তিন তিনটে সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেছে স্বাধীন ভারতে। প্রত্যেকবারই কেন্দ্রে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছে কংগ্রেস দল, একটানা প্রধান মন্ত্রিত্ব করলেন জওহরলাল নেহরু। যথেষ্ট বয়েস হয়ে গেলেও তাঁর আচরণ যুবকোচিত ৷ সুদর্শন পুরুষ তিনি, তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ অতি সুরুচিসম্মত। সকলের সঙ্গে সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার। তিনি গোলাপ ফুল, শিশু ও কবিতা ভালোবাসেন। এমন মানুষকে কেউ অপছন্দ করতে পারে না। ভারতের শেষ ভাইসরয়ের পত্নী শ্ৰীমতী মাউন্টব্যাটেন পর্যন্ত তাঁর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। আরও কত নারী এই বিপত্নীক পুরুষটির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে, তা কে জানে?
নিজের দলের মধ্যে জওহরলাল নেহরুর প্রতিদ্বন্দ্বী তো দূরের কথা, সমকক্ষ হবার মতন কাছাকাছিও কেউ নেই। বিরোধী দলগুলিও ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না। দেশের যেখানেই তিনি যান, হাজার হাজার মানুষ তাঁকে শুধু একবার চোখের দেখা দেখে জীবন সার্থক করতে চায়। তিনিও বছরে দু’তিনবার প্রচুর ক্যামেরাম্যান ও সাংবাদিকদের চোখের সামনে, সব রকম নিরাপত্তাবিধি লঙ্ঘন করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে একেবারে জনসাধারণের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ান, বয়স্কদের আলিঙ্গন করেন, বাচ্চাদের গাল টিপে দেন। জাতির পিতা হলেন মহাত্মা গান্ধী, আর কর্ণধার চাচা নেহরু।
বিদেশেও তাঁর প্রচুর খ্যাতি ও সম্মান। পশ্চিমী দুনিয়ায় নেতারা প্রথম দিকে আশঙ্কা করেছিল, এই লোকটা কমুনিস্ট হয়ে না যায়। ওঁর লেখা বইপত্রে সমাজতন্ত্রের দিকে খানিকটা ঝোঁক দেখা গেছে। তাছাড়া, চীনের সঙ্গে এত বন্ধুত্ব! কিন্তু এত বড় দেশে তিন তিনটি সাধারণ নির্বাচন নির্বিঘ্নে পার করার পর সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলো। ভারতে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দিন দিন বেড়েই চলেছে বটে, বহু লোক এখনও না খেয়ে থাকে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যখন তখন কয়েক শো লোক মারা যায়, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী কিছুই দমন করা যায়নি, কিন্তু জওহরলাল নেহরু গণতন্ত্রকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ভারতে গণতন্ত্রের উজ্জ্বল পতাকা সগর্বে ওড়ে। ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদের জিগির নেই, সরকারি ভাবে এ দেশ ধর্মনিরপেক্ষ।
দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করলেও জওহরলাল নেহরু ধনতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে পুরোপুরি হাত মেলাননি, জোট নিরপেক্ষতার নীতি আঁকড়ে ধরে থেকে তিনি তৃতীয় বিশ্বের প্রধান নেতা হয়ে উঠেছেন। ক্রেমলিন ও হোয়াইট হাউস থেকে তিনি সমান নেমন্তন্ন পান। দেশের মধ্যেও তিনি চালু রেখেছেন মিশ্র অর্থনীতি। ইস্পাতের উৎপাদন ভার নিয়েছে পাবলিক সেকটর, বিমা কম্পানিগুলি জাতীয়করণ করা হয়েছে। দেশীয় রাজ্যগুলি বশ্যতা স্বীকার করে ‘ইণ্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত’-এর অন্তর্গত হয়েছে, একমাত্র হায়দ্রাবাদ ছাড়া অন্য কোথাও বলপ্রয়োগ করতে হয়নি। শুধু এখনও কাশ্মীর প্রশ্নটি গলার কাঁটা হয়ে ফুটে আছে।
এ বছরের গোড়ার দিকে ভুবনেশ্বরে কংগ্রেসদলের অধিবেশন চলার সময় জওহরলাল নেহরু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সারা দেশ জুড়ে একটা বিস্ময়ের ঢেউ বয়ে গেল। অনেকেরই ধারণা ছিল, উনি চিরযুবা থাকবেন, কোনো দিন বৃদ্ধ হবেন না, এখনও তো দিনের মধ্যে উনিশ ঘণ্টা খাটেন, হাঁটা-চলার মধ্যে একটুও শ্লথ ভাব নেই, ক্লান্তি নেই দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছোটাছুটিতে। সেই মানুষ শয্যাশায়ী হয়ে থাকবেন?
অনেকে বলতে লাগলো, শরীর নয়, আসলে ওঁর মন ভেঙে গেছে। চীনের কাছ থেকে যে আঘাতটা পেয়েছেন, সেটা উনি কিছুতেই সামলাতে পারছেন না। এত দোস্তি ছিল চীনের প্রধানমন্ত্রী চো এন লাই-এর সঙ্গে, দু’জনে এক সঙ্গে পঞ্চশীল ঘোষণা করেছেন, ভারত সফরে এসে চৌ এন লাই ‘হিন্দী-চীনী ভাই ভাই’ শ্লোগান দিয়েছেন, ফুর্তি করে লোকজনের সঙ্গে নেচেছেন। সেই চৌ এন লাই আচমকা ভারত আক্রমণ করে বসলো? শান্তির প্রবক্তা নেহরুর কাঁধে চাপিয়ে দিল একটা যুদ্ধ, শুধু তাই নয়, পরাজয়ের কলঙ্ক! এখনও ম্যাকমাহন লাইনের এদিকের অনেকটা জমি চীনা সৈন্যরা দখল করে বসে আছে। ভারতের ডিফেন্স ফ্যাকটরিগুলিতে বন্দুকের বদলে হাঁড়ি-কড়াই বানাবার ব্যবস্থা হচ্ছিল, তা জেনে সবাই এখন ছি ছি করছে। প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে হলে অনেক। মাঝে মাঝে গুজব শোনা যায়, চীনের প্ররোচনায় এ দেশের কমুনিস্টরা নাকি পশ্চিম বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান আর আসাম নিয়ে পিপলস রিপাবলিক অফ বেঙ্গল গড়তে চাইছে। কেউ কেউ বলে, সি আই এরও একই মতলব।
কয়েক মাস বাদেই আবার নেহরু সুস্থ হয়ে উঠলেন, যাতায়াত করতে লাগলেন সংসদে, প্রেস কনফারেন্সে ডেকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিলেন। একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, অনেকেই এখন জানতে চাইছে, আফটার নেহরু, হু? আপনার উত্তরাধিকারী কে হবে আপনি ঠিক করেছেন?
নেহরু হেসে উত্তর দিলেন, আমি আরও অনেকদিন বাঁচবো, এখনই ঐ প্রশ্ন উঠছে কেন?
সাংবাদিকরা লক্ষ করলো, প্রধানমন্ত্রীর চোখের নিচের কালিমা মুছে গেছে, মুখে উৎফুল্ল ভাবটি ফিরে এসেছে, তিনি আবার সক্ষম স্বাস্থ্যবান হয়েছেন।
কাজে যোগ দিতে না দিতেই অনেক রকম সমস্যা। চতুর্দিকে নানান গোলমাল, খাদ্য পরিস্থিতি ভালো নয়, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় দুর্ভিক্ষের মতন অবস্থা, চালের দাম বাড়তে বাড়তে বত্রিশ টাকা মন পর্যন্ত উঠে এখন কালোবাজারে আত্মগোপন করেছে সব চাল। পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু আগমন হঠাৎ বেড়ে গেছে এ বছর। এত উদ্বাস্তু সামলাতে একেবারে হিমসিম অবস্থা।
উদ্বাস্তুর সংখ্যা যত বাড়ছে, ততই ভারতে ধূমায়িত হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। কট্টর হিন্দুরা প্রকাশ্যে বলাবলি করছে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে জওহরলাল নেহরু আসলে মুসলমানদের তোষামোদ করেছেন। পার্টিশানের সময় দু’দেশ থেকে হিন্দু-মুসলমান বদলাবদলির প্রস্তাব নেহরু মানেননি। তার ফল হলো এই যে পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা চলে আসছে আর ভারতে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পশ্চিম বাঙলা, আসাম, ত্রিপুরায় প্রতিদিন হাজার হাজার উদ্বাস্তু আসছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। মে মাসে মাত্র একদিনেই পশ্চিম বাংলার সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে সাত হাজার শরণার্থী। তাদের মুখে মুখে ছড়াচ্ছে অত্যাচার ও বিভীষিকার কাহিনী। পূর্ব পাকিস্তানের বড় বড় ব্যবসা থেকে শাসন যন্ত্র পর্যন্ত সব অবাঙালী মুসলমানদের দখলে, তারা সে-দেশ থেকে হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করতে চায়। অনেক বাঙালী মুসলমানও সহযোগিতা করছে তাদের।
আবার সেখানে অনেক বুদ্ধিজীবী, শান্তিপ্রিয় মানুষ, পশ্চিম পাকিস্তানের এক তরফা আধিপত্যের বিরোধী, ধর্মের চেয়ে মনুষ্যত্ব যাদের কাছে বড়, সেই রকম মুসলমান পূর্ব পাকিস্তান থেকে সমূলে হিন্দু বিতাড়নের প্রতিবাদ জানাতে চায়। অনেক রকম বৃত্তিজীবী হিন্দুদের অনুপস্থিতিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে তার ফল ভালো হবে না। কিন্তু কে শোনে তাদের কথা।
পুনবাসনমন্ত্রী মহাবীর ত্যাগী দিল্লী থেকে পশ্চিমবাংলার সীমান্তে ছুটে আসছেন উদ্বাস্তুদের সংখ্যা গুণে দেখবার জন্য। তারপর স্বীকার করলেন, রাজধানীতে বসে যা শুনেছিলেন তা গুজব নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দ বিবৃতি দিলেন, দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিকেও উদ্বাস্তুদের দায়িত্বের ভাগ নিতে হবে, দেশ বিভাগের কোনো আঁচই ওদের গায়ে লাগবে না। তা তো হতে পারে না!
নানারকম সমস্যার মধ্যে একটি সমস্যা জওহরলাল নেহরুর কাছে সবচেয়ে বড়। কাশ্মীর প্রশ্ন আবার প্রবলভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। শেখ আবদুল্লা মুক্তি পেয়েই কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করেছেন। তিনি পাকিস্তানে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে চান।
কাশ্মীর প্রসঙ্গ আন্তজাতিক ক্ষেত্রেও গড়িয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বক্তৃতার আগুন ছোটাচ্ছেন। কাশ্মীর আদায়ের জন্য তিনি ভারতের সঙ্গে এক হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চালাতেও রাজি।
পাকিস্তানের বন্ধুরা নেহরুকে বিদ্রূপ করে বলছে, ভারত যদি এতই ভোটাভুটির ভক্ত হয়, গণতন্ত্র নিয়ে লম্বা চওড়া বড়াই করে, তা হলে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে কাশ্মীরে ভোটের ব্যবস্থা করছে না কেন? নেহরু এর জবাব দিয়ে রেখেছেন যে পাকিস্তানের একটা অংশ তো পাকিস্তানী ফৌজ দখল করে রেখেছে। ওরা হানাদারবাহিনী আগে সরিয়ে নিক, তারপর ভোটের ব্যাপার দেখা যাবে। পাকিস্তানীরা বলে, ভারতই তো আসল হানাদার, ফৌজ সরাতে হয় ওরা সরাক। কাশ্মীরের হিন্দু রাজা ভারত ইউনিয়ানে যোগ দেবার জন্য আবদার ধরেছিল কিন্তু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য নেই? ভারতীয় মুখপাত্র আবার এর উত্তরে বলে, তোমরা পাকিস্তানী জনগণের ওপর সামরিক শাসন চাপিয়ে গলা টিপে রেখেছো, তাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছো, এখন কাশ্মীরে ভোটের কথা তোমরা বলছো কোন মুখে?
আগে ফৌজ সরানো হবে, না আগে ভোট হবে, এ প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। যেমন, গাছ থেকে বীজ, না বীজ থেকে গাছ, এ ধাঁধার উত্তর কেউ জানে না।
নেহরুর ঘনিষ্ঠ মহল অবশ্য জানে যে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে যেমন বিধান সভায় সরকারি দল গঠনের জন্য নির্বাচন হয়, সেই রকম একটি অঙ্গ রাজ্য হিসেবে কাশ্মীরেও নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করবেন নেহরু, শেখ আবদুল্লাকে তিনি সেই উদ্দেশ্যেই ছেড়েছেন। সেটাই তো আত্মনিয়ন্ত্রণ। কাশ্মীর পাকিস্তানে যাবে কি না, এ প্রশ্নই ওঠে না। কোনো কারণেই নেহরু কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি নন। তাঁর ব্যক্তিগত দুর্বলতা তো আছেই, তা ছাড়া এতদিন পর কাশ্মীর হাতছাড়া হয়ে গেলে সারা দেশের মানুষের ক্রোধ তাঁকে এবং তাঁর কংগ্রেস দলকে ভস্ম করে দেবে। কাশ্মীরের জন্য তিনি চালের দর এক টাকা সের বেঁধে দিয়েছেন, সেখানে বনস্পতি নিষিদ্ধ, সস্তা দরে পাওয়া যায় খাঁটি ঘি, এম এ পর্যন্ত পড়াশোনা ফ্রি, তবু কি কাশ্মীরীরা এতই অকৃতজ্ঞ হবে যে তারা পাকিস্তানে যেতে চাইবে?
দক্ষিণপন্থীদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও নেহরু শেখ আবদুল্লাকে পাকিস্তান সফরের অনুমতি দিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ঐ লোকটি জাতীয়তাবাদী, ধর্ম-গোঁড়া নয়। পাকিস্তানের অবস্থা স্বচক্ষে দেখে আসুক!
অসহ্য গরম পড়েছে দিল্লীতে, বৃষ্টির নাম-গন্ধ নেই, প্রত্যেক দিন দুপুরে লু বইছে। এর মধ্যে এত কাজের চাপ। শুভার্থীরা নেহরুকে পরামর্শ দিলেন, কিছুদিন আগেই শক্ত অসুখ থেকে উঠেছেন, তারপরেই, এত কাজের বাড়াবাড়ি ঠিক হচ্ছে না। শেখ আবদুল্লা ফিরে না আসা পর্যন্ত তো কাশ্মীর সম্পর্কে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে না, আপনি কয়েকটা দিন কোনো ঠাণ্ডা জায়গায় বিশ্রাম নিয়ে আসুন!
পরামর্শটা নেহরুর মনে ধরলো। একমাত্র মেয়ে ইন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দেরাদুন চলে গেলেন। পাহাড় তাঁর প্রিয়। প্রকৃতির কাছ থেকে শুশ্রূষা পাবার মতন চোখ তাঁর আছে। দু’একদিনেই তাঁর শ্রান্তি কেটে গেল, হিমালয়ের টাটকা বাতাসে তিনি যেন নতুন করে শারীরিক বল ও প্রেরণা পেলেন।
তিন দিন বাদেই রাজধানী আবার তাঁর মন টানল। কর্মোদ্যোগী পুরুষ তিনি। সুস্থ শরীরে কাজ ছাড়া বেশিদিন থাকতে পারেন না। ইন্দিরাকে বললেন, বাক্স গুছোও, আজই দিল্লি ফিরবো।
দিল্লী এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছোলেন সন্ধের সময়। দফতরবিহীন মন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এসেছেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে। তাঁর সঙ্গে হাস্য পরিহাস করলেন কিছুক্ষণ। দিল্লীর আকাশ এখনো গুমোট, এই তুলনায় দেরাদুনের আবহাওয়া কত চমৎকার ছিল। সাহেবরা শীতকালে রাজধানী দিল্লী থেকে সরিয়ে নিয়ে যেত সিমলায়, সেখানে ঠাণ্ডার মধ্যে অনেক ভাল কাজ করা যেত। কিন্তু স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ব্রিটিশ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা মানায় না।
লাল বাহাদুরকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। নৈশভোজে বসে মোটামুটি জেনে নিলেন দিল্লীর পরিস্থিতি, তারপর শুয়ে পড়লেন তাড়াতাড়ি। কাল সকাল থেকে আবার সব কাজে হাত দেবেন।
খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যেস তাঁর। প্রথমে খানিকটা পায়চারি করে নেন। কয়েক পা হাঁটতে না হাঁটতেই চীন, কাশ্মীর, দেরাদুনের স্মৃতি, রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা সব তালগোল পাকিয়ে গেল। তিনি চোখে হঠাৎ অন্ধকার দেখলেন, ঝুপ করে পড়ে গেলেন মাটিতে। সেই যে চক্ষু বুজলেন, আর খুলতে পারলেন না, জ্ঞান আর ফিরলো না একবারও, দুপুর দুটো বেজে এক মিনিটে তাঁর হৃৎস্পন্দন একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। তাঁর এত সাধের দেশটিকে মাঝিহীন নৌকোর মতন মাঝ দরিয়ায় ছেড়ে দিয়ে পঞ্চভূতে মিলিয়ে গেলেন তিনি।
কারুর কারুর থাকাটাই এমন অভ্যেস হয়ে যায় যে তাঁর না-থাকাটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য হতে চায় না। টানা সতেরো বছর ধরে যিনি একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তার আগেও যিনি বহু বছর ছিলেন নেতৃত্বের শীর্ষ সারিতে, যিনি গতকালও ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ, তিনি আজ আর নেই, এই নির্মম সত্যটি কিছুতেই যেন মগজে ঢুকতে চায় না। সারা দেশেরই হলো এই রকম উদ্ভ্রান্ত অবস্থা। প্রাচ্যদেশীয় লোকেরা সশব্দ শোক প্রকাশ করে। ভারতের প্রত্যেক শহরের রাস্তায় ঘাটে বহু লোককে দেখা গেল চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে।
পাকিস্তানেও নেহরুর জন্য শোক করার লোকের অভাব নেই। যাঁরা তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন তাঁদের অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গণতন্ত্রবাদীরা এই উপমহাদেশের গণতন্ত্রের কাণ্ডারীর আকস্মিক প্রস্থানে সত্যিকারের দুঃখিত হলেন। কেউ কেউ ভাবলেন, দেশ বিভাগের জন্য যারা দায়ী, ইণ্ডিয়া-পাকিস্তান নামে দুটি দেশের যারা স্রষ্টা, একে একে তারা সবাই চলে গেল। আবার এই দু’দেশেই ‘লোকটা মরেছে, যাক বাঁচা গেছে! এমন চিন্তা করার মানুষ অনেক।
পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা প্রথামতন শোক বার্তা পাঠিয়ে দেবার পর বলাবলি করতে লাগলো, এবারে তো নেহরু সরে গেছে, এবার দেখা যাক ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে বিলাসিতা ক’দিন টেকে! মারামারি, কাটাকাটি শুরু হলো বলে! ওদেশের আর্মি জেনারেলদের মধ্যে কি কেউ মরদের বাচ্চা নেই, এখনও মাথা তুলছে না কেন?
কলকাতায় সকালের দিকে নেহরুর অসুস্থতার খবর বিশেষ কেউ জানতে পারেনি। সুতরাং দুপুরে চরম সংবাদটি এলো একেবারে আচম্বিতে।
অতীন তখন একটি সিনেমা হলের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে। সত্যজিৎ রায়ের একখানা ছবি চলছে এখানে। খুব নাম হয়েছে ছবিটার, মমতা বেশ কয়েকদিন ধরে ছেলেকে বলছেন টিকিট কেটে দিতে, অতীনের আর সময়ই হয় না। আজ মমতা পাঠিয়েছেন জোর করে। বেশ ভিড়, টিকিট পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। টিকিট নাকি ব্ল্যাক হচ্ছে। অতীন একা এসেছে তাই। কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব সঙ্গে থাকলে সে টিকিট ব্ল্যাকারদের ঠাণ্ডা করে দিত।
হঠাৎ লাইনটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। অতীন প্রথমে কারণটা বুঝতে পারলো না। সিনেমা হলের লোহার গেটটা ঝনঝন করে টেনে বন্ধ করা হচ্ছে। আশেপাশের দোকানগুলোরও ঝাঁপ পড়তে লাগলো এক এক করে। কংগ্রেসের পতাকা ওড়ানো একটা খোলা জিপ গাড়িতে চেপে একদল ছেলে বলতে বলতে গেল, দোকান বন্ধ করুন। দোকান বন্ধ করুন!
অতীন প্রথমেই ভাবলো, দাঙ্গা শুরু হলো নাকি? তারপর নেহরুর মৃত্যু সংবাদটি শুনে তার তীব্র কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না, সে মনে মনে বললো, যাঃ, আজ আর মা-পিসিমণির সিনেমা দেখা হল না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে অতীনের মনে বিশেষ কোনো শ্রদ্ধা গড়ে ওঠেনি। তার বাবা মাঝে-মাঝেই নেহরুর সমালোচনা করেন। তাদের স্টাডি সার্কেলের মানিকদা তো প্রায়ই বাপান্ত করেন নেহরুর। মানিকদার মতে পাকিস্তানের মতন ভারতেরও নেহরু-সরকারের বদলে মিলিটারি শাসন থাকলে অনেক ভালো হতো, তা হলে এ দেশে বিপ্লব ত্বরান্বিত হতো। পাকিস্তানের জঙ্গি সরকারের সঙ্গে চীনের যে নতুন বন্ধুত্ব হয়েছে, মানিকদার মতে এর পেছনে গূঢ় কারণ আছে, চীন এই সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানে বিপ্লব ঘটাতে চায়। তপন নামে যে রিফিউজি ছেলেটির সঙ্গে অতীনের এখন বন্ধুত্ব হয়েছে, সেও নেহরুর ওপরে হাড়ে চটা। তার ধারণা উদ্বাস্তুদের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী ঐ জওহরলাল নেহরু।
অতীনের যা বয়েস তাতে একেবারে খুব কাছের প্রিয়জন ছাড়া অন্য কারুর মৃত্যু বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করে না। রাস্তার কিছু লোকের হাহাকার ও শোকের উচ্ছ্বাস দেখে সে ভাবল, এত বাড়াবাড়ি করার কী আছে? নেহরুর যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, তাই মারা গেছে! এত বছর ধরে প্রধানমন্ত্রিত্বগিরি করেছে, আরও কত চাই? মানুষ কি মরবে না নাকি?
বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার জন্য মনটা ছটফট করলেও সে ভাবলো, বাড়িতে গিয়ে মাকে খবরটা জানানো উচিত আগে। দেখতে দেখতে ট্রামবাস বন্ধ হয়ে গেল, সে হাঁটতে শুরু করলো বাড়ির দিকে।
হাজরার মোড়ের কাছে একটা মুসলমান শালকরের দোকানের সামনে ছোটখাটো ভিড় জমেছে। এখানে আবার কী হলো, অতীন উঁকি মেরে দেখতে গেল। একজন লোক হাউ হাউ করে কাঁদছে। লোকটি বৃদ্ধ, লুঙ্গি ও ফতুয়া পরা, মাথায় সাদা টুপি, মুখভর্তি ধপধপে দাড়ি, ঐ লোকটিই দোকানের মালিক। অতীন চেনে ওকে, গত শীতের আগে সে এই দোকানে বাড়ির দু’খানা শাল ধোলাই করতে দিয়েছিল।
লোকটির চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে, সে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলছে, হায়, হায়, অতবড় মানুষটা চলি গেল, আমরা বট বিরিক্ষের নিচে আশ্রিত ছিলাম। মুসলমানেরে আর কে দ্যাখবে? এবারে কাজিয়া বাধলে আর বাঁচবো না, হায় হায়, উনি চলি গ্যালেন গো, সব যে অন্ধকার হইয়ে গেল…
দু’জন কর্মচারি থামাবার চেষ্টা করছে বৃদ্ধকে, উনি কিছুতেই শুনছেন না। বারবার বলে যাচ্ছেন ঐ একই কথা। বৃদ্ধটি কাঁদছেন ঠিক শোকে নয়, অনেকখানি ভয়ে। ভয়ে যেন ওর মাথা বিগড়ে গেছে।
ভিড়ের মধ্য থেকে একজন চেঁচিয়ে বললো, চুপ করো মিঞা। ঐ সব কথা বলছো কেন? তোমাকে কি কেউ ভয় দেখিয়েছে?
অতীন সেখানে আর দাঁড়ালো না, বাড়ির দিকে জোরে পা চালালো। কান্নার দৃশ্য সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এই লোকটির কান্নার মধ্যে এমন একটা আকুলতা রয়েছে যে বুকে ধাক্কা মারে। সে চেষ্টা করেও লোকটির মুখটা ভুলতে পারলো না।
বাড়িতে এসে দেখলো, প্রতাপ আগেই খবর পেয়ে আদালত থেকে বাড়িতে ফিরে, এসেছেন। বাড়িতে একেবারে নিঝুম অবস্থা, প্রতাপ গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তাঁর দু’পাশে মমতা আর সুপ্রীতি। অতীন আর সিনেমার প্রসঙ্গ তুললোই না। প্রতাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এখন কী হবে? নেহরু শক্ত হাতে হাল ধরে ছিলেন, এবার দেশটা যদি টুকরো টুকরো হয়ে যায়…ওঁর মতন আর তো কেউ নেই…
বাবা নেহরুর সমালোচনা করতেন, সেই বাবা যে নেহরুর মৃত্যুতে এতখানি বিহ্বল হয়ে পড়বেন, তা অতীন ভাবতে পারেনি। দেশটা টুকরো টুকরো হয়ে গেলেই বা ক্ষতি কি আছে? বিপ্লবের পর আবার ছোট ছোট রাজ্যগুলি সঙ্ঘবদ্ধ হবে, এই তো নিয়ম! সোভিয়েত ইউনিয়নে যেমন হয়েছে।
মৃত্যুর পরে দেখা গেল নেহরু সত্যিই কোনো উত্তরাধিকারী ঠিক করে রেখে যাননি, তবে গণতন্ত্রের বনিয়াদটি বেশ শক্ত করেই গড়ে রেখে গেছেন। মারামারি কাটাকাটি শুরু হলো না, বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দিল না। দিল্লিতে ক্ষমতা দখলের কোনো কুৎসিত রূপও ফুটে উঠলো না। সৈন্যরা ব্যারাকেই রইলো। টু শব্দটিও করলো না কোন সেনাপতি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দকে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী করে কাজ চালিয়ে যাওয়া যেতে লাগলো। তলে তলে আলাপ-আলোচনা চললো, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। প্রথমেই মোরারজি দেশাই জানালেন তাঁর দাবি। যদিও কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতার ইচ্ছে নিঝাট, নিঃশত্রু লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে নেহরুর জায়গায় বসানো। কয়েকদিন বাদে এগিয়ে এলেন জগজীবন রাম। গান্ধীজী সমাজের নিচুতলার মানুষের নাম দিয়েছিলেন হরিজন, কোনো একজন হরিজনকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি করা উচিত, এরকম কথাও একবার বলেছিলেন না?
লালবাহাদুর শাস্ত্রী নিজে প্রথম দিকে চুপচাপ ছিলেন, কয়েকদিন পর বললেন, তাঁর দল যদি অন্য কোনো প্রার্থীকে মনোনীত করে, তা হলে তিনি স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াবেন। কেউ কেউ বলতে লাগলো, ঐ যে গুলজারিলাল নন্দ একবার প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছে। ও আর ছাড়বে না। এসব চেয়ার কি কেউ ছাড়ে, ওই অন্যদের হটিয়ে দেবে।
শেষ পর্যন্ত সে রকম কিছু হল না। দক্ষিণ ভারতের নেতা কামরাজের মধ্যস্থতায় ছোট্টখাট্টো মানুষ লাল বাহাদুরই হলেন প্রধানমন্ত্রী; মোরারজি ও জগজীবন রাম তাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন না। মেনে নিলেন দলের সিদ্ধান্ত। গুলজারিলাল চেয়ার ছেড়ে দিলেন বিনা বাক্যব্যয়ে। পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের প্রত্যাশা ব্যর্থ করে ভারতে টিকে গেল গণতন্ত্র।
দিন দশেক বাদে অতীন হাজরা মোড়ের সেই শালকরের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলো, সেই দোকানের মালপত্র টেনে বার করা হচ্ছে রাস্তায়। পাকা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধটি একটি লরিতে সেই সব মালপত্র তোলার তদারকি করছেন। আজও তাঁর মুখোনি বিষণ্ণ। অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি চোখ মুছছেন মাঝে মাঝে।
অতীন সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লো। টুকরো টুকরো কথাবার্তা শুনে সে বুঝতে পারলো, সেদিন ঐ বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন তা একেবারে অমূলক নয়। এর মধ্যেই কারা নাকি দু’বার তাঁকে ভয় দেখিয়ে গেছে, এ পাড়ায় কোনো মুসলমানের ব্যবসা করা চলবে না। তিনি তাই দোকান বিক্রি করে ইস্ট পাকিস্তানে চলে যাচ্ছেন।
দু’চারজন তোক বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে বলছে, মিঞা, তুমি ঐ কয়েকটা গুণ্ডা বদমাসের কথা শুনে ভয় পেলে? আমরা তো আছি। থানায় একটা খবর দিয়ে রাখো। ওরা কিছু করতে পারবে না। দু’পুরুষের ব্যবসা ছেড়ে চলে যাবে?
বৃদ্ধটি চোখ মুছে বললেন, দুই পুরুষের দোকান ছাড়ি চলি যেতে কী কষ্ট হয় না? কষ্ট তো হবেই, সাধ করে কি আর চক্ষের পানি ফেলছি রে দাদা! তবু যেতেই হবে। এখন ভালয় ভালয় যাতে যেতে পারি, সেই দোয়া করুন।