ছাত্র ও শিক্ষকের কাহিনী
ইয়েমানের সুবাদার উজির বদর অল-দিনের এক পরম রূপবান কনিষ্ঠভ্রাতা ছিলো। তার অতুলনীয় রূপের জেল্লায় মুগ্ধ নয়নে চেয়ে দেখতো সবাই। বদর অল-দিনের মনে ভয় হতো, না। জানি কোন খারাপ সংসর্গে মিশে ভাই তার বয়ে যাবে। তাই সে সব সময় তাকে চোখে চোখে রাখতো। তার সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে বড় একটা মিশতে দিত না। এই আশঙ্কায় সে তাকে মাদ্রাসায় পাঠাতো না। এক প্রবীণ প্রাজ্ঞ সদাশয় শিক্ষককে তার গৃহ-শিক্ষক নিযুক্ত করে লেখাপড়া শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলো। এই বৃদ্ধ মৌলভী প্রতিদিন তার বাড়িতে এসে তাকে পড়িয়ে যেত। বাড়ির একটি নিভৃত কক্ষে দ্বার রুদ্ধ করে বহুক্ষণ ধরে সে তাকে পড়াশুনা করাতো। সে ঘরে কারুরই প্রবেশ অধিকার ছিলো না, এমনকি স্বয়ং উজির সাহেবও যেত না।
কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই বৃদ্ধ মৌলভী খুব সুরৎ কিশোরের প্রেমে মশগুল হয়ে পড়লো। অচিরেই মৌলভীর বুড়ো হাড়ে বহুকালের সুপ্ত বসন্ত চেগে উঠলো।
একদিন সে আর মনের আকুলি-বিকুলি চেপে না রাখতে পেরে কিশোরের কাছে তার মহব্বৎ পেশ করে বসলো, তোমাকে দেখা ইস্তক আমার বুকের মধ্যে আঁকু পাঁকু করছে। তোমাকে ছাড়া এ জিন্দগী আমার বরবাদ হয়ে যাবে-আমি বাঁচতে পারবো না।
বদর অল-দিনের ভাই বৃদ্ধ মৌলভীর এই আকুল আবেদনে বিচলিত হয়ে পড়ে। বলে, কিন্তু আমার বড়ভাই সব সময় আমাকে চোখে-চোখে রাখে। তার নজর এডিয়ে আপনাকে আমি কি করে খুশি করতে পারি?
বৃদ্ধ বলে, উপায় আমি ভেবেছি। রাত্রে যখন তোমার বড়ভাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন তুমি ওপাশের ছাদে গিয়ে দাঁড়াবে। আমি দেওয়ালের ওপাশে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। তোমার সাড়া পেলেই আমি দেওয়াল বেয়ে উপরে উঠে আসবো। তারপর তোমাকে নিয়ে দেওয়াল টপকে ওপাশে চলে যাবো। কেউ জানতে পারবে না।
এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সুলতান শাহরিয়ার মনে মনে ভাবে, শাহরাজাদকে এখন মারা চলবে না। ছেলেটাকে নিয়ে বৃদ্ধ মৌলভী কী কাণ্ড করে একবার জানতে হবে।
তিনশো পচাত্তরতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয় :
শাহরাজাদ বলতে থাকে। ছেলেটি বললো, ঠিক আছে তাই হবে। সন্ধ্যা হতে না হতেই সে ঘুমাবার ভান করে শুতে চলে গেলো। কিন্তু বিছানায় ঘাপটি মেরে পড়ে রইল্ল। কিছু পরে বড় ভাই বদর অল-দিন দিনের কাজকর্ম সেরে নিজের ঘরে চলে গেলে সে চুপিচুপি ছাদের কিনারে এসে দাঁড়ালো।
বৃদ্ধ মৌলভী আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো সেখানে। শয়তানটা তাকে দেওয়ালের ওপারে নিয়ে চলে গেলো। তারপর সোজা নিয়ে গিয়ে তুললো তার নিজের শোবার ঘরে।
নানা রকম সুন্দর সুন্দর ফলমূল এবং দামী দামী সরাবে সাজানো ঘর। স্মৃর্তি করার সব সাজ-সরঞ্জাম সেখানে হাজিরা। ঘরের মেজেয় ফুটফুটে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। মৌলভী একখানা সাদা মাদুর বিছিয়ে ছেলেটিকে পাশে নিয়ে বসলো।
তারপর চলতে থাকলো তাদের পানাহার। একের পর এক মদের পেয়ালা নিঃশেষ করে ওরা। চলতে থাকে লঘু সুরের প্যােলা মারা গান। মৃদুমন্দ হাওয়া, মধুক্ষরা জ্যোৎস্নালোক, সরাবের মন্দিরত আর হাল্কা সুরের সঙ্গীত এক অপূর্ব মোহময় স্বপ্নলোকের ইন্দ্রজাল রচনা করছিলো তখন।
এইভাবে মধুর আবেশের মধ্যে অনেকক্ষণ কেটে গেছে। আরও কত সময় কাটতো কে জানে। কিন্তু একটা ব্যাপার ঘটে গেলো।
বদর অল দিন নিজের ঘরে বিশ্রাম করছিলো। হঠাৎ তার খেয়াল হলো, ভাই-এর সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু তার শোবার ঘরে এসে অবাক হলো, বিছানায় সে নাই। সারাবাড়ি আঁতিপাতি করে। খোঁজা হলো। কিন্তু না, কোথাও তাকে পাওয়া গেলো না। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় সে ছাদের সেই প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। বদর অল দিন দেখতে পেলো, প্রাচীরের ওপাশের বাড়ির একটি ঘরে বসে তার ভাই মীলভীর সঙ্গে মদের পেয়ালা হাতে মশগুল!
হঠাৎ মৌলভীর নজর পড়ে ছাদের দিকে। স্বয়ং উজির বদর অল দিন ছাদের প্রান্তে দণ্ডায়মান। মৌলভী প্রমাদ গুণলো। কিন্তু মুহূর্ত মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে সে লঘু গানের বয়ান বদলে এক উচ্চ মাগের সঙ্গীত শুরু করে দিলো।
বদর অল দিন সব ভুলে তন্ময় হয়ে শুনতে থাকে সেই সুমধুর মার্গ-সঙ্গীত। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তারিফ করতে থাকে, বহুৎখুব-তোফা।
এই রাতে মৌলভীর ঘরে ভাইকে মদের পেয়ালা হাতে দেখেও তার আর খারাপ লাগে না। বরং মনে হয়, তার ভাইকে কালোয়াতী গানের তালিম দিতে নিয়ে গিয়ে মৌলভীসাহেব ভালোই করেছে। নিশ্চিন্ত মনে সে নিজের ঘরে ফিরে যায়।
এর পর মৌলভীটা ছেলেটিকে নিয়ে সুখের সমুদ্রে সুধা পান করতে থাকে।