2 of 3

২.২৯ অতীনদের স্টাডি সার্কল

অতীনদের স্টাডি সার্কল মানিকতলার মোড় থেকে সরে গেছে আরও উত্তরে। গ্রে স্ট্রিট আর সার্কুলার রোডের মোড়ের কাছে। খান্না সিনেমার পাশে এক ফ্ল্যাট বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছে। বাড়িটাতে নানান জাতের পাঁচমিশেলি লোকেরা থাকে, কে কখন আসে যায়, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ঘরখানা সাবলেট করেছেন মানিকদার এক বন্ধু আবিদ আলি; এই ভদ্রলোক এক সময় এ ডিভিশনে ফুটবল খেলতেন, এখন ছিট কাপড়ের ব্যবসা করেন। মানুষটি অকৃতদার ও সুরসিক।

মানিকতলার ঘরটা ছাড়তে হলো কারণ পমপমের বাবা অশোক সেনগুপ্তর সঙ্গে ওদের অনেকেরই মতপার্থক্য দিন দিন বাড়ছিল। তাত্ত্বিক আলোচনা ও তর্ক বিতর্ক প্রায়ই পর্যবসিত। হচ্ছিল তিক্ততায়। ভারতীয় কর্মানিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হবার পরেও কোনো কোনো নেতা দু নৌকোয় পা দিয়ে রাখতে চাইছিলেন। অতীনদের গুরু মানিক ভট্টাচার্যের মতে অশোকদা সেই রকমই একজন। তিনি মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট পার্টিকেও পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির দিকে নিয়ে যেতে চান বলে মানিকদার দারুণ রাগ।

পমপমদের বাড়ি ছেড়ে আসা হলে পমপম এই স্টাডি সার্কল ছাড়েনি। পমপমের মা নেই, যদিও তাদের বাড়িতে মাসি-পিসির সংখ্যা অনেক। ওদের বর্ধমানের গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায়ই কেউ না কেউ এসে এখানে থেকে যায়, কিন্তু পমপমের সঙ্গে বাড়ির সম্পর্ক খুব কম। রোগা, লম্বাটে চেহারা পমপমের, চোখ দুটো যেন বেশি উজ্জ্বল, সে কক্ষনো সাজগোজের ধার ধারে না, তার কাঁধে সব সময় একটা শান্তিনিকেতনী কাপড়ের ব্যাগ ঝোলে। একদিন কংগ্রেসী ছেলেদের গুণ্ডামি প্রসঙ্গে আলোচনার সময় পমপম খুব ক্যাজুয়ালি সেই ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা রিভলভার বার করে বলেছিল, আমার সঙ্গে ওরা কেউ বাঁদরামি করতে এলে আমি সোজা কপাল ফুটো করে দেবো।

পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল যে ওটা খেলনা পিস্তল। আবার এ খবরও জানা গিয়েছিল যে পমপমদের মেমারির বাড়িতে অনেকদিন ধরেই আসল বন্দুক আছে এবং পমপমের দাদু নিজে তাঁর প্রিয় নাতনীকে বন্দুক ছোঁড়া শিখিয়েছিলেন। পমপম সহজ মেয়ে নয়। সে পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে এম এ পড়ছে, আবার সে গাছপালাও ভালো চেনে। এক বিঘে জমিতে কতটা সার, কতটা জল, কতদিনের মজুরি দিলে কতখানি ফসল পাওয়া যায়, সে বিষয়ে স্টাডি সার্কেলের সদস্যদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বেশি জানে। পমপম তার বাবার চেয়ে মানিকদার বেশি ভক্ত মনে হয়। পমপমের একটাই দোষ, সে প্রায় হাসেই না বলতে গেলে। তার ঠোঁটে হাসি দেখা অতি দুর্লভ ঘটনা। অতীন একদিন তাকে বলেছিল, এই, তুই জানিস না, গম্ভীর মুখে ঠোঁট দুটো থাকে সোজা, আর হাসলে ঠোঁটে একটা ঢেউ খেলে যায়। ঢেউ খেলানো ঠোঁটেই মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়!

এর উত্তরে ঠোঁটে কোনো ঢেউ না খেলিয়েই পমপম বলেছিল, আসুক আগে সে রকম দিন আসুক, তখন আনন্দ করে হাসবো।

পমপম ছাড়া আরো দুটি মেয়ে আসে ষ্টাডি সার্কেলে, অনীতা আর শুভ্রা, কিন্তু তারা আবার বড্ডই মেয়ে মেয়ে! কথা বলতেই চায় না, কথা বলার সময় বারবার আঁচল ঠিক করে।

অতীনকে এখানে প্রথম এনেছিল তার বন্ধু কৌশিক। ওরা সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও দু’ জনের স্বভাবে বেশ বৈপরীত্য আছে। কৌশিকের মুখে চোখে একটা সরল আদর্শবাদের আলো জ্বলে,সে এই পৃথিবীটাকে বদলাতে চায়। কৌশিকের ব্যক্তিগত চরিত্রও খুব নির্মল, তার বিশ্বাসের সঙ্গে তার জীবনযাত্রার কোনো অমিল নেই। কৌশিক খারাপ কথা তো বলেই না, তার মুখ দিয়ে সামান্য একটা মিথ্যে কথা বার করাও প্রায় অসম্ভব। বন্ধুরা অনেকবার এরকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।

সেই তুলনায় অতীনের কোনো মূল্যবোধেই স্থির দৃঢ় বিশ্বাস নেই, আদর্শবাদীদের বক্তৃতাকে তার মনে হয় বড় বড় কথা, যে কোনো আলোচনাতেই উপদেশের গন্ধ পেলে সে নাক কুঁচকোয়, সে যে-কোনো মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে ভণ্ডামির চিহ্ন আছে কি না তা খোঁজার চেষ্টা করে। এই কারণেই সমাজের অনেক শ্রদ্ধেয় মানুষ তার চোখে অবজ্ঞার যোগ্য। এবং এক মাত্র এই কারণেই সে কৌশিককে ভালোবাসে।

কৌশিকের কথায় সে প্রথম এই স্টাডি সার্কেলে এসে যোগ দিয়েছিল। আস্তে আস্তে মানিকদাকেও তার পছন্দ হয়। মানিকদার সব মতামত সে মেনে নিতে পারে না, কিন্তু সে বুঝেছে যে মানুষটা খাঁটি। মানিকদা ইংরিজির ভালো ছাত্র ছিলেন, কিন্তু চাকরি-বাকরির চেষ্টা করেন নি, পার্টিতেও উঁচু পদের দিকে ঝোঁক নেই। তিনি অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশে তাদের মধ্য থেকে বেছে বেছে ভালো পার্টি ওয়ার্কার তৈরি করার কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেছেন।

এই মানিকদার মধ্যে অতীন যেন তার দাদার খানিকটা মিল খুঁজে পায়। চেহারা বা ব্যবহারে কোনো মিল নেই, শুধু কথা বলার ধরনটা যেন কিছুটা পিকলুর মতন। অতীনের ধারণা, তার দাদা বেঁচে থাকলে সাধারণ ছেলেদের মতন চাকরিবাকরির দিকে না ঝুঁকে এই মানিকদারই মতন কোনো একটা আদর্শ নিয়ে থাকতো।

প্রথম দিকে খানিকটা কৌতূহল আর খানিকটা অবজ্ঞার ভাব নিয়ে এলেও অতীন এখন এই স্টাডি সার্কেলের সঙ্গে অনেকটা জড়িয়ে গেছে। ইউনিভারসিটিতে ইলেকশানের সময় কংগ্রেসী ছেলেদের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে অতীন, মাথায় চোট লেগেছিল, তারপর থেকে তার জেদ আরও বেড়ে যায়।

এখন থেকে বাড়ি ফিরতে প্রায়ই বেশ রাত হয়ে যায় অতীনের। আলোচনা ও তর্কাতর্কি শেষ হতেই চায় না, অতীনেরও এই আড্ডা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। এক একদিন তেলেঙ্গানা ও কাকদ্বীপের তে-ভাগা আন্দোলনের কাহিনী শুরু হয়, আবিদ আলি সাহেবের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে কাকদ্বীপের আন্দোলনের, কংসারি হালদার নামে একজন বিপ্লবী নেতা সম্পর্কে এমন সব গল্প বলেন তিনি যা শুনতে শুনতে অতীনদের রোমাঞ্চ হয় শরীরে।

রাত সাড়ে নটা-দশটার পরেও খান্না সিনেমা সংলগ্ন এই অঞ্চলটি মানুষজনের ভিড়ে বেশ রমরম করে। কাছেই একটি বৃহৎ বাজার, রাস্তার ওপাশে আশুতোষ অয়েল মিলের গা ঘেঁষে লম্বা বেশ্যা পল্লী। ট্রাম লাইন থেকে মাত্র দু’ তিন হাত দূরে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে মুখে ফটফটে সাদা রং মাখা নানা বয়েসী স্ত্রীলোকেরা।

স্টাডি সার্কল থেকে বেরিয়ে অতীন আর কৌশিক গ্রে স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে হাতিবাগানের মোড়ের কাছে। অন্য অনেকেই উত্তর কলকাতায় থাকে, শুধু ওদের দু’জনের বাড়ি সুদূর দক্ষিণে। এখান থেকে ওরা টু-বি বাস ধরে, তাতে একটানা চলে যাওয়া যায়।

এক রাতে প্রায় খালি একটা দোতলা বাসে উঠতে গিয়েও কৌশিক অতীনের হাত চেপে ধরে বললো, এটা ছেড়ে দে, পরের বাসে যাবো।

রাতের দিকে বাসের সংখ্যা কমে আসে, পরের বাসের জন্য অন্তত মিনিট পনেরো অপেক্ষা করতে হবে, অতীন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার?

সেই স্টপ থেকে তিন চারজন তোক ওঠার পর বাসটা ছেড়ে দিয়েছে। পা-দানিতে দাঁড়ানো ধুতি ও শাদা হাফ শার্ট পরা একটা লোক মুখ ঘুরিয়ে বিস্মিতভাবে কৌশিক ও অতীনকে দেখলো। তার মুখের ভাবটা এমন যেন সে নিজে বাসে উঠে পড়লেও তার অন্য সঙ্গীরা উঠতে পারে নি, রয়ে গেল।

কৌশিক বললো, ঐ লোকটাকে দেখলি? ও রোজ খান্না সিনেমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা বেরুনর পর এক একদিন আমাদের এক একজনকে বাড়ি পর্যন্ত ফলো করে!

অতীন বললো, যাঃ!

কৌশিক বললো, তুই লক্ষ করিস নি? কাল দেখিস। তপন আর উৎপলকে দুতিনদিন একজন ধুতি আর শার্ট পরা লোক ফলো করে বাড়ি পর্যন্ত গেছে। আমাদের বাড়ির ঠিকানা জেনে রাখছে।

–লোকটা কে?

–পুলিসের ইনফর্মার হতে পারে। সি আই এর কোনো দালাল হতে পারে। আমাদের ওপর নজর রাখছে। কংগ্রেস গভর্নমেন্ট জ্যোতিবাবু, প্রমোদ দাশগুপ্তকে অ্যারেস্ট করেছে, এরপর পার্টির অনেক ওয়ার্কারকে রাউন্ড আপ করবে বলে শোনা যাচ্ছে।

অতীনের ঠিক বিশ্বাস হয় না। সে বা কৌশিক কেউই পার্টির কার্ড হোল্ডার নয়। মানিকদার কাছে তারা পার্টির মেম্বারশীপ পাবার জন্য আবেদন জানিয়েছিল, মানিকদা বলেছেন, এখনও সময় হয়নি। তবু পুলিস তাদের এতখানি গুরুত্ব দেবে? তাদের স্টাডি সার্কল তো গোপন কিছু ব্যাপার নয়, প্রায়ই তাতে নতুন ছেলেমেয়েরা যোগ দিতে আসে। তা ছাড়া, শুধু ঘরের মধ্যে তো নয়, এক একদিন কফি হাউস থেকে বেরিয়ে কলেজ স্কোয়ারে ঘাসের ওপর বসে আড্ডা মারে। সেখানেও তো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে এইসব বিষয়েই কথা হয়।

ওরা পরের বাসটা ধরলো এবং পরবর্তী স্টপে সেই ধুতি-শার্ট পরা লোকটা উঠলো। সে নেমে গিয়ে অতীনদের জন্যই অপেক্ষা করছিল? কৌশিক অতীনের গায়ে ঠেলা দিয়ে চুপিচুপি বললে, দেখলি? আমরা এসপ্লানেডে নেমে পড়ে একটু ঘুরে ফিরে তারপর অন্য বাস বা ট্রাম ধরবো।

অতীন ভালো করে লক্ষ করলো লোকটাকে। বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। বাসের ভেতরে ঢোকেনি, পাদানিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে, অতীনদের দেখছে না, চেয়ে আছে রাস্তার দিকে।

অতীন কৌশিককে বললো, চুপ করে বসে থাক। আমরা একসঙ্গে কালীঘাটে নামবো। ঐ লোকটাও যদি আমাদের সঙ্গে নামে আমি ওর কলার চেপে ধরবো। যদি পুলিস হয়, বলবো ওয়ারেন্ট দেখাও! যদি তা দেখাতে না পারে রামধোলাই দেবো শালাকে। আমার সঙ্গে চালাকি না!

কৌশিক বললো, চুপ কর, অতীন!

অতীন বললো, কেন, ভয় কিসের রে! কনস্টিটিউশনে ফ্রিডম অফ স্পীচের গ্যারান্টি দিয়েছে, তাও পেছনে পুলিশ লাগবে? মামদোবাজি নাকি?

অতীন আর কৌশিক বসেছে একতলায়, লোকটা গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো, ভেতরে এলো না, বৌবাজার মোড়ের কাছে হঠাৎ নেমে গেল।

অতীন কৌশিককে কনুই দিয়ে খোঁচা মারতেই সে বললো, ও বুঝতে পেরে গেছে যে আমরা ওকে চিনে ফেলেছি। কাল থেকে অন্য লোক লাগবে।

অতীন বললো, তাকেও আমরা চিনে ফেলবো।

–শোন অতীন, তোকে একটা কথা বলবো? আমিই তো তোকে স্টার্ডি সার্কলে এনেছিলুম, আমিই রিকোয়েস্ট করছি, তুই এখন কিছুদিন এখানে আসা বন্ধ করে দে।

–কেন?

–তোর এবার ফাইনাল পরীক্ষা। যদি সত্যিই পুলিস ধরে-টরে—

–তার মানে। ফাইনাল পরীক্ষা আমার একার?

–আমি এবার ড্রপ করছি। আমার প্রিপারেশন ভালো হয়নি, আমি সামনের বছর দেবো।

কৌশিকের একথার গুরুত্ব দিল না অতীন। সে বললো, ড্রপ করবি মানে? আমি ঘাড় ধরে তোকে পরীক্ষায় বসাবো। তুই ড্রপ করলেও আমি শান্তনু আর নির্মলকে ডিঙিয়ে টপ পজিশনে পৌঁছোতে পারবো না।

–আমি সিরিয়াসলি বলছি, অতীন। হঠাৎ যদি আমাদের জেলে ভরে দেয়…

–জেলের ভেতরটা আমার একবার ঘুরে দেখে আসার ইচ্ছে আছে। জেলে বসেও তো পরীক্ষা দেওয়া যায়।

–আমাদের পলিটিক্যাল প্রিজনারদের স্টেটাস দেবে না। বিনা বিচারে আটক করে চোর ডাকাতদের সঙ্গে রাখবে।

–ধ্যাৎ! তুই বেশি রোমান্টিসাইজ করছিস!

পরদিন সেই ধুতি-হাফশার্ট পরা লোকটিকে খান্না সিনেমার আশেপাশে আর দেখা গেল না। তার বদলে আর কেউ এসেছে কিনা সেদিকে নজর রাখলো অতীনরা। সেরকম চেনা গেল না কারুকে। যদিও, মানিকদারও ধারণা, তাদের স্টাডি সার্কলের প্রতি পুলিসের নজর পড়েছে।

অতীন একদিন অলিকে নিয়ে এলো এখানে। সপ্তাহে অন্তত একদিনও দেখা না হলে অলি অভিমান করে। অতীন সময় পায় না। সেইজন্যই সে ঠিক করলো, অলিকে সে সপ্তাহে একদিন দুদিন অন্তত স্টাডি সার্কলেই নিয়ে আসবে। কলেজ যাওয়া ছাড়া অলি একা একা বাইরে কোথাও বেরোয় না। তাই বাইরের জগৎটা চেনে না। পমপমের মতন মেয়ের সঙ্গে কয়েকদিন মিশলে অলি অনেককিছু শিখবে।

প্রথম দিন অলি আগাগোড়া প্রায় চুপ করে বসে রইলো। পমপম তার সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করেও বেশি কথা বলতে পারলো না। সেদিন একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েও অলিকে যখন বাড়ি পৌঁছে দিল অতীন, তখন রাত সাড়ে নটা। এত দেরিতে অলি কখনো বাড়ি ফেরে না। অতীন তাকে কলেজ থেকে ফেরার পথে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, অলি বাড়িতে খবর দেবারও সময় পায়নি। বাড়ির সবাই উৎকণ্ঠিত, বিমানবিহারী বাইরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁর মেয়ে বাবলুর সঙ্গে ফিরছে দেখে তিনি অনেকটা স্বস্তি বোধ করলেন।

অতীন জানে, অলিকে তার বাবা-মা তুলোয় মোড়া বাক্সে আদরে যত্নে রাখতে চান। কুমারী মেয়ের সাড়ে নটায় বাড়ি ফেরা ওঁদের পক্ষে অকল্পনীয়। কিন্তু ওঁদের খানিকটা কালচার শক দেওয়া দরকার। ছেলেরা দেরি করে ফিরতে পারে, আর মেয়েরা একটু দেরি করলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

দুদিন বাদে অতীন অলিকে জিজ্ঞেস করলো, কীরে, তুই আবার যাবি আমার সঙ্গে ওখানে?

অলি বিনা দ্বিধায় বললো, হ্যাঁ।

সেদিন বাড়িতে অলি বকুনি খেয়েছে কিনা তা কিছুতেই স্বীকার করলো না। অলি তার বাবা-মায়ের কাছে মিথ্যে কথা বলেনি, বাবলুদার সঙ্গে সে কোথায় গিয়েছিল তা জানিয়েছে। তার বাবা-মায়ের কোনো আপত্তি নেই। তবে, যেদিন সে ওখানে যাবে, সেদিন বাড়িতে জানিয়ে যেতে হবে।

অতীন দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করলো, আর স্টাডি সার্কেলে যাবার নাম করে আমি যদি তোকে অন্য কোথাও নিয়ে যাই?

অলি বললো, অন্য কোথাও মানে?

অতীন বললো, এই ধর, ডায়মন্ড হারবার। সেখানে নদীর ধারে বালিতে দু’জন শুয়ে থাকবো।

অলি অতীনের দিকে গাঢ় ভাবে কয়েক পলক চেয়ে থেকে বললো, বাবলুদা, তুমি কোনোদিন আমায় ডায়মন্ডহারবার নিয়ে যাবে না তা আমি ভালোই জানি। তুমি যে সবসময় ব্যস্ত। আমি ডায়মন্ডহারবারে বাড়ির লোকদের সঙ্গে দুতিনবার গেছি। তুমি নিশ্চয়ই কখনো যাওনি। তুমি যদি চাও, আমি তোমায় একদিন ট্রেনে করে নিয়ে যেতে পারি সেখানে। কিন্তু

সেখানে নদীর ধারে বালি নেই, শুধু কাদা, শুয়ে থাকা যায় না।

হঠাৎ অতীনের মনে পড়ে গেল একটা বিশেষ দিনের কথা। স্কুলে পড়ার সময় সে অলির মুখে ডায়মণ্ড হারবার বেড়ানোর গল্প শুনেছিল। তার খুব লোভ আর ঈর্ষা হয়েছিল। অমন একটা সুন্দর জায়গা অলি দেখেছে, অথচ সে দেখে নি! কে তাকে নিয়ে যাবে?

সেই বিশেষ দিনটিতে, বাগবাজারের গঙ্গার ধারে, মা আর পিসিমনির শাড়ি-টাড়ি পাহারা দিতে দিতে তার দাদা পিকলু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে একদিন বাবলুকে ডায়মণ্ড হারবার নিয়ে যাবে। সে প্রতিশ্রুতি রাখে নি দাদা। সম্ভবত সেটাই ছিল দাদার শেষ কথা…

দৃশ্যটা মনে পড়লেই অতীনের যেন দমবন্ধ হয়ে আসে, চতুর্দিকে নীল জল, সেই জল তাকে টানছে…

দৃশ্যটা মুছে ফেলার জন্য অতীন মাথা ঝাঁকালো, সিগারেট ধরালো। স্মৃতি যেন মাকড়সার জাল, তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সিগারেটের ধোঁয়া, অলি আর তার মাঝখানে একটা পর্দা নেমে আসছে। ঠিক পদ সরাবার ভঙ্গিতে হাত তুললো অতীন।

তারপর মুখ ফিরিয়ে বললো, তুই একদিন আমাকে নিয়ে যাস তো ডায়মন্ডহারবার। ওখান থেকে কাকদ্বীপটা দেখে আসবো।

দুতিন দিন স্টাডি সার্কলে এসেও অলির ঠিক পছন্দ হলো না জায়গাটা। যেসব কথা সে বইতে আগেই পড়েছে, সেইসব কথাই অনেকে এখানে এমন ভাবে গলা ফুলিয়ে জোর দিয়ে বলে, যেন নতুন কথা। এরা কি বই পড়ে না? পমপম নামের মেয়েটি গ্রাম জীবনের সাহিত্যের আলোচনা করতে গিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা করে বিভূতিভূষণ আর তারাশঙ্করকে খুব গালাগালি দিল। অথচ অলির এই তিনজনের লেখাই ভালো লাগে। পমপম এককথায় আরণ্যক উপন্যাসটিকে খারিজ করে দিল, অলির সন্দেহ হলো পমপম বোধহয় আরণ্যক পড়েইনি। বাবলুদা এইসব বই পড়ে না, অলি তা জানে। কৌশিকও কি পড়ে না? মানিকদা বললেন চীনা লেখক লু সুনের লেখা পড়তে, অলি লু সুনের কয়েকটি গল্পের অনুবাদ আগেই পড়েছে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারলো না সেকথা।

তারপর এই শনিবারের রাতটা অলির বহুকাল মনে থাকবে।

স্টাডি সার্কল থেকে বেরিয়েই সে রাতে ওরা একটা বিরাট হাঙ্গামার মধ্যে পড়ে গেল। সার্কুলার রোডের দুপাশে কয়েকশ লোক জড়ো হয়ে ইঁট ছুঁড়ছে, দুম দাম করে ফাটছে বোমা। কী নিয়ে যে গণ্ডগোল তা বোঝা যাচ্ছে না।

অলির হাত শক্ত করে চেপে ধরে বাবলু বললো, তুই ঘাবড়াসনি, এসব এ-পাড়ার গুণ্ডা আর মাতালদের ব্যাপার, এরকম প্রায়ই হয়। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের দিকটায় গেলেই ফাঁকা হয়ে যাবে।

কিন্তু গ্রে স্ট্রিট ধরে বেশিদূর এগোনো গেল না, স্টার থিয়েটারের পাশের গলি দিয়ে একদল লোক সোডার বোতল ছুঁড়তে ছুঁড়তে দৌড়ে এলো এদিকেই। কৌশিক চেঁচিয়ে বললো, পেছনে পুলিসের গাড়ি। ওরা আমাদের আগে ধরবে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওরা ছিটকে গেল আশেপাশের গলিতে। অতীন অলির হাত ছাড়েনি। কিন্তু কৌশিক চলে গেলে অন্যদিকে। পুলিস গুলি চালাতে শুরু করেছে।

বছর দেড়েক আগে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে অলি ঠিক এই রকম একটা গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে একা হয়ে গিয়েছিল, সেদিন সে বাড়ি পৌঁছেছিল অতি কষ্টে, দু চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল কান্না। আজ বাবলুদা তার সঙ্গে রয়েছে, আজ তার একটুও ভয় করছে না। আজ সারারাত ধরে এরকম চললেও ক্ষতি নেই।

একটা গাড়ি-বারান্দার তলায় ওরা একটুখানি দম নেবার জন্য দাঁড়াতেই ওপর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠলো, কারফিউ! কারফিউ ডিক্লেয়ার করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *