2 of 3

২.১৫ মুড়ি ও তেলেভাজা খাওয়া

মুড়ি ও তেলেভাজা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম হাসি-ঠাট্টা চলছিল, হঠাৎ মানিকদা জোরে দু’বার হাততালি দিয়ে বললেন, চুপ, সবাই চুপ। অনেক গল্প হয়েছে, এবারে কাজের কথা হবে।

প্রীতিময় বললো, চা আনতে গেছে। মানিকদা, আগে চা-টা খেয়ে নিলে হতো না? মানিকদা একটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে বললেন, আসুক, চা আসতে দেরি আছে, ততক্ষণ কথাবার্তা চলতে থাকুক।

তারপর তিনি একজনের দিকে আঙুল তুলে বললেন, এবারে তপন তুমি বলো, দেশ বলতে তুমি কী বোঝে।

তপন নামে এই ছেলেটিকে বাবলু আগে দেখেনি। বাবলুর থেকে বয়েসে তিন চার বছর বড়ই হবে, একটা ময়লা ধুতি ও নীল রঙের হাফশার্ট পরা, মাথার চুল ঝাঁকড়া, গায়ের রং বেশ কালো, চোখ দুটিতে ভয় ভয় ভাব। মানিকদা একে সঙ্গে নিয়ে ঢোকার সময় বলেছিলেন, এই আমাদের একজন নতুন বন্ধু। আর কোনো পরিচয় করিয়ে দেননি।

এখন সকলের দৃষ্টি পড়লো তপনের ওপর, সে যেন অসহায় বোধ করছে, এই নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেবার সে সময় পায়নি। এই ঘরে যে এগারো জন যুবক-যুবতী উপস্থিত, তারা সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের, তাদের কেউ কেউ ছেঁড়া জামা পরে থাকলেও তাদের চেহারার পালিশ দেখলেই বোঝা যায়, অন্তত তিন পুরুষ ধরে এক ধরনের শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিবেশে লালিত, সেই তুলনায় তপনের মুখ একেবারে টাটকা।

–চুপ করে রইলে কেন, কিছু বলো। দেশ বলতে তোমার চোখে কোন্ ছবি ফুটে ওঠে? তপনের ঠিক থুতনির কাছে একটা আঁচিল। সেটা খুঁটতে খুঁটতে সে মুখ খোলার চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলো না। ঘরের মধ্যে এক অস্বস্তিকর নীরবতা। অন্যদের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে চোখ নিচু করে নিচ্ছে।

বাবলুর পাশে বসা কৌশিক বললো, মানিকদা, এ নতুন এসেছে, প্রথম দিনই কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। আগে ওর সঙ্গে আমাদের ভালো করে পরিচয় করিয়ে দাও।

মানিকদা বললেন, এ সব লজ্জা ফজ্জা কোনো কাজের কথা নয়। ফর্মালি আলাপ-পরিচয় করিয়ে দেওয়াও আমি পছন্দ করি না, ওগুলো সব বুর্জোয়া সিস্টেম। আমাদের একজন নতুন বন্ধু এসেছে, তোমরা নিজেরাই তো আলাপ করে নেবে। যাই হোক, আমি কী করে ওর দেখা পেলুম, সেইটুকুই শুধু বলছি। শ্যামবাজারের মোড়ে যে কতকগুলো খুচরো দোকান আর স্টল আছে, তারই একটা দোকান, বুঝলে, দোকানটা ঠিক ফুটপাথে নয়, একটা ওষুধের দোকানের দেয়ালের গায়ে, সেই দোকান থেকে আমি মাঝে মাঝে গেঞ্জি কিনি।

পেছন থেকে একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, মানিকদা, আপনিও গেঞ্জি কেনেন?

সবাই হেসে উঠলো একসঙ্গে। গেঞ্জি কেনার কথাটা সত্যি অবিশ্বাস্য শোনায়। সারা বছর মানিকদাকে একই পোশাকে দেখা যায়, একটা গেরুয়া পাঞ্জাবি ও গাঁজামা, কাঁধে একটা ঝোলা। এক একদিন গায়ের পাঞ্জাবিটা ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে যায়, পরের দিনও মানিকদা সেটাই পরে আসেন। সবাই বলে, মানিকদা চান করবার সময় কিংবা ঘুমোবার সময়ও পাঞ্জাবিটা খোলৈন না, আর মানিকদার গালের দাড়িও কখনো বাড়ে-কমে না।

অমল নামে একটি ছেলে বললো, আপনাকে শীতকালেও তো গেঞ্জি পরতে দেখিনি। মানিকদা নিজেও খানিকটা হেসে ফেলে বললেন, নিজের জন্য না হোক, বাড়ির লোকজনের জন্য তো কিনতে হয়। তা ছাড়া আমিও পরি, কলকাতার বাইরে গেলে…কলকাতার শীত আমার গায়ে লাগে না, কিন্তু গ্রাম ট্রামের দিকে গেলে ঠাণ্ডা আটকাবার জন্য আর একটা গেঞ্জি অন্তত… তার পর শোনো, সেই গেঞ্জির দোকানের যে দোকানদার, বুড়ো মতন একজন লোক, তার সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। আমি কোনো মানুষের সঙ্গেই শুধু দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কে বিশ্বাস করি না, একটা কিছু ব্যক্তিগত যোগাযোগ রাখতে চাই…একদিন গিয়ে দেখি সেই দোকানে মালিকের বদলে এই তপন বসে আছে।

এবারে তপন মুখ তুলে বললো, দোকানটা আমার জ্যাঠামশাইয়ের।

মানিকদা বললেন, জ্যাঠামশাইয়ের দোকানে তার ভাইপো দু’-একদিন বসবে, আই মিন দাঁড়াবে, দেয়ালের গায়ে দোকান তো, বসার জায়গা নেই, মালিক বা কর্মচারিকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হয়, সেটা আশ্চর্য কিছু নয়, কিন্তু…

তপন আবার বললো, একটা টুল আছে, সেটা ওষুধের দোকানে রোজ রেখে দেওয়া হয়। আপনি যেদিন গেলেন, সেদিন ওষুধের দোকান বন্ধ ছিল, তাই আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম…

মানিকদা হাত তুলে বাধা দিয়ে বললেন, আমাকে শেষ করতে দাও। তারপর শোনো, সেদিন সারাদিন বৃষ্টি পড়ছে, রাস্তায় বেশি লোক নেই, শ্যামবাজারের অধিকাংশ দোকানদারই সেদিন মাছি তাড়াচ্ছে, আমি আমার ছোট ভাইয়ের জন্য একটা গেঞ্জি কিনতে গেছি…

বাবলু একটু অবাক হয়ে কৌশিকের দিকে তাকালো। তাদের দু’জনের চোখেই পাতলা বিস্ময়। তাদের ধারণা ছিল, মানিকদার মা-বাবা, ভাই-বোন ইত্যাদি সম্পর্কের লোক থাকলেও তারা অনেক দূরে কোথাও আছে, মানিকদার মুখে কোনোদিন তাদের কথা শোনা যায়নি। মানিকদার মতন লোক কোনেদিন বাজার করে না, গেঞ্জি কেনে না, কোনদিন কোথায় কী খাবে তা নিয়ে চিন্তা করে না।

মানিকদা বলে চললেন, আমি গিয়ে দেখি, আমার চেনা বুড়ো লোকটি নেই, তার জায়গায় একটি নতুন ছেলে, খদ্দের নেই বলে সে এক মনে একটা বই পড়ছে। তোমরা ইমাজিন করতে পারবে, কী বই সেটা? শশধর দত্তের মোহন সিরিজ নয়, আধুনিক সাহিত্যিকদের কোনো ট্র্যাশও নয়, ও পড়ছিল, একটা কবিতার বই, সুকান্ত ভট্টাচার্যর ‘ছাড়পত্র’। যাস্ট থিংক অ্যাবাউট ইট। ফুটপাথের একটা গেঞ্জির দোকানের কর্মচারি সুকান্তর কবিতা পড়ছে। তা হলে সুকান্তর কবিতা কতখানি ছড়িয়েছে। সেটাই তো দরকার। মাইকেল মধুসূদন বউবাজারের এক মুদিকে নিজের কবিতার বই পড়তে দেখে যে রকম থ্রিলড হয়েছিলেন, আমারও প্রায় সেই রকম অবস্থা। সুকান্ত বেঁচে থাকলে… সুকান্ত আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, তার কবিতা আমি আমার নিজের…

সুকান্ত ভট্টাচার্য যে মানিকদার বন্ধু ছিলেন তা এ ঘরে উপস্থিত সবাই জানে। মানিকদা অনেকবার বলেছেন। বাবলু আগে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কোনো কবিতা পড়েনি, সে কবিতা-টবিতা পড়তে ভালোবাসে না, সে এখানে আসবার পরই কয়েকবার সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার আবৃত্তি শুনেছে কয়েকজনের মুখে।

পমপম বললো, মানিকদা, আমরা ওর মুখে একটা কবিতার আবৃত্তি শুনবো।

মানিকদা হাত তুলে বললেন, পরে, পরে, পমপম, অধৈর্য হচ্ছিস কেন? খানিকপরে কবিতার সেশান হবে। তার আগে সবটা শোন্? ওর হাতে সেই বই দেখে আমি প্রথমেই ভেবেছিলুম ওকে জড়িয়ে ধরবো। নিজেকে অতিকষ্টে সংযত করেছি। আস্তে আস্তে ওর সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললুম। ফ্যান্টাস্টিক ছেলে। কী মনের জোর। আমরা এখানে যারা বসে আছি, ইনকুডিং মাইসেলফ বলছি, আমাদের সবার চেয়ে ও অনেক বেশি স্ট্রাগল করেছে। বেশ কয়েকদিন ওর সঙ্গে মিশে, ওকে ভালো করে চেনবার পর একদিন জিজ্ঞেস করলুম, তপন, তুমি আমাদের স্টাডি সার্কেলে যাবে? ও রাজি হয়ে গেল। তাই ওকে আজ নিয়ে এসেছি। নাও, হিয়ার হি ইজ। তপনকে নিয়েই আজ আমাদের মেইন আলোচনা হবে। তার আগে, ওর ব্যাকগ্রাউণ্ডটা জানা দরকার। সেটা তপন নিজেই বলবে। তপন, এখানে লজ্জাটজ্জা পাবার কারণ নেই, এখানে সবাই তোমার বন্ধু, তুমি নিজের কথা কিছু শোনাও।

তপন মুখ তুলে বললো, কী বলবো, মানিকদা? নিজের কথা…মানে…আপনিই তো বলে দিলেন…

মানিকদা বললেন, আমরা তোমার সম্পর্কে সব কিছু জানতে চাই। এখানে যারা নিয়মিত আসে, তাদের প্রত্যেকের নাড়ি-নক্ষত্র আমরা সবাই জানি। তুমিও জানতে পারবে। তুমি কোথা থেকে শুরু করবে, সেটা বুঝতে পারছে না তো? তাহলে, আমরা সবাই মিলে তোমাকে প্রশ্ন করব, এটাকে জেরা বলে ভেবো না। আমরা সবাই সবাইকে ভালো ভাবে জানতে চাই। এই, তোমরা প্রশ্ন করার জন্য তৈরি হও। প্রথম প্রশ্নটা আমিই করছি। তপন, তুমি সবাইকে বলল, তুমি কোথায় থাকো। একটু ডিটেইলসে বললো।

তপন বললো, আমি দমদমে নাগের বাজারের কাছে থাকি। জায়গাটার নাম ক্লাইভ কলোনি। ঐখানে লর্ড ক্লাইভের বাগান বাড়ি ছিল। লর্ড ক্লাইভ মানে যিনি ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথম দিকে…যিনি পলাশীর যুদ্ধে মুর্শিদাবাদ থেকে সব ধনরত্ন লুঠ করে এনে…

মানিকদা আবার বাধা দিয়ে বললেন, আমরা লর্ড ক্লাইভ বিষয়ে জানি, তুমি তোমার থাকার জায়গাটা সম্পর্কে বলো। তুমি কি লর্ড ক্লাইভের বাড়িতেই থাকো?

এতক্ষণ পরে তপন ফিকে ভাবে একটু হাসলো। তারপর বললো, না, আমি সে বাড়িতে থাকি না। জায়গাটার নাম ক্লাইভ কলোনি হলেও আসলে সেটা এখন একটা রিফিউজি কলোনি। আমি সেখানে আমার জ্যাঠামশাইদের সাথে থাকি।

–পাকা বাড়ি, না মাটির বাড়ি?

–পাকা বাড়ি মানে কি ইটের? না, ইটের বাড়ি না, চ্যাঁচার বেড়ার ওপরে মাটি ল্যাপা, আগে খড়ের ছাউনি ছিল, গত বর্ষায় টিন দেওয়া হয়েছে। এখন আর জল পড়ে না।

–কটা ঘর? ক’জন থাকো।

–দুইটা ঘর। ফেমিলি মেম্বার নয়জন।

মানিকদা পেছন ফিরে খানিকটা বিরক্তভাবে বললেন, তোমরা আর কেউ কোনো প্রশ্ন করছো না কেন? আমাকে একলাই সব বলতে হচ্ছে।

বাবলু এবার হাত তুলে বললো, আমার একটা প্রশ্ন আছে। তপনবাবুর বাড়ি আগে কোথায় ছিল? উনি রিফিউজি কলোনিতে থাকেন বললেন…।

তপন কিছু উত্তর দেবার আগেই মানিকদা বললেন, ওসব বাবু টাবু চলবে না। শুনলেই আমার গা জ্বালা করে। হয় ওকে তোমরা তপনদা বলবে, নয় শুধু নাম ধরে ডাকবে। তপন, তুমি উত্তর দাও প্রশ্নটার।

তপন বললো, আমাদের বাড়ি আগে ছিল কুমিল্লায়। আপনারা কেউ সরাইল-এর নাম শুনেছেন। সেই সরাইলে ছিলাম আমরা।

অনুপম বললো, আমার বাবা-মার মুখে শুনেছি, আমাদের বাড়ি ছিল কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আমি অবশ্য সেখানে কখনো যাইনি। তার কাছে?

তপন বললো, খুব দূরে না। পাকিস্তান হবার পরও আমরা মোটামুটি ছিলাম। আমি সেখানে মেট্রিক পর্যন্ত পড়েছি। কিন্তু আমার বাবা ছিল খুব তেজী মানুষ, একবার জমি নিয়ে এক গণ্ডগোলে থানার দারোগার সাথে ঝগড়া হলো, সেই থেকে আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম, তারপর আমার বাবা খুন হলো, আমাদের বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিল।

অনুপম বললো, তারপর আপনারা চলে এলেন?

তপন বললো, আসতে বাধ্য হলাম। আমি আসতে চাই নাই। আমি ঢাকায় থেকে পড়াশুনা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উপায় তো নাই। কে আমার খরচ দেবে? বাবা মারা গেলেন… জ্যাঠামশাই আগেই চলে এসেছিলেন এই দ্যাশে, মায়েরে নিয়ে আমারেও চলে আসতে হলো।

হঠাৎ যেন তপনের চোখে ঘনিয়ে এলো স্মৃতির মেঘ। সে চুপ করে গিয়ে তার থুতনি ঠেকালো বুকে।

মানিকদা বললেন, এরকম ঘটনা আমরা অনেক শুনেছি। কিন্তু এক্সট্রা অর্ডিনারি ব্যাপার হলো, পায়ে হেঁটে বর্ডার ক্রশ করে, রিফিউজি কলোনিতে জ্যাঠামশাইয়ের আশ্রয়ে থেকেও তপন হার স্বীকার করেনি। তাই না, তপন? তুমি এখানে এসেও কী করে লেখাপড়া চালালে।

তপন আবার মুখ তুললো, এবারে তার কণ্ঠস্বর বেশ গম্ভীর। সে বললো, মাইগ্রেশান সার্টিফিকেট পেতে বেশ অসুবিধা হয়েছিল। একটা বছর নষ্ট হয়ে গেল। তারপর আমি কলেজে ভর্তি হতে গেলে জ্যাঠামশাই রাজি হন নাই। আমাদের নাগেরবাজারে থাকেন প্রফেসার পি চ্যাটার্জি, তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আমাকে হাফ ফ্রি করে দিতে পারবেন বললেন, তাঁরও বাড়ি ছিল কুমিল্লায়–আমি শিয়ালদা বাজারে কিছুদিন ডিম বিক্রি করেছি, তাতে যাতায়াতের ভাড়াটা উঠে যেত…কিন্তু গ্রেজুয়েট হয়েও কোনো লাভ হলো না, কোথাও চাকরি পাই না, এম. এ. পড়ার কোশ্চেন নাই, অনেক খরচ, এদিকে চাকরিও জোটে না। তাই জ্যাঠামশাইয়ের দোকানে এখন মাঝে মাঝে বসি। আপনারাই বলেন, গেঞ্জি বিক্রি করার জন্য কি বি এ পাশ করা কোনো কাজে লাগে?

অনুপম জিজ্ঞেস করলো, কেন, রিফিউজিদের জন্য তো আলাদা কোটা আছে শুনেছি। তাতেও আপনি চাকরি পেলেন না?

মানিকদা হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন, শাট আপ। অনুপম, তুই কোটার কথা বলছিস, তোর লজ্জা করে না? মানুষে মানুষে আর এ রকম কত শ্রেণী বিভাগ হবে?

তপন তবু মুখ উঁচু করে অনুপমের উদ্দেশে বললো, হ্যাঁ, কোটা আছে। যে অফিসে পাঁচজনের কোটা আছে, সেখানে দেড়শো জন রিফিউজি অ্যাপ্লাই করে। তাদের মধ্যে পঁচাত্তরজনই ওভার কোয়েলিফাইড। জানেন তো, যারা আমাদের মতন রিফিউজি না, যাদের বাপ-ঠাকুদার দেশ ছিল পূর্ববঙ্গে, এদেশে অনেক দিন আছে, বাড়ি ঘর আছে, তারাও এখন রিফিউজি সেজে গভর্নমেন্টের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিতে চায়।

এই সময় রাধা কেবিনের এক ছোঁকরা এলো কেটলিতে চা আর কিছু ভাঁড় নিয়ে। ছেলেটির বয়েস চোদ্দ-পনেরোর বেশি না, বেশ নাদুশনুদুশ চেহারা, সে এসেই ভারিক্কিভাবে চ্যাঁচায়। চা লিন। তাড়াতাড়ি করুন। দু টাকা ষাট নয়া, পয়সাটা দিয়ে দিন আগে।

স্টাডি সার্কেলের সদস্যদের প্রত্যেক জমায়েতে চল্লিশ নয়া করে চাঁদা দিতে হয়, সেই পয়সা জমা হয় একটি ভাঁড়ে। পমপম তার থেকে চায়ের দাম মিটিয়ে দিল।

চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে মানিকদা আর একাট বিড়ি ধরালেন। কেউ সিগারেট দিলেও তিনি নেন না। অবশ্য, অন্যান্য সদস্যদের তিনি ইচ্ছেমতন বিড়ি-সিগারেট খাবার অনুমতি দিয়ে রেখেছেন। এখানে বয়েসের ব্যবধানকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

মানিকদা আবার দু’বার হাত তালি দিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে বললেন, এতক্ষণ তোমরা তপন সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা করতে পেরেছো। এবারে অরিজিনাল প্রশ্নে ফিরে আসা যাক। আজ তপনকে কেন্দ্র করেই আমাদের আলোচনা হবে। তপন, তুমি বলো, দেশ বলতে তুমি কী বোঝে।

তপনের লাজুকতা অনেকটা কেটে গেছে। অনুপমের কাছ থেকে পাওয়া একটা সিগারেট প্রায় শেষ করে এনেছে, সে খানিকটা দুঃখী দুঃখী গলায় বললো, মানিকদা, দেশ বলতে এখনো আমি কুমিল্লার সেই সরাইলকেই বুঝি। মাপ করবেন! এখনো ইণ্ডিয়ায় আছি, কিন্তু প্রায়ই সরাইলের স্বপ্ন দেখি। যা সত্যি, তাই বললাম। পাকিস্তান হবার পরও আমরা সেদেশে ছিলাম, পাকিস্তানকেই নিজের দেশ বলে মেনে নিয়েছিলাম, কোনোদিন চলে আসতে হবে ভাবিনি, যে বাড়িতে জন্মেছি, যে পুকুরে সাঁতার শিখেছি, যে রাস্তা ধরে রোজ ইস্কুলে গেছি, তা কি কেউ সহজে ছেড়ে আসতে চায়? তবু ছেড়ে আসতে হয়েছে…এখন ইণ্ডিয়াতে আছি, রিফিউজি কলোনিতে… বি এ পাশ করেও চাকরি পাই না, বাসে-ট্রামে বেশি ভিড় হলে, “শালা বাঙালদের জন্য দেশটা উচ্ছন্নে গেল। এই কথা শুনতে হয়, তবু আমি বলবো, এখন ইণ্ডিয়াই আমার দেশ।

অনুপম জিজ্ঞেস করলো, পাকিস্তানে থাকলেও কি আপনি বি এ পাশ করলেই চাকরি পেতেন? সে দেশে বেকার নেই?

তপন বললো, তা আছে। কিন্তু সেখানে আমাদের বাড়ি-জমি ছিল, ভাত কাপড়ের অভাব ছিল না, রিফিউজি বলে পদে পদে লাথি ঝাঁটা খেতে হতো না। আপনারা তো দেশ ভাগের ফল ভোগ করেননি…

মানিকদা রেগে গিয়ে বললেন, আঃ, অনুপম, তুই আলোচনাটা বড্ড মানডেন দিকে নিয়ে যাচ্ছিস। এসব কথা তো বহুবার শোনা হয়ে গেছে। আমরা এর থেকে অনেক বড় ব্যাপার নিয়ে… তপন, তুমি আমার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারোনি। তুমি পাকিস্তানের সিটিজেন না ইণ্ডিয়ার সিটিজেন, সেটা এমন কিছু ইমপটান্ট ব্যাপার নয়। দেশ বলতে আমি কোনো জিওগ্রাফিক্যাল বাউণ্ডারির কথা জিজ্ঞেস করছি না। দেশ নামে একটা ভাবমূর্তি তো আছে। তোমার কাছে সেটা কী রকম? সে কি বঙ্কিমের “সুজলাং সুফলাং শস্য শ্যামলাং মাতরম্।” না কি, রবি ঠাকুরের “নমো নমো নমো সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি”, নাকি ডি এল রায়ের “সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।”

তপন বেশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে সবার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে ও মানিকদা ছাড়া আটটি যুবক ও তিনটি যুবতী রয়েছে এই ঘরে। যুবতীদের দিকেই চলে যাচ্ছে তার চোখ, কারুর সঙ্গে চোখাচোখি হলেই সে মুখ নামিয়ে নিচ্ছে। এখন সবাই চেয়ে আছে তার দিকে।

সে বললো, যে-দেশেই থাকি, সব সময়ই দেশ আমার কাছে মায়ের মতন। নীল আকাশ, সবুজ ধান খেত, নদীর ধারে কাশ ফুল ফুটে আছে…

মানিকদা উঁচু গলায় হেসে উঠলেন। তারপর অন্যদের দিকে ফিরে বললেন, দ্যাখো, এই একটা টিপিক্যাল উদাহরণ, এই ছেলেটি এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছে, তবু পুরোনো সংস্কার ছাড়তে পারেনি। দেশকে মা বলা কিংবা বাবা বলা একটা পুরোনো সামন্ততান্ত্রিক এবং বুর্জোয়া কনসেন স্বার্থপর শ্রেণী নানারকম গানে ও কবিতায় এই সেন্টিমেন্টাল ইমেজটা বাঁচিয়ে রাখতে চায়।

তপনের দিকে ফিরে তিনি ধমকের সুরে বললেন, নীল আকাশ, সবুজ ধান ক্ষেত, কাশ ফুলের আড়ালে আড়ালে সর্বক্ষণ কী উঁকি মারছে তা তুমি দেখোনি। সেদিন সুকান্তর ছাড়পত্র পড়ছিলে, সুকান্তর কবিতা তোমার মনে পড়লো না?

“এখানে মৃত্যু হানা দেয় বার বার
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার
এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ, স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু মেলেছে এখানে ঘাঁটি;
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন ভাঙা নৌকোর পাল…”

শোনো তপন, দেশ বলে আলাদা কিছু নেই। এই পৃথিবীটাই সব মানুষের দেশ। আজও এই পৃথিবীতে দুটিই মাত্র জাতি আছে। হিন্দু-মুসলমান, খৃষ্টান-বৌদ্ধ, এই সব আলাদা আলাদা জাত-পাঁতের ভাগও কৃত্রিম। শোষক ও শোষিত ছাড়া আর কোনো জাত নেই। তুমি হিন্দু বলে পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানে ধনী মুসলমানরা কি গরিব মুসলমানদের শোষণ করে না? তুমি হিন্দু হয়ে এদেশে পালিয়ে এসেছে বলে কি এদেশের ধনী হিন্দুরা তোমাদের আদর করে বুকে টেনে নিয়েছে? শোষক আর শোষিত ছাড়া আর কোনো জাত নেই। নিজেকে হিন্দু ভেবো না, মুসলমান ভেবো না, এগুলো ভুল। তুমি আর হুগলি জেলার চাষী রহিম শেখ একই শ্রেণী, একই রকম শোষিত। পৃথিবীতে একদিন শোষণ ও শোষিত শ্ৰেণীর লড়াই হবে, ওরা হারবে, ওরা হারতে বাধ্য, তারপর যখন একটাই শ্ৰেণী থাকবে তখনই সত্যিকারের পৃথিবীটা হবে আমাদের দেশ। আমাদের মাতৃভূমি বা পিতৃভূমি যাই-ই বলো।

এই বক্তৃতায় খুব বেশি বিচলিত না হয়ে তপন শান্তভাবে বললো, এই সব কথা আমি আগেও শুনেছি। কিন্তু এই লড়াইটা কী করে হবে, মানিকদা? যারা অত্যাচারী, যাদের আপনি শোষক বললেন, তাদের হাতেই যে সব অস্ত্রশস্ত্র। তারা সুবিধাভোগী, তারা দাবি ছাড়বে কেন।

মানিকদা এবারে অনুপমের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি বেশি কথা বলে ফেলছি। এটা বক্তৃতার জায়গা নয়, স্টাডি সার্কেল। সবাইকে আলোচনায় অংশ নিতে হবে। অনুপম, তুমি এবার তপনের প্রশ্নের জবাব দাও।

অনুপম বললো, শোষকদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র আছে তা ঠিকই কিন্তু শোষিতরা সংখ্যায় বেশি। অনেক বেশি। একদিন তারাও যে যা পারবে অস্ত্র তুলে নেবে। তারা স্বার্থপর নয়, সেই জন্যই তারা জিতবে। তবে লড়াইটা একদিনে আরম্ভ হয়ে একদিনেই শেষ হবে না। লড়াই শুরু হয়ে গেছে, চলবে অনেকদিন।

বাবলুর পাশ থেকে কৌশিক বলে উঠলো, এ লড়াইতে নেতৃত্ব দেবে কে? চীন না রাশিয়া?

দারুণভাবে আহত হবার মতন মুখ বিকৃত করে মানিকদা বললেন, প্লিজ, তোমাদের কতবার বলেছি, রাশিয়ার নাম উচ্চারণ করো না। ওরা বিপ্লবের পথ থেকে সরে গেছে। ওরা শোধনবাদী। এদেশে ওরা বুর্জোয়া-ন্যাশনালিস্ট সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেছে। এর পর ওরা আমেরিকার সঙ্গে হাত মেলাবে। ওদের কথা বলো না। প্রোলেতারিয়েত দুনিয়ার একমাত্র ভরসা হলো চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর চীন।

তপন বললো, কিন্তু মানিকদা, চীন তো আমাদের ইণ্ডিয়া আক্রমণ করেছিল গত বছর। ইণ্ডিয়াও একটা গরিব দেশ, তবু কেন চীন অ্যাটাক করলো।

মানিকদা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, তপন, তুমি কয়েক বছর আগে মাত্র পাকিস্তান থেকে এসেছো, রিফিউজি কলোনিতে কষ্ট করে থাকো, তবু এর মধ্যেই ইণ্ডিয়া তোমার কাছে “আমাদের ইণ্ডিয়া” হয়ে গেল? শোনো, চীন কখনো ইণ্ডিয়া অ্যাটাক করতে পারে না, করেনি। ওটা জওহরলাল নেহরু দেশের লোককে ধোঁকা দিয়েছে। দেশের ইন্টার্নাল সমস্যা চাপা দেবার জন্য একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস সৃষ্টি করতে চেয়েছে। যুদ্ধটা নিজে থেকেই কে থামালো, চীন থামায়নি? কখনো শুনেছো, যে-দেশ যুদ্ধে জিতছে, সেই দেশ নিজে থেকেই সীজ-ফায়ার ডিক্লেয়ার করে? গত বছর চীন ইণ্ডিয়ার মধ্যে ঢুকে এসেও তাই-ই করেছে। কেন? কারণ, চীন মিলিটারি ভিকট্রিতে বিশ্বাস করে না। এই চীনই এখন সারা দুনিয়ায়…

হঠাৎ এই সময় ঘরের মধ্যে ঢুকে এলেন পমপমের বাবা অশোক সেনগুপ্ত। সাদা পাঞ্জাবি ও ধুতি পরা, মাথার চুলে পাক লাগায় তাকে এই পোষাকে বেশ সৌম্য দেখায়। তিনি একজন বামপন্থী নেতা, এই স্টাডি সার্কল তাঁরই দাক্ষিণ্যে খোলা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে দেখেই মানিকদা থেমে গেলেন।

অশোক সেনগুপ্ত উদারভাবে বললেন, এই যে মানিক, তোমাদের চলছে এখনো? কিন্তু সাতটার সময় যে আমাদের একটা সেল মিটিং আছে এখানে?

মানিকদা হাসিমুখে বললেন, সাতটার তো দেরি আছে। আমরা উঠে যাবো একটু বাদে। অশোকদা, বসুন না।

কৌশিক ফিসফিস করে বাবলুকে জিজ্ঞেস করলো, চল, এবার উঠবি?

বাবলুর আরও একটু বসার ইচ্ছে ছিল। সে লক্ষ্য করেছে, পমপমের বাবা অশোক সেনগুপ্তর সঙ্গে ইদানীং মানিকদার একটুও মনের মিল নেই। তিনি এই জায়গাটার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বটে কিন্তু তাঁর সঙ্গে প্রায়ই মানিকদার কথা কাটাকাটি হয়। সেই তর্ক বাবলুর শুনতে ভালো লাগে।

কিন্তু আজ বাবলুকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। সে উঠে পড়ে কৌশিককে বললো, চল্।

মানিকদা তাদের দিকে ফিরে বললেন, অতীন আর কৌশিক, তোমরা একটু তপনকে এগিয়ে দাও। খুব যদি কাজ না থাকে, তা হলে কোনো পার্কে বসে তোমরা ওর সঙ্গে আর একটু কথা বলো। ওকে বুঝতে, বোঝাবার চেষ্টা করো।

এটা অনুরোধ নয়, আদেশ। বাবলু ও কৌশিক তা বোঝে। তারা সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানালো।

পেছন থেকে পমপম বললো, আমাকে একবার শ্যামবাজার যেতে হবে, আমিও যাবো ওদের সঙ্গে। এই, তোরা একটু দাঁড়া…

তপনকে নিয়ে ওরা তিনজন বেরিয়ে এলো রাস্তায়। বাবলু লক্ষ করলো, এই সন্ধের সময়ে বাড়ি থেকে বেরুবার জন্য পমপম তার বাবার অনুমত নিল না। পমপম সব ব্যাপারেই নিজেকে ছেলেদের সমান সমান বলে মনে করে। এই সময় কখনো বাড়ি থেকে বেরুলে বাবলুও তার মাকে বলে যায়। পমপমের অবশ্য মা নেই।

বাইরে ঝোড়ো বাতাস বইছে, রাস্তা ঘাট অনেকটা ফাঁকা। শ্যামবাজারের দিকে না গিয়ে ওরা মানিকতলা ব্রীজের মাঝখানে দাঁড়ালো ঝড় দেখবে বলে। পমপম ঝড় দেখতে ভালোবাসে। বাতাসের বেগ একই রকম রইলো, কিন্তু ঝড় উঠলো না। ওরা আড্ডা দিতে লাগলো

অনেকক্ষণ ধরে। তপনের আড়ষ্টতা কিছুতেই কাটছে না দেখে এক সময় পমপম তপনের একটা হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে অদ্ভুত ভাবে হেসে বললো, আমাদের কথাবাতা তোমার অপছন্দ হচ্ছে না তো?

তপন প্রবল ভাবে দু দিকে মাথা নাড়লো।

পমপম বললো, অন্ধকারে মাথা নাড়া দেখে কি হ্যাঁ-না বোঝা যায়? মুখে বলতে হয়। তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যেও না যেন। আজ থেকে তুমি আমাদের দলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *