পাতিপুকুর স্টপে বাস থেকে নেমে অসমঞ্জ রায় রাস্তা পার হবার আগে একবার থমকে দাঁড়ালেন। একটা কথা তাঁর আগেই মনে পড়া উচিত ছিল। প্রমীলা আশ্রমে খালি হাতে যাওয়া ভালো দেখায় না। এদিকে মিষ্টির দোকান কোথায় পাওয়া যাবে? আগে মনে পড়লে তিনি শ্যামবাজার থেকে ভালো মিষ্টি নিয়ে আসতে পারতেন।
খানিকটা হেঁটে একটা ছোট দোকান পেলেন, সে-দোকানে মোট বাইশটা কড়া পাকের সন্দেশ রয়েছে, সবগুলিই কিনে ফেললেন তিনি। এক হাতে সেই বাক্স, অন্য হাতে কোঁচাটা তুলে ধরে হাঁটতে লাগলেন, রাস্তায় চিটচিটে কাদা রয়েছে।
মেঘলা আকাশে সন্ধে নেমে এসেছে আগে আগে। প্রমীলা, আশ্রমের গেটের আলোটা দূর থেকে দেখা যায়। নিয়নবাতি দিয়ে আশ্রমের নাম লেখা হয়েছে গত মাসে। আশ্রমের বেশ উন্নতি হচ্ছে দিন দিন। নেপালী দারোয়ান রাখা হয়েছে দু’জন। গ্লোব নাসারি বিনা পয়সায় দেবদারু গাছ লাগিয়ে দিয়েছে কয়েক সারি।
যোগেন দত্তর মায়ের নামে এই আশ্রমের নাম রাখার শর্ত ছিল, তাই-ই হয়েছে। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, যোগেন দত্তর মায়ের নাম প্রমীলা। সুতরাং অর্থের অসঙ্গতি হয়নি, বরং নামটি বেশ মানানসই হয়েছে।
রাস্তা থেকে পাগলিনীদের ধরে আনার ইচ্ছেটা পরিত্যাগ করতে হয়েছে চন্দ্রাকে। তাতে আইনের বাধা আছে। উন্মাদ আশ্রম বা লুনাটিক অ্যাসাইলাম খুলতে হলে সরকারের অনেক নিয়ম কানুন মানতে হয়। কে পাগল আর কে পাগল নয়, তা প্রমাণ সাপেক্ষ। যাকে তাকে পাগল বলে ধরে রাখা যায় না, এমনকি যে-নারী রাস্তায় উলঙ্গ হয়ে ঘোরে, তাকেও না।
আপাতত দুঃস্থ, সহায় সম্বলহীন, অসহায় মেয়েদের আশ্রয় দেওয়া হয় এখানে।
এক সময় এই অঞ্চলটা ছিল জন বিরল, এখন উপনিবেশ গড়ে উঠছে দ্রুত। ধনীদের বাগান বাড়ি গুলো টুকরো টুকরো প্লটে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, কাদের যেন একটা বেশ বড় বাড়ির গেটের মাথায় ছিল একটি নহবৎখানা, সেখানেও আশ্রয় নিয়েছে একটি পরিবার, ভেঁড়া কাঁথা ঝোলে, প্রায় শানাইয়ের মতনই তীব্র স্বরে শোনা যায় দু’একটি শিশুর গলায় কান্না। নহবৎখানার নিচটায় হয়েছে মটোর গাড়ি সারানোর খুদে কারখানা। যে-যেখানে পারে বাড়ি তুলছে, কলকাতা শহর ডাল-পালা মেলে এগিয়ে আসছে।
প্রমীলা আশ্রমের গেট দিয়ে ঢুকলেই সামনে একটি বাঁধানো চাতাল ও মন্দির। সেই মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণের শ্বেত পাথরের মূর্তি। মাত্র পঁচাত্তর-আশি বছর আগেও যে মানুষটি জীবিত ছিলেন, এখন তাঁকে পুজো করা হচ্ছে দেবতাজ্ঞানে। প্রতি সন্ধেবেলা আরতি হয়, ভক্ত আসে প্রচুর, শুধু স্থানীয় নয়, দূর দূর থেকেও।
জুতো খুলে রেখে, চাতালে উপবিষ্ট নর-নারীদের এক পাশ দিয়ে এগিয়ে অসমঞ্জ মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে মূর্তির পায়ের কাছে সন্দেশের বাক্সটি রাখলেন। একবার তাকিয়ে দেখলেন চন্দ্রার দিকে। সিল্কের গেরুয়া পরা চন্দ্রা চোখ বুজে আছে, যেন ধ্যান-বিভোর। অসমঞ্জ ভাবলেন, তিনি যে পয়সা খরচ করে মিষ্টি আনলেন সেটা চন্দ্রা জানবে না? তা হলে আনার কী মানে হয়? এখানে আরও অনেকে ভোগ দিয়েছে, তার মধ্যে অসমঞ্জর বাক্সটা মিশে যাবে। চন্দ্রাকে এখন ডাকার উপায় নেই, তাই তিনি ডান পাশে বসা আর একটি নারীকে উদ্দেশ্য করে বেশ জোরে বললেন, এটা এখানে রাখি? বাক্সর মুখটা খুলে দিতে হবে?
মেয়েটি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে তার দরকার নেই।
সেখান থেকে নেমে অসমঞ্জ চাতালের ভক্তদের মধ্যে ফিরে গেলেন না, বাঁ দিকের অফিস ঘরে একটা চেয়ারে বসলেন। তিনি এই আশ্রমের অন্যতম ট্রাস্টি, তার আসন আলাদা জায়গায়। তবে তিনিও হাত জোড় করে চোখ বুজে কীর্তন গানের তালে তালে দোলাতে লাগলেন মাথা। এখানে ধূমপান নিষেধ, সন্ধ্যারতির সময় কথা বলাও চলে না।
এই অফিস ঘর থেকে মন্দিরের অভ্যন্তর দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু অসমঞ্জ চন্দ্রাকে দেখতে পাচ্ছেন না, মাঝখানে একজন মোটা সোটা মহিলা দাঁড়িয়ে আড়াল করে আছেন। উনি এই আশ্রমের সুপার, ওঁর নাম কুমুদিনী, কিন্তু এই আশ্রমের সকলেই যে আড়ালে ওঁকে বাঘিনী বলে ডাকে তা অসমঞ্জও জানেন। প্রকৃতি ওঁকে পুরুষ হিসেবে গড়তে গিয়েও মুহূর্তের ভুলে নারী করে পাঠিয়েছেন। একদিন উনি নাকি এ পাড়ার দুটি রসস্থ ছোঁকরাকে তেড়ে গিয়েছিলেন লাঠি হাতে নিয়ে।
অসমঞ্জ মাঝে মাঝে চোখ পিটপিট করে চন্দ্রাকে দেখতে চাইছেন। কিন্তু ঐ পাহাড়টি না সরলে কোনো লাভ নেই। কতক্ষণ চলবে? অসমঞ্জ মন দিয়ে গানটা শোনার চেষ্টা করলেন। শেষ গানটি তিনি চেনেন, সেটি হলো, “কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন।– তাঁর রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব যাঁর হাতে মরণ বাঁচন।” এখন অন্য গান হচ্ছে।
চন্দ্রার সঙ্গে প্রথম আলাপের দু’এক বছরের মধ্যে অসমঞ্জ কোনোদিন তার গলায় গান শোনেন নি। এখন সে এইসব কীর্তন টির্তন দিব্যি গায়। সত্যিই কি অলৌকিক কিছু ভর করেছে তার ওপর? অসমঞ্জ পুরোপুরি নাস্তিক নন, নিজের জীবনে ধর্মচর্চা না করলেও অবিশ্বাস করতে ভয় পান। চন্দ্রার কথা বলার ধরন, চোখের দৃষ্টি এমন ভাবে বদলে গেছে যে মাঝে মাঝে চন্দ্রাকেও তাঁর ভয় হয়। আবার এক এক সময় মনে হয়, চন্দ্রা যেন ইচ্ছে করে কোনো উদ্দেশ্যে এই ছদ্মবেশ ধরে আছে।
যোগেন দত্তর সঙ্গে ডায়মণ্ড হারবারে বেড়াতে গিয়েছিল চন্দ্রা। কী ঘটেছিল সেখানে? ডায়মণ্ড হারবার যাবার কথা অসমঞ্জ আগে থেকে কিছুই জানতেন না, শোনার পর তাঁর মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল। আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ অধ্যাপক হলেও অসম রায়ের মতন মানুষও বোধহয় কখনো কখনো মানুষ খুন করতে পারে। ক্রাইম অফ প্যাশান। অন্য কেউ চন্দ্রার। গায়ে হাত ছুঁইয়েছে এরকম চিন্তা করলেই অসমঞ্জ প্রায় পাগলের মত হয়ে ওঠেন!
ডায়মণ্ড হারবার থেকে চন্দ্রা: ফিরে এসেছিল রাত পৌনে দুটোয়। এবং সে যোগেন দত্তর নামে কোনো অভিযোগ করে নি। কোনো মানসিক বিপর্যয়ও লক্ষ করা যায় নি। কিন্তু সেই ঘটনার সাত দিনের মধ্যেই সে বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মঠে গিয়ে নিয়ে সন্ন্যাসিনী হতে চেয়েছিল।
কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা নিলেই সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনী হওয়া যায় না কিংবা গেরুয়া ধারণ করার অনুমতি পাওয়া যায় না, তার আগে কয়েকটা স্তর পেরিয়ে আসতে হয়। চন্দ্রার অত ধৈর্য নেই। দু’দিন পরে সে বেলঘরিয়ায় শিবানন্দ স্বামীর কাছে আবার দীক্ষা নিয়ে স্বেচ্ছায় গেরুয়া ধারণ করেছে। মাথার চুল হেঁটে ফেলেছে ছোট ছোট করে। বেলঘরিয়ার সেই আশ্রমে সে থেকে এসেছে তিন মাস।
চন্দ্রার বাবার সঙ্গে ‘অসমঞ্জর আলোচনা হয়েছিল এ ব্যাপারে।
আনন্দমোহন বলেছিলেন, চন্দ্রার তো এলাহাবাদে যাবার কথা ছিল শিবানীর বিয়েতে, এইভাবে ও এলাহাবাদে যাওয়াটা এড়িয়ে গেল।
চন্দ্রার এলাহাবাদ পর্বটাও অসমঞ্জ প্রায় কিছুই জানেন না। কী যেন একটা রহস্য আছে। এলাবাদের প্রসঙ্গ উঠলেই চন্দ্রা চটে উঠতো।
আনন্দমোহনকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, চন্দ্রা যেতে চায় না কেন এলাহাবাদ?
আনন্দমোহনও সরাসরি উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, যেতে ও চায় না, সে জন্য আমি ওকে জোর করি না। কিন্তু ওর মা জোর করে পাঠাতে চায়। আমার এই মেয়েটা ছেলেবেলা থেকেই বড্ড জেদী।
–তা বলে মন্ত্র নেওয়া, গেরুয়া পরা, এসব নিয়ে ছেলেমানুষী করা কি ঠিক?
–আমি বাবা বলেই কি ফতোয়া দিতে পারি, ওর জীবনের কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক। অ্যাডাল্ট ছেলেমেয়ে, শিক্ষা দীক্ষা পেয়েছে, ওরাই ঠিক করে নেবে কী ভাবে জীবনটা কাটাবে। কেন, আপনার কী মনে হয়, একবার গেরুয়া ধারণ করে তারপর কিছুদিন বাদে ফের গেরুয়া ছেড়ে বেনারসী শাড়ী পরা অন্যায়?
অসমঞ্জ অবাক হন। তিনি লেখাপড়া জানা মানুষ। আধুনিক যুক্তিবাদ তাঁর অজানা নয়। কিন্তু মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের কোনো বাবা শ্রেণীর মানুষের মুখে এরকম কথা শুনবেন, তিনি আশা করেন নি। তাও নিজের মেয়ে সম্পর্কে? অন্যদের ব্যাপারে ভাসা ভাসা আদর্শবাদের কথা বলা সহজ, কিন্তু নিজের ছেলে মেয়েদের বেলায়…
অসমঞ্জ আধুনিক যুক্তিবাদের কথা বইয়ের পৃষ্ঠায় পড়লেও তাঁর নিজের জীবন চর্যায় অনেক সংস্কার রয়ে গেছে। ছেলেখেলার মতন একবার গেরুয়া ধারণ করে সন্ন্যাসিনী হয়ে আবার কয়েক মাস বাদে সিল্কের শাড়ী পরে টেনিস খেলতে যাওয়া এবং সিগারেট টানতে টানতে পরপুরুষের গায়ে ঢলে পড়া, তাঁর মতে এটা ধর্মীয় ব্যভিচার, এটা পাপ। তাঁর ধারণা, চন্দ্রা ঠিক এই ব্যাপারটাই করবে।
আনন্দমোহনকে তিনি খানিকটা মাস্টারি ধরনে বলেছিলেন, আপনি আপনার মেয়েকে বড় বেশি আদর দিয়েছেন। কিছু কিছু ভ্যালুজ তো মানতেই হয়!
আনন্দমোহনকে যতটা সরল ও আপন ভোলা মনে হয়, তিনি আসলে ততটা নন নিশ্চয়ই। তা হলে আর শ্যামবাজারের মতন পাড়ায় অতবড় ওষুধের দোকান চালাচ্ছেন কী করে?
অসমঞ্জর ঐ কথা শুনে আনন্দমোহন বলেছিলেন, হ্যাঁ, বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়ে। আদরটা বেশিই পেয়েছে। তাতে ক্ষতি কিছু হয়েছে কী? চন্দ্রা কোনোদিন নিন্দনীয় কিছু কাজ করেনি।সেইজন্যই তো রাত নটাতেও ওর কোনো পুরুষ বন্ধু দেখা করতে এলে আমরা কিছু মনে করি না। আমার মেয়েকে তো আমি চিনি!
অসমঞ্জর মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। মিষ্টি মিষ্টি সুরে আনন্দমোহন তাঁকেই ঘুরিয়ে থাপ্পড় মারলেন। অসমঞ্জই তো প্রায়ই টিউশানি সেরে রাত ন’টার পর ‘চন্দ্রার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন।
টাকার অভাবে প্রমীলা সমিতির বাড়ি তৈরির কাজ কিছুদিন বন্ধ ছিল। তিন মাস পরে চন্দ্রা বেলঘরিয়ার আশ্রম থেকে ফিরে পুরোপুরি আবার সেইকাজে লাগলো। বাবার বাড়ি ছেড়ে সে ঠাঁই নিল প্রমীলা আশ্রমের সেই অসমাপ্ত বাড়িতে, তার নাম হলো চন্দ্রামা, তার কথার লব্জ হলো, ‘তিনি রবি, আমি চন্দ্র, তিনি আলো, আমি মুকুর, তিনি সাগর, আমি নদী, তিনি স্রষ্টা, আমি সৃষ্টি, তিনি বিভু আমি ভূ।’
অতিশয় সরল ও বহু ব্যবহৃত এই সব কথাই অধ্যাত্ম দর্শন নামে এখনো চলে। চন্দ্রামার চেলা জুটতে দেরি হলো না। সে এক রূপসী যোগিনী, এর অতিরিক্ত আকর্ষণ তো আছেই, শুধু পুরুষরা নয়, মহিলারাও সুন্দরী সন্ন্যাসিনী দেখে আকৃষ্ট হয়। সেই যোগেন দত্তই আবার ফিরে দিতে লাগলো টাকা। আরও দাতা জুটিয়ে আনলো সে, সেই টাকায় সম্পূর্ণ হলো আশ্রম বাড়ি। তৈরি হলো মন্দির। এ দেশে মন্দির-মশজিদ গড়ার জন্য কখনো টাকার অভাব হয় না। যোগেন দত্তর মায়ের নামেই সংস্থার নাম হয়েছে কিন্তু অনেকেরই মুখে মুখে এর নাম শুধু চন্দ্রামা’র আশ্রম! চন্দ্রার অনুরোধেই যোগেন দত্ত এই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হয়েছে। অসমঞ্জ ভাবেন, তা হলে কি ডায়মণ্ড হারবারে যোগেন দত্ত চন্দ্রার প্রতি কোনো অসমীচীন আচরণ করে নি? তবে চন্দ্রা ডায়মণ্ড হারবার বেড়াতে গেল কেন ওর সঙ্গে, গভীর রাতে ফিরে এসে কদিন পরই সে কেন ব্রহ্মচারিণী সন্ন্যাসিনী হতে চাইলো?
অসমঞ্জ ধরেই রেখেছিলেন, চন্দ্রার এই হুজুগ বেশিদিন টিকবে না। চন্দ্রা খেলাধূলা করতে, নাচতে, বেড়াতে ভালোবাসে, আগে সে সিগারেট খেত খুব, বীয়ার কিংবা জিন পানে আসক্তি ছিল, সমাজসেবা বা নিরাশ্রয় মেয়েদের জন্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা তার একটা শখ মাত্র, সে শুধু ঐ শখের জন্য তার ব্যক্তিগত জীবন-উপভোগ বাদ দিতে পারবে না।
তা ছাড়া আর একটা ব্যাপারেও অসম্ভব সন্দেহ হয়েছিল। অপূর্ব বর্মণ নামে একজন আর্কিটেক্টের সঙ্গে চার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে ছোঁকরা সময়ে অসময়ে ঘুরঘুর করতো চন্দ্রার আশেপাশে। সে অতি সুপুরুষ এবং কাজকর্মের ব্যাপারেও সার্থক। সন্ন্যাসিনী হবার পরেও চন্দ্রা ঐ অপূর্ব বর্মনকেই ডাকলো তার বাড়ি সম্পূর্ণ করবার জন্য। অপূর্ব বর্মণ এজন্য টাকাকড়ি কিছু পায় নি, তবু সে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে গেছে এখানে। চন্দ্রা না হয় সন্ন্যাসী হয়েছে, অপূর্ব বর্মণ তো সাধু হয়নি, তা হলে তার কিসের টান? শুধু ঐ অপূর্ব বর্মণের ওপর নজর রাখবার জন্যই অসমঞ্জ নিজের প্রচুর কাজ নষ্ট করে এখানে এসে পড়ে থাকতেন। না, এতদিনেও তিনি ওদের মধ্যে কোনো গোপন লীলাখেলা আবিষ্কার করতে পারেন নি।
ঐ অপূর্ব বর্মণ লোকটি, ইংরেজিতে যাকে বলে একটি এনিগমা। ওর কোনো দোষ ধরতে পারেন নি অসমঞ্জ, তবু ওকে তিনি সহ্য করতে পারেন না। ও যে এ পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো অন্যায় করেনি, সেটাই যেন একটা প্রচণ্ড অন্যায়। একটা সুস্থ, সবল, যুবক, সে কী চায়? সে কিছুই চায় না, তবু আসে? অপূর্ব বর্মণ যেন একেবারে ভদ্রতার প্রতিমূর্তি, তার মুখের বাঁধানো হাসিটি দেখলেই অসমঞ্জর শরীর রি-রি করে! সে কোনোদিন অসমঞ্জর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি, সেটাও তার একটা অপরাধ, সে এতবড় শয়তান যে অসমঞ্জকে খারাপ ব্যবহারের উত্তর দেবার সুযোগ পর্যন্ত দিচ্ছে না।
এই পাতিপুকুর আশ্রমে চন্দ্রার জনপ্রিয়তা হঠাৎ বাড়িয়ে দেন চন্দ্রার বাবা আনন্দমোহন স্বয়ং।
বছর দুয়েক ঘোরবার পর, অসমঞ্জ তখনও পর্যন্ত আশা ছাড়েন নি চন্দ্রার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার, সেই সময় একদিন বিকেলের প্রার্থনা সভায় দেখা গেল আনন্দমোহন বসে আছেন চাতালের ভক্তদের মধ্যে। সেই দিনটি ছিল শনিবার, চন্দ্রার উপদেশ দেবার দিন। আনন্দমোহন এসে পরিচয় দেন নি চন্দ্রার বাবা হিসেবে, চন্দ্রাও নিশ্চয়ই বাবাকে দেখতে পেয়েছিল, তবু তাঁর প্রতি কিছু আলাদা মনোযোগ দেয়নি বা পিতৃ সম্বোধনও করে নি। তাহলেও বিদ্যুতের মতন কথাটা রটে গিয়েছিল। চন্দ্রামার বাবা এসেছেন মেয়ের উপদেশ শুনতে! চন্দ্রা মা’র কী অলৌকিক শক্তি, তিনি নিজের পিতাকেও ভক্ত বানিয়েছেন।
সেদিন অসমঞ্জ উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু ঘটনাটা শুনেই তাঁর মনে হয়েছিল, এটা একটা পাবলিসিটি স্টান্ট! বাবা আর মেয়ের ষড়যন্ত্র! অসমঞ্জ রীতিমতন বিরক্ত হয়েছিলেন। ওষুধের দোকান থেকে তো যথেষ্ট লাভ হয়,আনন্দমোহন কি তবে প্রমীলা আশ্রম থেকেও কিছু বাগাবার তালে আছেন নাকি?
শ্যামবাজারের দোকানে ওষুধ কেনার ছলে একদিন গিয়ে অসমঞ্জ আনন্দমোহনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, শুনলাম নাকি আপনি নিজেই এখন আপনার মেয়ের ভক্ত হয়েছেন?
মাথা ভর্তি পাকাচুল সমেত সেই বৃদ্ধ সরল বিস্ময়ে ভুরু তুলে বলেছিলেন, ও আর আমার মেয়ে নয়, অসমঞ্জবাবু! ওর ওপর কিছু ভর করেছে। আমি নিছক পরীক্ষা করবার জন্য গিয়েছিলাম একদিন, বুঝলেন। ভেবেছিলাম, শুনি না ও লোকদের কী বলে! শুনতে গিয়ে আমি তো, কী বলবো আপনাকে, একেবারে অভিভূত। এসব ও কোথায় শিখলো? চন্দ্রা তো কোনোদিন দর্শন পড়ে নি। কত সাধারণ কথা ও কত গভীরভাবে বলে! তারপর থেকে ইচ্ছে করে রোজ শুনতে যাই!
–আপনার তা হলে ধারণা যে আপনার মেয়ে সত্যি সন্ন্যাসিনী হয়ে গেল, আর ফিরবে না?
–আপনার কি ধারণা, অসমঞ্জবাবু?
–সত্যি কথা বলবো, আমি মনে করি, এই সব ভড়ং আপনার মেয়ে বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না! ও মেয়ে অন্য ধাতুতে গড়া!
আনন্দমোহন দুঃখিত স্বরে, পাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে শুনিয়েছিলেন, আপনিই একদিন আমায় বলেছিলেন, একবার গেরুয়া ধারণ করে তারপর আবার ছেড়ে আসা পাপ। আমার মেয়ে তা হলে পাপীয়সী হবে? কী জানি, কী আছে ভবিতব্য!
অসমঞ্জ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক উত্তর দিতে পারেন নি। হ্যাঁ। তিনি মনে করেন, একবার গেরুয়া ধারণ করে আবার তা ছেড়ে দেওয়াটা পাপ। অথচ, তিনি চান চন্দ্রা ঐ সব ভড়ং ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক।
অসমঞ্জ প্রমিলা আশ্রমের সঙ্গে সব সংশ্রব চুকিয়ে দিতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা অধিকাংশই বামপন্থার দিকে ঝুঁকেছেন। কংগ্রেস শাসনের প্রতি সারা পশ্চিম বাংলা বীতশ্রদ্ধ। বিধান রায় তবু শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন, এখন প্রফুল্ল সেনের আমলে দিন দিন বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। ওদিকে কেন্দ্রেও চীনের সঙ্গে হঠকারীর মতন যুদ্ধ বাধিয়ে তারপর শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের পর ম্লান হয়ে গেছেন জওহরলাল নেহরু, তাঁর স্বাস্থ্যও ভালো নয়। বামপন্থীরা চীন-ভারত যুদ্ধসূচনার পুরো দায়িত্বটা চাপিয়ে দিয়েছে ভারত সরকারের কাঁধে। অসমঞ্জ রায় মনেপ্রাণে পুরোপুরি বামপন্থী নন, তবে তিনি সবসময়ই হাওয়ার স্রোতের অনুকূলে, তাই তিনি গলা মিলিয়েছেন বামপন্থীদের সঙ্গে, ওদের সমর্থন পেয়ে তিনি সিন্ডিকেটের নির্বাচনে জিতেছেন। এখন তাঁর পক্ষে কোনো ধর্মীয় সংস্থার সঙ্গে সংযোগ রাখা সমুচিত নয়।
কিন্তু অসমঞ্জ অসহায়। চন্দ্রাকে ছেড়ে দূরে চলে যাবার সাধ্য তাঁর নেই। দুতিনদিন চন্দ্রাকে দেখলেই জীবনটা বিস্বাদ মনে হয়। চন্দ্রা তাঁকে অবহেলা করলেও তাঁর উপায় নেই।
সন্ন্যাসিনী হবার আগে বরং কিছুদিন অসমঞ্জর প্রতি চন্দ্রা বেশ বিরাগ দেখিয়েছিল। অসমঞ্জের চেয়েও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ছিল চন্দ্রার বেশি ভাব। কিন্তু একবার গেরুয়া ধারণ করার পর চন্দ্রার ব্যবহার আবার বদলে গেছে, চন্দ্রাই তো বারবার অনুরোধ করেছে অসমঞ্জকে এই প্রমিলা আশ্রম ট্রাস্টের সদস্য হতে। আশ্রম চালাবার ব্যাপারে চন্দ্রা তাঁর পরামর্শ চায় যখন তখন।
চন্দ্রা কি জানে না অসমঞ্জ কী চান চন্দ্রার কাছ থেকে? না জানার তো কথা নয়!
অসমঞ্জ চান চন্দ্রার স্পর্শ। তিনি চান ওকে বুকে জড়াতে। কল্পনায় যখন তিনি সেই দৃশ্যটা ভাবেন, তখন তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। চন্দ্রাকে পাওয়ার বিনিময়ে তিনি নিজের স্ত্রী-পুত্র-সংসার, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি, সামাজিক প্রতিপত্তি সব কিছু পরিত্যাগ করতে রাজি আছেন। দিন দিন তাঁর এই আকাঙ্ক্ষাটা বাড়ছে।
আগে যে-কোনো ছুতোয় অসমঞ্জ চন্দ্রাকে একটু-আধটু ছুঁয়ে দিতেন। এখন তাঁকে সব সময় একটু দূরত্ব রাখতে হয়। সন্ন্যাসিনীকে স্পর্শ করার সাহস তাঁর নেই। চন্দ্রা কারুকে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করারও অনুমতি দেয় না। অথচ দিনের পর দিন কী সুন্দর হচ্ছে চন্দ্রা!
অসমঞ্জ মাঝে মাঝেই ভাবেন বোমা মেরে যদি এইসব আশ্রম টাশ্রম একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া যেত! এদেশে সংসার পরিত্যক্ত হাজার হাজার মেয়ে পথে পথে ঘুরছে, তার মধ্যে মাত্র পনেরো-ষোলোটি মেয়েকে আশ্রয় দিয়ে সমাজের কী উন্নতি হবে? এসব হচ্ছে দেশোদ্ধারের বিলাসিতা!
অসমঞ্জ মনে মনে সর্বক্ষণ বলতে চান, ফিরে এসো, চন্দ্রা, ফিরে এসো, তোমার আগেকার জীবনে এসো, আমরা একসঙ্গে আবার গাড়ি চেপে রিফিউজি কলোনিতে যাবো, তোমার সঙ্গে আমি তাল মেলাবো, দুঃস্থ ছেলে-মেয়েদের জন্য ইস্কুল খোলার জন্য আমি মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে আমার প্রভাব খাটাবো, কিন্তু আশ্রম-টাম এসব কী?
অসমঞ্জ হঠাৎ খেয়াল করলেন, এবার ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়…’ গান হচ্ছে, কুমুদিনী সরে দাঁড়ানোতে চন্দ্রাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চন্দ্রার চক্ষু দুটি এখনও বোঁজা, আস্তে আস্তে দুলছে তার মাথাটা। অসমঞ্জের দৃষ্টিপথ থেকে আর সব কিছু অদৃশ্য হয়ে গেল, আর কারুকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, এমনকি শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তিও না, তিনি শুধু দেখছেন চন্দ্রার মুখমণ্ডল। তাঁর হৃদয় কাতরভাবে বলে উঠলো, ফিরে এসো, চন্দ্রা, ফিরে এসো!
প্রার্থনা শেষ হবার পরেও প্রসাদ বিলি করতে খানিকক্ষণ সময় লাগবে। অসমঞ্জ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে হাতছানি দিয়ে এক রমণীকে ডাকলেন। এর নাম কিরণ, খুবই শুকনো ও বিমর্ষ চেহারা, একে তুলে আনা হয়েছিল শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে। এর বেশ মাথা খারাপ ছিল। আশ্রমের অন্যতম ট্রাস্টি একজন নাম করা ডাক্তার, তাঁর নাম বিজন ব্যানার্জি, তিনি সপ্তাহে দু’দিন এখানে চিকিৎসা করেন। ডঃ বিজন ব্যানার্জির চেষ্টায় কিরণ অনেকখানি সুস্থ হলেও পুরোপুরি সারেনি, সে প্রায় কারুর সঙ্গেই কথাবার্তা বলতে চায় না, তার অতীতের কথাও জানায় না। তবে কিরণ রান্না করে ভালো, তার ওপর রান্নাঘরের ভার দেওয়া হয়েছে, সেটা সে বেশ সুষ্ঠুভাবে পালন করে।
কিরণ কাছে আসতেই অসমঞ্জ বললেন, কেমন আছো, কিরণ? এক কাপ চা খাওয়াতে পারবে?
কিরণ মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ভেতরের দিকে পা বাড়াতেই অসমঞ্জর একটা কথা মনে পড়ে গেল। বাজারে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন যে-কোনো বাড়িতে গেলেই চিনির আলোচনা। সরকার লোক দেখানোভাবে ১৫ জন চিনির কালোবাজারিকে গ্রেফতার করেছে, তাতে কিছুই সুরাহা হয় নি। গোপন- বাজার থেকে যদি বা একটু চিনি সংগ্রহ করা যায়, তার দামও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। প্রতি কিলো দেড় টাকা! ট্রামে বাসে লোকজন বলাবলি করে, প্রফুল্ল সেন এবারে বাঙালীর চা-খাওয়ার অভ্যেস ছাড়াবে! আরে ধুর, ধুর, গুড় দিয়ে কী চা খাওয়া যায়?
অসমঞ্জ আবার কিরণকে ডেকে বললেন, শোনো, কিরণ, চা খাওয়াবে তো বললে, তোমাদের চিনি আছে?
কিরণ দু’দিকে মাথা নাড়লো।
–তা হলে যে চা আনতে যাচ্ছিলে?
কিরণ নির্বাকভাবে গোল গোল চোখ মেলে অসমঞ্জের দিকে তাকিয়ে রইলো।
–গুড়ের চা খাওয়াতে চাইছিলে নাকি?
আর একটি মেয়ে এদিকে এসে বললো, আমরা তো এখানে গুড়ের চা-ই খাই।
অসমঞ্জ বললেন, থাক, আমার জন্য চা আনতে হবে না।
তাঁর মাথায় একটা চিন্তা এলো। যোগেন দত্তর বড়বাজারে অনেক প্রতিপত্তি, সে আশ্রমের জন্য চিনি জোগাড় করে দিতে পারে না? অসমঞ্জর কিন্তু একটা সোর্স আছে। ফুড ডিপার্টমেন্টের এক কত্তার ছেলে তাঁর ছাত্র, সে দশ কিলো চিনি ভেট পাঠিয়েছে অসমঞ্জর বাড়িতে। সেই ছেলেটির বাবাকে ধরে এই আশ্রমের জন্য কিছু চিনি বরাদ্দ করিয়ে নেওয়া যেতে পারে ন্যায়সঙ্গতভাবেই।
এ প্রসঙ্গ কিরণদের সঙ্গে আলোচনা করার কোনো মানে হয় না। চন্দ্রাকে বলতে হবে, চন্দ্রা নিশ্চয়ই খুশী হবে। সন্ন্যাসিনী হয়েও চন্দ্রা চা-খাওয়া ছাড়েনি, এটা অসমঞ্জ লক্ষ করেছেন।
কিরণের পাশে এখন যে-মেয়েটি দাঁড়িয়ে, তার নাম সুধা। সে যেন কিরণের ইন্টারপ্রেটার। কোনো প্রশ্ন শুনেও কিরণ চুপ করে থাকলে সে উত্তর জুগিয়ে দেয়। সুধা মেয়েটি বেশ চটপটে, তার ওপর প্রতিদিনের বাজার খরচের হিসেব রাখার ভার। অসমঞ্জ তার সঙ্গে দৈনন্দিন কাঁচা বাজার বিষয়ে আলোচনা করলেন। তিনি নিজে কক্ষণো বাজারে যান না, তাঁর নিজের সংসারে। কোনদিন কতটা আলু-পটল-মাছ আসে সে খবরও তিনি রাখেন না, কিন্তু ট্রাস্টি হিসেবে এখানকার খরচপত্তরের তত্ত্বাবধান করতে হয় তাঁকে। দৈনন্দিন যে টাকা এখানে বরাদ্দ, তা দিয়ে আর কুলোচ্ছে না। বাজারে এখন আগুন লেগেছে। সামান্য যে আলু, তাও এখন বেয়াল্লিশ পয়সা কিলো। মানুষ খাবে কী?
সুধা বললো, দাদা, আমাদের এখানে কলারপাতায় খাওয়ার ব্যবস্থা তুলে দিন। টিনের বা অ্যালুমুনিয়ামের থালা কিনে দিন বরং, তাতে পয়সার সাশ্রয় হবে!
অসমঞ্জ বললেন, কেন? কলার পাতায় খাওয়াই তো ভালো, বাসনপত্র মাজাঘষার ঝামেলা নেই।
–আপনি ব্যবস্থা করুন, প্রত্যেকে যার যার বাসন মেজে নেবে। এখন এক বান্ডিল কলাপাতার জন্য রোজ কুড়ি নয়া করে লাগছে!
–কলাপাতার বান্ডিল কুড়ি নয়া করে?
–বিয়ের দিন থাকলে পঁচিশ নয়া নেয়। বলেন, এইটা একটা বাজে খরচ না? অসমঞ্জ মাথা নাড়লেন। এর পরের মিটিং-এ এই কথাটা তুলতে হবে।
একটু বাদে ভেতরে এলো চন্দ্রা। তার গেরুয়া বসনের আঁচল গলায় জড়ানো। কপালে একটা বড় লাল টিপ। ঠোঁটে মধুমাখা স্মিত হাসি। তার শরীরে কোনো অলংকার নেই তবু সে যেন ষড়ৈশ্বর্যময়ী। ডান হাতে ঝুলছে একটা রুদ্রাক্ষের মালা।
–কেমন আছো, অসমঞ্জ? তুমি গত শনিবার এলে না?
–হ্যাঁ, আসতে পারিনি। চন্দ্রা, তোমার সঙ্গে আমার দু’একটা কথা আছে।
-–এসো। দালানে গিয়ে বসি।
অসমঞ্জ কেঁপে উঠলেন ভেতরে ভেতরে। চন্দ্রা এর আগে কোনোদিন তাঁকে তুমি বলে সম্বোধন করে নি।
চন্দ্রা বললো, আজ আমার আবার চোখ খুলে গেল। সব মানুষই নারায়ণ। তবু মানুষে আর নারায়ণে ভেদ রাখি কেন? অসমঞ্জ, আজ আমি তোমার মধ্যেও নারায়ণকে দেখতে পেলাম।
অসমঞ্জ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি যেন দিব্য দৃষ্টিতে দেখলেন, চন্দ্রার গায়ে গেরুয়া নেই, কপালে ঐ বিশ্রী লাল টিপটা নেই, আগেকার মতন চন্দ্রার পরনে একটা হালকা নীল শাড়ী, তার গলায় চন্দ্রহার, হাতে সিগারেট, সে যেন দু’হাত বাড়িয়ে অসমঞ্জকে নিজের বুকে নেবার জন্য ডাকছে, এসো, এসো!