যেন হাড়গোড় সব ভেঙে গেল। একটা কাঠামো ধসে পড়ল যেন। মরেছে, এইভাবেই বোধহয় মৃত্যু আসে। মরার অভিজ্ঞতা তো নেই আমার। জবার হাতে চাপ দিলুম। বোধহয় তন্দ্রা এসেছিল। একটু চমকে উঠল, কী হল?

তুমি কোনও শব্দ শুনতে পেলে? অতি কষ্টে জড়িয়ে জড়িয়ে বললুম।

কই না তো? কীসের শব্দ?

আমি কী বোকা! জবা কেমন করে শুনতে পাবে আমার অন্তরের অলৌকিক শব্দ! এ তো আমার সংস্কার ভেঙে পড়ার শব্দ। এ-ও আমার মনের ভুল। সংস্কার একটা মনের ভাব, বস্তু নয়, তার আবার ভেঙে পড়া কী!

জবা আমার কপালে হাত রেখে বললে, বেশ জ্বর। তোমাদের বাড়িতে সব আছে, একটা থার্মোমিটার নেই। তোমার আর একবার ওষুধ খাবার সময় হল। ট্যাবলেটটা গুঁড়ো করি। জবা উঠে পড়ল। বাড়িঘর ছেড়ে আমার জন্যে মেয়েটার কী শাস্তি! এ ঋণ আমি কেমন করে শোধ করব? একটা ভাল শাড়ি! একটা হার! হবে না। উপহার দিয়ে সব ঋণ শোধ করা যায় না। বোতলের পেছন দিয়ে জবা ট্যাবলেট গুঁড়ো করছে। ঠুকঠুক শব্দ। নিস্তব্ধ রাত। ঘড়ির টুকটুক পদশব্দ। দূরে কুকুরের ডাক। আমি চলে যাচ্ছি এই সুন্দর প্রেম-প্রীতির পৃথিবী ছেড়ে। জবা মেঝেতে বসে আছে। তাকাচ্ছি, ভাল দেখতে পাচ্ছি না। চোখে পরদা পড়েছে। রাত ভোর হবার আগেই হয়তো থেমে যাবে আমার যন্ত্র! মৃতজনদের দেখতে পাচ্ছি। আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সকলেই হাসছেন। আর দেরি কেন? মায়ার খাঁচা খুলে বেরিয়ে এসো। আকাশ কত নীল!

অনেক কসরত করে জবা আমাকে ওষুধটা খাওয়াতে পারল। সে এক পর্ব। লজ্জা করছে, হাসিও পাচ্ছে। অসুস্থ দেহ, টগবগে মন, পাশেই ভোগ, কিছুই করার উপায় নেই। তখনই যেন অমৃত ফলের রহস্য পরিষ্কার হল। সন্ন্যাসী জানতেন, আগুন আর ঘৃত পাশাপাশি আসবে, এমন একটা অবস্থা করে দাও যাতে মাথা তুলতে না পারে। তারপর নারীতে মাতৃদর্শন হোক। একটু একটু করে দুধ খাওয়াচ্ছে, ওষুধ খাওয়াচ্ছে, বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। প্রবল যন্ত্রণার মধ্যে মায়ের দর্শন।

জবা একটা কঁচা টাকা আমার কপালে ঠেকিয়ে ঠাকুরের ছবির কাছে রেখে এল। মায়েরা ছেলের আরোগ্য কামনায় এইরকমই করে। সেরে উঠলে পুজো দেওয়া হবে। আমি ধীরে ধীরে আবার একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি; আর ঠিক সেই মুহূর্তে সামনে এসে দাঁড়ালেন মিশনারিদের মতো সাদা পোশাক পরা এক মূর্তি। প্রথমে চিনতে পারিনি। অন্ধকারে এক ছায়ার মতো। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। সাদা পোশাকে একটি অন্ধকার মুখ। চোখদুটো আলপিনের মতো জ্বলছে। হঠাৎ একটা সোনালি আলো ফুটে উঠল। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল মূর্তির শরীরে। জল যেমন কাগজে শুষে যায়, সেইভাবে আলোটা ভেতর থেকে ফুটে উঠছে। ক্রমশই উজ্জ্বল হচ্ছে। আলোয় ভেজা এমন এক সুঠাম মানবকে চোখের সামনে দেখে চেতনা স্তম্ভিত। এই কি দেবদূত! মৃত্যুর প্রাক মুহূর্তে যাঁর আগমন হয়! তলার দিক থেকে আলো পড়ল মুখে। চমকে উঠলুম। স্বয়ং হরিশঙ্কর এসেছেন দুয়ার খুলে দিতে। একটা ভয় ছড়িয়ে পড়ল, পাশেই জবা। জবাকে দেখে যদি তিরস্কার করেন, এখনও গেল না আঁধার, এখনও রহিল বাধা/ এখনও মরণব্রত জীবনে হল না সাধা ॥ হরিশঙ্করের মুখ পাথরের মতো। সেই বজ্রকঠিন মুখ। যে-মুখে তিনি সংসার-সমস্যার মুখোমুখি হতেন। যে-মুখের সামনে কারও ক্ষমতা হত না মুখ তুলে দাঁড়াবার। হরিশঙ্কর দুটো হাত নিজের চোখের সামনে তুলে ধরলেন। হাতে একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। ভেতরে টলটল করছে সাদা তরল পদার্থ। সিরিঞ্জের গায়ের কালো কালো রেখা সুস্পষ্ট। হরিশঙ্কর সামনে ঝুঁকে আমার হাতে প্রিক করে চুঁচটা ফুটিয়ে দিলেন। সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল পিপারমেন্টের অনুভূতি। ভীষণ একটা আরামে আঃ করে উঠলুম। সাদা আলখাল্লা পরা হরিশঙ্কর সেজ নেবার মতো ধীরে ধীরে নিবে গেলেন। কানে এল জবার গলা, কী হল? খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার? জবার মুখ হেঁট হয়ে আছে। আমার মুখের ওপর। কানের দুল টুলটুল করে দুলছে। সোনার চেনে বাধা পাথর-বসানো লকেট আমার বুকে নেমে এসেছে। কথা বলার ক্ষমতা নেই আমার। ডান হাতে তার ওপর বাহুটা চেপে ধরলুম। নরম তুলতুলে। জবার নরম বুক চেপে আছে আমার বুকের একপাশে। স্পঞ্জের মতো ওঠানামা করছে।

হঠাৎ জবা চমকে উঠল। ওটা কী?

জবা আড়ষ্ট কাঠ। কী দেখেছে! জবা অতি সন্তর্পণে আমার মাথা ও পাছার তলা দিয়ে তার হাতদুটো চালিয়ে দিয়ে খুব সাবধানে বিছানা থেকে তুলে নিল। প্রায় পাঁচফুট নইঞ্চির মতো দীর্ঘ সুঠাম শরীর। জবার কোনও অসুবিধেই হল না। আমাকে তুলে নিয়ে একপাক ঘুরে যেতেই ভোরের মৃদু আলোয় চোখে পড়ল, মাথার বালিশ আর খাটের সীমানা ঘেঁষে বিছানার খাজ ধরে গলগল করে চলেছে মেটে লাল রঙের একটা সাপ। ঠোঁটের সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে আমি আর্তনাদ করে উঠলুম, সাপ সাপ।

জবা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে মুকু যে তক্তাপোশে শুত তার ওপর ধীরে ধীরে শুইয়ে দিল। সাপ কোথা থেকে এল! অত বড় সাপ! পুরনো বাড়ি, সাপের অভাব নেই। একতলায় হামেশাই দেখেছি, দোতলায় এই প্রথম। আগে পিছনের সিঁড়িতে সন্ধের দিকে প্রায়ই কামিনীভোগ চালের পায়েসের গন্ধ পেতুম। হরিশঙ্কর একদিন রহস্যটা বলেছিলেন, বাস্তু সাপ বেরোলে অমন গন্ধ বেরোয়। পরে একদিন দেখিয়েও ছিলেন। বেঁটে, চওড়া, শ্যাওলার মতো গাত্রবর্ণ। বয়েসের কোনও ঠিকঠিকানা নেই। হরিশঙ্কর সাপ মারা একদম পছন্দ করতেন না। বলতেন, সাপ তো মানুষ নয় যে অকারণে মানুষের ক্ষতি করবে! সাপ পোষার এই ফল।

জবা বললে, তোমার একটু কষ্ট হল, এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। তুমি শুয়ে থাকো, আমি দেখে আসি চলে গেল কি না?

জবা চলে যাচ্ছিল, আঁচলটা চেপে ধরে বললুম, আমার ডান হাতের এই জায়গাটা দেখো তো।

জবা ঝুঁকে পড়ল। স্বপ্নে যে-জায়গাটায় হরিশঙ্কর ছুঁচ ফুটিয়েছিলেন সেই জায়গাটা দেখতে বললুম। জবা দেখে বললে, কী ব্যাপার বলো তো? একটা কিছু ফুটেছিল?

একটা মৃদু হাসি খেলে গেল ভেতরে, শাবাশ! অক্ষয় কাকাবাবু, অভ্রান্ত আপনার গণনা। ডবল আক্রমণ। ওই দাগটা আর কিছুই নয়, সাপের ছোবল। হরিশঙ্করের উঁচ নয়। তিন দিনের মধ্যে বিপদ আসছে। সেই বিপদের চেহারা যে এইরকম হবে কে জানত।

জবা প্রশ্ন করলে, কী ফুটল বলো তো? আমার কিছু? হাতের নোয়া? সেফটিপিন?

মনটা আমার বিশাল সমুদ্রে ভেসে চলা ছোট্ট নৌকোর মতো হয়ে গেছে। যেতেই হবে, যেতেই হবে। কোনওরকমে বললুম, জবা, হয়ে গেছে। ফিনিশ। ওটা সাপের ছোবল। একটু আগে মনে হল একটা ছুঁচ ফুটল। তখনই আমি তোমাকে ডেকেছিলুম।

জবাব মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল, সে কী? সর্বনাশ! তা হলে তো ওর ওপরে একটা বাঁধন দিতে হবে। দাঁড়াও।

বাঁধনে কী হবে জবা? যেখানে কামড়েছে সেটা মাথার খুব কাছে।

আর আমার সামান্যতম শক্তি নেই। ঠোঁটের যন্ত্রণাও আর অনুভব করতে পারছি না। শরীর একেবারেই এলিয়ে গেল। সাপের বিষে এইরকমই হয়তো ঘোর লাগে। তারই মধ্যে দেখলুম জবা শাড়িটা খুলে ফেলল। তারই মধ্যে একঝলক ভেবে নিলুম, আহা! জবার শরীরটা কী সুন্দর! ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নারী। একই নারীর কত রূপ! জবা সায়ার দড়ি খুলছে। একটানে ফস করে দড়িটা খুলে কোমরের একটু নীচে সায়াটাকে.কোনওরকমে গাঁট দিয়ে সামলে রাখল। গভীর নাভির দিকে আমার আচ্ছন্ন চোখ চলে গেল। মৃত্যুটা আমার খুবই সুখের হতে চলেছে। নানারকম বিভীষিকা দেখে মরতে হচ্ছে না। জবৗ আমার হাতে দড়ির ফাস পরাতে লাগল। জবার দেহের উত্তাপে দড়িটা গরম। মনের কল্পনাও হতে পারে। ব্লাউজে দুটো সেফটিপিন। সাপটা কি চলে গেছে। এ ঘরে আসবে না তো! এক ঝটকায় কে যেন আমাকে অচেতনায় তলিয়ে দিল।

কটা দিন চলে গেছে, কে জানে? আমার মরা হল না। চোখ মেলে তাকালুম। স্বপ্ন দেখছি না তো? সামনেই হরিশঙ্করের মুখ। সেই সোনার চশমা। তীক্ষ্ণ, উজ্জ্বল চোখ। মুখে অদ্ভুত একটা জ্যোতি খেলছে। পাশেই মাতুল জয়নারায়ণ। তার পাশেই জবা। জবার পাশে মুকু, মুকুর পাশে টিপ। টিপের পাশে সুরঞ্জনা। সুরঞ্জনার পাশে টিপের মা। তার পাশে কাকিমা। কাকিমার পাশে অক্ষয় কাকাবাবু। ভাবছি পুনর্জন্ম হল কি না!

হরিশঙ্কর তাঁর সেই পরিচিত ভঙ্গিতে একটা আঙুল তুলে বললেন, ক্রাইসিস ইজ ওভার।

আমি হাত জোড় করে নমস্কার করলুম। তিনিও হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। এই হলেন আমার পিতা। এটিকেট, ম্যানার্স, ফর্মালিটি। অতুলনীয়। শুয়ে আছি বড়ঘরে। পিতারই খাটে। খাটের পাশে একটা স্ট্যান্ড। দুটো বোতল ঝুলছে। তার মানে আমাকে ড্রিপ দেওয়া হচ্ছিল। নিজের মুখটা খুব দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল। খুব হালকা মনে হচ্ছে। কোনও জ্বালাযন্ত্রণাও নেই।

জয়নারায়ণ বললেন, মিরাক। যমে মানুষে টানাটানি অ্যান্ড যম মিজারেবলি ফেলড্‌।

এই মেয়েটার কাছে যম হার মেনেছে। হরিশঙ্কর জবার পিঠে হাত রাখলেন। এ সব জানে। বাঁধন দিয়েছে। ইনসিশন করে সা করেছে। হোয়াটএভার ইট মে বি, দ্যাট ওয়ার্কড।

মাথার কাছে কেউ একজন বসে আছেন, তাঁর গলা, এটা হল ডিভাইন গ্রেস। যেটুকু ভেনাম রয়ে গেল দ্যাট ফট আউট ইরিসিপ্লাস। ইরিসিপ্লাসে কেউ সারভাইভ করেছে, দিস ইজ ভেরি রেয়ার। ডক্টর সেনের গলা। কতদিন কতক্ষণ আমার মাথার কাছে বসে আছেন জানি না। কাকিমা আমার কাছে এগিয়ে এলেন। চিনতে পারছ?

আমি একটু হাসলুম। চেহারা বেশ ভাল হয়েছে। গালদুটো লাল। কুচকুচে কালো ছবির মেয়েদের মতো চুল। অনুমান করার চেষ্টা করলুম, কী ঘটে গেছে এই কদিনে? মামা এসেছেন। ফিরে গেছেন। হরিশঙ্কর কোথায় তিনি জানতেন। তাকে নিয়ে এসেছেন। মুকু আর সুরঞ্জনা কেমন করে এল!

অক্ষয় কাকাবাবুই বললেন, একে আমরা পুনর্জন্ম বলতে পারি হরিদা।

ওটা তোমার মেয়েলি সাবজেক্ট অক্ষয়। আই বিলিভ ইন সায়েন্স। একে বলে চান্স সারভাইভাল। হয়ে গেছে। বেঁচে গেছে। অ্যান্ড দেয়ার ইজ সায়েন্স ইন ইট। তবে হ্যাঁ, সাপের ছোবলটা না খেলে কী হত? বা শুধুই যদি সাপের ছোবল হত? উইদাউট ইরিসিপ্লাস। এ ম্যাটার অফ ইনভেস্টিগেশন? লাক্ শব্দটা যখন বেঁচে থাকার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, লেট আস অ্যাকসেপ্ট ইট। তবে, উই হ্যাভ এ ফাইন টিম হিয়ার। এ পারফেক্ট সেবাদল। ডাক্তার সেন, আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ, জাস্ট ওয়ান ক্ল্যারিফিকেশন। সেকবাইটের রোগীকে কখনও ঘুমোতে দিতে নেই। বাট হিওয়াজ ইন এ কোমা। হাউ ক্যান ইউ এক্সপ্লেন।

ডক্টর সেন হেসে বললেন, আই ডিডন্ট অ্যালাউ হিজ সিস্টেম টু স্লিপ। কেপ্ট হিম অ্যাওয়েক ইনসাইড।

হরিশঙ্কর হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, গেট আপ। গেট আপ। অনেক দিন শুয়ে আছ। অনেক সময় নষ্ট করেছ। অনেকের সময় নষ্ট করেছ। উঠে পড়ো। মনের জোর করো।

কাকিমা বললেন, এখনও বড় দুর্বল। মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। ও উঠবে। ঠিক উঠবে। একটু খাওয়াদাওয়া করুক।

জবার সঙ্গে চোখাচোখি হল। জবা কোনও কথা বলেনি, সাহস পায়নি বলার। রাত জাগার ছাপ মুখে। মনে মনে জবাকে নমস্কার করলুম। আমার জন্যে তুমি যা করলে, তার তুলনা নেই। এর কোনও প্রতিদান হয় না। সুরঞ্জনা বললে, আমরা তো সব আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। মেসোমশাই, আপনার নার্ভ হল স্টিলের নার্ভ। আমরা এমন দেখিনি।

হরিশঙ্কর বললেন, ডোন্ট ফোমেন্ট মাই ইগো। তোমার বাবার নার্ভও কিছু কম যায় না। কলকাতার দাঙ্গার সময় আমরা দেখেছি। আচ্ছা এইবার কাজের কথা। নাও উই হ্যাভ আর্নড এ গুড কাপ অফ টি। তোমরা বোসো, আমি করে আনি।

জবা পাশ থেকে সামনে এসে বললে, আমি করছি, আপনারা বসুন।

হরিশঙ্কর বললেন, এই একটা মেয়ে। নেভার গেটস টায়ার্ড। কেউ তোমাকে সাহায্য করুক তা হলে?

সুরঞ্জনা বললে, আই ভলানটিয়ার।

সুরঞ্জনা আর জবা একেবারে মাথায় মাথায়। দু’জন বেরিয়ে গেল। ডক্টর সেন উঠে দাঁড়ালেন, যাবার আগে একটা কথা বলে যাই, যদি ব্ল্যাক স্টুল হয়, ডোন্ট গেট নার্ভাস।

হরিশঙ্কর বললেন, জানি। আপনি চা খাবেন না?

এক্সকিউজ মি। আমার একটু তাড়া আছে।

হঠাৎ মনে হল, একজনকে দেখছি না কেন? মেনিদা? কাকেই বা জিজ্ঞেস করি! সাহস হচ্ছে না। অক্ষয় কাকাবাবু বললেন, আমি তা হলে বড় করে একটা বাজার করে আনি।

হরিশঙ্কর বললেন, অফ কোর্স। আজ আমরা খাব।

জয়নারায়ণ বললেন, নিশ্চয় শাক্তমতে?

তুমি যখন আছ শাক্ত না হয়ে উপায় কী!

মাথাটা তরল হয়ে গেছে, যেন টলটলে জলের মতো। গালে হাত দিলুম। দাড়ি। মুখটা চুপসে গেছে। টিপ একটু ফাঁক পেয়ে এগিয়ে এল। প্রশ্ন করার আগেই বললুম, বেশ ভালই মনে হচ্ছে, জানো? আর কোনও কষ্ট নেই।

টিপ বললে, উঃ কী সাংঘাতিক কাণ্ড! তুমি কিছু জানো, এই ক’দিন কী হল?

বাইরে কী হয়েছে জানি না, ভেতরে যা হয়েছে তোমাকে একদিন বলব।

মুকু কিন্তু কাছে ঘেঁষছে না। দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালে পিঠ রেখে। গলায় তেমন জোর পাচ্ছি না। ওরই মধ্যে যতটা সম্ভব গলা চড়িয়ে বললুম, তোমার বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

মুকু গম্ভীর গলায় বললে, ওসব কথা এখন থাক।

তবে থাক। আমার চোখ বুজে আসছে আবার। ভীষণ দুর্বল। খালি বাড়ি আবার ভরে উঠেছে। বহু চরিত্রে সরগরম। কথা, শব্দ। কেউ যদি আমাকে এক কাপ চা দিত! চা যেন সুখ আর জীবনের প্রতীক। আমার জীবনের যত নারী সবাই আজ এক পরিচ্ছেদে সমবেত হয়েছে। পুরাকালে স্বয়ংবর সভায় রাজকুমাররা আসতেন। রাজকন্যারা বেছে নিতেন যে-কোনও একজনকে। এই সভায় রাজকন্যারা এসেছেন। হরিশঙ্কর কুমারকে বেছে নিতে হবে যে-কোনও একজনকে। নিজেকেই নিজে তারিফ করলুম, ক্ষমতা রাখিস পিন্টু! শুয়ে শুয়ে কী খেলই দেখালি! সেই সংগীত:

চিড়েতন হর্তন ইস্কাবন
অতি সনাতন ছন্দে করতেছে নর্তন
কেউ বা উঠে কেউ পড়ে,
কেউ বা একটু নাহি নড়ে,
কেউ শুয়ে শুয়ে ছুঁয়ে করে কালকর্তন ॥

তাসের দেশের রাজা চেত্তা খেয়ে পড়ে আছে। তাও তার কত রোয়াব! কাকিমা খাটের তলা থেকে কী একটা বের করে বললেন, আজ কি তোমার বেডপ্যান লাগবে? না বাথরুমে যেতে পারবে?

লজ্জার কুঁকড়ে গেলুম। ছিছি। এ ক’দিন তা হলে শুয়ে শুয়ে ছুঁয়ে বীরত্ব প্রদর্শন করেছি। লজ্জা! ছিছি লজ্জা!

আজ আমি মরে গেলেও বাথরুমে যাব।

ঠাকুরপোকে জিজ্ঞেস করি, ভাল করে গরম জলে চান করো। তোমার জন্যে জবা যা করেছে কেউ কারও জন্যে অমন করে না। আমরা তো স্রেফ দর্শকের মতো দেখেই গেলুম। এমন সেবা দেখা যায় না। ও না থাকলে তোমার কী হত?

বাবা কি রাঁচিতে আপনাদের কাছেই ছিলেন?

না, কারও আশ্রয়ে থাকার মানুষ উনি নন। সে তো তুমি জানোই।

তা হলে?

কাছাকাছিই ছিলেন। পুরুলিয়ায়।

কার কাছে খবর পেলেন?

পরে শুনো। তার কাছেই শুনো। আমার বলা বারণ।

সবাই যখন চলে গেলেন, মুকু এসে বসল আমার মাথার কাছে, খুব কাহিল হয়ে গেছ। আমার চলে যাওয়াটাই ভুল হয়েছিল। আমি থাকলে এই বিপদ তোমার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারত না।

আমি তোমার মাদুলি।

তুমি কোথায় ছিলে?

সুরঞ্জনাদের বাড়িতে।

সুরঞ্জনা? সুরঞ্জনার দাদা ফিরেছেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *