অসুখ-বিসুখের ব্যাপার নিয়ে প্রতাপ আলোচনা করতে ভালোবাসেন না। নিজের কখনো শরীর খারাপ হলে সহজে তা স্বীকার করতে চান না, এমনকি মমতার কাছেও না। দেহ নামক যন্ত্রটিতে কখনো সখনো বিকার ঘটেই, তখনও প্রতাপ ডাক্তার দেখাবার বদলে নিজেই গোপনে নিজের চিকিৎসা করেন।
রাস্তা ঘাটে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মতন ঘটনা তাঁর জীবনে আর কখনো ঘটেছে কি না তা কেউ জানে না, তবে এবারের কথাটা বাবলু এসে তার মাকে বলে দিয়েছে। প্রতাপ তবু কয়েকবার অস্বীকার করবার চেষ্টা করলেন, বললেন, ওটা কিছুই না, সেদিন মাথায় বেশি রোদ লেগে গিয়েছিল, তারপর থেকে তো আবার ঠিকই আছি, ট্রামে বাসে চাপছি…। মমতা তবু তাঁর এক আত্মীয় ডাক্তারকে ডাকার জন্য জেদ ধরতে প্রতাপ বললেন, ঠিক আছে, আগে বাড়ির ডাক্তারকে দিয়েই প্রেসার ট্রেসার মাপিয়ে দেখা যাক-তুতুলকে একবার ডাকো।
বাড়িতে তুতুলের সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না কখনো। এ বাড়িতে দুটি মেয়ে আছে, মুন্নি আর তুতুল, মেয়েদের কণ্ঠস্বর সাধারণত একটু উচ্চগ্রামে বাঁধা, মুন্নির হাসি-কান্না, কথাবার্তা অন্য ঘর থেকে শুনতে পাওয়া যায় প্রায়ই। তুতুল যদিও মুন্নির সঙ্গে একই ঘরে থাকে, তবু সে অদ্ভুত নিঃশব্দ। সে মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে যায়, প্রত্যেকদিন ঠিক সময় ফেরে, তার কোনো বন্ধু বান্ধব আসে না এ বাড়িতে। সে কখনো চেঁচিয়ে বই পড়ে না, যদিও জেগে থাকে অনেক রাত পর্যন্ত। তাকে বাড়ির কিছু কাজ করতে বললে সে করে দেয় ঠিক ঠাক, এমনকি রান্নাবান্নাও করতে জানে, শুধু মুখের কথা খরচ করতেই তার যত কষ্ট। এজন্য সে প্রায়ই বকুনি খায় সুপ্রীতির কাছে।
ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্রটি নিয়ে তুতুল এসে দাঁড়াল প্রতাপের বিছানার কাছে।
শুক্রবারের সন্ধ্যা, আদালত থেকে ফিরে প্রতাপের আবার খানিকবাদে বেরুবার কথা, বাড়ি বদলাবার ব্যাপারে একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন রাত আটটায়, মাঝখানের সময়টুকুতে প্রতাপ একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলেন। অমনি মমতা উদ্বিগ্নভাবে এসে তাঁর কপালে হাত রেখে বলেছিলেন, তুমি বাড়ি ফিরেই শুয়ে পড়লে? নিশ্চয়ই আবার তোমার শরীর খারাপ হয়েছে। প্রতাপ বলেছিলেন, আহা কী মুশকিল, আফিস থেকে ফিরে একটুখানি শুতেও পারবো না? তোমরা চা-টা করো…
তুতুলের দু’পাশ ঘিরে রয়েছেন মমতা এবং সুপ্রীতি, মুন্নিও এসে উঁকি মেরেছে পিছন থেকে। বাবাকে সবাই মিলে কাবু করে ফেলা হচ্ছে দেখে সে বেশ মজা পাচ্ছে।
তুতুল কিছু বলার আগেই দু’পাশ থেকে মমতা আর সুপ্রীতি নানারকম নির্দেশ দিতে থাকেন। এখন প্রতাপের কয়েকদিন অফিস যাওয়া চলবে না, ছুটি নিয়ে শুয়ে থাকতে হবে। বাড়িতে বসেও লেখা-পড়ার কাজ করা চলবে না, ওতে মাথার ওপর চাপ পড়ে, রোজ সকালে থানকুনি পাতার রস খাওয়া ভালো।
তুতুল প্রতাপের বাহুতে পট্টি জড়াতে শুরু করেছে, প্রতাপ তাকে বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়া তো একটু।
তিনি উঠে বসে আঙুল তুলে হুকুমের সুরে বললেন, তোমরা সব বাইরে যাও! ডাক্তার যখন পেশেন্ট দেখে, তখন অন্য কারুর সেখানে থাকার কথা নয়। কোনো রোগ এখনো ধরা পড়েনি, এর মধ্যেই তোমরা আমার চিকিৎসা করতে শুরু করে দিয়েছে। বা রে বাঃ! যাও, সবাই বাইরে যাও!
মমতা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, প্রতাপ সঙ্গে সঙ্গে আবার বললেন, না হলে কিন্তু আমি দেখাবো না!
মমতা প্রতাপের জেদ জানেন, তিনি সুপ্রীতির দিকে তাকালেন। মমতা বাইরে যেতে রাজি হলেও মনে মনে ঠিক করলেন, তুতুল এখনও ছাত্রী, শুধু ওকে দিয়ে দেখালেই চলবে না, একজন বড় ডাক্তার ডাকতেই হবে।
মমতারা বেরিয়ে যাবার পর প্রতাপ বললেন, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আয় তুতুল। তারপর তুই ঐ চেয়ারটা টেনে আমার সামনে বোস।
প্রতাপ ভালো করে তুতুলকে দেখতে লাগলেন, যেন তিনি অনেকদিন পরে ওকে দেখছেন। লম্বা হয়েছে মেয়েটা, কিন্তু অসম্ভব রোগা। রংটাও ময়লা ময়লা লাগছে। ব্লাউজটা ঢলঢলে, একটা বিবর্ণ শাড়ি পরে আছে, মাথার চুলের যত্ন নেই। এই মেয়ে কিছুদিন পরে ডাক্তার হবে, তখন ওকে কেউ মানবে? অবশ্য তুতুল রেজাল্ট ভালো করে, ও পড়ছে নিজের স্কলারশিপের টাকায়। কিন্তু শুধু ভালো রেজাল্ট করলেই তো হয় না, ডাক্তারদের খানিকটা ব্যক্তিত্ব না থাকলে চলে? এ মেয়ে শুধু রোগা নয়, শীর্ণ। তার ওপরে কথাই বলতে চায় না, ডাক্তার হিসেবে ওকে মানবে কে?
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, তুতুল, তুই বাড়িতে খেতে পাস না নাকি? এত রোগা হচ্ছিস দিন দিন…
তুতুল একটু ম্লান ভাবে হাসলো। অধিকাংশ প্রশ্নের তার এই উত্তর। নিতান্ত দরকার না হলে সে হাঁ কিংবা না-ও বলে না।
প্রতাপ আবার বললেন, সেই সকালে বেরিয়ে যাস, দুপুরে খাস তো কিছু? মেডিক্যাল কলেজে ক্যান্টিন আছে তো?
তুতুল সম্মতিসূচক মাথা হেলালো একদিকে, তারপর যাতে আর কোনো প্রশ্ন শুনতে না হয়। সেইজন্য কানে গুজলা স্টেথোস্কোপ।
প্রতাপ তুতুলের চোখে চোখ ফেলার চেষ্টা করলেন কিন্তু সে মুখ নিচু করে আছে। প্রতাপ ভাবলেন, মেয়েটা প্রত্যেক রাত জেগে পড়াশুনো করে, বড় বেশি পরিশ্রম করছে, সেই জন্য তার মুখে ক্লান্তির ছাপ। এরকম ভাবে চললে ওর শরীর ভেঙে যাবে। ও নিজে ডাক্তারি পড়ে, আর নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা বোঝে না?
হঠাৎ নিজের বড় ছেলের কথা মনে পড়ে গেল প্রতাপের। বেঁচে থাকলে পিকলু এতদিনে পরিপূর্ণ যুবক হয়ে যেত, কিন্তু মৃত্যুতে মানুষের বয়েস থেমে থাকে, পিকলুর সেই সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ চেহারাটাই চোখে ভাসে, তার তুলনায় তুতুলও বড় হয়ে গেল। এমনকি মুন্নিও একদিন পিকলুকে ছাড়িয়ে যাবে…। পিকলুর মৃত্যুর মাস ছয়েক আগে রাত্তিরবেলা শুয়ে মমতা চুপি চুপি প্রতাপকে বলেছিলেন, পিকলু আর তুতুল দু’জনেই বড় হচ্ছে, এই বাড়িতে এত ছোট জায়গা, আমি আর দিদি দুপুরে সিনেমা-টিনেমায় গেলে ওরা একা একা থাকে…আমার ভয় করে…যদি কিছু একটা হয়ে যায়…এই বয়েসী ছেলেমেয়েরা হঠাৎ মাথার ঠিক রাখতে পারে না।
প্রতাপ শুনে অবাক হয়েছিলেন। পিঠোপিঠি ভাই বোনের মধ্যে অনেক সময় ঝগড়া হয়, অনেক সময় বেশি ভাবও হয়। মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে সেই ভাব যদি ভালোবাসাতেও উত্তীর্ণ হয়ে যায়, তাতে ক্ষতি কী? সেই ভালোবাসার সম্পর্ক তো অতি মধুর। সেই সম্পর্কের মধ্যে নোংরামি আসতে পারে যদি ছেলে বা মেয়ের মধ্যে কেউ একজন বদ হয়। পিকলু বা তুতুল দু’জনের কেউই সেরকম নয়। ওরা, অন্যায় কিছু করতেই পারে না।
প্রতাপ মমতাকে সেদিন ধমক দিয়েছিলেন। নিজের ছেলেমেয়ের ওপর যে বাপ-মা বিশ্বাস রাখতে পারে না, তারা ছেলেমেয়েদেরও ক্ষতি করে, নিজেরাও অশান্তিতে ভোগে। ছেলেমেয়েদের ঠিক মতন লেখাপড়ার সুযোগ দাও, সহবৎ শেখাও, পারিবারিক সম্মান সম্পর্কে সচেতন করো, আত্মসম্মানবোধ জাগিয়ে তোলো, তারপর ওদের ভালোমন্দ ওরা নিজেরাই বুঝে নেবে। কিছুদিন পর তো এই পৃথিবীটা ওদেরই হবে, আমাদের চলে যেতে হবে, ওরা যদি কিছু ভুলও করে, সেই ভুলের বোঝাও ওরাই বইবে, আমরা তো বইতে যাবো না!
মমতাও সঙ্কীর্ণমনা নন। প্রতাপের উপদেশ মেশানো বকুনি শুনে তিনি আহতভাবে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিলেন, ওরা খারাপ কিছু করবে, আমি মোটেই সে কথা বলিনি। তুমি বাড়ি বদলাবার ব্যবস্থা করবে কি না বলো। জায়গায় মোটেই কুলোয় না, শুধু তুতুল কেন, মুন্নিও তো বড় হচ্ছে, সে আর কতদিন আমাদের সঙ্গে শোবে? তুতুলের একটা আলাদা ঘর না হলে…বাথরুমের দরজাটা ভাঙা, বেচারা কাপড় ছাড়বারও জায়গা পায় না…
প্রসঙ্গটা তখন বাড়ি বদলের সমূহ প্রয়োজনীয়তার দিকে গড়িয়ে যায়।
সেই একবারই শুধু প্রতাপ তুতুল আর পিকলুর সম্পর্কে কিছু শুনেছিলেন। তখন তিনি জীবিকার তাড়নায় ব্যস্ত ছিলেন বড় বেশি, বাড়ি বদলাবার ব্যবস্থা করতে গিয়ে তাঁকে উপার্জন বাড়াবার চেষ্টা করতে হয়, তিনি ওদের দিকে লক্ষ্য করবার সময় পান নি। আজ তিনি তুতুলের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, ওদের ভালোবাসা কতটা গম্ভীর হয়েছিল? তুতুল কি এতদিন পরেও পিকলুর জন্যই মনমরা হয়ে থাকে?
প্রতাপের হাতের পট্টিটা খুলতে খুলতে তুতুল মৃদুস্বরে বললো, বেশি তো নয়!
প্রতাপ ব্যগ্র ভাবে জিজ্ঞেস করলেন কত, কত দেখলি প্রেসার?
তুতুল সিস্টোলিক, ডায়াস্টোলিক কী সব বললো, প্রতাপ অত সব বোঝেন না। তিনি বোঝেন নিচেরটা আর ওপরেরটা। পঁচানব্বই আর একশো সত্তর। একে তো মোটেই অ্যাবনমাল বলা যায় না। তাঁর সহকর্মী একজন হাকিম, মনোমোহন সেন একশো দশ আর দুশো দশ ব্লাড প্রেসার নিয়ে দিব্যি কাজকর্ম করছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন, একই বিয়ে বাড়িতে কব্জি ডুবিয়ে পাঁঠার মাংস খেলেন…
প্রতাপের ধারণা ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধিই একমাত্র ভয়ের বস্তু। তিনি উৎফুল্ল মুখে উঠে বসে বললেন, দেখলি, দেখলি, আমার কিছু হয় নি? তোর মামীমার যত বাড়াবাড়ি, আমি বেশ ভালো আছি।
তুতুল তার সরঞ্জাম গুছোতে গুছোতে বললো, ব্লাড সুগারটা একবার চেক করতে হবে…ফ্যামিলিতে কারুর ডায়াবিটিস ছিল?
–কী জানি! আমার বাবা-মা গ্রামে থাকতে তো কখনো ব্লাড টেস্ট করান নি। মার স্বাস্থ্য এখনো ভালো আছে। বাবা মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাকে, যতদূর জানি ডায়াবিটিসের কোনো সিমটম ছিল না, আমারও নেই.তোর বাবার কিন্তু ছিল, আমার মনে আছে, অসিতদাকে ডাক্তার ইনসুলিন নিতে বলেছিল-হ্যারে মামণি, তুই এত রোগা হয়ে যাচ্ছিস কেন?
তুতুল নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো।
–তোর বাবার কাছ থেকে তুই আবার ওটা পাস নি তো? শিগগির একদিন চেক করা। তুই আমার ওপর ডাক্তারি করতে এসেছিস, আমার তো মনে হচ্ছে তোরই চিকিৎসা করানো, দরকার।
–আমি কাল-পরশু তোমার ব্লাড টেস্টের ব্যবস্থা করবো, মামা।
–তুই আমার কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন রে? সব সময় গোমড়া মুখে থাকিস, এটাও শরীর খারাপের লক্ষণ। এই, তুই আমার দিকে ভালো করে তাকাচ্ছিস না কেন? কী হয়েছে তোর? আমাকে সব বল তো!
–আমার কিছু হয় নি।
তুতুল গিয়ে দরজা খুলতেই প্রতাপ চেঁচিয়ে বললেন, তোর মা আর মামীকে জানিয়ে দে যে আমার শরীরে রোগ টোগ কিছু নেই। আমি চমৎকার আছি!
প্রতাপ তখুনি বাইরে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগলেন। আবার বাড়ি বদল করতে হবে। আগেরবার পিকলু…। এ বাড়ি বদল না করে উপায় নেই। বাড়িওয়ালা ছিলেন একজন উকিল, বেশ সজ্জন, প্রতাপের সঙ্গে সদ্ভাব ছিল, তিনি হঠাৎ পক্ষাঘাতে পঙ্গু হবার পর তাঁর জামাই এ বাড়ি খালি করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
তুতুলকে দিয়ে ব্লাড প্রেসার চেক করাবার ফলে বেশ উপকার হলো প্রতাপের, আবার মনের জোর ফিরে পেয়েছেন। মুখে যতই অস্বীকার করুন, সেদিন সায়েন্স কলেজের সামনের ফুটপাথের ঘটনার পর তাঁর মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁতুনি ঢুকেছিল। রোদ্দুর লেগে মাথা ঘুরে যাবার ব্যাপার নয়, কয়েক মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখের সামনে সব কিছু আবছা হয়ে এসেছিল, মনে হচ্ছিল, পায়ের তলায় মাটি নেই, তিনি অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন, যেন মৃত্যুর দেশ তাঁকে টেনে নিচ্ছে, তিনি বাবলুর হাত ধরে…। নাঃ, হয়তো শারীরিক কিছু নয়, ওটা মনের বিকার। প্রেসার যখন ঠিক আছে, তখন সব ঠিক আছে।
সে রাতে বাড়ি বদলাবার বিষয়ে কিছু ঠিকঠাক হলো না। ভাড়া অত্যন্ত বেশি।
এরপর কয়েকদিন প্রতাপ তুতুল সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। বারবার তাকে ডেকে কথা বলাতে চান, তার কলেজের পড়াশুনো সম্পর্কে জানতে চান। তবু মেয়েটা কিছুতেই মুখ খোলে না। তাকে বকুনি দিলেও কাজ হয় না। প্রতাপ পরাস্ত হয়ে গেলেন।
মমতাকে তিনি একদিন বললেন, মেয়েটা দিন দিন কী রকম হয়ে যাচ্ছে, তোমরা একটু নজর দাও না কেন?
মমতা বললেন, আমি আর দিদি তো ওকে বলে বলে হয়রান হয়ে গেছি। কিছুই খেতে চায় না। ভাত খায় ঠিক এইটুকু, ওর থেকে মুন্নি অনেক বেশি খায়। কোনো মাছ-তরকারি ওর পছন্দ হয় না। আমার ওপরে ওর কিছু রাগ টাগ হয়েছে কিনা জানি না, আমার সঙ্গে তো পারতপক্ষে ও একটা কথাও বলতে চায় না।
–তুমি ওকে কোনোদিন বকেছো…পিকলুর নাম করে…বাবলুকে যেমন তুমি মাঝে মাঝে পাগলের মতন…
–না, ওকে আমি কোনোদিন কিছু বলিনি, বিশ্বাস করো। এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি।
–এভাবে বেশিদিন চললে তো মেয়েটা মরে যাবে! এই বয়েসের মেয়ে, ভালো করে খাবে দাবে, সাজপোশাক করবে…ও কোনোদিন সিনেমা টিনেমাতেও যায় না?
–আমরা জোর করলেও যেতে চায় না। ও যেন ইচ্ছে করে এমন সাজ করে যাতে ওকে আরও খারাপ দেখায়! কানু বলছিল, ও কলেজে কোনো ছেলে মেয়ের সঙ্গেও মেশে না!
প্রতাপ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, কানু?
প্রতাপের আশঙ্কা মিথ্যে হয় নি, কানু একবার ছ’মাসের জন্য জেল খেটে এসেছে। এর মধ্যেই সে অবশ্য বিয়েও করেছে, বাচ্চা হয়েছে দুটি, তার অবস্থা সচ্ছল হচ্ছে দিন দিন, টালিগঞ্জে একটা ছোট বাড়ি কিনেছে, কিন্তু তার রোজগারের সঠিক পন্থাটা বোঝা যায় না। সে মুখে বলে অড়ার সাপ্লাই-এর ব্যবসা। প্রতাপ তাকে সহ্য করতে পারেন না, কানু তা জানে, তাই সে শুধু দুপুরের দিকে মাঝে মাঝে এ বাড়িতে আসে।
প্রতাপ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কানু কী করে জানলো তুতুলের কলেজে কী হয় না হয়?
মমতা বললেন, কানুর এক শালা যে মেডিক্যোল কলেজে ওর সঙ্গেই পড়ে। সে নাকি বলেছে, তুতুলের একটাও বন্ধু নেই, প্রফেসাররা ছাড়া ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে কথাই বলে …দু’একজন প্রফেসার ওকে বেশি ফেভার করে, চেম্বারে আলাদা করে ডেকে নিয়ে যায়, সেইজন্য ছেলেমেয়েরা তুতুলকে ক্ষ্যাপায়।
প্রতাপ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, কানুর শালাও সেই ক্ষ্যাপাবার দলে আছে নিশ্চয়ই। একদিন আমি মেডিক্যাল কলেজে খোঁজ নিতে যাবো, যদি দেখি কেউ অন্যায় ভাবে আমার ভাগ্নীর পিছনে ফেউ লেগেছে, তাহলে তাকে আমি চাবকে সোজা করবো!
মমতা হেসে স্বামীর বুকে হাত রেখে বললেন, তুমি এক কাজ করো। একটা চাবুক হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ো একদিন, তারপর যেখানে যত অন্যায়কারী দেখবে, সবাইকে চাবুক কষাবে এক ঘা করে!
এর কয়েকদিন পরে প্রতাপ ডাকবাক্স খুলে একটি অদ্ভুত খাম পেলেন। এয়ারমেলের লম্বাটে লেফাফা, তাতে কেউ হাতে ছবি এঁকেছে। বিভিন্ন সাইজের হৃৎপিণ্ডের ছবি, সেগুলি ক্রস করে কাটা। চিঠিটা তুতুলের নামে। ঠিকানার জায়গায় বাংলায় লেখা শ্ৰীমতী বহ্নিশিখা সরকার, তার নিচে, ব্র্যাকেট দিয়ে, বড় বড় লাল হরফে ইংরিজিতে লেখা Mrs. Grundy.
খামটি দেখে প্রতাপের বুক কেঁপে উঠলো একবার। ঐ মিসেস গ্রান্ডি লেখার মানে কী? তুতুল কুমারী মেয়ে, তার নামের নিচে মিসেস দিয়ে অন্য একটা পদবী…গ্রান্ডি নামের কোনো লোককে তুতুল গোপনে গোপনে বিয়ে করেছে? সে কথাটা বলতে পারে না বলেই সে এমন মনমরা হয়ে থাকে? মেডিক্যাল কলেজে ঐ নামের কোনো অধ্যাপক আছে? সাহেব অধ্যাপকরা তো সবাই বিদায় নিয়েছে, যদি কোনো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান…বা পার্শী হতে পারে…
প্রতাপ মমতাকে এনে চিঠিটা দেখালেন। মমতাও বুঝতে পারলেন না কিছু। তুতুলকে এমনিতে কে চিঠি লিখবে? একসময় সে ফুলের মতন সুন্দর ছিল, পাড়ার ছোঁকরারা জ্বালাতন করতো…কিন্তু ইদানীং তো কেউ…।
প্রতাপের সবচেয়ে বেশি ভয় হলো সুপ্রীতির জন্য। চিঠিটার মধ্যে যদি সেরকম কিছু থাকে, যদি সুপ্রীতি জানতে পেরে যান, তাহলে তিনি সামলাবেন কী করে?
ভাগ্নীর নামে চিঠি যদিও খুলে পড়া উচিত নয়, তবু প্রতাপ কৌতূহল সামলাতে পারছেন না। যে-ই চিঠিটা লিখুক, মিসেস গ্রান্ডি লিখলো কেন, ওপরে আবার হৃৎপিণ্ডের ছবি, তাও কেটে দেওয়া…।
প্রতাপ মমতাকে জিজ্ঞেস করলেন, চিঠিটা খুলে দেখলে দোষ হবে?
মমতা একটা বাটিতে করে জল এনে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর নিজেই আঙুলে জল লাগিয়ে বোলাতে লাগলেন আঠার জায়গায়। যাতে ছিঁড়ে না যায়, খুব সাবধানে আস্তে আস্তে খোলা হলো।
ভেতরের চিঠিটাও অদ্ভুত! একটা গোটা পৃষ্ঠা জুড়ে বড় বড় অক্ষরে শুধু কতকগুলি প্রশ্নসূচক দুর্বোধ্যবাক্য লেখা। নিচে কোনো সই নেই। বাক্যগুলি এইরকম : মিসেস গ্রান্ডি, অ্যানাটমি ক্লাসের সব ছবিতে জামাকাপড় পরানো উচিত, তাই না?… মিসেস গ্রান্ডি, আমরা হাইড্রোশিলের চিকিৎসা শিখবো না, শিখবো না!…মিসেস গ্রান্ডি, গত শনিবার অনীতা সরকার আর সুশোভন ব্যানার্জি একসঙ্গে কোথায় গেল। কোথায় গেল?…মিসেস গ্র্যান্ডি, শর্মিলা বুক কাটা ব্লাউজ পরে আসে, তুমি তার পাশে বসো না, আমাদের বসতে দাও, বসতে দাও…
চিঠিটা পড়তে পড়তে প্রতাপের মুখ বিকৃতি ঘটতে লাগলো, মমতা হাসতে লাগলেন। এ কোনো বদমাইস সহপাঠীর কীর্তি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ চিঠি তুতলকে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, প্রতাপ রাগের চোটে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়তে লাগলেন সেটাকে।
মমতা ছদ্ম কৌতুকের সঙ্গে বললেন, তুমি ছিঁড়ে ফেললে? হাতের লেখার প্রমাণ থাকতো যে লিখেছে পরে তাকে ধরা যেত!
প্রতাপ বললেন, হাকিমের বউ হয়ে তুমি দেখছি প্রমাণ-ট্রমাণের ব্যাপারটা খুব শিখে গেছো! এখন থেকে ডাকবাক্সতে তালা লাগাবে, রোজ আমি এসে খুলবো।
চিঠির ব্যাপারটা চুকে গেলেও মনের মধ্যে একটা সন্দেহের কাঁটা রয়ে গেল। মিসেস গ্রান্ডি কেন? ইংরিজিতে ঐ নামের কোনো রেফারেন্স আছে! প্রতাপের ইংরিজি সাহিত্য তেমন পড়া নেই।
বিমানবিহারীর বাড়িতে অনেক লেখা পড়া জানা মানুষ আসে। একদিন ইংরিজির অধ্যাপক পরেশ গুহর সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে প্রতাপ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা পরেশবাবু, মিসেস গ্রান্ডি কে আপনি জানেন!
পরেশ গুহ বললেন, মিসেস গ্রান্ডি? মিসেস গ্রান্ডি হচ্ছে আমার ন’পিসিমা। আমার নপিসিমা একদিন কী করেছেন জানেন? আমাদের পাড়ায় একটা বড় বকুল গাছ আছে। বিকেলবেলা কি সন্ধেবেলা ওখানে ছেলেরা আড্ডা মারে। আজকাল তো মেয়েরাও আজ্ঞা দিতে শিখেছে, দু’একটি মেয়েও সেখানে যায়। একদিন আমার পিসিমা কীর্তন শুনে ফিরছেন, তখন সেই গাছতলায় একটি ছেলে আর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, চুমুটুমু খায়নি, বুঝলেন, পাড়ারই তো ছেলেমেয়ে, এমনি দাঁড়িয়ে গল্প করছিল, অমনি ন’পিসিমা চেঁচিয়ে উঠলেন, এই, তোরা এখানে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছিস কেন রে? তোদের লজ্জা সরম নেই! এত বড় একটা ধিঙ্গি মেয়ে–এরকম করলে তোর কোনো দিন বিয়ে হবে? তা শুনে ছেলে-মেয়ে দুটো দৌড়ে পালালো। আমার ন’ পিসিমার জন্য পাড়ার কোনো মেয়ে জানলায় দাঁড়াতে পারবে না, কোনো ছেলে রাস্তায় গান গাইতে গাইতে যেতে পারবে না, আমার স্ত্রী তার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে সিনেমায় যেতে চেয়েছিল, তাই শুনে ন’পিসিমা নাক দিয়ে ঘোঁৎ শব্দ করে বললো, হুঁঃ, দিনে। দিনে কত কী দেখবো! একেবারে পারফেক্ট মিসেস গ্রাণ্ডি!
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, ঐ মিসেস গ্রান্ডি নামটা এলো কোথা থেকে?
–হঠাৎ মিসেস গ্রান্ডিকে নিয়ে আপনার এত কৌতূহল কেন, প্রতাপবাবু?
–এমনিই…মানে, একটা জায়গায় হঠাৎ এ, নামটা পেলাম।
–একটা পুরোনো ইংরিজি নাটক আছে, বুঝলেন, মর্টনের লেখা, স্পীড দা প্লাও, তাতে ঐ মিসেস গ্রান্ডি বলে একটা চরিত্র আছে। প্রচণ্ড নীতিবাগিশ আর শুচিবায়ুগ্রস্ত…তার থেকে এসেছে, ঐ রকম কোনো মহিলাকেই মিসেস গ্রান্ডি বলে…ভিকটোরিয়ান মরালিটি কোন পর্যন্ত পৌঁছেছিল জানেন তো, প্রায় সব কিছুই অশ্লীল, একটা আন্দোলন উঠেছিল যে অপারেশানের সময়, কিংবা বাচ্চার জন্ম দেবার সময়েও মেয়েদের জামাকাপড় খোলা চলবে না। পুরুষ ডাক্তাররা দেখে ফেলবে, এই চিন্তাটাও অন্যদের কাছে অশ্লীল…তখন কত শব্দ নিয়েও শুচিবাই ছিল, মোরগের ইংরিজি কক্ বলা চলতো না, কারণ ঐ শব্দটার অন্য খারাপ মানে আছে, কেউ কেউ বলতো রুস্টার! ষাড় মানে বুল শব্দটারও দোষ ছিল, তাই বলতে হতো জেন্টলম্যান কাউ!
-–ঠিক আছে, বুঝেছি।
–আরও শুনুন না! শ্লীলতার বাতিক, মানে প্রডারি এতদূর পৌঁছে ছিল যে অনেক মহিলা দাবি করেছিল চেয়ার টেবিলের পায়াতেও পোশাক পরাতে হবে। কারণ চেয়ার টেবিলের পায়াও তো লেগ, আর পোশাক ছাড়া লেগ দেখতে হবে ভাবলেই মিসেস গ্রান্ডিদের কান লাল হয়ে যায়…হাঃ হাঃ হাঃ।
কিন্তু প্রতাপের এইসব রসিকতা শোনার দিকে মন নেই। তুতুলের কথা ভেবে তাঁর মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে। অমন সুন্দর মেয়ে ছিল তুতুল, তার এই পরিণতি। এরকম কী করে হলো! তাঁদের বাড়িতে কেউ এরকম নয়। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তো তাহলে পিছনে লাগবেই। শুচিবায়ুগ্রস্তরা দিন দিন রোগা হয়ে যায়, এটা এক ধরনের পাগলামি। এই ভাবে চলতে থাকলে ও কি মেডিক্যাল কোর্স শেষ করতে পারবে, কিংবা কোর্স শেষ করলেই বা কী লাভ হবে?
প্রতাপ উঠে পড়লেন সেই আড্ডা থেকে। তুতুলকে এই অবস্থা থেকে ফেরাতেই হবে, যদিও কী করে ফেরাবেন তা প্রতাপ জানেন না। নিজের জন্য নয়, তুতুলের জন্যই তাঁর এবার কোনো বড় ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরামর্শ নেওয়া দরকার।