1 of 2

২.১৫ বৃষোৎসর্গ

বৃষোৎসর্গ! সুবোধচন্দ্ৰ হাসলেন, অত বড় ফর্দ করে বসবেন না ভটাচাৰ্য মশাই। তেমন রেস্তওলা যজমান যে আপনার আমি নই, সে কথা। আপনিও ভালই জানেন। আমার ওই ষোড়শ পর্যন্তই, ব্যস।

ভটচার্য ক্ষুণ্ণভাবে বলেন, বহু প্রাচীন হয়েছিলেন তিনি, চারকুড়ির কাছে বয়েস হয়েছিল, তাই বলা। তাছাড়া তুমি তেমন উপায়ী না হলেও তাঁর আরও তিন ছেলে রয়েছে রোজগারী, নাতিরাও সব কৃতী হয়ে উঠেছে–

সুবোধচন্দ্র বাধা দিলেন, ওর সবই আমি জানি ভটচায মশাই, তবু আমার যা ক্ষমতা, আমি সেই মতই চলবো।

তুমি জ্যেষ্ঠ, শ্ৰাদ্ধাধিকারী—

সে নিয়মকানুন তো সবই পালন করছি—

তা জানি, তোমার নিষ্ঠাকাষ্ঠা সবই শুনলাম তোমার কন্যার কাছে। এযুগে এতটা আবার সবাই পারে না।

ওকথা থাক ভটচায মশাই, আপনি ওই একটা ষোড়শের ফর্দ দিন।

একটা? ভটচায আহত গলায় বলে ওঠেন, চার ভাই চারটে ষোড়শও করবে না? আর নাতিরা এক-একটা ভুজ্যি—

আমি আমার কথাই বলছি। ভটাচায মশাই, আপনি বুঝতে পারছেন না কেন তাই আশ্চর্য!

ভটচায তবু নাছোড়বান্দা গলায় বলেন, জানে তোমাদের হাঁড়ি ভিন্ন, তৎসত্ত্বেও মাতৃশ্ৰাদ্ধের সময় একত্র হয়ে করাই শাস্ত্রীয় বিধি। যার যা সাধ্য, তুমি বড় তোমার হাতে তুলে দেবে, তুমি সৌষ্ঠব করে-

সুবোধচন্দ্ৰ এবার হেসে ওঠেন।

হেসেই বলেন, শাস্ত্রীয় বিধিটাই জানেন ভট্যচায মশাই, আর একথা জানেন না, ভাগের মা গঙ্গা পায় না! কেন আর বৃথা সময় নষ্ট করছেন? আমার ফর্দটা ঠিক করে দিন, সময় থাকতে—

ভটচার্য বিদায় নিলে সুবল এসে দাঁড়ায়।

বলে, জ্যাঠামশাই, মা একটা কথা বলছেন।

মা!

সুবোধচন্দ্র একটু নড়েচড়ে বসলেন। সুবলের মার আবার বক্তব্য কি!

ঘাটকামান না হওয়া পর্যন্ত প্ৰবোধকে আর সুবৰ্ণলতাকে এ বাড়িতেই থাকতে হয়েছে, পাড়াপ্রতিবেশী জ্ঞাতিগোত্রের এই নির্দেশ।

তাই বকুলকে নিয়ে এ বাড়িতেই রয়েছে সুবর্ণ, ছেলেরা যাওয়া-আসা করছে। এদিকে তো চাঁপা এসেই গেছে, চন্নন পারুল ওরাও আসবে শ্রাদ্ধের দিন।

সে যাক, ওসব ব্যবস্থাপনার মধ্যে সুবোধ নেই। সুবৰ্ণ যে রয়েছে। এ বাড়িতে, তাও ঠিকমত জানে কিনা সন্দেহ। কাজেই মা আপনাকে একটা কথা বলবেন শুনে সন্দিগ্ধ গলায় বলেন, কি কথা!

সুবল মাঝখানে শিখণ্ডিস্বরূপ থাকলেও সুবৰ্ণলতার কণ্ঠটাই স্পষ্ট শোনা গেল, মার চার ছেলে বর্তমান, নাতিরাও অনেকেই কৃতী হয়ে উঠেছে, মার তো বৃষোৎসর্গ হওয়াই উচিত।

সুবোধচন্দ্র অবশ্য তাঁদের বাড়ির মেজবৌকে কোনদিনই লজ্জাশীলা মনে করেন না, কাজেই এই স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে খুব একটা অবাক হন না। তবে বোধ করি একটু বিচলিত হন। গম্ভীর গলায় আস্তে বলেন, উচিত সে কথা জানি মেজবৌমা, কিন্তু ক্ষমতা বুঝে কথা। আমার ক্ষমতা কম।

এবারে সুবলের মাধ্যমেই কথা হয়, মা বলছেন, তা হোক আপনি এগোন, আপনার পেছনে সবাই আছে।

আমার পিছনে-, সুবোধচন্দ্রের গলাটা যেন কাঁপা-কোপা আর ভাঙাভাঙা শোনায়, আমার পিছনে কেউ নেই সুবল, শুধু সামনে ভগবান আছেন, এইটুকু তোর মাকে বলে দে বাবা। গতকাল এসব আলোচনা হয়ে গেছে, আমার তিন ভাই-ই সাফ জবাব দিয়ে গেছে, তিরিশ টাকা করে দেবে, তার বেশি দিতে পারবে না। আমার অবস্থাও তদ্রপ। কাজেই ও নিয়ে আর-তোর মাকে বাড়ির মধ্যে যেতে বল সুবল।

এটা অবশ্যই বাক্যে যবনিকা পাতের ইশারা।

তত্ৰাচ সুবৰ্ণলতা যবনিকা পাত করতে দেয় না।

হয়তো প্ৰবোধের এই নীচতলার খবরে এখনো নতুন করে বিস্ময়বোধ করে, তাই কথা বলতে একটু সময় যায়, আর বলে যখন তখন গলায় স্বরটা প্ৰায় বুজে আসার মত লাগে, তবু বলে, সুবল, বল-জ্যাঠামশাই, মার একটা মিনতি রাখতেই হবে।

মিনতি!

রাখতেই হবে!

সুবোধচন্দ্র বিব্রত বোধ করেন।

চিরকেলে পাগলা মানুষটা কি-না-কি আবদার করে বসে!

কে জানে কি সঙ্কল্প নিয়ে এমন তোড়জোড় করে তার দরবারে এসে হাজির হয়েছে! মুহূর্তের মধ্যেই অবশ্য এসব চিন্তা খেলে যায়। পরমুহূর্তে সুবোধের কণ্ঠ থেকে প্রায় হাসির সঙ্গে উচ্চারিত হয়রত্নতই হবে! তোর মার যে এটা সাদা কাগজে সেই করিয়ে নেবার মত ইচ্ছে রে সুবল কি বল শুনি?

মা নিজেই বলছেন—

বলে সুবল সরে দাঁড়ায়।

গুণ্ঠনবতী সুবৰ্ণলতা তার পাশ দিয়ে এসে দাঁড়ায়, আর ছেলেকে এবং ভাসুরকে প্রায় তাজ্জব করে দিয়ে মৃদু চাপা স্বরে বলে ওঠে, সুবল, তুই একটু অন্যত্র যা তো বাবা-

সুবল তুই অন্যত্র যা!

তার মানে ভাসুরের সঙ্গে একা নির্জনে কথা বলতে চায়!

এর চাইতে অসম্ভব অসমসাহসিকতা আর কি হতে পারে?

সুবোধচন্দ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান, কি যেন বলতে চান। সুবল চলে যায় আস্তে আস্তে, আর সুবৰ্ণ এগিয়ে এসে ভাসুরের পায়ের কাছে কিছু জিনিস ফেলে দিয়ে মৃদু দৃঢ়স্বরে বলে, এগুলো নিতে হবে আপনাকে এই মিনতি। আপনার নিজের বলে মনে করে বেচে দিয়ে ইচ্ছেমত ভাবে খরচ করে। মার কাজ করুন।

সুবোধ যেন সাপের ছোবল খেয়েছেন।

সুবোধ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে সেই উজ্জ্বল স্বর্ণখণ্ডগুলির দিকে তাকিয়ে গভীর হাস্যে বলেন, এ তো মিনতি নয়। মেজবৌমা, হুকুম। কিন্তু সে হুকুম পালন করবার ক্ষমতা আমার নেই মা। তুমি আমায় মাপ কর।

গলার মোটা হেলে হার!

হাতের চুড়ির গোছা!

সুবৰ্ণ সেই বস্তুগুলোর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বলে, এ তো শুনেছি স্ত্রীধান, এতে নাকি স্বামীপুতুদের কোনো দাবি থাকে না। তবে আপত্তি কিসের?

সুবোধ এবার আরো ভারী গলায় বলেন, এ তুমি কি বলছো মেজবৌমা! তোমার গায়ের গয়না বেচে মাতৃশ্ৰাদ্ধ করবো। আমি? গরীব বলে কি-

চড়িয়ে ঘুরে বেড়াবে, এটাও তো অনিয়ম!

অনিয়ম!

সুবোধচন্দ্ৰ যেন একটু চমকান, তারপর একটু হেসে বলেন, অনিয়ম তো জগৎ জুড়ে মা, চন্দ্রসূর্যের নিয়মটা আছে বলেই আজো পৃথিবীটা টিকে আছে। কিন্তু সেকথা থাক, তুমি এগুলো উঠিয়ে নিয়ে যাও মা। তুমি যে দিতে এসেছিলে, এতেই তাঁর আত্মার তৃপ্তি হয়ে গেছে।

তাঁর হতে পারে, কিন্তু আমাদেরও তো তৃপ্তি শান্তি হওয়া চাই। আপনার পায়ে পড়ছি, এটুকু আপনাকে করতেই হবে। মনে করুন। এ টাকা আপনার, তা হলেই তো সব চিন্তা মুছে যাবে। মার কুপুত্ৰ ছেলেরা টাকা হাতে থাকতেও নেই বলেছে, সে পাপের প্রায়শ্চিত্তেরও তো দরকার। আমি যাচ্ছি, এ আর আপনি অমত করবেন না। যদি অমত করেন, যদি না নেন, তাহলে বুঝবো আমি পতিত তাই—, গলার স্বরটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় সুবর্ণর। আমি চাই বলে নীচু হয়ে গলায় আঁচল মুড়িয়ে একটি প্ৰণাম রেখে তাড়াতাড়ি উঠে চলে যায় সুবর্ণ, সুবোধকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে।

সুবোধ হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন।

সুবোধ এখন এই সোনার তালগুলোকে নিয়ে কি করবেন?

তা শেষ পর্যন্ত সেগুলো নিলেন সুবোধচন্দ্র।

সুবৰ্ণলতার ওই রুদ্ধকণ্ঠ হয়ে চলে যাওয়ার মধ্যে তিনি একটা পরম সত্য উপলব্ধি করলেন যেন।

সেই সত্য সব দ্বিধা মুছে দিল বুঝি।

সমারোহ করেই বৃষোৎসর্গ শ্ৰাদ্ধ হলো মুক্তকেশীর।

কে জানে তাঁর আত্মা সত্যই পরিতৃপ্ত হলো কিনা! তবু সুবোধ মনে করলেন হলো। সুবোধের মুখে রইল সেই পরিতৃপ্তির ছাপ।

যদিও আড়ালে আবড়ালে সবাই বলাবলি করতে লাগলো, সুবোধ কি রকম ভেতর চাপা! এই যে খরচটি করলো, টাকা তোলা ছিল বলেই তো! অথচ কেউ বুঝতে পেরেছে?

সে কথা প্ৰবোধ এসেও মহোৎসাহে বলে, দেখলে তো? চিরকাল দেখিয়ে এসেছেন যেন হাতে কিছু নেই!

সুবৰ্ণ একবার স্থিরদৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে, বেশ তো, হাতের টাকা তো মন্দ কাজে ব্যয় করেন নি, সদ্ব্যয়ই করেছেন! তা তোমার তো হাতে টাকার অভাব নেই, তুমি একটা সৎকাজ কুরু তোমার মায়ের একটা ইচ্ছে পালন কর না? অনেক কাঙালী খাওয়াও না? মার খুব ইচ্ছে ছিল।

প্ৰবোধ সচকিত হয়ে বলে, এ ইচ্ছে। আবার কখন তোমার কানে ধরে বলতে গেলেন মা? তুমি যখন গিয়ে পড়েছিলে, তখন তো বাকরোধ হয়ে গিয়েছিল।

ক্ষীণ একটু হাসলো সুবর্ণ।

বহুকাল পরে হাসলো।

বললো, না, এ ইচ্ছে প্ৰকাশ তখন করেন নি। যখন পুরোদস্তর বাক্যস্রোত ছিল, এ তখনকার কথা। তোমাদের ওখানের জগন্নাথ ঘোষের মা যখন মারা গেলেন, তখন কাঙালী খেয়েছিল মনে আছে? দেখে মা বলেছিলেন, আমি যখন মরবো, আমার ছেলেরা কি এমন করে কাঙালী ভোজন করাবে!

ওঃ, এই কথা! প্ৰবোধ ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়। বলে, জ্যান্ত থাকতে জন্মভোর অমন কত কথা বলে মানুষ! সে-সব ইচ্ছে পালন করতে গেলেই হয়েছে আর কি!

তা বেশ। ধরে যদি আমারই ইচ্ছে হয়ে থাকে!

প্ৰবোধ বিশ্বাস করে সেকথা। এটাই ঠিক কথা। তাই বলে, তোমার তো চিরদিনই এই রকম সব আজগুবী ইচ্ছে! শ্ৰাদ্ধ হয়ে গেল। সেখানে, এখন কাঙালী ভোজন হবে এখানে। ওসব ফ্যাচাং তুলো না। অত বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই।

তবে থাক! সুবৰ্ণ বলে, দরকার যখন নেই, ভালই হলো, তোমার ছেলেদের সুবিধে হলো। ভবিষ্যতে তাদেরও আর মেলাই বাজে খরচ করতে হবে না। মনে জানবে মা-বাপের শ্ৰাদ্ধার বেশি।

প্ৰবোধ এ ব্যঙ্গে জ্বলে উঠে বলে, ওঃ ঠাট্টা! ভারী একেবারে! আমার মার মরণকালের ইচ্ছে নিয়ে আমি কাতর হলাম না, উনি হচ্ছেন! বলি শাশুড়ীর ওপর ভক্তি উথলে উঠলো যে! এ ভক্তি ছিল কোথায়? চিরটা কাল তো মানুষটাকে হাড়ে-নাড়ে জুলিয়ে পুড়িয়ে খেয়েছ।

সুবৰ্ণ এ অপমানে রেগে ওঠে না, বরং হঠাৎ হেসে উঠে বলে, সত্যি বটে। স্মরণশক্তিটা আমার বড় কম। মনে করিয়ে দিয়ে ভালই করলে।

তারপর উঠে গেল।

সেই ওর ছাতের ঘরের কোটরে গিয়ে বসলো খাতাখানা নিয়ে।

কিন্তু খোতাখানা কি শুধু সুবর্ণর অপচয়ের হিসেবের খাতা?

সুবৰ্ণলতার জীবনের খাতাখানার মতই?

নইলে সুবর্ণর সেই খাতাখানার পাতা উল্টোলেই এই সব কথা চোখে পড়ে কেন?.

…মেয়েমানুষ হয়েও এমন বায়না কেন তোমার সুবৰ্ণ, তুমি সৎ হবে, সুন্দর হবে, মহৎ হবে! ভুলে যাও কেন, মেয়েমানুষ হচ্ছে একটা হাত-পা-বাধা প্ৰাণী! মানুষ নয়, প্রাণী! হাত-পায়ের বাঁধনটা যদি ছিঁড়তে যায়। সে তো হাত-পা-গুলো কেটে বাদ দিয়ে দিয়ে ছিঁড়তে হবে সে বাঁধন!…

কেন রেখা থাকে… তবু বাঁধন ছেঁড়ার সাধনটা চালিয়ে যেতে হবে তাকে। কারণ তাঁর বিধাতা ভারী কৌতুকপ্রিয়। তাই ওই হাত-পা-বাধা প্রাণী।মাত্রগুলোর মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ ঢুকিয়ে দিয়ে বসে থাকেন বুদ্ধি, চেতনা, আত্মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *