2 of 3

২.০৬ খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছেন প্রতাপ

অনেকক্ষণ ধরে খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছেন প্রতাপ। কিংবা পড়া শেষ হয়ে গেছে, তবু চেয়ে আছেন কাগজের দিকে। আনন্দবাজারে ব্যানার হেড লাইন : পূর্ব পাকিস্তানে খণ্ড প্রলয়। তার নিচে গোটা গোটা অক্ষরে বিভিন্ন জেলায় মৃত্যু ও ক্ষয়-ক্ষতির বর্ণনা। চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, বরিশাল, খুলনা এই সব নামগুলি শুনলে বা ছাপার অক্ষরে দেখলে প্রতাপের মনে এখনও রোমাঞ্চ জাগে, ছবি ভেসে ওঠে। কতদিন হয়ে গেল, প্রায় বছর পনেরো, তবু ছবিগুলি মোছে না, বরং যেন গাঢ়তর হয়ে উঠছে দিন দিন।

তাঁর ছেলে মেয়েদের মনে এই সব নাম একটুও দাগ কাটে না। বাবলু, মুন্নিরাও সকালে কাগজ পড়েছে, এ বিষয়ে একটা কথাও বলেনি, তুতুলের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল। অবশ্য ওরা কতটুকুই বা দেখেছে নিজের দেশ, ওদের কিছুই মনে থাকবার কথা নয়। ওদের তুলনায় পিকলু বরং বেশি দেখেছিল, এস প্রায়ই বলতো…

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতাপ জানলার দিকে তাকালেন। অসহ্য গ্রীষ্মের দুপুর, তবু রাস্তায় লোক চলাচলের বিরাম নেই। রাত্তিরে ঘণ্টা তিন চার বাদ দিলে এ শহরের রাস্তায় সব সময়ই মানুষ। জানলার পদাটা গুটিয়ে গেছে এক পাশে, বাইরের লোক ঘরের মধ্যে দৃষ্টিপাত করে যাচ্ছে। পদাটা ঠিক করে দেবার জন্য প্রতাপ উঠলেন, চেয়ার ছেড়ে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন। জানলার কাছে।

সকালে তিনি কালীঘাট বাজারে গিয়েছিলেন, কয়েকজন চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হলো, কই কেউ তো একবারও বললো না ঝড়ের কথা? সব কাগজেই আজ এটাই প্রধান খবর। সবাই ভুলে যাচ্ছে? পনেরো-ষোলো বছর আগে হলে কলকতায় একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যেত, অনেকেই শিয়ালদায় ছুটতো দেশের বাড়ি ঘর ও আত্মীয় স্বজনের খোঁজ নেবার জন্য। একটা রাজনৈতিক সীমারেখা টানায় এতখানি মানবিক তফাৎ হয়ে গেল? বাংলার ওপাশে হাজার হাজার মানুষ মরলেও এপাশে আমরা নির্বিকার থাকবো, প্রতিদিনের জীবনযাত্রার একটুও পরিবর্তন হবে না? ওদিকের ওরাও কি এ পাশের বাঙালীদের জন্য মাথা ঘামায় না?

গেরুয়া আলখাল্লা পরা একটি সাধু প্রতাপকে দেখে থমকে দাঁড়ালো, শিরা ওঠা হাত তুলে বললে, জয় হোক বাবা!

লোকটির মাথায় একটি বেশ দর্শনীয় জট। তৈরি হতে অনেকদিন সময় লেগেছে। প্রতাপ বললেন, নমস্কার!

সাধু গম্ভীর ভাবে বললো, তুমি যা নিয়ে চিন্তা করছে, তার সমাধান হয়ে যাবে। একটু সময় লাগবে, এক মাস কি দেড়মাস। শুধু শুধু চিন্তা করে শরীর খারাপ করো না। দ্যাখো, কালস্রোত কারুর জন্য থেমে থাকে না।

প্রতাপ হাসলেন। লোকটি বয়েসে হয়তো তার চেয়ে ছোটই হবে, বড় জোর সমবয়েসী, গায়ে একটা আলখাল্লা চাপিয়েই সে প্রতাপকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করার অধিকার পেয়ে গেছে?

প্রতাপ মোটামুটি ভদ্রভাবেই বললেন, আপনি অযাচিত ভাবে আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন। আমি আপনাকে কোনো পয়সা দেবো না।

সাধুটি বললো, আমি তো বাবা পয়সার জন্য তোমাকে দেখে থামিনি। তোমার কপালে একটা অমঙ্গল চিহ্ন দেখলাম…

–সে জন্য শান্তি-স্বঘন করা দরকার? কিংবা আপনি তাবিজ বা মাদুলি বেচবেন?

–না, না, সেসব কিছু না। আমি মানুষের মঙ্গলের জন্য একটা মহাযজ্ঞ করবো, তুমি যদি খানিকটা ঘি দাও, তোমার পুণ্য হবে। কুগ্রহ কেটে যাবে।

প্রতাপ হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার করে বললেন, তুমি দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। যত সব আপদ! সমাজের পরগাছা! সরে যাও এখান থেকে! নইলে

সেই চিৎকার শুনে মমতা ছুটে এলেন পাশের ঘর থেকে।

ধমক খেয়ে সাধুটি দমবার পাত্র নয়। সে ঠায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কী সব বলে যাচ্ছে। মমতাকে দেখে বলে উঠলো, মা আমি মানুষের ভালো ছাড়া মন্দ করি না। দেখলাম কপালে অমঙ্গল চিহ্ন।

প্রতাপ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, মমতা জোর করে টেনে আনলেন তাঁকে। তারপর জানলা বন্ধ করে দিলেন।

রাগের চোটে প্রতাপ হাঁপাচ্ছেন। তখনও বলে চলেছেন, এত সাহস, আমাকে ভয় দেখিয়ে ঘি আদায় করতে চায়? লোকে খাবার পাতে ঘি পায় না, আর ওর যজ্ঞের জন্য

মমতা বললেন, তা বলে এ রকম মাথা গরম করতে হবে। তোমার নিশ্চয়ই প্রেসার আবার বেড়েছে।

–না, আমার প্রেসার ঠিক আছে। এ রকম অন্যায় কথা শুনলে কার না রক্ত গরম হয়ে যায়?

–মাপ করুন, আমরা কিছু দেবো না, বলে জানলা বন্ধ করে দিলেই হতো!

–কেন এই গরমের মধ্যে জানলা বন্ধ করবো। তুমি জানলা খুলে দাও!

করপোরেশনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে উনিও যা খুশী বলতে পারেন, তা তুমি আটকাতে পারো না।

–না, লোকের বাড়ির জানলার দিকে তাকিয়ে যা খুশী বলার অধিকার কারুর নেই। এ জন্য প্রসিকিউট করা যায়।

–একটা কথা সত্যি করে বললো তো! আসলে কার ওপরে তোমার রাগ হয়েছে? বরাবর দেখেছি, একজনের ওপরে রাগ হলে তুমি অন্য কারুর ওপরে চোটপাট করো।

–ওর কথা শুনেই আমার মাথা গরম হয়ে গেল!

মমতা নরম করে হাসলেন। তারপর প্রতাপের চোখে চোখ রেখে মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, উহুঃ! আজকাল তুমি সব সময়ই রেগে থাকো। আজ কার ওপর রাগ হয়েছে, আমার ওপর!

প্রতাপ সংযত হয়ে বললেন, না, তোমার ওপর রাগ করবো কেন?

পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ভরে তিনি সিগারেটের প্যাকেট-দেশলাই বার করলেন। দেশলাই-এর কাঠি রয়েছে মাত্র একটি, সেটাও জ্বালতে গিয়ে ভেঙে গেল। মুখ তুলে তিনি বললেন, মমো, একটা দেশলাই এনে দেবে?

মমতা বললেন, তুমি ওঘরে চলো না। তুমি কি বাইরের ঘরেই বসে থাকবে নাকি সারা দুপুর?

এই ঘরখানায় পিকলুর থাকার কথা ছিল। কালীঘাটে বাড়ি দেখার সময় পিকলু নিজে পছন্দ করে এই ঘরখানা চেয়েছিল। সে অবশ্য এখানে এক রাত্রিও বাস করে যেতে পারেনি। এখন এটাকে বাইরের ঘর বা বৈঠকখানা করা হয়েছে। কিছুদিন এঘরের দেয়ালে পিকলুর একটা ছবি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, প্রতাপ নিজেই একদিন ছবিটা খুলে নিয়েছেন।

তুতুল আর মুন্নি একঘরে থাকে, ওদের ঘরে রেডিওতে কী যেন একটা নাটক হচ্ছে। বাবলু বাড়ি নেই, পরীক্ষা হয়ে গেছে এখন খাওয়া আর ঘুমোবার সময় ছাড়া তাকে এক মিনিটও বাড়িতে দেখা যায় না। অবশ্য দু’বেলা সে দুটি টিউশানিও করে।

শোওয়ার ঘরে এসে একটা সিগারেট টানতে টানতে প্রতাপের মনটা আবার উধাও হয়ে গেল।… চোখের পাতায় এলো তন্দ্রা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া…পটুয়াখালি…দায়ুদকান্দি…এইসব জায়গাগুলি যেন ধু ধু জলময়, একটাও মানুষ নেই, ফিনফিনে বাতাস বইছে জলের ওপর দিয়ে…সব বাড়ি-ঘরই কি তুফানে উড়ে গেছে। ঢাকা জেলার কিছু হয়েছে কি না কাগজে লেখেনি… মালখানগরে প্রতাপদের বাড়িটা ছিল বেশ উঁচুতে, কোনোদিন উঠোন পর্যন্ত জল আসতো না…পটুয়াখালিতে ছিল প্রতাপের মামাবাড়ি…বাবা মায়ের সঙ্গে সেখানে যাওয়ার স্মৃতি…বরিশাল শহরে একটা হোটেলে ভাত খাওয়া, তারপর নৌকোয় পটুয়াখালির দিকে.কী সুন্দর জায়গা পটুয়াখালি–মানুষজনের ব্যবহার কত আন্তরিক…আবু তালেব নামে একজন ইস্কুল মাস্টার বাবাকে কত খাতির করলেন…সেই পটুয়াখালি কি ঝড়বৃষ্টিতে নিশ্চিহু হয়ে গেছে? প্রতাপের ইচ্ছে হলো এক্ষুনি একবার ছুটে গিয়ে দেখে আসতে…

–কী ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? আঙুল পুড়ে যাবে যে!

মমতার হাতে একটা লম্বা কাঁচের গ্লাস ভর্তি ঘোলাটে পানীয়। প্রতাপ সিগরেটের শেষ অংশটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললেন, ওটা কী?

মমতা বললেন, মিছরি দিয়ে আম পোড়ার সরবৎ, দ্যাখো তো কেমন হয়েছে?

প্রতাপ গেলাসটি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, আজ এত খাতির যে?

–এমনি আজ বানাতে ইচ্ছে হলো। যা গরম পড়েছে ক’দিন!

প্রতাপ এক চুমুক দিয়ে বললেন, মিষ্টির বদলে নোনতা হলে বেশি ভালো লাগতো। কাঁচা আমের সঙ্গে মিষ্টিটা ঠিক যায় না।

–মিছরি দিয়ে খেলে শরীর ঠাণ্ডা হয়। এক চুমুকে খেয়ে নাও!

–এই গরমে আমরা কাঁচা আম মাখা খেতাম। আমপোড়া সরবতের চল ছিল না আমাদের ওদিকে। কাঁচা আম মাখা হতো কী করে জানো? আমের খোসা ছোলা হতো ঝিনুক দিয়ে। ঐ ঝিনুক পাওয়া যেত আমাদের পুকুরেই। ঝিনুকের খোলার মাঝখানটা ঘষে নিলে যে ফুটো হতো, সেটা দারুণ ধার। সেই ঝিনুক দিয়ে আমের চোকলা ছাড়িয়ে সরু সরু করে কেটে নুন মেখে রাখা হতো খানিকক্ষণ। তারপর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মেখে…এই দ্যাখো, দ্যাখো, বলতে বলতে এখনো আমার জিভে জল এসে যাচ্ছে!

–আচ্ছা, ঐ রকম আম মাখা করে দেবো একদিন। ঝিনুক দিয়ে হবে না, বঁটি দিয়ে…

–সে আম মাখা তো আমরা বাড়িতে বসে খেতাম না। বাগানে, গাছের ছায়ায় বসে।

–এখন ঐ রকম আম মাখা খেতে গেলে তোমার দাঁত টকে যাবে!

–কী জানি! আমাদের ছেলে মেয়েরা কেউ ঐ সব স্বাদই পেল না। ওরা কেউ কাঁচা আম খায় না, না?

–গ্রামের খাবার আর শহরের খাবার কি এক হয়? ওরা তো ঝড়ের সময় গাছ থেকে টপ টপ করে আম খসে পড়তে দেখেনি!

–তুমিও তো দ্যাখোনি, মমো? তুমি আর কতদিনই বা ওদিকে ছিলে! আজ কাগজে দেখেছো, ঝড় বৃষ্টিতে কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হয়েছে। ওদিকে?

–দেখলাম তো! কাল রেডিওতেও বলেছে। আহারে, কত মানুষের সংসার তছনছ হয়ে গেল। আচ্ছা, এখান থেকে যদি কেউ সাহায্য করার জন্য জিনিসপত্তর নিয়ে ওদিকে যেতে চায় এখন, ওরা কি যেতে দেবে?

–থাক, ওসব কথা!

–শোনো, একটা কথা বলবো? তুমি কিছুদিনের জন্য বাইরে কোনো জায়গা থেকে ঘুরে এসো। চার পাঁচ বছর কোথাও যাওয়া হয়নি। তুমি সব সময় গম্ভীর গম্ভীর হয়ে থাকো, যখন তখন রেগে ওঠো, আমার এটা ভালো লাগে না। তোমার একটু চেইঞ্জ দরকার।

–আগে প্রত্যেক বছর সবাইকে নিয়ে বাইরে যেতাম একবার করে।

–সবাইকে নিয়ে যেতে অনেক খরচ। তুমি একা ঘুরে এসো। দেওঘরে মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসবে? অবশ্য ওখানে যা গরম এখন!

–কাল ওস্তাদজীর চিঠি এসেছে, তুমি পড়েছো?

–হ্যাঁ পড়লুম তো। লিখেছেন তো সবাই খুব ভালো আছেন। মা রোজ মোহনানন্দ মহারাজের আশ্রমে ভজন গান শুনতে যাচ্ছেন। রোজ বাড়ি থেকে বেরোন যখন, তার মানে শরীর ভালো আছে। ওস্তাদজীও নাকি এই শীতে বাড়ির বাগানে পেঁয়াজকলির চাষ করেছিলেন, অনেক লাভ হয়েছে, এবারে কাঁচা লঙ্কার চাষ করবেন। ঐ শরীর নিয়ে এসব করা কী ভালো? তবে আমার মনে হয়, ওনার টি বি হয়নি। তুমি কী বলো।

–কী জানি!

–ব্রঙ্কাইটিস হলেও কশির সঙ্গে রক্ত পড়তে পারে। টি বি-তে কি এতদিন…তবে ঐ শরীর নিয়ে বাগানের কাজ টাজ করা কি ঠিক হচ্ছে?

–নিজের ভালো উনি কি নিজে বুঝবেন না? ঐ নিয়েই আনন্দে আছেন যখন।

–মাকে কিছুদিন কলকতায় নিয়ে এসে রাখবে।

–লিখেছিলাম তো, মা আসতে চাননি।

–তুমি বরং একটু পুরীতে ঘুরে এসো। কিংবা, দীঘায় নাকি আজকাল থাকার জায়গা হয়েছে। অনেকেই যাচ্ছে।

–হঠাৎ ওসব জায়গায় যেতে যাবো কেন একলা একলা? তোমার বুঝি যেতে ইচ্ছে হয়েছে?

–না! আমি গেলে বাড়িসুষ্ঠু সবাইকেই নিয়ে যেতে হয়!

মমতা কাছে এসে প্রতাপের চুলের মধ্যে হাত রেখে বললেন, তুমি এবারে একটু ঘুমিয়ে নাও। ছুটির দিনে একটু বিশ্রাম নিলে…।

দরজাটা ভেজানো। এখন হঠাৎ কেউ এঘরে ঢুকবে না। মুন্নি বড় হয়ে গেছে, সেও এখন দরজা ভোজানো দেখলে বাইরে থেকে মা বলে ডাকে।

প্রতাপ মমতার কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে গাঢ় স্বরে বললেন, মমো!

মমতা অমনি কান্নায় ভেঙে পড়ে লুটিয়ে পড়লেন প্রতাপের বুকে।

পিকলুর মৃত্যুর পর মমতাই সব চেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছিলেন। হয়তো কার্যকারণের কোনো সম্পর্ক নেই, সেই সময়েই মমতা সাঙ্ঘাতিক বিকোলাই রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে ছিলেন প্রায় এক বছর। তাঁর চিকিৎসার জন্য জলের মতন টাকা খরচ হয়েছে, ভাঙতে হয়েছে মমতার অনেকগুলি গয়না।

পিকলু প্রতাপের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান, কিন্তু প্রতাপ তেমন ভাবে ভাঙেননি। একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা,তবে এ জন্য তো কারুকে দায়ী করা যায় না! সে যদি রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়তো, তা হলেও গাড়ির চালককে দোষ দেওয়া যেতে পারতো, কিন্তু গঙ্গানদীর নামে তো অভিযোগ আনা যায় না।

মমতা অবশ্য শোকের তীব্রতার প্রথম দিকে বাবলুর নামে দোষারোপ করেছিলেন। এমনকি একদিন মমতা বাবলুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মাথা দেয়ালে ঠুকে দিতে দিতে পাগলাটে গলায় বলেছিলেন, শয়তান, এই ছেলেটা শয়তন, এর জন্যেই আমার পিকলু চলে গেল! মা গঙ্গা তোকে নিল না কেন, তোকে নিলে আমি বাঁচতাম!

মায়েরাই ঝোঁকের মাথায় এ রকম কথা বলতে পারে। মায়ের অভিশাপ সন্তানের গায়ে লাগে না। ঐ রকম বলার কিছু পরেই মমতা আবার বাবলুকে এত আদর করেছিলেন, এত আদিখ্যেতা করেছিলেন তাকে নিয়ে যে বাবলু অস্বস্তিতে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই রাত্রেই প্রতাপ দেখেছিলেন, বাবলু তার মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বলছে!

প্রতাপ অবশ্য কোনোদিন বাবলুর ওপর দোষারোপ করেননি। দুরন্ত ছেলে বাবলু, সে সাঁতার জানে না, তবু জলে নেমেছিল। পিকলু মোটামুটি সাঁতার জানতো, সে ভাইকে উদ্ধার করতে গিয়েছিল, কিন্তু একটা বয়ায় মাথায় ধাক্কা লেগে তার প্রাণটা চলে যায়। কী বলা যাবে একে। নিয়তি ছাড়া? যা ব্যাখ্যা করা যায় না, তাই-ই নিয়তি বলে চালানো যায়।

সেই শোক প্রতাপ আর মমতাকে অনেক কাছাকাছি এনে দিয়েছিল। পিকলুকে অনেকেই ভালোবাসতো, অনেকেই খুব আঘাত পেয়েছে, কিন্তু এই শোক যেন প্রতাপ আর মমতার মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতু নির্মাণ করে দিয়েছে। তা এতই ব্যক্তিগত যে অন্য কেউ বুঝবে না। মুখে কিছু বলার দরকার নেই, অনেক লোকের মাঝখানে হয়তো অন্য কথাবার্তা চলছে, শুধু প্রতাপ বা মমতা পরস্পরের দিকে একবার তাকালেই শুধু ঐ দু’জনই জানবেন যে তাঁদের বুকের মধ্যে হু-হুঁ কান্না, এবং দু’জনেই দু’জনকে নিঃশব্দে বলছেন, শান্ত হও, শান্ত হও!

প্রতাপের জীবন ধারা বদলে গেছে অনেকটা। আগে তিনি আদালত থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সুলেখা-ত্রিদিবদের সঙ্গে ঠাট্টা মস্করা করতেন। এখন প্রতিদিন সোজা বাড়ি ফিরে আসেন। বুলার কথা আগে যখন তখন মনে পড়তো, বুলার জন্য এমন এক গোপন জ্বালা অনুভব করতেন যা মমতাকে বলা যায় না। এখনো বুলার কথা চকিতে দু’একবার মনে পড়ে বটে, কিন্তু বুলার মুখটা তিনি আর মনে করতে পারেন না। বহুকাল আগে দেখা বুলার। জ্যাঠামশাই-জ্যাঠাইমার মুখ মনে আছে, এমনকি বুলার দেওর ঐ দুশ্চরিত্র সত্যেনটার মুখও তিনি স্পষ্ট দেখতে পান, অথচ বুলার মুখ ঝাঁপসা হয়ে গেছে। পিকলুর মৃত্যুর সঙ্গে বুলার মুখ। অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার যে কী সম্পর্ক কে জানে!

অনেকদিন বাদে প্রতাপ মমতার কান্না ভেজা মুখোনি তুলে তাঁর ওষ্ঠে চুম্বন করলেন।

শরীরের গুপ্ত আগুন যে কখন দপ করে জ্বলে ওঠে তার ঠিক নেই। মমতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে গিয়ে দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিয়ে এলেন। মধ্যবয়স্ক গৃহস্থের মতন দুপুরবেলার শয্যায় নিয়ম মাফিক আধো-উত্তাপময় মিলনের বদলে প্রতাপ উঠে দাঁড়িয়ে মমতাকে পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিলেন। তিনি দীর্ঘকায় শক্তিশালী পুরুষ, সেই তুলনায় মমতা কোমল, হালকা। মমতাকে নিয়ে দোলাতে দোলাতে প্রতাপ বললেন, মমো, তোমার মনে আছে, সেই যুদ্ধের সময়, কলকতায় যখন বোমা পড়ে?

মমতা কৃত্রিম ত্রাসে বললেন, আরে আরে, ছাড়ো, ছাড়ো।

–আগে বলো, তোমার মনে আছে কি না?

–না, মনে নেই। কী হয়েছিল সে সময়ে!

–সত্যি, তোমার মনে নেই?

–তুমি বলো!

–আমরা সেই সময় উত্তর কলকতায় নয়নচাঁদ দত্ত স্ট্রিটে থাকতুম। সাইরেন বাজলো, এরকম তো প্রায়ই বাজতো, কিন্তু জাপানীরা সত্যিই কলকাতায় বোমা ফেলবে কেউ তো ভাবেনি। সেদিন কিন্তু সত্যিই বোমা পড়লো। খিদিরপুরে, হাতিবাগানে…আমাদের বাড়ির অন্য ভাড়াটেরা দুম দুম করে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলো, আমাদের একতলায় থাকার জন্য বলতে এসেছিল, কিন্তু আমরা দরজা খুলতে পারিনি…তখন আমরা কী করছিলুম?

–জানি না যাও!

–উই ওয়্যার মেকিং লাভ! যুদ্ধ-টুদ্ধ, বোমা- টোমা কিছু আসে যায় না, আমরা তখন…

–এই ছাড়ো, ছাড়ো, প্লীজ।

–তারপর আর একবার, সেটা ফর্টি সিক্স না ফটি সেভেন আমরা স্টিমারে যাচ্ছিলাম ঢাকা–তখনও তো আমি অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে, আমরা ক্যাবিন প্যাসেঞ্জার ছিলাম, কিন্তু আরও একটা লোক ছিল সেই ক্যাবিনে, সে ব্যাটা কিছুতেই বাইরে যায় না, কত রকম ইঙ্গিত করি, সে আবার তোমার দিকে হ্যাংলার মতন তাকাচ্ছিল, তারপর মাদারিপুরে সে ইলিশমাছের নৌকো দেখতে যেই একবার বাইরে গেল অমনি আমরা দরজার ছিটকিনি তুলে দিলাম।

–তুমি লোকটার সঙ্গে বড্ড খারাপ ব্যবহার করেছিলে।

–মনে আছে, মনে আছে!

মমতার শরীরের চামড়া ফেটে ফেটে বেরিয়ে আসছে আগুন। প্রতাপ তাঁকে এবার খাটে শুইয়ে দিয়ে বললেন, কতদিন হয়ে গেল। মমো, আমি তোমাকে এখনো ঠিক সেই রকম ভালোবাসি। আমি তোমাকে এখনো সেইভাবে চাই!

তফাত শুধু এই যে প্রতাপ যে সময়ের কথা বলছেন, তখন প্রতাপ নিজে খুলে দিতেন মমতার শাড়ি। অতিরিক্ত ব্রীড়ায় মমতা নিজের ব্লাউজও খুলতে চাইতেন না। এখন বহু ব্যবহারে ওসব রোমাঞ্চ চলে গেছে। মমতা নিজেই পটপট করে ব্লাউজের ক্লিপ খুললেন। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন নিজের বুকের দিকে। তাঁর স্তন দুটি এখনও পীনোন্নত বলা যায়। চোখ তুলে দেখলেন। প্রতাপও চেয়ে আছেন তাঁর চোখে চোখ মিলিয়ে। শাড়িটি ভাঁজ করে রাখলেন খাটের মাথায়। তারপর প্রতাপের দিকে তাকিয়ে বললেন, পাখাটা একটু জোর করে দাও না!

পাখার রেগুলেটার খুঁজতে গিয়ে প্রতাপ অন্ধ হয়ে গেলেন। দিনের বেলা, দরজা-জানলা বন্ধ করা সত্ত্বেও ঘরের মধ্যে যথেষ্ট আলো আছে, তবু প্রতাপ কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। যেন একটা অন্ধকার অরণ্যে তিনি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন।

এ অনুভূতি কয়েক মুহূর্তের মাত্র। তারপরেই তিনি তাঁর পাঞ্জাবি ও পাজামা খুলে ফেলে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। প্রায় দৌড়ে গিয়ে বসে পড়লেন ঘরের এক কোণে।

মমতা জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো তোমার? প্রতাপ অদ্ভুত পাগলটে গলায় বললেন, মমো, এদিকে এসো, শিগগির এদিকে এসো—

মমতা খাট থেকে নেমে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী?

প্রতাপ বললেন, আজ খাটে শুয়ে নয়। মেঝেতে, মনে করো, এটা ঘর নয়, এটা একটা নদীর ধার, আমরা শুয়ে আছি কাদামাটির মধ্যে, মাথার ওপরে খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে, আমরা কিছুই গ্রাহ্য করছি না।

নারীর শরীর একবার জ্বলে উঠলে আর দেরি সয় না। মমতা শুয়ে পড়লেন প্রতাপের পাশে। তারপর হাত বাড়িয়ে দিলেন।

ব্যাপারটা চুকে যাবার পর দু’জনে কয়েক মিনিট নীরবে শুয়ে রইলেন পাশাপাশি। তারপর মমতা উঠে সায়া, শাড়ী, ব্লাউজ পরে নিয়ে দরজা খুলে চলে গেলেন বাথরুমে। প্রতাপের এখন আর একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু উঠে গিয়ে আনতে ইচ্ছে করছে না। তিনি ঘরের দেয়াল দেখতে লাগলেন। এই বাড়িটা ভালো নয়, সব ঘরে ড্যাম্প, দেয়ালে প্লাস্টার ফুলে গেছে কোথাও কোথাও। বাড়ি পাল্টালে ভালো হয়, কিন্তু প্রতাপের আর উদ্যম নেই। যা চলছে চলুক। কে আর বাড়ি খোঁজাখুঁজি করে।

মমতা জল-মাখা মুখে ফিরে এসে বললেন, এই, তুমি উঠবে না?

প্রতাপ হাতছানি দিয়ে ডেকে বললেন, মমো, এসো আজ দুপুরটা আমরা মেঝেতেই শুয়ে থাকি!

মমতা ভুভঙ্গি করে বললেন, বয়েস হচ্ছে, খেয়াল থাকে না বুঝি?

প্রতাপ হেসে বললেন, সত্যিই খেয়াল থাকে না। বয়েস হচ্ছে, তাই না? এখন এসব মানায়। না! মমো, আমি কিন্তু তোমাকে ঠিক আগের মতন ভালোবাসি।

–হঠাৎ আজ তোমার কী হয়েছে বলো তো? ভালোবাসার কথা তো আগে কখনো মুখে বলতে না?

–আমি মুখে বললে তোমার খারাপ লাগে?

–মুখে ওসব কথা বলার দরকার নেই। আমি সব বুঝি। যাদের মনে মনে ভয় আছে, তারাই ঐ সব কথা মুখে শুনতে চায় বারবার।

–আমিই ভুল করি, মমো। তুমি আমার থেকে অনেক সলিড!

–এবারে ওঠো, ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

–তুমি আগে আমাকে একটা ভিজে তোয়ালে এনে দাও। আর সিগারেট দেশলাইটা এগিয়ে দাও। আর একটুক্ষণ থাকি। এখান থেকে উঠলেই ভালো লাগাটুকু শেষ হয়ে যাবে।

–পাখাটা কী রকম শব্দ করছে দেখেছো? স্পীড বাড়ালেই এরকম হয়। এবার অয়েলিং করাতে হবে। এই, তুমি দেওঘরে তোমার মায়ের জন্য একটা পাখা কিনে দেবে বলেছিলে না?

-কেন, ওস্তাদজী মাকে একটা পাখা কিনে দিতে পারে না? পুরো বাড়িটা ভোগ করছে। একতলায় ভাড়া পাচ্ছে।

–ওরকম ভাবে বলো না। কতইবা বাড়ি ভাড়া পান? তাছাড়া একজন ভাড়াটে নাকি ছ’মাস ধরে কিছু দেয় না। শান্তি ঠাকুরঝি একবার লিখেছিল মনে নেই?

–তা আমি কী করবো, আমার হাতে এখন আর টাকা নেই। বিমানবিহারীর কাছে অনেক ধার রয়ে গেছে!

–তা বললে তো চলবে না। আমাদের এই পাখাটাও বোধ হয় বদলানো দরকার, এই গরমে…আমার একটা বালা ভেঙে গেছে, ওটা আমি কোনোদিন পরবো না। ওটা বিক্রি করে দাও। তোমার দিদির গয়না তুমি না ভাঙতে পারো। আমার গয়না বিক্রি করতে তো দোষ নেই!

প্রতাপ সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলেন। এখন আর নদীর ধার নয়, এটা ঘোর সংসার। একটু আগেকার চরম ভালো লাগার পরেই এই ধরনের কথাবাতা তাঁর সহ্য হলো না। এখন বিছানায় উঠে ঘুমিয়ে পড়াই ভালো।

দু’জনের মনেই হঠাৎ পিকলুর স্মৃতি দপ করে জ্বলে উঠেছিল। সেই জ্বালা, সেই শোক ভোলবার জন্যই এত সব। অন্য কিছু, অন্য কথা।

কিন্তু বিছানায় শুয়ে পাশ ফিরতেই আবার পিকলুর মুখখানা ফিরে এলো। বয়ায় যখন মাথাটা ধাক্কা লাগে, তখন কত কষ্ট পেয়েছিল ছেলেটা, তবু সে নিজের ছোট ভাইকে ধরে ছিল উঁচু করে, তাকে ডুবতে দেয়নি…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *