1 of 2

২.১৭ কানায় কানায় পূর্ণ মন নিয়ে

কানায় কানায় পূর্ণ মন নিয়ে বাড়ি ফিরলো সুবৰ্ণলতা।

ভাবতে লাগলো। ভগবানের উপর অবিশ্বাস এসে গেলেই বুঝি তিনি এইভাবে আপন করুণা প্ৰকাশ করেন।

মানুষের উপর প্রত্যাশা হারালেই ভগবানের উপর আসে অবিশ্বাস। তবু কোথাও বুঝি কিছু একটা আশা ছিল, তাই দ্বিধাগ্ৰস্ত চিত্ত নিয়ে সেই আশার দরজায় একটুকু করাঘাত করতে গিয়েছিল সুবৰ্ণলতা, রুদ্ধ কপাট খোলে কিনা দেখতে। দেখলো, দু হাট হয়ে খুলে গেল। ভিতরের মালিক সহাস্য অভ্যর্থনায় বললো, এসো এসো! বোসো, জল খাও।

হ্যাঁ, সেই কথাই মনে হয়েছিল সুবৰ্ণলতার।

একথা সেকথার পর আবার মামীমার মাধ্যমে ছাপার খরচার কথাটা তুলেছিল সুবৰ্ণ, সুবৰ্ণলতার জগু-বটুঠাকুর সে প্রস্তাব তুড়ি দিয়ে ওড়ালেন। বললেন, দূর! কাগজের আবার দাম! বস্তা বস্তা কাগজ কেনা আছে আমার। এই তো এখনই তো দু হাজার বর্ণপরিচয় ছাপা হচ্ছে। বৌমা বই লিখেছেন, এটা কি কম আহ্লাদের কথা! ছেপে বার করে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াবো লোককে। কী গুণবতী বৌ আমাদের! বুকটা দশ হাত হয়ে উঠবে।

শুনে তখন সহসা ভূমিকম্পের মতো প্রবল একটা বাম্পোচ্ছাসে সুবৰ্ণলতার সমস্ত শরীর দুলে উঠেছিল। জীবনের তিন ভাগ কাটিয়ে এসে সুবৰ্ণলতা এই প্রথম শুনলো সে গুণবতী! শুনলো তার কোনো গুণ নিয়ে কেউ গৌরব করতে পারে!

অথচ এই গুণাই–

হ্যাঁ, এই গুণই দোষ হয়েছে চিরকাল!

আজীবনই তো একটু-আধটু লেখার সাধ ছিল। কিন্তু সে সাধ মেটাতে অনেক দাম দিতে হয়েছে। কত সঙ্গোপনে, কত সাবধানে, হয়তো রাত্রে যখন ওদিকে তাসের আড্ডা জমজমাট, অথচ এদিকে ছেলেরা ঘুমিয়েছে, তখন বসেছে একটু খাতা-কলম নিয়ে, প্ৰবোধ কোনো কারণে ঘরে এসে পড়ে দেখে ফেললো, ব্যস, শুরু হলো ব্যঙ্গ তিরস্কার।

আর তার জের চলতে লাগলো বেশ কিছুকাল। যে সংসারে মেয়েমানুষ বিদ্যোবতী হয়ে উঠে কলম নাড়ে, তাদের যে লক্ষ্মী ছেড়ে যাওয়া অনিবাৰ্য এ কথাও ওঠে। তাছাড়া কলম ধরা হাত যে আর হাতবেড়ি ধরতে চাইবে না, তাতে আর সন্দেহ কি!

অনেক সময় অনেক কটুক্তি হজম করেছে। সুবৰ্ণলতা তার খাতা নিয়ে। আর এখনই কি হয় না? কটূক্তি না হোক বক্রোক্তি!

কানে আসে বৈকি।

আর সে উক্তি আজকাল অনেক সময়ই আসে ছেলেদের ঘর থেকে। সুবৰ্ণলতার রক্তেমাংসে গঠিত ছেলেদের!

ব্যাপারটা কি? কোনো থিসিসৃটিসিস লেখা হচ্ছে নাকি?… মা কি রান্নাঘরটা একদম ছেড়ে দিলেন নাকি রে বকুল? দেখতেই পাওয়া যায় না!–সুবল, তুই তো অনেক জানিস, মহাভারত লিখতে বেদব্যাসের কতদিন লেগেছিল জানিস সে খবর?

অথবা প্ৰবোধের আক্ষেপ-উক্তি শোনা যায়, কী রান্না-বান্না হচ্ছে আজকাল? বকুল, এ মাছের তরকারি রোধেছে। কে? তুই বুঝি? মুখে করা যাচ্ছে না যে—

জানে বকুল নয়, ছেলের বৌরা রোধেছে। তন্ত্ৰাচী ওইভাবেই বলে। বোধ করি সেই চিরাচরিত মেয়েলী প্ৰথাটাই বজায় রাখে। বিকে মেলে বেঁকে শেখায়।

আবার এ আক্ষেপও করে ওঠে, হবেই তো! বাড়ির গিন্নী যদি সংসার ভাসিয়ে দিয়ে খাতাকলম নিয়ে পড়ে থাকে, হবেই নষ্ট-অপচয়, অবিলি, বে-বন্দোবস্ত!

সুবৰ্ণর কানে আসে।

কিন্তু সুবৰ্ণ কানে নেয় না। সব কিছু কানে নেওয়া থেকে বিরত হয়েছে সুবর্ণ, অভিমানশূন্য হবার সাধনা করছে।

অতএব জবাব দেয় না।

সুবৰ্ণলতার তার সংসারের সব প্রশ্নের জবাব তৈরি করছে বসে শেষ আদালতে পেশ করার জন্যে। হয়তো সেই জবাবী বিবৃতির মধ্য থেকে সেই সংসার সুবৰ্ণলতাকে বুঝতে পারবে।

আর সেই বোঝা বুঝতে পারলেই বুঝতে পারবে নিজের ভুল, নিজের বোকামি, নিজের নির্লজতা।

সুবৰ্ণলতার স্মৃতিকথা সুবৰ্ণলতার জবানবন্দী।

সেই মুক্তি দিতে পারছে সুবৰ্ণলতা, মুক্তি দিতে পারছে খাতার কারাগার থেকে আলোভিরা রাজরাস্তায়।

ঈশ্বরের করুণা নেমে এসেছে মানুষের মধ্য দিয়ে।

আজীবনের কল্পনা সফল হতে চললো এবার, আজীবনের স্বপ্ন সফল। এ যেন একটা অলৌকিক কাহিনী। যে কাহিনীতে মন্ত্রবলের মহিমা কীর্তিত হয়। নইলে চিরকালের বাউণ্ডুলে জগু-বটুঠাকুরের হঠাৎ ছাপাখানা খোলার শখ হবে কেন?

ভগবানই সুবৰ্ণলতার জন্যে–

পৃথিবীটাকে হঠাৎ ভারি সুন্দর লাগে সুবর্ণর, ভারি উজ্জ্বল। খুশি-ঝলমলে সকালের আলোয় এই বিবর্ণ হয়ে আসা গোলাপি-রঙা বাড়িটা যেন সোনালী হয়ে ওঠে। নিজের সংসারটাকেও যেন হঠাৎ ভাল লেগে যায়।

এই তো, এই সমস্তই তো সুবৰ্ণলতার নিজের সৃষ্টি, এদের উপর কি বীতশ্রদ্ধ হওয়া যায়? এদের উপর বিরূপ হওয়া সাজে?

এরা যে সুবৰ্ণলতাকে ভালবাসে না, সে ধারণাটা ভুল ধারণা সুবৰ্ণলতার। বাসে বৈকি, শুধু ওদের নিজেদের ধরনে বাসে। তা তাই বাসুক। সুবৰ্ণলতাও চেষ্টা করবে ওদের বুঝতে।

হয়তো জীবনের এই শেষপ্রান্তে এসে জীবনের মানে খুঁজে পাবে সুবৰ্ণ, আর তার মধ্যেই খুঁজে পাবে জীবনের পূর্ণতা।

ক্রমশই যেন প্রত্যাশার দিগন্ত উদ্ভাসিত হতে থাকে নতুন সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষ্ণয়।

শুধুই বা ওই জবানবন্দী কেন?

আরও তো লিখেছে সুবৰ্ণলতা, যা শিল্প, যা সৃষ্টি।

যেখানে সুবৰ্ণলতা একক, যেখানে তার ওপর কোনো ওপরওয়ালা নেই। যেখানে থাকবে সুবৰ্ণলতার অস্তিত্বের সম্মান। যেখানে সে বিধাতা।

আঃ, এ কল্পনায় কী অপূর্ব মাদকতা!

এ যেন কিশোরী মেয়ের প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি। অনুক্ষণ মনের মধ্যে মোহময় এক সুর গুঞ্জরণ করে। সে সুর রাত্রির তন্দ্রার মধ্যেও আনাগোনা করে।

নিত্য নূতন বই লেখা হচ্ছে, নিত্য নিত্য বই ছাপা হয়ে বেরোচ্ছে সে সব, অবাক হয়ে যাচ্ছে সবাই সুবৰ্ণলতার মহিমা দেখে, আর ভাবছে তাই তো!

আশ্চর্য! আশ্চর্য! কী হাস্যকর ছেলেমানুষটিই করে এসেছে এতদিন সুবর্ণ। R\OO

এই তুচ্ছ সংসারের বিরূপতা আর প্রসন্নতার মধ্যে নিজের মূল্য খুঁজে এসেছে! হিসেব কষেছে লাভ আর ক্ষতির!

অথচ সুবৰ্ণলতার নিজের মুঠোর মধ্যে রয়েছে রাজার ঐশ্বৰ্য্য!

সুবৰ্ণলতার ওই হলুদ পোচফোঁড়নের সংসারখানা নিক না যার খুশি, নিয়ে বরং রেহাই দিক সুবৰ্ণলতাকে। সুবৰ্ণলতার জন্যে থাক এক অনির্বচনীয় মাধুৰ্যলোক।

কী আনন্দ!

কী অনাস্বাদিত সুখস্বাদ!

সুবৰ্ণলতার জীবনখাতার এই অধ্যায়খানি যেন জ্যোতির কণা দিয়ে লেখা।

সুবৰ্ণলতা রান্নাঘরে এসে বলে, ও বড়বৌমা, বল বাছা কী কুটনো হবে? কুটি বসে।

বড়বৌমা শাশুড়ীর এই আলো-ঝলসানো মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে অবাক হয়। তবে প্রকাশ করে না সে বিস্ময়। নরম গলায় বলে, আমি আবার কি বলবো? আপনার যা ইচ্ছে—

বাঃ, তা কেন? তুমি রাধবে— তোমার মনের মত রান্নাটি হওয়াই তো ভাল। বলে। বঁটিটা টেনে নেয়। সুবর্ণ।

আবার হয়তো বা একথাও বলে, তোমরা তো রোজই খেটে সারা হচ্ছে বৌমা, আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কি রান্না হবে বল, আমি রাঁধি।

বৌরা বলে, আপনার শরীর খারাপ—

সুবৰ্ণ মিষ্টি হাসি হাসে, খারাপ আবার কি বাপু? খাচ্ছি।–দাচ্ছি, ঘুরছি ফিরছি! তোমাদের শাশুড়ী চালাক মেয়ে, বুঝলে? কাজের বেলাতেই তার শরীর খারাপ!

ওরা অবাক হয়।

ওরা শাশুড়ীর এমন মধুর মূর্তি দেখে নি এসে পর্যন্ত। ওরা ভাবে ব্যাপারটা কি?

সুবৰ্ণ ওদের বিস্ময়টা ধরতে পারে না, সুবৰ্ণ আর এক জগৎ থেকে আহরণ করা আলোর কণিকা মুঠো মুঠো ছড়ায়।

ভানু মাছের মুড়ো দিয়ে ছোলার ডাল ভালবাসে, তাই বরং হোক আজ। কানুটা বড়া দিয়ে মোচার ঘণ্টর ভক্ত, হয় নি। অনেকদিন, দুটো ডাল ভিজোও তো মেজবৌমা! … ওগো আজ মোচা এনো তো।

বাজার করার তারা প্ৰবোধের।

এই মহান কর্মভার অবশ্য সে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছে। ছেলেরা চক্ষুলজ্জার দায়ে কখনো কখনো বলে বটে, আমাদের বললেই পারেন! নিজে এত কষ্ট করার কি দরকার! তবে সে কথা গায়ে মাঝে না প্রবোধ।

কিন্তু সেই বাজার-বেলায় সুবৰ্ণলতা তাকে ডেকে হেঁকে বিশেষ কোনো জিনিস আনতে হুকুম দিয়েছে, এ ঘটনা প্রায় অভূতপূর্ব অন্তত বহুকালের মধ্যে মনে পড়ে না।

বোধ করি ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছোট, তখন তাদের প্রয়োজনে বিস্কুট কি লজেন্স, বার্লি কি মুলু যুদ্ধ ইত্যাদির অর্ডার দিতে এসেছে বেরোবার মুখে। কিন্তু মুখের রেখায় এই যে আহ্লাদের জ্যোতি।

এ বস্তু কি দেখা গিয়েছে কোনোদিন?

দেখা যেত—ওই আলোর আভা দেখা যেত কখনো কখনো সুবর্ণর মুখে, কিন্তু সে আভা আগুন হয়ে প্ৰবোধের গাত্ৰদাহ ঘটাতো।

স্বদেশী হুজুগের সময় যখনই কোনো বিদঘুটে খবর বেরোতো, তখনই সুবর্ণর মুখে আলো জুলতো। আলো জুলতো যখন নতুন কোনো বই হাতে পেত—আলো জুলতো যখন বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে একত্রে বসিয়ে পাঠশালা পাঠশালা খেলা ফেঁদে তার স্বরে তাদের দিয়ে পদ্য মুখস্থ করাতো—আলো জুলতো যদি কেউ কোনখান থেকে বেড়িয়ে বা তীৰ্থ করে এসে গল্প জুড়তো।

তা ছাড়া আর এক ধরনের আলো আর আবেগ ফুটে উঠেছিল সুবৰ্ণলতার মুখে, ইংরেজ-জার্মান যুদ্ধের সময়। সে এক ধরন। যেন সুবৰ্ণলতারই জীবনমরণ নিয়ে যুদ্ধ হচ্ছে! দেশের রাজা বৃটিশ, অথচ সুবৰ্ণর ইচ্ছে জার্মানরা জিতুক। তাই তর্ক, উত্তেজনা, রাগোরাগি। মেয়েমানুষ, তাও রোজ খবরের কাগজ না হলে ভাত হজম হবে না!

তা সে প্রকৃতিটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে।

এই তো ইদানীং আবার যে স্বরাজ-স্বরাজ হুজুগ উঠেছে, তাতে তো কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। বরং যেন অগ্রাহ্য। বলে, অহিংসা করে শক্ৰ তাড়ানো যাবে এ আমার বিশ্বাস হয় না।… বলে, দেশসুদ্ধ লোক বসে বসে। চরকা কাটলে স্বরাজ আসবে? তাহলে আর পৃথিবীতে আদি-অন্তকাল এত অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতো না। উত্তেজিত হয়ে তর্কটা করে না, শুধু বলে।

শক্তি-সামৰ্থ্যটা কমে গেছে, ঝিমিয়ে গেছে।

তাই মুখের সেই ঔজ্জ্বল্যাটাও বিদায় নিয়েছিল। বিশেষ করে সেই অদেখা মায়ের, আর চকিতে দেখা বাপের মৃত্যুশোকের পর থেকে তো—

হঠাৎ যেন সেই ঝিমিয়ে পড়া ভাবটার খোলস ছেড়ে আবার নতুন হয়ে ওঠার মত দেখাচ্ছে সুবৰ্ণকে।

কেন?

মাথার দোষ-টোষ হচ্ছে না তো?

পাগলরাই তো কখনো হাসে কখনো কাঁদে।

তা যাক, এখন যখন হাসছে, তাতেই কৃতাৰ্থ হওয়া ভালো।

তাৰ্থই হয় প্ৰবোধ।

গলিত গলায় বলে, মোচা? মোচা আনা মানেই তোমার খাটুনি গো, ও কি আর বৌমারা বাগিয়ে কুটিতে-ফুটিতে পারবেন?

সুবৰ্ণ বলে, শোনো কথা! সব করছে ওরা। কিসে হারছে? তবে আমারই ইচ্ছে হয়েছে, রান্নাবান্না ভুলে যাব শেষটা?

কৃতাৰ্থমন্য প্ৰবোধ ভাবতে ভাবতে বাজার ছোটে, আহা, এমন দিনটি কি চিরদিন থাকে না?

এই জীবনটাই তো কাম্য!

গিনী ফাইফরমাস করবে, এটা আনো ওটা আনো বলবে, কর্তা সেইসব বরাতি বস্তু এনে সাতবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাবে, বাহবা নেবে, গিন্নী গুছিয়ে-গাছিয়ে রাধবে বাড়বে, বেলা গড়িয়ে পরিপাটি করে খাওয়া-দাওয়া হবে, আর অবসরকালে কর্তা-গিনী পানের বাটা নিয়ে বসে ছেলে বৌ বেয়াই বেয়ানের নিন্দাবাদ করবে, এযুগের ফ্যাশান নিয়ে সমালোচনা করবে—এই তো এই বয়সের সংসারের ছবি!! প্ৰবোধের সমসাময়িক বন্ধুবান্ধবরা তো এই ধরনের সুখেই নিমগ্ন।

প্ৰবোধের ভাগ্যেই ব্যতিক্রম। এই সামান্য সাধারণ সুখটুকুও ইহজীবনে জুটলো না।

গিনী যেন সিংহবাহিনী।

তাসের আড্ডাটা যাই আছে প্ৰবোধের, তাই টিকে আছে বেচারা।

তা এতদিনে কি ভগবান মুখ তুলে চাইছেন?

পাগল-ছাগল হয়ে সহজ হয়ে যাচ্ছে সুবৰ্ণ?

নাকি এতদিনে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে?

তা সে যে কারণে যাই হোক, সুবৰ্ণ যে সহজ প্ৰসন্নমুখে ডেকে বলেছে, ওগো বাজার যোচ্ছ, মোচা এনো তো—এই পরম সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে বাজারে যায় প্ৰবোধ, আর প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাছ-তরকারি এনে জড়ো করে।

সুবৰ্ণ তখন হয়তো অনুমান করতে চেষ্টা করছে, তার ওই খাতাটা ছাপতে কতদিন লাগতে পারে, কতদিন লোগা সম্ভব! ধারণা অবশ্য নেই কিছুই, তবু কতই আর হবে? বড় জোর মাস দুই, কমও হতে পারে। তারপর

আচ্ছা, জগু-বটুঠাকুর আমার নামটা জানেন তো? কে জানে! কিন্তু জানবেই বা কোথা থেকে? কবে আর কে আমার নাম উচ্চারণ করেছে। ওঁর সামনে?

তাহলে?

বিনা নামেই বই ছাপা হবে?

নাকি মামীমার কাছ থেকে জেনে নেবেন। উনি?

তা মামীমাই কি ঠিক জানেন?

মেজবৌমা ডাকটাতেই তো অভ্যস্ত।

হঠাৎ নিজ মনে হেসে ওঠে সুবৰ্ণলতা।

কী আশ্চর্য! খাতাটার প্রথম পৃষ্ঠাতেই তো তার নাম রয়েছে। যে হাতের লেখার প্রশংসা করেছেন জগু-বটুঠাকুর, সেই হাতের লেখাঁটিকে আরো সুছোদ সুন্দর করে ধরে ধরে নামটি লেখে নি। একবার সুবৰ্ণ?

হ্যাঁ, পরম যত্নে পরম সোহাগে কলমটিকে ধরে ধরে লিখে রেখেছিল সুবর্ণ—শ্ৰীমতী সুবৰ্ণলতা

সেই লেখা চোখ এড়িয়ে যাবে?

এড়িয়ে যাবে না।

চোখ এড়িয়ে যাবে না।

নামতা মুখস্থ করার মত বার বার মনে মনে এই কথা উচ্চারণ করতে থাকে সুবর্ণ, চোখ এড়িয়ে যাবে না। বইয়ের উপর লেখা থাকবে শ্ৰীমতী সুবৰ্ণলতা দেবী!

সুবৰ্ণলতার মা জেনে গেল না এ খবর!

এত আনন্দের মধ্যেও সেই বিষণ্ণ বিষাদের সুর যেন একটা অস্পষ্ট মূৰ্ছনায় আচ্ছন্ন করে রাখে।

মা থাকতে এই পরম আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটলে, মাকে অন্তত একখণ্ড বই পার্শেল করে পাঠিয়ে দুড় মুকু বাড়ির কাউকে দিয়ে অবশ্য, মামীমাকে দিয়ে এই জণ্ড বইঠাকুরকে বলেই করিয়ে দিতো কাজটা।

মা প্রথমটায় পার্শেল পেয়ে হকচাকিয়ে যেত, ভাবতো, কী এ? তারপর বাঁধন খুলে দেখতো। দেখতো! দেখতো বইয়ের লেখিকা শ্ৰীমতী সুবৰ্ণলতা দেবী!

তারপর?

তারপর কি মার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তো না?

সুবৰ্ণলতার মনটা যেন ইহলোক পরলোকের প্রাচীর ভেঙে দিতে চায়। যেন তার সেই অদেখা বইটা সেই ভাঙা প্রাচীরের ওধারে নিয়ে গিয়ে ধরে দিতে চায়! সুবৰ্ণ দেখতে পায়, সুবর্ণর মা সুবর্ণর স্মৃতিকথা পড়ছেন।

পড়ার পর?

শুধুই কি সেই দু ফোঁটা আনন্দাশ্রুই ঝরে পড়ে শুকিয়ে যাবে? সেই শুকনো রেখার উপর দিয়ে ঝরণাধারার মত ঝড়ে পড়বে না। আরো অজস্র ফোঁটা? দেখতে পাচ্ছেন, কীভাবে কাটাবনের উপর দিয়ে রক্তাক্ত হতে হতে জীবনে এতটা পথ পার হয়ে এসেছে সুবর্ণ।

মা বুঝতে পারছেন সুবর্ণ অসার নয়।

কোন কোন অংশটা পড়তে পড়তে মা বিচলিত হতেন, আর কোন কোন অংশটা পড়ে বিগলিত, ভাবতে চেষ্টা করে সুবর্ণ।

নিজের হাতের সেই লেখাগুলো যেন দৃশ্য হয়ে ভেসে ওঠে।

পর পর নয়, এলোমেলো।

যেন দৃশ্যগুলো হুড়োহুড়ি করে সামনে আসতে চায়। যেন এক প্যাকেট তাসকে কে ছড়িয়ে দিয়েছে।

অনেক বয়সের অনেকগুলো সুবর্ণ ছড়িয়ে পড়ে সেই অসংখ্য র মধ্যে। মাথায় খাটো, পায়ে মল, একগালা-ঘোমটা বালিকা সুবৰ্ণ, হঠাৎ লম্বা হয়ে যাওয়া সদ্য রী সুবর্ণ, নতুন মা হয়ে ওঠা আবেশবিহ্বল সুবৰ্ণ, তারপর

আচ্ছা, ওই ঘোমটা দেওয়া ছোট মাপের সুবৰ্ণর ঘোমটাটা হঠাৎ খুলে গেল যে!

কি বলছে ও?

কী বলছে, সে কথা শুনতে পাচ্ছে সুবৰ্ণলতা!

তাড়িয়ে দিলে? তোমরা আমার বাবাকে তাড়িয়ে দিলে? আমাকে নিয়ে যেতে দিলে না? কেন? কেন? কী করেছি। আমি তোমাদের, তাই এত কষ্ট দেবে আমাকে. কে বলেছিল আমাকে তোমাদের বৌ করতে? শুধু শুধু ঠকিয়ে ঠকিয়ে বিয়ে দিয়ে…চলে যাব, আমি তোমাদের বাড়ি থেকে চলে যাব-তোমাদের মতন নিষ্ঠুরদের বাড়িতে থাকলে মরে যাব আমি।

সুবৰ্ণলতা অন্য আর এক গলার উচ্চ নিনাদও শুনতে পাচ্ছে, ওর নিজের কলমের অক্ষরগুলোই যেন সশব্দ হয়ে ফেটে পড়ছে, ওমা, আমি কোথায় যাব! এ কী কালকেউটের ছানা ঘরে আনলাম গো আমি! চলে যাবি? দেখা না একবার চলে গিয়ে! খুন্তি নেই আমার? পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছ্যাকা দিতে জানি না?… বাপকে তাড়িয়ে দিলে! দেব না তো কি, ওই বাপের সঙ্গে নাচতে নাচতে যেতে দেব তোকে?…সইমা আমার পূর্বজন্মের শত্রু ছিল, তাই তোকে আমার গলায় গছিয়ে পরকাল খেয়েছে আমার। আর ওমুখো হতে দিচ্ছি না তোকে… ইহজীবনে কেমন আর বাপের বাড়ির নাম মুখে আনিস, দেখবো! বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তোর যদি না ঘোচাই তো আমি মুক্তবামনী নই! বাপ চলে যাচ্ছে বলে ঘোমটা খুলে রাস্তায় ছুটে আসা বার করছি।

সেই ঘোমটা খোলা, বালিকা সুবৰ্ণকে টেনেহিঁচড়ে ঘরে এনে পুরে শেকল তুলে দিয়ে গেল ওরা, বলে গেল, মুখ থেকে আর টু শব্দ বার করবি না!

সুবৰ্ণ স্তব্ধ হয়ে গেল।

এই অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতায় যেন নিথর হয়ে গেল।…তবু তখনো সত্যি বিশ্বাস হয় নি তার, সেই নিষ্ঠুরতার কারাগারেই চিরদিনের মত থাকতে হবে তাকে।… মনে করছিল, কোনমতে একবার এদের কবল থেকে পালিয়ে যেতে পারলেই সব সোজা হয়ে যাবে।

তাই পালাবার মতলবই ভেজেছিল বসে বসে!

রাস্তা চেনে না? তাতে কি? রাস্তায় বেরোলেই রাস্তা চেনা যায়। রাস্তায় লোককে জিজ্ঞেস করলেই হবে।… সুবৰ্ণদের বাড়িটা রাস্তার লোক যদি না চেনে তো সুবর্ণ তার ইস্কুলটার নাম করবে। ইস্কুলটাকে নিশ্চয়ই সবাই চেনে, বেথুন ইস্কুল তো নামকরা জায়গা।… হে ঠাকুর, একবার সুবৰ্ণকে সুযোগ দাও পালিয়ে যাবার!… সুবর্ণ রাস্তার লোককে জিজ্ঞেস করে করে একবার ইস্কুলে গিয়ে পৌঁছে যাক। তারপর আর বাড়ি চেনা আটকায় কে?… রোজ যেমন করে চলে যেতো তেমনি করেই চলে যাবে।

চলে গিয়ে?

চলে গিয়ে বাবাকে বলবে, দেখলে তো বাবা, তুমি আনতে পারলে না, আমি নিজে নিজেই চলে এলাম! আর মাকে বলবে, মা! মা কোথায়? এরা তো কেবলই বলে তার মা চলে গেছে! কোথায় চলে গেছে মা? এতদিনেও আসে নি? ঠিক আছে, সুবর্ণ গিয়ে পড়ে দেখবে কেমন না আসে মা? দাদার বিয়ে হবে, কত মজা, আর কত কাজ মার, কোথায় গিয়ে বসে থাকবে শুনি?…

ইস্ ভগবান, একবার এদের বাড়ির লোকগুলোর দৃষ্টি হরে নাও, সুবৰ্ণকে পালাতে দাও। কে জানে সুবর্ণর দাদার বিয়ের সময়েও হয়তো যেতে দেবে না। এরা সুবৰ্ণকে।

আচ্ছা, ইস্কুলের মেয়েরা যদি জিজ্ঞেস করে, এতদিন আসিস নি কেন? যদি সুবর্ণর মাথায় সিঁদুর দেখে হেসে উঠে বলে, এ মা, তোর বিয়ে হয়ে গেছে! কী উত্তর দেব?

বলব কি-আমার ঠাকুমা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে? … নাঃ, সে কথা শুনলে ওরা আরো হাসবে!… তার চাইতে সিঁদুরটা আচ্ছা করে মুছে নেব রাস্তায় বেরিয়ে। রাস্তার কলে ধুয়ে ঘষে সাদা করে ফেলবো। ও-বাড়ির দিদি-জায়াবতীদিদি, ওকেই শুধু বলে যাব আমি চলে যাচ্ছি! ও আমায় যা ভালবাসে, ঠিক মুক্তারামবাবুর স্ত্রীটে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবে! ওর শ্বশুরবাড়ি এমন বিচ্ছিরি নয়, ও কত বাপের বাড়ি যায়!

পালাবো পালাবো। এই ছিল ধ্যান-জ্ঞান।

কিন্তু পালাতে পারে নি। সুবর্ণ। জীবনভোর পারল না … দেখেছে পালানোটাকে যত সোজা ভেবেছিল তত কঠিন।

একাদণ্ডের জন্যে পাহারা সরায় না এরা।

ক্রমশই তাই বেথুন ইস্কুল, ঠনঠনে কালীতলা, মুক্তারামবাবু স্ত্রীট, আঠারোহাত কালীর মন্দির, সব কিছুই ঝাপূসা হয়ে যাচ্ছে… স্পষ্ট আর প্রখর হয়ে উঠছে সিঁথির ওই সিঁদুরটা। ওটাকে ঘষে ঘষে মুছে ফেলার কথা যেন অবাস্তব মনে হচ্ছে।… সেই তার নিজের জীবনে, সত্যিকার জীবনে যে আর ফিরে যাওয়া যাবে না, সেটা যেন স্থিরীকৃত হয়ে যাচ্ছে।

সুবৰ্ণর বই খাতা স্লেট পেন্সিল সব যে তাদের কুলুঙ্গিটার মধ্যে পড়ে রইল, সেকথা তো কেউ ভাবলো না? সামনেই যে সুবর্ণর হাফ-ইয়ারলি একজামিন, সে কথা মারও তো কই মনে পড়ল না?

সুবৰ্ণর সমস্ত প্ৰাণটা যেন ওই কুলুঙ্গিটার উপর আছড়ে পড়তে যায়।

এতদিন না পড়ে পড়ে সুবৰ্ণ যে সব ভুলে যাচ্ছে!

ভগবান, সুবর্ণ তোমার কাছে কি দোষ করেছিল যে এত কষ্ট দিচ্ছ তাকে? রোজসকালে ঘুম থেকে উঠে কি তোমাকে নমস্কার করে নি? রোজ ইস্কুলে গিয়ে প্রার্থনা করে নি… রাত্তিরে শুতে যাবার সময় কি বলে নি, ঠাকুর, বিদ্যে দিও, বুদ্ধি দিও, সুমতি দিও!

যা যা শিখিয়েছিল মা, সবই তো করেছে সুবর্ণ, তবে কেন এত শাস্তি দিচ্ছ সুবৰ্ণকে?

কেন? কেন? কেন?

ওই কেনর ঝড় থেকে বালিকা সুবৰ্ণ হারিয়ে যাচ্ছে, তার খোলস থেকে যুবতী জন্ম নিচ্ছে, তবু সেই কেনটাই ধূসর হয়ে যাচ্ছে না। সে যেন আরো তীব্র হয়ে উঠছে।

আমি কি এত পাজী হতে চাই?… আমি কি গুরুজনদের মুখের উপর চোপা করতে ভালবাসি? আমি কি বুঝতে পারি না, আমি চোপা করি বলেই আমার ওপর আক্রোশ করেই ওরা আমাকে আরো বেশি বেশি কষ্ট দেয়?

কিন্তু কি করবো?

এত নিষ্ঠুরতা আমি সহ্য করতে পারি না, সহ্য করতে পারি না। এত অসভ্যতা। আমার ওই বর, ও কেন এত বিচ্ছিরি! এর থেকে ও যদি খুব কালো আর কুচ্ছিত দেখতে হতো, তাও আমার ছিল ভালো। কিন্তু তা হয়নি। ওর বাইরের চেহারাটা দিব্যি সুন্দর, অথচ মনের ভেতরটা কালো কুচ্ছিত বিচ্ছিরি … ও মিছিমিছি। করে আমাকে বলেছিল, লুকিয়ে আমাকে আমার বাপের বাড়ি নিয়ে যাবে। সেই কথা বিশ্বাস করে ওকে ভালবেসেছিলাম আমি, ভক্তি করেছিলাম, ওর সব কথা রেখেছিলাম।–খারাপ বিচ্ছিরি সব কথা! —কিন্তু ওর কথা ও রাখে নি। রোজ ভুলিয়ে ভুলিয়ে শেষ অবধি একদিন হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হেসে বলেছিল, ও বাবা, একবার গিয়ে পড়লে কি আর তুমি আসতে চাইবে! নিৰ্ঘাত সেখানে থেকে যাবে। এমন পরীর মতন বৌটি আমি হারাতে চাই না বাবা!

কত দিব্যি গাললাম যে আবার ফিরে আসবো, তবু বিশ্বাস করল না।

ও আমায় বিশ্বাস করে না, আমিও ওকে বিশ্বাস করি না। ও নাকি আমায় ভালবাসে, বলে তো তাই সব সময়, কিন্তু ভগবান, আমার অপরাধ নিও না, আমি ওকে ভালবাসি না। ওকে ভালবাসা আমার পক্ষে অসম্ভব। ওর সঙ্গে একবিন্দু মিল নেই আমার।

তবু চিরদিন ওর সঙ্গে ঘর করতে হবে। আমায়?

 

…আজ আবার সেই হলো!

আজ আবার ওরা ছোড়দাকে তাড়িয়ে দিল।

আমার সঙ্গে দেখা করতে দিল না।

দাদার বিয়েতে নাকি ঘটা করে নি। বাবা, মা চলে গেল বলে। নমো নমো করে সেরেছে। দাদার মেয়ের মুখেভাতে। একটু ঘটা করবে। তাই ছোড়দা আমায় নিতে এসেছিল। বাবা নাকি অনেক মিনতি করে চিঠি লিখে দিয়েছিল ওর হাতে। ওরা সে চিঠি ছিঁড়ে ফেলেছে, ছোড়দাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দেয় নি।

বলেছে, ছেলের বিয়ে শুনলাম না, নাতনীর ভাত! এমন উনচুটে বাড়িতে আমাদের ঘরের বৌ যাবে না।

ছোড়দা নাকি ভয় করে নি, ছোড়দা নাকি এ বাড়ির সেজ ছেলের মুখের ওপর চোটপাট শুনিয়ে দিয়ে গেছে। নাকি বলেছে, আপনাদের মত লোকের জেল হওয়া উচিত।

এ বাড়ির সেজ ছেলে সেই অপমান সহ্য করবে?

উল্টো অপমান করবে না? করবে না। গালমন্দ?

তবু তো এ বাড়ির মেজ ছেলে তখন বাড়ি ছিল না, থাকলে ছোড়দার কপালে আরো কি ঘটতো কে জানে!

বাড়ি ফিরে শুনে তো অদৃশ্য লোকটাকেই এই মারে তো সেই মারে! বলে, কি, শুধু চলে যেতে বললি? ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে পারলি না শালাকে?

আমি যখন রাগে ঘেন্নায় কথা বলি নি ওর সঙ্গে, তখন হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হেসে বললো, শালাকে শালা বলবো না তো বেয়াই বলবো? হ্যাঁ, আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তোমার ভাইদের মান আছে, আমার ভাইদের মান নেই?

সেই শুনে এমনি হাসি হেসেছিল ও, আমি কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর সবাইকে ডেকে বুলেছিল, আরে গুনছ, শলাকে নাকি সমান করা উচিত ছিল আমার! পাদ্য-অৰ্ঘ্য দেওয়া উচিত ছিল!

ঠিক আছে, ভগবান যখন আমাকে এই নিষ্ঠুর আর অসভ্যদের কাছেই রেখে দিয়েছে, তখন তাই থাকবো। আর যেতে চাইব না। এ বাড়ির বাইরে। ভুলে যাব আমারও মা ছিল, বাপ ছিল, ভাই ছিল, বাড়ি ছিল। ওদের বাড়ি থেকে বেরোবো একেবারে নিমতলাঘাটের উদ্দেশে।

তাই—তাই হোক।

মরেই দেখিয়ে দেব, আটকে রাখবে বললেই আটকে রাখা যায় না!

কিন্তু শুধু কি এইসব কথাই লিখেছে সুবর্ণ তার স্মৃতিকথায়?

সুবৰ্ণ যেন ছাপাখানায় পাঠিয়ে দেওয়া খাতাখানার পাতাগুলোর মধ্যে ড়ুবে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে।…

সুবৰ্ণ দেখতে পাচ্ছে, সিঁড়ির ঘুলঘুলি থেকে বেরিয়ে আসছে একটা বই, তার সঙ্গে মিষ্টি একটু কথা। মানুষটাকে দেখা যায় না, শোনা যায় শুধু কথা। হাসি-হাসি গলার ঝঙ্কার।

এই নে, বইটা আর তোকে ফেরত দিতে হবে না! তুই পদ্য পড়তে ভালবাসিস শুনে তোর ভাসুর তো মোহিত। বলেছে, এটা তুমি উপহার দিও বন্ধুকে।

পৃথিবীতে এই মানুষও আছে ভগবান!

তবে তোমার উপর রাগ করে কি করবো?

আমার ভাগ্য! এ ছাড়া বলার কিছু নেই।

কিন্তু কী বই দিল জয়াদি?

এ কী জিনিস!

মানুষ এমন লিখতে পারে?

এ যে চেঁচিয়ে পড়বার, লোককে ডেকে শোনাবার!

এ কি সেই কবির কথা? না আমার কথা?

এ যে আমি মনে মনে পড়ে মনের মধ্যে ধরে রাখতে পারছি না গো–

আজি এ প্ৰভাতে রবির কর,
কেমনে পশিল প্ৰাণের ’পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাত-পাখীর গান।
না জানি কেমনে এতদিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্ৰাণ।

এর কোন লাইনটাকে বেশি ভাল বলবো। আমি, কোন লাইনটাকে নয়?

জাগিয়া উঠিছে প্ৰাণ,
ওরে উথলি উঠিছে বারি।
প্ৰাণের বাসনা প্ৰাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।
থর থর করি কাঁপিছে ভুধর—

এ পদ্য আমি সবটা মুখস্থ করবো।

আমি ওদের সংসারের জ্বালায় আর কষ্টবোধ করবো না। ওরা যা চায়। তাই করে দিয়ে নিজের মনে এই বই নিয়ে বসবো। আরো যে সব পদ্য আছে, সব শিখে ফেলবো।

জয়াদি দেবী, তাই এই স্বর্গের স্বাদ এনে দিল আমায়। জয়াদির স্বামী দেবতা, তাই তাঁর মনে পড়েছে। আমি পদ্য ভালবাসি। ভগবান, ওঁদের বাঁচিয়ে রাখো, সুখে রাখো।

আজি এ প্ৰভাতে রবির কর,
কেমনে পশিল প্ৰাণের ’পর—

এর সব কথা আমার, সব কথা আমার জন্যে লেখা!

কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন
চারিদিকে তাঁর বাঁধন কেন?
ভাঙা রে হৃদয় ভাঙা রে বাঁধন…
সাধ রে আজিকে প্ৰাণের সাধন—

উঃ, কী চমৎকার, কী অপূর্ব! আমি কি করবো!

স্বৰ্গ বলে কি সত্যিই কোন রাজ্যপাট আছে? সত্যিই মাটি থেকে অনেক উঁচু তে মেঘেরও ওপরে সেই জগৎ, সেখানে দুঃখ নেই, শোক নেই, অভাব নেই, নিরাশ নেই, খলতা-কপটতা নেই, এক কথায় বলতে গেলে এই পৃথিবীর ধুলো-ময়লার কোন কিছুই নেই!

নাকি ওটা শুধুই কবিকল্পনা? আমাদের এই মনের মধ্যেই স্বৰ্গ, মর্ত্য, পাতাল! এই মনের অনুভব ই পৃথিবীর ধুলোমাটি থেকে অনেক উঁচু তে, মনের যত মেঘ তারও ওপরে উঠে গিয়ে স্বৰ্গরাজ্যে পৌঁছয়?

কে জানে কি! আমার তো মনে হয়, শেষের কথাটাই বুঝি ঠিক। আর উঁচু দরের কবিরা পারেন। সেই অনুভবের উঁচু  স্বর্গে নিয়ে যেতে। সেখানে গিয়ে পৌঁছলে মনেই পড়ে না পৃথিবীতে দুঃখ আছে, জ্বালা আছে, ধুলো-ময়লা আছে।

শুধু আনন্দ, শুধু আনন্দ!

চোখে জল এসে যাওয়া অন্য এক রকমের আনন্দ!

কিন্তু মানুষকে কেন নিয়ে যেতে পারেন না কবিরা? পারেন না বলেই না সেই আনন্দের দেশ থেকে হঠাৎ আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়তে হয়!

অন্তত সেদিনের সেই সংসারবুদ্ধিহীনা বালিকা সুবৰ্ণলতা তাই পড়েছিল। সেই আছাড় খাওয়ার দুঃখে তার বিশ্বাসের মূল যেন আলগা হয়ে গিয়েছিল। মানুষের ওপর বিশ্বাস, ভাগ্যের ওপর বিশ্বাস, ভগবানের ওপর বিশ্বাস। সব বিশ্বাস বুঝি শিথিল হয়ে গেল।

সুবৰ্ণর স্বামী রূঢ় রুক্ষ, সুবৰ্ণ জানে সে কথা, কিন্তু সে যে এত বেশী নীরেট নির্বোধ, এত বেশি ক্রুর, সে কথা বুঝি জানতো না তখনো।

জানলো, আছাড় খেয়ে জানলো।

এই বহুদূরে এসে সেই সংসারবুদ্ধিহীন আবেগপ্রবণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে করুণা হয় সুবর্ণর, ওর আশাভঙ্গের আর বিশ্বাসভঙ্গের দুঃখে চোখে জল আসে। মেয়েটা যে একদার আমি, ভেবে ভেবেও মনে আনতে পারে না।

কিন্তু এই আমিটার মত এত ভয়ঙ্কর পরিবর্তনশীল আর কি আছে? আমিতে আমি-তে কী অমিল!

তবু তাকে আমরা আমিই বলি—

অবোধ সুবৰ্ণও ভেবেছিল, এই আনন্দের স্বাদ ওকেও বোঝাই। আমার স্বামীকে। তখনো তার ওপর আশা সুবর্ণর!

আশা করেছিল ওরও হয়তো মনের দরজা খুলে যাবে! তাই বলেছিল, তোমার খালি শুয়ে পড়া যাক, শুয়ে পড়া যাক। বোসো তো একটু, শোনো। কী চমৎকার!

হ্যাঁ, প্ৰদীপটা উস্কে দিয়েছিল, সুবর্ণ তার সামনে ঝুঁকে পড়ে পড়েছিল—

হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি,
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি,
ধরায় আছে যত মানুষ শত শত,
আসিছে প্ৰাণে মম, হাসিছে গলাগলি।

ও সেই সুবৰ্ণকে থামিয়ে দিলো, বেজার গলায় বললো, জগৎসুদ্ধ সবাই এসে কোলাকুলি করছে? তাই এত ভাল লাগছে? বাঃ বাঃ, বেড়ে চিন্তাটি তো! শত শত মানুষ এসে প্ৰাণে পড়ছে? তোফা! এমন রসের কবিতাটি লিখেছেন কোন মহাজন?

সুবৰ্ণ বলল, আঃ, থামো না! শেষ অবধি শুনলে বুঝবে-

আবার পড়তে শুরু করে। পড়ছে, —হঠাৎ ও ফস করে বইটা কেড়ে নিল, বলে উঠলো, তোফা তোফা! এ যে দেখছি রসের সাগর! কি বললে, এসেছে সখাসখি, বসেছে চোখাচৌখি? আর যেন কি, দাঁড়িয়ে মুখোমুখি।? বলি এসব মাল আমদানি হচ্ছে কোথা থেকে?… ব্যঙ্গের সুর গেল, ধমক দিয়ে উঠলো, কোথা থেকে এল এ বই?

চোখে জল এসে গেল মেয়েটার, সেটা দেখতে দেবে না, তাই কথার উত্তর দেয় না।

ও বইটা নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখল। তারপর সাপের মত হিসহিসিয়ে বলে উঠলো, এই যে প্ৰমাণ-পত্তর তো হাতেই। প্ৰাণাধিক ভগিনী শ্ৰীমতী সুবৰ্ণলতা দেবীকে মেহোপহার—, বলি এই প্ৰাণাধিক ভ্ৰাতাটি কে? কোথা থেকে জোটানো হয়েছে। এটিকে?

লেখাটা যে মেয়েমানুষের হাতের, তা কি ও বুঝতে পারে নি। নিশ্চয় পেরেছিল। সত্যি বেটা ছেলে ভাবলে বইটাকে কি আস্ত রাখতো? কুচি কুচি করে ছিঁড়তো, পা দিয়ে মাড়াতো! এ শুধু সুবৰ্ণকে চারটি বিচ্ছিরি-বিচ্ছিরি কথা বলে নেবে বলেই ছল করে–

চোখ দিয়ে খুব জল আসছিল, তবু সুবৰ্ণ জোর করে চোখটা শুকনো রেখেছিল, শক্ত গলায় বলেছিল, দেখতে পাচ্ছে না মেয়েমানুষের হাতের লেখা? ও-বাড়ির জয়াদি দিয়েছেন!

ওর মুখটা শক্ত হয়ে উঠলো, ও-বাড়ির জয়াদি মানে? জয়াদিটি কে?

জানো না, তোমাদের নতুনদার বৌ! জয়াবতী দেবী।

বটে! নতুনদার বৌ! বলি তিনি কি আসা-যাওয়া করছেন নাকি? আশ্চর্য বেহায়া মানুষ তো! এদিকে জোর তলবে মামলা চলছে, আর ওদিকে তিনি প্ৰাণাধিক ভগিনীকে স্নেহ-উপহার ঘুষ দিতে আসছেন!

আমি সুবৰ্ণলতা দেবী রেগে গিয়েছিলাম।

আমি বলেছিলাম, মামলা ওরা করে নি, তোমরাই করেছি। জানতে বাকি নেই আমার! আর ভালবাসা জিনিসটা জানো না বলেই ঘুষ বলতে ইচ্ছে করছে তোমার!

ভালবাসা! ওঃ! বইখানা পাকিয়ে মোচড় দিতে দিতে বললো, তুমি যে জিনিসটা খুব জানো তা আর আমারও জানতে বাকি নেই। যারা আমাদের শক্ৰপক্ষ, উনি ঘর-জ্বালানে পর-ভোলানে মেয়ে যাচ্ছেন তাদের সঙ্গে ভালবাসা জমাতো মাকে বলে দিতে হচ্ছে, ও-বাড়ি থেকে লোকের আসা বন্ধ করছি!

বলে বইটা নিয়ে নিল ও।

বললো, যাক, আর কাব্যিতে দরকার নেই! এমনিতেই তো সংসারে মন নেই! এসো দিকি এখন–

বলে প্ৰদীপটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ঘরটাকে অন্ধকার করে দিল ও।

কিন্তু শুধু কি ঘরটাই অন্ধকার করে দিল?

ন বছর বয়সে এদেব বাড়িতে এসেছিলাম, আর এই তেরো বছর পার করতে চললাম, অনবরত শুনছি। সংসারে মন নেই। শাশুড়ী বলেন, তাঁর ছেলে বলেন। দ্যাওররাও তো বলতে ছাড়ে না। কি জানি সংসার মন কাকে বলে! কাজকৰ্ম্ম সবই তো করি। আমার গায়ে জোর বেশি বলে তো বেশি বেশিই করি। আর কি করতে হয়! আমার ওই বড়জায়ের মত—সব সময়ে রান্নাঘরে ভাড়ারঘরে থাকতে পারি না, এই দোষ। তার আর কি করবো!

ও আমার ভাল লাগে না।

কিন্তু দিদিরই কি সত্যি ভাল লাগে? ওর ইচ্ছে করে না, দোতলায় উঠে আসে, নিজের ঘরে এসে বসে, মেয়েকে দেখে?

করে ইচ্ছে। বুঝতে পারি।

তবু দিদি সুখ্যাতির আশায় ওইরকম রাতদিন নিচের তলায় পড়ে থাকে। কি না লোকে বলবে, কী লক্ষ্মী বৌ! সংসারে কী মন?

আচ্ছা, কী লাভ তাতে?

ওই সব স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর লোকেদের মুখের একটু সুখ্যাতি পেয়ে লাভ কি? আর চিরকালই কি ওরা সুখ্যাতি করে? দিনের পর দিন ভাল হয়ে হয়ে আর খেটে খেটে যে সুনামটুকু হয়, তা তো একাদণ্ডেই মুছে যায়। দেখিনি কি? এত কন্না করে দিদি, একদিন দ্বাদশীতে ভোরবেলা উঠে এসে শাশুড়ীকে তেল মাখিয়ে দিতে দেরী করে ফেলেছিল বলে কী লাঞ্ছনাই খেলো! দ্বাদশীতে নাকি নিজে হাতে তেল মাখতে নেই। জানি না, এইসব এই করতে নেই। আর ওই করতে নেই-এর মালা কে গোথেছিল বসে বসে!

মাও বলতেন বটে করতে নেই।

সে আর কি বেলা অবধি ঘুমোতে নেই, ইস্কুলের মেয়েদের সঙ্গে ঝগড়া করতে নেই, বড়দের সামনে বেশি কথা বলতে নেই, গরীব মানুষকে তুচ্ছ করতে নেই, ভিখিরিদের তাড়িয়ে দিতে নেই— এইসবু! মিষ্টি করে বুঝিয়ে দিতেন মা সেসব।

তার তো তবু মানে আছে।

আর এদের বাড়িতে?

এদের বাড়িতে যে কী অনাছিষ্টি সব কথা! মানে নেই! শুধু করতে নেই সেটাই জানা!

আর বৌ-মানুষদের যে কত-ই নেই!

বৌ-মানুষের তেষ্টা পেতে নেই, খিদে পেতে নেই, ঘুম পেতে নেই, আবার হাসিও পেতে নেই! লক্ষ্মী বৌ নাম নিতে হলে কথাও বলতে নেই! এত সাধনার শেষ মূল্য অথচ শেষ পর্যন্ত ওর। একদিন একটু দোষ করে ফেললেই সেই ছুতোয় চিরদিনের সব নম্বর কাটা।

কী লাভ তবে ওই বৃথা কষ্টে?

আর ওই ভাল হওয়াটা তো মিথ্যে বানানো, বলতে গেলে একরকম ছলনা। হ্যাঁ, ছলনাই। আমি যত ভাল নই, ততটা ভাল দেখানো মানেই তো ছলনা। তবে তা দেখাবো কেন আমাকে?

ওসব মিথ্যে আমার ভাল লাগে না।

দিদি অবিশ্যি সত্যিই ভাল মেয়ে। তবু আরো দেখাতে চেষ্টা করে। তাই সেদিন শাশুড়ীর পায়ে ধরে আবার তেল মাখাবার অধিকার অর্জন করে নিয়েছিল।

ওই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে এত ঘটা দেখলে আমার হাসি পায়। দিদি কেঁদে মরছে দেখে হোসে মরছিলাম আমি। কিন্তু সেদিন!

যেদিন সেই স্বৰ্গ থেকে আছাড় খেয়ে পড়েছিলাম?

যেদিন নিশ্চিত জেনেছিলাম, আমার স্বামীর সঙ্গে কোনোদিনই মনের মিল হবে না। আমার? সেদিন কি হাসতে পেরেছিলাম? ওর বোকামি দেখে, ওর নীরোটত্ব দেখে? পারি নি। রাত্তিরে লুকিয়ে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছিলাম।

অবশ্য জীবনের এই দীর্ঘ পথ পার হয়ে এসে জেনেছি, মনের মিল শব্দটা একটা হাস্যকর অর্থহীন শব্দ।

ও হয় না।

মনের মিল হয় না, মনের মত হয় না!

নিজের রক্তে-মাংসে গড়া, নিজের আপ্রাণ চেষ্টায় গড়া সন্তান-তাই কি মনের মত হয়?

হয় না, হয় নি। আমার ছেলেমেয়েরা?

ওরা আমার অচেনা।

শুধু আমার শেষের দিকের তিনটে ছেলেমেয়ে, পারুল, বকুল আর সুবল, যাদের দিকে আমি কোনদিন ভাল করে তাকাই নি, যাদের গড়বার জন্যে বৃথা চেষ্টা করতে যাই নি, তারাই যেন মাঝে মাঝে আশার আলো দেখায়। মনে হয়। ওই দর্জিপাড়ার গলিতে বোধ হয়। ওদের শেকড় বসে নি, ওরা স্বতন্ত্র। ওরা নিজের মনে ভাবতে জানে।

তবু ওদের সঙ্গেই কি আমার পরিচয় আছে?

ওরা কি আমার অন্তরঙ্গ?

নাঃ, বরং মনে হয়, ওরা আমাকে এড়ায়, হয়তো বা—হয়তো বা আমাকে ঘেন্না করে।

আর ভয় তো করেই, আমাকে নয়, আমার আচরণকে। ওরা হয়তো আমাকে বুঝতে চেষ্টা করলে বুঝতে পারতো। কিন্তু তা করে নি।

ওরা অনেক দূরের।

তবু ওরা যে ওদের দাদা-দিদির মতন নয়, সেইটুকু আমার সান্ত্বনা আমার সুখ।

পারুর মুখে আমি মাঝে মাঝেই আর এক জগতের আলো দেখছি, পারু লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখে এ আমি বুঝতে পারতাম। কিন্তু পারুর জন্যে আমার দুঃখ হয়, পারুর জন্য আমার ভাবনা হয়। বড় বেশি অভিমানী ও। ওর ওই অভিমানের মূল্য কি এই সংসার দেবে? বুঝবে ওর স্বাৰ্থবুদ্ধিহীন কবিমনের মূল্য?

হয়তো আমার মতই যন্ত্রণা পাবে ও! অভিমানের জ্বালাতেই আমি জীর্ণ হলাম!

তবু আমি চিরদিনই প্রতিবাদ করেছি, চেঁচামেচি করেছি, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি।

ও তা করবে না।

ও ওর মায়ের মত অসভ্য হবে না, রূঢ় হবে না, সকলের অপ্রিয় হবে না! কারণ ও শান্ত, ও মৃদু, ও সভ্য। ও শুধু অভিমানীই নয়, আত্মাভিমানী। ও ওর প্রাপ্য পাওনা না পেলে নীরবে সে দাবি ত্যাগ করবে, ও অন্যায় দেখলে নিঃশব্দে নিজেকে নির্লিপ্ত করে নেবে। ও অপরকে ভালো করে তোলবার বৃথা চেষ্টা করবে না।

জানি না পারুকে যার হাতে তুলে দিয়েছি, সে পারুকে বুঝতে চেষ্টা করছে কিনা। ওকে বোঝা শক্ত; নিজের সম্পর্কে ওর ধারণা খুব উঁচু। ও আমার এই শেষদিকের অবহেলার মেয়ে। চাঁপাচন্ননের মত অত রূপও নেই, বিদুষী হবার সুযোগও পায় নি, তবু নিজেকে ও তুচ্ছ ভাবতে পারে না। ওর এই মনের দায় কে পোহাবে? হয়তো সেই দায় ওকে নিজেকেই পোহাতে হবে। আর সেই ভার পোহাতে পোহাতেই ওর সব সুখ-শান্তি যাবে। নিজেকে বইবার কষ্ট যে কী, সে তো আমি জানি! পারুকে আমরা রীতিমত সুপাত্রের হাতে দিতে পেরেছি।–এই আমার স্বামীর গর্ব। আরও দু জামাইয়ের থেকে অনেক বিদ্বান আর রোজগারী পারুর বির।

বিদ্বান আর রোজগারী, কুলীন আর বনেদী ঘর, এই তো সুপাত্রের হিসেব, এই দেখেই তো বিয়ে দেওয়া। কে কবে দেখতে যায়, তার রুচি কি, চিন্তা কি, জীবনের লক্ষ্য কি?

দেখতে যায় না বলেই এত অমিল!

তলায় তলায় এত কান্না!

শুধু যে মেয়েমানুষই কাঁদে তাও তো নয়। পুরুষেও কাঁদে বৈকি। তার অন্তরাত্মা কাঁদে।

সবাই তো সমান নয়, কেউ হয়তো ছোট সুখ, ছোট স্বস্তি, ছোট গণ্ডি—এইতেই গরম সন্তুষ্ট, কারো না অনেক আশা নিয়ে ছুটোছুটি।

দোষ কাউকেই দেওয়া যায় না।

শুধু ভাগ্যদেবী যখন দুটো দু প্ৰকৃতির মানুষকে এক ঘানিতে জুড়ে দিয়ে মজা দেখেন তখনই অশেষ কষ্ট।

আমার স্বামীকে স্বামী পেয়ে সুখী হবার মত মেয়েই কি জগতে ছিল না!

অথচ তারা হয়তো উদার, হৃদয়বান, পণ্ডিত স্বামীর হাতে পড়ে সে স্বামীকে অতিষ্ঠা করে মারছে।

বিরাজের কথাই ধরি না।

বিরাজ তো তার ভাইদের মতই স্বার্থপর, সঙ্কীর্ণচিত্ত, পরশ্ৰীকান্তর আর সন্দেহবাতিকগ্ৰস্ত, অথচ তার স্বামী কত ভাল, কত উদার, কত ভদ্র!

বিরাজ মৃত্যুবৎসা।

ডাক্তারে বলেছে এটা বিরাজেরই দেহের ত্রুটি, তবু বিরাজ স্বামীকেই দোষ দেয়, স্বামীর চরিত্রে সন্দেহ করে। বিরাজকে নিয়ে ঠাকুরজামাই চিরদিন দগ্ধাচ্ছে।

প্রকৃতির পার্থক্য! এর বাড়া দুঃখ নেই।

তাই মনে হয়, হয়তো পারুর কপালেও দুঃখ আছে।

 

কিন্তু বকুল?

বকুল একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির।

বকুল নিজের তুচ্ছতার লজ্জাতেই সদা কুণ্ঠিত। ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি ও যেন নিজের জন্মানোর অপরাধেই মরমে মরে আছে। ও যে ওর মায়ের বুড়ো বয়সের মেয়ে, ও যে অনাকাজ্যিক্ষত, ও অবহেলার, ও যে অবান্তর, এই দুঃখময় সত্যটি বুঝে ফেলে সংসারের কাছে ওর না আছে দাবি, না আছে। আশা! তাই এতটুকু পেলেই যেন বর্তে যায়। পারুর ঠিক উল্টো।

পারু ও মুখ ফুটে কোনদিনই কিছু চায় না, কিন্তু পারুর মুখের ভাবে ফুটে ওঠে, ওর প্রাপ্য ছিল অনেক, খেলোমি করার রুচি নেই বলেই ও তা নিয়ে কথা বলে না।

আশ্চর্য! একই রক্তমাংসে তৈরি হয়ে, একই ঘরে মানুষ হয়ে, এমন সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতি কি করে হয়?

কোথা থেকে আসে নিজস্ব চিন্তা ভাব ইচ্ছে পছন্দ?

অথচ দুই বোনে মতান্তরও নেই। কখনো। বেচারী বকুলের যা কিছু কথা সবই তো তার সেজাদির সঙ্গে। আবার পারুলের যা কিছু স্নেহ-মমতা, তা বকুলের ওপর।

মা-বাপের কাছে কোনদিন আশ্রয় পায় নি। ওরা, বড় ভাইবোনের কাছে পায় নি। প্রশ্রয়, তাই ওরা যেন নিজেদের একটা কেটর তৈরি করে নিয়ে তার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল।

সে কোটর থেকে চলে যেতে হয়েছে পারুকে, বকুল একাই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে তার মধ্যে।

তবে পারুর মত নিজের মধ্যেই নিজে মগ্ন নয় বকুল, সকলের সুখবিধানের জন্যে যেন সদা তৎপর।

সংসার জায়গাটা যে নিষ্ঠুর, তা জেনে-বুঝেও ও যেন সংসারের ওপর মমতাময়ী। ওর মধ্যে বিধাতা একটি হৃদয় ভরে দিয়েছেন, ছোটবেলা থেকে তার প্রকাশ বোঝা গেছে। ভীতু-ভীতু নীরব প্ৰকাশ।

ওকে কাছে ডেকে গায়ে হাত বুলোতে ইচ্ছে হয় আমার। কিন্তু চিরদিনের অনভ্যাসের লজ্জায় পারি না। যদি ও অবাক হয়, যদি ও আড়ষ্ট হয়?

আর সুবল?

সুবলকে ঘিরে পাথরের পাঁচিল!

সুবলের মধ্যে বস্তু আছে, সুবলের মধ্যে হৃদয় আছে, কিন্তু সুবল যেন সেই থাকাটুকু। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে একটা পাথরের দুর্গ গড়ে তার মধ্যে আত্মগোপন করে থাকতে চায়।

হয়তো—

এদের বাড়িতে হৃদয় জিনিসটার চাষ নেই বলেই সেটাকে নিয়ে এত সঙ্কোচ আমার ছোট ছেলের।

কিন্তু সুবল কি এই পৃথিবীর ঝড়-ঝাপটা সয়ে বেশিদিন টিকবে? দুর্বল স্বাস্থ্য ক্ষীণজীবী এই ছেলেটার দিকে তাকাই আর ভয়ে বুক কাপে আমার। কিন্তু প্ৰতিকারের চেষ্টা করবো সে উপায় আমার হাতে নেই।

যদি বলি, সুবল, তোর মুখটা লাল-লাল দেখাচ্ছে কেন, জ্বর হয় নি তো? দেখি—

সুবল মুখটা আরো লাল করে বলবে, আঃ, দেখবার কি আছে? শুধু শুধু জ্বর হতে যাবে কেন?

যদি বলি, বড্ড কাশছিস সুবল, গায়ে একটা মোটা জামা দে!

সুবল গায়ে পরা পাতলা কামিজটাও খুলে ফেলে শুধু গেঞ্জি পরে বসে থাকবে।

রোগা বলে সুবলের জন্যে একটু বেশি দুধের বরাদ্দ করেছিলাম, তদবধি দুধ একেবারে ত্যাগ করেছে সে। সেবার ভানুকে দিয়ে একবোতল টানিক আনিয়েছিলাম, বোতলটার মুখ পর্যন্ত না খুলে যেমনকে তেমন লেপের চালিতে তুলে রেখে দিল সুবল, বললো, থাক, দামী জিনিস উঁচু  জায়গায় তোলা থাকা।

অদ্ভুত এই অকারণ অভিমানের সঙ্গে লড়াই করতে পারি, এমন অস্ত্র আমার হাতে নেই।

আমার বড়জা হলে পারতো হয়তো।

হাউ হাউ করে কাঁদতো, মাথার দিব্যি দিতো, নিজে না খেয়ে মরবো–বলে ভয় দেখাতো। সেই সহজ কৌশলের কাছে প্ৰতিপক্ষ হার মানতো।

কিন্তু আমি তো আমার বড় জায়ের মত হতে পারলাম না কোনদিন।

সহজ আর সস্তা।

তা যদি পারতাম, তাহলে জয়াদির ভালবাসার উপহার সেই বইটাকে চিরকালের জন্যে হারাতাম না। চেয়ে-চিন্তে, কেঁদে-কোট, যেভাবেই হোক আদায় করে নিতাম। কিন্তু আমি তা পারি নি। সেই যে ও কেড়ে নিল, কোথায় লুকিয়ে রাখলো, আমি আর তার কথা উচ্চারণও করলাম না। বুক ফেটে যেতে লাগলো, তবু শক্ত হয়ে থাকলাম। পাছে ও বুঝতে পারে ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে আমার বইটার জন্যে, তাই সহজভাবে কথা কইতে লাগলাম। কাজেই ও বাঁচলো।

বইটাই চিরতরে গেল!

চিরটাদিন এই জেদেই অনেক কিছু হারিয়েছি। আমি। অনেক অসহ্য কষ্ট সহ্য করেছি। ও আমাকে কষ্ট দিয়েছে, আমি অগ্রাহ্য করেছি। অন্তত অগ্রাহ্যর ভাব দেখিয়েছি।

ভেবেছি গ্রাহ্য করলেই তো ওর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো! আমাকে যন্ত্রণা দেওয়ার উদেশ্য। ও কি আমার মনোভাব বুঝতে পারে নি?

ভেবেছে, তাই আরো হিংস্র হয়েছে।

আশ্চর্য, আশ্চর্য!

দুই পরম শত্রু বছরের পুরু বছর একই ঘরে কাটিয়েছি, এক শয্যায় শুয়েছি, এক ডিবেয় পান খেয়েছি, কথা কয়েছি, গল্প করেছি, হেসেওছি।

ওর বেশি অসুখ করলে আমি না খেয়ে না ঘুমিয়ে সেবা করেছি, আমার কোনো অসুখ করলে ও ছটফটিয়ে বেড়িয়েছে, আর তারই ফাঁকে ফাঁকে ও আমাকে, আর আমি ওকে ছোবল দেবার চেষ্টা করে ফিরেছি।

অদ্ভুত এই সম্পর্ক, অদ্ভুত এই জীবন!

দর্জিপাড়ার সেই বাড়িতে আর তিন-তিন জোড়া স্বামী-স্ত্রী ছিল, জানি না। তাদের ভিতরের রহস্য কি?

বাইরের থেকে দেখে তো মনে হতো, ওদের স্ত্রীরা স্বামীদের একান্ত বশীভূত ক্রীতদাসের মত। স্বামীদের ভয়ে তটস্থ, তাদের কথার প্রতিবাদ করবার কথা ভাবতেও পারে না।

আমার ভাসুর অবশ্য এদের মত নয়, সরল মানুষ, মায়ামমতাওলা মানুষ, কিন্তু দিদির প্রকৃতিই যে ভয় করে মরা! ও জানে শ্বশুরবাড়ির বেড়াল কুকুরটাকে পর্যন্ত ভয় করে চলতে হয়। স্বামীকেও করবে, তাতে আর আশ্চর্য কি!

কিন্তু এদের? সেজ। আর ছোটর?

এদের মধ্যে সম্পর্ক যেন প্রভু-ভৃত্যের।

তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, বাইরে থেকে যা দেখতে পাওয়া যায়, সেটাই কি সত্যি? আমার স্বামীকেও তো বাইরে থেকে দেখে লোকে বলে স্ত্রীর দাসানুদাস, বলে কেনা গোলাম, বলে বশংবদ!

 

গিরিবালা সাবিত্রীব্ৰত উদযাপন করলো, গিরিবালা স্বামীর সঙ্গে একত্রে গুরুদীক্ষা নিয়ে তীর্থযাত্রায় বেরোলো। গিরিবালা সেই যাত্রাকালে মেজভাসুরের বাড়ি বেড়াতে এসে গল্প করে গোল কাশীতে কদিন থাকবে, কদিন বা বৃন্দাবনে, মথুরায়।

গিরিবালার মুখে সৌভাগ্যের গর্ব ঝলসাচ্ছিল।

আমি মূঢ়ের মত তাকিয়ে ছিলাম। সেই মুখের দিকে। ভেবে ঠিক করতে পারছিলাম না, এ কী করে সম্ভব! আমার সেজ দ্যাওরকে তো আমি জানি!

চরিত্রদোষের জন্যে খারাপ অসুখ হয়েছিল ওর। এ কথা লুকোছাপা করেও লুকোনো থাকে নি! তাছাড়াও মানুষের শরীর যত অসৎ বৃত্তি থাকা সম্ভব, যত নীচতা, যত ক্রুরতা, তার কোনটা নেই। ওর মধ্যে?

তবু গিরিবালা আহ্লাদে ডগমগ করছে, লোককে দেখিয়ে দেখিয়ে সৌভাগ্যকে ভোগ করছে।

একে কি সত্যি বলবো?

না। এ শুধু মনকে চোখ ঠারা?

কে জানে মন-ঠকানো, না লোক-ঠকানো!

 

বিন্দু আবার আর এক ধরনের।

ওর রাতদিন কেবল হা-হুতাশ আর আক্ষেপ। ও প্রতিপন্ন করতে চায়, জগতের সেরা দুঃখী ও।… যেমন করতে চায় আমার বড়মেয়ে আর মেজমেয়ে চাপা আর চন্নন!

কিন্তু সত্যিই কি ওরা আমার মেয়ে?

ওই চাপা আর চন্নন?

আমার বিশ্বাস হয় না। মনে হয় নিতান্তই দৈব-দুর্ঘটনায় ওরা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবার আগে দিনের জন্যে আমার গর্ভে আশ্রয় নিয়েছিল। ওদের থেকে বুঝি আমার ননদরা আমার অনেক বেশি নিকট।

কিন্তু তার জন্যে আর আক্ষেপ নেই আমার, আক্ষেপ শুধু এই পোড়া বাংলা দেশের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মেয়ের জন্যে। আজও যারা চোখে ঠুলি এঁটে অন্ধ নিয়মের দাসত্ব করে চলেছে।

আজও যারা জানে, তারা শুধু মানুষ নয়, মেয়েমানুষ।

 

কিন্তু সুবৰ্ণলতার স্মৃতিকথায় স্থানকালের ধারাবাহিকতা নেই কেন? অতীতে আর বর্তমানে এমন ঘেঁষাঘেষি কেন?

অনেক সুবৰ্ণলতা একসঙ্গে মুখর হয়ে উঠতে চেয়েছে বলে? যে যখন পারছে কথা কয়ে উঠছে?… তাই সূত্র নেই?

গোড়ার দিকের পাতাগুলো তবু ভরাট ভরাট, তারপর সবই যেন খাপছাড়া ভাঙাচোরা।

হঠাৎ লিখে রেখেছে, মানুষের ওপর শ্রদ্ধা হারাবো কেন? জগু বট্‌ঠাকুরকে তো দেখেছি, দেখেছি বড় ননদাইকে, দেখলাম অম্বিকা ঠাকুরপোকে। আবার তার পরের পাতায় এ কোন জনের কথা?

বাবাকে… অপমান করে চলে এলাম।… বাবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু কি করবো? এ ছাড়া আর কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। আমার।…

নিকটজনদের দুঃখের কারণ হবো, —এই হয়তো আমার বিধিলিপি।

আমার নিষ্ঠুরতাই দেখতে পাবে সবাই, আমার ফেটে যাওয়া বুকটা কেউ দেখবে না! শুধু জানবে সুবর্ণ কঠোর, সুবৰ্ণ কঠিন।

জানুক। তাই জানুক।…

ভেবেছিলাম। এই অপমানিত জীবনটার শেষ করে দিয়ে এ জন্মের দেনা শোধ করে চলে যাব।

হল না।

ভগবানও আমাকে অপমান করে মজা দেখলেন, যমও আমাকে ঠাট্টা করে গেল। দেখি তবে এর শেষ কোথায়? নিজের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখছি চারদিকে, দেখতে পাচ্ছি। শুধু আমি একা নয়, সমস্ত মেয়েমানুষ জাতটাই একটা অপমানের পঙ্ককুণ্ডে পড়ে ছটফটাচ্ছে। কেউ টের পাচ্ছে, কেউ টের পাচ্ছে না।

কারণ?

কারণ তারা রোজগার করে না, অপরের ভাত খায়। হ্যাঁ, এই একমাত্র কারণ।

আর স্বার্থপর পুরুষজাত সেই অবস্থাকেই কায়েমী রাখতে মেয়েমানুষকে র সুযোগ দেয়। না, চোখ-কান ফুটতে দেয় না। দেবে কেন? বিনিমাইনের এমন একটা দিনরাতের চাকরানী পাওয়া যাচ্ছে এমন সুযোগ ছাড়ে কখনো?

পা বেঁধে রেখে বলবো, ছি ছি, হাঁটতে পারে না! চোখ বেঁধে রেখে বলবো, রাম রাম, দেখতে পায় না! আর সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে বলবো, ঠুঁটো ঠুঁটো! এ কী কম মজা?

চিরদিন এইরকমই তো করে আসছে। পুরুষসমাজ আর সমাজপতিরা।

মেয়েমানুষ পরচর্চা করে, মেয়েমানুষ কোঁদক করে, আর মেয়েমানুষ ভাত সেদ্ধ করে এই হল তোমাদের ভাষায় মেয়েমানুষের বিবরণ। ভেবে দেখ না, আর কোন মহৎ কাজ করতে দিয়েছ তোমরা মেয়েমানুষকে?

দেবে না, দিতে পারবে না।

দুবেলা দুমুঠো ভাতের বদলে আস্ত একটা মানুষকে নিয়ে যা খুশি করতে পারার অধিকার, এ কি সোজা সুখ? ওই দুমুঠোর বিনিময়ে সেই মানুষটার দেহ থেকে, মন থেকে, আত্মা থেকে, সব কিছু থেকে খাজনা আদায় করা যাচ্ছে—তার ওপর উপরি পাওনা নিজের নীচতা আর ক্ষুদ্রতা বিস্তার করবার একটা অবারিত ক্ষেত্ৰ।

মেয়েমানুষ যে পুরুষের পায়ের বেড়ি গলগ্রহ পিঠের বোঝা, উঠতে বসতে এসব কথা শোনাবার সুখ কোথায় পাবে পুরুষ, মেয়েমানুষ যদি লেখাপড়া শিখে ফেলে নিজের অন্নসংস্থান করতে সক্ষম হয়?

তাই পাঁকের ভরা পূর্ণ আছে।

মুখ্যু মুখ্যু, বুঝবে না। ওই পাকে নিজেরাও ড়ুবছে।

তবু–

বুঝতে একদিন হবেই।

তীব্ৰদূষ্টি তীক্ষ্ণকণ্ঠ এক জ্বলন্তদৃষ্টি মেয়ে যেন আঙুল তুলে বলছে, এই মেয়েমানুষদের অভিসম্পাত একদিন লাগবে তোমাদের। সেদিন বুঝতে পারবে চিরদিন কারুর চোখ বেঁধে রাখা যায় না। পতি পরম গুরুর মন্তর চিরদিন আর চলবে না।

আরো কত কি যেন বলছে সেই মেয়ে, আগুনঝরা চোখে, রূঢ়কঠিন গলায়, প্রায়শ্চিত করতে হবে, এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। অত্যাচার অবিচার এর মাপ হয় না।

কিন্তু দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর হচ্ছে। সে অগ্নিমূর্তি মেয়ের এ আবার কোন রূপ!

উদাস বিহ্বল স্বপ্নাচ্ছন্ন!

কী বলছে ও?

অদ্ভুত অসম্ভব।

ও না তিন-তিনটে ছেলেমেয়ের মা?

ও কি ভুলে গেছে তাদের কথা? তাই ওর মেঘলা দুপুরে হাতের বইখানা মুড়ে রেখে স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে ভাবছে, প্ৰেম, প্ৰেম! কি জানি কেমন সেই জিনিস, কেমন স্বাদ? সে কি শুধুই নাটক-নভেলের জিনিস? মানুষের জীবনে তার ঠাঁই নেই? প্ৰেম-ভালবাসা সবই মিথ্যে, অসোর?

আমার ইচ্ছে হয় কেউ আমায় ভালবাসুক, আমি কাউকে ভালবাসি।

জানি এসব কথা খুব নিন্দের কথা, তবু চুপি চুপি না বলে পারছি না।–প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হয় আমার।

যে প্রেমের মধ্যে কবিতা জগতের সমস্ত সৌন্দর্য দেখতে পান, যে প্রেমকে নিয়ে জগতের এত কাব্য গান নাটক…

একটা শিশুকে ধরে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলে, আর একটা বালিকাকে ধরে জোর করে মা করে দিলেই তার মনের সব দরজা বন্ধ হয়ে যাবে? যেতে বাধ্য?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *