2 of 3

২.১৮ কফি হাউসে ঢোকার মুখে

কফি হাউসে ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে অতীন কৌশিককে জিজ্ঞেস করলো, এই, উলুবেড়িয়া কী করে যেতে হয় জানিস?

কৌশিক অবাক হয়ে বললে, উলুবেড়িয়া, মানে উলুবেড়ে? কেন জানবো না! ওর কাছেই তো আমার মামাবাড়ি। আমার মামাবাড়ির গ্রামটার নাম ফুলেশ্বর। তোকে তো একবার নিয়ে যাবো বলেছিলুম।

অতীন একটুক্ষণ কী যেন চিন্তা করলো। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো, একদিনে ফিরে আসা যায়? ট্রেনে যেতে হয়, না?

কৌশিক হেসে ফেলে বললো, তুই আজও বাঙালই রয়ে গেলি, অতীন। উলুবেড়ে কত দূর তুই জানিস না? ট্রেনে যাওয়া যায়, বাসে যাওয়া যায়। কতক্ষণ লাগবে, বড়জোর ঘণ্টা ডেড়েক।

–চল ঘুরে আসি তা হলে।

–হঠাৎ?

–আজ তো ক্লাস হলো না, কতক্ষণ কফি হাউসে গ্যাঁজাবো? সারা দুপুর-বিকেল পড়ে আছে। আজ বেড়িয়ে আসি চল। এখন কটা বাজে? মোটে একটা দশ…

–তা বলে উলুবেড়ে? আগে থেকে খবর দিয়ে রাখলে আমার মামার বাড়িতে গিয়ে থাকা যেত। তার চেয়ে বরং চল বটানিক্স যাই। এই গরমের মধ্যে ওখানটা ভালো লাগবে।

–না, আমার উলুবেড়িয়াতেই যেতে ইচ্ছে করছে।

–কেন?

–না গেলে বলবো না।

–ঠিক আছে, কাল সকালে যাবো। কাল তো, ছুটি আছে।

–গেলে আজই যেতে হবে।

কৌশিক চুপ করে গেল। এরপর সে অনেকগুলো যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলেও অতীনের কাছে হেরে যাবে। অতীনের কথায় বিশেষ যুক্তি থাকে না, তার থাকে জেদ। হঠাৎ এক একটা ব্যাপারে তার ঝোঁক চাপে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। কৌশিক জানে, সে যেতে রাজি না হলেও অতীন একাই উলুবেড়ের দিকে রওনা হবে।

মে মাসের অসহ্য গরম। রাস্তায় পিচ গলে যাচ্ছে। ক’দিন ধরেই আকাশটা বারুদ রঙের, সব বাতাস চলে গেছে অন্য কোনো দেশে। এই রকম দুপুরে কফি হাউসে পাখার তলায় বসে এক দঙ্গল বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিলে সময়টা অগোচরে কেটে যায়, তার বদলে এই জ্বালা-পোড়া রোদ্দুরে ট্যাং ট্যাং করে অতদূর যাবার কোনো মানে হয়? কৌশিকের ভুরু কুঁচকে গেল।

অতীন বললো, তুই এখানে ইসমাইলের দোকানটার কাছে দাঁড়া। তুই ওপরে গেলে আটকে যাবি। আমি চট করে ঘুরে আসছি।

–তা হলে দ্যাখ, রবিকে পাস কিনা। রবি গেলে জমবে।

–আমি রবিকেই খুঁজতে যাচ্ছি।

অতীন লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল ওপরে। আজ বিনা নোটিসে ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে বলে ইউনিভার্সিটি ও প্রেসিডেন্সি কলেজের ছেলেমেয়েতে একেবারে গমগম করছে কফি হাউস। অতীনকে দেখে বিভিন্ন টেবিল থেকে হাত উঠলো, কিন্তু সে কোনো টেবিলের কাছে গেল না, দ্রুত চোখ বুলিয়ে খুঁজতে লাগলো রবিকে।

রবি নেই। তবে এমন আরও তিন-চারজন বন্ধু আছে, যাদের ডাকলেই তারা অতীনের সঙ্গে যেতে রাজি হবে। অতীন কারুকে ডাকলো না।

সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় সে অলি আর বর্ষার মুখোমুখি পড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য সে ভাবলো, অলিকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায়? পরের মুহূর্তেই সে ভাবনাটা উড়িয়ে দিল। অলিকে নিতে চাইলে বর্ষাও যেতে চাইবে, মেয়েদের সঙ্গে নিলে ঠিক সময়ে ফিরে আসার একটা ঝামেলা আছে।

অলি জিজ্ঞেস করলো, এই বাবলুদা, তুমি চলে যাচ্ছো?

অতীন তার খাতাটা অলির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, এটা রাখ তো তোর কাছে। আজকাল ঘনঘন কফি হাউসে দেখছি তোকে, খুব আড্ডা দিতে শিখেছিস, তাই না?

বর্ষা বললো, কেন আড্ডা দেবো না? তোমরা দিতে পারো, তোমরা বুঝি কফি হাউসটা লিজ নিয়েছো?

একটা কোনো সুযোগ পেলেই বর্ষা তোমরা-আমরা দিয়ে কথা শুরু করে দেয়। সে পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে নারী-বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে চায়।

অতীন তাকে বললো, ঠিক আছে, আজ কফি হাউসটা তোমাদের দিয়ে দিলাম।

তারপর সে অলিকে বললো, এই, তোর কাছে ক’টাকা আছে? আমাকে পাঁচটা টাকা ধার দিতে পারবি?

অলি সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ব্যাগ খুললো। তার কাছে-সাত টাকা রয়েছে, অতীন উঁকি মেরে। দেখে বললো, ঐ তো, যথেষ্ট আছে, বাঃ, ফাইন!

নিজেই সে তুলে নিল পাঁচ টাকার নোটটা।

অলি জিজ্ঞেস করলো, তুমি কোথায় যাচ্ছো?

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অতীন বললো, খাতাটা তোদের বাড়ি থেকে পরে নিয়ে নেবো। তারপর সে দৌড়ে নেমে গেল নিচে।

কৌশিকের পাশে অনুপম আর সিদ্ধার্থ এসে জুটেছে। অনুপম জিজ্ঞেস করলো, এই, তোরা উলুবেড়ে যাচ্ছিস কেন রে?

অতীন ভুরু তুলে কৌশিককে নিঃশব্দ বকুনি দিল। কৌশিকটার পেটে কোনো কথা থাকে। এখন এরা দু’জন সঙ্গে সেঁটে থাকতে চাইবে। সব জায়গায় সবার সঙ্গে যাওয়া যায় না।

সে গলা চড়িয়ে বললো, ওখানে যাচ্ছি কৌশিকের মামাবাড়িতে দুধ-ভাত খেতে।অন্য কারুর ভাগ বসানো চলবে না।

কৌশিকের হাত ধরে সে টেনে নিয়ে গেল সামনের দিকে। তারপর হ্যারিসন রোডের মোড় থেকে চলন্ত ট্রামে লাফিয়ে উঠে হাওড়ায়।

কৌশিক লোকাল ট্রেনের টিকিট কাটলো, কুড়ি মিনিট বাদেই ট্রেন। এর মধ্যেই ঘামে ভিজে গেছে ওদের জামা। ভাঁড়ের চায়ে চুমুক দিতে দিতে অতীন বললো, আমি এদিকে বিশেষ কোথাও যাইনি, জানিস? যাওয়ার মধ্যে তো কয়েকবার গেছি দেওঘর, আমার ঠাকুমা থাকেন সেখানে, আর খুব ছোটবেলা বাবা-মা’র সঙ্গে দেশের বাড়ি যেতাম, সে আমার ভালো মনে নেই, স্কুলে পড়ার সময় একবার শুধু। মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম, ব্যস! আর একবার বোধহয় চন্দননগরে কোন বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে, সেও অনেকদিন আগে …

উলুবেড়িয়া, বসিরহাট, নৈহাটি, লক্ষ্মীকান্তপুর, কন্টাই …এইসব জায়াগুলোর নাম কাগজে পড়ি, কিন্তু এগুলো কী রকম জায়গা তার কোনো আইডিয়াই নেই। দেশটাকে এখনো ভালো করে চিনি না।

কৌশিক বললো, তোরা বাঙালরা তো এখনও দেশ বলতে ইস্ট বেঙ্গল ভাবিস! যার নাম এখন ইস্ট পাকিস্তান।

অতীন চোখ পাকিয়ে বললো, মারবো শালা পেছনে এক লাথি। আমরা আবার কিসের বাঙাল রে? ফর্টি সেভেনের আগে থেকে এদিকে আছি।

কৌশিক তবু বললো, তোরা রিফিউজি তা তো বলছি না, কিন্তু বাঙাল ঠিকই। সেটা গা থেকে ঘষে তুলে ফেলতে পারবি না। বাঙালদের অদ্ভুত সেন্টিমেন্ট। সেদিন একটা বিয়ের চিঠি পেলাম, আমার বাবার এক বন্ধুর মেয়ের বিয়ে, ভদ্দরলোকের মোটর পার্টসের ব্যবসা, পূর্ণ দাস রোডে বিরাট বাড়ি হাঁকিয়েছেন, তবু বিয়ের চিঠিতে লিখেছেন, ‘পূর্ববঙ্গের বরিশাল জিলার কোটালিপাড়া গ্রামের অধিবাসী, অধুনা কলিকাতার পূর্ণ দাস রোড নিবাসী’ …যেন পূর্ণ দাস রোডের বাড়িটা টেম্পোরারি, ওঁর আসল বাড়ি ঐ বরিশালে! সেখানে আর বাপের জন্মে কোনোদিন যেতে পারবেন কিনা ঠিক নেই।

–ওরকম কিছু কিছু লোকের বোকা সেন্টিমেন্ট এখনো রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর কত বছর কেটে গেল খেয়াল নেই, কত বছর …এদিকে তিন আর চোদ্দ, মোট সতেরো বছর, এক যুগের বেশি …।

–তোর বাবাও দেখবি তোর বিয়ের সময় ঐ রকম চিঠি ছাপাবেন …

–আমার বাবা খুব নস্টালজিয়ায় ভোগেন, হ্যাঁ, আমার বাবা সারা জীবন বাঙালই থেকে যাবেন, কিন্তু আমার ঐ সব হ্যাং আপ নেই, আমার মায়েরও তেমন নেই। পার্টিশান না হলেও আমি কি ঐ গ্রাম-ফ্রামে গিয়ে কোনোদিন থাকতুম নাকি? ধুস্!

–আচ্ছা অতীন, এবার বল তো, তুই হঠাৎ আজ উলুবেড়ে যাবার জন্য ক্ষেপে উঠলি : কেন? হোয়াট ইজ সো স্পেশ্যাল অ্যাবাউট উলুবেড়ে?

–তুই আজ সকালে স্টেটসম্যান পড়িসনি?

-–কেন পড়বো না। কী আছে, উলুবেড়ে সম্পর্কে কিছু আছে?

–কাগজ খুলে শুধু খেলার খবর ছাড়া আর কিছু পড়িস না, তাই না?

ট্রেন ছেড়ে দেবে, ওদের উঠে পড়তে হলো। এই ঠা-ঠা দুপুরেও ট্রেনে ভিড় কম নেই, কৌশিক অবশ্য আগেই জানলার কাছে রুমাল পেতে রেখেছে। একজন লোক সেই রুমালটা এক পাশে ঠেলে সেখানে পেছন ঠেকিয়েছিল, অতীন চোখ গরম করে বললো, উঠুন, আমরা ওখানে বসবো।

লোকটি বললো, ওসব রুমাল পেতে জায়গা রাখা শিয়ালদা লাইনে চলে, হাওড়ায় চলে না।

কৌশিক বললেব, দাদা, এ লাইনে অনেকদিন যাতায়াত করছি। আমাদের হাওড়া লাইন শেখাবেন না।

ঝগড়া আরও গড়াতে পারতো কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলিষ্ঠকায় ব্যক্তি বললো, বড্ড গরম পড়েছে, এর মধ্যে আর মাথা গরম করবেন না। আপনারা রুমাল পেতে দুটো জায়গা রেখেছিলেন, একটা সীট ছেড়ে দিন, একটাতে একজন বসুন।

অন্যরাও তাতে সায় দিল। অতীন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কৌশিককে জোর করে বসালো সেই জায়গায়। আশ্চর্য, যে-লোকটি জায়গার জন্য ঝগড়া শুরু করেছিল, সে নেমে গেল পরের স্টেশনে। দাঁড়িয়ে থাকা সেই বলিষ্ঠ লোকটি হেসে বললো, যে দেশে ট্রামে-বাসে-ট্রেনে সামান্য বসবার জায়গা নিয়ে লোকে ঝগড়া করে, সেদেশে কখনো ইউনিটি আসতে পারে! দেখবেন, শিগগিরই এমন দিন আসছে, যখন হিন্দু-মুসলমানের রায়টের দরকার হবে না, আমরা এমনি এমনিই মারামারি কাটাকাটি শুরু করে দেবো।

দরজার কাছে দু’তিনজন মুসলমান ব্যাপারি দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে থেকে একজন বললো, আবার ঐ সব অলুক্ষণে কথা তোলেন কেন?

কৌশিকের পাশে বসা একজন শীর্ণকায় প্রৌঢ় বললো, আমাদের টাইমে দুপুরবেলা এই লাইনে এক এক কামরায় পাঁচ-সাতটা লোক থাকতো কিনা সন্দেহ। বাঙালরা এসে দেশটা ভরিয়ে দিল, ট্রেনে জায়গা পাবেন কোথ থেকে?

আর একজন বললো, আগে শেয়ালদা লাইনেই বাঙালদের রাজত্ব ছিল, এখন আস্তে আস্তে এদিকটাতেও ভরে যাচ্ছে।

কৌশিক আড় চোখে তাকালো অতীনের দিকে। সে উদগ্রীব হয়ে শুনছে। শীর্ণ প্রৌঢ়টি বললো, শেয়ালদা লাইন? আরে রাম রাম। আমি তো মরে গেলেও ওদিকের ট্রেনে কক্ষনো চাপবো না। ওদের কথা শুনলে মনে হয় আমাদের বাপ-পিতেমো’র বাংলা ভুলে যাবো!…

উলুবেড়িয়া স্টেশনে নেমে কৌশিক জিজ্ঞেস করলো, যখন বাঙালদের নিয়ে ঐ সব কথা বলছিল, তখন তোর কেমন লাগছিল, সত্যি করে বল তো!

অতীন হেসে বললো, একটু একটু গায়ে জ্বালা ধরছিল, সেটা অ্যাডমিট করছি।

–ঐ যে বললুম, তোদের বাঙালত্ব কোনোদিন গা থেকে ধুয়ে মুছে ফেলতে পারবি না!

–এক হিসেবে আমার অবস্থা আমার বাবাদের জেনারেশনের থেকেও খারাপ। আমার ইস্ট বেঙ্গলের কথা ভাল মনে নেই, কোনো ফিলিংও নেই। অথচ এদিককার লোক যখন রিফিউজিদের নামে দোষ দেয়, তখন তাদের সাইডও নিতে পারি না, আবার চুপ করে থাকলেও মনে হয় কাপুরুষের মতন নিজের পরিচয় গোপন করছি।

–শোন অতীন, এদিককার সব লোক রিফিউজিদের নামে দোষ দেয় না, অনেকে সিমপ্যাথিও দেখিয়েছে।

–এই সব ট্রেনে চাপলে দেশকাল সম্পর্কে সাধারণ লোকের অ্যাটিচিউড টের পাওয়া যায়। মানিকদাকে বলবো, আমাদের স্টাডি সার্কেল শুধু একটা ঘরের মধ্যে লিমিটেড না রেখে, মাঝেসাঝে এই সব ছোটখাটো জায়গায় ঘুরে ঘুরে যদি হয়, তা হলে অনেক কিছু শেখা যাবে।

–মানিকদা নিজে প্রায়ই গ্রামে যায় কৃষাণ ফ্রন্টের কাজ করতে। যাকগে ওসব কথা। উলুবেড়ে তো এলুম, এখন যাওয়া হবেটা কোথায়?

আমি কী ভেবেছিলাম জানিস, কৌশিক, এখানে এসে দেখবো ঝাঁকে ঝাঁকে লোক গঙ্গার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। গঙ্গা কোন দিকে? আজ সকালবেলার কাগজে পড়লাম, একটা বিলিতি জাহাজ এখানকার গঙ্গার কাছে কিসে যেন আটকে গিয়ে জখম হয়ে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে।

–হ্যাঁ। সে জাহাজের খবরটা তো আমিও দেখেছি। এখানকার গঙ্গায় বুঝি? সেটা লক্ষ করিনি।

–তুই পুরো খবরটা পড়িসনি তার মানে।

–জাহাজটা ডুবে যাচ্ছে বলে তুই এখানে ছুটে এলি? তুই-আমি খুচরো আদার ব্যাপারি, আমাদের সঙ্গে জাহাজের কী সম্পর্ক?

–একটা জাহাজ আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে, সেটা তোর দেখতে যেতে ইচ্ছে করে না? এরকম সুযোগ ক’বার পাওয়া যায় জীবনে?

–তুই…জাহাজডুবি দেখতে এসেছিস?

–এটা একটা দেখার জিনিস নয়?

–চল, বাইরে গিয়ে রিকশা ধরি, ওরা হয়তো জানবে ব্যাপারটা কোথায় হয়েছে।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওরা একটা রিকশায় উঠে বসলো। দলে দলে লোক গঙ্গার দিকে ছুটে যাচ্ছে না, বটে, তবে রিকশাওয়ালা ঘটনাটা জানে। জাহাজটা ডুবছে কয়েকদিন ধরে। প্রথমে ওটাকে উদ্ধার করার চেষ্টা হয়েছিল, এখন আশা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

স্টেশন থেকে ঘটনাস্থলটি বেশ দূরে। গঙ্গার ধারে পৌঁছে দেখা গেল, কিছু লোক জমায়েত হয়ে আছে সেখানে। গঙ্গা নদী এই জায়গায় একটা বাঁক নিয়েছে, যেন বাঁকের মুখে কাৎ হয়ে আছে জাহাজটা। দু’খানি স্টিম লঞ্চ ও বেশ কয়েকটি নৌকো ঘিরে আছে তাকে।

এদিকের আকাশে মেঘ জমছে বেশ। এর মধ্যেই রোদ মুছে গিয়ে একটু একটু অন্ধকার অন্ধকার ভাব হয়েছে, হেলে পড়া জাহাজটিকে যেন কোনো ট্রাজেডির নায়কের মতন দেখায়। দুটি মাস্তুল যেন আকাশের দিকে হাত তোলা।

ভিড় ঠেলে জলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো দু’জনে। অতীন জাহাজটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। কৌশিক বললো, আমার মামাবাড়ি তো গঙ্গার ধারেই প্রায়, ছোটবেলা কত জাহাজ দেখতুম। সবচেয়ে ভালো লাগত রাত্তিরবেলা, এক একটা বিরাট বিরাট বিলিতি জাহাজ, কত আলো জ্বেলে রাখতো.এখন গঙ্গায় চড়া পড়ে যাচ্ছে, কলকাতা বন্দরটার বারোটা বেজে গেল! এই জাহাজটা তো এমন কিছু বড় নয়, এই সাইজের জাহাজই যদি আটকে যায়…

অতীন বললো, চল, একটা নৌকো ভাড়া নিয়ে আরও কাছ থেকে দেখে আসি।

–আবার নৌকো-ফৌকোর ঝামেলা করে কী হবে?

–আমি কখনো খুব কাছ থেকে কোনো জাহাজ দেখিনি। ছেলেবেলায় ভাবতাম, জাহাজে কোনো একটা চাকরি নেবো, তারপর সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবো। এই জাহাজটাও, তুই ভেবে দ্যাখ, কত দেশ ঘুরেছে, সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত আমাদের এই গঙ্গায় এসে ডুবে গেল…ভালো বাংলায় কী যেন বলে, সলিল সমাধি হয়ে গেল!

–এটা তো মনে হচ্ছে দিশি জাহাজ।

–কাগজে লিখেছে বিলিতি।

–হ্যাঁ, জাহাজটার মালিক টানার মরিসন কম্পানি, জাহাজটার নাম এস এস মার্তণ্ড, বোধ হয় ব্রিটিশ আমল থেকে চলছে। বুড়ো না হলে কোনো জাহাজ সহজে ডোবে না।

–টাইটানিক বুঝি বুড়ো ছিল? অতীন নিজেই আর একটু নিচে নেমে গিয়ে দরাদরি করলো একজন নৌকোওয়ালার সঙ্গে। তারপর কৌশিককে ডেকে বললো, চলে আয়, ও রাজি আছে।

কৌশিক কাছে এসে বললো, আকাশের অবস্থা ভালো নয়। অতীন, তুই সাঁতার জানিস? অতীন হেসে দু’দিকে মাথা দোলালো।

কৌশিক উদ্বিগ্ন ভাবে বললো, তা হলে নৌকোয় যাওয়ার দরকার নেই। বছরের এই সময়টায় যখন তখন ঝড় ওঠে। তুই মাঝিকে জিজ্ঞেস কর।

অতীন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো, আমার কিচ্ছু হবে না। আমি অমর। আমি সাঁতার জানি না, আমি একবার জলে ডুবে যাচ্ছিলাম, আমার দাদা সাঁতার জানতো, আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার দাদাই মরে গেল। অথচ আমার কিছু হলো না। এইরকম ছেলে কি আর কখনো জলে ডুবে মরতে পারে?

–তুই কি ভয় পেয়ে তোর দাদাকে জড়িয়ে ধরেছিলি? অনেক সময় হয়, যে বাঁচাতে যায়

–সে সব আমার মনে নেই। তবে, অনেকেই মনে করে, আমার বদলে আমার দাদারই বেঁচে থাকা উচিত ছিল। আমার মা বাবাও বোধ হয় সেইরকমই মনে করে। অথচ বেঁচে রইলাম তো আমিই। শালা, পৃথিবীটা একটা বিচিত্র জায়গা, চল তো!

কৌশিকের হাত ধরে টেনে সে জোর করে নৌকোয় তুললো। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, এখন ঝড় উঠলে বেশ হয়! তুই তো সাঁতার জানিস। তুই যেন আমাকে

বাঁচাবার চেষ্টা করিস না। তাহলে কিন্তু তুই-ই মরবি?

কৌশিক বললো, অতীন, আমি আগে কখনো তোর মুখে এই ধরনের কথা শুনিনি। তোর মধ্যে মনে হচ্ছে একটা ডেথ উইশ আছে?

–তোর মাথা খারাপ! আমি অন্তত একশো বছর বাঁচবো। অনেককে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তারপর নিজে যাবো।

–তোর দাদা খুব ট্যালেন্টেড ছিল, তাই না?

–বাদ দে, বাদ দে। ওসব কথা রাখ তো! দ্যাখ, জাহাজটাকে এখন কীরকম একটা ভাঙা দুর্গের মতন দেখাচ্ছে।

অতীনকে এরকম রোমান্টিক হতে কখনে, দেখেনি কৌশিক। সে সব সময় চাঁছা ছোলা ভাষায় কথা বলে। হাওয়ায় চুল এলোমেলো হয়ে গেছে অতীনের, চোখ দুটি যেন খুবই ব্যগ্র। একটা ডুবন্ত জাহাজ দেখার জন্য তার এই ব্যাকুলতা যেন বিশ্বাসই করা যায় না।

কৌশিক হঠাৎ আবৃত্তি শুরু করলো :

I’ll warrant him for drowning, though the ship were no stronger than a nutshell, and as leaky as an unstanched wench.

Lay her a-hold, a-hold! Set her two courses: off to sea again; lay her off.

তারপর থেমে গিয়ে বললেন, এটা কোথায় আছে বল তো? অতীন উদাসীন ভাবে বললো, কী জানি! তুই তো জানিস, আমি কবিতা-টবিতা পড়ি না!

কৌশিক বললো, হ্যাঁ, লুকিয়ে লুকিয়ে পড়িস। একদিন হ্যামলেট থেকে মুখস্ত বলেছিলি। এটা শেকস্পীয়ারের দা টেমপেস্ট নাটকের প্রায় শুরুতেই…

সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে অতীন জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা কৌশিক, আমরা আমাদের জন্মটা পেয়েছি মা বাবার কাছ থেকে, সেইজন্য সারাটা জীবনই কি তাদের কাছে ঋণী থাকতে হবে?

কৌশিক কয়েক মুহূর্ত বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, এর উত্তর ইয়েস অ্যান্ড নো!

–তার মানে?

–বায়োলজিক্যাল ব্যাপারটা সহজে এক্সপ্লেইন করা যায়। বায়োলজিক্যাল কারণে ঋণী থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার তো এত সহজে ব্যাখ্যা করা যায় না। শুধু জন্মের টানে নয়, বাবা-মায়ের সঙ্গে তার পরে কতখানি স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তার ওপর সব কিছু ডিপেন্ড করে। কত ছেলে-মেয়ে তো বাবা-মাকে ভালো করে চেনেই না!

অতীন অস্ফুট ভাবে বললো, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার বন্ধন, নাইলনের দড়ির চেয়েও অনেক শক্ত। স্টাডি সার্কলে মানিকদার কথা শুনতে শুনতে মনে হয়, কবে সব বন্ধন অগ্রাহ্য করে বেরুবো!

এখন ভাটার টান চলছে তাই জাহাজটার কাছাকাছি যেতে ওদের খানিকটা সময় লাগলো। ছোট নৌকো, দু’জনেই ছই ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ডুবন্ত এস এস মার্তণ্ড থেকে নামানো হচ্ছে মালপত্র, সন্নিহিত স্টিমবোট ও নৌকোগুলি সেই কাজে নিযুক্ত। বড় বড় সব খয়েরি রঙের পেটি।

একটি স্টিম বোট থেকে একজন পুলিস অফিসার ওদের উদ্দেশ্যে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললো, এই, এদিকে আসবে না! যাও, হটে যাও!

অতীন মাঝিকে বললো, তুমি ওর কথা শুনো না, আর একটু কাছে চলো তো ভাই!

মাঝি বললো, ঐ জাহাজের ধারে যাওয়া নিষেধ আছে। লোকে যদি জিনিস চুরি করে সেই ভয় আছে তো।

অতীন বললো, ঐ পুলিস ব্যাটারাই অনেক কিছু চুরি করবে! তুমি চলে এসো, আর একটু কাছে চলো।

কৌশিক অবাক হয়ে অতীনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, কী বলছিস পাগলের মতন! পুলিস যদি গুলি চালায়? মাঝিভাই, তুমি আর যেও না!

অতীন বললো, গুলি চালালেই হলো নাকি!অ্যাই, আরও কাছে না গেলে আমি জলে ঝাঁপ দেবো বলে দিচ্ছি!

পুলিস অফিসারটি হুংকার দিতে শুরু করেছে। অতীনদের নৌকো অন্য একটি নৌকোর গায়ে লাগতেই অতীন লাফিয়ে চলে গেল সেটাতে। তারপর সামনে দৌড়ে গিয়ে জাহাজটির রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। একজন সাদা পোশাক পরা ইংরেজ অফিসার পুলিসের হম্বিতম্বি শুনে সেখানে এসে দাঁড়িয়ে অতীনদের লক্ষ করছিল। এবারে সে সহাস্যে ইংরিজিতে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার, যুবক, এই ডুবন্ত জাহাজে তোমার কোনো নিকট আত্মীয় রয়ে গেছে নাকি? তোমার বাকদত্তা?

অতীন বললো, না, আমরা কলকাতা থেকে এসেছি এই জাহাজটা দেখতে। একবার ওপরে আসতে পারি?

অফিসারটি ভুরু তুলে বললো, তোমরা কলকাতা থেকে এই জাহাজটি দেখবার জন্যই এসেছো শুধু?

–হ্যাঁ।

–তবে তো অবশ্যই ওপরে আসতে পারো। এস এস মার্তণ্ড ধন্য, মৃত্যুকালেও সে তোমাদের মতন দু’একজন উপযাজক ভক্ত পেয়েছে।

অতীন আর কৌশিককে ওপরে তোলা হলো। অফিসারটি তাদের ওপরের ডেকের কয়েকটি ফাঁকা ক্যাবিন ঘুরিয়ে দেখালেন। জাহাজটি ঝুঁকে আছে পোর্ট সাইডের দিকে, ভেতরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে উঁকি মারলে ইঞ্জিন ঘরে জল দেখা যায়।

অফিসারটি ওদের দু’প্যাকেট সিগারেট উপহার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি মদ খাও?

অতীন আর কৌশিক একই সঙ্গে বললো, না।

অফিসারটি বললেন, তা হলে আর তোমাদের সঙ্গে ফেয়ারওয়েল টোস্ট করা গেল না। আমি এর আগে সাতবার কলকাতা এসেছি, আর কখনো আসবো না। গুড বাই!

ফেরার পথে ট্রেনে উঠে অতীন বললো, আমি জাহাজটাকে এখন যেন আরও ভালো করে দেখতে পাচ্ছি।

কৌশিক বললো, যাই-ই বল, ওপরে উঠে আমার বেশ ভয় ভয় করছিল। যদি ভুস করে ডুবে যেত!

–একটা কী রকম ভালো লোকের সঙ্গে আলাপ হলো।

–লোকটা বেশ ভদ্র ছিল ঠিকই, কিন্তু আমি ইংরেজদের পছন্দ করি না।

–ও ইংরেজ নয়, ও একজন নাবিক। ও যখন বললো, আর কোনোদিন কলকাতায় আসবো না, তখন আমার মনে হলো, ঐ লোকটা যেন এই জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে জলের তলায় তলিয়ে যাবে।

–যাঃ, তা কখনো হয় নাকি? ও মালপত্র খালাস করাবার জন্য রয়ে গেছে।

–তা জানি। তবু ঐ রকম একটা দৃশ্য ভাবতে ভালো লাগে না। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, জাহাজটা একটু একটু করে ডুবছে, আর ঐ সাদা পোশাক পরা লোকটা দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ধরে…

কৌশিক বললো, আমি কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না, তোর এই ডুবন্ত জাহাজ দেখতে আসার ব্যাপারটা!

অতীন ভুরু কুঁচকে বললো, কেন, তোর ভালো লাগে নি? জাহাজটার ওপরে যে ওঠা যাবে, এতটা আশাই করিনি আমি!

কৌশিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ভালো লাগবে না কেন? দৃশ্যটার মধ্যে একটা ট্র্যাজিক মহিমা আছে, আকাশে সেই সময় সূর্যাস্তের রঙের সঙ্গে মিলে ছিল কালো মেঘ। তবে কি জানিস অতীন, আগে এই সব দৃশ্য দেখে যত আনন্দ পেতাম, এখন আর পাই না। সুন্দর কিছু দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেই হঠাৎ কে যেন আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা!

অতীন জিজ্ঞেস করলো, এটা কী? কবিতা? তোর কানে কানে কে এই কবিতা বলে?

কোনো উত্তর না দিয়ে কৌশিক এবার জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলো বাইরে। হঠাৎ কৌশিকের মুখখানা কেন বিষণ্ণ হয়ে গেল, তা বুঝতে পারলো না অতীন।

এত কাণ্ডের পরেও ওরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেল পৌনে ন’টার মধ্যে। কৌশিকের মামাবাড়িতেও বুড়ি ছুঁয়ে আসা হয়েছে। সত্যিকারের বুড়ি ছোওয়ার কারণ ওর থুরথুরে দিদিমা ছাড়া বাড়িতে আর কেউ ছিল না।

দু’জনে দু বাসে চাপলো। অতীন নেমে পড়লো ভবানীপুরে অলিদের বাড়ির সামনে। তার খাতাটা নিতে হবে। সায়েন্স কলেজে যাবার সময় খাতা নিয়ে বেরিয়েছিল, বাড়ি ফেরার সময় হাতে খাতা থাকবে না, এটা ভালো দেখায় না।

অলিদের অবারিতদ্বার বাড়িতে ঢুকে পড়ে অতীন একবার দোতলায় উঁকি মারলো, তারপর তিন তলায় উঠে এলো। অলির ঘরে তার পড়ার টেবিলের সামনে একজন মধ্য বয়স্ক পুরুষ বসে আছেন। ইনি ইংরিজির অধ্যাপক, অলিকে পড়াতে আসেন সপ্তাহে দু দিন। এই লোকটিকে অতীন দু’চক্ষে দেখতে পারে না। সে ঠিক করে রেখেছে, কোনো একটা সুযোগ পেলেই সে ঐ অধ্যাপকটিকে অলিদের বাড়ি থেকে তাড়াবে। এই উদ্দেশ্যে সে ইতিমধ্যে অধ্যাপকটির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করে দিয়েছে।

অধ্যাপকটি মন দিয়ে কিছু লিখছেন, অতীনের পায়ের শব্দ পেয়েই অলি চোখ তুলে তাকালো। অতীন দু হাত তুলে ইসারায় বুঝিয়ে দিল খাতাটার কথা।

একটু আসছি বলে অলি উঠে এলো চেয়ার থেকে। তার চুলের বেনীটা বুকের ওপর ফেলা।

অলি দরজা দিয়ে বেরুতেই অতীন ক্ষিপ্র হাতে তাকে একপাশে টেনে নিয়ে সবলে বুকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটটা কামড়ে চুমু খেল। অলি ভয়ের চোটে কোনো শব্দ করতে পারলো না। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টাও করলো না। তার মায়ের ঘরের দরজা খোলা, যে-কোনো মুহূর্তে মা বেরিয়ে আসতে পারে।

একটু পরে অতীন অলিকে ছেড়ে দিয়ে বললো, চলি! তোর টাকাটা আমি পরে শোধ করে দেবো।

অলি অতীনের একটা হাত চেপে ধরলো। তার চোখ ফেটে জল আসছে। সে কোনো কথা বলতে পারছে না। বাল্লুদা এলেই এরকম একটা কাণ্ড করবে, আবার এজন্য তাকে বকুনি দিলে আসা বন্ধ করে দেবে। মাসের পর মাস এ বাড়িতে আসবে না।

অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বাবলুকে টেনে নিয়ে এলো সিঁড়ির কাছে। তারপর ধরা গলায় বললো, তোমরা উলুবেড়িয়া গিয়েছিলে?

–হ্যাঁ। সে কথা বুঝি এর মধ্যে কফি হাউসে রাষ্ট্র হয়ে গেছে? কেন গিয়েছিলাম বল তো। একটা দারুণ ব্যাপার দেখলাম। একটা জাহাজ ডুবে যাচ্ছে…

–আমার সঙ্গে দেখা হলো, তবু কেন আমায় সঙ্গে নিয়ে গেলে না?

–তোর সঙ্গে যে ঐ ফেমিনিস্ট মেয়েটা ছিল! তাছাড়া তুই যেতে পারতিস না। নৌকো-টৌকো চড়ার ব্যাপার ছিল…কিন্তু আমি ভাবলাম, ফিরে এসেই তোকে সব শোনাবো, সেইজন্য দৌড়োতে দৌড়োতে এসেছি, এদিকে তুই ঐ বদ মাস্টারটাকে নিয়ে বসে আছিস!

–ছিঃ, ও কথা বলে না।

–তা হলে তুই থাক ঐ মাস্টারকে নিয়ে। আমি চলি! অতীন পেছন ফিরতেই অলি আবার বাবলুর হাত চেপে ধরলো। অতীন ধারালোভাবে হেসে জিজ্ঞেস করলো, কী?

অলি কোনো উত্তর দিল না। সে বুঝতে পেরেছে, এখন এভাবে সে বাবলুদাকে ধরে রাখতে পারবে না। তার মুষ্টি আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে এলো। তার ঠোঁট জ্বালা করছে, তার বুকের মধ্যেও সব কিছু কাঁপছে।

অতীনকে ছেড়ে দিয়ে সে দেয়ালে মাথা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *