বাড়ির সামনে যে গেট ছিল সেটি আর নেই। কবে ভেঙে গেছে, তারপর আর মেরামতের প্রশ্ন ওঠেনি। ভজন সিংকেও ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, দুটি বউ ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে সে ফিরে গেছে গাঁয়ের বাড়িতে। এখনো মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে। সুহাসিনীর জন্য খানিকটা ঘি কিংবা কিছু আতা-পেয়ারা উপহার আনে।
একতলাটা এখন পুরোপুরিই ভাড়া, দুটি রেল-পরিবার থাকে সেখানে। তাদের মধ্যে সর্বক্ষণ জল নিয়ে, ময়লা ফেলা নিয়ে, ছেলেমেয়েদের অবাধ্যতা নিয়ে ঝগড়া চলে। ওপর তলায় পাঁচ ইঞ্চি দেয়াল গেঁথে দুটি ঘর বানানো হয়েছে কোনোক্রমে, সেই দুটি ঘরে বিশ্বনাথ গুহ তাঁর স্ত্রী-কন্যা-শাশুড়িকে নিয়ে থাকেন।
বিশ্বনাথ এত রোগা হয়ে গেছেন যে তাঁকে হঠাৎ দেখে চেনাই শক্ত। ক্ষয় রোগ তাঁকে ছাড়েনি। তবু তিনি বেঁচে আছেন, বলতে গেলে, সম্পূর্ণ মনের জোরে। মাঝে মাঝে জোড়াতালি দিয়ে চিকিৎসা হয়েছে, কিন্তু এই রোগে ওষুধ পত্রের চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয় হলো পরিপূর্ণ বিশ্রাম এবং নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য। কিন্তু বিশ্বনাথ গুহ সেসব কিছু মানেননি, খাদ্যাখাদ্য সম্পর্কে তাঁর বাছ-বিচার নেই, আর বিছানায় শুয়ে থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। সর্বক্ষণ টো টো করে ঘুরে বেড়ান। শুধু বাড়ি ভাড়ার টাকায় সংসার খরচ কুলোয় না, তাঁকে অন্য রোজগারের ধান্দায় থাকতে হয়।
তবে, গায়ক বিশ্বনাথ গুহর কণ্ঠ থেকে গান চির বিদায় নিয়েছে। গানের ইস্কুলটি তিনি তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ তাঁর গলায় এখন সুর তো দূরের কথা, তাঁর কথাই এখন ভালো করে বোঝা যায় না। কাশির প্রকোপে তাঁর কণ্ঠস্বর ফ্যাসফেসে হয়ে গেছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তাঁর তেজ নষ্ট হয়নি, রসিকতা-জ্ঞানটি অক্ষুণ্ণ আছে। হেসে ওঠেন যখন-তখন।
ট্রেনের সময় অনুযায়ী স্টেশানে বসে থাকাই এখন বিশ্বনাথের প্রধান কাজ। মুখের দাড়ি অধিকাংশই পেকে গেছে, মাথার চুলও প্রায় সাদা, গায়ের মোটা পাঞ্জাবিটা বিশেষ সাবানের ছোঁয়া পায় না। ইদানীং টায়ার কাটা অতি শস্তায় চটি বেরিয়েছে, সেই চটিই পায় দেন। স্টেশানের অনেকেই তাঁকে চেনে, তবে আগের মতন আর কেউ খাতির করে না। খাতির করার মতন চেহারা বা পোশাকও তাঁর নেই, শুধু একজন বুড়ো চাওয়ালা তাঁকে অর্ধেক দামে চা দেয়।
সত্যিই বিশ্বনাথকে দেখে আর বোঝবার উপায় নেই যে এককালে এই মানুষটিই কলেজের পড়াশুনো ছেড়ে গান বাজনা শেখার ঝোঁকে লক্ষৌ-আগ্রা ঘুরে বেড়িয়েছেন। টানা সাত-আট বছর তালিম নিয়েছেন সঙ্গীত-সম্রাট স্বয়ং ফৈয়াজ খানের কাছ থেকে। মোটামুটি বেশ সমৃদ্ধ পরিবারের সন্তান ছিলেন বিশ্বনাথ, জীবনের অনেকগুলি বছর অর্থচিন্তা করতে হয়নি। এক ধরনের মানুষ থাকে, যারা নিজের জন্য কক্ষনো কিছু চায় না, অন্যদের সবসময় কিছু দিতে চায়, অনেক সময় সাধ্যের অতিরিক্তও, বিশ্বনাথ ছিলেন সেই দলের। এখন অবস্থাটা উল্টে গেছে।
আমাদের দেশের সব মানুষ এখনো আপনি, তুমি, তুই-তে ভাগ করা। অচেনা মানুষকেও অনায়াসে তুমি বা তুই বলা চলে তার পোশাকের দৈন্য কিংবা খালি পা দেখে। বিশ্বনাথকে অনেকেই আজকাল তুমি শ্রেণীর মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। ট্রেনের যাত্রীরা তাঁকে দীন উমেদার বলে গণ্য করলে তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। বিশ্বনাথ এই জন্য মাঝে মাঝেই কথার মধ্যে ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করেন। এই একটা ভালো ওষুধ আছে। ইংরিজি শুনলেই সবাই আবার আপনি বলতে শুরু করে।
ইদানীং দেওঘরে যাত্রীর সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দাও বেড়েছে। ভ্রমণবিলাসী বা স্বাস্থ্য-উদ্ধারকারীরা আগে শুধু দুগা পুজোর মরশুমে এবং শীতকালেই আসতো। এখন গ্রীষ্ম বর্ষাতেও যাত্রীর বিরাম নেই। সেই তুলনায় খালি বাড়ির সংখ্যা কমেছে, ধর্মশালাগুলিতে জায়গা হয় না।
আগে শুধু বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেবার জন্য তীর্থযাত্রীরা আসতো, এখন সৎসঙ্গের অশ্রমের শিষ্যরাও আসে। আসে মোহনানন্দ মহারাজের শিষ্যরা। একসময় শুধু বৈদ্যনাথ মন্দিরের পাণ্ডাদের একাধিপত্য ছিল এই শহরে, এখন তাদের গুরুত্ব অনেক কমে গেছে, সেই জন্য পাণ্ডা সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ। তাদের সঙ্গে সৎসঙ্গীদের সংঘর্ষও হয়ে গেছে কয়েকবার।
বিশ্বনাথ খুব সতর্কভাবে পাণ্ডা সম্প্রদায় ও সৎসঙ্গীদের থেকে সমান দূরত্ব বজায় রাখেন। ঐ দুই দলেরই কেউ কখনো তাঁকে ধমক টমক দিতে এলে তিনি একেবারে বিনয়ের অবতার হয়ে যান, প্রয়োজনে তাদের পা ধরতেও দ্বিধা করেন না। আত্মরক্ষার তাগিদেই তিনি এদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যান না, তিনি জানেন, এদের মার তিনি সহ্য করতে পারবেন না।
কয়েকটি বড় বড় বাড়ির দারোয়ান ও মালিকের সঙ্গে বিশ্বনাথের গোপন চুক্তি আছে। বাড়ির মালিকরা বছরে একবার দুবার আসে, অন্য সময়ে বাড়ি খালি পড়ে থাকে। অনেক মালিক ভাড়া দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। টি বি রুগীরা এসে বাড়ি বিষাক্ত করে দিয়ে যাবে, এইটাই প্রধান ভয়। কেয়ার টেকার বা দারোয়ানরা এই সব বাড়ি খুব গোপনে ভাড়া দেয়। সেই ব্যাপারে তারা বিশ্বনাথের ওপরে নির্ভর করে। বিশ্বনাথ এমন ভাড়াটে জোগাড় করে আনবেন যারা সাত দিন-দশ দিনের বেশি থাকবে না। তাছাড়া বিশ্বনাথ এই সব কটি বাড়ির মালিকদের ও পরিবারের প্রধান লোকজনের মুখ চেনেন। তারা হঠাৎ কেউ এসে পড়ল কি না তাও বিশ্বনাথ স্টেশানে বসে বুঝতে পারবেন। এই কাজের জন্য তাঁর আধা-আধি বখরা।
বিশ্বনাথ ট্রেন থেকে নামা যাত্রীদের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। যাদের দেখে মনে হয় তীর্থযাত্রী কিংবা সৎসঙ্গের শিষ্য, তাদের প্রতি তিনি লোভ করেন না। নব দম্পতি কিংবা কলেজের ছাত্রদের দলই তাঁর বেশি পছন্দ। আজকাল ছাত্ররা প্রায়ই দল বেঁধে আসে।
পছন্দসই পার্টি দেখলে বিশ্বনাথ পকেট থেকে একখানা ভাঁজ করা কাগজ বার করে মেলে ধরেন বুকের কাছে। তাতে মোটামোটা অক্ষরে লেখা থাকে, উত্তম বাড়ি ভাড়া, সব রকম আরামের ব্যবস্থা আছে, দৈনিক বা সাপ্তাহিক বন্দোবস্ত। কাগজের উল্টোপিঠে ঐ বক্তব্যই ইংরেজিতে লেখা। ঐ কাগজ দেখে কেউ কেউ এগিয়ে আসে, দরাদরি হয়, বিশ্বনাথ তাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, তারপরেও প্রতিদিন তাদের খোঁজ খবর করেন। মাসে এরকম দু’তিনবার খদ্দের জোটে, আয় নেহাত মন্দ হয় না।
চার পাঁচজন ছাত্রের একটি দল বিশ্বনাথের বুকের ঐ কাগজ দেখে থমকে দাঁড়ালো। একজন অন্যদের বললে, ধর্মশালায় যাবার আগে এটা ট্রাই করবি নাকি?
ওদের একজন বললো, না, না! বাইরে চল আগে! স্টেশানের টাউটের পাল্লায় পড়লে অনেক পয়সা খসাবে।
বিশ্বনাথ তাঁর কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে ঐ দলের একজনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তিনি বুঝে গেছেন যে জালে শিকার পড়েছে।
একজন যুবক বন্ধুদের বললো, কথা বলে দেখাই যাক না! ধর্মশালা পাওয়া যাবে কিনা ঠিক নেই তো কিছু!
সে এগিয়ে এসে ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে জিজ্ঞেস করলো, কোঠী-ভাড়া হ্যায়? কিত্সা ভাড়া?
প্রতিদিন ট্রেনের যাত্রীদের দেখে দেখে বিশ্বনাথ অভিজ্ঞ হয়ে গেছেন, দেখেই চিনতে পারেন, তারা কোথাকার লোক, কোন্ ভাষাভাষী। অবশ্য এই শহরে বাঙালী ভ্রমণকারীর সংখ্যাই বেশি।
তিনি বললেন, প্রাইভেট হাউস। ভেরি রিজনেবল রেন্ট, আপনাদের পছন্দ হবে।
বিশ্বনাথের মুখে ইংরিজি ও বাঙলা দু’রকম শব্দ শুনে যুবকটির মুখের চেহারা একটু বদলালো। বন্ধুদের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, কত দূরে বাড়ি?…
বিশ্বনাথ হেসে বললেন, বেশ দূর আছে। শহরের ঘিঞ্জি থেকে অনেকটা দূরে। নিরিবিলি জায়গায়, সঙ্গে বাগান আছে, চমৎকার ভিউ পাবেন…
–কত ভাড়া?
–আপনারা ক’দিন থাকবেন?
–এই তিন-চার দিন। আমাদের দু’টো ঘর চাই।
–তাহলে পার রুম তিরিশ টাকা করে পড়বে পার ডে! যুবকদের দলের অন্য একজন চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ওরে বাপরে, একেবারে গলাকাটা! চ, চ, ধর্মশালাতে ঠিক ব্যবস্থা করে নেবো!
আর একজন বললো, আমি শুনিছি, এখানে হোটেলের ঘর ভাড়াও দশ বারো টাকার বেশি না!
বিশ্বনাথ সঙ্গে সঙ্গে মাথা হেলিয়ে বললেন, তা ঠিকই শুনেছেন। দশ টাকা ভাড়ায় হোটেলের ঘর পেতে পারেন এখানে। যদি খালি থাকে। কোনো না কোনো ধর্মশালাতেও জায়গা পেয়ে যাবেন। খুব ভিড় নেই এখন।
এই পদ্ধতিটা খুব কার্যকর। খদ্দেরের কাছে কাকুতি-মিনতি না করে এমন ভাব বজায় রাখা যে তোমরা আমার খদ্দের হবার যোগ্য নও!
চলে যেতে উদ্যত হয়েও যুবক দলটি থমকে দাঁড়ালো। লালচে রঙের গেঞ্জি পরা তাদের মুখপাত্রটি রুক্ষ ভাবে জিজ্ঞেস করলো, হোটেলের ঘর ভাড়া যদি দশ টাকা হয়, তাহলে আপনার ঘরের রেট এত বেশি কেন?
–হোটেলের ঘর এই অ্যাতটুকু, পায়রার খোপের মতন। বাজারের পাশে, সব সময় হৈ হট্টগোল। আর ধর্মশালার বাথরুম অতি নোংরা, সেখানে মাছ-মাংস খেতে পারবেন না।
–তা বলে থার্টি রুপিজ পার ডে, এটা টু মাচ্!
–তাহলে হোটেলেই যান। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটু বাঁ দিকে গেলেই হোটেল দেখতে পাবেন। যদি ওপর তলার ঘর পান, খুব খারাপ হবে না। বেরুবার সময় দরজায় সব সময় তালা লাগাতে ভুলবেন না। নিজস্ব তালা থাকলে ভালো হয়।
বিশ্বনাথ এগিয়ে যান অন্যদিকে। যুবকের দল পরামর্শ করে নিজেদের মধ্যে। নতুন জায়গায় এসে একজন বাঙালীকে হাত ছাড়া করতে চায় না তারা।
মুখপাত্রটি চেঁচিয়ে ডাকলো। এই যে দাদা শুনুন।
বিশ্বনাথ উৎকর্ণ হয়ে ছিলেন, তিনি জানতেন যে ওরা ডাকবেই। মানব চরিত্র তাঁর চেনা হয়ে গেছে ভালো করে।
ফিরে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, কী!
–চলুন, আপনার বাড়িটা দেখে আসি আগে।
–বাড়ি দেখলে আপনাদের পছন্দ হবে ঠিকই, সে আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। তবে আপনাদের বাজেট যদি কম থাকে, তা হলে হোটেলেই থাকুন। সব কিছু কাছাকাছির মধ্যে পেয়ে যাবেন।
–আমরা দু’চারদিনের জন্য বেড়াতে এসেছি, ভালো জায়গাতেই থাকতে চাই। কিন্তু আপনি ভাড়াটা বেশি চাইছেন।
–সাতদিনের জন্য নিন, অনেক রেট কমে যাবে। এক সপ্তাহ দেড়শো টাকা।
–উইকলি দেড়শো আর ডেইলি তিরিশ টাকা? এটা কোন্ হিসেবে হলো?
–কম দিনের জন্য নিলে আমাদেরই ক্ষতি। মনে করুন, আপনি দু’তিন দিনের জন্য ভাড়া নিলেন। কালই একটা পার্টি এসে বললো, আমার সাত দিন, কি দশদিনের জন্য চাই। তখন তো তাকে দিতে পারবো না। ফিরিয়ে দিতে হবে!
–শুনুন দাদা, আমাদের দু’খানা ঘর চাই। মোট তিনদিন থাকবো। সব মিলিয়ে টোটাল একশো টাকা দেবো। রাজি থাকেন তো বলুন!
বিশ্বনাথ যুবকটির দিকে সোজা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চেহারার কিছুই অবশিষ্ট নেই, কণ্ঠস্বর ভাঙা, পোশাকে দৈন্য প্রকট, তবু শুধু চোখের দৃষ্টিতে যতটা ব্যক্তিত্ব আনা যায়, ততটা প্রয়োগ করে তিনি দু’দিকে মাথা নেড়ে বললেন, না। আমি দরাদরি করি না!
অন্য একজন বললো, আমরা গোটা বাড়িটা পাবো। অন্য কেউ ডিসটার্ব করবে না?
–ফাঁকা বাড়ি, মস্ত বড় বাগান, ডিসটার্ব করার কেউ নেই।
–তা হলে আমরা এক শো কুড়ি পর্যন্ত দিতে পারি।
বিশ্বনাথ ভেতরে ভেতরে কাঁপছিলেন। এক শো কুড়ি কেন। তিনি শুধু পঞ্চাশ টাকাতেই রাজি ছিলেন। দারোয়ানদের সঙ্গে সেইরকমই চুক্তি আছে, যেদিন যা পাওয়া যায়! তবু তিনি এই কায়দাটা সব সময় পরীক্ষা করে দেখতে চান। নিজে থেকে দাম কমান না, খদ্দেরকে দিয়েই বলাতে চান, তাতে তারা ছোট হয়ে যায়। দু’চার বার এই কায়দাটা ব্যর্থ হয়। যারা প্রকৃত কৃপণ কিংবা ভালো বাড়িতে থাকতে অভ্যস্ত নয়, তারা মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাটে।
উদারতার ভাব দেখিয়ে বিশ্বনাথ বললেন, ঠিক আছে, চলুন! বাঙালীর ছেলে, হঠাৎ এসে পড়েছেন… আপনাদের উচিত ছিল আগে থেকে জায়গা ঠিক করে আসা… অনেক সময় কোনো জায়গাই খালি পাওয়া যায় না।
আজকের দিনে ষাট টাকা রোজগার হলো এজন্য বিশ্বনাথ বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন : গত আট দশদিন একটাও পার্টি পাওয়া যায়নি। আজ ভালো টাকা পাওয়া গেছে। ষাট টাকা, কম নয়!
এককালের গায়ক বিশ্বনাথ গুহ। যিনি কোনোদিন গানের বিনিময়ে পয়সা নেবেন না ঠিক। করেছিলেন, তিনি আজ বাড়ি ভাড়ার দালালিতে এতটা দক্ষতা অর্জন করে পুলকিত।
স্টেশানের বাইরে এসে বিশ্বনাথ দু’খানা টাঙ্গা ভাড়া করলেন। সব টাঙ্গাওয়ালা তাঁর পরিচিত। এদের সঙ্গেও তাঁর কমিশনের ব্যবস্থা আছে। প্রত্যেকের কাছ থেকে তিনি আট আনা করে পাবেন।
লাল গেঞ্জি পরা দলপতিটির সঙ্গে এক টাঙ্গায় উঠলেন বিশ্বনাথ। কথায় কথায় বেরিয়ে পড়লো এরা ঠিক সাধারণ ছাত্র নয়, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ছে, আর্টিকেল ক্লার্ক হিসেবে একটি ফার্মের সঙ্গে যুক্ত আছে। সুতরাং অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল।
লাল গেঞ্জিপরা যুবকটির নাম অজয়। সে দেওঘরে জিনিস পত্রের দাম বিষয়ে কিছু জেনে নেবার পর জিজ্ঞেস করলো, আমরা ওখানে খাবো কোথায়? রান্না করে দেবার লোক পাওয়া যাবে?
–হ্যাঁ, মালি তার বৌ নিয়ে থাকে। তাকে জিনিসপত্র কিনে দিলে রান্না করে দেবে। ভালো রাঁধে।
–কী রকম চুরি করবে?
–আপনাদের ঘর খোলা রেখে যাবেন, রেডিও, ঘড়ি এসব থাকলেও কেউ ছোঁবে না। ওরা এসব চুরি করতে জানে না। তবে যদি মুর্গি রান্না করতে দ্যান, তার দু’এক টুকরো কি ছেলেমেয়েকে খাওয়াবে না?
–সে কথা বলছি না! বাজার করতে দিলে মারবে না? জানেন, গত বছর আমরা ঘাটশিলায় গেসলুম। এক ব্যাটা মালি ছিল, তাকে দশ টাকার নোট দিয়ে সিগারেট কিনতে পাঠালে কক্ষনো পয়সা ফেরৎ দিত না।
–আপনারা দু’চারদিনের জন্য আমোদ করতে এসেছেন, আপনারা একটু বেশি বেশি খর্চা করবেন, সেটা স্বাভাবিক। এখানকার গরিব লোকেরা তো তার থেকে দু’চারপয়সা মারবেই।
–দু’চার পয়সা কী বলছেন মশাই! পাঁচ-দশ টাকা তো বখশিসই দিই। তবু এ যে পুকুর চুরি।
–আপনাদের একটা টিপস দিয়ে দিচ্ছি। মালিকে চাল-ডাল, মুর্গি-টুর্গি কিনে দিয়ে রান্না করতে বলার সময় বলবেন, বেশি করে চাল নিও, তোমরাও আমাদের সঙ্গে খাবে! দেখবেন, ওরা তাতে কত খুশী হয়। আপনারা নিজে থেকেই দিলে ওরা আর চুরি করবে না।
–সে না হয় খারে আমাদের সঙ্গে, ঠিক আছে। এখানে মুর্গি কোথায় শস্তায় পাওয়া যায়? বাজার থেকে নিয়ে যাবো?
–মালির কাছেই মুর্গি আছে, আজকের মতন চলে যাবে। তারপর গাঁয়ের দিকে ঘুরতে যাবেন তো, ওখানে শস্তায় ভালো জিনিস পাবেন। দশ টাকা বারো টাকা জোড়া।
বাড়ি দেখে যুবকদলের পছন্দ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বিশ্বনাথ কিছুই বাড়িয়ে বলেননি। এটা লাহাদের বাড়ি, কলকাতায় তাদের রঙের বড় কারবার। বাড়িটি সাজাতে তারা কার্পণ্য করেনি। সামনে-পিছনে বাগান, সবটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাগানে বসলে ডিগরিয়া পাহাড়ের চূড়া দেখতে পাওয়া যায়।
মালিকে ডেকে বিশ্বনাথ সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন। এই সব বাড়ির মালিরাই নিজেদের কাছে চা-চিনি, ডিম, চাল-ডাল ইত্যাদি স্টকে রাখে। বাইরে থেকে এসেই সবাই ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে, তক্ষুনি চা ও খাবার-টাবার চায়, সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেলে খুশী হয়। প্রথম দিন অনেকে বাজারে যেতে চায় না।
বাথরুমে জল তুলিয়ে দেবার ব্যবস্থাও সম্পন্ন হবার পর বিশ্বনাথ বললেন, এবারে আমি চলি? সব ঠিক আছে তো?
অজয় তাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বললো, হ্যাঁ, সব ঠিক আছে, ভালো বাড়িতে এনেছেন, থ্যাংক ইউ, তবে ইয়ে… একটা ব্যাপার মানে আমরা ড্রিংকস আনতে ভুলে গেছি, এদিকে পাওয়া যাবে?
–দেশি না বিলিতি?
–বীয়ার, আপাতত কয়েক বোতল বীয়ার, যা গরম দেখছি এখানে…
–হ্যাঁ, বীয়ার পাওয়া যায়, সবই পাওয়া যায়। আসবার সময় যদি বলতেন…যেখানে একবার টাঙ্গা থামিয়ে সিগারেট কিনলেন, তার খুব কাছে। গেলেই দেখতে পাবেন।
অজয় অন্যদিকে ফিরে গলা তুলে বললো, এই হেমেন, পাওয়া যাবে বলছে, চল তাতে আমাতে যাই!
হেমেন নামক যুবকটি ততক্ষণে জামা-প্যান্ট ছেড়ে শুধু একটি জাঙ্গিয়া পরে বাগানে একটি মর্মর নারী মূর্তির কাছে শুয়ে আছে। সে চেঁচিয়ে বললো, আমার এখন বেরুতে ইচ্ছে করছে না। ঐ বুড়োটাকেই বল না এনে দেবে!
অজয় বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বললো, আপনি… মানে… মালিটাকে পাঠালে এনে দিতে পারবে না?
বিশ্বনাথ বললেন, মালি তো এখন জল তুলবে। দিন, আমাকেই টাকা দিন, আমি এনে দিচ্ছি।
মালির কাছ থেকে একটা থলি আর সাইকেলটা ধার নিলেন বিশ্বনাথ। মদ কিনে আনার প্রস্তাবে তিনি অসন্তুষ্ট হননি। মদের দোকানের সঙ্গেও তাঁর কমিশনের ব্যবস্থা। এক শো টাকায় দু’ টাকা। পাশাপাশি দুটি মদের দোকানের একটির প্রতি বিশ্বনাথের পক্ষপাতিত্ব। এরা বারো বোতল বীয়ারের অর্ডার দিয়েছে, বিশ্বনাথের এক বোতল ফ্রি হয়ে যাবে।
দুপুর বারোটায় চড়া রোদ। শরীরের এই অবস্থায় বিশ্বনাথের সাইকেল চালানো নিষেধ। কিন্তু গাড়ি ভাড়ার জন্য কিছু খরচ করতে বিশ্বনাথের সব সময় গায়ে লাগে। বিশ্বনাথের দৃঢ় ধারণা, তিনি সহজে মরবেন না। মেয়েটা বড় হচ্ছে, তার বিয়ে দিতে হবে। সুপূণার একটা বিয়ে দিতে পারলেই তিনি নিশ্চিন্ত। তারপর তিনি পৃথিবী ছাড়লেও তাঁর বউ ও শাশুড়ী, এই দুই বিধবার চলে যাবে ঐ বাড়ি ভাড়ার টাকায়। অবশ্য যদি ঠিক মতন আদায় হয়।
এরা তো তবু তাঁকে দিয়ে মদ আনাচ্ছে। কোনো কোনো পার্টি এসে মেয়েছেলে জোগাড় করে দেবারও ইঙ্গিত দেয়। বিশ্বনাথ অবশ্য এখনো অতটা নিচে নামেননি। তা-না-না-না- করে সরে পড়েন। সেইজন্যই তিনি পারতপক্ষে সন্ধের পর এই সব লোকদের কাছে আসেন না। অন্ধকার হলেই এদের মধ্যে ঐ প্রবৃত্তি জাগে।
ঘামে ভিজে গেল বিশ্বনাথের জামা। মদের দোকানে পৌঁছেই তিনি চলে গেলেন কাউন্টারের পেছনে। একটা বীয়ারের বোতল চেয়ে নিয়ে ছিপি খুলে দারুণ তৃষ্ণার্তের মতন পান করতে লাগলেন ঢক ঢক করে। দোকানের মালিক সিংজীকে বললেন, ভালো পার্টি এসেছে। আরও অনেক বোতল যাবে। বালুরাম মালি যে-মাল নিতে আসবে, তার কমিশান। কিন্তু আমার নামে হবে!
বোতলগুলো থলেতে ভরে তিনি সাইকেলে ঝোলালেন। তিনি কখনো ক্যাশ মেমো নিতে ভোলেন না। দোকানের মালিক ক্যাশ মেমোতেই দাম বাড়িয়ে লিখে দেয়। ফেরার পথে বিশ্বনাথ খানিকটা বরফও নিয়ে নিলেন।
বোতলগুলো পৌঁছে দেবার পর বিশ্বনাথ অজয়কে বললেন, এবারে সব ঠিক আছে তো? তা হলে আমি যাই?
বিশ্বনাথ বুদ্ধি করে বরফও এনেছেন দেখে অজয় প্রকৃতই খুশী হয়েছে। ব্যবস্থাপনা চমৎকার। মানি ব্যাগ খুলে সে একটা পাঁচ টাকার নোট তুলে বললো, আপনি এটা নিন!
মালিটা কাছেই দাঁড়িয়ে। বিশ্বনাথ সাধারণত ওর সামনে কারুর কাছ থেকে টাকা নেন না। বখশিস টখশিস ওরই প্রাপ্য। কিন্তু পাঁচ টাকার লোভ সামলানো যায় না। তিনি ভাবলেন, নাচতে নেমে আর ঘোমটা টেনে কী হবে?
হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে তিনি বললেন, থ্যাংক ইউ!
বাড়ি ফেরার সময় বিশ্বনাথ একটা বেশ বড় দেখে লাউ কিনলেন। সুহাসিনী লাউ ভালোবাসেন। মেথি ফোঁড়ন দিয়ে একটা লাউ-সুক্তো তিনি রাঁধেনও চমৎকার।
আজকাল অবশ্য সুহাসিনী রান্না করতে চান না একেবারেই। শান্তিই সব কিছু করে। সুহাসিনী গত কয়েক বছর ধরে একেবারে পাথর হয়ে গেছেন, মুখ দিয়ে কথা বেরুতেই চায় না। অমন ছটফটে মানুষ ছিলেন, এখন ঠাকুর ঘরে বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিশ্বনাথ লক্ষ্য করে দেখেছেন, তাঁর চোখ দিয়ে জলও গড়ায় না, চোখ শুকনো।
বিশ্বনাথ বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে হাঁফিয়ে গেলেন। কাশি এলো দু’একবার। এইসময় কাশির দমক এলে দু’তিন দিন আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবেন না। যে করেই হোক চাঙ্গা থাকতেই হবে, এই ছেলেগুলোর কাছ থেকে আরও কিছু পয়সা পাওয়া যাবে।
তেল মেখে স্নান করতে হবে ভালো করে। গরম তেল বুকে মালিশ করলে আরাম হয়। তাঁর মেয়ে তেল মাখিয়ে দেয়।
ওপরে এসে বিশ্বনাথ একবার উঁকি দিলেন ঠাকুর ঘরে। সুহাসিনী যথারীতি সেখানে বসা। এখন তাঁর হাতে লাউটা তুলে দেওয়া যাবে না। রান্না ঘরে ঢুকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, খুকী। কোথায়?
শান্তি বললেন, কী জানি। এক ঘণ্টা আগে তো হঠাৎ বেরিয়ে গেল! আজকাল আমার কোনো কথা শোনে না!
সুপূর্ণ কোনো ক্রমে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছে। তারপর আর তার পড়াশুনো হলো না। সে কলকাতায় মামার বাড়িতে থেকে কলেজে পড়তে চেয়েছিল, তাকে পাঠানো হয়নি। সে চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকতে চায় না। মেয়েটা খুব পাড়া-বেড়ানি হয়েছে। কিন্তু শরীরে তার যৌবন এসেছে, এরকম ভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। শান্তি তাকে শাসন করতে পারেন না। বিশ্বনাথ বাড়ি থাকেন না অধিকাংশ সময়।
হাঁপাতে হাঁপাতে বিশ্বনাথ বসে পড়ে ভাবলেন, আজ তিনি মেয়েকে আচ্ছা মতন বকুনি দেবেন।
কিন্তু একটু পরেই সুপূণা যখন ফিরে এলো, বিশ্বনাথ কিছু বলতে পারলেন না। তখন কথা বলতেই তাঁর কষ্ট হচ্ছে।
পাতলা হিলহিলে চেহারা, তার গায়ের রং শ্যামলা। মাথার চুল খোলা।
সুপূর্ণার হাতে একটা চিঠি। রাস্তায় পিওনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। চিঠিখানা প্রতাপের। বিশ্বনাথের এখন যেন চিঠি পড়ারও ক্ষমতা নেই। তিনি ফিসফিস করে বললেন, খোল। কী লিখেছে জোরে জোরে পড়।
শান্তি বললেন, দাঁড়াও, মাকে ডাকি। মা-ও শুনবেন।
বিশ্বনাথ দাবড়ানি দিয়ে বললেন, আঃ, ভালো-মন্দ কী লিখেছে আগে শুনে নি। আগেই মাকে ডাকার কী দরকার! গত মাসে তোমার ভাই টাকা পাঠায় নি। সে ভেবেছে কি, আমাদের সংসার চলবে কী করে?
সুপূর্ণার ডাক নাম টুনটুনি, তার স্বভাবটি ঐ পাখির মতনই ছটফটে। বাংলা সে ভালো পড়তে পারে না, বিশেষত হাতের লেখা। সে থেমে থেমে একটা একটা শব্দ উচ্চারণ করে পড়তে লাগলো।
বিশ্বনাথের বুকটা হাপড়ের মতন উঠছে নামছে। নিশ্বাস ফেলতে পারছেন না ভালো করে। এ বাড়িতে চিঠি কদাচিৎ আসে, প্রতাপরাও আসা অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। চিঠি এলেই বিশ্বনাথের মনে হয়, একটা কিছু দারুণ খবর থাকবে।
প্রথম দিকের সাধারণ কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে বিশ্বনাথ বললেন, আসল কথাটা কী লিখেছে, দ্যাখ না!
মাত্র দু’ পাতার চিঠি, তাও পুরোটা শোনা হলো না বিশ্বনাথের। এক বোতল বীয়ারের নেশাতেই তার ঘুম এসে গেল, তিনি নাক ডাকতে লাগলেন।