আদালতে প্রতাপ একটি সম্পত্তি ঘটিত বিবাদের সওয়াল শুনছিলেন। মামলাটি অতি বিরক্তিকর, দুই ভাইয়ের পৈতৃক জমি-জায়গার শরিকানা নিয়ে গণ্ডগোল, মামলা চলছে প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে।
এক এক সময় প্রতাপের মনে হয়, আগেকার কাজীর বিচারই বোধ হয় ভালো ছিল। এই মামলায় প্রথম থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বড় ভাইটি ছোট ভাইকে ঠকাচ্ছে। প্রতাপের ইচ্ছে করে, বড় ভাইটির কান ধরে দুই থাপ্পড় মেরে বলতে, এই হারামজাদা, দে, তোর দখল করা সম্পত্তির অর্ধেকটা ছোট ভাইকে দিয়ে দে!
কিন্তু আইনের কূট কচালিতে এই রকম সমাধান তো সম্ভব নয়। বছরের পর বছর মামলা গড়াবে, উকিলদের পকেট ভারি হবে।
মামলা চলার মধ্যে প্রতাপের পেশকার তাঁর হাতে একটা টেলিগ্রাম ধরিয়ে দিল। অতি জরুরি তার বার্তা, পাঠিয়েছেন দেওঘর থেকে ওস্তাদজী। “ইয়োর মাদার ওয়ান্টস টু সী ইউ। কাম শার্প। বিশ্বনাথ।”
প্রতাপ অতীব বিস্মিত হলেন। প্রথম কথা, বাড়িতে না পাঠিয়ে এটা আদালতের ঠিকানায়। পাঠানো হলো কেন? দেওঘরের চিঠিপত্র সব বাড়িতেই আসে। দ্বিতীয় কথা, “ইয়োর মাদার ওয়ান্টস টু সী ইউ” মানে কী? মা খুব অসুস্থ। আগের চিঠিতেও বিশ্বনাথ লিখেছেন যে মা ভালো আছেন। মা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই কথাই তো জানানো উচিত ছিল। মা শুধু দেখা করতে চেয়েছেন বলে কি ততটা গুরুত্ব বোঝায়? তার জন্য আর্জেন্ট টেলিগ্রাম?
গত পুজোয় অবশ্য দেওঘর যাওয়া হয়নি, মা’র সঙ্গে দেখা হয়নি অনেকদিন।
যথারীতি মামলাটির আর একটি তারিখ ফেলে প্রতাপ উঠে গেলেন নিজের চেম্বারে। তাঁর চিত্ত খুব উতলা হয়ে গেছে। মা দেখা করতে চেয়েছেন। প্রায় দেড় বছর মায়ের কাছে যাওয়া হয়নি, এজন্য একটা প্রচণ্ড অনুতাপবোধ তাঁকে দংশন করতে লাগলো।
শরীর খারাপের জন্য প্রতাপ কিছুদিন আগেই ছুটি নিয়েছেন, এখন ছুটি পাওয়ার অসুবিধে আছে। তবু তাঁকে যেতেই হবে।
মাসের ছাব্বিশ তারিখ, হাতে বিশেষ টাকা পয়সা নেই। দেওঘরে যেতে গেলে কিছু কেনাকাটি করতেই হয়, ওস্তাদজী একবার লিখেছিলেন যে বাড়িটা না সারালে কোনদিন কড়িকাঠ খসে পড়বে, তা ছাড়া মায়ের চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু টাকা হাতে রাখা দরকার। এত টাকা এখন কোথায় পাওয়া যাবে?
বিমানবিহারীর কাছ থেকে অনেক অগ্রিম নেওয়া আছে, এখন আর চাওয়া যায় না। যদিও বিমানবিহারী ঘুণাক্ষরে জানতে পারলেই পকেটে খুঁজে দেবেন টাকা।
অন্তত হাজার খানেক টাকা তো দরকারই। কে দেবে? প্রতাপের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স এখন দুশো-আড়াইশোর বেশি নয়। এত বড় সংসারের ব্যয়, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, মাইনের টাকাতে কিছুতেই কুলোয় না। উপরি রোজগার বলতে বইয়ের অনুবাদ, কিন্তু এখন তার চাহিদাও কমে গেছে। মাতৃভাষার মাধ্যমে সবরকম শিক্ষা চালু হবে বলে একটা রব উঠেছিল, সেটা কেন যেন ধামা চাপা পড়ে গেল, এখন চতুর্দিকে গজাচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল।
প্রতাপ লাখ লাখ টাকার মামলার নিষ্পত্তি করেন, এখন তিনি নিজেই এক হাজার টাকার চিন্তায় কাতর। খুব সংকটে পড়ে মমতার দু’একখানা গয়না বিক্রি করতে হয়েছে, কিন্তু নিজের মায়ের চিকিৎসার জন্য মমতার কাছে হাত পাততে তাঁর কিছুতেই ইচ্ছে হলো না। এই একটা ব্যাপার আছে, যা মুখে কোনোদিন বলা হয়নি, কিন্তু বাস্তবে কঠিন সত্য। মমতা তাঁর খুবই আপন, তবু প্রতাপ লক্ষ করেছেন, যখন নিজের মা বা দিদি বা দেওঘরের দিদি-ওস্তাদজীর ব্যাপারে কখনো কোনো খরচপত্রের প্রসঙ্গ এসে পড়ে, তখনই মমতার সঙ্গে সে সব আলোচনা করতে প্রতাপ সঙ্কোচ বোধ করেন। মমতা যেন তখন অন্য দলের লোক হয়ে যান। যদিও মমতা কৃপণ নন মোটেই, ননদ বা শাশুড়ির সঙ্গে তাঁর ঝগড়াও নেই, তবু যেন কিসের একটা বাধা…
প্রতাপ খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। তিনি একদা এক সচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন, এখনও অর্থ সঙ্কটে পড়লে তাঁর মেজাজ গরম হয়ে যায়। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে হলেও তিনি এক হাজার টাকা হেসে-খেলে যে কোনো কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে দান করতে পারতেন। অথচ, আজ তাঁর মাতৃদায়, তিনি টাকা জোগাড় করতে পারছেন না।
বেশি দেরি করা যাবে না, একটা কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে। প্রতাপ শুনেছেন, এই এ আদালতেই অনেকে টাকা ধার দেয়। বিপন্নদের ঋণ দিয়ে চড়া হারে সুদ নেয়। প্রতাপের অধস্তন কর্মচারিরা কেউ কেউ তাঁর তুলনায় অনেক গুণ অবস্থাপন্ন।
তিনি তাঁর পেশকার রতনমণি নাগকে ডেকে পাঠালেন। রতনমণির চিমসে চেহারা, ধুতির ওপর হাফ শার্ট পরে। চোখের দৃষ্টিতে সব সময় একটা ভয় ভয় ভাব। কিন্তু প্রতাপ জানেন, এই মানুষটি অতিশয় ধূর্ত।
প্রতাপ বিনীতভাবে বললেন, নাগবাবু, আমার মায়ের খুব অসুখ, কিছু টাকার দরকার হয়ে পড়েছে, শুনেছি এখানে কারা যেন টাকা ধার দেয়…
প্রতাপের কথা শুনে রতনমণির চোখ চক চক করে উঠলো। সে বললো, হ্যাঁ, সার, ব্যবস্থা হয়ে যাবে স্যার, আপনার কত টাকা লাগবে, কবে লাগবে বলুন। এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। টাকা ঠিক…-বাড়িতে পৌঁছে যাবে!
প্রতাপ রতনমণির দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এই লোকটি কী ইঙ্গিত করছে তা বুঝতে তাঁর কোনো অসুবিধে হলো না। টাকা বাড়িতে পৌঁছে যাবে, এর মানে তো অতি সরল।
প্রতাপ এক মুহূর্ত ভাবলেন, তিনি আর কত ঋণের বোঝা টানবেন? তিনিও এবারে একটুর জন্য রাজি হয়ে গেলে ক্ষতি কী? সারা দেশ জুড়েই তো এই কারবার চলছে। আণ্ডার হ্যাণ্ড মানি, ব্ল্যাক মানি, গ্র্যাক্ট? প্রতাপ কি কোনোদিনই এইসব দমন করতে পারবে? কোনো আশা নেই। ইফ ইউ ক্যানট বীট দেম, জয়েন দেম!
পর মুহূর্তেই প্রতাপ বংশ গরিমায় অহংকারী হয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, টাকাটা আমার আজ, এক্ষুনি দরকার। আটশো থেকে হাজার। যা সুদ লাগে আমি দেবো। সুদ আর প্রিন্সিপালের খানিকটা অংশ সামনের মাস থেকে আমার মাইনে থেকে কাটা যাবে।
প্রতাপের কণ্ঠস্বর শুনেই রতনমণি খানিকটা সাবধান হয়ে গিয়ে বললো, আটশো…হাজার…অত টাকা তো স্যার এক্ষুনি জোগাড় করা শক্ত? তবু আমি দেখছি চেষ্টা করে।
–দেখুন। আধ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে জানাবেন। আমার খুবই দরকার। এখানে না পেলে আমাকে অন্য জায়গায় চেষ্টা করতে হবে।
প্রতাপের শরীরে একটা অস্থিরতা জেগে উঠলো। যেন দেরি হয়ে যাচ্ছে খুব। মায়ের সত্যি কী হয়েছে তার কেন একটু ইঙ্গিত দেননি ওস্তাদজী? যদি মায়ের সঙ্গে আর দেখা না হয়! আজ রাত্তিরেই ট্রেন আছে।
দারোয়ানরাও নাকি যখনতখন হাজার দু’হাজার টাকা ধার দিতে পারে। ওরা বাড়ি ভাড়া দেয় না, ছাতু খেয়ে টাকা জমায় আর দেশের বাড়িতে টাকা পাঠায়। রতনমণি যদি টাকা জোগাড় করতে না পারে, প্রতাপ দারোয়ানদের কাছে চাইবেন? নিজের মুখে বলবেন কী করে? আদলিকে দিয়ে বলাবেন? তা প্রতাপ মুখ ফুটে বলতে পারবেন না! অহংকার! না খেয়ে শুকিয়ে যদি মরতে হয় কখনো, তবু প্রতাপ এই অহংকার ছাড়তে পারবেন না।
রতনমণি একটু পরে এসে বললো, নশো টাকা জোগাড় করা গেছে, স্যার!
জোগাড় শব্দটির ওপর সে জোর দিল, হয়তো টাকাটা তার নিজেরই।
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক আছে, ওতেই হবে। সুদ কত?
–সে কথা এখন আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনার বিশেষ দরকার বলছেন, এখন কাজ চালিয়ে নিন।
প্রতাপ গম্ভীর ভাবে বললেন, ওভাবে আমি কারুর কাছ থেকে টাকা নিতে পারবো না। আপনি হ্যাণ্ড নোট তৈরি করে আনুন, আমি তাতে সই করে তারপর টাকা নেবো।
টাকাটা হাতে পাবার পর প্রতাপ সত্যিকারের কৃতজ্ঞ বোধ করলেন রতনমণির ওপর। আর কারুর কাছে হাত পাতার গ্লানি তো তাঁকে সহ্য করতে হলো না?
বাড়ি ফিরে খবরটি প্রকাশ করতেই মমতা বললেন, তুমি একা যাবে? না, না, তা হবে না, তোমার নিজেরই শরীর ভালো না।
প্রতাপ মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও মমতা লক্ষ করেছেন, ইদানীং প্রতাপের আহারে রুচি নেই, সেটাই তাঁর শরীর খারাপের লক্ষণ। আগে প্রতাপ যাই-ই খেতেন তৃপ্তি করে খেতেন। মুসুরির ডালের বদলে একদিন ভাজা মুগের ডাল হলেই বলতেন, বাঃ। বড় ভালো হয়েছে তো, আর একটু দাও! সেই মানুষ এখন কী রান্না হলো, না হলো তা গ্রাহ্যই করেন না।
কিন্তু কে যাবে সঙ্গে? মমতা যেতে পারেন না, মুন্নির পরীক্ষা আছে সামনের সপ্তাহে। বাবার সঙ্গে বাবলুরই যাওয়া উচিত, কিন্তু কোথায় বাবলু? সে কোনোদিনই আটটার আগে বাড়ি ফেরে না। তার পড়াশুনোর জন্য তাড়া দিয়ে কোন লাভ নেই। সে নিয়মিত সকাল-সন্ধেবেলা কিছুতেই পড়তে বসে না। তার পড়াশুনোর ধরনটাই অন্য রকম। যেদিন তার ইচ্ছে হবে, সে সারা রাত জেগে পড়বে। পরীক্ষার আগেই তার এরকম জেদ চাপে। রেজাল্ট তো খারাপ করে না।
এখন বাবলু কোথায় আছে, তাকে খবর দেবার উপায় নেই। প্রতাপও বাবলুকে সঙ্গে নিতে চান না। প্রতাপ কবে ফিরতে পারবেন ঠিক নেই, কলকাতার বাড়িতে বাবলুর থাকা দরকার। বাড়িওয়ালাদের অত্যাচার ইদানীং খুব বেড়েছে। বাড়িতে একজনও পুরুষ মানুষ না থাকলে ওরা আরও পেয়ে বসবে।
সুপ্রীতি বললেন, আমি তোর সঙ্গে যাবো, খোকন! মাকে আমি অনেকদিন দেখিনি।
প্রতাপ সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। সুপ্রীতি তার মায়ের বড় মেয়ে, প্রথম সন্তান, তাঁকে দেখলে মায়ের ভালো লাগবে। তা ছাড়া, আর যদি কখনো দেখা না হয়?
এর পর সুপ্রীতি একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, তুতুলকেও নিয়ে যাবো?
এত বড় হয়েছে তুতুল, তবু তার সম্পর্কে ভয় পান সুপ্রীতি। মেয়েটা শুধু মেডিক্যাল কলেজে যায় আর ফিরে আসে, এ ছাড়া যেন তার আর কোনো জীবন নেই। আগে গান শুনতে কত ভালোবাসতো, এখন গান শোনে না। নিজে থেকে কারুর সঙ্গে একটা কথাও বলে না। সুপ্রীতির সব সময় আশঙ্কা হয়, বাম্ব ফিউজ হয়ে যাবার মতন, এ মেয়েটা হঠাৎ যদি একদিন মরে যায়?
এ প্রস্তাবও প্রতাপের পছন্দ হলো। ট্রেন ভাড়া বেশি লাগবে, তবু তুতুলকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভালো। সে ডাক্তারির অনেকখানি জানে, সে মায়ের চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারবে। তা ছাড়া প্রতাপ তুতুলের সঙ্গে ভালো করে কথাবার্তা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন কয়েকদিন ধরেই।
তুতুল কিন্তু যেতে রাজি হলো না, তার কলেজ খোলা, সে এখন কী করে বাইরে যাবে? পড়াশুনোই তো তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। একদিনের জন্যও সে কলেজ কামাই করে না।
প্রতাপ তার আপত্তি শুনলেন না। রীতিমতন ধমকের সুরে তিনি বললেন, তোর যদি জ্বর হতো, খুব অসুখ করতো, তা হলেও তুই কলেজে যেতি? কিংবা, আমি যদি কাল হঠাৎ মারা যাই, তাহলেও তুই কাল কলেজে যাবি?
সুপ্রীতিও অনেক করে মেয়েকে বোঝাতে চাইলেন, তুতুল ঘাড় গোজ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কোনো কথার উত্তর দেয় না।
প্রতাপ শেষ আদেশ জারি করলেন, আর কোনো কথা শুনতে চাই না। ওকে যেতেই হবে। আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে, তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র গুছিয়ে নে!
কিছু জিনিসপত্রের কেনাকাটির জন্য প্রতাপ বাড়ি থেকে বেরুতে যাচ্ছেন, সেই সময় সুপ্রীতি একটা একশো টাকার নোট দিতে এলেন তাঁকে।
প্রতাপ বললেন, এটা কী হবে? টাকা আমার কাছে আছে যথেষ্ট।
সুপ্রীতি জোর দিয়ে বললেন, না, খোকন, আমাদের দু’জনের টিকিট, আরও অনেক খরচপত্র আছে, এটা তুই রাখ।
প্রতাপ বললেন, দিদি, এমনভাবে আমাকে বলো না, আমার মনে লাগে। যদি হাত-পা ভেঙে কখনো অথর্ব হয়ে পড়ি, তখন হয়তো আর কিছুই পারবো না। ও টাকাটা তোমার সঙ্গে রাখো, পরে লাগলে দেখা যাবে।
বরানগরের বাড়ি থেকে এক সময় সুপ্রীতি কিছু টাকা পেতে শুরু করেছিলেন, তা আবার বন্ধ হয়ে গেছে। আর একটি মামলা চাপিয়েছে অন্য কে শরিক। এখন সব মিলিয়ে তিন চারটি বেশ জটিল মামলা, প্রতাপের ধারণা, ঐ মামলা করতে করতেই সব কটি শরিক সর্বস্বান্ত হবে, ঐ বাড়ি থেকে তাঁর দিদির আর কিছু পাওয়ার আশা নেই। সুপ্রীতিও আর মামলার ঝঞ্ঝাটে যেতে চান নি।
প্রতাপ জানেন, দিদির গয়নাও সব শেষ হয়ে গেছে। তবে, তুতুল শিগগিরই ডাক্তারি পাশ করবে, ঐ মেয়েই তো দিদির শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার।
এরই মধ্যে মমতা বাবলুর জন্য উদ্বেগ বোধ করতে লাগলেন। ছেলেটা কোথায় থাকে, কাদের সঙ্গে মেশে, তাই বা কে জানে! তার বাবা একটা দুঃসংবাদ পেয়ে দেওঘর চলে যাচ্ছেন, ছেলেটা সে কথা জানলোই না। বাবলু তো ওঁদের অন্তত ট্রেনে তুলে দিয়ে আসতে পারতো! আজকাল বাবলু বাড়ির কোনো খবরই রাখে না; শুধু খাওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক।
প্রতাপ বেরিয়ে যেতে তিনি মুন্নিকে বললেন, একবার দেখে আসবি নাকি, মুন্নি, তোর ছোড়দা অলি বুলিদের বাড়িতে আছে কি না?
মুন্নি এখন একা একা স্কুল যায়। কালীঘাট থেকে ভবানীপুর সে যেতে পারে রাস্তা চিনে, খুব দূর তো নয়।
কিন্তু মুন্নি বললো, ছোড়দা ওখানে বিকেলবেলা থাকে না।
মমতা বিরক্ত হয়ে বললেন, তুই কী করে জানলি? তোকে একবার দেখে আসতে বলছি, তুই যাবি কিনা বল্!
মুন্নি বললো, মা, তুমি সব সময় আমাকে বকো। আমি বলছি, ছোড়দা বিকেলবেলা ওখানে যায় না। তবু তুমি আমাকে জোর করে পাঠাবে?
–তুই কী করে জানলি, সেই কথাটা আমাকে বল?
–ছোড়দা ওর বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে, আমি শুনেছি। সায়েন্স কলেজ থেকে বেরিয়ে ছোড়দা মানিকতলায় কোথায় যেন যায়। সেখানে অনেকক্ষণ থাকে। ছোড়দা সেখানে কাকে যেন পড়ায়।
–পড়ায়? ওকে যে টিউশানি করতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে?
–সে আমি কী জানি!
মমতার আবার চিন্তা বাড়লো। নিষেধ করা সত্ত্বেও বাবলু গোপনে গোপনে টিউশনি করছে? বাবলু তাঁর কাছে অনেক কিছু লুকোয়?
প্রতাপ অনেক কিছু বাজার করে ফিরলেন ঘণ্টাখানেক পরে। কোথাও যাবার আগে প্রতাপ শোরগোল করতে ভালোবাসেন। এটা নেওয়া হয়েছে? ওটা নেওয়া হয়েছে? খাবার জলের কুঁজো? মায়ের জন্য জর্দার কৌটো, সুপুরি, আখের গুড়। সুপ্রীতির সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক গোছানো হয়েছে? তুতুলের?
মমতা তাড়াতাড়ি রুটি, তরকারি আর ডিমের ঝোল বানিয়ে দিলেন। প্রতাপরা যখন খেতে বসেছেন, তখন মমতা ভাবছেন, এর মধ্যেও যদি বাবলু ফিরে আসতো! কেন যেন তাঁর মনে। হচ্ছে, যাবার আগে প্রতাপের সঙ্গে বাবলুর একবার দেখা হবার বিশেষ প্রয়োজন ছিল!
বাবলু এলো না, প্রতাপরা বেরিয়ে পড়লেন।
সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটাই যে খুব খালি হয়ে গেল তাই-ই নয়, মমতার বুকটাও খালি হয়ে গেল। এরকম অনুভূতি আগে কখনো হয়নি, প্রতাপ যেন অনেক দূরে চলে গেলেন, আবার কবে ফিরবেন তার ঠিক নেই। সুপ্রীতি আর তুতুলকে নিয়ে প্রতাপ যাচ্ছেন তাঁর মায়ের কাছে, এটা যেন ওঁদের একটা পারিবারিক সম্মিলন, এর মধ্যে মমতার ভূমিকা অতি গৌণ। প্রতাপ যত আগ্রহ করে সুপ্রীতি আর তুতুলকে নিয়ে গেলেন, মমতা আর মুন্নি যেতে চাইলে কি রাজি হতেন? খরচপত্রের কথা তুলতেন না? প্রতাপ নিশ্চয়ই টাকা ধার করে এনেছেন, মমতা তা বুঝেছেন ঠিকই, অথচ প্রতাপ সে সম্পর্কে কিছুই বলেননি তাঁকে!
মমতা খুব ভালো করেই জানেন, কারুর কাছে টাকা চাইতে, ধারের জন্য তো বটেই, এমন কি নিজের প্রাপ্য টাকা চাইতেও প্রতাপের আত্মাভিমানে লাগে।
মমতার নিজের মা নেই অনেকদিন, শাশুড়িকে তিনি মায়ের মতনই দেখেন। সুহাসিনীর যদি গুরুতর অসুখ হয়ে থাকে, সুপ্রীতির মতন মমতারও কি তাঁকে একবার দেখার ইচ্ছে করতে পারে না! অথচ প্রতাপ একবারও সে কথা বললেন না মমতাকে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বুঝি কখনো রক্তের সম্পর্ক হয় না?
মমতা রান্নাঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন।
অতীন ফিরলো ন’টার পর। প্রত্যেকদিনই সে সর্বগ্রাসী খিদে নিয়ে ফেরে। জামা খুলতে খুলতেই সে চেঁচিয়ে বলে, খাবার দাও! খাবার দাও!
চোখের জল মুছে মমতা ছেলের খাবার বেড়ে দিলেন।
খেতে বসেই অতীন চেঁচিয়ে বললো, আজও রুটি? ও আর পারি না! কম খান আর গম খান! কম খান আর গম খান! হারামজাদারা দেশের লোককে খাবার দিতে পারিস না,আমেরিকান গম খাওয়াচ্ছিস! যত সব জোচ্চোরের দল!
মমতা অতীনের পাশে বসে পড়ে বললেন, বাবলু, তুই ছাত্র পড়াচ্ছিস?
–কে বললো, তোমাকে?
–আমার কথার উত্তর দে!
–যদি বা পড়াই, ছাত্র পড়ানো কি খারাপ কাজ?
–তোর বাবা তোকে বারণ করেছে না? এ বছর তোর ফাইনাল ইয়ার-টাকা রোজগার করতে গিয়ে নিজের রেজাল্ট যদি খারাপ হয়…এত টাকারই বা দরকার কিসের ভোর?
–মা, আমি টাকা নিয়ে ছাত্র পড়াই না আর। আমাদের একটা স্টাডি সার্কল আছে। সেখানে আমাদের চেয়ে যারা বেশি কিছু জানে, তারা আমাদের পড়ায়। আমরা আবার অল্প বয়েসী ছেলে-মেয়েদের কিছু কিছু পড়াই। ধরো, যারা স্কুল কলেজে পড়ার সুযোগ পায় নি, তাদেরও তো কিছু শেখাতে হবে। আমার রেজাল্টের জন্য বাবাকে চিন্তা করতে বারণ করো!
হঠাৎ কথা থামিয়ে অতীন উৎকর্ণভাবে এদিক-ওদিক তাকালো। ভুরু কুঁচকে গেল তার। সে জিজ্ঞেস করলো, বাবা কোথায়, এখনো ফেরেননি?
মমতা কোনো উত্তর দিলেন না।
–বাড়িটা এত চুপচাপ কেন? পিসিমণির ঘর বন্ধ। পিসিমণি, ছোড়দি, এরা সব কোথায় গেছে?
মমতা কোনো উত্তর দিতে পারছেন না, তাঁর গলার কাছে বাষ্প জমে গেছে। তাঁর স্বামী যেন তাঁকে আজ অবহেলা করে চলে গেলেন। আদালত থেকে ফিরে প্রতাপ কি একটিবারও মমতাকে ঘরে ডেকে নিয়ে আলাদা করে কিছু বলেছেন? তিনি কতদিন পর ফিরবেন, কী করে এই ক’দিন সংসার চলবে, সে বিষয়ে কিছুই বলে গেলেন না।
ছেলের ওপরই বা ভরসা করবেন কী করে মমতা। ছেলের বাড়ির প্রতি মন নেই। মমতা তাঁর ছেলেকে আঁকড়ে ধরতে গেলেও সে পিছলে পিছলে বেরিয়ে যায়। মমতা তা হলে কার ওপরে আর ভরসা করবেন?
খাওয়া থামিয়ে অতীন এক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ যেন সমস্ত বাইরের জগৎ ভুলে গিয়ে সে দেখতে লাগলো শুধু মাকে। তার বুকটা কেঁপে উঠলো একবার।
–মা, কী হয়েছে বলো তো। বাবা কোথায়? পিসিমণিরা কোথায় গেছে? মমতা আর সামলাতে পারলেন না নিজেকে। মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে চোখের জল ঝরাতে ঝরাতে বললেন, তাতে তোর কী আসে যায়? এ বাড়িতে কেউ মরুক, বাঁচুক, তোর কিছুই আসে যায় না।
অতীন সেই মুহূর্তে বালক হয়ে গেল। সে উঠে এসে মায়ের মাথার চুলে গাল ঠেকিয়ে বললো, মা, তোমার কী হয়েছে বলো? আমি তো আছি। আমি সব সময় তোমার পাশে থাকবো। তুমি কাঁদছো কেন, বলো? কী হয়েছে? কী হয়েছে?