২ জুলাই, শুক্রবার ১৯৭১
গতকাল সন্ধ্যার পর ডাক্তাররা এসে পৌঁছেছেন। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছেন। পরশু দিন ট্রাঙ্কলে বলেছিলেন সকালেই রওয়ানা দেবেন। সে হিসেবে তাদের বিকেল তিনটে-চারটের মধ্যে এসে পৌঁছানোর কথা। দেরি দেখে আমরা সবাই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। বিশেষ করে খুকুর যা অবস্থা। দেরির কারণ সম্বন্ধে বললেন, পথে বহু জায়গায় পাক আর্মি গাড়ি থামিয়ে চেক করেছে। উনি রাওয়ালপিন্ডিতে মিটিং করতে যাচ্ছেন শুনে এবং করাচি থেকে আসা মিটিঙের চিঠি দেখে ওকে সব জায়গায় ছেড়ে দিয়েছে। গতকালই ওঁর কাছ থেকে রাজশাহীর কথা শুনতে খুব ইচ্ছে করছিল; কিন্তু সারাদিন ধরে পথের ধকলে ওদের সবার যা বিধ্বস্ত চেহারা হয়েছে–তাতে সে ইচ্ছে চেপে বললাম, আজ বিশ্রাম নিন। কাল সব শুনব।
আজ সারাদিন ডাক্তার ব্যস্ত ছিলেন, পি.জি হাসপাতালের ডিরেক্টর ডাঃ নূরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করা, প্লেনের টিকিট ও যাত্রার অন্যান্য ব্যবস্থা করার জন্য। সন্ধ্যার পর এসে বসলেন আমাদের বসার ঘরে। সঙ্গে সানু ডাক্তারের স্ত্রী।
ডাক্তার বললেন, আমরা তো প্রথমে ভেবেছিলাম ঢাকায় কিছু নেই। সব ভেঙেচুরে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মিসমার করে দিয়েছে। কোনদিক থেকে কোন খবর পাবার উপায় নেই। শুধু ইন্ডিয়ান রেডিও, বিবিসি, রেডিও অস্ট্রেলিয়া আর ভয়েস অব আমেরিকার খবর। তা সেসব খবর শুনে তো মাথা খারাপ। ঢাকার সঠিক খবর পেতে অনেকদিন লেগেছে।
রাজশাহী ফল করে কবে?
খুব সম্ভব তের কি চৌদ্দ এপ্রিল। ভোরবেলা নদীর ধার দিয়ে পাক আর্মি শহরে ঢুকে পড়ল। সেদিনের স্মৃতি ভয়াবহ। টাউনের চোদ্দ আনা লোক বোধহয় পালিয়েছে, বাকি দুআনা ঘরে দরজা-জানালা সেটে বসে ছিল। রাজশাহী টাউন সেদিন শ্মশানের মত দেখাচ্ছিল। পরে জেনেছি, পাক আর্মি পথের দুপাশে সব জ্বালাতে জ্বালাতে শহরে ঢুকেছিল। বহু লোক মরেছে তাদের গুলিতে। কদিনের মধ্যেই পাকবাহিনী রাজশাহী শহরের পুরো কন্ট্রোল নিয়ে নিল। আমাদের সবাইকে বলা হল, কাজে জয়েন করতে, হাসপাতাল চালু করতে। আমরা প্রাণ হাতে করে হাসপাতালে যাতায়াত করতে লাগলাম।
হাসপাতালে রুগী ছিল?
মাঝে কিছুদিন ছিল না। কিন্তু হাসপাতাল আবার চালু করার পর রুগী আসতে লাগল। খালি জখমের রুগী।
জখমের রুগী?
হ্যাঁ। সাধারণ কোন রুগী বহুদিন হাসপাতালে কেউ আনেনি, এনেছে গুলি খাওয়া, বেয়নেট খোচাননা, হাত পা উড়ে যাওয়া রুগী। আরো একরকম রুগী হাসপাতালে লোক আনত, তারা আমাদের জীবনে ব্যথা হয়ে আছে।
ডাক্তারের গলা ভারি হয়ে উঠল, আমরা সবাই নীরবে চেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ডাক্তার প্রায় আর্তনাদের মতো স্বরে বললেন, ধর্ষিতা মহিলা। অল্প বয়সী মেয়ে থেকে শুরু করে প্রৌঢ় মহিলা,, নানী, দাদী–কেউ রেহাই পান নি। অনেক বুড়ি মহিলা বাড়ি থেকে পালান নি, ভেবেছেন তাদের কিছু হবে না। অল্প বয়সী মেয়েদের সরিয়ে দিয়ে নিজেরা থেকেছেন, তাঁদেরও ছেড়ে দেয়নি পাকিস্তানি পাষণ্ডরা। এক মহিলা রুগীর কাছে শুনেছিলাম তিনি নামাজ পড়ছিলেন। সেই অবস্থায় তাঁকে টেনে রেপ করা হয়। আরেক মহিলা কোরান শরীফ পড়ছিলেন, শয়তানরা কোরান শরীফ টান দিয়ে ফেলে তাকে রেপ করে।
ডাক্তার থমথমে মুখে চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে রইলেন। আমরা খানিকক্ষণ স্তম্ভিত, বাকহারা হয়ে বসে থাকলাম।
খানিকক্ষণ পর ডাক্তার আপন মনেই বললেন, যদি আল্লার অস্তিত্ব থাকে, তবে এই শয়তানের চেলা পাকিস্তানিদের ধ্বংস অবধারিত। আর যদি এরা ধ্বংস না হয়, তাহলে আল্লার অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমাকে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে।