1 of 2

২৯. নরেন্দ্র মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বরে যায় বটে

নরেন্দ্র মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বরে যায় বটে, আবার প্রায়ই তার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ভক্তি নয়, ঈশ্বরকে পাবার ব্যাকুলতা নয়, সে যায় শুধু ভালোবাসার টানে। তার প্রতি রামকৃষ্ণ ঠাকুরের যে তীব্র ভালোবাসা, বুক ভরা ব্যাকুলতা, সে যেন তার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। আবার এমন নিঃস্বাৰ্থ ভালোবাসাকে অস্বীকারও করা যায় না। ভালোবাসার জন্য মানুষ সব কিছু বিসর্জন দিতে পারে। সত্যি পারে? এমনকি বিশ্বাসও?

রামকৃষ্ণ ঠাকুরের সাহচর্যে নরেন্দ্ৰ স্নিগ্ধ মাধুর্য অনুভব করে। তাঁর ব্যক্তিত্বে অয়স্কান্তমণির আকর্ষণ আছে। রঙ্গরসিকতায় মেতে থাকতে থাকতে হঠাৎ হঠাৎ তিনি গভীর ভাবের দিকে চলে যান। তাঁর সঙ্গ ছেড়ে উঠে আসতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু যখন তাঁর ভক্তবৃন্দ বিভিন্ন ঠাকুর দেবতার নামে গদগদ হয়, যখন তিনি বলেন ঈশ্বর দর্শনই মনুষ্য জীবনের সার কথা, তখন নরেন্দ্রর বিশ্বাসে ঘা-লাগে, সে ফুসে ওঠে। সে ছাড়া রামকৃষ্ণ ঠাকুরের মুখের ওপর প্রতিবাদ করতে আর কেউ সাহস পায় না। রামকৃষ্ণ ঠাকুরও নরেন্দ্রর কথা শুনে রাগ করেন না, হেসে ওঠেন।

নরেন্দ্রর বন্ধু রাখাল একসময় নরেন্দ্রর সঙ্গে ব্ৰাহ্মসমাজে যেত, নিরাকার ব্ৰহ্ম ছাড়া আর কোনও ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস করবে না বলে শপথ নিয়েছিল, এখন সে সাকারবাদী হয়েছে। দিব্যি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কালীঠাকুরকে পুজো করতে যায়। নরেন্দ্র সে জন্য একদিন রাখালকে ধমকাতে গিয়েছিল। রামকৃষ্ণ ঠাকুর বললেন, তুই নিজে না মানিস না মানিস, ওকে বকিস কেন? ও বেচারি তোকে দেখলেই ভয়ে ভয়ে থাকে।

রামকৃষ্ণ ঠাকুর কোনও বিষয়েই নরেন্দ্ৰকে জোর করেন না। নরেন্দ্র তর্ক করুক, নাস্তিকতার বড়াই করুক, তাও ঠিক আছে, শুধু বেশিদিন নরেন্দ্রকে না দেখলে তিনি ছটফট করেন। নিজেই সিমলে পাড়ায় নরেন্দ্রর পড়ার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হন।

রামকৃষ্ণ ঠাকুরের দু একটি ব্যবহার নরেন্দ্রর পক্ষে খুবই অস্বস্তিজনক। কেউ মিছরি, পেস্তা বাদাম, কিসমিস দিয়ে গেলে তিনি বলবেন, ওরে নরেনকে দে, ও সব খাবে! একদিন নরেনের টঙে তিনি  নিজে কিছু মিষ্টি নিয়ে এসেছেন, তখন নরেনের আরও দু’জন বন্ধু সেখানে উপস্থিত। অগ্রাহ্য করে রামকৃষ্ণ ঠাকুর তাকে বললেন, তুই এগুলা খা, আমি দেখব! মহা মুশকিলের ব্যাপার। গ্রাম্য ঠাকুমা-দিদিমারা অন্যদের লুকিয়ে নিজের নাতিকে ভালো ভালো জিনিস খাওয়ান। কিন্তু শহরের ছেলেরা বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ না করে কিছু খায় নাকি!

আর হচ্ছে অতিশয়োক্তি। এক ঘর মানুষের মধ্যে রামকৃষ্ণ ঠাকুর নরেনের প্রশংসা করে তাকে একেবারে আকাশে তুলবেন। একদিন কেশব সেনের সঙ্গে তুলনা করায় নরেনের লজ্জায় মাথা কাটা যাবার জোগাড়।

রামকৃষ্ণ ঠাকুর ফস করে বলে বসলেন, কেশবের তুলনায় নরেনের অন্তরের শক্তি ষোলোগুণ বেশি! ছিছিছি, এমন কথা বলার কোনও মনে হয়? কোথায় বিশ্ববিখ্যাত, ধী সম্পন্ন, পরম শ্ৰদ্ধেয় কেশব সেন, আর কোথায় একটা কলেজের ছোকরা। নরেন্দ্র কি নির্বোধ যে নিজের অন্যায্য প্রশংসা শুনে বিগলিত হবে, সে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

কথা কানে হাঁটে। একজনের কথা আর একজনের কাছে পৌঁছে দিতে বাঙালিরা খুব তৎপর। যথাসময় রামকৃষ্ণ ঠাকুরের এই উক্তি কেশব সেনের কানেও তুলে দিল কিছু লোক। কেশববাবু কিন্তু রাগ করলেন না, তাঁর সহজাত উদারতায় বললেন, ওই ছেলেটার গুণপনা বিকশিত হলে আমি অবশ্যই খুশি হব।

অন্য ভক্তদের সামনে রামকৃষ্ণ ঠাকুর প্রায়ই বলেন, তোরা সব এক থাকের, নরেন আর এক থাকের। কিংবা কয়েক জন ভক্তের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোরাও সবাই কুসুম, কেউ দশ, কেউ পনেরো, কেউ বড় জোর বিশ দল বিশিষ্ট পদ্ম, কিন্তু নরেন যে সহস্রদল কমল! এত সব লোক আসে, কিন্তু নরেনের মতন আর কেউ না। অন্যরা কলসি, ঘটি এসব হতে পারে, নরেন হচ্ছে জালা। ডোবা, পুষ্করিণীর মধ্যে নরেন হচ্ছে বড় দিঘি— যেমন হালদারপুকুর। মাছের মধ্যে নরেন রাঙাচক্ষু বড় রুই, আর সব. পোনা কাঠি বাট এই সব!

অন্য সব ভক্তদের এই ধরনের মন্তব্য ও তুলনা পছন্দ হবার কথা নয়। কারুর কারুর গাত্রদাহ হয়। কয়েকজন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নরেন্দ্রর নামে নিন্দা-মন্দ ছড়াবার চেষ্টা করে।

রামকৃষ্ণ ঠাকুর মাঝে মাঝে নরেনের সঙ্গে অন্য দু’একজনের তর্ক লাগিয়ে দিয়ে দেখেন। মহেন্দ্র গুপ্ত দক্ষিনেশ্বরে প্রায়ই আসেন। তিনি ইংরেজিতে কৃতবিদ্য এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের স্কুলে পড়ান, স্বয়ং রামকৃষ্ণ ঠাকুরও তাঁকে মাস্টার বলে ডাকেন। একদিন নরেন্দ্ৰ পঞ্চবটিতে একা বসে আছে। ঠাকুর তার হাত ধরে টানতে টানতে সহাস্যে বললেন, আজ তোর বিদ্যে বুদ্ধি বোঝা যাবে। তুই তো মোটে আড় পাশ করেছিস, আজ সাড়ে তিনটে পাশ করা মাস্টার এসেছে। চল, তার সঙ্গে কথা কইবি!

মুরগির লড়াইয়ের মতন দেখা মাত্ৰই তো তর্ক শুরু করা যায় না। নরেন্দ্র বিনীতভাবে আলাপ পরিচয় শুরু করল। প্রথমে বই পড়া জ্ঞানের কথা আসে, তারপর বিচার, বুদ্ধি ও বিশ্বাস। মাস্টারমশাই সংসারী মানুষ, আবার ইন্দ্ৰিয়াতীত অনুভূতির ওপরেও খুব ঝোঁক। কথায় কথায় অবতারবাদের প্রসঙ্গ এসে গেল। ঈশ্বর কোনও বিশেষ মানুষের রূপ ধরে পৃথিবীতে আসেন? এ কথাটা শুনলেই নরেন্দ্রর হেসে উঠতে ইচ্ছে করে। কেউ একজন বলল, আমি ঈশ্বরের প্রতিনিধি, দু’চারজন তাকে নিয়ে নাচানাচি শুরু করল আর অমনি তা সত্যি হয়ে গেল। এর প্রমাণ কোথায়? অন্যদের মতে, বিশ্বাস থেকেই প্রমাণ আসে। ‘বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ, তর্কে বহুদূর”। বিশ্বাস শব্দটির ব্যাখ্যা নরেন্দ্রর কাছে অন্যরকম। জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও নিজস্ব বিচারবোধ, এর থেকেই গড়ে ওঠে বিশ্বাস। আর অন্যদের মতে, সত্যিকারের বিশ্বাস অর্জন করতে হলে বুদ্ধি ও বিচারবোধকে বিসর্জন দিতে হবে। নরেন্দ্র এ কথাটা কিছুতেই মানতে পারে না। সে বরাবরই তার মতামত তীব্র কণ্ঠে জাহির করতে ভালোবাসে। কথা বলতে বলতে তার কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে ওঠে, মাটির ওপর ঘুষি মেরে সে বলে, অন্যে যা বলে, তা আমি চোখ বুজে বিশ্বাস করব? কিছুতেই না।

রামকৃষ্ণ ঠাকুর আগাগোড়া মিটমিটি হাসেন ও দু’জনের মুখের দিকে তাকান। তর্ক থামলে, মাস্টার বিদায় নেবার পর তিনি বললেন, পাশ করলে কী হয়? মাস্টারটার মাদী ভাব, কথা কইতে পারে না। নরেন হচ্ছে খাপ খোলা তরোয়াল!

নরেন্দ্র লজ্জা পেয়ে বলে, ছিছি, এ কী বলছেন। মাস্টারমশাই কি কিছু মনে করলেন? ওঁর কাছে মাপ চেয়ে নেব।

অবতারবাদের প্রশ্নটি বেশ গুরুতর। আগে দক্ষিণেশ্বরে কিছু কিছু লোক আসত তার কারণ, রামকৃষ্ণ ঠাকুর সরল ও রসালে গল্পের ছলে ধর্মের ব্যাখ্যা করেন। ওঁকে দেখলেও খুব ভালো লাগে, মনে হয় খুব কাছের মানুষ। কিন্তু ইদানীং কিছু কিছু লোক ওঁকেই ঈশ্বরের অবতার বলে ভাবতে শুরু করেছে। রামকৃষ্ণ ঠাকুর তার প্রতিবাদ করেন না, নিজের মুখে কিছু বলেনও না।

একদিন কয়েকজন ভক্ত ব্ৰাহ্মদের নিরাকারবাদের তুলনায় সাকারবাদই যে হিন্দু ধর্মকে এতকাল ধরে রেখেছে। তা নিয়ে নিজেদের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতে লাগল। যুগ যুগ ধরে হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে মাটির প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। সেই প্রতিমার সামনে চক্ষু বুজে বসে ধ্যান করলে সত্যিই সেই ঠাকুর জীবন্ত হয়ে ওঠেন। রামকৃষ্ণ ঠাকুর তো যখন-তখন কালীর সঙ্গে গিয়ে কথা বলেন, অন্য ভক্তদেরও এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে।

নরেন্দ্র বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, মশাই, এসব আপনাদের অন্ধ বিশ্বাস। এবার রামকৃষ্ণ ঠাকুরের অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হল। তিনি খানিকটা ধমকের সুরে নরেন্দ্রকে বললেন, বিশ্বাসের আবার অন্ধ কি রে ; বিশ্বাসমত্ৰেই তো অন্ধ। বিশ্বাসের কি আবার চোখ আছে নাকি? হয় বল শুধু ‘বিশ্বাস’, না হয় বল “জ্ঞান’। তা না হয়ে আবার ‘অন্ধ বিশ্বাস’, চোখওয়ালা বিশ্বাস’- এ কী রকম?

নরেন্দ্ৰ হঠাৎ খুব দমে গেল। এখানে আসতে হলে একেবারে অন্ধবিশ্বাস রাখতে হবে? না, না, সে পারবে না। ভালোবাসার জন্যও পারবে না।

নরেন্দ্ৰ দক্ষিণেশ্বরের পথ মাড়ানো বন্ধ করল। সে আর আসে না। আসে না তো আসেই না। সে না এলে অন্য কয়েকজন ঈর্ষাকাতর ভক্তের সুবিধে হয়, তারা কুটুস কুটুস করে নরেন্দ্রর নামে নিন্দে ছড়ায়।

বি এ পরীক্ষার ফল বেরিয়ে গেছে, মেধাবী ছাত্র হলেও নরেন্দ্ৰ পাশ করেছে মাঝারি ভাবে। পৈতৃক পেশা নেবার জন্য সে শিক্ষানবিসি শুরু করেছে অ্যাটার্নি অফিসে। অধিকাংশ সময় কাটায় বন্ধুদের সঙ্গে। বাড়িতে থাকেই না, কারণ সেখানে সব সময় বিয়ের তাড়না। বিশ্বনাথ দত্ত একটার পর একটা মেয়ে দেখেই চলেছেন। এক এক জায়গায় কথা প্ৰায় পাকা হয়ে গিয়েও খুঁটিনাটির জন্য ভেঙ্গে যায়।

গান আর আড্ডা নরেন্দ্রর খুব প্রিয়। কখনও একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে সারা রাত হইহই করতে করতে ঘোরা হয়। কলকাতা শহরে। কখনও কোনও বাগানবাড়িতে যাওয়া হয়। নস্যি, চুরুট এবং রান্নায় খুব বেশি ঝাল খাওয়া ছাড়া নরেন্দ্রর অন্য কোনও নেশা নেই, কিন্তু তার বন্ধুরা কেউ কেউ যুগের হাওয়া অনুযায়ী মদ্যপানও করে, বেশ্যাপল্লীতেও যায়।

সংসর্গ অনুযায়ী মানুষের চরিত্র বিচার হয়। যারা নরেন্দ্রর নামে অপবাদ ছড়াতে উৎসুক, তারা বলাবলি করতে লাগল যে নরেন্দ্ৰ আজকাল মদ্যপান ও পতিতালয়ে যাওয়া-আসা শুরু করেছে।

এসব কথা নরেন্দ্রর কানে আসে। সে বুঝতে পারে যে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের দু’একজন শিষ্য তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেবার জন্য তার বাড়ির কাছে ঘোরাঘুরি করে। শরৎ নামে একজন শিষ্য নরেন্দ্রর এক প্রতিবেশীর কাছে জিজ্ঞেসবাদ করছিল। প্রতিবেশীটি বলল, ধুর মশাই ওর কথা আর বলবেন না। এমন ত্রিপণ্ড ছেলে কখনও দেখিনি, বি এ পাশ করেছে বলে যেন ধরাকে সরা দেখে। বাপ-খুড়োর সামনেই তবলায় চাটি দিয়ে গান ধরল, পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের সামনে চুরুট খেতে খেতে চলল- এই রকম সব ব্যাপার।

নরেন্দ্রর অহংকার প্রবল। কেউ তার নামে মিথ্যে বদনাম দিলে তো প্রতিবাদ করেই না, বরং তার উত্তর শুনে অন্যদের পিলে চমকে যায়। বদনামকারীরা সাধারণত আড়ালপ্রিয়, সামনে ভালো মানুষটি সেজে থাকে। নরেন্দ্র তাদের মুখের ওপর বলে, এই দুঃখ কষ্টের সংসারে নিজের দুরদৃষ্ট ভুলে থাকবার জন্য কেউ যদি মদ খায় কিংবা বেশ্যা বাড়ি গিয়ে সুখী হয়, আমার তাতে কিছুমাত্র আপত্তি নেই। শুধু তাই নয়, আমি যদি কখনও নিশ্চিত ভাবে বুঝি যে আমিও ওই সব করে কিছুটা সুখ পাব, তা হলে কারুর ভয়ে পিছিয়ে যাব না।

নরেন্দ্রর মনে কোনও একটা বিশ্বাস আছে যে দক্ষিণেশ্বরের ওই পাগল মানুষটি কখনও তার সম্পর্কে এসব কথা বিশ্বাস করবেন না। আর তিনিও যদি ভুল বোঝেন, তা হলে আর ভালোবাসার মাহাত্ম্য রইল কী।

রামকৃষ্ণ ঠাকুরের সামনে যখন কেউ কেউ নরেন্দ্রর নামে অপবাদ দেয়, তিনি হাসেন। কখনও বা রেগে উঠে বলেন, দুর শালা ; নরেনের নামে ওসব কথা বলবি তো তোদের আর মুখ দেখব না! নরেন সপ্তর্ষির একজন। ও কখনও নষ্ট হতে পারে?

এক একদিন নরেন নিজেই রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে পরীক্ষা করতে যায়। কিংবা দক্ষিনেশ্বর তাকে টানে, সে অন্য জায়গায় যাবে ভেবে হঠাৎ উপস্থিত হয় দক্ষিণেশ্বরে। কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে প্রবল আড্ডায় মেতে আছে, তারই মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে হন হন করে রওনা দেয় দক্ষিণেশ্বরের দিকে। সেখানে গিয়ে কিন্তু সে মূর্তি পূজা নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে ছাড়ে না। এমনকি অদ্বৈতবাদও মানতে পারে না সে। সব মানুষ, এমনকি সব বস্তুর মধ্যেই ঈশ্বর আছেন। তাহলে, চোর-ডাকাত-খুনেদের মধ্যেও ঈশ্বরের অবস্থান? ঘটি-বাটি-গামলাও ঈশ্বর?

একদিন উইলসনের হোটেলে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে খানাপিনা চলছিল। এক সময় অকারণেই নরেন্দ্রর মন উচাটন হল, বন্ধুদের ছেড়ে সে চলে এল দক্ষিণেশ্বরে। আট-দশজন ভক্ত হয়ে রামকৃষ্ণ ঠাকুর বসে আছেন তাঁর ঘরের সামনের বারান্দায়। কিছু একটা গল্প বলছেন, সবাই শুনছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। এমন সময় নরেন্দ্র এসে সেখানে দাঁড়াল।

রামকৃষ্ণ ঠাকুর খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, এসেছিস ; বোস।

নরেন্দ্ৰ উদ্ধতভাবে বলল, আগে একটা কথা জানিয়ে রাখি। আমি হোটেল থেকে খেয়ে এসেছি। লোকে যাকে অখাদ্য বলে, তাই খেয়েছি। আপনার জলের পাত্র, ঘটি-বাটি স্কুলে যদি অপবিত্র হয়, তা হলে বলে দিন, কিছু ছোব না।

রামকৃষ্ণ ঠাকুর একটুক্ষণ অপলক নয়নে চেয়ে রইলেন নরেন্দ্রর দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, তুই যা খুশি খা, কোনও দোষ লাগবে না। শোর-গরু খেয়েও যদি কেউ ভগবানে মন রাখে, তবে তা হবিষ্যান্নের তুল্য। আর শাক-পাতা খেয়েও যদি কেউ বিষয়-বাসনায় ডুবে থাকে, তবে তা শোর-গরু খাওয়ার চেয়েও কোনও অংশে পবিত্র নয়। তুই অখাদ্য খেয়েছিস, তাতে আমার কিছুই মনে হচ্ছে না। ইঙ্গিতে তিনি নরেন্দ্ৰকে কাছে ডাকলেন। তার একটা হাত ধরে বললেন, এই দেখ, তোকে আমি খুঁয়ে দিলাম। আমার কোনও বিকার হল না।

নরেন্দ্র স্তম্ভিত হয়ে গেল। ইনি গরু-শুয়োর খাওয়াটাকেও ঘৃণ্য মনে করেন না। আজ পর্যন্ত কোনও সাধু-সন্ন্যাসী কি এমন কথা উচ্চারণ করতে পেরেছেন? আর কোনও মহাপুরুষ দেখাতে পেরেছেন এতখানি উদারতা? নিজের খাওয়াদাওয়া সম্পর্কে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের বাছ-বিচার আছে। কিন্তু অন্যদের ব্যাপারে সহনশীল। সাধারণত গুরুরা শিষ্যদের আচার-আচরণ সম্পর্কে বেশি কঠোর। অনেক গুরুই নিজেরা গোপনে ভোগী হয়ে শিষ্যদের ত্যাগী হতে বলেন। আর ইনি?

ক্রমশ নরেন্দ্ৰ বুঝতে পারল, বিশ্বাস শব্দটার অর্থ সকলের কাছে এক নয়। সে ধরে রেখেছে, যা যুক্তিসিদ্ধ নয়, তা বিশ্বাস করা যায় না। অর্থাৎ বিশ্বাস আর যুক্তি অঙ্গাঙ্গী জড়িত। আর রামকৃষ্ণ ঠাকুর বিশ্বাস শব্দটি বলেন উপলব্ধি অর্থে। যে-কোনও বিষয়ের যে তাৎপৰ্য, তার উপলব্ধি হলে তখন আর কোনও প্রশ্ন জাগে না। সেই উপলব্ধিটাই রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ভাষায় অন্ধ বিশ্বাস?

অমন উপলব্ধি কী ভাবে হয়?

আর একটা প্রশ্নও নরেন্দ্রর মনের মধ্যে ঘোরে। রামকৃষ্ণ ঠাকুর যে সবার সামনে তাকে এতবড় বড় বলেন, সে কি তার যোগ্য। সত্য না হোক, এটা ওঁর প্রত্যাশা। অমন সরল-সুন্দর মানুষটির এই প্রত্যাশার উপযুক্ত সে হবে কী করে? বজ্ৰপাতের মতন একটি ঘটনায় এই সব প্রশ্ন তার মন থেকে উপে গেল।

বরানগরে থাকে নরেন্দ্রর বন্ধু ভবনাথ চাটুজ্যে। সে নরেন্দ্রকে এতই ভালোবাসে যে, তাকে দেখে রামকৃষ্ণ ঠাকুর একদিন রঙ্গ করে বলেছিলেন, তুই আগের জন্মে নরেন্দ্রর ইস্তিরি ছিলি বোধহয়! সেই ভবনাথ তার বাড়িতে প্রায়ই নরেন্দ্রকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়। আরও দু’জন বন্ধু, সাতকড়ি আর দাশরথিও কাছাকাছি থাকে, তারাও আসে। সেরকমই একদিন খাওয়াদাওয়া ও গান-বাজনায় অনেক রাত হয়ে গেল, আর বাড়ি ফেরা যাবে না। নরেন্দ্ৰ শুয়ে পড়ল সেখানেই। নরেন্দ্রর বাড়ি না ফেরার আর একটি গূঢ় কারণ আছে, পরদিন সকালেই বাবা তার জন্য আর একটি পাত্রী দেখতে যাবেন এবং নরেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। নরেন্দ্রর দিদিমার ধারণা হয়েছে যে, দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ সাধুর পাল্লায় পড়েই নরেন্দ্র বিয়ে করতে চায় না। সাধুই নিষেধ করেছে। নইলে, বয়েসকালের ছেলে, বিয়ের দিকে মন যাবে না কেন? এখনই জোর করে ওর বিয়ে দেওয়া দরকার।  আলো নিবিয়ে সবাই শুয়ে পড়েছে, একসময় ঘুমিয়েও পড়ল।

গভীর রাতে জানলার বাইরে কে যেন ডাকল, নরেন, নরেন!

প্রথমে নরেন্দ্ররই ঘুম ভাঙিল। কেউ কি সত্যি তাকে ডাকছে, না স্বপ্ন? আবার সেই ডাক, খুব ব্যাকুল কণ্ঠস্বর।

নরেন্দ্ৰ ধড়মড়িয়ে উঠে জানলা খুলে জিজ্ঞাসা করল, কে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। নরেন্দ্রর পাড়ার একটি ছেলে, তার নাম হেমালী। সে বলল, নরেন, শিগগিরই বেরিয়ে আয়, তোর বাড়িতে খুব বিপদ!

খালি গায়ে, খালি পায়ে ছুটে বেরিয়ে এসে নরেন্দ্র জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। ওরে। শিগগির বল, কী হয়েছে? নরেন্দ্র তার হাতে চেপে ধরে বলল, অসুস্থ? এখনও আছেন তো? হেমালী বলল, কী জানি… নেই বোধহয়।

এত রাত্রে গাড়ি পাওয়া যাবে না। নরেন্দ্ৰ ছুটতে লাগল। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর পেরিয়ে গেছে, নরেন্দ্র যখন সিমলেয় পৌঁছোল, তখন প্রায় ভোর।

বিশ্বনাথ দত্ত সেদিনও অফিস করেছেন। অফিস থেকে আলিপুরে গিয়েছিলেন এক মক্কেলের দলিলপত্র দেখতে। বাড়ি ফেরার পর বুকে একটু একটু ব্যথা বোধ করছিলেন, বেশি গুরুত্ব দেননি। বহুদিন থেকেই তাঁর ডায়বেটিস, কিছুদিন আগে হৃদরোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলেও তিনি তাঁর জীবনযাত্রার ধরন বদল করেননি, তিনি ভোজনবিলাসী, প্রতি রাত্রে উত্তম পানাহার ছাড়া তার মন ওঠে না। আজও আহারাদি সেরে স্ত্রীকে বললেন, বুকে একটা মলম মালিশ করে দিতে। বুকের ব্যথা চলছে, তার মধ্যেই তিনি গড়গড়ার নল মুখে নিয়ে তামাক টানছেন ও লেখাপড়ার কাজ করছেন। একবার উঠে গিয়ে তিনি বমি করলেন, সেই অবস্থাতেও স্ত্রীকে বললেন, কাল সকাল সকাল বেরুব, বিলের বিয়ের পাকা কথা দিয়ে আসব, জামা-কাপড় ঠিক করে রেখো। তার কিছুক্ষণ পরেই সব শেষ।

নরেন্দ্ৰ মৃত পিতার পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসল। সে শক্ত মনের যুবা, কেউ কখনও তাঁকে কাঁদতে দেখিনি, পুরুষ মানুষের কান্না সে ঘোর অপছন্দ করে। সে বসে রইল নিঃশব্দে। অনুতাপে তার বুকটা দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং সে তার বাবাকে এড়িয়ে এড়িয়ে যাচ্ছিল। বেশ কিছুদিন বাবার সঙ্গে তার প্রায় কোনও কথাই হয়নি। শেষ সময়েও সে বাবার কাছে থাকতে পারল না! যাবার আগে জ্যেষ্ঠ পুত্রকে একটি কথাও বলে যেতে পারলেন না বিশ্বনাথ।

হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়ার মতন নরেন্দ্ৰ কান্নায় আছড়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *