2 of 3

২.২০ ভিত নেই তবু বাসস্থান গড়ে উঠেছে

ভিত নেই তবু বাসস্থান গড়ে উঠেছে, মাথার ওপর চাল যখন তখন ঝড়ে উড়ে যায়, তাহলেও এরই মধ্যে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ সবই চলে। খিদের কান্না, মৃত্যুশোকের কান্না, স্মৃতির কান্নার মধ্যেও মাঝে মাঝে শোনা যায় উলুধ্বনি। রঙ্গ কৌতুক, দু’একটা যাত্রা পালার সংলাপ।

কয়েকদিন আগে দণ্ডকারণ্যের কুরুদ শিবিরে প্রচণ্ড ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে উদ্বাস্তুদের সব কটা চালাঘর ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। উদ্বাস্তুরা আবার উদ্বাস্তু। এখানকার হাজার সাতেক মানুষের সংসার এখন খোলা আকাশের নিচে। এখনো কোনো রিলিফ এসে পৌঁছোয়নি, দিল্লিতে খবর পৌঁছেচে কি না সন্দেহ। যে তিনজন অফিসার এই শিবিরের দায়িত্বে, তাদের মধ্যে একজন ছুটিতে ছিল, আর দু’জন উদ্বাস্তুদের বিক্ষোভের ভয়ে পালিয়েছে।

হারীত মণ্ডল তার মেয়ে গীতার বিয়ে দিয়েছে মাত্র গত মাসে। পাত্র এই কুরুদ শিবিরেরই। নানান ক্যাম্পে ক্যাম্পে পাত্র আর পাত্রী একই সঙ্গে বড় হয়ে উঠেছে, এখন আর পাঁচ জনের পরামর্শে ওদের হাতে হাত মিলিয়ে দেওয়া হলো। বিয়ের নিয়ম কানুনও মানা হয়েছিল মোটামুটি, একজন পুরুত আছে এখানে, হারীত মণ্ডল তার পুতুল বেচা টাকায় দু’খানা নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছে মেয়েকে, জামাই মাধবের জন্য ধুতি। সেদিন পঁচিশ-তিরিশটা পরিবারের বরাদ্দ চাল নিয়ে রান্না হয়েছে এক সঙ্গে, সবাই একসঙ্গে বসে খেয়েছে, সুতরাং সেটাকে বিবাহের প্রীতিভোজ বলা যেতে পারে। ফুলশয্যাতেও ত্রুটি রাখা হয়নি। আট দিনের দিন দ্বিরাগমন, সেই দিন গীতা পাকাঁপাকি চলে যাবে মাধবের বাড়িতে, সেই দুপুরেই ঝড় উঠলো। গীতার বাপের বাড়ি, স্বামীর বাড়ি কিছুই রইলো না।

তিন দিন কেটে যাবার পরেও পলাতক অফিসারদের কোনো পাত্তা নেই বলে আজ সকালে ক্যাম্প অফিস লুট করে চাল-ডাল যা পাওয়া গেছে তা ভাগ করে নিয়েছে সবাই।

একদল লোক ঘিরে ধরেছে হারীত মণ্ডলকে। সে এখন আর নেতা হতে না চাইলেও সবাই তাকেই নেতা মনে করে। সবাই জানতে চায়, অফিসাররা যদি আর ফিরে না আসে, তা হলে তাদের ভাগ্যে কী হবে?

হারীত মণ্ডলের যৌবনের সেই তেজ আর নেই। মাঝখানে তার শরীরটা খুবই ভেঙে গিয়েছিল, এখন সামলে উঠেছে অনেকটা। তার স্ত্রীও প্রায়ই অসুস্থ থাকে ইদানীং, তার পালিতা কন্যা গোলাপীই এখন তার সংসার দেখে।

এত দুর্যোগ-দুর্দিনের মধ্যেও অবশ্য সে তার কৌতুক বোধ হারায়নি। ঝড়ে যে ঘর-বাড়ির চালা উড়ে গেছে, তাতে সে খুব একটা বিচলিত নয়। ঝড় থামবার পর সে অন্যদের বলেছিল, আরে, এ তো এক প্রকার ভালোই হলো! এবারে নতুন বাড়ি হবে। পুরোনো না ভাঙলে নতুন পাবি কী করে? সরকার বাহাদুর এই ক্যাম্পের বাড়িগুলান পকা নড়বড়ে করে বানায়েছিল, তার কারণ হইলো, এ গুলান তো অস্থায়ী। আমরা তো আর চিরকাল ক্যাম্পে থাকবো না, এরপর পাকা বাড়িতে যাবো! তোরা শুনিসনি, শিগগিরই আমাগো উদ্বাস্তু নাম ঘুচে যাবে। এই দ্যাশের আর পাঁচটা রামা-শ্যামা-যদু-মধুর মতন আমরাও হবো সাধারণ মানুষ!

হারীত মণ্ডলের এই ধরনের রসিকতা কারুরই পছন্দ হয় না। সকলেই নিদারুণ নৈরাশ্যে ভুগছে। যতই ছোট, নড়বড়ে, নোংরা চালাঘর হোক, তবু তো একটা মাথা গুজবার নিজস্ব আস্তানায় এই কয়েক বছর তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, এখন আবার সেটাও গেল!

হারীত মণ্ডল সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করে, আরে শোন, সব কিছুরই একটা ভালো দিক আছে। এই কুরুদ ক্যাম্পের কথা সরকার তো ভুইলেই গিয়েছিল, অখাইদ্য চাউল দিত, আমরা নালিশ করলে কেউ শোনতো? এই ঝড়ে সরকারের টনক নড়াবে। খবরের কাগজের মাইনেষেরা আসবে, আমাগো ফটো ছাপাবে, আবার একটা কিছু হবে।

এ কথাতেও কেউ ভরসা পায় না।

অনেকে হারীতকে বললো, চলো কাকা, আমরা পশ্চিম বাংলায় ফিরা যাই। যদি মরতেই হয় সেখানে গিয়ে মরুম। তুমি আমাগো রাস্তা দেখাও!

হারীত মণ্ডল মাথা নাড়ে। এ প্রস্তাব তার কাছে হঠকারিতার সমান মনে হয়। ঝড়ের কয়েকদিন আগেই এই ক্যাম্পের এক অফিসার তাকে বলেছিল, পশ্চিম বাংলায় নতুন করে লাখ। লাখ উদ্বাস্তু ঢুকছে, সেখানে এখন দুর্ভিক্ষের মতন অবস্থা, চাল একেবারেই পাওয়া যায় না। এই অবস্থায় দণ্ডকারণ্য থেকে আবার রিফিউজিরা ফিরে গেলে তাদের কেউ ঠাঁই দেবে না। খেতে দেবে কে? এখানে তবু ভারত সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, আজ হোক কাল হোক, অফিসাররা ফিরে আসবেই। জোড়াতালি দিয়ে বাসস্থানের একটা কিছু হবেই। পশ্চিম বাংলায় ফিরে গেলে দুর দুর করে আবার তাড়াবে।

হারীত মণ্ডলকে ঘিরে সবাই চেঁচামেচি, তর্কাতর্কি করছে। এই সময় দূরে শোনা গেল একটা ঢোলের আওয়াজ। সবাই কথা থামিয়ে সন্ত্রস্ত। উৎকর্ণ হয়ে উঠলো। এই ক্যাম্পে বসতি নেবার পর প্রথম দিকে প্রায়ই জঙ্গলের আদিবাসীরা হানা দিত রাত্তিরের দিকে।

এখানে আসবার আগে অনেকে রটিয়েছিল যে দণ্ডকারণ্যে নাকি রাক্ষসদের বাস। এসে দেখা গেল, রাক্ষস নেই বটে, কিন্তু মারাত্মক তীর-ধনুক ও টাঙ্গি নিয়ে এক জাতীয় কালো কালো অরণ্যবাসী মানুষ ঘুরে বেড়ায়। তারা এমনিতে সরল ও নিরীহ, কিন্তু বহুকাল ধরে এই জঙ্গলে তারা ফল মূল কাঠ-পাতার অধিকার ভোগ করে আসছে। হঠাৎ বাইরে থেকে হাজার হাজার মানুষ সেখানে উড়ে এসে জুড়ে বসলে তারা সহ্য করবে কেন? আদিবাসীদের সঙ্গে উদ্বাস্তুদের সংঘর্ষ হয়েছে একাধিকবার।

এখন কলোনিটি অরক্ষিত ও ছিন্নভিন্ন অবস্থায় আছে, এই খবর পেয়েই কি আদিবাসীরা আবার আক্রমণ করতে আসছে। সবাই লাঠি-সোঁটা কুড়ুল যা পেল তাই নিয়ে তৈরি হলো।

ঢোল বাজনা ক্রমশ এগিয়ে এলো কাছে। দেখা গেল, একজন লোক ঢোল বাজাচ্ছে, অন্য একজন তার পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে চিৎকার করে কিছু বলছে। জঙ্গলের গাছপালাকে কী শোনাচ্ছে ওরা? এ তো গান নয়, কোনো সওদা বিক্রির ব্যবস্থাও নয়, কারণ ওদের সঙ্গে কিছু নেই।

সবাই ছুটে গিয়ে ঐ দু’জনকে ঘিরে ধরলো।

ঢোল বাদকটি এবারে দর্শক ও শ্রোতা পেয়ে প্রবল উৎসাহে খানিকটা বাজিয়ে থেমে গেল। হঠাৎ। তার সঙ্গের লোকটি হাতের ছোট লাঠিটি তুলে রাজকীয় ঘোষণার ভঙ্গিতে বললো, ভাইয়ো আউর বহেনো, অপলোগ সব শুনিয়ে, ভারতকা পরধান মন্ত্রীজী, পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুকো স্বরগ প্রাপ্তি হো গ্যয়া! ভারতকা পরধান মন্ত্ৰীজী পণ্ডিত জবারলাল…

এক মুহূর্তে সমস্ত গোলমাল থেমে গেল। খবরটা হৃদয়ঙ্গম করতে সময় লাগলো খানিকটা। তারপর হারীত মণ্ডলের জামাই মাধব চেঁচিয়ে উঠলো, বেশ হয়েছে, আপদ গেছে?

অনেকেই গলা মেলালো তার সঙ্গে। আবার শুরু হয়ে গেল কলরব। দু’একজন নাচতে শুরু করে দিল।

এত কষ্ট ও হতাশার মধ্যেও একজন মানুষের মৃত্যু সংবাদ তাদের মধ্যে খানিকটা আনন্দ এনে দেয়। তারা ঢোল বাদক ও ঘোষককে চেপে ধরে জানতে চাইলো আরও তথ্য। লোকটাকে কেউ গান্ধীর মতন গুলি করে মেরেছে? কষ্ট পেয়ে মরেছে? মৃত্যুকালে তার ঠোঁটে জল দেবার মতন কেউ ছিল পাশে!

ঘোষক অতশত জানে না। ঘটনাটি দশ দিন আগেকার। সরকারি নির্দেশে দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে রাজা বদলের খবর জানাতে হয়। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বদল। নেহরুর মৃত্যু হয়েছে, এখন লালবাহাদুর শাস্ত্রী গদীতে বসেছে!

সমস্ত বিশ্বের চোখে এক বরেণ্য নেতা, বিশ্ব শান্তির প্রবক্তা, স্বাধীন ভারতের একটানা সতেরো বৎসর ব্যাপী প্রধানমন্ত্রী, দেশের জন্য খাটতে খাটতে যিনি দেহান্ত করলেন, সেই জওহরলাল নেহরু এই বাস্তুচ্যুত, দেশচ্যুত, ভাগ্যতাড়িত মানুষগুলির কাছে একটুও জনপ্রিয় নন। জিন্না সাহেবের মতন নেহরুকেও এরা তাদের সমস্ত দুর্দশার জন্য দায়ী মনে করে।

খবর শুনে হারীত মণ্ডলের মুখটাও কুঁচকে গেল একবার। সে জনতার মধ্য থেকে সরে গিয়ে একটা ভগ্ন্যুপের ওপরে গিয়ে বসলো। তারপর তার পালিতা মেয়েকে ডেকে বললো, গোলাপী মা, একটু তামুক সেজে দিবি!

এই ক্যাম্প থেকে মাইল পনেরো দূরে একটা হাট বসে মাসে একবার। এখানকার কাঠ ভালো, হারীত মণ্ডল নানা রকম পুতুল বানিয়ে সেই হাটে বিক্রি করে। তার তৈরি কয়েকটি পুতুল নাকি বিভিন্ন আদিবাসী গ্রামে দেবতা জ্ঞানে পুজো পাচ্ছে। পুতুল বিক্রির টাকায় আর যাই কেনা হোক বা না হোক, কিছুটা তামাক হারীতের কেনা চাই। এটাই তার একমাত্র বিলাসিতা। বিড়ি ছেড়ে সে এখন হুঁকো ধরেছে।

দু’জন বয়স্ক লোক, পীতাম্বর আর হরেন, খানিকটা তামাকের ভাগ পাবার লোভে আর হারীতের মতামত জানার কৌতূহলেও হারীতের পাশে এসে বসলো। হারীত এদের তুলনায় বেশি খবর রাখে। সে নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তির কথা জানে। সে একথাও জানে যে পাঞ্জাবের রিফিউজিরা এরকম জঙ্গলের মধ্যে থাকে না, তাদের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গরু-ছাগলের মতন তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় না। বস্তুত তারা আর রিফিউজি নয়, তারা এখন ভারতের নাগরিক। কিন্তু বাঙালী উদ্বাস্তুদের প্রতি নেহরু কোনোদিন সদয় ছিলেন না। তিনি পূর্ব বাংলার হিন্দুদের দেশ ত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন বারবার, যারা সে দেশ ছেড়ে আসছে, তাদের তিনি বলেছেন কাপুরুষ। অথচ পূর্ব বাংলার কংগ্রেস নেতারাই দেশ ছেড়ে পশ্চিম বাংলায় চলে এসেছেন সবার আগে। ওদিককার সবচেয়ে নামকরা হিন্দু নেতা কিরণশঙ্কর রায়কে বিধান রায় ডেকেছিলেন পশ্চিম বাংলার মন্ত্রী হতে।

নেহরু কি ভেবেছিলেন যে বাংলা বিভাগ একটা অবাস্তব ব্যাপার। সেইজন্য তিনি বাঙালী উদ্বাস্তুদের ভর্ৎসনা করতেন? এদের তিনি এত বৎসর ধরে রিফিউজি আখ্যা দিয়ে রেখেছিলেন এই ভরসায় যে এইসব বাস্তুহারারা আবার ফিরে যাবে নিজেদের বাস্তু ভূমিতে? নেহরুর এই দিবাস্বপ্নের খেসারত দিল লক্ষ লক্ষ অসহায় পরিবার।

পীতাম্বর হারীতের হুঁকোর দিকে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, এবার কী হইব, কও তো হারীত। তুমি তো অনেক কিছু জানো!

হারীতের এখনো মৌজ হয়নি, সে হুঁকো না দিয়ে বললো, আমি তত কিছু জানি না। তবে ঐ যে আমি সব সময় কই না, সব ঘটনারই একটা ভালো দিক আছে? নেহরু মারা গ্যালেন, তাতে দিল্লির মহা বিপদ হইতে পারে, কিন্তু আমাগো বোধ হয় কিছু উপকার হবে।

হরেন বললো, কী উপকার হবে?

হারীত বললো আমরা এখন যা আছি, তার থিকা খারাপ তো আর কিছু হইতে পারে না। একটা কিছু বদল হইলেই বোঝবা কিছু ভালো হইলো।

হরেন বা পীতাম্বর এতে সন্তুষ্ট হলো না। এ কেমন যেন ভাসা ভাসা কথা। আজকাল হারীতের ওপর যেন আস্থা হারিয়ে ফেলছে সবাই। সংকটের মুহূর্তে সে কোনো উত্তেজক কথা বলে না।

এ কথা অবশ্য ঠিক যে চরবেতিয়া ক্যাম্প ছেড়ে আসার সময় হারীত মণ্ডল আবার পুলিসের কাছে প্রচণ্ড মার খেয়েছিল। রাণাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প থেকে তাদের আনা হয়েছিল চরবেতিয়ায়, সেখানেও অব্যবস্থার চূড়ান্ত। দিনের পর দিন এক ফোঁটা কেরোসিন তেল পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝেই চাল ফুরিয়ে যায়। হারীতের তখন দাপট ছিল, তার কথায় সবাই উঠতোবসতো, সে বিদ্রোহ জানিয়ে একদিন সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। হারীত ভেবেছিল উড়িষ্যার পুলিস তার সম্পর্কে কিছু জানবে না। কিন্তু পুলিসে পুলিসে কথা চালাচালি হয়, বেঙ্গল পুলিস উড়িষ্যা পুলিসকে জানিয়ে দিয়েছে হারতের চরিত্র বৃত্তান্ত। পুলিস বাহিনী বিদ্রোহীদের ঘিরে ধরে শুধু হারীতকে আলাদা করে বেছে নিয়ে যায়। বেদম মার ও প্রাণনাশের হুমকির পর সে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয় যে সে তার দলবল নিয়ে দণ্ডকারণ্যের দিকে চলে যাবে।

মার খেয়ে খেয়েই লোকটার মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। সে এখনও হাসি-ঠাট্টা করে বটে, কিন্তু উগ্র সরকারবিরোধী কথা তার মুখে একবারও শোনা যায় না।

একটু বাদে হারীত তার কোটা ওদের দিয়ে দিল, কিন্তু আলাপ-আলোচনা জমলো না। আবার একটা হৈ হৈ শোনা গেল।

ঢোল বাদক ও ঘোষককে রিফিউজির ছেলে-ছোঁকরারা ছেড়ে দেয়নি। হঠাৎ তারা উত্তেজিত হয়ে ঢোলটা আছড়ে ভেঙে ফেললো এবং লোকদুটিকে চড় চাপড় মারতে শুরু করে দিল। লোক দুটির একমাত্র দোষ, অতি নিম্নপদের হলেও তারা সরকারি কর্মচারি। রিফিউজিদের চোখে ওরাই অদৃশ্য সরকারের একমাত্র প্রতিভূ, তাই ওদের ওপর বর্ষিত হলো পুঞ্জীভূত রাগ। হারীতের হস্তক্ষেপে লোকদুটো প্রাণে বেঁচে গেল বটে, কিন্তু ছেলে-ছোঁকরারা শাসিয়ে দিল, যা ব্যাটারা, তোরা বাবুদের গিয়ে বল, আমরা কী অবস্থায় আছি। কাইলকের মইধ্যে যেন র‍্যাশোন আসে, আর যদি না আসে, তবে তোগো এই দিকে আর একবার দ্যাখলে ঘেটি ভেঙ্গে দেবো!

কিন্তু তার পরের দুদিনেও কোনো সাহায্য এলো না। দুর্দশার একেবারে চরম অবস্থায় পৌঁছোলো এতগুলো মানুষ। দিনের বেলা অসহ্য গরম, রাত্তিরে নানা রকম পোকা মাকড়ের উৎপাত, তার ওপরে আছে সাপ। ক্যাম্প অফিসে আর এক কণা খাদ্য নেই। নেহরু মারা গেছে বলে কি সরকারি কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে গেছে? সবাই ভুলে গেছে এই ক্যাম্পের কথা? খবরের কাগজওয়ালারাও এলো না? বড় খবর পেলে তারা ছোট খবরের কাছে আসে না।

আর উপায় নেই, এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতেই হবে। ছেলে-ছোঁকরারা জোর করে রাজি করালো হারীতকে। কয়েকজন বললো, তারা জেনেছে যে উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী এখন বীরেন মিত্র, নাম শুনে মনে হয় বাঙালী। কটক পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছোলে তিনি কি কিছু সাহায্য করবেন না?

আবার শুরু হলো পদযাত্রা। সেই পঞ্চাশ সালে শুরু হয়েছিল, আজও ঘরছাড়ারা ঘর পায়নি। সামান্য বাসনপত্র, ভেঁড়া বিছানা বা দু’একটা জামা কাপড়ের পুঁটলি কাঁধে সাত হাজার নারী-পুরুষ-শিশু বৃদ্ধ জঙ্গল ছেড়ে চললো শহরের খোঁজে।

অনিচ্ছুক নেতা হিসেবে হারীতকে যেতে হলো সকলের সামনে সামনে। তার কোলে গোলাপীর পাঁচ বছরের ছেলে নবা। কুপার্স ক্যাম্প থেকে চলে আসার পর অবিবাহিতা পোয়াতী মেয়ে গোলাপীকে নিয়ে অনেক প্রতিকূলতা সহ্য করতে হয়েছে হারীতকে। এমনকি তার সঙ্গী সাথীরাও তার নাম জড়িয়ে কুৎসিত কথা বলতেও ছাড়েনি, কিন্তু এই একটা ব্যাপারে কিছুতেই হার স্বীকার করেনি হারীত। গোলাপী তার কেউ নয়, তবু তাকে সে পরিত্যাগ করেনি, গোলাপীর অবৈধ শিশুটিকে সে এখন সকলের কাছে নিজের নাতি বলে পরিচয় দেয়। গোলাপীকে কেউ বিয়ে করতে রাজি হয়নি, তাতে কিছু যায় আসে না। এই নাতিকে নিয়েই এখন হারীতের অধিকাংশ সময় কাটে।

এই নিয়ে পাঁচবার গৃহত্যাগ করতে হলো হারীতকে। এর মধ্যে একবারও কলকাতার দিকে যায়নি সে। চন্দ্রার ঠিকানায় তার ছেলে সুচরিতের নামে দু’খানা পোস্টকার্ড লিখেছিল, কোনো জবাব আসেনি তার। হারীত তার ঘুমন্ত নাতির পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে মনে মনে বললো, একদিন না একদিন তোকে আমি একখানা নিজস্ব বাড়িতে তুলবোই। সে বাড়ির সামনের জমিতে লঙ্কাগাছ, বেগুন গাছ, জবা ফুলের গাছ থাকবে, ঘরের ছাউনির ওপর বসে শালিক পাখি ডাকবে…।

এই হতভাগ্যদের মিছিল নিয়ে বেশি দূর এগোনো গেল না। রিলিফ নিয়ে সরকারি কর্মচারিরা এতদিন পর এদিকেই আসছিল, গোলমালের আশঙ্কায় তারা সঙ্গে এক গাড়ি পুলিসও এনেছে।

পুলিস দেখেই হারীতের শরীরে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল। নবাকে চট করে গোলাপীর কোলে দিয়েই সে লাফিয়ে লাফিয়ে বলতে লাগলো, ভাইসকল, পুলিসের সাথে জেদাজেদি করতে যাইও না, তর্ক করো না, বসে পড়ো, সবাই বসে পড়ো, আমি হাত জোড় করতেছি, আমার কথা শোনো, সরকার রিলিফ পাঠায়েছেন…আমাগো ভালোর জইন্যেই…

একদল স্পষ্ট বিদ্রোহ করলো হারীতের বিরুদ্ধে। তারা হারীতকে ধিক্কার দিয়ে দল বেঁধে ছুটে গেল, ঠিক পুলিসের মুখোমুখি নয়, বাঁ দিকের জঙ্গলের মধ্যে, তারা যে কোনো উপায়ে কটক পৌঁছোতে চায়। পুলিস তাদের তাড়া করে গেল, কিন্তু খুব একটা আন্তরিকভাবে নয়, নামকাওয়াস্তে রিফিউজিরা পাঁই পাঁই করে ছুটতেই হুইশল বাজিয়ে পুলিসের দল ফিরে এলো।

হারীতের অনুগতরা প্রধানত বয়স্ক এবং স্ত্রীলোকেরাই বেশি, পথের ওপর বসে পড়েছিল হারীতের কথা মতন। খানিকটা দূরত্ব রেখে পুলিসরা লাইন করে দাঁড়িয়ে রইলো তাদের সামনে। প্রভুভক্ত হনুমানের মত ভঙ্গিতে হাত জোড় করে রইলো হারীত।

তবু একটুবাদেই পুলিসের দিক থেকে চোঙা ফুঁকে ঘোষণা করা হলো, হারীত মণ্ডল কিসকা নাম হ্যায়? হারীত মণ্ডল! সামনে আও! মাথা পর হাত উঠাকে আও?

হারীতের বুক কেঁপে উঠলো। আবার তাকে মারবে। এবার মার খেলে কি সে আর বাঁচবে? তবু তাকে যেতেই হবে। সে একবার তাকালো নবা আর গোলাপীর মুখের দিকে, তারপর অন্যদের বললো, তোমরা চুপচাপ বসে থাকো, আমি কথাবার্তা বলে আসি। ভয়ের কিছু নাই!

লাঠিওয়ালা পুলিস লাইনের পেছন দিকে দুটি স্টেশন ওয়াগন দাঁড়ানো। দু’তিন জন পুলিস অফিসার ও কয়েকজন সিভিলিয়ান অফিসার বসে আছেন সেই দুটি গাড়িতে। একজন সেপাই হারীতের হাত ধরে একজন পুলিস অফিসারের কাছে নিয়ে গেল। তিনি প্রথমে মিষ্টি করে বললেন, তোমার নাম হারীত মণ্ডল? তুমি আবার রিফিউজিদের ক্যাম্প ডেজার্ট করার উস্কানি দিয়েছো?

হারীত বললো, ক্যাম্প কোথায়, স্যার? দ্যাখেন গিয়ে ক্যাম্প নাই! ঝড়ে সব তছনছ করে দিয়েছে!

লোকটি হঠাৎ রেগে গিয়ে বললো, শাট আপ। যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দাও?

সঙ্গে সঙ্গে হারীত হাত জোড় করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, মারবেন না। মারবেন না, স্যার? আপনার পায়ে ধরছি। কোনো দোষ করি নাই। দুই দিন ধরে আমরা কিছুই খেতে পাই নাই, তাই হুজুরদের কাছে দরবার করতে যাইতেছিলাম।

পাশের গাড়ি থেকে একজন সিভিলিয়ান বললেন, মিঃ দাস, আমি এই হারীত মণ্ডলের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

অফিসারটি গাড়ি থেকে নেমে হারীতের কাঁধে হাত দিয়ে একটু দূরের একটা গাছতলায় টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, আমার নাম অরুণকুমার দাশগুপ্ত, আমারও দেশ ছিল পূর্ববঙ্গে। হারীতবাবু, আপনাদের কাছে আমরা ক্ষমা চাচ্ছি!

হারীত হকচকিয়ে গেল। এ আবার কী ধরনের কথা! মিষ্টি কথা শুনলে বেশি ভয় লাগে, মনে হয় পিটুনীর প্রস্তুতি। এ লোকটার পূর্ব বঙ্গে বাড়ি ছিল তো কী হয়েছে! ভদ্দরলোক তো! ভদ্দরলোক রিফিউজিরা এদিককার ভদ্দরলোকদের মধ্যে ঠিক মিশে গেছে!

হারীত হাত জোড় করে বললো, আজ্ঞে?

অফিসারটি আরও মোলায়েম গলায় জিজ্ঞস করলো, এদিকে কী হয়েছিল, বলুন তো? হারীত বললো, আজ্ঞে, এমন কিছু না। নেহরুজী যেদিন মারা গেলেন, সেইদিনই ঝড়ে আর শিল পড়ে আমাগো ঘরবাড়িগুলো ভেঙে গেল। অফিসার দু’জন গেলেন সদরে খবর দিতে, তা নেহরুজীর মৃত্যুতে মনে ব্যথা পেয়ে বোধ হয় ভুলে গেলেন আমাগো কথা। তা তো হতেই পারে, কী বলেন! এতবড় একজন মানুষ চলে গেলেন, সেই তুলনায় আমরা তো মশা মাছি। তবে কি না, তিন দিন ধইরা এক কণা দানাপানি নাই, অবুঝ পোলাপানগুলা কান্নাকাটি করে তাই ভাবলাম।

অফিসারটি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, অপদার্থ, ছি ছি ছি ছি ছি! ঐ অফিসার দু’জনকে আমি ফিরেই সাসপেণ্ড করার অর্ডার দেবো! জানেন, হারীতবাবু, এই দণ্ডাকারণ্য প্রজেক্টে এখনো কোনো কো-অর্ডিনেশান নেই। কেউ কারুর কথা শোনে না। লোকাল অথরিটির সঙ্গে আমাদের এখনও ঠিক মতন আণ্ডারস্টাণ্ডিং হলো না।

–স্যার আমি ইংরাজি বুঝি না।

–আপনাকে আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। জানেন তো, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট বাঙালী রিফিউজিদের জন্য এখনও সে রকম কিছুই করছে না। আমরা যত টাকা চেয়েছি, যতগুলো প্রজেক্ট, মানে পরিকল্পনা দিয়েছি, কোনোটাই ঠিক মতন পাস হচ্ছে না। আমি বাঙালী হয়ে সব সময় এটা ফিল করি। আমাদের চেয়ারম্যান, মিঃ শৈবাল গুপ্ত তো ডিসগাস্টেড হয়ে রিজাইন করতে চেয়েছেন।

–স্যার, আমার সাথীরা তিনদিন ধরে না খেয়ে অস্থির হয়ে আছে। আমার দেরি হলে তারা ভাববে, আপনেরা বুঝি আমারে গ্রেফতার করেছেন!

–না, না, অফ কোর্স! আমরা চিড়ে মুর্কির বস্তা সঙ্গে এনেছি। এক্ষুনি ডিস্ট্রিবিউট করা। হবে। তবে, হারীতবাবু, কাজের কথা হচ্ছে, এই কুরুদ শিবিরের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এখানকার ঝড়ে পড়ে যাওয়া বাড়িঘর আর নতুন করে তৈরি করা যাবে না। সে টাকার স্যাংকশান নেই। তবে উড়িষ্যার কোরাপুট জেলার সোনাগড়াতে নতুন ক্যাম্প হয়েছে। আপনাদের যেতে হবে সেখানে।

–আবার আর এক জায়গায়?

–হ্যাঁ, আই প্রমিস, সোনাগড়া আপনাদের অনেক ভালো লাগবে। সেখানে কাজের সুযোগ আছে। আপনারা চাষবাস করতে পারবেন। বাঙালী রিফিউজিরা অলস, অকর্মণ্য, এই দুনামটাও তো ঘোচানো দরকার। আপনি আপত্তি করবেন না। আপনার লোকদের বোঝান!

হারীত অফিসারটির চোখে চোখ ফেলে হাসলো। তারপর বললো, সোনাগড়া! নামটি সুন্দর। সেখানে গ্যালে আমরা সোনার ভবিষ্যৎ গড়তে পারবো, কী বলেন?

–নিশ্চয়ই! আই মীন, আই হোপ সো!

তিন দিন পরে সোনাগড়ার পথে এই হা-ঘরের দলটির আবার যাত্রা শুরু হলো। যাত্রা পথেই দুটি নিদারুণ খবর এসে পৌঁছোলো। সোনাগড়ায় নাকি সাঙ্ঘাতিক জলকষ্ট, সেখান থেকে ইতিমধ্যেই একদল উদ্বাস্তু পালিয়েছে অন্ধ্রের দিকে। আর হারীতদের দল থেকে যে অংশটি কয়েকদিন আগে কটকের দিকে পালিয়েছিল, তারাও কটক পর্যন্ত পৌঁছোতে পারেনি, মাঝপথে বীরেন মিত্রর পুলিস বাহিনী তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে। নিহত হয়েছে পাঁচজন, চোদ্দজন গুরুতর আহত, বাকিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে কোথায় গেছে কে জানে!

ঐ দলটিতে গেছে হারীতের মেয়ে-জামাই। তাদের জন্য উদ্বিগ্ন হবার আগেই হারীত ভাবলো, সে নিজে যদি ঐ দলটিতে থাকতো, তা হলে পুলিসের প্রথম গুলিটি নিশ্চিত আসতো তার বুক লক্ষ্য করে।

আশ্চর্য, এরকম চিন্তা করার পরই হারীত তার পাঁচ বছরের নাতি নবাকে বুকে তুলে নিয়ে। বেশ জোরে জোরেই পাগলাটে গলায় বললো, তোকে আমি একটা নিজস্ব বাড়ি দেবো। একদিন ঠিকই দেবো। তোমরা সবাই দেখে নিও!

অন্যরা অবাক হয়ে তাকাতে হারীত আরও গলা চিরে বললো, তোরা মনে রাখিস, আমরা কিছুতেই খতম হমু না। রক্তবীজের ঝাড় আমরা, আদাড়ে-জঙ্গলে যেখানেই রাখুক আমাগো মাটি কামড়াইয়া থাকুম। এই নবা একদিন না একদিন ভারতের নাগরিক হবেই, ভোট দেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *