2 of 3

২.২৭ থার্ড ইয়ার থেকে ফোর্থ ইয়ারে

থার্ড ইয়ার থেকে ফোর্থ ইয়ারে উঠতে না উঠতেই অলি তার কয়েকজন বান্ধবীকে হারালো। তার সহপাঠিনীদের, টুপটাপ করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এই ফাল্গুনেই তিনজন পদবী বদলালো। অনিন্দিতা বিয়ের পর চলে গেল কানপুর, নাসিমের শ্বশুরবাড়ি কলকাতায় হলেও ৪৭৬

সে আর কলেজে আসে না।

ক্লাসে বরাবর আলির পাশে বসে চন্দনা, সেও হঠাৎ একদিন বাড়িতে এসে লাজুক লাজুক মুখে একখানা প্রজাপতি আঁকা চিঠি বার করল। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে একেবারে অকস্মাৎ, পাত্র তার বৌদির ভাই, ডাক্তারি পাশ করে সে বিলেত যাচ্ছে। বিলেতের সুলভ নারীদের সম্পর্কে নানা রকম রটনা আছে, তাই সেই তরুণ ডাক্তারটির সন্ত্রস্ত পিতা-মাতা ছেলের বিয়ে দিয়ে বউকে সঙ্গে পাঠাতে চান।

চন্দনার বিয়ের খবর শুনে অলি খুবই অবাক। চন্দনা অসাধারণ ভালো ছাত্রী। অনার্সে ফাস্ট বা সেকেণ্ড স্ট্যাণ্ড করবেই, সে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে?

দেখা গেল চন্দনা সে জন্য মোটেই দুঃখিত নয়, বরং সে গোপন আনন্দে ঝলমল করছে। বিলেত যেন এক স্বর্গপুরী, সেখানে যাবার সুযোগ কে উপেক্ষা করতে চায়।

চন্দনা এ বাড়িতে অনেকবার এসেছে, সে অলির বাবা-মাকেও নেমন্তন্ন করলো। সে চলে যাবার পর বিমানবিহারী সকৌতুকে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন তাঁর মেয়ের দিকে, তারপর বললেন, কী রে, তোর বন্ধুরা দেখছি একে একে গিয়ে ছাদনাতলায় বসছে, তোর জন্যও একটা পাত্তর-টাত্তর দেখি? অলির মা কৌতুকের সঙ্গে নয়, বেশ উদ্বিগ্ন ভাবেই বললেন, আমি ঠিক সেই কথাই ভাবছিলুম। অলকাদি একটি ভালো ছেলের কথা বলছিলেন, সেও বিলেত যাবে, অলকাদি বলছিলেন যদি আমরা অলির সঙ্গে সম্বন্ধ করতে চাই…

অলি অনেকখানি ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলো, সম্বন্ধ মানে?কল্যাণী ধমক দিয়ে বললেন, মেমসাহেব হয়েছিস নাকি? সম্বন্ধ করা কাকে বলে জানিস না?

বিমানবিহারী বললেন, আজকাল ভালো ভালো ছেলেরা সবাই বিলেত আমেরিকা চলে যাচ্ছে। তবু ওরকম ছেলের সঙ্গে আমি অলির বিয়ে দিতে চাই না।

কল্যাণী বললেন, কেন? অলকাদি যে ছেলেটির কথা বলেছেন সে জাস্টিস পি এন মিত্রর ছেলে, ব্যারিস্টারি পড়তে যাচ্ছে, চেহারাও সুন্দর।

বিমানবিহারী বললেন, তা না হয় বুঝলুম। কিন্তু এরা যদি বিলেত থেকে আর না ফেরে? আমি মরে গেলে আমার এই ব্যবসা দেখবে কে? অলি আর অলির বরকেই তো সামলাতে

কল্যাণী বললেন, তোমার যত সব অদ্ভুত কথা। ফিরবে না কেন? ভালো বংশের ছেলেরা কখনো বিলেতের মাটি কামড়ে পড়ে থাকে না। সবাই তো আর তোমার গুণধর ভাইটির মতন নয়! দু’চার বছরের জন্য যারা গিয়ে ঘুরে আসে, তারা অনেক ভদ্র-সভ্য হয়। আমার ছোটমামার ছেলে অরুণকেই দ্যাখো না! কত বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ফিরে এসেছে। অলকাদিকে বলবো, তুমি ছেলেটির সঙ্গে কথা বলবে?

তা আমি কথা বলে দেখতে পারি। জাস্টিস পি এন মিত্রর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। ওঁর স্ত্রী তো কৃষ্ণনগরের মেয়ে, নামকরা সুন্দরী ছিলেন, আমরা আতরদি বলে ডাকতুম। ওঁদের তো তিন ছেলে, তুমি কার কথা বলছো?

–ছোট ছেলে, ডাক নাম লালটু। ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনোয় খুব মাথা। বুলির সঙ্গে মানাবে!

চায়ের টেবিলে চা-পান শেষ হয়ে গেছে। টেবলক্লথের ওপর ছড়িয়ে আছে কিছু বিস্কুটের গুড়ো, বাবা আর মা বসেছেন পাশাপাশি, উল্টো দিকে অলি, পিছনের জানলা দিয়ে শীতের নরম রোদ এসে পড়েছে তার গায়ে। জানলার বাইরে এসে বসেছে তিনটি শালিক পাখি।

বাইরে সবাই অলিকে খুব লাজুক আর নম্র জানে, কিন্তু বাবা-মায়ের কাছে সে বেশ জেদী মেয়ে।

সে তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কার সম্পর্কে আলোচনা করছো? কল্যাণী বললেন, লালটুকে তো তুই একবার দেখেছিস! নীপার বিয়ের দিন এসেছিল, খুব ফর্সা রং, হলদে সিল্কের পাঞ্জাবি পরেছিল…

অলি বললো, হ্যাঁ, তার সঙ্গে কার বিয়ের কথা হচ্ছে? আমি যে সামনে বসে আছি…আমি বুঝি একটা মানুষ নয়, আমার একটা মতামত নেবার কথাও বুঝি ভাবো না?

কল্যানী গালে হাত দিয়ে বললেন, ওমা, তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন? তোর মতামত ছাড়া বিয়ে হবে, তা কে বলেছে? হুট করে বললেই কি বিয়ে হয়ে গেল নাকি? কথাবার্তা চলবে, দেখানো হবে, তোর মতামত নেওয়া হবে, ছেলের মতামত, তারপর সব কিছু যদি মেলে:একেই তো বলে সম্বন্ধ করা!

–আমার মতামতটা আগে নিলে তোমাদের অনেক ঝঞ্ঝাট কমে যাবে!

–সেটা কী শুনি?

–এটা নাইনটিনথ সেঞ্চুরি নয়। গৌরীদানের প্রথা উঠে গেছে। আমার বিয়ের চিন্তা নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

বিমানবিহারী হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, তুই আমাদের একেবারে নাইনটিনথ সেঞ্চুরিতে ফেলে দিলি? তোর মায়ের কি গৌরীদান হয়েছিল নাকি?

অলি বললো, মার বিয়ে হয়েছিল চোদ্দ বছর বয়েসে। তোমরা যদি ভেবে থাকো… বিমানবিহারী বাধা দিয়ে বললেন, তোর মায়ের খুব একটা খারাপ বিয়ে হয়নি কি বলিস? ভেবে দ্যাখ, ঐ বয়েসে আমার সঙ্গে যদি তোর মায়ের বিয়ে না হতো তা হলে হয়তো তোর জন্মই হতো না। সেটা একটা খুব খারাপ ব্যাপার হতো, বল্!

অলি উঠে পড়ে চলে যাচ্ছিল, বিমানবিহারী ঝুঁকে তার হাত চেপে ধরে বললেন, পালাচ্ছিস কেন? তোর মতামতটা কি বল, ভালো করে শোনা হলো না!

অলি ঝাঁঝের সঙ্গে বললো, এম এ পাশ করার আগে আমি ওসব নিয়ে কোনো কথাবার্তা বলতেও চাই না, শুনতেও চাই না!

–যাক বাঁচা গেল। আমারও ঠিক তাই মত। এখন তুই আর আমি দু’জনে মিলে তোর মায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাবো। কি বল? জাস্টিস মিত্রের ছেলে লালটু অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করুক?

কল্যাণী বললেন, তোমাদের যা ইচ্ছে করো, আমি আর কোনোদিন কিছু বলতে যাবো না!

এই প্রসঙ্গটা আপাতত এখানেই চাপা পড়ে গেল।

কলেজে অলির একমাত্র বন্ধু রইলো বর্ষা। বিয়ের ব্যাপারে তার মতামত আরও অনেক বেশী উগ্র। সে চন্দনার বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে যেতেও রাজি নয়।

অলি তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলো, চন্দনা তাদের খুবই ঘনিষ্ঠ, তার বিয়েতে না গেলে সে দুঃখ পাবে।

প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে বকুল গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে বর্ষা বললো, চন্দনার বাবা কত খরচ করছেন জানিস? মেয়ে-জামাইয়ের বিলেত যাবার জাহাজ ভাড়া দেবেন, মহম্মদ আলির দোকানে জামাইয়ের জন্য পাঁচখানা সুটের অর্ডার দিয়েছেন, এ ছাড়া গয়না দিয়ে চন্দনার গা

তো মুড়ে দেবেনই। আর ছেলের বাবা কী করবেন? ওদের বাড়ি আসানসোলে। সেখান থেকে শ’খানেক বরযাত্রী আসবে, বাস রিজার্ভ করে। সেই বাসের আসা-যাওয়ার ভাড়াও তিনি চেয়েছেন চন্দনার বাবার কাছে।

–তুই অত সব জানলি কী করে?

–চন্দনা বাড়িতে এসেছিল নেমন্তন্ন করতে, ওর কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জেনে নিয়েছি। যে-কোন বিয়ের কথা শুনলেই আমি এই সব খবরগুলো জেনে নিতে চাই। যে-সব বিয়েতে মেয়ের বাড়ি থেকে পণ নেওয়া হয়, সে সব বিয়ের নেমন্তন্ন আমি খেতে যাই না। আমার ঘেন্না করে।

–চন্দনার বাবা তো ঠিক পণ দিচ্ছেন না।

–মেয়ে-জামাইয়ের জাহাজ ভাড়া তিনি দিতে যাবেন কেন? ছেলেটার মুরোদ নেই? তুই একটা কথা ভেবে দ্যাখ, অলি, চন্দনা কি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। দেখতে সুন্দর, তাকে যে বিয়ে করবে, সেই-ই তো ধন্য হয়ে যাবে? চন্দনা শুধু মেয়ে বলেই তার বাবাকে টাকা খরচ করতে হবে? এই বারবারিক সিস্টেমকে তুই সাপোর্ট করিস?

–চন্দনার বাবার আছে বলেই দিচ্ছেন। উনি নিশ্চয়ই ইচ্ছে করেই দিচ্ছেন। ওরা চায়নি।

–কী করে বুঝলি ওরা চায়নি? চন্দনার বাবা দিতে চাইলে, সেই হতভাগা ছেলেটা নিতে রাজি হলো কেন? তার কোনো প্রেস্টিজ জ্ঞান নেই? ওর আমি মুখও দেখতে চাই না।

–তুই বড্ড রেগে যাচ্ছিস, বর্ষা। ঠিক আছে, আমরা চন্দনার বরের মুখ দেখবো না, শুধু চন্দনার সঙ্গে দেখা করে আসবো।

–তোর যেতে ইচ্ছে করে, তুই যা!

হ্যাণ্ড ব্যাগ খুলে বর্ষা একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করলো। শঙ্কিত ভাবে এদিক ওদিক তাকালো অলি। বর্ষার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি করা চাই। ছেলেরা যদি সিগারেট খেতে পারে তা হলে মেয়েরা কেন পারবে না, এই যুক্তিতে সে কিছুদিন ধরে সিগারেট টানতে শুরু করেছে। তাও সে লুকিয়ে চুরিয়ে খাবে না, প্রকাশ্যেই খাওয়া চাই। অনেকেই হাঁ করে তাকিয়ে দেখে, বয়স্ক লোকরা চলতে চলতে থমকে যায়, কেউ কেউ বিড় বিড় করে কী যেন বলে, খুব সম্ভবত ঘোর কলিকালের আন সম্পর্কে ঘোষণা, কেউ কেউ তাকে শুনিয়ে শুনিয়েই কটুক্তি করে যায়। বর্ষার কোনো দিকে ভূক্ষেপ নেই। সহপাঠীরাও অনেকে টিটকিরি দেয়। তার প্রসঙ্গ উঠলেই ছেলেরা বলে, কোন্ বর্ষা স্যান্নাল, সেই সিগারেট ফোঁকা পাগলিটা? ওয়াল ম্যাগাজিনে তার সম্পর্কে রসরচনা বেরিয়েছে, একটি ছেলে নিখুঁত ভাবে বর্ষার মুখ এঁকে দিয়েছে।

অলি অনেক ভাবে আপত্তি জানিয়েও শুধু ধমক খেয়েছে বর্ষার কাছ থেকে। বর্ষার ব্যক্তিত্বের কাছে সে হেরে যায়। তবে বর্ষার অনেক প্ররোচনাতেও সে নিজে সিগারেট ধরেনি। কয়েকবার সে সিগারেট টেনে দেখেছে, তার ভালো লাগে না।

সিগারেট ধরিয়ে বর্ষা বললো, আমার আরও রাগ ধরে কেন জানিস? প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হওয়া কত শক্ত, অনেক ছেলেমেয়ে চান্স পায় না, আর এই মেয়েগুলো ফোর্থ ইয়ারে উঠতে না উঠতেই বিয়ে করে কলেজ ছেড়ে দিচ্ছে! এটা একটা ক্রাইম। বিয়ের নাম শুনলেই মেয়েগুলো নেচে ওঠে। চন্দনার মতন মেয়েও যে পড়াশুনো ছেড়ে

অলি বললো, চন্দনার কথা শুনে মনে হলো ওর বিলেত যাবার খুব ইচ্ছে হয়েছে।

–ও নিজে বিলেত যেতে পারতো না? ওর বাবার পয়সা আছে, তা ছাড়া ও ডেফিনিটলি ভালো রেজাল্ট করতো, বিলেতের যে-কোনো কলেজে অ্যাপ্লাই করলে স্কলারশিপ পেতে পারতো! সেটুকু ধৈর্য ধরতে পারলো না, বরের ল্যাজ ধরে ওকে সমুদ্র পার হতে হবে?

–তুই বড্ড খারাপ কথা বলিস বর্ষা।

–কী খারাপ কথা বলেছি রে? চন্দনার বরকে শুধু বাঁদর বলেছি, ওকে শালা বলা উচিত। শালা!

–তুই মনীশকে বিয়ে করবি না?

–মনীশকে? তোর মাথা খারাপ হয়েছে অলি? তুই আমাকে এরকম একটা সিলি প্রশ্ন করতে পারলি? যে-ছেলে ফ্রানৎস কাফকার নাম শোনেনি, থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি কী তা জানে না, তাকে আমি কথা বলার যোগ্যই মনে করি না।

–মনীশ কিন্তু তোর জন্য একেবারে পাগল?

–আমি পাগল-টাগলদের থেকে দূরে থাকতে চাই। ছোটবেলা থেকেই আমি পাগলদের দেখলে ভয় পাই।

–ধ্যাৎ! আমি কি সেই সেন্সে বলছি নাকি?

–জানি। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হলে মনীশকে আমার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। আমার রুচি, আমার মানসিকতা বুঝতে হবে, শুধু পেছন পেছন ঘোরা আর তোষামোদ করলেই তো চলবে না। ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আমার আপত্তি নেই, শুধু বন্ধুত্ব। বিয়ে-ফিয়ের কথা ভাবলেই আমার গা গুলিয়ে ওঠে। কপালে সিঁদুর, হাতে লোহা…এগুলো কিসের চিহ্ন জানিস? মেয়েদের জোর করে ধরে এনে পুরুষরা তাদের চুলের মাঝখানটায় চিরে দিত। অর্থাৎ এই মেয়েটা আমার বন্দিনী। সেই রক্তের দাগ এখনকার সিঁদুর। বিয়ের পর হাতে লোহা পরতে হয় কেন, তার মানে লোহার শেকল দিয়ে হাত বাঁধা হলো…এখনও চন্দনার মতন মেয়েরা সেধে সেধে ক্রীতদাসী হতে চায়। পৃথিবীতে যেদিন পুরুষ আর মেয়েরা একদম সমান সমান হবে, সেইদিন আমি বিয়ের কথা ভাববো!

অলি হেসে ফেললো। বর্ষাও হেসে বললো, ভাবছিস, ততদিনে আমি বুড়ি হয়ে যাবো?

–সে কথা ভাবিনি। তুই যখন এই সব কথা বলিস, তোর মুখে এমন একটা সীরিয়াস ভাব ফুটে ওঠে, মনে হয় তুই যেন আমার সঙ্গে কথা বলছিস না, গোটা পুরুষ জাতিটাই তোর চোখের সামনে…।

–চল, কফি হাউসে যাবি?

একটু দ্বিধা করে অলি বললো, না। কয়েকদিন আগে কফি হাউসে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে, সেই জন্য আর ওখানে যেতে ইচ্ছে করে না।

বর্ষা বললো, চল, তা হলে আমাদের বাড়িতে গিয়ে একটু বসবি? আজ আমাদের বাড়িতে কেউ নেই।

অলির জন্য এখন আর বাড়ির গাড়ি আসে না, সে নিজেই বারণ করে দিয়েছে। সে এখন ট্রামে বাসে যাতায়াত করে। এখন দুপুর তিনটে, পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরলেই চলবে।

বর্ষাদের বাড়ি বেশি দূরে নয়। তিনতলা বাড়িটিতে অনেকগুলি ভাড়াটে। দোতলায় বর্ষাদের দুটি মাত্র ঘর। বাবা মারা গেছেন, মা ছোট বোন আর দাদা-বৌদির সঙ্গে থাকে বর্ষা। বাড়ির সবাই মুর্শিদাবাদে দেশের বাড়িতে গেছে। কলেজ খোলা বলে বর্ষা যায়নি।

একখানা নিজস্ব পড়ার টেবিল পর্যন্ত নেই বর্ষার। টেবিল ফেলার জায়গা নেই, দু’দিকে দুটি খাট পাতা, একটি তার মা ও ছোট বোনের। ঘরের দেয়ালে একটি জোন অব আর্ক-এর বাঁধানো ছবি। বর্ষার খাটের ওপর বইপত্র ছড়ানো, সেগুলোই সরিয়ে সরিয়ে বর্ষা বললো, বোস এখানে। আমি চা তৈরি করে আনছি।

বসবার ঘর নেই, শোওয়ার ঘরেই বাইরের লোক এসে বসে, তাও খাটের ওপর। এরকম দেখার অভিজ্ঞতা নেই অলির। পড়ার টেবিল নেই, তবু বর্ষা রেজাল্টের জোরে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়েছে। হাত খরচ চালানোর জন্য সে একটা টিউশনি করে। হঠাৎ অলির চোখ ছলছল করে উঠলো। নিজেকে তার মনে হলো স্বার্থপর। বর্ষার তুলনায় সে কত আরামে, কত ভালো অবস্থায় থাকে! এটা যেন একটা অন্যায়।

শুধু চা নয়, দুটি ডিমের ওমলেটও ভেজে নিয়ে এলো বর্ষা।

অলি জিজ্ঞেস করলো, বাড়িতে আর কেউ নেই, তোর খাবার কে রান্না করে দেয়?

বর্ষা বললো, কে আবার দেবে? আমি নিজেই রান্না করি। আমাদের তো ঠাকুর-চাকর নেই। অন্য সময় মা রান্না করে। আমার মা কী রকম জানিস? যেন পরের সেবা করার জন্যই জন্মেছে। আমার বাবা ছিলেন অটোক্রাট হিটলারের মতন। এক হিসেবে হিটলারের চেয়েও খারাপ। কারণ কোনো ক্ষমতা ছিল না, সাধারণ রেলের চাকরি করতেন, বাড়িতে ছিল যত রকম হম্বিতম্বি, মা ভয় পেত খুব বাবাকে। আগে মা মুখ বুজে স্বামীর সেবা করে গেছে, এখন ছেলেমেয়ের সেবা করছে। নিজের কোনো সাধ-আহ্লাদ নেই। দাদাকেও মা ভয় পায়। আমি সামনের বছর একটা চাকরি নেবো ঠিক করেছি। তখন মাকে নিয়ে দাদার সংসার থেকে চলে যাবো।

–তুই এম এ পড়বি না?

–প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবো। কোয়ালিফিকেশন তো বাড়াতেই হবে। এদিকে আয় অলি… বর্ষা একদিকের একটা জানলা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠলো একটা অপূর্ব দৃশ্য। একটা চমৎকার বাগান, অনেক রকম ফুলের গাছ, কয়েকটা বড় বড় আম গাছ, তার মাঝখানে একটি শ্বেত পাথরের নগ্ন নারীমূর্তি।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দুই বান্ধবী দাঁড়ালো জানলার পাশে। অলির তুলনায় বর্ষা বেশ লম্বা, তার মাথার চুল আলুথালু।

বর্ষা বললো, এটা লাহাদের বাড়ির বাগান, সুন্দর না? আমি বিনা পয়সায় এই বাগানের শোভাটা পেয়ে যাই। তবে জানলাটা সব সময় খুলি না, সব সময় দেখলে এই সুন্দর ব্যাপারটা যদি পুরোনো হয়ে যায়? ঐ লাহারা কি আর রোজ ওদের বাগানে এসে বসে?

পাথরের মূর্তিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বর্ষা বললো, ঐ মূর্তিটা দেখলেই আমার তোর কথা মনে পড়ে। মুখখানা ঠিক তোর মতন না?

লজ্জায় রক্তিম হয়ে অলি বললো, যাঃ, কী যে বলিস!

অলির কাঁধে হাত রেখে বর্ষা বললো, তুই বড় সুন্দর রে, অলি! এই বাগানটার মতন, নরম আর পবিত্র। এত নরম থাকিস না। এই পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর জায়গা, সবাই তোর ওপর সুযোগ নেবে।

কিছুক্ষণ দু জনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো জানলার কাছে। বর্ষা সাধারণত বেশী কথা বলে, এখন সেও নীরব। অলির মনে পড়ছে বাবলুদার কথা। বাবলুদা এখন আর বেশী আসে

তাদের বাড়িতে। ক’দিন আগে কফি হাউসে অলির সামনেই বাবলুদা একটি ছেলের সঙ্গে মারামারি করতে গিয়েছিল, সেই ছেলেটি নাকি কৌশিকের নামে কী খারাপ কথা বলেছে। বাবলুদা কি অলির চেয়েও কৌশিককে বেশী ভালবাসে? রাস্তায় কোনো ছেলে যখন অলির দিকে তাকিয়ে অসভ্য ইঙ্গিত করে, তখন তো বাবলুদা তাদের কিছু বলে না?

ছেলেবেলা থেকে দেখছে, তবু বাবলুদাকে এখনো ঠিক বুঝতে পারে না অলি। হঠাৎ হঠাৎ বাবলুদার মেজাজ বদলে যায়। বাবলুদা যখন-তখন তাকে জোর করে আদর করতে চায়, কিন্তু মুখে একটাও ভালো কথা বলে না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বর্ষা বললো, চন্দনার মতন তুইও হঠাৎ বিয়ে করে চলে যাবি না তো, অলি? তা হলে আমি তখন কী করবো?

অলি বললো, যাঃ, ওসব বিয়ে-টিয়ের কথা আমি ভাবিই না মোটে!

অলিকে আর একটু কাছে আকর্ষণ করে বর্ষা বললো, তোকে আমি বড় ভালোবাসি রে, অলি! তুই একদিন কলেজে না এলে আমারও ক্লাস-ফ্লাস করতে ইচ্ছে করে না!

বর্ষা অলির গালে তার গালটা ঠেকালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *