2 of 3

২.১৪ কয়েকদিন এড়িয়ে এড়িয়ে চলার পর

কয়েকদিন এড়িয়ে এড়িয়ে চলার পর অতীনকে একদিন প্রতাপের সামনে পড়তেই হলো। মা কিংবা পিসিমণিকে সে চেঁচিয়ে তর্কে হারিয়ে দিতে পারে কিন্তু বাবার সামনে সে মুখচোরা।

সপ্তাহের মাঝখানে কাজের দিন হলেও প্রতাপ সেদিন আদালতে যাননি। ঠাণ্ডা লেগে জ্বর জ্বর ভাব ও শরীর কিছুটা অবসন্ন হয়েছে। অফিসে না যাবার সিদ্ধান্ত নেবার পর প্রতাপ দাড়িও কামাননি, স্নানও করেননি, দুপুরের খাওয়া সেরে নিজের ঘরে বসে কাগজ পড়ছেন। মমতাকে বলে রেখেছেন, বাবলু ফিরলেই যেন দেখা করে তাঁর সঙ্গে। ইদানীং বাবলু সক্কালবেলা বেরিয়ে যায়, সারাদিন কোথায় থাকে ঠিক নেই। ফেরে রাত দশটা-সাড়ে দশটায়, মাঝখানে দুপুরে একবার খেতে আসে, এক একদিন তাও আসে না। বাড়ির শাসনের সীমা সে অতিক্রম করে গেছে! প্রতাপ খবর পেয়েছেন যে বাবলু এখন রাজনীতির হুজুগ নিয়ে মেতেছে।

আজ দুপুরে খেতে এসে বাবলু ধরা পড়ে গেল। বাবা ডেকেছেন, দেখা না করে উপায় নেই। বাইরে থেকে এসেই বাবলু গায়ের জামা ছুঁড়ে ফেলে স্নানের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল,মমতা গম্ভীর ভাবে বললেন, বাবার সঙ্গে আগে দেখা করে আয়। তোর জন্য আজ তোর বাবা অফিস যায়নি।

বাবলু ঘাড় গোঁজ করে একটুখানি থমকে দাঁড়ালো। তার পেটে খিদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। খিদে সে সহ্য করতে পারে না বেশিক্ষণ, বাস থেকে নেমে সে ছুটতে ছুটতে এসেছে। বাবা যখন বাড়িতে আছেনই, তখন স্নান করে খেয়ে নেওয়ার পর বাবার সঙ্গে কথা বলা যায় না! কিন্তু মায়ের গলার সুর অন্য রকম।

বাবলু বাবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো। প্রতাপ মন দিয়ে একটি পত্রিকা পড়ছেন। দু’ এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার পর বাবলু বললো, বাবা, তুমি আমায় ডেকেছো?

প্রতাপ চোখ তুলে বাবলুকে দেখলেন। প্রায় মাসখানেক তিনি তাঁর ছেলেকে ভালো করে দেখেননি। সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। বাবলুর খালি গায়ের দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন, ছেলেটার স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালোই হয়েছে, বুকখানা পেটানো। কিন্তু সারাদিন নিশ্চয়ই রোদ্দুরে টো-টো করে ঘোরে। চোখের নিচে কালো দাগ, মুখের রং পোড়া পোড়া, বোধ হয় দু’তিন মাস মাথার চুল কাটেনি।

প্রতাপ তাঁর বাবাকে অতিরিক্ত সমীহ করতেন। সেকালে যৌথ পরিবারের প্রধানরা ছিলেন গোষ্ঠি অধিপতির মতন প্রতাপশালী। প্রতাপদের আমলে বাবাকে আপনি বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ ছিল। বাবলু কি তাঁকে ভয় পায়? ছেলেটার চোখের পাতা ঘন ঘন পড়ছে। ছেলের সঙ্গে ভয় বা অতিরিক্ত সমীহর সম্পর্ক চান না প্রতাপ। যদিও বাবলু সম্পর্কে একটা চাপা রাগ ঘোরাফেরা করছে প্রতাপের মাথার মধ্যে, তবু তিনি সংযত হতে চাইলেন। যেজন্য তাঁর একটু সময় দরকার।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোর সারা গা দেখছি ঘামে ভিজে গেছে। তুই চান করিসনি?

বাবলু মাথা নেড়ে বললো, না।

প্রতাপ নরমভাবে বললেন, আগে চান করে আয়। খেয়ে নে। তারপর তোর সঙ্গে আমার কতকগুলো কথা আছে।

বাবলু তবু দাঁড়িয়ে থেকে বলল, পরে চান করতে যাবো। তুমি বলো না।

প্রতাপ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। পৌণে একটা বাজে। তিনি আবার বললেন, না, আগে খাওয়া-টাওয়া সেরে আয়।

বাবলু এবারে ফিরে গেল বাথরুমে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্নান সেরে সে রান্নাঘরের টেবিলে এসে বসলো। মুখে কোনো কথা নেই। যেন সে এ বাড়ির অতিথি, কেউ খাবার দিলে খাবে, নইলে খাবে না। মমতা তাকে নিঃশব্দে ভাত বেড়ে দিলেন। বাবলুর সঙ্গে কয়েকদিন তিনি ভালো করে কথা বলতে পারছেন না। অভিমান এক এক সময় মাতৃস্নেহকেও অতিক্রম করে যায়।

সুপ্রীতি আড়াল থেকে সব কিছু লক্ষ্য করছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে আজ পিতা-পুত্রে একটা সংঘর্ষ হবে। প্রতাপের মাথা গরম, ছেলেটাকে যদি মার ধোর শুরু করে তখন সুপ্রীতিকে বাধা দিতেই হবে। রাগের মুহূর্তে প্রতাপ মমতাকেও অগ্রাহ্য করতে পারে, কিন্তু এখনও সুপ্রীতিকে অমান্য করতে পারে না। বাবলু খাওয়া শেষ করে উঠে গেল, সুপ্রীতি দুঃখ পেলেন এই দেখে যে ছেলেটার আর একটু ভাত লাগবে কিনা, মমতা তা একবারও জিজ্ঞেস করলো না। অবশ্য একটু পরেই রান্নাঘরে এসে তিনি দেখলেন, বাবলু থালায় খানিকটা ভাত ফেলে রেখে গেছে।

বাবলু যখন আবার প্রতাপের ঘরে এলো, তখন প্রতাপ পায়জামা ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট পরে বাইরে বেরুবার জন্য তৈরি হয়েছেন। দাড়ি কামাননি এখনো। বাবলুকে দেখে তিনি বললেন, ভেতরে এসে এই চেয়ারটাতে বোস।

বাবলু আধখানা চেয়ারে খানিকটা কাৎ হয়ে বসলো, সরাসরি সে তার বাবার দিকে তাকাচ্ছে না।

প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, তোর মা বলছিল, তুই নাকি চাকরি খোঁজার চেষ্টা করছিস? বাবলু দ্বিধা না করে বললো, হ্যাঁ।

–তুই আর পড়তে চাস না? কেন?

–আমার আর পড়তে ভালো লাগে না। তাছাড়া, চাকরি করা তো দরকার।

–কিসের দরকার?

দরকার, মানে, টাকা পয়সার দরকার।

-–কেন, দু’বেলা খেতে পাচ্ছিস না নাকি?

–সেজন্য না। ছোড়দি পড়ছে, মুন্নি পড়ছে, ওদের পড়াশুনোর খরচ আছে।

–তোর পড়াশুনোর খরচ আমি চালাতে পারবো না, তুই বুঝি তাই ভেবেছিস? শোন, আমি। এম এ পড়িনি, পড়ার দরকারও ছিল না, আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি আইন পাস করে। আদালতে চাকরি করি। সেইসব সময়ে মুন্সেফ-হাকিমদের খুব সম্মান ছিল গ্রামের দিকে। যদি পার্টিশান না হতো, আমি ইস্ট বেঙ্গলেরই কোনো জেলায় থাকতাম, ছুটি-ছাটায় বাড়ি চলে যেতে পারতাম। আমার বাবা তাই-ই চেয়েছিলেন। তোর বেলায় আমি আমার সে রকম কোনো ইচ্ছে চাপিয়ে দিতে চাই না। তুই সায়েন্স পড়েছিস নিজের ইচ্ছেতে। ঠিক কি না?

বাবলু মাথা নাড়ালো।

প্রতাপ একদৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই ভালো রেজাল্ট করেছিস। তুই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট না হয়েও যা হয়েছিস, তাতেই আমি খুশী হয়েছি। এই রকম রেজাল্ট করে কেউ হায়ার এজুকেশনের সুযোগ ছাড়ে না। আজকাল তো শুনি ইউনিভার্সিটিতেও সিট পাওয়াই শক্ত। তুই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিস, তুই ঠিক সুযোগ পাবি। এর পরেও তুই যদি এম এস সি না পড়িস, লোকে বলবে আমি তোকে পড়াতে পারলাম না, আমার সে সামর্থ্য নেই। আমার কিন্তু সেরকম অবস্থা এখনও হয়নি।

প্রতাপ চুপ করে গেলেন। বাবলুও চুপ করে রইলো। সে বাবার দিকে মুখ ফেরাচ্ছে না, কিন্তু সে বুঝতে পারছে যে বাবা তার কাছে থেকে একটা উত্তর আশা করছে।

সে বললো, আজকাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো কিচ্ছু হয় না। ওরা নতুন কিছু শেখায় না।

প্রতাপ বললেন, পড়াশুনোর অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে ঠিকই। জীবনের শিক্ষা নিজেকেই নিতে হয়, মাস্টাররা আর কতখানি শেখাতে পারে। কিন্তু সায়েন্স শিখতে গেলে অ্যাকাডেমিক পড়াশুনোর দরকার আছে। আজকাল কেউ বাড়িতে বসে বিজ্ঞানচর্চা করতে পারে না। এম এস সি ডিগ্রিটা ভালোভাবে পেলে তারপর রিসার্চ করার সুযোগ আসে, তখন নিজস্ব চিন্তা প্রকাশ করা যায়।

বাবলু তবু জেদের সঙ্গে বললো, তারপর তো সবাই চাকরিই করে।

প্রতাপ এবারে খানিকটা শ্লেষ গোপন করে পারেলেন না। তিনি বললেন, হ্যাঁ, বিজ্ঞান পড়ে বাঙালীর ছেলেরা নিউটন-আইনস্টাইন হতে চায় না। এমনকি সত্যেন বোসও হতে চায় না। সবাই চাকরি পেয়েই নিশ্চিন্ত হতে চায়। কিন্তু চাকরিরও তারতম্য আছে। বি এস সি ডিগ্রি নিয়ে তুই কী চাকরি পাবি? আমাদের অফিসে অনেক অর্ডিনারি এম এ, এম এস সি পাস ছেলে আসে কেরানিগিরির জন্য। তুই কেরানি হয়ে থাকতে চাস! ভালো কেরানিগিরিও তুই পাবি না। আমরা তো রিফিউজি,এখনো আমরা পশ্চিম বাংলায় পুরোপুরি অ্যাকসেপ্টেড হইনি। আমাদের প্রতি পদে পদে লড়াই করতে হয়। সেই লড়াই হবে মেধা দিয়ে, মনের জোর দিয়ে। বি এস সি ডিগ্রি নিয়ে চাকরি খুঁজতে গেলে তোকে পঞ্চাশটা অফিসের দরজায় ঘুরতে হবে, কেউ কেউ জুতোর ঠোক্কর দেবে।

–কাগজে চাকরির বিজ্ঞাপন বেরোয়, তাই দেখে অ্যাপ্লাই করবো, পরীক্ষা দেবো।

–হ্যাঁ, অ্যাপ্লাই করবি। পাঁচটা পোস্টের জন্য পাঁচ হাজার দরখাস্ত পড়ে, এদের মধ্য থেকে কারা চাকরি পায় জানিস না? যাদের কানেকশন আছে। যাদের মামা, কাকা, পিসেরা বড় বড় পোস্টে আছে। তোকে এখন কে চাকরি দেবে? কিন্তু তোমার নামের পাশে যদি একটা পি এইচ ডি থাকে, তখন তোমাকে কেউ সহজে ফেরাতে পারবে না! তুই …

প্রতাপের কথার মাঝখানে একটা নাটকীয় কাণ্ড হলো। মমতা হঠাৎ ছুটে এলেন ঘরে, তাঁর দুটি চোখ নীরব ক্রন্দনে রক্তিম। এবার তিনি সরব হয়ে বাবলুকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতন বলতে লাগলেন, বাবলু, তুই কেন এম এস সি পড়বি না। বল, বল, আমাকে? আমার কোন কথায় তোর রাগ হয়েছে। এই বংশের একটা ছেলে লেখাপড়া শিখবে, নাম করবে, সবাই তাই চায়, আর তুই … তোর কী হয়েছে, বল, বাবলু, তুই আমাকে বল্।

প্রতাপ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আঃ, মমতা ছাড়ো, ওকে ছাড়ো, আমি ওর সঙ্গে আলোচনা করছি।

মমতা বললেন, না, ছাড়বো না! ও আমার ছেলে নয়? আমি ওকে পেটে ধরিনি? ও আমার কাছেও মন খুলে কথা বলবে না?

প্রতাপ অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, আঃ, আমি তো ওর সঙ্গে আলোচনা করছি, তুমি আবার কেন ডিসটার্ব করতে এলে?

মমতা পাগলাটে গলায় বললেন, কেন, আমি বুঝি কেউ না? ও আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না। মুখ ফুটে কিছু খেতে চায় না। কেন, কেন, আমি কী দোষ করেছি?

প্রতাপ গর্জে উঠে বললেন, এ সব কথা এখন থাক না। আমরা কাজের কথা বলছি! মমো, তুমি বাইরে যাও!

মমতাও সমান তেজের সঙ্গে বলে উঠলেন, না, আমি যাবো না! আমি জানতে চাই, ও কেন…

বাবলু হঠাৎ যেন এক প্রবল জলোচ্ছ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। নীল রঙের জল, দারুণ ভারি, তলার দিক থেকে চুম্বকের মতন টানে, সেই টানে বাবলু তলিয়ে যাচ্ছে, তার দাদা এসে তাকে ধরলো, ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে পিকলু তাকে ওপরে তুলে ধরতে চাইছে, সে পিকলুকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছে, মুখে এত জল ঢুকেছে যে সে আর নিশ্বাস নিতে পারছে না…

বাবলু উঠে দাঁড়িয়ে মাকে একটু দূরে সরিয়ে দিয়ে তাঁর চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকালো।

মমতাও সোজা তাকিয়ে থেকে বললেন, বাবলু, একদিন আমি তোকে বলেছিলাম, তোর জন্যই তোর দাদা…সেই জন্য তুই আমাকে…

বাবলু বললো, মা, মা, তুমি চুপ করো। হ্যাঁ, আমি পড়বো, এম এস সি পড়বো। তোমাকে এমনই বলেছিলাম।

মমতার কান্না ভেজা মুখে এক পলক রোদের মতন হাসি ফুটে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তীব্র চোখে বললেন, পড়বি! সত্যিই তুই পড়বি!

বাবলু বললো, হ্যাঁ।

মমতা তবু যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। একবার স্বামীর দিকে, একবার ছেলের দিকে তাকালেন। বাবলুর ব্যবহারে তাঁর মন একেবারে ভেঙে গিয়েছিল, বাঁচার সাধই চলে গিয়েছিল। সব হঠাৎ বদলে গেল?

মমতা বললেন, তুই ভর্তি হবি? আমার গা ছুঁয়ে বল! বাবলু বললো, এই তো তোমার গা ছুঁয়ে আছি মা! কৌশিকও আগে পড়বে না বলেছিল, এখন দু’জনেই ভর্তি হবো ঠিক করেছি!

প্রতাপ বললেন, টাকা জমা দেবার লাস্ট ডেট আর দু’দিন আছে। আমি ফর্ম এনে রেখেছি। তুই ফিল আপ কর। তারপর চল, আমি যাই তোর সঙ্গে। তিনটের মধ্যে পৌঁছালেই হবে।

বাবলু গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর সে বাবাকে বললো, তোমাকে যেতে হবে না। আমিই যাচ্ছি। তোমার তো দু’দিন ধরে জ্বর।

মমতা বললেন, তোর বাবার যে জ্বর তুই তা জানলি কী করে? তুই তো আমাদের কারুর খোঁজই রাখিস না।

এর পরের দৃশ্যটি অনেকদিন পর পারিবারিক পুনর্মিলনের মতন আনন্দময় হলো। বাবার কাছ থেকে ফর্ম নিয়ে বাবলু সেটি পূর্ণ করলো বাধ্য ছেলের মতন। মমতা তাঁর স্বামীকে বললেন, বাবলুর জন্য দুটো নতুন শার্ট কিনে দিতে হবে। ইউনিভার্সিটিতে ও কী পরে যাবে, ওর একটাও ভালো জামা নেই। প্রতাপ মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।

সুপ্রীতি ঘরের মধ্যে ঢুকে বললেন, আমি জানতাম, ও রাজি হবে। বাবলু খুব ভালো ছেলে।

তিনি বাবলুর মাথায় হাত দিয়ে আশীবাদ করে বললেন, আরও বড় হও, গুণী হও, তোমাকে দিয়ে এই বংশের আরও সুনাম হোক!

জুতো-মোজা পরে প্রতাপ এক রকম জোর করেই বেরুলেন বাবলুর সঙ্গে। বাইরে দুপুরের রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে। ওরা এসে দাঁড়ালো বাস স্টপে। এই দুপুরেও ট্রামবাস খালি নেই। সিনেমার ম্যাটিনি শো-এর দর্শকরা যাচ্ছে ঝুলতে ঝুলতে। ইদানীং সংসার খরচের খুবই টানাটানি যাচ্ছে বলে ট্যাক্সির কথা প্রতাপের মনেই পড়ে না।

ওঠা হলো একটা ভিড়ের বাসেই। ভালো করে দাঁড়াবারও জায়গা নেই। দু’তিন স্টপের পরই বাবলু ঠেলে ঠুলে একটা বসবার জায়গা পেয়ে চেঁচিয়ে বললো, বাবা, তুমি এখানে এসে বসো!

আরও দু’তিনজন লোক সেই সীট দখল করার জন্য বাবলুর ওপর হুমড়ি খেয়ে আছে, বাবলু। দু হাত দিয়ে তাদের আটকে আছে। এই রকম ভাবে বসতে প্রতাপের লজ্জা করে। তিনি হাত তুলে বললেন, না, থাক, আমি ঠিক আছি।

প্রতাপের শরীর অবশ্য ঠিক নেই। এত ভিড়ে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। কয়েকদিনের জ্বরে তাঁর মাথাটা হাল্কা হয়ে আছে, টলটল করছে মাঝে মাঝে। তবু তিনি দাঁতে দাঁত চেপে রইলেন।

ইউনিভার্সিটি ও সায়েন্স কলেজ ঘুরে সব কাজ চুকিয়ে ফেলার পর প্রতাপ নিশ্চিন্ত হলেন। পকেটে অনেকগুলো টাকা, তাঁকে সব সময় শঙ্কিত থাকতে হচ্ছিল।

প্রতাপ বললেন, চল, বাবলু, কোন দোকানে বসে একটু চা খাই। বাবার সঙ্গে বাবলু কখনো কোনো চায়ের দোকানে ঢোকেনি। এই গনগনে দুপুরে তার চা খাওয়ার ইচ্ছেও নেই। তবু বাবার এই অদ্ভুত শখের কথা শুনে তার মজা লাগলো. সে আপত্তি করলো না।

ওরা হেঁটে এগোলো রাজাবাজারের মোড়ের দিকে। রোদ্দুরটা প্রতাপের ঠিক সহ্য হচ্ছে না, মাথাটা ঘুরে উঠছে হঠাৎ, দু’তিনদিন জ্বরের জন্যই কী এমন? না অন্য কোনো বড় অসুখ বাসা বেঁধেছে। চিন্তাটা প্রতাপ মন থেকে উড়িয়ে দিলেন। ছেলের সঙ্গে তিনি হাঁটছেন, যেন তাঁর বয়েস অনেক কমে গেছে।

একটা অন্ধকার ঘুপচি মতন চায়ের দোকানে গিয়ে বসা হলো। ভনভন করে নীল ডুমো ডুমো মাছি উড়ছে। টেবিলের ওপর অয়েল ক্লথ পাতা, তাতে একটা চটচটে ভাব। চায়ের সঙ্গে প্রতাপ কেকের অর্ডার দিলেন। বাবলু একটু আগে ভাত খেয়ে এসেছে। তার কেক খাবার ইচ্ছে নেই, তবু প্রতাপ শুনলেন না। কাঁচের বৈয়ামে রাখা কতকালের বাসি কেক তা কে জানে! চায়ে দু’একটা মরা পিঁপড়ে ভাসছে। প্রতাপ সেই চা-ই বেশ তারিয়ে খেতে লাগলেন।

বাবলুর চোখে চোখ রেখে তিনি বলতে লাগলেন, আমি তো ইউনিভার্সিটিতে পড়িনি … তবে ল’ কলেজে পড়তে আসতাম … আমাদের সময় তোদের ঐ কফি হাউসের নাম ছিল অ্যালবার্ট হল … তোর বিমানকাকা আর আমি গোলদিঘিতে বসে গল্প করতাম প্রায়ই, ভাঁড়ের চা খেতাম, তখন ঐ চায়ের দাম ছিল এক পয়সা … আমার বাবা আমাকে প্রতি মাসে তিরিশ টাকা হাত খরচ পাঠাতেন, তা দিয়ে যথেষ্ট বাবুয়ানি করা যেত। এক একদিন আমরা শখ করে ফিটন গাড়ি চাপতাম … থাকতাম আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটা মেসে। এখান থেকে বেশি দূর নয় … দেশ থেকে কোনো লোক এলেই মা তার হাত দিয়ে নানারকম জিনিস পাঠাতেন আমাদের মেসে। পাটালি গুড়, ঘি, নারকোল নাড়ু, তক্তি, আমসত্ত, সবাইকে ভাগ করে দিতাম … তোর দেশের বাড়ির কথা মনে নেই, না রে বাবলু?

বাবলু বললো, একটু একটু মনে আছে।

প্রতাপ জোরে নিশ্বাস ফেলে বললেন, তোর মনে থাকবার কথা নয়, তুই তখন। কতটুকু … আমার বাবা তোকে খুব ভালোবাসতেন। . হঠাৎ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর প্রসঙ্গ বদল করে বললেন, তোর নামে আমি একটা ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে দেবো, সেখানে প্রতি মাসে জমা করে দেবো পঞ্চাশ টাকা। এখন বড় হয়েছিস, এখন রোজ রোজ বাবা-মায়ের কাছ থেকে পয়সা চাইতে তো লজ্জা করবেই। টিউশনি আর করতে হবে না, এ মাসেই ছেড়ে দে। পঞ্চাশ টাকায় তোর কুলিয়ে যাবে।

বাবলু লাজুক ভাবে বললো, না, অত লাগবে না।

–লাগবে, আজকাল সব জিনিসের তো খুব দাম, এক কাপ চা পনেরো পয়সা … তোদের ক্লাসে তো এখন মেয়েরাও পড়বে … মেয়েদের সঙ্গে মিশবি, বন্ধুত্ব করবি, তবে কখনো তাদের কারুর সঙ্গে এমন ব্যবহার করবি না, যাতে মনে দুঃখ পায়। মেয়েদের সঙ্গে যারা রুক্ষ ব্যবহার করে, তারা জীবনে সুখী হয় না।

বাবলু কয়েক ঢোঁকে চা শেষ করে ফেলেছে। সে এখন উঠতে পারলে বাঁচে। প্রতাপ বাবলুর চঞ্চলতা দেখে বললেন, বোস না। আমি আর এক কাপ চা খাবো। বেশ ভালো লাগছে। তুই পড়াশুনোটা করতে চাইছিলি না কেন? ছাত্রজীবনটা কত আনন্দের, ফুরিয়ে গেলেই তো গেল!

চায়ের দোকান থেকে বেরুবার পর বাবলু বললো, বাবা, তুমি তো বাড়ি ফিরবে? আমি মানিকতলায়, এক বন্ধুর বাড়িতে যাবো!

প্রতাপ বললেন, ঠিক আছে, তুই যা। আমি বাস ধরে নেবো এখন!

প্রতাপ একটা সিগারেট ধরিয়ে বাস স্টপের দিকে এগোলেন, বাবলু রাস্তা পার হয়ে অন্য দিকে চলে গেল। এখান থেকে সে হেঁটেও মানিকতলা চলে যেতে পারে। পমপমদের বাড়ি স্টাডি সার্কল আছে। এই স্টাডি সার্কল বাবলুকে চুম্বকের মতন টানে। বাবলু শেষ পর্যন্ত এম এস সি-তে ভর্তি হলো বলে ওখানে কেউ কেউ ঠাট্টা করবে। অবশ্য মানিকদা তাকে গোপনে বলেছিলেন, তুই ভর্তি হয়ে যা!

বাবলুর মনটা খচ খচ করছে। বাবাকে কি বাসে তুলে দেওয়া উচিত ছিল তার? ভিড়ের বাসে যেতে হবে। ট্রাম বরং কিছুটা ফাঁকা, এসপ্লানেড থেকে ট্রাম বদল করে গেলে …

বাবলু পেছন ফিরে তাকালো। রাস্তার সোজাসুজি অন্য পারে প্রতাপ একটা বাতিস্তম্ভ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। থুতনিটা ঠেকে আছে বুকের কাছে, কেমন যেন অদ্ভুত ভঙ্গি। একটু বেশি রাতের দিকে মাতালরা এইভাবে ল্যাম্পপোস্ট ধরে দাঁড়ায়। বাবলু অবাক ভাবে চেয়ে রইলো। তার কি কিছু করা উচিত। বাবলুর বাবা শক্ত সমর্থ পুরুষ, বাবলু কোনোদিন তাঁকে দুর্বল হতে দেখেনি।

কয়েক মুহূর্ত পরেই প্রতাপ সেই বাতিস্তম্ভটা ধরেই উবু হয়ে বসে পড়লেন রাস্তার ওপর। বাবলু সঙ্গে সঙ্গে এক দৌড়ে, গাড়ি ঘোড়া অগ্রাহ্য করে রাস্তা পেরিয়ে চলে এল এদিকে। কাছে এসে ভয় পাওয়া গলায় ডাকলো, বাবা!

প্রতাপ পথের ধুলোর ওপর বসে পড়েছেন, মুখটা ঘুরিয়ে তাকালেন বাবলুর দিকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য তাঁকে দারুণ অসহায় মনে হলো, মুখোনি একেবারে বিবর্ণ, তিনি হাতটা বাড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন, বাবলু, বাবলু, আমি পড়ে যাচ্ছি!

বাবলু সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রতাপকে। তারপর জিজ্ঞেস করলো, তোমার শরীর খারাপ লাগছে? একটা রিকশা ডাকছি …

পাশ দিয়ে লোক জন হেঁটে যাচ্ছে, কারুর কারুর দৃষ্টি কৌতূহলী কিন্তু কেউ কোনো মন্তব্য করছে না। কাছাকাছি কোনো রিকশা নেই, বাবলু ব্যাকুল ভাবে তাকাতে লাগালো এদিক ওদিক। এখন বাবার দায়িত্ব তার ওপর।

একটুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলেন প্রতাপ। তিনি জোর করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই বাবলু জিজ্ঞেস করলো, কী হলো?

প্রতাপ স্বাভাবিক গলায় বললেন, হঠাৎ খুব মাথা ঘুরছিল। কেন এমন হলো ব তো! হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, প্রতাপ সেটা একবার তুলতে গিয়ে থেমে গেলেন। তারপরই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে ধরাতে গেলেন আর একটা, দেশলাই জ্বালতে গিয়ে তাঁর হাতের আঙুল কাঁপতে লাগলো থরথর করে।

বাবলু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। তার ধারণা, বেশি অসুস্থ হলে মানুষ সিগারেট খায় না। বেশি সিগারেট খাওয়ার জন্য বাবাকে মা মাঝে মাঝে বকেন। কিন্তু সে তো বাবাকে নিষেধ করতে পারবে না।

সিগারেটে দুটো বড় বড় টান দিয়ে প্রতাপ বললেন, ঠিক আছে। তুই যা …।

বাবলু বললো, আমি তোমার সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছি।

প্রতাপ মাথা নেড়ে বললেন, না, না, আমি ঠিক আছি। আমি এখন নিজেই যেতে পারবো।

বাবলু বাবার হাত ধরে বললো, না, তুমি একা যাবে কেন? তোমার যদি আবার শরীর খারাপ হয় … আমি যেখানে যাচ্ছিলাম, সেখানে না গেলেও চলবে, আমি তোমার সঙ্গে বাড়ি যাবো।

প্রতাপ ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সেদিনও বাচ্চা ছেলে ছিল বাবলু, আজ যেন হঠাৎ সাবালক হয়ে গেছে। তিনি বললেন, আমার জন্য তোকে ভাবতে হবে না, তুই যেখানে যাচ্ছিলি যা, আমি ঠিক চলে যাবো। তুই কিছু চিন্তা করিস না। ঐ তো একটা বাস আসছে।

হাত তুলে প্রতাপ বাসটা থামালেন। তারপর বাবলুর দিকে আর একবার হাসি মুখ ফিরিয়ে জেদ করে উঠে গেলেন ভিড়ের মধ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *