সকাল থেকে বিরামহীন বৃষ্টি। দুপুরে একটু থেমেছিল। বিকেলে আবার আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। আসমানী বৃষ্টি দেখছিল। দারোগাবাড়ির টানা বারান্দায় দাঁড়ালে চোখ অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। খোলা প্রান্তরে বৃষ্টি দেখতে অন্যরকম লাগে। সাদা একটা পর্দা যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে। বাতাস পেয়ে পর্দাটা কাঁপতে থাকে, একেবেঁকে যায়। বড় অদ্ভুত লাগে। শহরে বসে এই বৃষ্টি দেখা যায় না। দোতলা বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে রুনি ভিজছে। পা টিপে টিপে বাগানে নেমেছে। ফুল ছেড়ার চেষ্টা করছে। বেলি ফুল। সরফরাজ সাহেবের চোখে পড়লে প্ৰচণ্ড ধমক খাবে। ধমকের চেয়েও যেটা বড়–আবারো জ্বরজারি হবে। কয়েকদিন আগে মাত্র জ্বর থেকে উঠেছে। মেয়েটাকে শক্ত ধমক দেওয়া দরকার, ধমক দিতে ইচ্ছা করছে না। বাচ্চাদের শাসন করার সময় বাবা-মা দুজন থাকতে হয়। একজন শাসন করবে, আরেকজন আদর দিয়ে তা পুষিয়ে দেবে। এখানে আদরের কে আছে? শাহেদের কথা মনে করে আসমানীর চোখে পানি এসে পড়ার মতো হলো। সে নিজেকে সামলাল। কথায় কথায় চোখে পানি ফেলার মতো সময় এখন নয়। এর চেয়ে বরং বৃষ্টি দেখা ভালো। আচ্ছা বৃষ্টি যে চাদরের মতো পড়ে–এটা কোনো লেখকের লেখায় আসে নি কেন? সব লেখকই কি শহরবাসী? শাহেদের সঙ্গে দেখা হলে বৃষ্টির চাদরীরূপেব কথা বলতে হবে। সে এখন কোথায় আছে? যেখানে আছে সেখানে কি বৃষ্টি হচ্ছে? শাহেদ কি দেখছে? মনে হয় না। শাহেদের মধ্যে কাব্যভাব একেবারেই নেই। বর্ষা-বাদলার দিনে সে কাথামুড়ি দিয়ে ঘুমোতে পছন্দ করে। ঘুম ভাঙলে মাথা উঁচু করে বলে, এই একটু খিচুড়ি-টিচুড়ি করা যায় না? বেগুনভাজা দিয়ে খিচুড়ি হেভি জমতো। মানুষটার খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। খিচুড়ি জমবে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে, ভুনা গোশত দিয়ে। বেগুনভাজা দিয়ে খিচুড়ি আবার কী?
ভেতরের বাড়ি থেকে মোতালেব সাহেব ডাকলেন, আসমানী কোথায়? আসমানী!
আসমানীর বারান্দা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে রুনি ফুল চুরি করছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। এই দৃশ্যটা দেখতে বড় ভালো লাগছে। মেয়েটা ভালো দুষ্ট হয়েছে তো। আড়াল থেকে মেয়ের এই নতুন ধরনের দুষ্টমি দেখার সুযোগ তো আর সবসময় হবে না। তাছাড়া মোতালেব সাহেব কী জন্য ডাকছেন আসমানী জানে–গল্প করার জন্য। গল্প বলার সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। সান্ত্ৰনা দেবার ভঙ্গিতে পিঠে হাত দেবে। কী কুৎসিত স্বভাব! যতই দিন যাচ্ছে মানুষটার কদৰ্য স্বভাব ততই স্পষ্ট হচ্ছে। আর গল্পের বিষয়বস্তুও অদ্ভুত। সব গল্পই মিলিটারি-বিষয়ক। একই গল্প দুবার তিনবার করে বলছে। মিলিটাবিরা যে কত ভয়ঙ্কর তার বিশদ বর্ণনা। কোনো মানে হয়? মিলিটারি-বিষয়ক গল্প এখন শুনতেও অসহ্য লাগে।
আসমানী! আসমানী!
চাচা, আসছি।
আসছি বলেও আসমানী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মোতালেব সাহেবের কাছে এক মিনিট পরে গেলেই লাভ। এক মিনিটের জন্য হলেও তো যন্ত্রণা থেকে বাঁচা যাবে।
আসমানী ভেতরে ঢুকে দেখল, মোতালেব সাহেব গল্প করার জন্য ডাকেন। নি। অন্যকোনো ব্যাপারে। বাড়ির সবাই সরফরাজ সাহেবের শোবার ঘরে। সরফরাজী সাহেব ইজিচেয়ারে শুয়ে লম্বা নলের হুক্কা টানছেন। তিনি তামাক খেয়ে মজা পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। ইজিচেয়ারের হাতলে বড় কাপে এক কাপ চা। মোতালেব সাহেবের মুখ শুকনো। ঠিকমতো কথাও বলতে পারছেন না। শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়ির সবাই জড়ো হয়েছে। তাদের মুখও শুকিয়ে আছে। শুধু সরফরাজ সাহেব বেশ স্বাভাবিক। হুক্কা টানা বন্ধ করে তিনি এখন চায়ের কাপ হাতে নিলেন। নির্বিকার ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। প্রতিবারই চায়ে চুমুক দেবার পর জিভ বের করে নাড়াচাড়া করছেন। মনে হচ্ছে চা খুব গরম।
সবাইকে ডেকে মিটিং কেন হচ্ছে আসমানী বুঝতে পারল না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছা করছে না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
মোতালেব সাহেব বললেন, বাবা, এই বিষয়ে আপনার মতামত কী? সরফরাজ সাহেব চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, উড়া কথায় কান দেয়া ঠিক না। মিলিটারি ঘরে ঘরে ঢুকে মেয়েছেলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে–এটা একটা উদ্ভট কথা। গুজবে কান দিবা না। পাকিস্তানি মিলিটারি বিশ্বে নামকরা মিলিটারি। ভদ্রলোকের ছেলেপুলেরা সেই মিলিটারিতে যায়। তাদের আদবকায়দাও বিশ্বের নামকরা। এইটা তোমরা ভুলে যাও কেন?
মোতালেব সাহেব বললেন, এইটা আপনি অবশ্যিই ঠিক বলেছেন বাবা। আমি এই দিকে চিন্তা করি নাই।
সরফরাজ সাহেব বললেন, আরো কথা আছে। এইটা হলো দারোগাবাড়ি। এই বাড়ির একটা আলাদা ইজ্জত আছে। যাকে যতটুকু ইজ্জত দেয়া দরকার, মিলিটারি তাকে ততটুকু ইজ্জত দেয়। এই শিক্ষা তাদের আছে।
মোতালেব সাহেব বললেন, এই কথাটাও আপনি ঠিক বলেছেন। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আপাতত বাদ দিই।
অবশ্যই বাদ দিবা। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে যাইবা কই? আমরা তো যার-তার বাড়িতে উঠতে পারি না।
মোতালেব সাহেব তৎক্ষণাৎ বললেন, সেটাও একটা বিবেচনার বিষয়। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে একদল মানুষ নিয়ে কার বাড়িতে উঠব?
সরফরাজ সাহেব চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, গুজবের ওপর ভরসা করবা না। ভরসা করবা আল্লাহপাকের ওপর। আয়াতুল কুরসি পড়ে বাড়ি বন্ধন দিয়ে বসে থাকো, ইনশাল্লাহ কিছু হবে না।
মোতালেব সাহেব বললেন, সত্যি সত্যি যদি মিলিটারি আসে, এসে যদি দেখে দারোগাবাড়ির লোকজন পালিয়ে গেছে তাহলে তারা ধরেই নিবেদারোগাবাড়ির লোকদের মধ্যে কিন্তু আছে।
সরফরাজ সাহেব বললেন, কিন্তু তো আছেই। তুমি সবচে বড় কিন্তু। প্যাচাল শেষ করে। সকালবেলা এই প্যাচাল শুনতে ভালো লাগে না! অন্য ঘরে নিয়া মিটিং বসাও।
মিলিটারি-বিষয়ক খবর যে নিয়ে এসেছে, তার নাম কুদ্দুস। লুঙ্গিপরা গেঞ্জি গায়ের একজন মানুষ। মাথা নিচু করে সে মেঝেতে বসে আছে। এই শ্রেণীর মানুষদের কথার ওপর ভদ্রলোকেরা এমনিতেই বিশ্বাস করেন না। মোতালেব সাহেব কুদ্দুসের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে কুদ্দুস, তুমি যাও। অবস্থা তেমন দেখলে তোমাকে খবর দিব।
কুদ্দুস নড়ল না। শক্ত গলায় বলল, খবর দেওনের সময় পাইবেন না। যা বলতেছি শুনেন। এক্ষণ বাড়ি ছাড়েন। মিলিটারি অপেক্ষা করতেছে বৃষ্টি কমনের জন্য। বৃষ্টি কমব আর এরা দলে দলে বাইর হইব। পরথমে আসব দারোগাবাড়ি।
মোতালেব সাহেব বললেন, এত নিশ্চিন্ত হয়ে বলছি কী করে? মিলিটারিরা কি তোমার সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছে?
কুদ্দুস ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, হ, করছে। আপনারে যা করতে বলছি করেন। হাতে সময় নাই। সময় খুবই সংক্ষেপ।
প্রথমে দারোগাবাড়ি আসবে কেন?
মিলিটারির সাথে আছে মজিদ মিয়া, দারোগাবাড়ির সাথে তার পুরানা বিবাদ।
মোতালেব সাহেব বললেন, দারোগাবাড়ির সাথে তার বিবাদ থাকতে পারে, মিলিটারির সঙ্গে তো দারোগাবাড়ির কোনো বিবাদ নাই।
হাত জোড় করতেছি, আমার কথাটা শোনেন।
মোতালেব সাহেব বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে কুদ্দুস, তুমি এখন যাও। আমরা এইখানেই থাকব। বাড়ি-ঘর ছেড়ে যাওয়া ঠিক না। এতে মিলিটারির সন্দেহ আরো বাড়ে। মিলিটারিরা যুদ্ধের সময় খুবই সন্দেহপ্রবণ থাকে।
চাচামিয়া, আমার কথাটা শোনেন।
তোমার কথা তো মন দিয়েই শুনলাম। এখন আমাদের নিজের বুদ্ধি বিবেচনা মতো কাজ করতে দাও। তোমার বিবেচনায় কাজ করলে তো আমাদের পোষাবে না।
কুদ্দুস উঠে চলে গেল। জাহেদা বললেন, আমার তো ভালো লাগছে না, ওর কথা শুনলেই হতো।
মোতালেব সাহেব বললেন, এত গুজব শুনলে বাঁচা যাবে না। তুমি বরং মিলিটারির জন্যে চা-নাশতার আয়োজন কর। মুরগির কোরমা আর পরোটা। এরা পরোটা-মাংসের ভক্ত।
জাহেদা পরোটা মাংসের ব্যবস্থা করতে গেলেন।
বৃষ্টি সন্ধ্যার আগে আগে ধরে গেল। এবং আশ্চর্য কাণ্ড, সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় দারোগাবাড়িতে একদল মিলিটারি এলো। তাদের সঙ্গে আছে হোমিওপ্যাথ মজিদ ডাক্তার। কুদ্দুস এই মজিদ ডাক্তারের কথাই বলছিল। সরফরাজী সাহেব পাঞ্জাবি গায়ে বের হয়ে এলেন। মজিদ ডাক্তার ছুটে এসে কদমবুসি করল।
সরফরাজ বললেন, ব্যাপার কী মজিদ?
ইনারা আপনারে দুই একটা কথা জিজ্ঞেস করবে।
তুমি এদের সাথে কেন?
পথঘাট চিনে না। আমারে বলল পথ চিনায়ে দাও। মিলিটারি মানুষ কিছু বললে তো না করতে পারি না। এরা না শোনার জাত না।
তুমি পথ চিনাচ্ছি? খুবই ভালো কথা।
মিলিটারি দলের প্রধান অল্পবয়স্ক একজন ক্যাপ্টেন। সরফরাজ সাহেব খুব আদবের সঙ্গে ক্যাপ্টেন সাহেবকে বসতে বললেন। ক্যাপ্টেন আদবের ধার দিয়েও গেল না, কঠিন গলায় বলল, কেয়া তুমি আওয়ামী লীগ?
সরফরাজ সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, তিনি প্ৰায় নব্বই বছরের এক বৃদ্ধ। আর সেদিনের চেংড়া ছেলে তাকে তুমি করে বলছে। তিনি তার মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করলেন, বিনয়ের সঙ্গে বললেন, জি নেহি, মুসলিম লীগ।
তুম মুসলমান?
জি হ্যাঁ।
তোমকো দাড়ি কাঁহা?
সরফরাজ সাহেব এই পর্যায়ে একটা বোকামি করলেন। তিনি নিখুঁত উর্দুতে যা বললেন, তার সরল বাংলা হলো তুমিও তো মুসলমান, তোমার দাড়ি কোথায়? যার নিজের দাড়ি নেই সে অন্যের দাড়ির খোঁজ কেন নেবে?
এত বড় বেয়াদবি মিলিটারির সহ্য হবার কথা না। ক্যাপ্টেন সাহেবের ইশারায় একজন জোয়ান এসে বুটের লাথি বসাল, সরফরাজ সাহেব গড়িয়ে বারান্দা থেকে বাগানে পড়ে গেলেন। তার গলা থেকে কোনোরকম শব্দ বের হলো না।
মোতালেব এবং সরফরাজ সাহেব ছাড়াও বাড়িতে আরো তিনজন পুরুষ মানুষ ছিল। তারা লুকিয়ে পড়েছিল। এই পর্যায়ে তারা বের হয়ে এলো। মিলিটারি সরফরাজ সাহেবকে বাদ দিয়ে বাকি সবাইকে ধরে নিয়ে গেল।
সেই রাতেই তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হলো। সরফরাজ সাহেব মারা গেলেন ভোরবেলায় রক্তবমি করতে করতে।