শাহরাজাদ বললো, এবারে আবু নবাসের কবি প্রতিভার দু-একটা নমুনা শোনাচ্ছি জাঁহাপনা। এক নিদ্রাবিহীন রাতে খলিফা হারুন অল-রাসিদ প্রাসাদের দরজায় অস্থিরভাবে পায়চারী করছিলেন। এমন সময় দেখতে পেলেন, তীর এক প্রিয়পাত্রী বাঁদী তার বিলাস গৃহের দিকে চলেছে। খলিফা তাকে অনুসরণ করতে করতে তার ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। খলিফা তাকে জাপটে ধরে বোরখা আর নকাব খুলে ফেলার জন্য জবরদস্তি করতে লাগলেন। বাঁদীর সঙ্গে সুখ-সম্ভোগ করার জন্য তার সমস্ত সত্ত্বা চঞ্চল হয়ে উঠলো। কিন্তু বাঁদীটি করুণভাবে প্রার্থনা জানাতে লাগলো। আজকের রাতটা আমাকে ক্ষমা করুন। জাঁহাপনা। আজ আমার শরীর খারাপ, আমি কথা দিচ্ছি, কাল রাতে আমি আপনার কামনা-চরিতার্থ করে দেব। আজ আমার শরীরটা ঠিক নাই, আজকের রাতটায় আমাকে রেহাই দিন। খোদা মেহেরবান, কাল রাতে সুগন্ধী আন্তর মেখে মোহিনীরূপ ধরে আমি আপনার সামনে হাজির হবো।
সুতরাং খলিফা আর কোনও জোরজার করলেন না। ফিরে এসে আবার পায়চারী করতে থাকলেন।
পরদিন তিনি খোজা-সর্দার মসরুরকে পাঠালেন সেই বাঁদীর কাছে। বললো, খলিফা আপনার কাছে পাঠালেন আমাকে। কাল রাতে তার সঙ্গে আপনার যে-কথা হয়েছিলো তা কি আপনার স্মরণে আছে?
সেদিনও বাঁদীর দেহ-মন ভালো ছিলো না। সকাল থেকেই শরীরটা জুৎসই মনে হচ্ছিল না। মসরুরকে সে বললো, খলিফাকে গিয়ে বলো, নিভৃত রাতের সব কথাই লুকিয়ে থাকে দিনের আলোর গভীরে—
বাক্কাসী এবং আবু মুসাব তার সমীপে এসে হাজির হলো। খলিফা তাদের বললেন, ‘নিভৃত রাতের সব কথাই লুকিয়ে থাকে দিনের আলোর গভীরে’ এই কথাকে কেন্দ্র করে তোমরা সবাই এক একটা কবিতা বানাও, দেখি।
প্রথমে অল রাক্কাসী একটানা বলে গেলো :
ওরে আমার অশান্ত অবুঝ হৃদয়—সাবধান,
যেওনা যেওনা সেখানে, এলেও তাকে দিও না ঠাঁই
কথা তার মিষ্টি মধুর, কিন্তু কেমন বেয়াড়া
তার দুর্বোধ্য হাসির তুলনা বুঝি নাই
তাইতো সে বলতে পারে হেঁয়ালী ক’রে
‘নিভৃত রাতের সব কথাই লুকিয়ে থাকে
দিনের আলোর গভীরে।’
এরপর আবু মুসাব এগিয়ে এসে শুরু করে :
হাতের পুতুল হয় এ হৃদয় আমার,
যা পুড়ে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে চায়।
মোহময় রাতের আঁধারে,
ইশারায় ডাকে বারে বারে;
ছিনিমিনি খেলা ক’রে কী সাধ মেটায়?
সে আমায় বিদ্ধ করে রাখে শুধু
দুর্বোধ্য ভাষার তীরে :
‘নিভৃত রাতের সব কথাই লুকিয়ে থাকে
দিনের আলোর গভীরে।’
সব শেষে আবু নবাস বলতে শুরু করে :
দুঃসহ সুন্দরী—আনন্দের ঝরনা,
অনিন্দ্য মধুর ভাষিণী—কী দেব বর্ণনা!
ঘন তমশাবৃত মধ্যরাতের তারা,
একমাত্র সাক্ষী ছিলো যারা,
তারা তো সবাই জানে,
কী তার মানে?
আর জানে সেই তরুবর,
মৃদুমন্দ সমীরণে তার শাখার মর্মর
বারবার ধ্বনিত হয়েছিলো আমার বুকে।
তোমার কথার কুহকে
ভুলালে আমায়।
দুঃখের বেদনা চেপে ফিরে আসি আশায় আশায়
ফিরে রাতে ফিরে পাব বলে।
কিন্তু হায় এ রাত্ৰিও গেলো বুঝি চলে।
তোমার শব্দের ইন্দ্রজাল আমাকে রয়েছে ঘিরে,
‘নিভৃত রাতের সব কথাই লুকিয়ে থাকে
দিনের আলোর গভীরে।’
কবিতাগুলো শোনার পর খলিফা খুশি হয়ে প্রথম দু’জন কবিকে অনেক টাকা পুরস্কার দিলেন। কিন্তু কবি নিবাস-এর ওপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন।
—নবাস আমি তোমার গর্দান নেব।
নবাস বিচলিত হয় না, আমার কী অপরাধ, জাঁহাপনা?
–তোমার কবিতায় যা বর্ণনা করলে তা শুনে আমি নিঃসন্দেহ যে, ঐ বাঁদীটার সঙ্গে নিশ্চয়ই তোমার কোনও গোপন সম্পর্ক আছে! কারণ সে সব ব্যাপার একমাত্র আমি আর সেই বাঁদী ছাড়া তৃতীয় কোনও প্রাণীর জানার কথা নায়। নিশ্চয়ই তুমি তার কাছ থেকে সব শুনেছ।
খলিফার কথা শুনে আবু নবাস হো হো করে হেসে ওঠে, আমাদের মহানুভব সুলতান জানেন না, সত্যিকার শিল্পীর কাছে কোনও সত্যই গোপন করা যায় না। সে তার অন্তর দৃষ্টি দিয়ে সমস্ত গোপন রহস্য জেনে নিতে পারে। কবিদের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমাদের পয়গম্বর বলেছেন, কবিরা পাগলের মতো উদাম অসংলগ্ন হয়, প্রেরণাই তাদের পরিচালনা করে ভালোর দিকে অথবা খারাপ পথে। তারা অনেক সুন্দর সুন্দর নীতি কথা উপহার দেয় আমাদের। কিন্তু নিজেরা তা মেনে চলে না।
আবু নবাসের এই সব যুক্তি-তর্কে খলিফা ক্ষান্ত হন। খুশিও হন। অন্য দুজনকে যে ইনাম দিয়েছিলেন তার দ্বিগুণ দিলেন তাকে।
এই কাহিনী শোনার পর সুলতান শাহরিয়ার বললো, খোদা হাফেজ, আমি হলে কিন্তু আবু নবাসকে রেহাই দিতাম না। আসল রহস্য টেনে বের করতাম। তারপর তার গর্দান নিতাম। আমার এখনও ধারণা, বাঁদীটার সঙ্গে তার গুপ্ত প্রেম ছিলো। এবং তার কাছ থেকে জেনেই সে ঐ কবিতা বানিয়েছিলো। আমি বিশ্বাস করি না, কবি হলেই তারা গোপন যা কিছু সবই জানতে পারে। শাহরাজাদ, তুমি ভবিষ্যতে ঐ লম্পট কবিটাকে নিয়ে আর কোনও কিসসা শোনাবে না আমাকে। লোকটা ইসলাম, কানুন বা খলিফা কারুর উপরই শ্রদ্ধাবান নয়।
শাহরাজাদ বলে, তাই হবে জাঁহাপনা, আবু নবাসের আর কোনও কাহিনী আপনাকে শোনাবো না। আচ্ছা, এবারে একটা গাধার গল্প বলছি, শুনুন।