2 of 3

২.১২ টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে

টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে সুলেখা তাকালো ত্রিদিবের দিকে। বিছানায় কাৎ হয়ে শুয়ে ত্রিদিব গভীর মনোযোগ দিয়ে চার্চিলের আত্মজীবনী পড়ছেন। রাত এখন পৌনে বারোটা, এত রাতে কে টেলিফোন করলো তা জানার আগ্রহ নেই ত্রিদিবের। পাছে দু’একটা কথা কানে চলে যায় তাই কি তিনি পাশ ফিরেছেন দেয়ালের দিকে? সুলেখা স্বামীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তার মাথার মধ্যে পাতলা পাতলা ছায়ার মতন নানারকম চিন্তা ঘুরে যেতে লাগলো।

একটু বাদে সুলেখা শাড়ি ছেড়ে একটা পাতলা রাত পোশাক পরে নিল। আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে সে নিজের মুখ দেখে নিজেই নিচু করলো চোখ। তার মুখে একটা যন্ত্রণার ছাপ সে কিছুতেই লুকোতে পারছে না। মুখে ক্রিম মেখে সে এসে দাঁড়ালো জানলার কাছে। কলকাতা শহর অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। এখনও রাস্তা দিয়ে মানুষজন যাচ্ছে। তিন চারজন যুবক গল্প করছে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে, তাদের মধ্যে একজন হাসতে হাসতে শুয়ে পড়ছে প্রায়, অন্য একজন হাততালি দিচ্ছে। সুলেখা জানলার কাঁচ খোলেনি, তাকে রাস্তা থেকে দেখা যাবে না।

সুলেখা আর একবার মুখ ফেরালো। না ডাকলে বোধ হয় ত্রিদিব সারা রাতই বই পড়ে যাবে।

খাটের কাছে এসে সে বললো, রাতুল ফোন করেছিল।

বই থেকে চোখ না সরিয়ে ত্রিদিব বললো, ও।

এতই ভদ্র সে যে কিছুতেই জিজ্ঞেস করবে না, এত রাতে রাতুল কেন ফোন করেছিল কিংবা কী তার বক্তব্য। ত্রিদিবের এই ভদ্রতার শীতলতা এক এক সময় সুলেখার অসহনীয় লাগে। স্বামীর চরিত্র সে জানে, তবু তার মুখে যাতনার রেখাপাত হয়। রাতুল ত্রিদিবেরই বন্ধু, তবু সে টেলিফোনে ত্রিদিবকে ডাকেনি।

–আলো জ্বালা থাকবে?

–উঁ? হ্যাঁ। নিবিয়ে দিতেও পারো।

–তুমি কী বললে, হ্যাঁ, না না?

–তোমার অসুবিধে হলে আলো নিবিয়ে দাও। সুলেখা বিছানার ওপর এসে স্বামীর বাহুতে থুতনি ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি এখানে, না চার্চিলের সঙ্গে লাহোর বা কাবুলে ঘুরছো?

ত্রিদিব হেসে বললো, থাক, আর পড়বো না। খুব ইন্টারেস্টিং। লোকটাকে আমি পছন্দ করি না। কিন্তু ইংরিজিটা ভারি সুন্দর লেখে।

সুলেখা নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো, রাতুল তোমার কতদিনের বন্ধু?

–অনেক দিনের। মানে আমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়েছে।

–ইস্কুলে একসঙ্গে পড়লেই কি সবাই বন্ধু হয়?

–না, তার কোনো মানে নেই। ছেলেবেলার কত বন্ধু তো হারিয়ে গেছে। কারুকে কারুকে হঠাৎ দেখলেও চিনতে পারি না।

–বন্ধুত্ব কাকে বলে? পুরুষ মানুষদের পরস্পরের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসাই তো বন্ধুত্ব?

–হ্যাঁ, তা বলতে পারো। তুমি তো থ্রি কমরেডস পড়েছো, সুলেখা। ঐ হচ্ছে বন্ধুত্ব। কোস্টার নামে ছেলেটি, সে তার বন্ধুর প্রেমিকার চিকিৎসা করাবার জন্য, কী যেন নাম মেয়েটির? প্যাট্রিশিয়া…তার জন্য নিজের অত ফেভারিট গাড়িটা বিক্রি করে দিল।

–হ্যাঁ, থ্রি কমরেডস আমি পড়েছি। রাতুল তোমার বন্ধু নয়। থ্রি কমরেডস-এর মতন বন্ধু তোমার একজনও নেই।

ত্রিদিব চিৎ হয়ে সুলেখার মাথাটা বুকের ওপর টেনে নিয়ে তার কানের লতির নিচে আঙুল দিয়ে আদর করতে করতে বললো, সেরকম বন্ধু নেই, দোষটা বোধ হয় আমার। আমি খুব খোলাখুলি কারুর সঙ্গে মিশতে পারি না। আমি কোনোদিন কোনো ছেলের কাঁধ ধরে হাঁটিনি…ছেলেরা যেমন হাসতে হাসতে একজন আর একজনের পিঠ চাপড়ে দেয়, সেরকমও করিনি কখনো…আমার ঠিক আসে না… তবে রাতুলের সঙ্গে অনেক দিনের চেনা, মাঝখানে। কয়েক বছর বম্বেতে ছিল…রাতুল, শাজাহান, অমর্ত, নিরুপম এদের তো আমি বন্ধু বলেই মনে করি, অনেকটা রুচিতে মেলে, কথা বলতে ভালো লাগে…

–এরা কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারে কখনো?

–না, না, ক্ষতি করবে কেন? তাছাড়া এদের সঙ্গে তো কোনোরকম স্বার্থের সম্পর্ক নেই। শাজাহান অবশ্য বড় পয়সা খরচ করে আমাদের জন্য, প্রতিদান দেবার সুযোগ দেয় না।

–তবু ওরা কেউ তোমার বন্ধু নয়।

–এ কথা বলছো কেন? তুমি ওদের পছন্দ করো না?

–শোনো, তোমার একজনই বন্ধু আছে। তার নাম সুলেখা।

–সে কথা আর বলতে? তুমি আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু।

–কিন্তু তুমি আমায় সব সময় সাহায্য করো না। আমি কখনো কোনো অসুবিধেয় পড়লে তুমি বাচ্চা ছেলের মতন দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকো।

–যাঃ, কী বলছো! আমি তোমায় সাহায্য করি না?

–তোমার ছোট কাকা যখন আমাকে ভীষণ বিরক্ত করতে আরম্ভ করেছিলেন, তুমি আমায় সাহায্য করেছিলে?

–ওঃ, ছোট কাকার ঐরকম স্বভাব. আমি জানতুম তুমি ঠিক সামলে নিতে পারবে।

–তবু তুমি নিজে মুখ ফুটে কিছু বলবে না।

–নিজের কাকাকে কি রূঢ় কথা বলা যায়?

–তা হলে যাকে তুমি বন্ধু বলে মনে করো, কিন্তু আসলে সে বন্ধু নয়, সেরকম কারুকে যদি কিছু বলতে হয়?

একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গ আসছে বুঝতে পেরে ত্রিদিব হাই তুললেন। তিনি যে শুধু কারুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারেন না তাই-ই নয়, তিনি কারুর সম্পর্কে খারাপ কিছু ভাবতেও চান না। পৃথিবীটা যেন শুধু তাঁর রুচি অনুযায়ী চলবে।

সুলেখার ঘাড়ে ছোট একটি চুমু দিয়ে বললেন, ঘুম পেয়ে গেছে। কাল তো খুব ভোরে উঠতে হবে। লতুদের ট্রেন সাড়ে ছ’টায় না? তোমাকে হাওড়া স্টেশান যেতে হবে না। আমি একাই যাবো।

সুলেখা হাসলো। এই নিয়ে চারবার সে ত্রিদিবকে একটা বিষয় জানাবার চেষ্টা করছে, প্রত্যেকবারই ত্রিদিব এড়িয়ে যাচ্ছে। ত্রিদিব নিশ্চয়ই ব্যাপারটা জানে। কিন্তু কিছুতেই তা নিয়ে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে চায় না।

আর একটা হাই তুলে ত্রিদিব আবার বললেন, প্রত্যেকদিন ঘুম আসার আগে আমার মনে হয়, আমার কী দারুণ সৌভাগ্য যে তোমার মতন একটি বউ পেয়েছি। অন্য কোনো মেয়ের পাল্লায় যদি পড়তুম, যে চাচামেচি করে ঝগড়া করে কিংবা পরনিন্দা-পরচর্চা করে, তা হলে কী হতো বলো তো? তা হলে বোধ হয় আমি আত্মহত্যা করতুম।

ঘুমের ভাণ নয়, একটু পরে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লেন ত্রিদিব।

সুলেখার চোখে ঘুম নেই। কাল এ বাড়িতে অনেক লোকজন আসবে। ত্রিদিবের ছোট বোনের স্বামী বদলি হয়ে আসছে কলকাতায়, এখনো তারা কোনো বাড়ি পায়নি, কিছুদিন থাকবে এখানে। ওদের দুটি ছেলে-মেয়ে। সুলেখা লোকজন ভালোবাসে, ওদের জন্য ঘর-টর সাজিয়ে সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। ওরা আসছে বলে আর একটা কারণে সুলেখা খুশী, তা হলে রাতুল আর যখন-তখন আসতে পারবে না এখানে।

কোথায় যেন একটা বাচ্চা ছেলে কাঁদছে, সুলেখা কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো। প্রায় সদ্যোজাত শিশুর মতন গলার আওয়াজ। কয়েকদিন ধরেই মাঝ রাতে সুলেখা শুনতে পাচ্ছে। এই কান্না। তার সন্দেহ হয়, সে কি সত্যিকারের কোনো বাচ্চার কান্না শুনছে, না এটা তার মনের বিভ্রম? আশেপাশের কোনো বাড়িতে নতুন একটি শিশু তো জন্মাতেই পারে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা নেই সুলেখাদের, এরকম কোনো খবর সে শোনেনি। কাল বাড়ির ঝি-কে জিজ্ঞেস করতে হবে। ওরা ঠিক জানবে।

সুলেখার কোনো সন্তান হয়নি, অনেক বছরের বিবাহিত জীবন হয়ে গেল, এখন অন্যরা তাকে প্রশ্ন করে। সুলেখার মা আর বৌদি তো এই নিয়ে তাকে এখন বেশ জ্বালাতন করতে শুরু করেছেন। শুধু ত্রিদিব কিছুই বলেন না। সুলেখার নিজস্ব কোনো অভাব বোধ ছিল না এতদিন, অন্যদের কথা শুনতে শুনতে এখন মনে হয়, অন্তত একটি সন্তান থাকলে বেশ হতো। প্রতাপ একদিন সুলেখাকে ইঙ্গিত করেছিলেন, ত্রিদিবের উচিত ডাক্তার দেখানো। সুলেখা জানে, তারও উচিত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া, কারণ তার নিজেরও বন্ধ্যাত্ব থাকতে পারে। কিন্তু ত্রিদিব নিজে কিছু না বললে এ সম্পর্কে সুলেখার মুখ ফুটে কিছু বলতে লজ্জা করে। যদি ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে যে ত্রিদিবেরই কিছু খুঁত আছে, তা হলে তারপরেও কি ত্রিদিবের সঙ্গে তার সম্পর্ক এরকম ভালো থাকবে?

সুলেখা বুকের ওপর দুটি হাত এমনভাবে রাখলো যেন সে তার অজাত সন্তানকে আদর করছে। আবার শোনা গেল সেই শিশু কণ্ঠের ক্ষীণ কান্না।

রাতুল তাকে ঠিক এই জায়গাটাতে ধরেছে।

বিয়ের পর সুলেখা রাতুলকে বেশি দেখেনি। সে চাকরি নিয়ে বম্বেতে থাকতো। দু’একবার মাত্র এসেছে এ বাড়িতে। বম্বেতে রাতুলের স্ত্রী হঠাৎ গাড়ির অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়, ওদের একটি ছেলে এখন মানুষ হচ্ছে মামা বাড়িতে। সেই ঘটনার কিছুদিন পর রাতুল বম্বের পাট উঠিয়ে দিয়ে চলে আসে কলকাতায়। সে-ও প্রায় বছর চারেক হয়ে গেল। স্ত্রীকে সে ভালোবাসতো খুব, বছর তিনেক সে কারুর সঙ্গে কথা বলতে পারতো না ভালোভাবে। তার বন্ধুরা তাকে বাড়িতে ডেকে ডেকে এনে সান্ত্বনা দিতে চাইতো।

রাতুলের সুন্দর স্বাস্থ্য, টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে তার নাম ছিল এক সময়। তার গানের গলাও চমৎকার। সে একা একা একটা মস্ত বড় ফ্ল্যাটে থাকে, তাই ইদানীং তার বন্ধুরা, বিশেষ করে বন্ধু পত্নীরা তাকে বলছে, আপনার আবার বিয়ে করা উচিত। সুলেখারও খুব মায়া লাগতো রাতুলকে দেখে, একদিন সে-ও বলেছিল, সত্যি, এবারে আপনার আবার বিয়ে করা দরকার। একলা একলা সারা জীবন কাটাবেন কী করে? আমার তো ভাবলেই যেন কেমন লাগে।

কথাটা শুনে রাতুল এক দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল সুলেখার মুখের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলেছিল, আমি বিয়ে করতে পারি…তোমাকে।

এটা একটা ঠাট্টা হতে পারতো। বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে এরকম ঠাট্টা চলতে পারে। কিন্তু কথাটা বলার সময় রাতুল একটুও হাসেনি, তার চোখের দৃষ্টি ছিল গাঢ়। এরকম দৃষ্টির সামনে সুলেখা অস্বস্তি বোধ করে। কৈশোর বয়েস থেকেই সে পুরুষ মানুষদের বাসনাময় দৃষ্টি দেখতে অভ্যস্ত, কিন্তু রাতুলের তাকানো সেরকমও নয়, দেখলে ভয় লাগে। এ বাড়িতে ত্রিদিবের সঙ্গে পরিচয় বা আত্মীয়তার সূত্রে যারা প্রায় প্রতিদিনই আড্ডা দিতে আসে তাদের সঙ্গে সুলেখা শুধু হাস্য-পরিহাসের সম্পর্ক রাখে, বই-সিনেমা-থিয়েটার-গান বাজনা নিয়ে কথা বলে, তার বেশি কিছু না। সে কারুর ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দিতেও চায় না। তবু কেন যে হঠাৎ সেদিন রাতুলকে ঐ কথাটা বলতে গেল!

কয়েকদিন বাদেই রাতুল জানালো যে সে অনেকদিন ধরেই সুলেখাকে ভালোবাসে, কথাটা এতদিন মুখ ফুটে বলেনি, সে সুলেখাকে বিয়ে করতে চায়, সুলেখা ছাড়া আর কোনো মেয়েকেই সে বিয়ে করবে না।

এরকম কথা পুরোপুরি শুনতেই চায়নি সুলেখা, তার শরীর অস্থির লাগছিল, কিন্তু রাতুল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ধীর গম্ভীর গলায় সবটা তাকে না শুনিয়ে ছাড়েনি। সেদিন সুলেখা খুবই কাতর বোধ করেছিল। মানুষ এরকমভাবে ভালোবাসার কথা বলে কী করে? এ কী ধরনের ভালোবাসা? সুলেখা তো কোনোদিন রাতুলকে সামান্যতম প্রশ্রয়ও দেয়নি। দু’জন মানুষ পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলো না, হৃদয়সংবাদ বিনিময় হলো না, শুধু শুধু একজন ভালোবেসে ফেললো। তাও একজন বন্ধুর স্ত্রীকে? একজন মানুষ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রীকে বলতে পারে, তুমি তোমার স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে বিয়ে করো?

ত্রিদিবের সমান না হলেও সুলেখারও খুব বই পড়ার নেশা। কাব্য-সাহিত্যে সে অনেক একতরফা প্রেমের কাহিনী পড়েছে, কিন্তু সুলেখা মনে করে ঐ সব পুরুষ রচিত কাহিনীর নায়িকারা অধিকাংশই প্রতীক। বিয়াত্রিচে কি মানবী না দান্তের সরস্বতী? ঐ সব নারীদের সঙ্গে কবি-লেখকদের মিলন হয়, অনেক নরক পেরিয়ে যাবার পর, স্বর্গে।

রাতুলের মুখে এ কথা শুনেও তাকে ঘৃণা করা যায় না, তার কারণ মানুষ হিসেবে সে অতি ভদ্র ও মার্জিত, তার ব্যবহারে কখনো রুচিহীনতা প্রকাশ পায় না, সে কোনোদিন সুলেখাকে শারীরিকভাবে জোর করার চেষ্টা করেনি। ভালোবাসার কথা না বলেও অনেকেই সুলেখাকে নানাভাবে ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করে, রাতুল সেরকম: না মোটেই।

রাতুল দ্বিতীয় দিন ঐ একই কথা বলতে এলে সুলেখা হাসি ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রাতুল তাতে ভোলে না। সে পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চায় যে সুলেখা ছাড়া আর কারুকেই সে বিয়ে করতে পারবে না।

এরকম কথায় আবার সুলেখার ওপর একটা দায়িত্ব বর্তে যায়। তার জন্য একটা লোক সারা জীবন নিঃসঙ্গ থেকে যাবে কেন? তাতে সুলেখার মনেও একটা অপরাধ বোধ থেকে যাবে না?

ত্রিদিব যখন বাড়িতে থাকে না তখনও রাতুল আসে। সুলেখা কিছুতেই তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে পারে না। বলতে পারে না, আপনি আর আসবেন না!

একদিন সুলেখা রাতুলকে বললো, আপনি এরকম পাগলামি করছেন কেন? আপনি একটা জিনিস বুঝতে পারছেন না, আমি তো আমার স্বামীকে খুবই ভালোবাসি। আমাদের মধ্যে কখনো কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়নি।

রাতুল সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, তুমি ত্রিদিবকে ভালোবাসো, তা আমি জানি না? আমাকে বিয়ে করার পরেও, তুমি ত্রিদিবকে ভালোবাসবে। আমি যেমন মনিকাকে এখনো ভালোবাসি। তাকে তো ভুলে যাইনি।

এটা রাতুলের একটা অদ্ভুত যুক্তি। মৃত ও জীবিত মানুষের মধ্যে একটা তফাৎ থাকবে না? কিন্তু উত্তরটা সুলেখা মুখে আনতে পারেনি। রাতুলের মৃত স্ত্রীর কথা উল্লেখ করা তাকে মানায় না। রাতুল আবার বলেছিল, শোনো সুলেখা, ত্রিদিব তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছে। তোমরা দশ বারো বছর সুখের বিবাহিত জীবন কাটিয়েছে। কিন্তু ত্রিদিব কোনোদিনই তোমাকে সন্তান উপহার দিতে পারবে না। সে জন্য এক সময় তোমার মধ্যে একটা তিক্ততা আসবেই। বরং আমাকে বিয়ে করার পরও ত্রিদিব তোমার বন্ধু থাকতে পারবে।

কথাটা শুনে চমকে উঠেছিল সুলেখা। ত্রিদিব কোনোদিন সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না এ কথা রাতুল কী করে জানলো? কেন এত জোর দিয়ে বললো? রাতুল তো আর ডাক্তার নয়। কিংবা, ত্রিদিব কখনো কি গোপনে কোনো ডাক্তার দেখিয়েছে, তখন রাতুল সঙ্গে ছিল? ত্রিদিব তো সুলেখাকে লুকিয়ে কোনো কাজ করে না। এই একটা ব্যাপার সে সুলেখার কাছে গোপন করে গেছে? সুলেখা মুখ ফুটে এ কথা ত্রিদিবকে জিজ্ঞেস করতেও পারে না। যদি সত্যি হয়! না, না, সেরকম সত্য সুলেখা সহ্য করবে কী করে?

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাতুল যেন মরীয়া হয়ে উঠেছে। সে আর দেরি করতে চায় না। সে

যেন ধরেই নিয়েছে সুলেখার সঙ্গে তার বিয়ে হবেই। সে যখন তখন আসে কিংবা ফোন করে, ত্রিদিবকে অগ্রাহ্য করে সুলেখার সঙ্গে কথা বলে। সে যেন ত্রিদিবকে জানিয়ে দিতেই চায় তার উদ্দেশ্যটা। যেন ত্রিদিব একবার জেনে ফেললে, প্রসঙ্গটা উত্থাপন করলেই সব কিছুর সুরাহা হয়ে যাবে। কিন্তু ত্রিদিব উদাসীন।

সুলেখা মন শক্ত করে রাতুলকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করার কথা ভাবতে গিয়েই টের পেল তার মনের মধ্যে কখন একটা দ্বিধা এসে ঢুকে বসে আছে। রাতুলকে একেবারে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা তার নেই। এর আগে অন্য কোনো পুরুষ মানুষ সম্পর্কে তার এরকম হয়নি। এখনো যে ত্রিদিবের প্রতি তার ভালোবাসা একটুও কমেছে তা নয়, ত্রিদিবকে ছেড়ে যাবার কথা সে চিন্তাও করে না, কিন্তু রাতুল আর আসবে না, সে আঘাত পেয়ে নিজের বাড়িতে একা একা মুষড়ে থাকবে, এ কথা ভাবতেও তার কষ্ট হয়।

নিজের মনের এরকম দুর্বলতা টের পেয়ে সুলেখা শিউড়ে উঠেছিল। এরকম জটিলতা সে সহ্য করতে পারবে না। ত্রিদিবের সঙ্গে সে এতগুলি বছর চমৎকার কাটিয়েছে, বাকি জীবনটাও সুন্দরভাবে কাটাতে চায়, তার সন্তানের প্রয়োজন নেই। ত্রিদিব নিজে কিছু ব্যবস্থা করে না কেন? সব সমস্যা সমাধানের ভার সে স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দেবে? সে যদি রাতুলকে বলতো, তুই আমার বউকে আর বিরক্ত করতে আসিস না…

টেলিফোনটা আবার বেজে উঠতেই দারুণ চমকে উঠলো সুলেখা। বুকের মধ্যে দুম দুম শব্দ হতে লাগলো, পাগল হয়ে গেল নাকি মানুষটা? এত রাতে আবার কেউ ফোন করে?

সুলেখার উচিত ছিল ফোনটা নামিয়ে রাখা। কিংবা, এখনও তো সে সাড়া না দিয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখতে পারে। এরকম তীব্র ঝনঝন আওয়াজেও ত্রিদিবের ঘুম ভাঙেনি? সে জেগে উঠে ধরুক, তারপর যা খুশী বলুক।

টেলিফোনটা বাজতেই লাগলো। এক সময় সুলেখা পাশ ফিরে রিসিভার তুলে দুঃখী গলায় বললো, ছিঃ এটা কী হচ্ছে? কত রাত হয়েছে জানেন না?

রাতুল বললো, কিছুতেই ঘুম আসছে না। সুলেখা, তুমি আজ বিকেলে শাজাহানের সঙ্গে অতক্ষণ হেসে হেসে গল্প করলে, আমার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলোনি, তাতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আগে কখনো শাজাহানকে ঈষা করতুম না, কিন্তু আজ

–এসব কথা এখন না বললেই নয়?

–আমার যে মাথার মধ্যে এইসবই ঘুরছে, চোখ বুজলেও তোমাকেই দেখতে পাচ্ছি। আমি কোনোদিন ঘুমের ওষুধ খাই না। সুলেখা, তুমি আমার সঙ্গে একটু ভালোভাবে কথা বলো, তাহলে আমার ঘুম আসবে।

–এই তো বলছি। মাথা ঠাণ্ডা করে ঘুমিয়ে পড়ুন। কিংবা চোখ বুজে দু’তিনশোটা ভেড়া গুনতে থাকুন, ঘুম এসে যাবে ঠিক।

–ঠাট্টা করো না। সুলেখা, এবারে তুমি মন ঠিক করে ফেলো। দু’একদিনের মধ্যেই সুলেখা রিসিভারটা কানের কাছ থেকে একটু সরিয়ে নিয়ে চুপ করে রইলো। আপন মনে কথা বলে যেতে লাগলো রাতুল। একটু পরে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে সে ডাকতে লাগলো, সুলেখা, শুনতে পাচ্ছো না? সুলেখা, সুলেখা।

সুলেখা এবারে বললো, হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। আমি মন ঠিক করে ফেলেছি।

–ঠিক করে ফেলেছো? বাঃ, গুড! গুড! কবে বলবে ত্রিদিবকে, কালই?

–হ্যাঁ, কালই। এবারে ঘুমোন। গুড নাইট।

টেলিফোনটা রেখে দিয়ে সুলেখা আলো জ্বাললো। ত্রিদিব কি সব শুনেও ঘুমের ভান করে আছে? অবশ্য ত্রিদিবের গাঢ় ঘুম। তার কপালে প্রশান্ত ভাব, একটা হাত বুকের ওপর রাখা।

খাট থেকে নেমে এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলো সুলেখা। সামনের দেয়ালের ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠায় শুধু সাদা মেঘের ছবি। যেন ঐ ছবিটাই এখন তার খুবই দরকার, এইভাবে সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সুলেখা। একটু পরে সে চলে এলো জানলার কাছে। রাস্তা এখন একেবারে নির্জন, টুপটাপ টুপটাপ শব্দ হচ্ছে মৃদু বৃষ্টির। গভীর রাত্তিরে এইরকম একলা একলা বৃষ্টিপাতের দৃশ্যের মধ্যে একটা অদ্ভুত মায়া আছে।

জানলার পাল্লাটা খুলে বাইরে হাত বাড়ালো সুলেখা। আস্তে আস্তে তার হাত ভিজে গেল বৃষ্টির জলে। তারপর সেই জলে সে ধুয়ে ফেলতে লাগলো তার নিঃশব্দ চোখের জল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *