1 of 4

২.০৩ সিন্দাবাদের তৃতীয় সমুদ্র-যাত্রা

সিন্দাবাদের তৃতীয় সমুদ্র-যাত্রা

দু’শো আটানব্বইতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :

সিন্দবাদ নাবিক গল্প থামিয়ে চুপ করে। টেবিলে খানাপিনা সাজানো ছিলো। বান্দারা উপস্থিত অভ্যাগতদের সকলকে খানাপিনা দিলো। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বৃদ্ধ সিন্দবাদকুলি সিন্দবাদকে একশোটা সোনার মোহর দিয়ে বলে, এটা রাখে। আমি খুশি হয়ে দিলাম।

কুলি সিন্দবাদ কৃতজ্ঞ চিত্তে গ্রহণ করে তার দান। মহা আনন্দে বাসায় ফিরে আসে। পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে রুজু নামাজাদি সেরে আবার সে বৃদ্ধ সিন্দাবাদের প্রাসাদের দিকে রওনা হয়।

সিন্দবাদ নাবিক তারই প্রতীক্ষায় বসেছিলো। আদর করে কাছে বসায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক এক করে আবার সব অতিথি অভ্যাগতরা এসে হাজির হয়। যথারীতি টেবিলে সাজানো ছিলো। সকালবেলার নাস্তা। খানাপিনা শেষ হলে সিন্দবাদ কাহিনী শুরু করে :

বন্ধুগণ, আল্লা যে সর্বশক্তিমান সে তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু তার অসাধারণ জ্ঞান বুদ্ধি বিচক্ষণতাও মানুষের চাইতে অনেক অনেক বেশী। তা না হলে যে বিপদে পড়ে একদিন আমার প্রাণসংশয় ঘটেছিলো, এইরকম বিত্ত বৈভবের মধ্যে মহা আনন্দে দিন কাটাতে কাটাতে, আবার সেই প্রাণঘাতী বিপদের মধ্যে পা বাড়াবো কেন? যথা সময়ে তিনি আমার মন থেকে সেই সব আতঙ্ক ভয় মুছে নিয়েছিলেন। তাই আবার আমার সমুদ্রযাত্রার বাসনা হলো। বাগদাদে বসে বসে একঘেয়ে আনন্দের জীবন আর আমার ভালো লাগলো না। কোনও বৈচিত্ৰ্য নাই। কুঁড়ের মতো ঘরে বসে বসে বিলাস ব্যসনের মধ্যে দিন কাটাবো। আমার রক্তের ধারা সেরকম নয়। তাই আবার একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি।

এবার আমি আর ভারি ভারি মোটা সওদা সঙ্গে নিলাম না। বিদেশের বাজারে আরবের মূল্যবান আতর নির্যাসের কদর খুব বেশি। এছাড়া বাগদাদের সূক্ষ্ম শিল্পকর্মও অন্য দেশে চড়া দামে বিক্রি হয়। পয়সার তো আমার অভাব নাই তখন, অনেক অর্থ ব্যয়ে এই সব বিলাসের সামগ্ৰী সংগ্রহ করে বসরা হয় এসে পৌঁছলাম। এখান থেকে দুনিয়ার প্রায় সব জায়গারই জাহাজ ছাড়ে। বসরা হয় গিয়ে একদল সাচ্চা মুসলমান, সদাশয় সওদাগরের সঙ্গে আমার দোস্তি হয়ে গেলো। তারাও বাণিজ্যে যাবে। ভালো সঙ্গীদল পেয়ে আমিও ভিড়ে গেলাম তাদের দলে।

দিনক্ষণ দেখে, আল্লাহর নাম নিয়ে একদিন জাহাজে চেপে বসলাম আমরা।

পালে হাওয়া লাগলো। জাহাজ চলতে থাকলো।

এক এক করে অনেক বন্দর আসে। শহরে শহরে আমরা সওদা ফিরি করি। আমি যে-ধরনের মূল্যবান বিলাস সামগ্ৰী সঙ্গে নিয়েছি সে-ধরণেও সওদা বড় একটা কেউই সঙ্গে নিতে পারে না। তাই যেখানেই দেখাই সবাই লুফে নিতে থাকে। প্রতিটি সওদায় মোটা লাভ হতে থাকে আমার। খুশিতে মন নেচে ওঠে।

এইভাবে চলতে চলতে একদিন আমরা মুসলমান সুলতানদের সলতানিয়াৎ এলাকা ছাড়িয়ে মোঝ-সমুদ্র ধরে পাডি জমিয়েছি। হঠাৎ কপ্তেন চিৎকার করে ওঠে। সর্বনাশ!

আমরা ছুটে গেলাম তার কাছে।–কী? কী হয়েছে?

সে কোনও কথার জবাব দেয় না। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে, আর কপাল চাপড়ায়।

আমরা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে, বলবে তো?

কাপ্তেন তখন পাগলের মতো প্ৰায়। মাথার চুল, আর জামাকাপড় ছিড়ছে। চোখে মুখে তার সে-এক অবর্ণনীয় নিদারুণ আতঙ্ক। কোনওরকমে সে বলতে পারে, পালের হাওয়া ঘুরে গেছে। আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। এখন যে পথে জাহাজ চলেছে, সে পথে চলতে থাকলে আমরা বাঁদর দ্বীপে পৌঁছব। সেখানে একবার গেলে আর কেউ ফিরে আসতে পারে না।

আমরা চিৎকার করে উঠি, যেভাবেই হোক, জাহাজের গতি ফেরাও। কাপ্তেন বললো, অসম্ভব। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ বাঁদর দ্বীপে পৌঁছে যাবে। এখন চেষ্টা করে কোনও লাভ নাই। জোর করে ঘোরাতে গেলে জাহাজ ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাবে।

আমরা উদ্রান্তের মতো জাহাজের ডেকে ছুটাছুটি করতে লািগলাম। সামনে মৃত্যু অবধারিত জেনে কে আর চুপচাপ বসে থাকতে পারে?

কিছুক্ষণের মধ্যে জাহাজ বাঁদর দ্বীপের কাছাকাছি এসে পড়লো। জাহাজটা ঘিরে প্রবলো বান্দরের পঙ্গপাল। সংখ্যায় কত—তার হিসাব বলতে পারবো না। দশ বিশ-এমন কি? ধ্বগ্নশ হাজারও হতে পারে। এক বিশাল সেনাবাহিনী বলা যায়!

আমরা জাহাজের মধ্যে ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। নিয়ে নামবো-সাধ্য কী?–; কিন্তু দীতমুখ খিচিয়ে সহজাত অসভ্যতায় ‘স্বাগত জানাতে থাকে। মুখের ও স্বা দুর্বোধ্য, কিন্তু তু সখানা এই—নিচে নেমে এসো বাছাধনরা, আমরা তোমাদের বুক চিরে রক্ত ৮ ন করবো।

ওদের আক্রমণ করার দুঃসাহস আমাদের নাই। অথবা ওদের অ’ক্বমণ প্রতিরোধ কর, ‘। শক্তিও আমরা ধরি না। এই অবস্থায় আশু কর্তব্য কী, কিছুই ঠিক করতে পারছি না। এমন সময় হুড়পাড় করে তারা আমাদের জাহাজের ডেকে উঠে এলো। আমরা অনড় অচল হয়ে বসে রইলাম। ওরা আমাদের সওদাপত্র তছনছ করতে লাগলো। ওদের বীভৎ’ চেহারা দেখে আর বিকট চিৎকার শুনে হৃৎপিণ্ড শুকিয়ে যায়। বিচিত্র ধরনের অঙ্গভঙ্গী আর অদ্ভুল ধরনের মুখ বাদন করে তারা যে কত কি বলতে লাগালো তার একবৰ্ণও বুঝলাম না। আমোদর সামনেই তারা মাস্তুলের মাথায় উঠে পালের কাছি খুলে দিলো। তারপর হাল আর দ ডু অধিকার করে জাহাজটাকে সমুদ্রসৈকতে নিয়ে গিয়ে ভেড়ালো।

এক এক করে আমাদের সবাইকে টানতে টানতে তীরে নামালো ওরা কামরা তখন কোরবানীর খাসী; মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও রুখে দাঁড়াবার দুঃসাহস নাই।

আমাদের সকলকে নামিয়ে দিলো, কিন্তু ওরা কেউই জাহাজ থেকে নামবে না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের যথাসর্বস্ব সওদাপত্ব ঠাসা জাহাজখানা নিয়ে ওরা মাঝদরিয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেলো।

আমার মতো অনেকেই বুক ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। কিন্তু কান্নাকাটি করেই বা লাভ কী? বিদেশে বিপৰ্যয় ঘটতেই পারে। তার জন্য আগে থেকে যেমন সতর্ক হওয়াও সম্ভব না, তেমনি বিপদ এসে গেলে ভেঙ্গে পড়াও সঙ্গত না। অবস্থা ও সময়ের সঙ্গে মানিয়ে চলাই বিচক্ষণতা।

যাই হোক, আমাদের সর্বস্ব চলে গেছে। এখন বাঁচার পথ বের করতে হবে। আমরা সকলে সেই সমুদ্রসৈকতে বালির উপরে বসে এক সভা করলাম। ঠিক হলো আগে আমরা দ্বীপের অভ্যন্তরে ঢুকে কিছু খানাপিনার সন্ধান করবো। প্রথমে ফলমূল এবং জলের সন্ধান করে তারপর অন্য ফিকির খুঁজতে হবে।

সমুদ্রতীর থেকে খানিকটা ভিতরে ঢুকতেই নানারকম পাকা মিষ্টি ফল আর ঝর্ণার জলের খোঁজ পাওয়া গেলো। ধরে প্রাণ এলো। যাই হোক, অনাহারে শুকিয়ে মরতে হবে না।

এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে পাকা মিষ্টি ফলের সন্ধান করতে করতে আমরা আরও অনেকটা ভিতরে ঢুকে পড়েছি। হঠাৎ নজরে পড়লো, গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, অদূরে এক প্রাসাদোপম অট্টালিকা। আপাতভাবে মনে হয় জনমানব শূন্য।

খানাপিনা শেষ করে আমরা ঐ ইমারতের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রকাণ্ড উঁচু, প্রস্থে দৈর্ঘে সমান-চতুষ্কোণাকৃতি পোল্লাই এক প্রাসাদ। চারদিক পাথরের প্রাচীরে ঘেরা। দু-দুটো সিংহ দরজা পেরিয়ে তবে প্রাসাদের চত্বরে প্রবেশ করা যায়।

শুধু সিংহ দ্বারই হাট হয়ে পড়ে আছে। সিংহ সদৃশ প্রহরী আজ আর নাই সেখানে। আমরা ভিতরে ঢুকে গেলাম। বিরাট প্রশস্ত প্রাঙ্গণসদৃশ এক কক্ষ। সারা ঘরময় থরে থরে সাজানো রানাবান্নার সাজ-সরঞ্জাম। বড় বড় কড়াই ডেকচি হাতা বেডি প্রভৃতি। ঘরের মেজেয় স্তুপীকৃত হাড়। কতকগুলো একেবারে শুকনো সাদা। আবার কতকগুলো এখনও মাংসের ঝোলকাল লেগে রয়েছে। একটা পচাদুৰ্গন্ধ নাকে এলো। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। পলকের মধ্যেই আমরা সংজ্ঞা হারিয়ে মেজেয় লুটিয়ে পড়লাম।

সূর্য সবে পাটে বসেছে; এমন সময় বাজ পড়ার মতো। হুঙ্কারে আমাদের তন্দ্রাভাব কেটে গেলো। ধড়মড় করে উঠে বসতেই দেখলাম বিশাল দৈত্যের মতো একটা কালো কুৎসিত কদাকার একটা মানুষ সিডি দিয়ে নিচে নেমে আসছে। লম্বায় সে তাল গাছের সমান, হতকুৎসিৎ বাঁদরের চেয়েও দেখতে বীভৎস। তার চোখ দুটো গোলাকৃতি আগুনের ভঁটা। গাইতির কাটার মতো তার দাঁত আর মুখের গহ্বর ঠিক একটা ইদারার মতো। নিচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়েছে বুক অবধি। কুলোর মতে কান দু’খানা কাঁধ ঢেকে ফেলেছে। হাতের নখগুলো ইয়া বড় বড়, আর থাবা-ঠিক সিংহের মতো।

দেখা মাত্র আমরা ভয়ে শিউরে উঠেছিলাম। পরে পাথরের মত নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম। দেওয়ালের পাশে একটা বেঞ্চির উপরে সে বসলো। এক এক করে আমাদের সকলের ওপর চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলো। তারপর উঠে এসে সিংহের মতো থাবা দিয়ে আমার ঘাড়টা চেপে ধরলো। তারপর ছোট্ট একটা ইঁদুর ছানার মতো আমার দেহটাকে শূন্যে তুলে এদিক ওদিক ঘোরাতে থাকলো। তারপর কি খেয়াল হলো, আমাকে মেজের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে আর একজনের ঘাড়ে থাবা বসালো। হয়তো আমার কৃশকায় দেহটা তার পছন্দসই হলো না। কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাকে ধরলো তাকেও দু-একবার দুলিয়ে ছুঁড়ে দিলো। এইভাবে এক এক করে সে সকলের দেহের ওজন পরীক্ষণ করে দেখতে থাকলো। সব শেষে সে এলো কাপ্তেনের কাছে।

কাপ্তেনের শরীরটা বেশ মোটাসোটা তাগড়াই। যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। তাকে দেখে দৈত্যাটার মুখে হাসি আর ধরে না। অর্থাৎ খুব পছন্দ হয়েছে তার।

এক হাত দিয়ে ওর কোমরটা আর এক হাত দিয়ে ঘাড়টা ধরে একটা মোচড় দিয়ে মুণ্ডুটা ছিঁড়ে ফেললো সে। তারপর একটা বিরাট কড়াই-এর মধ্যে ফেলে উনুনে আগুন জেলে দিলো। কিছুক্ষণ পরে কাপ্তেনের দেহের আধ সেদ্ধ মাংসপিণ্ডটা তুলে গোগ্রাসে খেতে থাকলো সে। খুব তৃপ্তি করে খেয়ে মোটা মোটা হাড়গুলো মেজের ওপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়া মাত্র সে বেঞ্চিটার ওপরে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে মোষের মতো নাক ডাকাতে লাগলো। এইভাবে পরদিন সকাল অবধি সে ঘুমিয়ে কাটালো। ঘুম ভাঙ্গামাত্র কোন দিকে ভ্বদক্ষেপ না করে যে পথে নেমে এসেছিলো। সেই সিডি দিয়েই আবার ওপরে উঠে চলে গেলো। আমাদের অবস্থা তখন অবৰ্ণনীয়। বেঁচে আছি কি নাই, সে বোধশক্তিও নাই কারো।

যখন বুঝলাম সে সত্যিই চলে গেছে, আমরা হাঁউমাউ করে কেঁদে ফেললাম।-এর চেয়ে গহিন সমুদ্রে ডুবে মরাও ঢের ভালো ছিলো, আল্লাহ। অথবা বাঁদরগুলো যদি আমাদের কলিজা ছিঁড়ে রক্ত পান করতো সেও বরং সহ্য হতো, কিন্তু কড়াই-এর ফুটন্ত তেলে ফেলে ভাজা হওয়া-উফঃ!

কিন্তু ভেবে আর লাভ কী? নসীবে যা লেখা আছে তা হবেই। আল্লাহই একমাত্র ভরসা। তিনি না বাঁচালে কেউ বাঁচাতে পারবে না এখন।

প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। সারাদিন দ্বীপের এদিক ওদিক ঘুরলাম। লুকিয়ে থাকার মতো কোনও একটা গুহা বা ডেরা যদি কোথাও পাওয়া যায়। কিন্তু আতি পাতি করে খুঁজেও কোথাও কিছু পাওয়া গেলো না। সারা দ্বীপটািয়। আর কোনও বাড়িঘর নাই। না আছে কোনও পাহাড় পর্বত, না আছে কোনও গভীর জঙ্গল। সর্বত্রই ফাঁকা ফাঁকা গাছপালা বা উন্মুক্ত প্রান্তর।

সন্ধ্যা নেমে এলো। আমরা নিরুপায় হয়ে আবার সেই রাক্ষস পুরীতেই ফিরে এলাম। এছাড়া উপায়ই বা কী? রাক্ষসটার একটা গুণ-সে। আমাদের একজনকে ছাড়া দুজনকে এক সঙ্গে খাবে না। কিন্তু এই অরক্ষিত গাছতলায় রাত কাটোনর কী ভরসা। হয়তো এক রাতেই সদলে সকলে প্ৰাণ খোয়াবো আমরা। তার চাইতে যার নসীবে যা আছে, তাই হবে। রাক্ষস পুরীতেই যাওয়া যাক। যার বরাত খারাপ আজ রাতে তার প্রাণ যাবে

আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৈত্যটা হুংকার ছাড়তে ছাড়তে নেমে এলো। আবার সে গত রাতের মতো এক এক করে সকলের দেহ পরীক্ষা করে। দেখতে থাকলো। কোনটা ওজনে বেশি ভারি। শেষ পর্যন্ত একজনকে বেছে নিয়ে একই কায়দায় আধাসিদ্ধ করে খেয়ে আবার বেঞ্চে শুয়ে পড়ে মোষের মতো নাক ডাকাতে লাগলো। যথারীতি পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে আবার সে উপরে উঠে গেলো!

আমরা ঠিক করলাম, না, এই নারকীয় বীভৎস ব্যাপার। আর সহ্য করা যায় না। এর চেয়ে সমুদ্রে বাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করা ঢের ভালো। মরীয়া হয়ে উঠেছি সকলে, আজ যা হয় একটা এসপার-ওসপার করতেই যে হবে। আমাদের একজন উঠে দাঁড়িয়ে বললো, শুনুন ভাইসব, নিজেরা নিহত হওয়া অথবা আত্মহত্যা করার চেয়ে এই শয়তানটাকে হত্যা করার ফিকির খোঁজা কি ভালো না? মরতে তো হবেই, তা বলে এইভাবে মরা? আসুন আমরা আমাদের শক্রকে নিধন করি। তার জন্যে যদি মৃত্যু আসে। আসুক-সে। অনেক গৌরবের হবে। কিন্তু এতো কাপুরুষের মতো নিজের গলাটা হাডিকাঠে বাড়িয়ে দেওয়া–

এরপর আমি উঠে আমার বক্তব্য পেশ করলাম। —শুনুন শেখ সাহেবরা, দৈত্যটাকে যদি মারতে পারি তো খুব ভালো, কিন্তু না যদি পারি সে ক্ষেত্ৰেও তো একটা উপায় ভাবতে হবে। আমি বলি কি—আমরা একটা কাঠের ভেলা বানাই। আমি দেখেছি সমুদ্রের ধারে অনেক কাঠের গুডি পালা দেওয়া আছে। ভোলাটায় চড়ে আমরা ভাসতে ভাসতে চলি। তারপর আল্লাহ। যদি মুখ তুলে চান, নিশ্চয়ই কোনও জাহাজের নাবিক আমাদের তুলে নেবে। নতুবা হয়তো কোনও নতুন দ্বীপে গিয়ে ভিড়বো! আর যদি পথের মধ্যে ডুবেই মরি, সে-ও তো এর চেয়ে অনেক ভালো হবে। এই অবধারিত আপ-মৃত্যুর জন্য প্রতিটি মুহূর্ত অপেক্ষা করার চেয়ে অনেক ভালো হবে। অনেক গৌরবের হবে।

সকলে আমার কথায় সায় দিলো।–বহুৎ আচ্ছা, চমৎকার!

রাত্রির অন্ধকার কাটতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

তিনশোতম রজনী :

বৃদ্ধ সিন্দবাদ তার কাহিনী বলছেঃ আমরা সকলে সমুদ্র-সৈকতে গিয়ে কাঠের গুডি দিয়ে একটা ভেলা বানালাম। নানারকম কাঁচা পাকা ফলমূলে বোঝাই করলাম। বেশ কিছুদিনের খাবার সঙ্গে থাকা দরকার। না জানি কতদিনে নতুন দ্বীপের বা কোনও জাহাজের সন্ধান পাওয়া যাবে। এরপর আমরা আবার দৈত্যপুরীতে ফিরে আসি। যথা সময়ে রাক্ষসটা হুঙ্কার ১\ ছাড়তে ছাড়তে নামে। তারপর এক এক করে বাছাই করে একজনকে কড়াই-এ চাপায়। আমাদের এই বীভৎসতা অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিলো। তবু চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম।

একটু পরে রাক্ষসটার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আমরা দু’খানা ইয়া মোটা মোটা লোহার সিক এনে উনুনের মধ্যে রাখলাম। গানগনে আগুনে টকটকে লাল হয়ে উঠলো সিক দুটো। তারপর দুজনে দু’খানা তুলে এনে এক সঙ্গে ঢুকিয়ে দিলামদৈত্যটার দুই চোখে। যন্ত্রণায় আকাশ-ফাটা আর্তনাদ করে ওঠে সে। কিন্তু ততক্ষণে আমাদের কাজ হাঁসিল হয়ে গেছে। বিকটভাবে দাঁত-মুখ খিচিয়ে সে আমাদের দিকে তেড়ে আসে। কিন্তু এলে কি হবে, চোখ তো গেছে, আন্দাজে কি করে ধরবে। আমাদের? আমরা ওর সঙ্গে লুকোচুরি খেলা করতে করতে পাশ কাটিয়ে যেতে থাকি। নিরুপায় হয়ে দৈত্যটা তখন গোঙাতে গোঙাতে সিডি বেয়ে ওপরে উঠে যায়।

এবার আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে সমুদ্রের ধারে এসে ভেলায় উঠে পড়লাম।

ভাবলাম পথের কাঁটা দূর হয়েছে। কিন্তু না, ভোলাটা তখনও তীর ছেড়ে খুব বেশিদূর যায়নি, দেখলাম, একটা কালো কদাকার মেয়েছেলে দৈত্যটার হাত ধরে ছুটতে ছুটতে তীরের দিকে আসছে। মেয়েটা একখণ্ড পাথরের চাই এনে দিলো ওর হাতে। আর প্রচণ্ড বেগে সে ছুঁড়ে মারলো আমাদের ভেলা বরাবর। চোখে দেখতে না পেলে কি হবে, নিশানা একেবারে ব্যর্থ হয়নি। আর একটু হলেই ভেলার মাঝখানে পড়তে চাইটা। নেহাৎ বরাতের জোর, এক দিকের কানায় লেগে কাত হয়ে গেলো খানিকটা। আমাদের দুটি লোক প্রাণ হারালো। তবুও, অল্পের ওপর দিয়ে ফাঁড়া কেটে গেলো। এর পরেও অবশ্য আরও কয়েকটা পাথরের চাই সে ছুঁড়েছিলো, কিন্তু ততক্ষণে আমাদের ভেলা তার নাগালের বাইরে চলে গেছে।

আল্লাহর দোয়ায় হাওয়া অনুকুল হলো। একটানা দুদিন-দুরাত্রি চলার পর আমরা একটা নতুন দ্বীপে এসে ভিড়লাম। নতুন জায়গা, কিছুই জানি না, সুতরাং খানাপিনা সেরে আমরা একটা বড় গাছের ডালে উঠে সো-রাতটা কাটালাম।

সকাল বেলা, অন্ধকার কেটে যেতেই, নজরে পড়লো, বিরাট বিরাট সাপ সেই গাছের অন্য ডালে লেজ-জড়িয়ে ঝুলছে। ভয়ে প্রাণ শুকিয়ে গেলো। তাদের চোখগুলো যেন জ্বলন্ত ভাটা। লেলিহান জিহ্বা বের করে আমাদের দিকে জ্বল জুল করে তাকাচ্ছে। হঠাৎ একজনের আর্ত চিৎকারে তাকিয়ে দেখি, আমাদের একজনকে প্যাচে জড়িয়ে ফেলছে একটা সাপ। তারপর বিকট বিশাল হা করে তার গোটা দেহটা নিমেষের মধ্যে গিলে ফেললো সে।

হায় আল্লাহ, একি হলো, দৈত্যের খল্পর থেকে যদি বা রেহাই পাওয়া গেলো। কিন্তু এখন ভয়াল সাপের হাত থেকে বাঁচবো কি করে? আল্লাহ ছাড়া আর কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে। জ্ঞান চৈতন্যপ্রায় নাই বললেই চলে। কোনও রকমে গাছের ডাল থেকে নামতে পারলাম আমরা। একটা ঝর্ণার ধারে এসে মুখ হাত ধুয়ে কিছু ফলমূল খেয়ে নিলাম। তারপর শুরু হলো আমাদের অন্বেষণ যাত্রা। কোথায় একটা নির্ভরযোগ্য আস্তানা পাওয়া যাবে তারই অনুসন্ধান করতে লাগলাম। অবশেষে অনেক দূরে একটা গাছ নির্বাচন করা হলো। তন্ন তন্ন করে খুঁজে পেতে দেখলাম। না, কোথাও কোনও সাপখোপ কিছু নাই। তাছাড়া গাছটা অনেক উঁচু। সে-রাতটা আমরা সেই গাছের ডালেই অনেকটা নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবো। মনে আশা হলো এতদিন পরে বোধহয় এই প্রথম আমাদের নির্ভয় রাত্ৰিবাস হবে। কিন্তু হায় কপাল, রাত, যত গম্ভীর হতে থাকে চারদিকে ভয়াল সাপের নিশ্বাসের শব্দ শুনে কেঁপে উঠি। দিনের বেলায় তারা গাছে থাকে না। কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হয়।

আমার নিচের ডালের সঙ্গী চিৎকার করে উঠে। বুঝলাম, যদিও অন্ধকারে চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, সাপের মুখে চলে গেছে সে।

তখন, সেই অন্ধকারে, গাছ থেকে নেমে পালাই তার সাধ্য কি? মারি বাঁচি এই গাছের ডাল আঁকড়েই রাতটা কাটাতে হবে। প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়ে শুধু আল্লাহর নাম জপ করতে থাকলাম।

সকাল হলো। দেখলাম সাপটা খেয়ে-দোয়ে কেটে পড়েছে। আমি গাছ থেকে নেমে পড়ি। তখন আমার মাথায় শুধু একমাত্র চিন্তা এই সাপপুরী থেকে পালাতে হবে। আবার সমুদ্রেই পাডি জমাবো। তাতে যদি ডুবেও মরি, কোন দুঃখ নাই।

সমুদ্রের দিকে চললাম। কিছুদূর যেতেই আমার বিবেক বাধা দিতে লাগলো। সামান্য সাপ-খোপের ভয়ে যদি পোলাতে হয় তবে, দেশের সুখ-বিলাস ছেড়ে পরবাসের দুর্ভোগ পোয়াতে বেরুবার কি দরকার ছিলো? ভাবলাম, না, পলায়ন নয়, সাপের হাত থেকে নিজেকে রক্ষণ করে চলতে হবে। সেই উপায় খুঁজে বের করতেই হবে।

সুতরাং আবার আমি ফিরে এলাম। কতকগুলো টুকরো টুকরো কাঠ যোগাড় করলাম। দুপায়ে বঁধিলাম দু’খানা। কোমর থেকে গলা অবধি বুক পিঠ ঢেকে বাঁধলাম কয়েকখানা কঠে। দু’হাতে বঁধলাম দু’খানা। এইভাবে অনেকগুলো কাঠের টুকরো দিয়ে সারা শরীরটা মুড়ে ফেললাম। এবার যদি সাপ আমাকে আক্রমণও করে, গিলে ফেলতে পারবে না।

আমার এই কায়দায় সে রাতটা আমি সাপের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছিলাম নিজেকে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ময়াল সাপ এসে আমাকে গ্রাস করার চেষ্টা করলো। কিন্তু দুস্তর কাঠের বাধা—সে কিছুতেই মুখে পুরতে পারলো না। কিছুতেই কায়দা করতে না পেরে শেষে সাপটা আমাকে জড়িয়ে ফেললো। কিন্তু তাতেও আমার কিছু অসুবিধে হলো না। তার প্যাচের বাঁধন কাঠের গায়েই আটকে থাকলো। আমার দেহে কোনও আঘাত করতে পারলো না।

এইভাবে সাপটা সারাটা রাত আমার সঙ্গে লড়াই করে ক্লাস্ত হয়ে ভোরবেলা কেটে পড়লো। ই এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

তিনশো একতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :

যখন আমি নিশ্চিতভাবে বুঝলাম, সাপটা চলে গেছে, কাঠের টুকরোগুলো এক এক করে। খুলে ফেললাম সব। সারাটা রাত এই কাঠের বন্ধনে কাটিয়ে শরীরটা অবশ অসাড় হয়ে গেছে। ঝর্ণার পাশে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে কিছু ফলাহার করে উন্মুক্ত সূর্যালোকে ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

এইভাবে অনেকক্ষণ আয়েস করার পর, ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে চলতে থাকি। হঠাৎ একটা মাস্তুল চোখে পড়লো। ছুটে আরো কাছে যেতেই পরিষ্কার দেখতে পেলাম, একখানা জাহাজ চলে যাচ্ছে। আমি দু হাত নেড়ে তারস্বরে চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু মনে হলো, কেউ শুনতে পেলনা। তখন আমার মাথার পাগড়ী খুলে জোরে জোরে দোলাতে থাকলাম। এবার কাজ হলো। বুঝলাম, ওরা আমার পাগড়ী নাড়া দেখতে পেয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কপ্তেন জাহাজের গতি ঘুরিয়ে দ্বীপে এসে ভিড়লো। আমাকে ওরা তুলে নিলো জাহাজে।

ওরা আমাকে নতুন সাজ পোশাক দিলো, খানাপিনা দিলো। আমি আবার নতুন জীবন ফিরে পেলাম। জাহাজের কাপ্তেন, খালাসীদের বললাম। আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী। তারা শুনতে শুনতে আমার দুঃসাহসিকতার তারিফ করলো। বললো, আল্লাহ তোমার সহায় আছেন, তাই এই বিপদেও প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছ।

এর পর আমরা বেশ সুখেই দিন কাটাতে থাকলাম। জাহাজ চলতে চলতে একদিন সালাহিতা দ্বীপে এসে নোঙর করলো। সওদাগররা নেমে শহরের দিকে চললো—কোেনাবেচা করতে।

জাহাজের কাপ্তেন আমকে ডেকে বললো, দেখো, তুমি তো ভাগ্যের বিপর্যয়ে আজ নিঃসম্বল। গরীব। এক কাজ কর, আমার এই জাহাজে বাগদাদের এক সওদাগরের কিছু সওদাপত্ব আছে। পথের মাঝখানে তাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তুমি সেই জিনিসপত্রগুলো এখানকার শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা করো। যা লাভ হবে, সবই তোমার। আমাকে শুধু আসল দামটা ফেরৎ দিও। দেশে ফিরে তার আপনজনদের হাতে টাকাটা ফেরৎ দিয়ে দেব।

আমি কাপ্তেনের এই বদন্যতায় খুশি হয়ে বললাম, আপনি আমার জন্যে এতটা করছেন, এ ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না।

কাপ্তেন বলে, তার দরকার নাই! যাও, আমি খালাসীদের বলে দিচ্ছি। তোমাকে গাটরিগুলো বের করে দেবে।

কাপ্তেনের হুকুমে খালসীরা গাঁটরীগুলো বাইরে আনলো। আমি দেখে অবাক হলাম— গাটরীগুলোর ওপরে আমার নাম ‘সিন্দবাদ নাবিক’ লেখা রয়েছে।

আনন্দে আমি লাফিয়ে উঠলাম। এসব তো আমারই জিনিস। গতবারের সমুদ্রযাত্রার সময় এক দ্বীপে নেমে যথা সময়ে জাহাজে ফিরতে পারিনি আমি। জাহাজ, ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।

কাপ্তেন সব শুনে আমাকে ভালো করে লক্ষ্য করলো, তাই তো, তুমিই তো সেই সওদাগর বটে। তা হলে তো ভালেই হলো। তোমার জিনিস তুমি ফিরে পেলে। আর আমিও একটা দায় থেকে রেহাই পেলাম। যাও, এবার শহরে গিয়ে বেসাতি করে এসো।

সেই সব জিনিসপত্র বেশ চড়া দামে বিক্রি করে অনেক নাফা করলাম আমি।

এর পর আমরা দেশে ফিরে আসি। এই হচ্ছে আমার তৃতীয় সমুদ্রযাত্রা। এর পর তোমাদের শোনাবো। আমার চতুর্থ যাত্রার কাহিনী।

বৃদ্ধ সিন্দবাদ একশোটা সোনার মোহর কুলি সিন্দবাদের হাতে গুঁজে দিয়ে বললো, কাল সকালে ঠিক সময়ে আসবে কিন্তু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *