কবি জসিমউদ্দিনের বাড়িতে এক রবিবার সকালে আড্ডা দিতে গিয়ে মামুনের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো।
ঐ বাড়িতে একবার আড্ডায় জমে গেলে উঠে পড়া শক্ত। কবি নিজেই অত্যন্ত মজলিশী মানুষ, অফুরন্ত তাঁর গল্পের স্টক। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন থেকে শুরু করে, হাস্ন রাজা, নজরুল প্রমুখ ব্যক্তিদের সম্পর্কে অনেক অন্তরঙ্গ কাহিনী শোনা যায় তাঁর মুখে। তা ছাড়া আরও অনেক বিশিষ্ট আড্ডাধারী এখানে এসে জমায়েত হন প্রায়ই।
মামুন ইদানীং আড্ডা দেবার সময় পান না, সংবাদপত্রের কাজ নিয়েই খুবই ব্যস্ত থাকতে হয়। নতুন কাগজ, রেফারেন্স লাইব্রেরি নেই, কোনো তথ্য যাচাই করতে গিয়ে মুশকিলে পড়তে হয় খুব। পুরোনো কোনো তথ্যের সন্ধানে তিনি নিজেই নানা জায়গায় ছোটাছুটি করেন। সেইরকম একটি কারণেই তাঁর মোতাহার হোসেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন ছিল, তাঁকে বাড়িতে পাননি, তাঁর খোঁজেই তিনি এসে পড়লেন কবি জসিমউদ্দিনের বাড়ির আড্ডায়। মোতাহার হোসেনের সঙ্গে দেখা হলো, প্রয়োজনও মিটলো, কিন্তু আজ্ঞা ছেড়ে ওঠা গেল না। কবির গৃহের আতিথেয়তা বিখ্যাত, শুধু গাল-গল্প নয়, নাস্তা-পানি না খাইয়ে তিনি কারুকে ছাড়েন না।
বৈঠকখানা ঘরটি বেশ প্রশস্ত। দেওয়ালে নানাবিধ ছবি, তার মধ্যে একটি রাধাকৃষ্ণের। একটি বড় ক্যালেণ্ডারে পল্লী দৃশ্য ঝুলছে এক কোণে, ক্যালেণ্ডারটি গত বৎসরের, কিন্তু সুন্দর ছবিটির জন্যই সেটি এখনও স্থানচ্যুত হয়নি। সেই ছবিটির নিচে একটি ইজি চেয়ারে বসে আছেন একজন প্রায়-বৃদ্ধ সুদর্শন পুরুষ। এক একজন মানুষের চেহারা ও পোশাক ছাড়িয়েও একটা ব্যক্তিত্বের জ্যোতি থাকে, একবার সে তাকালে আর একবার দৃষ্টি ফিরে আসে।
মানুষটি যে বেশ দীর্ঘকায় তা তাঁর ছড়ানো পা ও হাঁটুর উচ্চতা দেখলেই বোঝা যায়। পাজামা ও কুতা পরা, গালে নিখুঁতভাবে ছাঁটা কাঁচা-পাকা দাড়ি। চোখে রোদ-চশমা। ঘরের মধ্যেও ঐ চশমা পরে আছেন বলে তাঁর মুখোনি পুরোপুরি বোঝা যায় না। কিন্তু তাঁর চিবুক ও নাক দুই-ই সূচোলো। মামুনের সঙ্গে কেউ তাঁর পরিচয় করিয়ে না দিলেও তিনি চিনতে পারলেন।
অবিভক্ত বাংলার শেষ দশ বছরের রাজনীতিতে জনাব আবুল হাসেম ছিলেন একজন প্রভূত ক্ষমতাশালী মানুষ। নিজে কিঞ্চিৎ আড়ালে থেকে তিনি মুসলিম লীগ ও কোয়ালিশন মিনিস্ট্রিতে কলকাঠি নাড়তেন। লেখাপড়া জানা, তীক্ষ্ণধী পুরুষ, আর্থিক অবস্থাও ভালো। বর্ধমানের দিকে ওঁদের অনেক জমি জায়গা ছিল। পার্টিশানের পর এদিকে চলে এসেছেন। মামুনের সঙ্গে সেই কলকাতার সময় থেকে যথেষ্ট চেনাশুনো থাকলেও এর মধ্যে বছর দু’তিন দেখা হয়নি। তবে মামুন শুনেছিলেন যে আবুল হাসেম সাহেবের দৃষ্টিশক্তি সম্প্রতি খুব খারাপ হয়ে গেছে, চোখে প্রায় দেখতেই পান না, কিন্তু মস্তিষ্ক আছে পুরোপুরি সজাগ। ওঁর এক ছেলের সঙ্গে তাঁর প্রায়ই দেখা হয়, তাঁর নাম বদরুদ্দিন ওমর। পত্র-পত্রিকায় এই ছেলেটির দীপ্ত-খরসান ভাষায় প্রবন্ধ পড়ে মামুন অবাক ও মুগ্ধ হয়েছেন। তবে এর লেখার মধ্যে কিছুটা তিক্ততার ভাব আছে, যা মামুনের ঠিক পছন্দ হয় না। মামুনের সন্দেহ হয়, আবুল হাসেম সাহেবের মতন একজন। ধর্মনিষ্ঠ, জাতীয়তাবাদী মানুষের এই পুত্রটি বোধ হয় কমুনিস্ট!
মামুন এগিয়ে গিয়ে বললেন, আস্সালাম আলাইকুম, হাসেম সাহেব!
কালো চশমা পরা মানুষটি মুখ তুলে প্রতি-অভিবাদন জানালেন, তারপর উঁচু গলায় হাসলেন। জসিমউদ্দিনও হেসে উঠলেন। আরও দু’তিনজন।
বিস্মিত মামুনের পিঠে হাত দিয়ে জসিমউদ্দিন বললেন, সবাই ঐ এক ভুল করে। ওনারে চেনতে পারলা না? উনি হইলেন মুসাফির।
মামুনের তবু ভুরু কুঁচকে রইলো। মুসাফির মানে? সৈয়দ মোস্তাফা আলির ভাই মুজতবা আলি? যে এখন লেখক হিসেবে খুব নাম করেছে, শান্তিনিকেতনে পড়ায়? কিন্তু তার তো চেহারা অন্যরকম, টকটকে ফর্সা রং!
আর একজন কেউ বললো, সওগাতে এই মুসাফির সাহেব সিরিজ লিখতেন, আপনি পড়েন নাই?
মামুন অস্ফুট স্বরে বললেন, হ্যাঁ, তা পড়েছি। কিন্তু…
কথায় কথায় জানা গেল এই মুসাফির এক সময় বেশ পরিচিত লেখক ছিলেন, তারপর বহু বছরের জন্য উধাও হয়ে যান। সত্যিকারের মুসাফিরের মতন বহু দেশ ঘুরেছেন, সম্প্রতি সেট্ল করেছেন ভারতে, কয়েকদিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে বেড়াতে এসেছেন।
মামুনের মুখ থেকে ফস্ করে প্রশ্ন বেরিয়ে এলো, ইণ্ডিয়ায় সেট্ল করলেন কেন?
মামুন অন্য কিছু ভেবে প্রশ্নটি করেননি, তাঁর মাথায় সব সময় এখন তাঁর পত্রিকার চিন্তা। মুসাফির সাহেব পূর্ব পাকিস্তানে সেটল করলে তাঁর পত্রিকার জন্য আর একজন লেখককে পাওয়া যাবে, মামুনের এই কথাটাই প্রথমে মনে এলো। ভালো গদ্য লেখকের খুব অভাব।
মামুনের প্রশ্ন শুনে মুসাফির সাহেব হেসে বললেন, আপনারা নবাব ফারুকির নাম শুনেছেন? অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী ছিলেন একসময়।
সকলেই মাথা হেলালো। নবাব ফারুকীর নাম কে না জানে! মামুন লক্ষ করলেন, মুসাফির সাহেবের কথায় পরিষ্কার পশ্চিমবঙ্গীয় শান্তিপুরী টান। কণ্ঠস্বরটি ভরাট ও মিষ্টি।
মুসাফির সাহেব বললেন, পার্টিশানের পর নবাব ফারুকীকে অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কলকাতায় রয়ে গেলেন, পূর্ব পাকিস্তানে গেলেন না কেন? সেখানে আপনার জমিদারি রয়েছে…তিনি কী উত্তর দিতেন জানেন? তিনি সবাইকেই বলতেন, ওদিকে যেতে পারি। কিন্তু ক্যালকাটা ক্লাবটাকে উপড়ে তুলে নিয়ে যেতে পারো ঢাকায়? ক্যালকাটা ক্লাবের বন্ধুদের সঙ্গে
রোজ আড্ডা দিতে না পারলে যে ওদিকে মন টিকবে না। আমারও হয়েছে সেই অবস্থা। আমার অবশ্য ক্যালকাটা ক্লাবের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের মুর্শিদাবাদের বাড়িতে আছে একটা বাগান। নিজে হাতে আমি তার অনেক গাছ পুঁতেছি। সেই গাছগুলোকে তুলে না আনতে পারলে আমার একা আসা হবে না!
মোতাহার হোসেন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি মুসাফির হয়েও নিজের বাড়ির বাগানের ওপর এত টান?
–আমি মুসাফির হতে পারি, যাযাবর তো নই। আমার একটা শিকড় আছে, সেটা সব সময় টের পাই।
–ইণ্ডিয়ার অবস্থা এখন কী রকম? থাকার অসুবিধা নাই? কাগজে তো যা পড়ি মাঝে মাঝে,
–হ্যাঁ, অসুবিধে আছে। অন্তত ছ’রকম অসুবিধের কথা বলা যায়। তার মধ্যে তৃতীয়টি হলো, হঠাৎ কোনোদিন দাঙ্গা লাগলে কচুকাটা হতে পারি। ইণ্ডিয়ায় দাঙ্গার তো বিরাম নেই!
–এইটা হলো তৃতীয় অসুবিধে?
সবাই হেসে উঠলো একসঙ্গে। মামুন আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ইণ্ডিয়ার অবস্থা সত্যিই এখন কী রকম বলেন তো! আপনার কাছ থেকে ঠিক খবর পাওয়া যাবে।
মুসাফির একটা চুরুট ধরালেন। কালো চশমাটা তিনি খোলেননি একবারও। ঠোঁটে সব সময় পাতলা হাসি। সব মিলিয়ে মানুষটিকে রহস্যময় মনে হয়।
তিনি চুরুটে টান দিয়ে বললেন, ইণ্ডিয়ায় একটা এক্সপেরিমেন্ট চলছে। হিন্দুরা অনেকদিন পর রাজ্য শাসনের ভার পেয়েছে। মুখে ওরা যাই-ই বলুক, ওদের কনস্টিটিউশানে যতই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা থাক, হিন্দুরাই এখন শাসক। ধরুন, প্রায় সাত শো বছর পর এই ক্ষমতা পেয়ে তাদের খানিকটা দিশেহারা অবস্থা। হিন্দু চিন্তাধারার মধ্যে সব সময় একটা বৈপরীত্য থাকে। সেই তুলনায় মুসলিম মাইণ্ড বোঝা তবু সহজ। তা স্পষ্ট ও একমুখী। হিন্দুদের মধ্যে যেমন আছে গোঁড়ামি, তেমনই আবার ঔদার্যের প্রতি মোহ।
একজন বললো, ঔদার্যের ভাণ! কিংবা ঔদার্যের ভণ্ডামিও বলতে পারেন!
মুসাফির বললেন, মোহটাই বোধ হয় সঠিক আমার মতে। হিন্দুরা যেমন সাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী, তেমনি নাস্তিকতাও তারা কিছুটা সহ্য করে। হিন্দুধর্মের একটা অংশের মধ্যে নাস্তিকতাবাদ চলে আসছে অনেকদিন ধরে। তারা একসময় বৌদ্ধদের পিটিয়ে মেরেছে, আবার নিরীশ্বরবাদী গৌতম বুদ্ধকে অবতার বলেও স্বীকার করে নিয়েছে।
–স্বীকার করে নিয়েছে শুধু মুখেই। কোনো হিন্দু কি বিষ্ণু বা রামের মতন বুদ্ধের পূজা করে?
–বুদ্ধ মূর্তি দিয়ে তারা ঘর সাজায়। তাতে বাধা নেই। ঐটাই ঔদার্যের মোহ। এই মোহ থেকেই তারা মনে করে যে আধুনিক পৃথিবীতে তারা একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়তে পারবে। দু’পাঁচ শো জন হয়তো এটা আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করে। আবার হিন্দুদের একটা বিরাট অংশ মনে করে, ইংরেজদের কাছ থেকে তারাই ক্ষমতা ছিনিয়ে এনেছে, সুতরাং মুসলমানদের তারা দয়া করে যেটুকু দেবে, তা নিয়েই মুসলমানদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে। অধিকাংশ হিন্দু কংগ্রেস পার্টিকে ভোট দেয় কিন্তু মহারাষ্ট্রের সাভারকরকে অস্বীকার করে না। সুতরাং কাগজে-কলমে ও হিন্দু মানসিকতায় একটা দো-টানা চলছে। এই জন্যই আমি বলেছি, এটা একটা
এক্সপেরিমেন্টাল স্টেজ। তার পরে, তাদের রাজ্য শাসনের অভিজ্ঞতা নেই, তারা ফলো করছে। ব্রিটিশ মডেল। কিন্তু যে দেশে শতকরা সত্তর জনের ক-অক্ষর গোমাংস, শতকরা ষাট জন দু বেলা খেতে পায় না, শতকরা পঞ্চাশ জনের একটি গেঞ্জি পর্যন্ত গায়ে দেবার সামর্থ্য নেই, সেই দেশে ব্রিটিশ মডেল পদে পদে হাস্যকর হয়। যেমন একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ইকুয়ালিটি ইন দা আই অফ ল, আইনের চক্ষে ধনী-নির্ধন সবাই সমান। জমিদার রামচন্দ্র তার প্রজা শ্যামচন্দ্র কিংবা শেখ রহিমের জমি কেড়ে নিল জোর করে। এখন শ্যামচন্দ্র কিংবা শেখ রহিম আইনের। সাহায্য পাবে কী করে? আইন কিনতে পয়সা লাগে। আইন বুঝতে লেখাপড়া লাগে। ব্রিটেনে কী হয়? সেখানে সরকারের চোখনাক অনেক বেশি সজাগ, সরকারের হাত লম্বা। সারা দেশে কী ঘটছে, সরকার তার খোঁজ খবর রাখে। সে দেশেও ধনীরা গরিবদের শোষণ করে বটে কিন্তু জমি কেড়ে নিতে পারে না, যাকে-তাকে খুন করে পার পায় না, মাঝখানে সরকারের হাত এসে পড়ে। আর ভারতের নতুন সরকার বড় বড় শহরগুলোই সামলাতে পারছে না, গ্রামে তো সরকারের কড়ে আঙুলটিও কখনো পৌঁছোয় না।
মামুন বললেন, আমাদের এদিকেও তো একই অবস্থা।
মুসাফির বললেন, আমি আপনাদের দেশ সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। আমি ইণ্ডিয়ার সিটিজেন, সে দেশের সমালোচনা করতে পারি। আপনাদের সম্পর্কে শুধু একটা কথাই বলতে পারি, আল্লা আপনাদের রক্ষা করুন!
–আপনি মুসলমান হয়েও আমাদের পর পর ভাবছেন? পাটিশান তো একটা পলিটিক্যাল ডিভিশন, কিন্তু দু’দেশের মানুষ যে এত দূরে সরে যাচ্ছে… ৪৮৪
–সেইটাই তো সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। ভারত কাগজে-কলমে ধর্মনিরপেক্ষতা ঘোষণা করে বসে আছে, আর আপনারা গড়ছেন ইসলামিক রাষ্ট্র। আমার ধারণা, পার্টিশান না হলে হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থানের এক্সপেরিমেন্টটা তবু যদি বা সাকসেসফুল করা যেত, এখন আর তার কোনো আশা নেই। অবস্থা আরও খারাপ হবে, যদি এই দুই দেশের মধ্যে একটা যুদ্ধ বাধে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, শিগগিরই সেরকম একটা যুদ্ধ বাধবে।
–অ্যাঃ আবার যুদ্ধ?
–আমি চোখ বুজলেই যেন সেই দৃশ্য দেখতে পাই। এবারে আর কাশ্মীরে সীমান্ত সংঘর্ষ নয়। পুরোপুরি দুই দেশের যুদ্ধ, প্লেন থেকে বোমা পড়বে
–না, না, না, আপনি বড় সিনিক্যাল কথা বলছেন।
মোতাহার হোসেন গম্ভীরভাবে বললেন, আমি মুসাফির সাহেবকে বহুদিন ধরে চিনি। ওকে তোমরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বলতে পারো। উনি যা যা বলেন সব মিলে যায়। নজরুলের যে এই অবস্থা হবে, সে কথা উনি আমাকে বহু আগেই বলেছিলেন। মনে আছে, আপনার? আমার নিজের জীবন সম্পর্কেও উনি এমন কয়েকটা কথা বলেছেন, যা প্রত্যেকটা মিলেছে।
মামুন জিজ্ঞেস করলেন, উনি হাত দেখতে পারেন বুঝি? মুসাফির প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বললেন, না, না, আমি ওসব কিছু জানি না। মোতাহার, তুমি এসব কী আবোলতাবোল বলছো!
জসিমউদ্দিন বললেন, হ্যাঁ, মুসাফিরের এই একটা আনক্যানি ক্ষমতা আছে, আমিও লক্ষ করেছি।
আলোচনা অন্যদিকে ঘুরে গেল। অনেকেই মুসাফিরকে ঘিরে ধরে হাত বাড়িয়ে দিল। মুসাফির প্রথম কয়েকবার তাদের প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত এক একজনের হাত ছুঁয়ে নানান কৌতুকময় মন্তব্য ছুঁড়তে লাগলেন।
আড্ডা ভাঙলো বেলা একটায়। মুসাফির সাহেবের জন্য একটা গাড়ি মজুত আছে। তাঁর কোনো ব্যবসায়ী বন্ধু কয়েকদিনের জন্য গাড়িটি দিয়েছে। কাগজের সম্পাদক হবার পর মামুন একখানা অফিসের গাড়ি পান বটে কিন্তু আজ ড্রাইভার আসেনি, তিনি রিকশায় এসেছেন।
মুসাফির সাহেব কয়েকজনকে লিফট দিতে চাইলেন। মামুন উঠলেন সেই গাড়িতে। তিনি সব শেষে নামবেন। নামবার একটু আগে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি সত্যিই ভবিষ্যতের দৃশ্য দেখতে পান? সাধু-ফকিরদের যেরকম অলৌকিক ক্ষমতা থাকে শুনেছি…
মুসাফির স্বভাবসিদ্ধ সহাস্য কণ্ঠে বললেন, না, আমার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই। তবে ঐ জসিমউদ্দিন যা বললো, সেটাই ঠিক। মাঝে মাঝে আমার একটা আনক্যানি ফিলিং হয়, হঠাৎ হঠাৎ চোখের সামনে একটা ছবি ভেসে ওঠে…ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের একটা ছবি আমি প্রায়ই দেখি। আপনি তো সাংবাদিক, সে জন্য তৈরি হয়ে থাকুন!
–কিন্তু কী নিয়ে যুদ্ধ হবে? মুসাফির নিজের মাথায় টোকা মেরে বললেন, পাগলামি নিয়ে! দু’দেশের পাগলামির তো একটাই নাম, কাশ্মীর!
–হায় আল্লা! এই গরিব দেশে যুদ্ধ!
–সব যুদ্ধেই গরিবরা গরিবদের মারে! বড়লোকরা মজা দেখে!
–আপনি…মুসাফির সাহেব, আপনি…কোনো মানুষের জীবনেরও এরকম ছবি দেখতে পান?
–হ্যাঁ, তাও কখনো কখনো দেখি। কী করে দেখি তা জানি না। খুব সম্ভবত টেলিপ্যাথি। অন্য একজনের সাব-কনসাস মাইণ্ডের ছবিটা আমার মস্তিষ্কের বেতার তরঙ্গে কী করে যেন ধরা পড়ে যায়। আমার নিজের ছোট ভাই, খালেদ, একদিন তার মুখের দিকে চেয়ে আমি চমকে উঠলাম। দেখি যে, তার চোখের দুটো মণি নেই। সে তাকিয়ে আছে, কিন্তু চোখ দুটি সাদা। আমি খালেদকে তখুনি ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করতে বললাম। সে শুনলো না। তার আই-সাইট পারফেক্ট! স্বাস্থ্য ভালো, সে কেন ডাক্তারের কাছে যাবে। চাকরিও ভালো করে, বুদ্ধিমান ছেলে…কিন্তু শুনলে হয়তো আপনি বিশ্বাস করতে চাইবেন না, এক মাসের মধ্যে সেই সুস্থ ভাইটি আমার পাগল হয়ে গেল। একে আপনি কী বলবেন!
–সত্যি বিশ্বাস হতে চায় না।
–আরও আশ্চর্য হচ্ছে, আমি নিজের জীবনের ভবিষ্যতের কোনো ছবি দেখি না। অন্যদের দেখি। আমি জিন্না সাহেবকেও দেখেছিলাম। উনিশ শো সাতচল্লিশ সালের গোড়ার দিকে। আমি তখন জিন্না সাহেবের প্রচণ্ড অ্যাডমায়ারার। কিন্তু ওনার দিকে তাকিয়েই আমার বুক কেঁপে উঠলো। মুখে পরিষ্কার মৃত্যুর ছায়া। ভাবুন তো আপনি, যে মানুষটা এতকালের একটা পুরাতন দেশ ভেঙে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, তার নিজের আর আয়ু নেই।
–মুসাফির সাহেব, আপনি আর কতদিন থাকবেন ঢাকায়? একদিন আমার বাসায় এলে খুব খুশি হবো। আমরা একটা নতুন পেপার বার করছি, যদি সেখানে আসেন, যদি আমাদের জন্য কিছু লেখেন–
মুসাফির কোনো উত্তর না দিয়ে মামুনের মুখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
মামুনের বুকটা কেঁপে উঠলো। এক্ষুনি জিন্না সাহেবের কথা বলার পরই তাঁর মুখের দিকে চেয়ে এমন দীর্ঘশ্বাস…
–আপনি কী দেখলেন মুসাফির সাহেব? আমারও আয়ু ফুরিয়ে এসেছে নাকি!
–না, না, বালাই ষাট, আপনি আরও অনেকদিন বাঁচবেন।
–তবে কী দেখলেন?
–না, সেরকম কিছু না।
–কী দেখলেন, তবু বলুন।
–আপনার না শোনাই ভালো। হয়তো ঠিকই আছে। জানেন, সময়ে সময়ে আমারও ভুল হয়।
–এটা আপনি কী করছেন, মুসাফির সাহেব। আমার মনের মধ্যে একটা খটকা ঢুকিয়ে, দিলেন। এখন আমি অনবরত এই কথাই ভাববো। আমি তো ছেলেমানুষ নই, আপনার যা মনে এসেছে বলুন, শুনলেই যে আমি বিশ্বাস করবো, তারও তো কোনো মানে নাই!
–একটা ছায়া দেখলাম। হঠাৎ যেন আপনি দুটো মানুষ হয়ে গেলেন। একটা আপনার কর্ম জীবনের, আর একটা আপমার ব্যক্তি জীবনের। এর মধ্যিখানে একটা ছায়া। একটি অল্পবয়েসী যুবতীর, সে যেন দু’হাত মেলে আপনার ঐ দুটি সত্তাকে দু’দিকে সরিয়ে দিতে চায়, সে আপনার…
মামুন হেসে বললেন, এটা আপনার স্বপ্নই বটে। না, কোনো যুবতী-টুবতী আমার জীবনে নাই। বুড়া হয়ে যাচ্ছি, এখন আর কে আসবে। সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকি। ব্যক্তি জীবনের কথা ভাবারও সময় পাই না।
মুসাফির বললেন, হয়তো সে এখনও আসেনি। তাই তার ছায়া মূর্তি। আগামীতে কোনো সময় আসবে!
মামুন বললেন, যদি সে রকম কেউ আসেই, মন্দ কী! দেখা যাক, যদি এই বুড়োকে কারুর পছন্দ হয়!
হালকা সুরেই শেষদিকের কথাবার্তা বলে মামুন নেমে পড়লেন এক সময়। মুসাফিরকে তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে। এই মানুষটির আসল নাম কী তা কেউ বলেনি। পরদিন তিনি মোতাহার হোসেনের সঙ্গে আবার টেলিফোনে কথা বললেন, তখন মুসাফিরের প্রসঙ্গ উঠলো। মোতাহার হোসেন এই মুসাফিরকে বহুদিন ধরে চেনেন, কিন্তু আসল নামটা ভুলে গেছেন। সকলেই ওঁকে মুসাফির বলে ডাকে। লেখাপড়া জানা মানুষ, অভিজ্ঞতাও প্রচুর, এই লোককে পূর্ব পাকিস্তানে ধরে রাখতে পারলে অনেক লাভ হয়।
মুসাফিরের সঙ্গে মামুনের পরিচয় হবার ঠিক চারদিন পরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে গেল।