1 of 3

২.০২ শেষ পরীক্ষার শেষ ঘণ্টা

দ্বারভাঙা বিল্ডিং-এ শেষ পরীক্ষার শেষ ঘণ্টা। অতীনের হাতের কলম সময়ের চেয়েও দ্রুত দৌড়োচ্ছে। মাথা তুলে সে একবার দেখে নিল, দু’একজন খাতা জমা দেবার জন্য উঠে পড়েছে, এইবার বুঝি ঘণ্টা বাজবে। হলঘরে কোনো ঘড়ি নেই, তবু কোথাও যেন অদৃশ্য টক টক টক টক শব্দ হচ্ছে। অতীনের একটা প্রশ্নের এখনো প্রায় অর্ধেকটা বাকি, মুখ চোখ তার রাগে কঠিন হয়ে এলো, তারপর তার সম্পূর্ণ আত্মা যেন ভর করলো ডান হাতের আঙুলের ডগায়।

ঘণ্টা বাজবার পরও অতীন লিখে যাচ্ছিল, ইনভিজিলেটার এসে তার পাশে দাঁড়াতেই সে খাতাটা মুড়ে তার হাতে তুলে দিল বিনা প্রতিবাদে, মুখ তুললো না। ইনভিজিলেটার চলে যাবার পরেও সে কয়েক মুহূর্ত বসে রইলো স্থির হয়ে, তারপর বিচারক যেমন কারুকে ফাঁসিরদণ্ড দেবার পর তাঁর কলমের নিবটা ভোঁতা করে দেন, অতীনও তার কলমটা মুঠোয় চেপে ধরে ঠিক ছুরির মতন ঘ্যাঁচ করে বসিয়ে দিল হাই বেঞ্চে।

তার পাশের ছেলেটি চোখ বড় বড় করে বললো, এ কী রে, কলমের ওপর রাগ করছিস কেন? সব লিখতে পারলি না?

অতীন বললো, ধ্যাৎতেরিকা!

এই কলমটা থেকে ঠিক মতন কালি বেরুচ্ছিল না, লিখতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল অতীনের।

হল থেকে বেরিয়ে আসবার পর সিদ্ধার্থ জিজ্ঞেস করলো, কী রে, কেমন দিলি?

অতীন ঠোঁট উল্টে অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বললো, ফার্স্ট ক্লাস পাবো ঠিকই, সে আর এমন বেশি কথা কী আছে!

সিদ্ধার্থ হেসে উঠলো। অতীনের কথা বলার ধরনই এই রকম। ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া যেন কিছুই না, রাস্তা থেকে একটা খোলাম কুচি কুড়িয়ে নেবার মতন।

ওদের আর দু’জন বন্ধু, কৌশিক আর রবি সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন পত্র হাতে নিয়ে পরস্পরের উত্তর মেলাচ্ছিল, অতীনকে দেখে ওদের একজন বললো, এই অতীন শোন্‌, তুই পাঁচ নম্বরটা…

অতীন বাঁ হাত নেড়ে ধমক দিয়ে বললো, রাখ্‌, রাখ্‌, হয়ে গেছে, এখন আবার ও নিয়ে মাথা ঘামানো!

নিজের প্রশ্নপত্রটা সে অপ্রয়োজনীয় দাদের মলমের হ্যাঁন্ডবিলের মতন গুলি পাকিয়ে ছুঁড়ে দিল শূন্যে। তারপর তরতর করে নেমে গেল নিচে।

রাস্তায় বৃষ্টি পড়ছে ছোট ছোট ফোঁটায়। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই বৃষ্টি পড়ছে নিশ্চয়ই, কেননা রাস্তার রং এখন কালো, পদাতিকের সংখ্যা বেশ কম। গত তিন ঘণ্টায় অতীন একবারও জানলার বাইরে কী ঘটছে লক্ষ করেনি।

অতীনের চোখ দুটো ঢুকে গেছে কোটরে, নাকটা যেন বেশি খাড়া দেখাচ্ছে, মুখমণ্ডলে রাত্রি জাগরণের অবসাদের ময়লা ছাপ। মাথার চুলে নাপিতের কাঁচি পড়েনি অনেকদিন। তার জামার বুকের বোতাম খোলা, গ্রীষ্মকালে সে গেঞ্জি পরে না, দেখা যাচ্ছে তার পাঁজরার হাড়। সারা বছরের ফাঁকিবাজ অতীন ঠিক পরীক্ষার আগের দেড় মাস পাগলের মতন পড়াশুনো করে স্বাস্থ্য ক্ষয় করেছে।

সিদ্ধার্থ তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুই কি এখন বাড়ি ফিরে যাবি নাকি?

অতীন বললো, নাঃ! চল, খেলা দেখতে যাই, মোহনবাগান-মহামেডান স্পোর্টিং-এর খেল আছে।

সিদ্ধার্থ বললো, ধ্যাৎ, সে খেলা এতক্ষণে আদ্ধেক হয়ে গেছে। তাছাড়া টিকিট পাবি কী করে! চল, সিনেমা দেখতে যাই, মেট্রোতে লরেন্স অলিভিয়ারের ‘হ্যামলেট’ এসেছে।

–সোর্ড ফাইটিং আছে?

–কী জানি, গল্পটা আমি জানি না, আমার দাদা বলেছে খুব ভালো ছবি।

–তোর দাদা বলেছে, ভালো? তা হলে আমার ভালো লাগবে না। তোর দাদা তো হেভি ইনটেলেকচুয়াল! বড় বড় রাইটারদের গল্প নিয়ে সিনেমা খুব বোরিং হয়। নিউ এমপায়ারে গ্যারি কুপারের কী একটা ওয়েস্টার্ন এসেছে না? চল, সেটা দেখি!

–আমি গ্যারি কুপারের উচ্চারণ বুঝতে পারি না রে, অতীন!

পেছন থেকে কৌশিক এসে অতীনের কাঁধে হাত রেখে বললো, এই, সিনেমা দেখতে যাবি? আমি দেখাবো?

–কোনটায় যাচ্ছিস।

–হ্যামলেট! অনেকদিন পর লরেন্স অলিভিয়ারের ছবিটা আবার এসেছে।

অতীন বললো, হ্যামলেটের দেখছি হেভি ডিমান্ড! তুই গল্পটা জানিস।

কৌশিক বললো, টু বী অর নট টু বী, দ্যাট ইজ দা কোয়েশ্চেন? এটা শুনিসনি কখনো আগে? কিংবা, দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ, হোরেশিও, দ্যান আর ড্রেট অফ ইন ইয়োর ফিলসফি…।

অতীন কৌশিকের থুতনিটা ধরে বললো, মান্তু, মান্তু! তুই আর্টস পড়লি না কেন রে?

ওরা রাস্তা পার হয়ে বিপরীত দিকে এলো এবং চলন্ত ট্রামের পাশ দিয়ে ছুটতে লাগলো, সিদ্ধার্থ জিজ্ঞেস করলো, কোন ক্লাসে উঠবো? অতীন বললো, সেকেন্ড ক্লাস!

একটু দূরেই ট্রাম স্টপ, তবু ওরা লাফিয়ে লাফিয়ে চলন্ত ট্রামে উঠে পড়লো।

মেট্রো সিনেমার পেছনের দিকের রাস্তাটার ডাক নাম মেট্রো গলি। ফ্রন্ট স্টলের সবচেয়ে কম দামি টিকিটের জন্য এখানে লাইন পড়ে। কিছুকাল আগেও এই টিকিটের দাম ছিল সাড়ে ছ’ আনা, তারপর হলো দশ আনা। নয়া পয়সার আমলে দু এক বছরের মধ্যেই বেড়ে গিয়ে হয়েছে এক টাকা কুড়ি পয়সা। আজ এই লাইনে বেশ ভিড়। বৃষ্টির মধ্যেও এত লোক জুটেছে।

অন্যরা লাইনে দাঁড়ালো, অতীন সামনের তেলেভাজার দোকানটা থেকে আট আনার আলুর বড়া কিনলো! তার দারুণ খিদে পেয়েছে। কৌশিক টিকিট কাটার পয়সা দেবে, সুতরাং অতীনের আট আনা খরচ করতে কোনো অসুবিধে নেই। এরকম সুস্বাদু আলুর বড়া সারা পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যায় না। এত ছোট ছোট আলু এরা কোথা থেকে জোগাড় করে?

শাল পাতার ঠোঙাটা নিয়ে অতীন ফিরে এলো বন্ধুদের কাছে। কাউন্টার খুলে গেছে, ময়াল সাপের মতন লাইনটা আস্তে আস্তে এগোচ্ছে!

রবি বললো, এই মাইরি, যত টিকিট তার চেয়ে তোক বেশি। আমরা টিকিট পাবো না!

সিদ্ধার্থ জিজ্ঞেস করলো, তুই কী করে বুঝলি?

রবি বললো, আমি জানি, এই রেলিংটার পেছনে দাঁড়ালে আর কাউন্টার পর্যন্ত পৌঁছোনো যায় না। ঐ দ্যাখ, মনীশ, সুজয় ওরা আগে থেকে দাঁড়িয়েছে।

ওদের ব্যাচের অনেক ছেলেই এসেছে হ্যামলেট দেখতে। কয়েকজন অতীনের মুখ চেনা। সে হাত নেড়ে দু’একজনকে সম্বোধনও জানিয়েছে।

কৌশিক বললো, আমি দেখাবো বলেছি, চল, মেইন গেটে যাই, বেশি দামের টিকিট কাটবো!

অতীন কৌশিকের দিকে তাকিয়ে ভয়ংকর একটা মুখভঙ্গি করলো। তারপর দাঁত খিঁচিয়ে বললো, বাঞ্চোৎ, তোর বেশি বেশি পয়সা, তাই না? ইয়ে ফুট ফুট কুট কুট করছে? দ্যাখ, কী করে এখানে টিকিট ম্যানেজ করি!

অতীন প্যান্টের পকেট থেকে একটা নীল রুমাল বার করে গলায় বাঁধলো। অমনি তাকে দেখতে লাগলো বেলেঘাটার গুণ্ডাদের মতন। সে বললো, আমাদের আজ পরীক্ষা শেষ হয়েছে, আজ আমাদের সিনেমা দেখার ফাস্ট প্রেফারেন্স। এত ফালতু লোক ভিড় করেছে কেন?

অতীন সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই রবি বললো, ও শালা ঠিক ম্যানেজ করবে।

সিদ্ধার্থ বললো, অতীনটা একটা চিজ। শালা ভগবান একটার বেশি দুটো গড়েনি!

কৌশিক ভীতু ভীতু গলায় বললো, ও মারামারি করবে নাকি?

রবি বললো, দ্যাখ না কী হয়!

অতীন লাইনের একেবারে ডগায় পৌঁছে চেঁচিয়ে উঠলো, এ কী, এ কী, ডাবল লাইন কেন? এই যে দাদা, আপনি কোথায় ঢুকছেন? এ কী নেমন্তন্ন বাড়ি নাকি যে পরে এসেও আগে বসবে? আমরা কী ঘাসে মুখ দেবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি? সিঙ্গল লাইন, সিঙ্গল লাইন!

অতীনের রোগা চেহারা হলেও কণ্ঠস্বরটি জোরালো, আত্মপ্রত্যয়ে সুগোল। সে তার চেয়ে বড়সড়ো চেহারার দু’চারটি ছেলেকে জোর করে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলো।

একটু পরেই দেখা গেল কাউন্টারের সামনে শুরু হয়ে গেছে ঠ্যালাঠেলি, চিৎকার, হট্টগোল। তারপর চড়-চাপাটি, ঘুষোঘুষি, জুতো ছোঁড়াছুঁড়ি। অতীন কিন্তু সেই মারামারির মধ্যে নেই। সে পিছিয়ে বন্ধুদের কাছে এসে বললো, এবারে রা কর! সবাই মিলে একসঙ্গে হৈ হৈ করে সামনের দিকে এগো, ওদের হটিয়ে দে! সবাই এক সঙ্গে, ওয়ান, টু থ্রি…।

অতীনের পদ্ধতিটা কার্যকর হলো, ওরা চার বন্ধুই টিকিট পেয়ে জালের খাঁচায় ঢুকল।

অতীন কৌশিককে বললো, দেখলি, তোর কত পয়সা বাঁচিয়ে দিলুম!

কৌশিক বললো, আমার বেশি পয়সা খচা করতে আপত্তি ছিল না। এটা ভালো ছবি, ভালোভাবে দেখা যেত!

অতীন বললো, তোর সেই পয়সায় আমাদের আইসক্রিম খাওয়াবি!

সিদ্ধার্থ বললো, আইসক্রিম না, ইন্টারভ্যালে ম্যাটন প্যাটিজ খাবো। তুই আলুর বড়া খাইয়ে খিদেটা আরও বাড়িয়ে দিলিরে, অতীন!

রবি বললো, মাটন প্যাটিজ কী বলছিস, যা খিদে পেয়েছে, মনে হচ্ছে আমি এখন একটা আস্তো দোতলা বাড়ি খেয়ে ফেলতে পারি।

অতীন বলো, সিনেমাটা যদি খারাপ হয় তা হলে আমি কৌশিককেই খেয়ে ফেলবো!

কৌশিক চোখ বড় বড় করে বললো, তুই কী বলছিস, অতীন? শেক্সপীয়ারের বেস্ট লেখা, হ্যামলেট; অ্যাকটিং করছেন লরেন্স অলিভিয়ার, জিন সিম…।

অতীন অসীম বিরক্তির সঙ্গে বললো, সেক্সপীয়ার মারাচ্ছিস কেন রে তখন থেকে? জিজ্ঞেস করছি না, সিনেমাটা কেমন?

সিদ্ধার্থ বললো, আমি পোস্টার দেখলুম, সোর্ড ফাইটিং আছে!

কৌশিক তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে এমন একটা ভাব করলো যেন সে হঠাৎ অচেনা কোনো দেশে ঘোর অরণ্যের মধ্যে একলা এসে পড়েছে। তার মুখে অল্প অল্প দাড়ি, চোখে সোনালি ফ্রেমের গোল চশমা। অন্যরা প্যান্ট পরা, সে পরেছে ধুতি আর হাফ শার্ট। অন্যদের তুলনায় তার মুখে এখনও সারল্য বেশি, সে পৃথিবীটা কম চেনে, যেটুকু চেনে তাও বইয়ের পৃষ্ঠায়।

ফ্রন্ট স্টলে সীট নাম্বার নেই, কিছুক্ষণ সবাইকে খাঁচায় আটকে রাখার পর ছবি আরম্ভ হবার একটু আগে দরজা খুলে দেয়, সবাই হুড়মুড়িয়ে ছুটে ভালো জায়গা দখল করতে যায়। ফ্রন্ট স্টলে মেয়েদের তো টিকিট দেওয়াই হয় না, বুড়ো লোকরাও আসতে ভয় পায়।

কয়েকটি আগামী ছবির ট্রেইলার দেখাবার পর মূল ছবি শুরু হলো। রবি বললো, এই রে ভূতের গল্প নাকি? সিদ্ধার্থ বললো, হিস্টরিক্যাল, কস্টিউম দেখছিস না?

কৌশিক বললো, তুই কী রে, সিদ্ধার্থ? শেকীয়ার চারশো বছর আগে যা লিখেছেন তা সবই তো হিস্টোরিক্যাল হবে!

তৃতীয় দৃশ্যে ওফেলিয়াকে দেখা যেতেই অতীন তার জিভের তলায় দু’ আঙুল দিয়ে হু-ই-ই শব্দে প্রচণ্ড জোরে একটা সিটি দিল। যে-কোনো ইংরিজি ছবিতে সুন্দরী নায়িকার আবির্ভাব সে এইভাবে অভ্যর্থনা জানায়। তার ধ্বনি শুনে কাছাকাছি আরও কয়েকজন সিটি দিয়ে উঠলো।

কৌশিক কাতরভাবে অতীনের একটা হাত চেপে ধরে বললো, ওরকম করিস না, প্লীজ। মন দিয়ে ডায়ালগগুলো শোন, তোর ভালো লাগবে!

অতীন বললো, ধুস! ডায়ালগ কে শোনে। আই লাভ অ্যাকশান! ডুয়েল…

–একটু ধৈর্য ধর, অনেক অ্যাকশান আছে।

খানিক বাদে বিরতির আলো জ্বলে উঠতেই রবি উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালো। এই সময়ে উঁচু ক্লাসের দর্শকদের মধ্য থেকে ভালো ভালো মেয়েদের দেখে নিতে হয়। চোখ বুলিয়ে নিয়ে রবি বললো, চল, সিগারেট খেয়ে আসি।

সে কৌশিকের হাত ধরে টানতেই কৌশিক বললো, আমি সিগারেট খাই না।

–আজকে একটা খাবি চল।

–না, আমি সিগারেট খাবো না। তুই যা না!

সে কৌশিকের হাত ধরে টানাটানি করতে অতীন বাধা দিয়ে বললো, এই ওকে জোর করিস না। এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে!

অতীন নিজেও সিগারেট খেতে গেল না দেখে কৌশিক অবাক হলো। তার ধারণা সব ব্যাপারেই অতীন তার সব বন্ধুদের গুরু।

অতীন ঘেঁকে বললো, এই রবি, বাদাম কিনে আনিস! তারপর সে কৌশিকের দিকে ফিরে চোখ পাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, হ্যাঁরে হ্যাঁরে, তুই নাকি কাল, সাদাকে বলেছিলি লাল?

কৌশিক বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, অ্যাঁ? কী? আমি কী বলেছি?

অতীন একই ভঙ্গিতে আবার বললো, আর, তোদের পাড়ার বেড়ালগুলো, শুনছি নাকি বেজায় হুলো?

পাশ থেকে সিদ্ধার্থ হেসে উঠলো হো হো করে। কৌশিকের মুখখানা ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেছে।

অতীন কৌশিকের জুলপি ধরে টেনে বললো, শালা, তুই তখন থেকে আমাদের ইংরিজির জ্ঞান দিচ্ছিস, বাংলা কিছু জানিস না?আকৌশিক বললো, ছাড়, লাগছে! আমরা তো জামসেদপুরে থাকতুম, তাই বেশি বাংলা বই পড়িনি!

–তোদের জামসেদপুরে বুঝি শেক্সপীয়ারের চাষ হয়? ওটা শিখলি কী করে?

–তোর মেজাজটা আজ এত খারাপ কেন রে, অতীন? পরীক্ষা খারাপ হয়েছে?

–আমি কোনোদিন পরীক্ষা খারাপ দিই না।

–তোদের হ্যামলেটের গল্পটা সংক্ষেপে বলে দেবো, তা হলে বুঝতে সুবিধে হবে। অতীন বিচিত্রভাবে হাসলো। তারপর আবৃত্তি করলো, ‘সো টেল হিম উইথ দা অকারেন্টস, মোর অ্যান্ড লেস, হুইচ হ্যাভ সলিসিটেড।’

বুকে দুটো হাত রেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে এরপর ‘দা রেস্ট ইজ সাইলেন্স’ উচ্চারণ করেই সে মৃত্যুর ভান করে ঢলে পড়লো।

কৌশিক স্তম্ভিতভাবে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। সে এখনো যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।

–তুই জানিস? তুই পড়েছিস?

অতীন উদাসীনভাবে বললো, না, পড়িনি, শুনে শুনে শিখেছি। আমার দাদা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়তো! শেষ পর্যন্ত খুনোখুনি করে সবাই মরে যাবে, আমার এরকম গপ্পো ভালো লাগে না। সিদ্ধার্থ বললো, তুই শালা জেনেশুনে এতক্ষণ মাজাকি করছিলি আমাদের সঙ্গে?

অতীন তাকে এক ধমক দিয়ে বললো, চুপ বে! তারপর সে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো, তুই একটা জিনিস নিবি?

–কী?

–হাতটা দে। কৌশিকের ডান হাতের পাঞ্জাটা নিয়ে বাচ্চাদের কান্না থামাবার জন্য মা-ঠাকুমারা যেমন দুধ দেবো, ভাত দেবো, নাড়ু দেবো বলেন, সেইভাবে কাল্পনিক কিছু দিল তিনবার। তারপর বললো, নে, এবারে হাত মুঠো কর। তোকে দিয়ে দিলাম।

–কী দিচ্ছিস কী, অতীন?

–আমার থেকে ভালো রেজাল্ট। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট আমি হবো না, তুই হতে পারিস, যদি দীপংকর তোকে বীট না করে। তুই আমার থেকে পাঁচ-ছ নম্বর বেশি পেয়ে যাবি।

–অতীন, তুই জানিস, তোর সঙ্গে আমার কোনো কমপিটিশান নেই! আমি বলছি, আমার থেকে তুই ভালো রেজাল্ট করবি।

–বলছি তো, তুই আমার থেকে পাঁচ-ছ নম্বর বেশি পাবি। আমি লাস্ট কোয়েশ্চেনটা শেষ করতে পারিনি। কেন জানিস, আমার কলমটার জন্য। মাঝে মাঝে কালি বেরুচ্ছিল না, লিখতে দেরি হয়ে গেল!

কৌশিক ভুরু কপালে তুলে বললো, কলমের জন্য? আমার কাছে তিন তিনটে কলম, তুই। চাইলি না কেন?

সিদ্ধার্থ বললো, আমার কাছেও স্পেয়ারেবল কলম ছিল!

অতীন চুপ করে গিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো।

–তুই কলম চাইলি না কেন, অতীন?

–কলমটা আমাকে একটা মেয়ে দিয়েছে। সে রিকোয়েস্ট করেছিল যেন তার কলমেই আমি পরীক্ষা দিই!

–তুই এত সেন্টিমেন্টাল? একটা মেয়ে তোকে একটা বাজে কলম দিয়েছে বলে তুই পরীক্ষা খারাপ করবি?

–আসলে ঠিক তা নয়। তোদের কাছ থেকে কলম চাইবার কথা আমার মনেই পড়ে নি! এমন রাগ হচ্ছিল মেয়েটার ওপর!

সিদ্ধার্থ বললো, অতীনটা মাইরি একেবারে পিকিউলিয়ার! মেয়েটা কে রে? আমি দেখেছি?

সঙ্গে সঙ্গে মুড় পাল্টে অতীন বললো, হ্যাঁ, দেখবি না কেন? তোর নিজের মাসি রে, ঐ শম্পা–

সিদ্ধার্থ বললো, ভ্যাট, গুল মারবার আর জায়গা পাসনি? আমার মাসি তোর থেকে পাঁচ বছরের বড়।

অতীন আপন মনে হাসতে লাগলো।

রবি ফিরে এলো দু ঠোঙা বাদাম ভাজা নিয়ে। ফিস ফিস করে বললো, বাইরে গোলমাল হচ্ছে। কটা ছেলে এসে বলছে, তাদের জোর করে লাইন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, তার দেখে নেবে! অতীন, তোকে ওরা চিনে রাখেনি তো?

অতীন অবজ্ঞার সঙ্গে বললো, চিনে রাখলেও বয়ে গেল। আমার গায়ে হাত দেবার সাহস করবে, এমন কোন শুয়ারের বাচ্চা আছে, দেখবো!

সিদ্ধার্থ বললো, আমাদের কেমিস্ট্রির অনেক ছেলে আছে এখানে। দরকার হলে সবাইকে ডাকবো।

এরপর সিনেমা শুরু হতে সবাই চুপ হয়ে গেল।

শেষ দৃশ্যে লিয়ারটিস ও হ্যামলেটের দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় রবি হঠাৎ উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করলো, কে হারবে?

কৌশিক বললো, দু’জনেই।

অতীন আবার বললো, দা রেস্ট ইজ সাইলেন্স!

হল ছেড়ে বেরুবার মুখে সিদ্ধার্থ বললো, ভালো ছবি, তবে আজকের দিনে এরকম একটা দুঃখের ছবি কোনো মানে হয় না। কৌশিকটার জন্যই তো। এর চেয়ে নিউ এম্পায়ারের ছবিটা…

কৌশিকের চোখ ছলছল করছে এখনো। মধ্যে কয়েকবার সে রুমাল ব্যবহার করেছে। সে বললো, ট্রাজেডি হলেও মহৎ ট্রাজেডি দেখলে আপনি মনটা ভালো হয়ে যায়।

রবি বললো, তুই ফ্যাঁচ ক্যাঁচ করে কাঁদছিলিস শেষ দিকটায়!

–কান্নাতে তো মনটা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়। আমার ভালো লাগে।

অতীন চুপ করে হাঁটছিল, এক সময় সে কৌশিকের কাঁধে হাত রেখে বললো, তুই যে বললি, দু’জনেই হেরে গেছে, তুই ভুল বলেছিস। আসলে জিতেছে হ্যামলেট। কেউ কেউ মরে গিয়েও জিতে যায়।

যারা টিকিট পায়নি, সেই বিক্ষুব্ধ ছেলেরা কেউ নেই বাইরে, আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করার ধৈর্য থাকে না তাদের।

রবি বললো, এখন কী করবি, বাড়ি যাবি? মোটে সাড়ে আটটা বাজে।

সিদ্ধার্থ বললো, মোটে কী রে? আর বেশি দেরি হলে বকুনি খাবো।

রবি বললো, বড্ড খিদে পেয়েছে কৌশিক, তোর তো অনেক পয়সা বেঁচে গেল, অনাদির মোগলাই পরোটা খাওয়াবি?

কৌশিক মাথা নাড়লো। কিন্তু সিদ্ধার্থ আর থাকতে পারবে না। সে দৌড়ে উঠে পড়লো একটা দোতলা বাসে।

বৃষ্টি এখনো থামেনি, ছিপ ছিপ শব্দ হচ্ছে রাস্তায়। প্রায় বর্ষা এসে গেল। কিন্তু চৌরঙ্গি জনবিরল নয়। অনেকে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। রাত্তিরের দিকে এ পাড়ায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নারী-পুরুষ অনেক চোখে পড়ে। দু’একটি সুন্দরী রমণী সম্পর্কে মন্তব্য করতে করতে ওরা এসে ঢুকলো রেস্তোরাঁয়।

খাবারের অর্ডার দেবার পর রবি জিজ্ঞেস করলো, কাল কী করা হবে?

কৌশিক বললো, তোরা আমাদের বাড়িতে চলে আয়।

কৌশিকদের বাড়িটা বড়, তার আলাদা ঘর, সঙ্গে মস্ত বারান্দা। কৌশিকদের বাড়িতেই আড্ডা মারার সুবিধে।।

রবি বললো, পরীক্ষার পর কত কী করবো ভেবেছিলাম, এখন একটাও মনে পড়ছে না।

কৌশিক বললো, কোথাও বাইরে বেড়াতে গেলে হয়, মধুপুরে আমাদের একটা বাড়ি আছে, যাবি?

রবি বললো, গেলে হয়! এই অতীন, তুই চুপ করে আছিস কেন? চল, মধুপুরে যাই।

অতীন বললো, আমি এখন বলতে পারছি না। আমার টিউশানি আছে না?

কৌশিক বললো, পরীক্ষা খারাপ হয়েছে বলে তোর এখনো মন খারাপ লাগছে?

অতীন ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো, কে বললো, পরীক্ষা খারাপ হয়েছে? ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া নিয়ে কথা, কেউ আটকাতে পারবে না। পরীক্ষা চুকে গেছে, খবদার আমার সামনে আর ও কথা উচ্চারণ করবি না!

রবি বললো, বাপ রে! বাবুর মেজাজ বোঝা শক্ত! তুই এম এস সি পড়বি না অন্য লাইনে যাবি?

–কিছু ঠিক নেই!

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বেরুবার পর অতীনের ইচ্ছে ছিল আরও খানিকটা ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু এবারে কৌশিক আর রবিও রাজি নয়। পরীক্ষা হয়ে গেলেও দশটার পর বাড়ি ফেরা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া বৃষ্টি পড়ছে, এর মধ্যে কোথাই বা ঘোরা যাবে।

একই বাসে চেপে অতীনই আগে নামলো কালীঘাটে। এখন বৃষ্টি বেশ জোরে জোরে পড়ছে তবু সে হাঁটতে লাগলো আস্তে আস্তে। তার মুখখানা বিষণ্ণ। আজ পরীক্ষা দিতে দিতে সর্বক্ষণ মনে পড়ছিল তার দাদার কথা। দাদা বি এস-সি পরীক্ষা দিতে পারেনি।

বেছে বেছে এমন একটা সিনেমায় যাওয়া হলো, সেখানেও নতুন করে দাদার কথাই মনে পড়তে লাগলো। হ্যামলেটের চরিত্রের সঙ্গে তার দাদার যেন দারুণ মিল। এমনকি লরেন্স অলিভিয়ের-এর মুখোনিও যেন ঠিক তার দাদার মতন।

দূর থেকে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, তবু অতীনের বাড়ি ফিরতে হচ্ছে করছে না। প্রায় দিনই এরকম হয়। সপ্তাহে তিন দিন সে টিউশানি সেরে বাড়ি ফেরে রাত ন’টার পর। কাছাকাছি এসে তার আর পা চলতে চায় না। বাড়িতে ঢুকলেই তার কাঁধে যেন একটা বোঝা চেপে বসে।

সিনেমা হল থেকে বেরুবার সময় সে কৌশিককে যা বলেছিল, সেটাই অতীন এখন মনে মনে আবার বললো, কেউ কেউ মরে গেলেও জিতে যায়।

তার সঙ্গে সে এখন যোগ করলো, যেমন আমার দাদা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *