1 of 3

২৯. বিশাখা

॥ ২৯ ॥

বিশাখা ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, আর বলবি?

চড় খেয়ে কৃষ্ণকান্ত হতভম্ব হয়ে গেছে। ছোড়দির সঙ্গে তার সারাদিন নানা কারণে বহুবার ঝগড়া হয় বটে, কিন্তু মারে না কখনো। তার গাল জ্বালা করছিল। এমন সাঁটানো চড় সে বহুকাল খায়নি। তাকে কেউ মারে না।

কৃষ্ণকান্ত অবাক গলায় বলে, মারলি?

বিশাখা রাঙা মুখে বলে, একশবার মারব। মেরে মুখ ভেঙে দেবো।

ছোড়দির এরকম চেহারা কখনো দেখেনি কৃষ্ণকান্ত। রূপসী রাজকন্যার ভিতর থেকে যেন এক বিষধর বেরিয়ে এসে ফণা তুলেছে। বাস্তবিক ঠিক এই উপমাটিই তার মনে পড়ল। এসব অবস্থায় সাধারণত কৃষ্ণকান্ত প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আঁচড়ে, কামড়ে, ঘুষি মেরে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। ছোড়দিকে সে অবশ্য তেমন করে মারেনি কখনো। আজও মারল না। শুধু অবাক হয়ে চেয়ে রইল। এই ছোড়দি তার চেনা ছোড়দি নয়। এ এক অচেনা মেয়ে।

কৃষ্ণকান্ত কয়েক পা পিছিয়ে গেল। বলল, বাবাকে বলে দেবো?

বিশাখা হিংস্র মুখে বলল, যা বলগে যা।

কৃষ্ণকান্ত অবশ্য নালশেকুটি নয়। ছোড়দির এই রাগের কারণটাও তার জানা নেই। তবে কি “শচীরাণী” শব্দটার মধ্যেই কোনো গুপ্ত রহস্য আছে? ছোড়দির এত ঝাঁঝের অর্থ তার বয়ঃসন্ধির মাথায় ভাল ঢুকছিল না।

সিঁড়ির মুখটায় দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকান্ত বিশাখার চোখের দিকে চেয়ে বলল, তুই আমাকে মারলি কেন?

তুই ও কথা বললি কেন?

বললে কী হয়েছে? শচীনদার সঙ্গে তো তোর বিয়ে হবে।

কক্ষণো নয়।

হবেই। আমি শুনেছি।

হবে না। আমি বলছি।

হবে না? কৃষ্ণকান্ত খুব অবাক আর ব্যথিত হল। মনে মনে শচীনকে সে জামাইবাবু বলে স্থির করে ফেলেছে। ব্যাপারটা তার খারাপও লাগছে না। বড় দুই জামাইবাবুকে সে ভাল করে চেনে না। দেখাই হয় না তাদের সঙ্গে। কিন্তু শচীনদা তার চেনা লোক।

কৃষ্ণকান্ত বলল, বিয়ে কি ভেঙে গেছে?

ভেঙে যাবে।

যাঃ! শচীনদা দারুণ লোক।

সে তোরা তোদের ভাল লোক নিয়ে থাক। আমি বিয়ে করব না। বলে বিশাখা তার ঘরে চলে গেল।

সিঁড়ির মুখে কৃষ্ণকান্ত একটু ভাবিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। ছোড়দি বোকা। খুব বোকা। তবে কৃষ্ণকান্ত বোকা নয়। তার মনে কয়েকটা সম্ভাবনা উঁকি মারল। হয়তো শচীনদার বাবা অনেক পণ আর দানসামগ্রী চেয়েছে। কৃষ্ণকান্ত জানে, তাদের জমিদারীর অবস্থা খুব ভাল নয়। সম্পত্তি আছে বটে, কিন্তু নগদ টাকার খুব অভাব চলছে। সেই কারণে বিয়েটা ভেঙে যেতে পারেও বা। আর একটা হল, হয়তো শচীনদার কোনো খুঁতটুত বেরিয়েছে। কিংবা হয়তো কোষ্ঠীতে মেলেনি। কিছু একটা এরকমই হবে।

কৃষ্ণকান্ত ঘরে ঢুকল না। নীচের তলায় হেমকান্তর বৈঠকখানায় এসে ঢুকল। এখন হেমকান্ত নেই। এ সময়টায় উনি ঠাকুরঘরে গিয়ে আহ্নিক করেন। চুপচাপ তাঁর ডেক চেয়ারটায় বসে কষ্ণকান্ত তার গালে হাত বোলাতে লাগল। খুবই লেগেছে।

বসে থেকে সে অনেক কথা চিন্তা করতে লাগল। শশীদার ফাঁসি হবে। শচীনদা তাকে বাঁচাতে বরিশাল যাচ্ছে। লোকে বলছে, তার বাবাই শশীদাকে ধরিয়ে দিয়েছে। কথাটা কি ঠিক? ছোড়দি শচীনদাকে বিয়ে করতে চায় না কেন? পরশু কোকাবাবুর নাতি শরৎদা তাকে বলেছে, বন্দুক চালাতে শেখাবে। তাদের বাড়িতেও বন্দুক আছে, কিন্তু কেউ চালায় না। তাকে কেউ শেখাবেও না। শরৎদার কাছে শেখাই ভাল।

বন্দুক চালাতে শিখে কী করবে সে? পাখি মারবে, বাঘ মারবে, আর ইংরেজ।

কিন্তু বাবা বলে ইংরেজদের দোষ নেই। দোষ দেশবাসীর। আমরা দুর্বল বলেই ইংরেজ আমাদের ওপর প্রভুত্ব করছে। অকারণে ইংরেজ মারায় বাবার সায় নেই। তার স্কুলের বন্ধুরা বলে, বাবা ইংরেজের লোক। কথাটা কি ঠিক?

কৃষ্ণকান্ত আরামদায়ক ডেক চেয়ারটায় পা তুলে গুটিসুটি হয়ে বসেছিল। শ্রমক্লান্ত শরীরে ঘুমের ঢল নেমে এল আচমকা। ঘুমের মধ্যেই কে যেন—বোধহয় মনুপিসি নড়া ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে কয়েক গ্রাস ভাত খাইয়ে দেয়। তারপর নিয়ে বিছানায় শোয়। আর কিছু মনে থাকে না।

সকালে উঠেই সে গেল আস্তাবলে। ঘোড়াটায় জিন লাগানো ছিল না। শুধু লাগামটা পরিয়ে কৃষ্ণকান্ত তার পিঠে চেপে এক ছুটে চলে এল শচীনদের বাড়ি।

সামনের মাঠে দাঁড়িয়ে শচীন দাঁতন করছিল। তাকে দেখে বলল, কী রে?

কৃষ্ণকান্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে বলে, তোমার সঙ্গে ছোড়দির বিয়ে হবে না শচীনদা?

শচীন ম্লান একটু হেসে বলে, তোকে কে বলল?

ছোড়দি বলেছে।

বলেছে? তাহলে তো হয়েই গেল।

কেন বিয়ে হবে না বলো তো!

শচীন বলে, আমরা গরীব মানুষ বলেই বোধহয় তোর ছোড়দির পছন্দ নয়।

গরীব?

শচীন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, ওসব বাচ্চাদের শোনা উচিত নয়।

আমাকে ছোড়দি কাল মেরেছে ওকে শচীরাণী বলে ডেকেছিলাম, তাই।

শচীন আবার একটু হাসে, শচীরাণী মানে কী?

শচীনের বউ।

দূর পাগল! বিয়ের নামেই পাত্তা নেই।

তোমরা কি অনেক টাকা পণ চেয়েছো?

শচীন এবার একটু জোরে হাসে। মাথা নেড়ে বলে, তোকে নিয়ে পারা যায় না। যা একবার মাথায় ঢুকবে তা আর ছাড়তে চাস না।

বলো না।

না রে। পণ-টন চাইবার সুযোগই হয়নি। শুনছি ভাল জায়গা থেকে তোর ছোড়দির সম্বন্ধ এসেছে।

ভাল জায়গা?

কোকাবাবুর নাতি শরৎ। চিনিস তো!

কৃষ্ণকান্ত আরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। শরৎদা! শরৎদাকে তার যে খুব অপছন্দ তা নয়। বরং সে শরৎদার গুণে খুবই মুগ্ধ। পাঠানের মতো মস্ত চেহারা। হাতের টিপ দারুণ। শরৎদা খুব ভাল কুস্তি লড়তে পারে। তার সম্পর্কে নানা ধরনের দুঃসাহসিকতার গল্প ছেলেদের মুখে মুখে ফেরে। সেই শরৎদা ছোড়দিকে বিয়ে করবে কেন? ওরা জমিদার হিসেবেও অনেক বড়। তবে কথাটা শুনে কৃষ্ণকান্তর বুকটা লাফিয়ে উঠল আনন্দে।

সে বলল, শরৎদার সঙ্গে সম্বন্ধ এসেছে ঠিক জানো?

তাই তো শুনছি।

এঃ, শরৎদা কেন ছোড়দিকে বিয়ে করবে?

করলে তোর আপত্তি আছে?

শরৎদা তো কত বড়লোক। গায়ে কী জোর! শরৎদা রাজিই হবে না।

শচীনের মুখটা আরও গম্ভীর দেখাচ্ছিল। সে বলল, কে কাকে বিয়ে করবে কে জানে! ওসব ভেবে কী হবে?

খবরটা কৃষ্ণকান্তর কাছে নতুন এবং অবিশ্বাস্য। বিনা বাক্যব্যয়ে সে আবার তার ঘোড়ায় উঠল। এবার কোকাবাবুর বাড়ি।

শরৎ ভিতরের মহলে ছাদের ওপর পায়রা খাওয়াচ্ছে। গায়ে স্যাণ্ডো গেঞ্জী, পরনে ধুতি। বাবরি চুল। গলায় কার-এ বাঁধা ধুকধুকি। স্বাস্থ্য ফেটে পড়ছে।

কৃষ্ণকান্ত বিনা ভূমিকায় প্রশ্ন করে, শরৎদা, তুমি কি ছোড়দিকে বিয়ে করবে?

শরৎ আকাশ থেকে পড়ে, কাকে বিয়ে করব?

আমার ছোড়দিকে। চেনো না? বিশাখা।

শরৎ হাঁ করে তাকে কিছুক্ষণ দেখে বলে, বিশাখাকে বিয়ে করব তোকে কে বলল? শুনেছি। শচীনদা বলেছে।

কোন শচীনদা? উকিল?

হ্যাঁ। শচীনদার সঙ্গেই ছোড়দির বিয়ের কথা চলছিল।

শরতের গলা খুব গমগমে। অট্টহাস্য করলে বহু দূর থেকে শোনা যায়। সে সেই রকমই একটা হাসি দিয়ে বলে, তোর মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে।

বাঃ, আমাকে তো শচীনদা বলল।

তোর শচীনদারও মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

তাহলে কি বাজে কথা?

একদম বাজে কথা। আমি শীগগীরই বিলেত চলে যাচ্ছি।

বিলেত যাচ্ছো। বলোনি তো!

পড়তে যাচ্ছি। মাইনিং ইনজিনিয়ার হয়ে ফিরব।

সেটা কী?

খনিজ বিদ্যা। কয়লাখনির ইনজিনিয়ারিং। শক্ত কাজ।

পারবে?

দেখি তো গিয়ে। ওটা না পারলে অন্য কিছু পড়ব। আর কিছু না হলে আরমিতে ট্রেনিং নেবো। বিয়ে-ফিয়ে করবই না।

একদম না?

না। তোর ছোড়দির সঙ্গে শচীনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল?

হ্যাঁ। কিন্তু বিয়েটা হবে না।

তা আমার কথা কে বলল শচীনকে?

তা জানি না।

তোর ছোড়দিকে আমি দেখিইনি, না?

দেখেছো। আমার ছোড়দি দেখতে খুব সুন্দর।

শরৎ মৃদু মৃদু হেসে যাচ্ছিল। কিছু বলল না।

কৃষ্ণকান্ত একটু হতাশ হল। ছোড়দির সঙ্গে শরৎদারও যদি বিয়ে না হয় তবে কার সঙ্গে হবে? খুব দূরের অচেনা একজন এসে নিয়ে চলে যাবে একদিন ছোড়দিকে? কি রকম হবে সেটা?

শরৎ বলল, শচীন তোকে বাজে কথা বলেছে। সবাই জানে, আমি বিয়ে করব না।

কৃষ্ণকান্ত লোভাতুর চোখে শরতের বিরাট স্বাস্থ্যটা দেখছিল। সকালের রোদে ঝলমল করছে ডাকাতে চেহারাটা। এরকম একখানা শরীর হলে সবাইকে মেরে ঠাণ্ডা করে দেওয়া যায়।

শরৎ জিজ্ঞেস করল, শচীনের সঙ্গে তোর ছোড়দির বিয়ে হচ্ছে না কেন? পাত্র তো ভালই।

ছোড়দি ওকে বিয়ে করতে চায় না।

কেন রে? শচীনের দোষ কী?

কে জানে।

তবে ও কাকে বিয়ে করতে চায়? আমাকে? বলে খুব হেসে ওঠে শরৎ।

কৃষ্ণকান্ত লজ্জা পেয়ে বলে, না। ছোড়দি কাউকে বিয়ে করতে চায় না। তোমাদের বাড়ি থেকে নাকি সম্বন্ধ এসেছে।

বাজে কথা।

আমাকে বন্দুক চালাতে শেখাবে না?

এখনই তো চরে পাখি মারতে যাবো। যাবি?

যাবো। চলো।

বাড়িতে বলে এসেছিস?

বলতে হবে না। কেউ কিছু বলবে না।

পরে আমার দোষ হবে না তো!

না। কেউ কিছু বলবে না। চলো।

চল তাহলে।

শরতের সঙ্গে কৃষ্ণকান্ত বেরিয়ে পড়ল। শরৎদের সহিস ঘোড়াটা পৌঁছে দেবে তাদের বাড়িতে।

হেমকান্তর সঙ্গে নৌকোবিহার বা চরে বেড়ানো একরকম। শরতের সঙ্গে অন্য রকম।

হেমকান্ত এক স্থবির মহাবৃক্ষের মতো। তাঁর স্নিগ্ধ ছায়া আছে। আছে সুনিশ্চিত আশ্রয়। তাঁর শান্ত ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে যেন সমস্ত প্রকৃতিই হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ ও রূপময়। তিনি উড়ন্ত পাখিকে নিরাপদে চলে যেতে দেন। তিনি প্রকৃতির কোথাও কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করেন না।

কিন্তু শরং অন্যরকম। বন্য, দুরন্ত, টগবগে।

দুই নিপুণ মাঝি ছিপ নৌকোকে তীরের গতিতে চালিয়ে নিয়ে এল দূরবর্তী এক স্থায়ী চরে। এখানে জঙ্গল। নির্জনতা। পাখির ঝাঁক এসে পড়েছে। শরৎ নৌকো থেকে নেমেই বন্দুক চালাল।

সে কী শব্দ! কান চেপে মাটিতে বসে পড়ে কৃষ্ণকান্ত।

ভয় পেলি?

উঃ, কী শব্দ!

দূর বোকা। পুরুষ মানুষ কি শব্দকে ভয় পায়?

শরৎ তিনটে বন্দুক এনেছে। একনলা বন্দুকটা তাকে ধরিয়ে দিয়ে বলল, সাবধানে ধরে থাক। আমি দেখে আসি ক’টা পাখি পড়ল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুরে এল শরৎ । একটা মাথা ভাঙা পাখির রক্তাক্ত শরীর ঝুলছে তার হাতে। মুখে হাসি।

একটা। এই চরের পাখি সব পালিয়েছে। চল।

আবার ছিপ নৌকো চলল তীরের মতো।

শরৎ বলল, এবার তুই চালাবি বন্দুক।

পারব?

খুব পারবি। কিছু শক্ত কাজ নয়।

আশ্চর্য! কৃষ্ণকান্ত পারলও। দ্বিতীয় চরে তারা নামল না। ছোটো চর। বেলে হাঁসের ঝাঁক নেমেছে। একনলা বন্দুকটায় একটা ছররা গুলি ভরে শরৎ তার হাতে দিয়ে বলল, চালা। আমি ধরে থাকব! একটা ঝাঁকুনি লাগবে। একটুখানি। কাঁধটা শক্ত করে থাকিস। আরো ভাল হয় কুঁদোটা বগলে চেপে ধরলে।

প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে কৃষ্ণকান্ত টিপ করল। শরৎ ধরে রইল আলতো হাতে বন্দুকটা।

একটা বজ্রগর্জন চরের নির্জনতাকে টুকরো টুকরো করে ফেলল। হাত থেকে খসে গিয়েছিল বিশাল বন্দুক। শরৎ ধরে ফেলল। বলল, এই তো পেরে গেছিস।

পাখি মরেছে?

শরৎ হাসল, না মরলেই কি? প্রথমবারে মরে না। তবে এর পরে পারবি।

দুপুর পর্যন্ত কৃষ্ণকান্ত বহুবার বন্দুক চালাল। একটা পাখি মারলও সে। নিরীহ একটা ঘুঘু।

ফেরার সময় পাখিটা তার হাতে দিয়ে শরৎ বলল, বাড়ি নিয়ে যা। দেখে সবাই অবাক হয়ে যাবে।

উত্তেজনায় কৃষ্ণকান্ত তখন কাঁপছে।

বাড়ি ফিরতেই তুমুল হট্টরোল। বারবাড়িতে চেয়ার পেতে স্বয়ং হেমকান্ত বসা। সারি সারি কর্মচারীরা দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ার লোকজন, প্রজা, হর কমপাউনডার কে নেই! এমন কি একজন সেপাই অবধি। তাকে দেখেই সবাই চেঁচিয়ে উঠল, এসেছে! এসেছে! ফিরে এসেছে!

হেমকান্ত উঠতে গিয়েও টলে আবার বসে পড়লেন।

কেউ কিছু বলার আগেই মনুপিসি এসে তার হাত ধরে প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে গেল ঘরে।

কোথায় গিয়েছিলি?

পাখি শিকার করতে। শরৎদার সঙ্গে।

পাখি শিকারের বয়স তোর হয়েছে?

এই দেখ না, ঘুঘু মেরে এনেছি। নিজের হাতে।

শরৎকে পেলি কোথায়?

ওদের বাড়িতে।

ও ডাকল আর তুই চলে গেলি?

শরৎদা ডাকেনি তো! আমিই গিয়েছিলাম।

কাল রাতে তোকে বিশাখা মেরেছিল?

তোমাকে কে বলল?

বিশাখা সকাল থেকে কেঁদে কেঁদে ঘর ভাসিয়ে ফেলল তোর জন্য। কেবল বলছে, ও তোকে মেরেছিল বলেই তুই চলে গেছিস। আর ফিরবি না।

কৃষ্ণকান্ত মৃদু একটু হেসে বলল, আর বাবা?

বাবার কথা কি তুই ভাবিস?

খুব ভাবি।

তোর বাবা সকাল থেকে জলস্পর্শ করেননি। পরে সব শুনব। যা, স্নান করে আয়। ভাত খেয়ে একটু ঘুমো।

বাবা রাগ করেনি তো পিসি?

রঙ্গময়ী মাথা নেড়ে ধরা গলায় বলে, রাগ করার মতো অবস্থা ছিল নাকি কারো? তোর খোঁজই নেই সকাল থেকে। সকলেরই বুকে ধুকধুকুনি।

কেন, শরৎদাদের সহিস আমার ঘোড়া দিয়ে যায়নি?

না, তাহলে তো নিশ্চিন্ত হওয়া যেত।

কৃষ্ণকান্ত জামা কাপড় ছাড়তে ছাড়তে বলল, পিসি, দিদি কেন শচীনদাকে বিয়ে করতে চায় না বলো তো!

তা কে জানে!

শচীনদা বলল, ছোড়দির সঙ্গে নাকি শরৎদার বিয়ে হবে। কিন্তু শরৎদা তো বিয়েই করবে না।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, শরৎদা খনিজ বিদ্যা শিখতে বিলেত যাচ্ছে। তারপর সোলজার হবে।

রঙ্গময়ী চোখ কপালে তুলে বলে, তাই নাকি? তোকে বলল?

বলল। আমি তো শরৎদার কাছে সব শুনতে গিয়েছিলাম।

রঙ্গময়ী গালে হাত দিয়ে বলে, কী ছেলে রে বাবা! তা বিশাখার বিয়ে নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কেন?

ছোড়দি খুব দূরে কোথাও চলে যাবে না তো পিসি?

বিয়ে হলে দূরে যাওয়াই ভাল। বড় হলে বুঝবি।

না পিসি। ছোড়দির বিয়ে কাছাকাছিই দাও।

রঙ্গময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা, বিয়ের কথা পরে ভাবা যাবে। এখন স্নানে যা। তোর বাবা বসে আছেন।

স্নান করে এসে ভিতরের বারান্দায় বাবার পাশাপাশি খেতে বসার সময় একটু ভয় ভয় করছিল কৃষ্ণকান্তর। ঠিক বটে, বাবা তাকে কখনো শাসন করেন না। কিন্তু বাবার থমথমে মুখটাই শাসনের চেয়ে অনেক বেশী।

হেমকান্ত কোনো কথা জিজ্ঞেস করলেন না। নিঃশব্দে সামান্য একটু খেয়ে উঠে গেলেন।

কৃষ্ণকান্ত চোরচোখে লক্ষ্য করল।

রঙ্গময়ী বলল, খেয়ে উঠে যা, বাবার পায়ের কাছে বসে থাক একটু। লোকটা ছেলে ছেলে করে পাগল, আর ছেলে বাউণ্ডুলে তৈরি হচ্ছে একটা।

কৃষ্ণকান্ত খাওয়ার পর সসঙ্কোচে বাবার কাছে আসে। ঘরে ইজিচেয়ারে বসে আছেন হেমকান্ত। মুখখানা চিন্তিত, ভ্রুকুটিকুটিল।

পায়ের কাছে বসে কৃষ্ণকান্ত তার সরল সুন্দর মুখখানা তুলে ডাকল, বাবা।

হেমকান্তর একখানা হাত এগিয়ে এসে তার মাথা স্পর্শ করল। ভারী কোমল, ভারী স্নেহময় স্পর্শ।

অনেকক্ষণ বাদে হেমকান্ত বললেন, এই বংশের রক্তটা অন্যরকম, জানো?

কিরকম?

তোমার এক কাকা নিরুদ্দেশ, অন্য কাকার মৃত্যু হয়েছে অপঘাতে। তাই তোমার জন্য আমার খুব চিন্তা হয়।

আর এরকম হবে না।

যেখানেই যাও, বলে যেও। যতদিন আমি বেঁচে আছি, ততদিন।

আচ্ছা।

তারপর বিশাল পৃথিবী তোমাকে টেনে নেবে। কত দিকে কত কাজে ছড়িয়ে পড়বে তুমি। আমি তো তখন থাকব না।

কৃষ্ণকান্তর চোখ ফেটে জল আসছে। এর চেয়ে শাসন যে ভাল ছিল।

হেমকান্ত অনেকক্ষণ বাদে বললো, শরৎ কি তোমাকে বন্দুক চালাতে শেখাল?

হ্যাঁ বাবা। আজ আমি একটা ঘুঘু মেরেছি।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, শুনেছি।

আপনি খুশি হননি বাবা?

হয়েছি। তবে পাখি বড় নিরস্ত্র প্রাণী। ওদের মারায় কোনো বীরত্ব নেই। যাও, বিশাখা তোমার জন্য খুব কেঁদেছে আজ। ওর কাছে যাও।

ঘরে আসতেই বিশাখাকে দেখে কৃষ্ণকান্ত অবাক। কেঁদে কেঁদে মুখটা ফুলে রাবণের মা হয়েছে।

তাকে পেয়েই দুহাতে আঁকড়ে ধরল বিশাখা। তারপর ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকল।

অস্বস্তি বোধ করে কৃষ্ণকান্ত বলে, কাঁদছিস কেন?

তোর খুব লেগেছিল কাল?

আগে বল, শচীনদাকে বিয়ে করবি।

বিশাখা কান্না থামিয়ে চেয়ে রইল অবাক হয়ে। তারপর ফিক করে হেসে ফেলল হঠাৎ।

কৃষ্ণকান্ত বলল, শচীরানী! শচীরানী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *