একদিন উজির জাফর খলিফা হারুন অল রসিদকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলো। নানা উপাচারে খলিফাকে খানাপিনা করাচ্ছে সে, এমন সময় খলিফা জাফরকে বললেন, জাফর তোমার বাড়িতে দেখছি ভারি সুন্দর বাঁদী রেখেছো। আমার খুব ইচ্ছা মেয়েটাকা আমি তোমার কাছ থেকে কিনে নেব।
জাফর বললো, কিন্তু ধর্মাবতার, আমি ওকে বিক্রি করতে চাই না।
খলিফা বললেন, তা হলে এমনিতেই দাও।
জাফর বলে, তাও আমি দিতে পারবো না, জাঁহাপনা।
এবার খলিফা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। আমি বার বার তিন কসম খেয়ে বলছি জাফর আমার কথা যদি না মান-যদি ন্যায্য দাম নিয়ে বিক্রি না কর, অথবা এমনিতে না দাও তা হলে আজই আমি আমার প্রধান বেগম জুবেদাকে তালাক দিয়ে দেব।
জাফর সমানে গলা চড়িয়ে বলতে লাগলো, আমিও বার বার তিনবার কসম খেয়ে বলছি, আপনার কথা যদি মানতেই হয় তবে, আমার বালবাচ্চাদের মা—আমার বিবিকে বিয়ান তালাক দিয়ে দেব আমি। তারা দুজনেই মদের ঝোকে এইরকম মারাত্মক কসম খেয়ে বসলো কিন্তু একটুক্ষণ পরে দুজনেই বুঝতে পারলে কাজটা ভালো হয়নি। তখন কীভাবে এই সঙ্কট থেকে রেহাই পাওয়া যায় তারই উপায় খুঁজতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পরে খলিফা একটা মতলব বের করলেন।
–জাফর, এসো আমরা কাজী ইউসুফের পরামর্শ চাই। তিনি আইনজ্ঞ মানুষ, নিশ্চয়ই এর একটা বিধান করে দিতে পারবেন।
তখুনি কাজী ইউসুফের কাছে লোক পাঠানো হলো। এত রাতে খলিফা ডেকে পাঠিয়েছেন, ইউসুফ চিন্তিত হলো, নিশ্চয়ই এমন কোনও কাণ্ড তিনি করে বসেছেন যার ফলে ইসলাম বিপন্ন হতে বসেছে। তডিঘডিবাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা খচ্চরে চেপে কাজী ইউসুফ আগস্তুক পেয়াদাকে বললো, তুমি এই বাক্সটা নিয়ে রওনা হও, আমি এখুনি আসছি।
কাজী ইউসুফ এলো। খলিফা এবং জাফর তারই প্রতীক্ষায় সময় গুণছিলো। কাজী ইউসুফের সম্মানে দু’জনেই আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। খলিফা একমাত্র ইউসুফকেই এই সম্মান দিতেন। আর কাউকেই না। খলিফা বললেন, আমি আপনাকে বড় বিপদে পড়ে ডেকে পাঠিয়েছি।
খলিফা আগাগোড়া সব ঘটনা খুলে বললেন তাকে। —ধর্মাবতার, আবু ইউসুফ বললো, ব্যাপারটা একেবারেই জটিল কিছু না, পানির মতো সোজা সরল।
তারপর জাফরের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি বাঁদীর অর্ধেকটা খলিফাকে বিক্রি করবেন, বাকী অর্ধেকটা দান করবেন।
কাজীর বিচারে খলিফা খুশিতে নেচে ওঠেন। এতে শুধু যে তিনি নিদারুণ সঙ্কট থেকে অব্যাহতি পেলেন তাই নয়, তার আকাঙ্ক্ষিত সুন্দরী বাঁদীটাকেও পাওয়ার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। খলিফা বললেন, মহামান্য কাজী সাহেব, আপনি আর কালবিলম্ব করবেন না। তাড়াতাড়ি আইনের খুঁটিনাটি সেরে নিন যাতে আমি মেয়েটিকে নিয়ে এখুনি চলে যেতে পারি।
তখনি বাঁদীকে সামনে হাজির করতে বলা হলো। কাজী ইউসুফ বললো একজন ক্রীতদাসকে ডাকুন।
সঙ্গে সঙ্গে এক দশাসই চেহারার ক্রীতদাসকে আনা হলো।
ইউসুফ বললো, এই ক্ৰীতদাসের সঙ্গে আমি বাঁদীটার শাদী দিয়ে দিচ্ছি। শাদীর পর সে তার বিবিকে সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ান তালাক দিতে পারে। তার খেসারৎ হিসাবে তাকে দেন মোহর দিতে হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হবে। শাদীর সঙ্গে সঙ্গেই সে তাকে এক হাজার দেন মোহর দিয়ে তালাক দিয়ে দেবে। তালাক হয়ে গেলে তার পর এই বাঁদীকে খলিফা অনায়াসেই ইসলাম বিধি অনুসারেই রক্ষিতা করতে পারবেন।
ইউসুফ এবার ক্রীতদাসকে উদ্দেশ করে বললো, তুমি একে শাদী করতে চাও?
নফরটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, চাই।
—তা হলে এই মুহূর্তে এই বাঁদীর সঙ্গে তোমার শাদী হয়ে গেলো। আচ্ছা, এই নাও এক হাজার দেন মোহর। এবার এই দিনারগুলো তোমার সদ্য শাদী করা এই বিবিকে দিয়ে বলো, এক তালাক, দুই তালাক বয়ান তালাক দিলাম তোমাকে। এই নাও তোমার খেসারতের দেন মোহর।
ক্রীতদাসটা অবাক হয়ে বললো, কিন্তু এই মাত্র তো আপনি আমার সঙ্গে ওর শাদী দিলেন। এখন সে আমার আইনসম্মত বিবি। কেন তাকে তালাক দিতে যাবো? না—দেব না। আমি আমার বিবিকে ঘরে নিয়ে যাবো। আমরা সুখে ঘর সংসার করবো।
ক্রীতদাসের এই উদ্ধত্য দেখে ক্ৰোধে ফেটে পড়েন। খলিফা। কাজীকে উদ্দেশ করে বললেন, একটা ক্রীতদাসের এত বড় স্পর্ধা!
ইউসুফ খলিফাকে ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করলো।–আপনি শান্ত হোন ধর্মাবতার, আমি সব সমাধান করে দিচ্ছি। ক্রীতদাস আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আইনতঃ কোনও অপরাধ করেনি। কারণ বাঁদী এখন তার শাদী করা বিবি। সে যদি রাজি না হয়, তরে তাকে তালাক নাও দিতে পারে। কিন্তু তারও বিধান ইসলামেই দেওয়া আছে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনি শুধু এই ক্রীতদাসকে কিছুক্ষণের জন্য আমাকে দান করে দিন।
হারুন অল রসিদ তৎক্ষণাৎ বললেন, ওকে আমি আপনাকে দিয়ে দিলাম।
এইবার কাজী ইউসুফ বাঁদীকে বললো, এই ক্রীতদাসটাকে আমি তোমাকে উপহার দিলাম—নেবে একে?
বাঁদীটা বললো, হ্যাঁ, নেব।
কাজী ইউসুফ এবার সোচ্চার কণ্ঠে বললো, ব্যাস, কেল্লা ফতে। তোমাদের শাদী বাতিল হয়ে গেলো। এখন থেকে এই ক্রীতদাস আর তোমার স্বামী নয়, নাফর মাত্র। এই-ই ইসলামের বিধান। আমার বিচার খতম; এবার ধর্মাবতার আপনি অনায়াসে এই মুক্ত বাঁদীকে আপনার রক্ষিতা করে নিয়ে যেতে পারেন।
কাজীর এই বিচার বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে খলিফা লাফিয়ে উঠলেন।
—আপনার তুল্য বিচারক তামোম দুনিয়ায় আর দ্বিতীয় নাই, কাজীসাহেব।
খলিফার হুকুমে তখনি একখানা বিরাট রেকবী ভর্তি সোনার মোহর। এনে কাজী আবু ইউসুফের সামনে ধরা হলো। খলিফা বললেন, আমি খুশি হয়ে আপনাকে দিচ্ছি। মেহেরবানী করে গ্রহণ করুন।
ইউসুফ খলিফার বদান্যতায় গদগদ হয়ে বললো, আল্লাহ। আপনাকে দীর্ঘায়ু করুন। ধর্মের পথে অবিচল থেকে আপনি প্রজোপালন করতে থাকুন।
তারপর সেই পেয়াদাকে বললো, আমার বাক্সটা নিয়ে এসো।
মোহর ঠাসা রেকবীখানা বাক্সে পুরে নিয়ে কাজীসাহেব স্বগৃহে! ফিরে গেলো।
এই ছোট্ট কাহিনী থেকে একটি আইনের জটিল সমস্যার সমাধান পাওয়া গেলো।
শাহরাজাদ একটুক্ষণ থেমে আর একটি কাহিনী বলতে শুরু করলো।