2 of 3

২.০৮ গাড়ি ভাড়া করেছে আলতাফ

কোথা থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করেছে আলতাফ। সে সাইকেল রিকশা চাপে না, তার বিশ্রী লাগে। নতুন ঝকমকে টয়োটা গাড়ি, সঙ্গে উর্দি পরা ড্রাইভার। বাবুলও বেরুচ্ছিল, আলতাফ বললো, চল, কোথায় যাবি, তোরে নামায়ে দেবো।

এই গরমেও আলতাফের পরনে থ্রী পিস্ সুট, গলায় চওড়া টাই, চোখে সান গ্লাস। সে ওয়েস্টকোটের পকেটে দু আঙুল রেখে কায়দা করে কথা বলে। তার পায়ের জুতো জোড়া দেখলেই বোঝা যায় ঐ জুতোর দামে পূর্ব পাকিস্তানের কোনো চাষী পরিবারের ছ’ মাসের সংসার খরচ চলে যেতে পারে। বিলিতি সিগারেটের প্যাকেট খুলে সে উদার ভাবে বিলোয়, নিজের সিগারেটটা আধখানা ফুরোবার আগেই সে ফেলে দেয় অবহেলায়। আগেও সে শৌখিন প্রকৃতির ছিল, এখন জার্মানি-প্রবাসী হয়ে, উপার্জনের সচ্ছলতায় অমিতব্যয়ী বিলাসী হয়েছে।

দুই ভাইয়ের চেহারা ও স্বভাবে অনেক অমিল। আলতাফ ইদানীং হৃষ্টপুষ্টের চেয়েও কিছু বেশি, বাবুল রোগা-পাতলা। আলতাফ প্রগম্ভ, বাবুল লাজুক ও মিতভাষী, আলতাফ সম্ভোগপরায়ণ, বাবুল ব্যক্তিগত সাচ্ছন্দ্য সম্পর্কে উদাসীন।

গাড়িতে উঠে আলতাফ বললো, উরে ব্বাইশ রে, কী গরম পড়ছে রে! তারপর সে সাহেবী কায়দায় টাইয়ের গিটে একবার অন্যমনস্ক ভাবে হাত ছোঁয়ালো। ছোট ভাইয়ের দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমি মিজান ভাইয়ের বাড়িতে বীয়ার খেতে যাবো, তুই আসবি নাকি আমার সাথে?

বাবুল যে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে একথা আলতাফকে সে অন্তত চারবার জানিয়েছে, কিন্তু আলতাফের তা মনে থাকে না। সে ঘাড় নেড়ে বললো, না, আমার অন্য জায়গায় কাজ আছে।

বাকি রাস্তা আলতাফ নিজের মনে অনেক কথা বলে গেল, বাবুল নীরব শ্রোতা। এলিফ্যান্ট রোডের মোড়ে নেমে পড়তে চাইল বাবুল।

আলতাফ জিজ্ঞেস করলো, এখানে কার বাসায় যাবি? উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে বাবুল বললো, আছে একজন, তুমি চেনো না!

নেমে পড়ে বাবুল একটা কাঁসার বাসনের শো রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরের জিনিসপত্র দেখতে লাগলো অলসভাবে। যেন তার কোথাও যাবার তাড়া নেই। ঠিক অবিশ্বাস নয়, সে তার বড় ভাইকে এড়িয়ে চলতে চায়। আলতাফের ভোগবাদী দর্শন তার বড় ভুল মনে হয়।

একটু পরে রাস্তার কয়েক বাঁক ঘুরে সে একটি বাড়ির কলিং বেল-এ ডান হাতের অনামিকা ছোঁয়ালো।

সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে একটা কুকুরের হিংস্র ঘেউ ঘেউ ডাক ভেসে এলো। বাবুল হাসলো ঠোঁট টিপে। প্যাটার্ন ঠিক মিলে যাচ্ছে। উনিশ শো আটান্নোর সেই সামরিক আইন জারি, কয়েকদিন পরেই ইস্কান্দার মিজার নিবাচন, তারপর সবাই ভেবেছিল এদেশে আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কোনো আশা নেই। যাদের রাজনীতির সঙ্গে কিছুমাত্র সংশ্রব ছিল তারা যখন তখন গ্রেফতারের ভয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালাবার ব্যবস্থা রেখেছে এবং বাড়িতে কুকুর পুষে সম্মুখ দরজায় বসিয়েছে। ইদানীং ঢাকা শহরে কুকুরের ডাক আগের তুলনায় অনেক বেশি শোনা যায়।

কেউ একজন প্রথমে কুকুরটাকে বাঁধলো, কোনো উপায়ে দরজার বাইরের আগন্তুককে দেখে নিয়ে তারপর দরজা খুললো।

পায়জামা ও গেঞ্জি পরা একজন ত্রিশোর্ধ যুবক অনেকখানি ভুরু তুলে নাটকীয় ভাবে বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, আরে, বাবুল মিঞা! কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! এ যে মেঘ না চাইতেই পানি! তুমি বিশ্বাস করবা না, আমরা এতক্ষণ তোমার কথাই বলতেছিলাম! বাবুল সামান্য হেসে বললো, কী খবর পল্টনভাই? সব ঠিকঠাক আছে?

যুবকটি বাবুলের কাঁধের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো, বাবুল আমার বাবুল রে! তোরে পাইলে যাইতাম আমি কাবুল রে! এতদিন কোথায় ছিলি? বিয়ে-শাদী করে শালা একেবারে ভাগলবা! আমরা কি তোর কেউ না?

বাতাসে গন্ধ পেয়ে বাবুল ঐ পল্টন নামের লোকটির এতখানি উচ্ছ্বাস ও আতিশয্যের কারণ বুঝতে পারলো। পরিষ্কার জিনের গন্ধ। বেলা বারোটা এখনও বাজেনি, এর মধ্যেই পল্টন মাতাল হয়ে গেছে!

পল্টন তাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল।

পল্টন ওরফে আবুল হোসেনদের বাড়ি ছিল পশ্চিম বাংলায়। ওর বাবা সরকারি চাকরি করতেন বর্ধমানে, পার্টিশানের সময় অপশান দিয়ে তিনি সপরিবারে ঢাকা চলে আসেন। চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর তিনি একটা বইয়ের দোকান ও প্রেস খোলেন বাংলা বাজারে, আবুল হোসেন এখন সেই ব্যবসা চালায়। এই দোকানের পেছনের একটা ছোট ঘরে প্রতিদিন বিকেল থেকে জমতো এক প্রচণ্ড আড্ডা, ছাত্র জীবনের শেষে বাবুলও তাতে যোগ দিয়েছিল। বন্ধু বান্ধবরা সবাই আবুল হোসেনকে পল্টন নামেই ডাকে। ঐ নাম তার বাপ-মায়ের দেওয়া নয়, রোগা-লম্বা চেহারার জন্য আগে তাকে বলা হতো তালপাতার সেপাই, তখন তাদের বাড়ি ছিল পুরানা পল্টনে, সেই থেকে পল্টন। বন্ধু বান্ধবদের আদর-আপ্যায়নে পল্টন অত্যন্ত উদার।

বইয়ের দোকানের সেই আড্ডাখানায় অবধারিতভাবে অনুপ্রবেশ করেছিল রাজনীতি, এক সময় কয়েকজন আড্ডাধারী রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে, তার ফলে পল্টন ছ’মাসের জন্য। জেল খেটে এসেছে।

আজ ছুটির দিন ছিল, তাই আড্ডা বসেছে বাড়িতে। সামনের দিকের দুতিনখানা ঘর পেরিয়ে একেবারে শয়ন কক্ষে। মস্ত বড় পালঙ্কের ওপর পুরু গদির বিছানা পাতা, তার কোণে কোণে বসেছে পাঁচ ছ’জন, মাঝখানে ছড়ানো তাস, তিন চারটে অ্যাশট্রে ভর্তি সিগারেটের টুকরো, পাশের একটা টুলের ওপর রাখা কয়েকটি বীয়ার ও একটি লন্ডন ড্রাই জিনের বোতল, প্রত্যেকের হাতে হাতে গ্লাস।

বাবুল দরজার কাছে থমকে দাঁড়ালো। দৃশ্যটি তার পরিচিত, শুধু ঢাকা শহর নয়, মফঃস্বলেও অনেক বাড়িতে ইদানীং এ দৃশ্য দেখা যায়।

সাত-আট বছর আগে পল্টনের দোকানে বা বাড়ির আড্ডায় মদ ছিল না, তাস ছিল না। কাপের পর কাপ চা আসতো, সঙ্গে পেঁয়াজি ও কাবাব, আর সিগারেট ছিল অফুরন্ত। তখন কথা বলাটাই ছিল প্রধান নেশা।

আটান্ন সালে সমস্ত রকম রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নিষিদ্ধ হবার পর এবং যখন তখন জেলে যাওয়ার আশঙ্কায় যখন অনেকের মন আচ্ছন্ন, তখন সময় কাটাবার উপায় হিসেবে আসে সুরা। ঢাকা শহরে এখন হাত বাড়ালেই মদ পাওয়া যায়, গরিব লোকেরাও কেরোসিন আনতে যায় বিলিতি মদের বোতলে।

পুলিসের নজর এড়াবার জন্য বাবুল যেমন মফঃস্বলে চাকরি নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তেমনি যারা ঢাকা শহরে রয়ে গেল, তারা অনেকেই আত্মগোপন করলো মদের নেশায় ও তাস খেলায়, সহজে কেউ রাজনীতির আলোেচনা করে না, কেন না, দেয়ালেরও কান আছে। প্রচুর লোক এখন ইনফর্মার হয়েছে, কে যে শত্রু, আর কে যে বন্ধু বোঝা দায়।

ছ’জন তাসের জুয়াড়ীদের মধ্যে বাবুল চারজনকেই চেনে আগে থেকে। জহির, বাচ্চু, মণিলাল, বসির। খেলার নেশায় সবাই গম্ভীর। অপরিচিত দু’জনের মধ্যে একজনের মুখে জঙ্গলের মতন দাড়ি, মাথায় টুপি।

পল্টন বললো, দ্যাখো দ্যাখো কে এসেছে দ্যাখো। আর একটা পুরানো পাপী।

সবাই মুখ তুলে তাকালো। মণিলাল হাত তুলে বললো, আরে বাবুল চৌধুরী যে, আদাব, আদাব!

তারপর সে অন্যদের বললো, বাবুল চৌধুরী আইয়া পড়ছে, এখন খেলা ছাড়ান দাও, ওর খবর শুনি।

বসির বললো, দাঁড়াও, এই রাউণ্ডটা শেষ করো। আমি ভাই প্রচুর হারছি। বাবুল, খেলবি নাকি?

বাবুল স্মিত হেসে মাথা নাড়লো, সে কোনো রকম তাস খেলাই জানে না।

পল্টন একটা খালি গেলাস তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী খাবি, জিন না বীয়ার?

বাবুল মদ্যপানও করে না, কিন্তু সে কথা প্রথমেই বললে এরা হই হই করে উঠবে, তাই বললো, আগে শুধু পানি খাবো, যা গরম!

মণিলাল নিজের পাশের জায়গাটা চাপড়ে বললো, আসো বাবুল, এইখানে বসো। বাবুল জিজ্ঞেস করলো, মণিদা, তোমার ব্যবসাপত্তর কেমন চলছে?

মণিলাল বললো, ভালো। আমার তাসটা একটু ছুঁইয়া দাও তো, যদি লাক ফেরে। ঐ জহিরটা ডাকাইতের মতন জেততে আছে।

দাড়িওয়ালা, টুপি মাথায় লোকটি মুখ তুলে বললো, কী রে, বাবুল, ঢাকায় ফিরলি কবে?

কণ্ঠস্বর শুনে বাবুল চমকে উঠে বললো, আরে, কামাল? কী সাজ করেছিস? আমি তো চিনতেই পারিনি। ভাবলাম বুঝি কোন্ এক মোল্লার পো এসে বসেছে!

কামাল বললো, হ্যাঁ মোল্লাই সেজেছি। কোন্ পাড়ায় আছি জানিস না তো! আমার বাসার লোকেরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে!

–কেন, কী হয়েছে?

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কামাল তার পাশের লোকটিকে দেখিয়ে বললো, তুই বোধহয় এরে চিনিস না। ইনি ইউসুফ সাহেব, মীরপুরে থাকেন।

ইউসুফ বেশ গোলগাল, গৌরবর্ণ পুরুষ, মাথায় চুল লালচে রঙের, চোখে ঈষৎ রঙীন চশমা। সে হাত তুলে বললো, আস্সালাম আলাইকুম।

পল্টন বললো, ইউসুফ সাহেব আমারই মতন এক মোহাজের। ওঁর বাড়ি ছিল বিহারের ভাগলপুর জেলায়!

বসির বললো, মোহাজের কী রে ব্যাটা! বল্ রিফিউজি! ঐ কথাটা বুঝি বলতে খারাপ লাগে?

বাবুল ইউসুফের দিকে তাকিয়ে আলাইকুম’আস্সালামজানিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপ ক আয়া?

দু’তিনজন সমস্বরে বললো, আরে এ বাংলা জানে, বাংলা জানে!

ইউসুফ বললো, আমি এসেছি গত বছর। কাশ্মীরে হজরত বাল চুরি হবার পর যে দাঙ্গা হলো, তখন আর থাকা গেল না।

কামাল বললো, কাশ্মীরের রসুলুল্লাহের পবিত্র কেশ কে বা কারা চুরি করলো, আর তার জন্য বিহারে হাজার হাজার মানুষ মরলো।।

বসির বললো, সত্যিই কি রসুলুল্লাহের পবিত্র কেশ সেখানে ছিল? সত্যি কেউ চুরি করেছিল? তাও তো কেউ জানে না! শুধু একটা গুজবের জন্য ইন্ডিয়ায় মরলো কত নিরীহ লোক!

পল্টন বললো, আর এখানে কী হয়েছিল? ঢাকায়, নারায়ণগঞ্জে? এখানে যা হয়েছে সেটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও নয়, একতরফা খুন। আমি নিজের চোখে কত দেখেছি, ভাবলেও এখনো বমি আসে। গড় অঞ্চলের আদিবাসীরা, সে বেচারিরা কাশ্মীরের নামও শোনেনি

জহির মণিলালের পিঠে এক চাপড় মেরে হাসতে হাসতে বললো, এই মণিটা গত বছর বড় বাঁচা বেঁচে গেছে! ব্যাটার কাছে আমার অনেক টাকা ধার। আমি ওরে হাতের কাছে পাইলে সেই সুযোগে বিসমিল্লাহ্ আল্লাহ আকবর বলে কোরবানি করে দিতাম।

মণিলাল হাতের তাস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, ভাই ওসব কথা বাদ দাও! খ্যালতে চাও তো খ্যালো, না হয় অইন্য কথা কও!

কামাল বললো, ঐ কাশ্মীর হইলো ইন্ডিয়া-পাকিস্তান দুই দেশেরই গলার কাঁটা! মণিলাল রাগের সঙ্গে বললো, আবার ঐসব কথা!

পল্টন ঘরের সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে তারপর বাবুলকে জিজ্ঞেস করলো, তুই গত বছর সেই সময় কোথায় ছিলি?

বাবুল উত্তর দিল, বরিশালে। সেখানে বিশেষ কিছু হয়নি। হাওয়া গরম হয়েছিল বটে খানিকটা, স্থানীয় লোকরা আপ্রাণ চেষ্টায় আগুন ছড়াতে দেয়নি।

পল্টন বললো, তুই বোধ হয় জানিস না, জহির সেই সময় অনেক কাজ করেছে। ওর চেষ্টায় বেঁচে গেছে শত শত মানুষ। মণিলাল ওর বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল এক মাস।

জহির বললো, আরে ধ্যাৎ, আমার বাসায় কে কইলো তোরে, আমার এক মামার বাসায়। সেখানে আমি যাওয়ার চান্স পাই নাই। নইলে সত্যিই সেই মওকায় আমার সব ধার কাটান কুটিন করে ফেলতাম! এই শালার সাথে তাস খেলতে বসলেই আমি হারি।

মণিলাল বললো, আজ তুই জেতোস!

জহির বললো, ঐ জন্যই তো তুই তখন থেকে খেলা ভণ্ডুল করার সুযোগ খুঁজছিস! শালা কায়স্থর কুটিল বুদ্ধি!

পল্টন বললো, গেলাস খালি কেন, গেলাস খালি কেন?

এর পর কিছুক্ষণ খেলা বন্ধ রেখে ব্যক্তিগত খবরাখবর বিনিময় হলো। বাবুলকে দেখে সবাই খুশী। বাবুল কম কথা বলে, কিন্তু এক একজনের উপস্থিতির মধ্যেই একটা মনোরঞ্জনের ব্যাপার থাকে, বাবুলকে সেই কারণে সবাই ভালোবাসে।

এক সময় কামাল বললো, জানিস বাবুল, ইউসুফ সাহেব ভাল বাংলা গান জানে। বাবুল কৌতূহলী হয়ে তাকাতেই ইউসুফ লাজুকভাবে বললো, আমি ভাগলপুরের বাংগালীদের ইস্কুলে কিছুদিন পড়ালিখা করেছিলাম। তখন দু’চারটা রবীন্দর সঙ্গীত শিখেছি। সব গানের কথা মনে থাকে না।

–এই পল্টন, তোর বাড়িতে গীতবিতান নেই?

–আছে, কিন্তু ইউসুফ বাংলা পড়তে জানে না। একদিন দেখি কি, উর্দু হরফে রবীন্দ্রসঙ্গীত সামনে রেখেছে, তাই দেখে দেখে গাইছে। ইউসুফ, তোমার পকেটে সেই কাগজ নেই?

ইউসুফ মাথা নেড়ে বললো, আজ তো সঙ্গে আনিনি, আর একদিন শুনাবো! কামাল তবু পীড়াপীড়ি করে বললো, দু’চার লাইন গাও! যেটুকু মনে আছে!

শেষ পর্যন্ত ইউসুফ রাজি হয়ে চোখ বুজে খানিকক্ষণ সুর ভাঁজলো। তার কণ্ঠস্বর শুনলেই বোঝা যায় ক্লাসিকাল ট্রেনিং আছে। তারপর সে যে-গানটি শুরু করলো তা শুনে একই সঙ্গে চমকিত ও পুলকিত হলো বাবুল। “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরাণ সখা বন্ধু হে আমার…।” গানটি বাবুলের খুবই প্রিয়।

গানটি শুনতে শুনতে বাবুলের একটা নতুন উপলব্ধি হলো।

ভারত থেকে অনেক মুসলমান চলে এসেছে এদিকে, এই সব রিফিউজিরা পূর্ব পাকিস্তানে নানান সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বিহার থেকে যারা এসেছে, তাদের সম্পর্কে স্থানীয় মানুষদের মনোভাব মোটেই ভাল নয়। এই বিহারীরা বাঙালীদের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে না, এদের সমমর্মিতা পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে, এরা উর্দু ভাষার পক্ষে, বাংলাভাষী মুসলমানদের এরা খানিকটা কম মুসলমান মনে করে, বাঙালীদের প্রতি এদের যেন অবজ্ঞার ভাব আছে।

বিহারী মুসলমান শুনলে বাবুলের মনেও একটা বিরাগ ভাব জন্মায়। সে মনে মনে বলে, অতই যদি উর্দু ভাষা-প্রীতি আর কট্টর ইসলামী হতে চাও, তাহলে তোমরা ঢাকায় এলে কেন? লাহোরে বা করাচীতে গিয়ে আশ্রয় নিলেই পারতে!

কিন্তু আজ বাবুল একজন বিহারী মুসলমানকে দেখছো, যে উর্দু হরফে লিখে বাংলা গান গায়। রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছে সে, কণ্ঠে কী দরদ! ·

সব মানুষকেই তার জাতি-পরিচয় বা ধর্মীয় পরিচয়ে বিচার করা কত ভুল! বাবুল নিজেকে সব রকম সংস্কারমুক্ত মনে করে, কিন্তু তারও তো এরকম ভুল হয়।

কথা না ভুলে গিয়ে পুরোপুরিই গানটা সুন্দর ভাবে গাইলো ইউসুফ। বাবুল তৎক্ষণাৎ অনুরোধ করলো, আর একটা…

ইউসুফের মেজাজ এসে গেছে, সে এবার ধরলো, “পুরানো সেই দিনের কথা …সেও কি ভোলা যায়…”

ইউসুফের গান শুনে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে পল্টনের স্ত্রী নীলা। বাবুল হাতছানি দিয়ে বললো, ভাবী, আসুন, এখানে এসে বসুন।

নীলা কলকাতার মেয়ে, এখনো পূর্ব বাংলার ভাষা একটুও বলতে পারে না। পল্টনও ভালো মতন পারে না, কিন্তু চেষ্টা করে। নীলার সে চেষ্টাও নেই। সে বরং মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলে, তোমাদের বাঙালদের ভাষা বাপু আমি বুঝি না!

নীলার পাশে আর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, তাকে দেখে বাবুল লজ্জা পেয়ে গেল। এই মেয়েটি নীলার ছোট বোন, এর নাম দিলারা। এই দিলারার সঙ্গে বাবুলের বিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছিল। পল্টন দিলারার সঙ্গে বাবুলের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল তো বটেই, একবার সবাই মিলে এক সঙ্গে পিকনিকে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাবুল ততদিনে মঞ্জুকে দেখে ফেলেছে। মঞ্জুই জুড়ে আছে তার ধ্যান জ্ঞান।

দিলারার অবশ্য বিয়ে হয়ে গেছে এতদিনে। তার ব্যবহারে কোনো আড়ষ্টতা নেই। নীলার সঙ্গে এসে সেও বসলো বিছানার এক ধারে।

মহিলাদের প্রতি সম্রম দেখাবার জন্য অন্য সবাই মদের গেলাস নামিয়ে রাখলো, একমাত্র পল্টন ছাড়া। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে গান শুনে একটু একটু দুলছে। বাবুল আগে জানতো, পল্টন খুব একটা গানের ভক্ত নয়। বেশিক্ষণ গানটান চললে সে অধৈর্য হয়ে উঠতো। এখন কি তার স্বভাব বদলেছে?

নীলা আর দিলারা বসেছে একেবারে বাবুলের মুখোমুখি। বাবুল সামনের দিকে চোখ তুলতে পারছে না, দিলারার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই সে ফিরিয়ে নিচ্ছে চোখ। দিলারার মুখের গড়ন অনেকটা পানপাতার মতন, মাথার চুল কোঁকড়া, চোখদুটি ঢলঢলে। সে কিন্তু বেশ সপ্রতিভ, এক সময় সে নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন বাবুলভাই? মঞ্জুভাবীকে নিয়ে এলেন না কেন?

বাবুল অস্পষ্ট ভাবে বললো, না, ও আসতে পারতো না, ছেলের একটু জ্বর।

পল্টন বললো, তোর ছেলে হয়েছে বুঝি? সে কথা আমাদের বলিসনি এতক্ষণ? খাওয়াবি না আমাদের?

কামাল বললো, জিন তো ফুরিয়ে গেছে। বাবুলকে দিয়ে আর একটা বোতল আনাও!

গান থেমে গেছে। নীলা উঠে দাঁড়িয়ে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো, তোমরা আরও খাবে? এবার বন্ধ করো!

পল্টন বললো, এর মধ্যেই কী? তোমার রান্না হয়েছে?

জহির জিজ্ঞেস করলো, কী রান্না করেছেন ভাবী? শুঁটকি মাছ হয়েছে নাকি? তাহলে এখন নিয়া আসেন, একটু চাঁট হিসাবে খাই!

নীলা কলকাতার মেয়ে হলেও এখানে এসে চমৎকার শুঁটকি মাছ রান্না করতে শিখেছে, জহিরের বাড়ি চট্টগ্রামে, সেও সার্টিফিকেট দিয়েছে।

নীলা দু প্লেট খুঁটকি মাছ নিয়ে এলো, একটা চিংড়ির, অন্যটা বম্বে ডাকের। পল্টন খাটের তলা থেকে আর একটা নতুন জিনের বোতল বার করে সগর্বে দেখালো। মণিলাল-জহিররা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে বললো, সাবাস মিঞা! আরে পল্টন তো দেখছি খুব রিসোর্সফুল!

এবারে বাবুলকেও ঢেলে দেওয়া হলো একটা গেলাসে। বাবুলের গোঁড়ামি নেই, কিন্তু মদে সে বিশেষ স্বাদ পায় না। অনেকখানি সোড়া ঢেলে একটুখানি জিভে ছুঁইয়ে সে সরিয়ে রাখলো গেলাসটা।

রুটি ছিঁড়ে খানিকটা শুঁটকি মাছ মাখিয়ে মুখে ভরে দিয়ে জহির দু’চোখ ঘোরাতে লাগলো। তারপর বললো, অমৃত! অমৃত! নীলা ভাবী, তোমার জবাব নেই!

বাবুলও খানিকটা শুঁটকি মাছ খেয়ে দেখলো। হ্যাঁ, অমৃতই বটে। তবে অমৃতের স্বাদ মিষ্টি না টক না তীব্র ঝাল তা কোনো বইতে লেখা নেই। এত ঝাল বাবুলের সহ্য হয় না। বাবুলদের বাড়িতে এই সব রান্নার চল নেই।

ইউসুফ বিহারের মানুষ, সে জানে না শুঁটকি খেতে। অন্যরা হই হই করে দীক্ষা দিতে লাগলো তাকে। তিন চারজন বেশ মাতাল হয়ে গেছে, পল্টনই সব চেয়ে বেশি। ইউসুফের মুখের সামনে বীয়ারের গেলাস ধরে সে বলতে লাগলো, ঝাল লেগেছে, তাতে কী, বীয়ার খাও, বীয়ার খাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে!

এই সুযোগে উঠে পড়লো বাবুল। তাকে বাড়ি ফিরতে হবে, মঞ্জু বসে থাকবে। বাবুলের সঙ্গে সঙ্গে কামালও বেরিয়ে এলো জোর করে। দু’জনে হাঁটতে লাগলো বড় রাস্তার দিকে।

কামাল বেশ শক্ত ধরনের মানুষ, তার একটুও নেশা হয়নি। বাংলা বাজারে বইয়ের দোকানের আড্ডায় কামাল ছিল প্রধান তাত্ত্বিক, কথায় কথায় উদ্ধৃতি দিত নানা বই থেকে।

বাবুল জিজ্ঞেস করলো, তুই এরকম পোশাক করেছিস কেন বললি না তো!

কামাল বললো, তুই শুনিসনি, আমার বাবা গত বছর প্রচণ্ড মার খেয়ে কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে গেছেন!

–কেন, মার খেয়েছিলেন কেন? কারা মেরেছিল?

–উনি দাঙ্গা থামাতে গিয়েছিলেন। তুই জানিস না বোধ হয় আমার বাবা সত্যিই এক মৌলবীর সন্তান, কিন্তু এখনকার মৌলবীদের সঙ্গে ওনার মেলে না। আমাদের পাড়াটা হয়েছে জামাতে ইসলামীদের আড্ডা।

–তুই এখন কাজকর্ম কী করিস?

–সিনেমা লাইনে গেছি, ডায়লগ-স্ক্রিপ্ট লিখি।

–বাংলা সিনেমা! এগুলি তো একেবারে অগ্রাহ্য!

–কিন্তু এটাই সবচেয়ে নিরাপদ লাইন। আর কিছু করে খেতে হবে তো। পয়সা মন্দ দেয় না!

বাবুল হাসতে লাগলো। কামালের মতন পড়ুয়া মানুষ, মার্কসবাদ বনাম জাতীয়তাবাদ নিয়ে যে কথায় কথায় তর্ক তুলতো, সে প্যানপেনে প্রেমের গল্প মার্কা নিকৃষ্ট বাংলা ছবির সংলাপ লিখছে, এটা যেন বিশ্বাসই করা যায় না।

কামাল একটা সিগারেট ধরিয়ে খানিকটা দুঃখের সঙ্গে বললো, জানিস বাবুল, আত্মগোপন করতে গিয়ে কিছুদিন পর অনেকে আত্মপরিচয়টাই ভুলে যায়। আমাদের হয়েছে সেই অবস্থা। পলিটিকস করা যখন নিষিদ্ধ হয়ে গেল, তখন মিলিটারির ভয়ে অনেকেই অন্য লাইনে চলে গেল। পল্টনের মতন কেউ কেউ মজে গেল মদ-ভঙের নেশায়। কিন্তু এইভাবে তো দেশটা চলতে পারে না। কিন্তু অবস্থার তো আবার বদল হয়েছে, এখন আবার কিছু একটা করার সময় এসেছে, তবু অনেকেই মজে আছে নেশায়। আর বার হতে পারছে না। আজকের আড্ডাটা দেখে তোর কী মনে হলো?

কামালের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবুল খানিকটা শ্লেষের সঙ্গে বললো, এখন আবার সময় এসেছে বুঝি?

কামাল বললো, কেন, তুই বুঝতে পারছিস না? আকাশে মেঘ গুরুগুরু করছে, আবার একটা বড় ঝড় আসবে, আমরা যদি সেই ঝড়ের সুযোগ না নিতে পারি…

বাবুল উদাসীন ভাবে বললো, না, আমি তো সেরকম কিছু বুঝতে পারছি না! আমি এখন আর বুঝতেও চাই না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *