আজকালকার যুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রই আক্রমণকারীর ভূমিকা নিতে চায় না। যুদ্ধ থেমে নেই, পৃথিবীর বিভিন্ন রাজ্যে যখন তখন বিষফোঁড়ার মতন হানাহানি শুরু হয়, তবু যুযুধান দুই পক্ষই তারস্বরে বলতে শুরু করে, ওরা আগে আক্রমণ করেছে, আমরা উপযুক্ত জবাব দিচ্ছি! এমনকি রণোন্মাদ হিটলারকেও পোলান্ড আক্রমণের আগে একটা ছুতো খুঁজতে হয়েছিল।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হবার পরেও যথারীতি পাকিস্তানের নাগরিকরা জানলো যে নির্লজ্জ ভারত সরকার আচমকা আক্রমণ করে পাকিস্তান নামে নতুন ঐশলামিক রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করতে চাইছে। আর ভারতের নাগরিকরা জানলো যে পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকরা দেশের বহুরকম অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান না করতে পেরে সীমান্তে সংঘর্ষ বাধিয়ে উত্তেজিত করতে চাইছে সে দেশের মানুষদের।
বোন অফ কনটেনশান অবশ্যই কাশ্মীর!
তুষারময় গিরিচূড়ায় ঘেরা, হ্রদ ও নদীময়, ফুল-ফলে ভরা এই সুরম্য উপত্যকাটির যেন অশান্তিই নিয়তি। মাত্র ৩৫০ মাইল লম্বা আর ২৭৫ মাইল চওড়া এই রাজ্যটির জনসংখ্যা গত আদমসুমারিতে ছিল ৩৬ লক্ষের কাছাকাছি। তার মধ্যে শতকরা ৭৫ জনের বেশিই মুসলমান, বাকিরা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান। ধর্মীয় কারণে এখানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিশেষ হয়নি। এখানকার মানুষরা অধিকাংশই নম্র, শান্তিপ্রিয় ও অতিথিপরায়ণ। কিন্তু এই রাজ্যটি নিয়ে অন্যদের খুব মাথাব্যথা।
ভারত বিভাগ হবার পর যুক্তিসঙ্গতভাবে এই রাজ্যটি পাকিস্তানেরই অন্তর্ভুক্ত হওয়া স্বাভাবিক ছিল। হলো না দুটি কারণে। মুসলমান প্রধান এই রাজ্যটির রাজা বংশানুক্রমিকভাবে হিন্দু, ভারত ভাগের সময় তিনি দোলাচলে রইলেন। আর একটি কারণ হলো, শেখ আবদুল্লার মনোভাব।
এক শালকর পরিবারের ছেলে এই শেখ আবদুল্লা। অকালে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়, তাঁর বিধবা জননী ছেলেকে পারিবারিক পেশায় নিযুক্ত না করে লেখাপড়া শেখাতে চাইলেন। শ্রীনগর, জম্মু, লাহোর ও আলিগড়ে পড়াশুনো সমাপ্ত করে একটা এম এস-সি ডিগ্রি নিয়ে ফিরে এসে শেখ আবদুল্লা নিজের শহরে একটা সরকারি স্কুলে মাস্টারি নিয়েছিলেন। কিন্তু অত ছোট গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকার জন্য তাঁর জন্ম হয়নি। অচিরেই তিনি চলে এলেন রাজনীতিতে।
তিরিশের দশকে কাশ্মীরে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আলিগড় থেকে লেখা-পড়া শিখে এলেও মোল্লাতন্ত্র ও ধর্মান্ধতাকে অপছন্দ করতেন শেখ আবদুল্লা। তখন কাশ্মীরে একটি জনপ্রিয় দলের নাম ‘মুসলিম কনফারেনস’, শেখ আবদুল্লার উদ্যোগেই সেই দলের রূপান্তর হলো ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’ হিসেবে; সেই দলে তখন থেকে যে-কোনো ধর্মের মানুষই যোগ দেবার অধিকারী। অবিলম্বেই শেখ আবদুল্লা শুধু কাশ্মীরে নয়, অবিভক্ত ভারতেও একজন প্রধান নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন। গান্ধী, নেহরু, আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে নাম শোনা যেতে লাগলো তাঁর।
পাকিস্তান সম্ভাবনা যখন অনেকখানি দানা বেঁধেছে, মহম্মদ আলি জিন্না যখন তাঁর দাবির সমর্থন আদায় করার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমান নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন, সেই রকম সময়েই জিন্না একবার এলেন কাশ্মীরে। আপাত উদ্দেশ্য বিশ্রাম, কিন্তু এই সুযোগে কাশ্মীরী শের শেখ আবদুল্লাকেও তিনি স্বমতে আনতে চেয়েছিলেন। সেটা ১৯৪৪ সাল।
জিন্না সাহেবের সঙ্গে শেখ আবদুল্লার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তিরিশের দশকে একবার কাশ্মীরী পুলিসের এক দারোগা মেহের আলির বিরুদ্ধে তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী হানিফা, বিবির খোরপোশের মামলার সময় শেখ আবদুল্লা জিন্না সাহেবকে অনুরোধ করেছিলেন মহিলার পক্ষ নিয়ে আদালতে দাঁড়াতে। জিন্না মামলার বৃত্তান্ত শুনে বলেছিলেন, দাঁড়াতে পারি, কিন্তু প্রত্যেক দিন এক হাজার টাকা করে দিতে হবে! শেখ আবদুল্লা এবং তাঁর সহযোগীরা আকাশ থেকে পড়েছিলেন, তাঁরা এক নিপীড়িত মহিলার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। এত টাকা পাবেন কোথায়? জিন্না সাহেব বলেছিলেন, তিনি প্রফেশনাল এথিকসে বিশ্বাস করেন, তাঁর অনেক দান-ধ্যান আছে, তিনি অনেক জায়গায় চাঁদা দেন, কিন্তু ব্যারিস্টার হিসেবে তিনি এক পয়সাও কম ফি নিতে রাজি নন। শেষ পর্যন্ত শেখ আবদুল্লার দল ঐ টাকাই চাঁদা করে তুলে দিতে রাজি হন।
জিন্না পরের বার কাশ্মীরে আসেন মুসলিম লীগের নেতা হিসেবে বক্তৃতা দিতে। শেখ আবদুল্লা তখন প্রতিযোগী ন্যাশনাল কনফারেন্স দলের নেতা। জিন্নাকে সেবার রাজ্য সরকার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কাশ্মীর ত্যাগ করার হুকম দেয়। জিন্না চলে যেতে বাধ্য হলেন পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ মুখে নিয়ে। শেখ আবদুল্লার প্রতি এই সময় তাঁর মনোভাব ভালো হওয়ার কথা নয়। শেখ আবদুল্লা নিজেই চিঠি লিখে জিন্নার সঙ্গে একটা সমঝোতার প্রস্তাব দিলেন, জিন্না তাঁকে আহ্বান জানালেন দিল্লিতে আসার জন্য।
কিন্তু সমঝোতা হলো না। জিন্না সাহেব ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের নেতা আর শেখ আবদুল্লা যে রাজ্যের নেতা সেখানে মুসলমানরা প্রবলভাবে সংখ্যাগুরু। দু’জনের মনোভাব আলাদা হতে বাধ্য। সংখ্যালঘুদের নেতা সংখ্যাগুরুদের প্রতি সন্দেহ, বিতৃষ্ণা বা বিদ্বেষ পোষণ করতে পারেন, তা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু সংখ্যাগুরুদের যিনি নেতা তিনি সংখ্যালঘুদের প্রতি খানিকটা উদার, পৃষ্ঠপোষক, বড় ভাই সুলভ আচরণ করতেই পারেন। তরুণ শেখ আবদুল্লা দ্বিজাতিতত্ত্ব মানেন না, তিনি জিন্নাকে বলতে চাইলেন যে মূল সমস্যাটা ধর্মীয় ততখানি নয়, যতখানি শোষক ও শোষিতের। শোষণ ব্যবস্থা দূর করতে পারলে হিন্দু-মুসলমান দু’ দলই উপকৃত হবে। জিন্না সাহেব যে পাকিস্তানের পরিকল্পনা করছেন, তাতে পূর্ব ও পশ্চিম দিকের মধ্যে দূরত্ব থাকবে এক হাজার মাইল, ধর্ম ছাড়া এই দু দিকের মানুষের মধ্যে কি অনেক রকম বৈষম্য থাকবে না?
এ সব কথা জিন্নার পছন্দ হয়নি। শেখ আবদুল্লার বক্তব্য শোনার পর তিনি বলেছিলেন, শোনো শেখ, আমি তোমার বাবার মতন। রাজনীতি করতে করতে আমি ঝুনো হয়েছি। আমার অভিজ্ঞতা এই যে কোনো হিন্দুকেই বিশ্বাস করা যায় না। তারা কখনো তোমার বন্ধু হবে না। সারা জীবন ধরে আমি তাদের আপন করতে চেয়েছি কিন্তু কিছুতেই ওদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। তোমার জীবনে একটা সময় আসবে যখন তুমি অনুতাপ করবে, আমার কথার মর্ম বুঝবে। কী করে ওদের তুমি বিশ্বাস করবে, যারা তোমার হাত থেকে এমন কি পানি পর্যন্ত খাবে না? সেটাকে পাপ মনে করে? ওদের সমাজে তোমার কোনো স্থান নেই। ওদের চোখে তুমি একটা ইনফিডেল!
প্রবীণ জিন্না অনেক অভিজ্ঞতায় যা ঠেকে শিখেছিলেন, তরুণ শেখ আবদুল্লা আদর্শবাদের উদ্দীপনায় তা মানতে চাননি। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, হ্যাঁ, আমি অস্বীকার করছি না, হিন্দুদের একটা সাংঘাতিক রোগ আছে, যার নাম অস্পৃশ্যতা। কিন্তু ওদের মধ্যে শিক্ষিত শ্রেণী এর থেকে বেরিয়ে আসছে এবং এর পরিবর্তন করতে চাইছে। মহাত্মা গান্ধী হরিজনদের স্বীকৃতি এবং আরও অন্যান্য সমাজ সংস্কারের চেষ্টা করছেন। বীর সৈনিকের মতন তিনি লড়ছেন অস্পৃশ্যতা নামের রোগটার বিরুদ্ধে। সুতরাং আমি মনে করি, সমস্ত সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন ভারতীয়েরই উচিত জাতি, ধর্ম, বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করা। রোগ যতই ভয়ংকর হোক, একজন ডাক্তার সেই রোগীর গলা চেপে ধরে না কিংবা সেই রোগীকে না দেখে ফেলে চলে যায় না, বরং তার দ্রুত আরোগ্যের জন্য সব রকম চেষ্টা করে। জিন্না সাহেব, আপনি এত বড় একজন আইনজ্ঞ, আপনি এটা বোঝেন না?
এ সব কথা শুনে জিন্না সাহেবের খুশি হবার কথা নয়। ১৯৪৪ সালে যখন তিনি কাশ্মীরে শেষ বারের মতন এলেন তখন তিনি স্পষ্টতই শেখ আবদুল্লার প্রতিপক্ষ। তিনি এসেছেন মুসলিম লীগের প্রতি সমর্থন আদায় করতে, কিন্তু মিটিং করতে গিয়ে দেখলেন, কাশ্মীরের যুব-জনতা শেখ আবদুল্লার পক্ষে। শেখ আবদুল্লা দুই জাতি তত্ত্বের প্রবল বিরোধী, আর জিন্না ঐ তত্ত্বের প্রবক্তা। তিনি তখন জয়যাত্রায় বেরিয়েছেন, কিন্তু কাশ্মীর হয়ে রইলো পথের কাঁটা। কাশ্মীরকে তিনি ভুলতে পারলেন না।
ব্রিটিশ ভারত দু ভাগ হলো, দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হলো। দেশীয় করদ রাজ্যগুলি যে-কোনো একটিতে যোগ দেবে এই রকমই ছিল বোঝাঁপড়া, কিন্তু পৃথক সত্তা বজায় রাখলো কাশ্মীর। জিন্নার জীবদ্দশতাতেই কাশ্মীরে হয়ে গেল একটা যুদ্ধ, বাইরের লোকের চোখে সেটাই প্রথম ভারত-পাক সংঘর্ষ। অবশ্য, ভারতের বক্তব্য অনুযায়ী সেটা পাকিস্তানী হানাদারদের আক্রমণ; আর পাকিস্তানের মতে, সেটা কাশ্মীরীদের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান, যা দমন করতে এগিয়ে এসেছিল বে-আইনী ভারতীয় ফৌজ।
ভারত যাদের আখ্যা দিল হানাদার, পাকিস্তান ঘোষণা করলো তারাই মুজাহিদ। দেশ বিভাগের মাত্র দু’ মাস সাত দিন পরেই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে শুরু হয়ে গেল ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা। পাকিস্তান সীমান্ত থেকে মাসুদ, ওয়াজির ও আফ্রিদি সম্প্রদায়ের সশস্ত্র লোকেরা ঢুকে পড়লো কাশ্মীরে। এরা স্বভাবতই যোদ্ধা জাতি, তা ছাড়া কাশ্মীরে তখন কোনোরূপ যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল না। পাখতুনিস্তানের সীমান্ত গান্ধী আবদুল গাফফার খানও পাকিস্তানের একটি শিরঃপীড়া। এই বর্ষায়ান পাখতুন নেতা এখনও পাকিস্তান-সৃষ্টি মেনে নিতে পারেননি। কাশ্মীর পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হয়ে গেলে পাখতুনিস্তানের পৃথক হওয়ার দাবি এমনিই মিইয়ে যাবে, এ রকমই হয়তো ভেবেছিলেন জিন্না।
কিন্তু মাসুদ-ওয়াজির-আফ্রিদি উপজাতীয়দের অভিযানে তেমনভাবে সাড়া দিল না কাশ্মীরীরা। কাশ্মীরে পাকিস্তানের স্বপক্ষে কোনো গণ-অভ্যুত্থান হলো না। বরং কাশ্মীরের হিন্দু রাজা সাহায্য প্রার্থনা করলেন ভারতের কাছে। জননেতা শেখ আবদুল্লাও ছুটে এলেন দিল্লিতে।
টেকনিক্যালি একটি স্বাধীন রাজ্যে ভারত নিজস্ব ফৌজ পাঠাতে পারে না। যেমন, পাকিস্তানী ফৌজ তো কাশ্মীর আক্রমণ করেনি, ঢুকে পড়েছে উপজাতীয়রা। যদিও ভারত ও পাকিস্তানের দু দেশের নেতারাই কাশ্মীর সম্পর্কে লোলুপ। কাশ্মীরের রাজা এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেনসের নেতা শেখ আবদুল্লার অনুরোধে ভারত সরকারের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটন কাশ্মীরের ভারতভুক্তিতে সম্মতি দিলেন আগে, তারপর ফৌজ পাঠালেন।
জিন্না সাহেব তাঁর অকাল মৃত্যুর আগে কাশ্মীর নামে রঙিন পালকটি তাঁর শিরোভূষণে দেখে যেতে পারলেন না। যদিও কাশ্মীর সমস্যা রয়েই গেল। ভারতের দক্ষিণপন্থী নেতা বল্লভভাই প্যাটেলের কাশ্মীরকে নিষ্কন্টক করার আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও মুজাহিদ বা হানাদার বাহিনীকে ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেল যুদ্ধ। কাশ্মীর প্রশ্নটি চলে গেল রাষ্ট্রসংঘে। তারপর যুদ্ধ বিরতি সীমারেখায় পাকিস্তানের আধিপত্যমূলক এক অংশের নাম হলো ‘আজাদ কাশ্মীর’, আর ভারতীয় অংশের নাম রইলো শুধু কাশ্মীর, যেন সেটাই আসল কাশ্মীর, ক্রমে সেটি ভারতীয় একটি অঙ্গ রাজ্য হয়ে গেল। দু দুটো সাধারণ নির্বাচন হলো সেখানে, তা ছাড়া কাশ্মীরী নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এসে আসন নিলেন ভারতীয় লোক সভায়। নীতির দিক দিয়ে এই কাশ্মীরের ভারতভুক্তি নিশ্চিত যুক্তিসিদ্ধ নয়। কিন্তু আইনের দিক দিয়ে কোনো খুঁত রইলো না।
সুতরাং পঁয়ষট্টি সালে যখন আবার যুদ্ধ বাঁধলো, তখন ভারতের পক্ষ থেকে বলা হলো, এটা তার একটা অঙ্গ রাজ্য আক্রমণেরই সমান। মাত্র কয়েক মাস আগেই কচ্ছের রানে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ হয়ে গেছে। গুজরাট সংলগ্ন ঐ অনুর্বর, বালিয়াড়ি ও গাধা-খচ্চর অধ্যষিত অঞ্চলটি নিয়ে দু’ দেশের অস্ত্ৰক্ষয় চললো কয়েকদিন। তারপর সুমতি ফিরে এলো দু’ দেশের। শান্তি চুক্তির সইয়ের সময় কলমের কালি শুকোতে না শুকোতেই আবার কাশ্মীরে যুদ্ধ।
ভারত কাশ্মীরের বৃহত্তর অংশটি নিজের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেও ঠিক হজম করতে পারেনি। মুসলমান প্রধান কাশ্মীরকে তোয়াজ করার জন্য ভারত সরকার খাদ্য ও শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে কতকগুলি বিশেষ সুযোগ-সুবিধে দিয়ে আসছিল। তার প্রতিক্রিয়া হলো দু রকম। যাদের বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তারা সন্দেহ করে, তারা প্রশ্ন করে, তারা জানতে চায়, ব্যাপারটা কী? আমরাও যদি সমান ভারতীয় হই, তা হলে অন্যান্য ভারতীয়দের থেকে আমরা সুযোগ। সুবিধে বেশি পাবো কেন? কাশ্মীরে চালের দাম কেন এত কম, কেন কাশ্মীরের বেতার কেন্দ্রের নাম কাশ্মীর রেডিও, কেন পশ্চিমবাংলা বা মহারাষ্ট্রের মতন অল ইন্ডিয়া রেডিও নয়? আবার ভারতের অন্যান্য রাজ্যের কিছু কিছু লোক চিন্তা করতে লাগলো, কাশ্মীর যদি ভারতের অন্তর্গত একটি রাজ্যই হয় তা হলে সেখানকার লোকরা বিশেষ সুযোগ-সুবিধে পাবে কেন! কেন ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে যে-কেউ গিয়ে কাশ্মীরে বসতি স্থাপন করতে পারবে না? কেন অন্য ভারতীয়দের কাশ্মীরে যেতে গেলে পারমিট লাগবে? এসব তো গণতন্ত্র-বিরোধী ব্যাপার। এই প্রশ্ন নিয়েই হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কাশ্মীরে গেলেন এবং অকস্মাৎ বন্দী অবস্থায় রহস্যময় ভাবে মৃত্যুবরণ করলেন।
ভারত সরকারের এই তোষণ নীতি কাশ্মীরী রাজনীতিতেও অনেক পরিবর্তন ঘটিয়ে দিল। এখন পাকিস্তানের দিকে একটু ঝুঁকে কথা বললেই ভারত সরকারের কাছ থেকে বেশি খাতির পাওয়া যায়। এ তো বেশ মজার ব্যাপার। ভারত-বিরোধী একটা বিক্ষোভ মিছিল বার করো, দিল্লি থেকে আরও চাল-ঘি আসবে। তা ছাড়া ভারত-পাকিস্তান বিবাদে ধর্মপ্রাণ কাশ্মীরীরা পাকিস্তানকেই সমর্থন জানাবে, ইসলামের বন্ধন তো অস্বীকার করা যায় না, ভারতের সঙ্গে তাদের কিসের আত্মীয়তা?
এতগুলি বছরে শেখ আবদুল্লারও মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে অনেক। কাশ্মীরীদের, একচ্ছত্র নেতা হয়ে থাকতে গেলে তাঁর পক্ষে পাকিস্তানকে অস্বীকার করা অসম্ভব। পুরোপুরি ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় না দিয়ে তিনি দাবি তুললেন স্বায়ত্তশাসনের। দেশ বিভাগের ঠিক পর পরই নেহরু একবার কাশ্মীরে প্লেবিসাইটের কথা বলে ফেলেছিলেন, শেখ আবার খুঁচিয়ে তুললেন সেই প্রস্তাব। কাশ্মীরের জনসাধারণেরও খুব পছন্দ হলো এটা। টাঙ্গাওয়ালা, শিকারাওয়ালা থেকে শুরু করে ছাত্র ও ব্যবসায়ীরা সবাই ধ্বনি তুললো, হমারা মুতলবা রায় সুমার! রায় সুমার ফওরন করো। আমাদের দাবি গণভোট, গণভোট পালন করো!
এই রকম একটা অবস্থায় কাশ্মীরে একটা যুদ্ধ লাগানোতে পাকিস্তান ও ভারত, এই দুই দেশেরই স্বার্থ আছে। কাশ্মীরে ভারত-বিরোধী হাওয়া বইছে, এই সুযোগে পাকিস্তান যদি মুজাহিদ ও সৈন্য পাঠায়, তা হলে কাশ্মীরীরা তাদের সাদরে বরণ করে নেবে। কাশ্মীরে একটা গণ-অভ্যুত্থান হবে, ভারত বাধা দিতে এলে বিশ্ববাসীকে বোঝানো যাবে যে ভারত জোর করে কাশ্মীরকে কুক্ষিগত করে রেখেছে!
আর ভারতের পক্ষেও কাশ্মীরের গণভোটের দাবি বা স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব বর্তমানে মেনে নেওয়া অসম্ভব। কাশ্মীর এখন ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য, সেখানে যদি স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তা হলে ভারতের অন্যান্য মুসলমান প্রধান অঞ্চলেও যে-কোনো দিন এরকম দাবি উঠবে। শুধু ধর্মীয় কারণে কেন, ভাষাগত, উপজাতিগত কারণেও এরকম দাবি উঠবে, ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। সুতরাং কাশ্মীর সীমান্তে এখন বড় রকম একটা যুদ্ধ বাধিয়ে দিলে গণভোটের প্রশ্ন ধামা চাপা পড়ে যেতে বাধ্য।
যে পক্ষই আগে শুরু করুক, যুদ্ধ একটা লাগলো কাশ্মীরে। সেখানে গণ অভ্যুত্থান হলো না, লড়াই করতে লাগলো ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্যরা।
যুদ্ধে যত গোলাগুলি ওড়ে, সেই তুলনায় মিথ্যে কথাও কম ছোঁড়াছুড়ি হয় না। যুদ্ধের প্রথম দিকে দু পক্ষই সমানভাবে জেতে। খবরের কাগজগুলির পোয়াবারো। সরকারি মিথ্যে তথ্য তো আছেই, তার ওপর নিজস্ব সংবাদদাতারা অনেকগুণ রঙ চড়ায়। পাকিস্তানের মানুষ বেতার ও সংবাদ পত্র মারফত জানলো যে পাকিস্তানী বীর সৈনিকদের হাতে ভারতীয় সৈনিকরা পোকা মাকড়ের মতন মরছে। একজন পাকিস্তানী সৈনিক দশজন ভারতীয়ের সমান, মরলে শহীদ, মারলে গাজী হওয়ার উদগ্র বাসনা নিয়ে তারা যুদ্ধে নেমেছে। আর ভারতে বেতার সংবাদপত্রে প্রচারিত হচ্ছে যে ভারতীয় সেনাদের সামনে পাকিস্তানীরা দাঁড়াতেই পারছে না, ছামব সেকটরে তারা পিছু হটছে, হাজি পীর গিরিবর্ত্য অনায়াসে ভারতের দখলে ইত্যাদি। এ পক্ষের বিমান ওপক্ষের বিমানবাহিনী ধ্বংস করে নিশ্চিন্তে ফিরে আসছে। ওদের ট্যাংকগুলি টিনের তৈরি, আমাদের গোলা লাগলেই ঘায়েল হয়, আমাদের ট্যাংকগুলি অভেদ্য, বোমাও হজম করে নেয়।
অঘোষিত যুদ্ধ, তবু তাতেও মানুষ মরে, জলের মতন অর্থের অপব্যয় হয়। পৃথিবীর ধনী ও শক্তিশালী দেশগুলি হাসে। তাদেরই কাছ থেকে কেনা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দুটি চরম গরিব দেশ, যারা মাত্র সতেরো বছর আগে ছিল একই জাতি, এখন শিশুর মতন মারামারি করছে।
সংঘর্ষ চলছিল কাশ্মীরে, আচম্বিতে ভারতের সেনাপতি জয়ন্তনাথ চৌধুরী লাহোর সেকটারে আক্রমণ করে বসলেন। ভারতীয় সংবাদপত্রগুলি চেঁচিয়ে উঠলো, লাহোর নগরীর পতন আসন্ন! কাশ্মীর সীমান্তে শক্তি সংহত করায় পাকিস্তান লাহোর সেকটারে ধরা পড়ে গেল খানিকটা অপ্রস্তুত অবস্থায়। তা হলে কি ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ হবে? এবারে কি পূর্ব পাকিস্তানও আক্রান্ত হবে?
ভারতীয় উপমহাদেশের এক প্রান্তে কাশ্মীর, আর এক প্রান্তে বাংলা। এই বাংলা আগেই দু’খণ্ড হয়েছিল, এবারে কাশ্মীরকে উপলক্ষ করে বাঙালী জাতিও সত্যিকারের দ্বিখণ্ডিত হলো। দু’ দিকের নাগরিকদের তবু যা কিছু যাতায়াত ছিল তা বন্ধ হয়ে গেল একেবারে। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়ি-জমি শত্রু-সম্পত্তি বলে ঘোষিত হলো, গ্রেফতার হতে লাগলো সেখানকার গণ্যমান্য হিন্দুরা। নিষিদ্ধ হলো রবীন্দ্র সঙ্গীত। এক শ্রেণীর কবি সাহিত্যিক দেশাত্মবোধের নামে উগ্র গল্প কবিতা লিখতে লাগলেন!
পশ্চিমবাংলাতেও অবস্থা প্রায় একই রকম। যুদ্ধের সময় নানারকম প্রচারযন্ত্রে মারাত্মক এক ধরনের কৃত্রিম দেশাত্মবোধ চাগিয়ে তোলা হয়। সাধারণ মানুষের মনোভাব হলো এই যে, এবারে পাকিস্তান নামের দেশটাকে একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হোক। যে-কোনো পাকিস্তানী মানেই যেন ব্যক্তিগত দুশমন। মুসলমান মাত্রই যেন পাকিস্তানের স্পাই। হুমায়ুন কবীর, শা নওয়াজ খান প্রমুখ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সম্পর্কেও সন্দেহ তোলা হলো, পাকিস্তানের সঙ্গে ওঁদের গোপন যোগাযোগ আছে কি না। লোকসভার সদস্য সৈয়দ বদরুদ্দোজা এবং আরও ৩৫০ জনকে আটক করা হলো ভারতরক্ষা আইনে। সৈয়দ মুজতবা আলি, আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতন শ্রদ্ধেয় লোকদের সম্পর্কেও শোনা যেতে লাগলো ফিসফাস। সৈয়দ মুজতবা আলি শান্তিনিকেতন থেকে মর্মান্তিক ক্ষোভের সঙ্গে এক তরুণ লেখককে চিঠিতে জানালেন, তুমি শোনোনি, চারদিকে গুজব ম ম করছে যে আমি পাকিস্তানের স্পাই!
যুদ্ধ মানেই ঘৃণা, অবিশ্বাস। যারা যুদ্ধ-বিরোধী, তারাও এই সময়ে কণ্ঠ তুলতে সাহস পায় না।
পূর্ব পাকিস্তানে এই যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত রকম রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে গেল। গভর্নর মোনেম খান লাট ভবনে সমস্ত বিরোধী নেতাদের ডেকে পাঠিয়ে বললেন, আপনারা যুদ্ধের সরকারি ব্যবস্থা সমর্থন করে যুক্ত বিবৃতি দিন!
মৌলভীরা ঘোষণা করলো জেহাদ। কেউ কেউ কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে মসজিদে যেতে লাগলো নামাজ পড়তে, জেহাদের সময় তা সুন্নত। মেয়েরা শুরু করলো কুচকাওয়াজ। তরুণরা শপথ নিল দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও পাকিস্তানকে রক্ষা করবে। ছাত্র সমাজে আলোচনা চলতে লাগলো যে আইয়ুব খাঁ-কে যাবজ্জীবন প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাব তোলা যায় কিনা! পূর্ব পাকিস্তানেও আইয়ুব হয়ে উঠলেন দারুন জনপ্রিয়।
কিন্তু যুদ্ধের আওয়াজ শুধু শোনা যেতে লাগলো রেডিওতে। আর কোথায় যুদ্ধ? সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পশ্চিমীরা যেন পূর্ব পাকিস্তানের কথা ভুলেই গেছে। ভারতীয় বাহিনী লাহোর আক্রমণের পর হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট লোকদের খেয়াল হলো যে, এই দিকটা তো সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ভারত যদি চায় তো একদিনেই পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিতে পারে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য যত খরচ, কামান-বিমান আর সৈন্যবাহিনী পোষা, সবই শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য? পূর্ব পাকিস্তানীরা অর্থ জুগিয়ে যাবে, ফল ভোগ করবে পশ্চিমীরা। ভারত তাদের শত্রু,কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরাও তাদের আপনজন মনে করে না! পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের রক্ষা করবে কে?