২৯
ছেলেটাকে ধরেছিল আপা। তার নাম সঞ্জয় পাল। ক্লাসমেট।
একদিন সঞ্জয় আপার কাছে পঞ্চাশটা টাকা ধার চাইল, দেবে আপা? পরশু শুক্রবার দিয়ে দেবো। খুব লেট হলে সোমবার।
আপা একটু অবাক হল। সঞ্জয়দের খুব বড় ব্যবসা। ভাল অবস্থা। অবাক আপা বলেছিল, এ তো রাজ ভিখারির মতো সিচুয়েশন। তুমি ধার চাইছ!
সঞ্জয় লাজুক হয়ে গিয়ে বলল, জানো তো, বাবা একটু টাইট ভাবে রাখে আমাকে। পকেট মানিটা খুব হিসেব করে দেয়।
তোমার পকেট মানিরই বা দরকার কী সঞ্জয়? গাড়ি করে স্কুলে আসো, তোমার তো আমার মতো বাস-ভাড়াও লাগে না।
একটা জিনিস কিনবো। নাইক-এর টি শার্ট এসেছে একটা দোকানে। কিছু কম পড়ছে টাকায়।
তখনই আপা সন্দিহান হয়েছিল। তার একটা অ্যান্টেনা আছে। তাতে সবসময়ে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। টাকাটা দিয়ে আপা বলল তোমার টি শার্ট কোন দোকানে পাওয়া যাচ্ছে?
সঞ্জয় লিন্ডসে স্ট্রিটের একটা দোকানের নাম বলল।
সুজিতার সোনার বালাটা তার ব্যাগ থেকে চুরি গেল সাত দিন পর। মোটা ভারী বালা, তাতে ঘড়ি সেট করা। সুজিতার খুব শখের জিনিস। ভারী বলে লেখার সময় খুলে হাত ব্যাগে রেখে দেয়। সুজিতা একটু অগোছালো। সাবধানী নয়। রিসেস-এর সময় ব্যাগ টেবিলে রেখেই বেরিয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে, ব্যাগ আছে, বালা নেই। সেই সঙ্গে নেই দেড়শ টাকা! খুব খোঁজাখুঁজি হল, স্কুলের হেড মিসকে জানানো হল। কিছু লাভ হল না তাতে।
পরদিন আপা অনীশকে এসে ধরল, শোনো অনীশ, আমার মনটাই সন্দেহ-পিচাশ। সবসময়ে পচা ইঁদুরের গন্ধ পাই। তোমাদের মতো সরল নই। আমার মনে হচ্ছে, সুজিতার যা হল সেরকম আরও হবে।
অনীশ হেসে বলে, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। একটা বুড়ি শুচিবায়ুওলা মহিলা হয়ে যাচ্ছ। কিসের গন্ধ পেলে?
এটা কোনো ড্রাগ অ্যাডিক্টের কাজ।
অনীশ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল, তোমার মনটা সত্যিই সন্দেহ-পিচাশ। এই স্কুলে ড্রাগ অ্যাডিক্ট কেউ নেই। আমরা সবাই মাস-প্রমিজ করেছি, কেউ ড্রাগের পাল্লায় পড়ব না, মনে নেই? রেগুলার র্যালি হচ্ছে স্কুলে। পোস্টার সেঁটে রাখছি ঘরে। উই আর ভেরি সেনসিটিভ টু ড্রাগ।
তুমি হচ্ছ ভাল ছেলে। পারফেক্ট গুড বয়। আমি তো তা নই। তোমাকে একটা কথা বলি, একটু খেয়াল রেখো।
তোমার কাকে সন্দেহ হয়?
এখন বলব না।
সঞ্জয় নয়, এবার ধার চাইল অনয় লালা। খুবই মেধাবী ছেলে। তার বাবা আর মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেছে। মা থাকে প্যারিসে, অনয় বাবার সঙ্গে কলকাতায়। স্কুল শেষ করেই সে প্যারিসে চলে যাবে।
আপা খুব সাহায্যকারী মেয়ে। প্রত্যেকের দায়ে দফায় আপা সর্বদা প্রস্তুত। ক্লাসে সবাই আজকাল তাকে মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে আন্টি বলে ডাকে। এমন কি মিস-রাও।
অনয়কে টাকাটা দিয়ে আপা বলল, শোনো, আমাকে সত্যি করে বলবে টাকাটা কেন নিচ্ছ?
অনয় খুব উদাসভাবে বলল, ধার নিচ্ছি আপা। বাবা তিন দিন হল বাইরে। আমার হাতখরচ নেই। বাবা কাল ফিরবে। দিয়ে দেবো।
আপা আর কিছু বলল না। সঞ্জয় আর অনয় যথাসময়ে তার টাকা ফেরতও দিয়ে দিয়েছিল। তবু আপা কেমন যেন দুশ্চিন্তায় রয়ে গেল।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল তিন দিন বাদে। শ্যামশ্রী নামে একটা সরল সোজা মেয়ের কাছে একটা দামী আর্টের বই ছিল। দুষ্প্রাপ্য বই। অনেক বিশ্ববিখ্যাত আর্টিস্টের ছবির প্রিন্ট। রিসেসে সে বইটা হপিস হয়ে গেল। আবার স্কুলে একটা হৈ-চৈ হল। নাম-করা ইংলিশ মিডিয়ম স্কুল। এখানে পড়ে সব বিশিষ্ট পরিবারের ছেলে-মেয়ে। চুরির ঘটনা তাই স্কুল কর্তৃপক্ষকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। ছাত্রছাত্রীদের মিটিং ডাকা হল। গার্জিয়ানদেরও মিটিং হল।
ছাত্রছাত্রীদের যে মিটিং ডাকা হল তাতে প্রিনসিপাল উঠে বললেন, চুরির ব্যাপারে আপা কিছু বলবে।
আপা উঠে দাঁড়াল। এবং স্পষ্ট ভাষায় বলল, আমি কাউকে আঙুল তুলে দেখাব না। কিন্তু যারা চুরি করছে তাদের জানাতে চাই যে, আমি তাদের চিনি। আরও জানাতে চাই যে, আমি জানি তারা ড্রাগ অ্যাডিক্ট। আমি প্রিনসিপালকে কথা দিয়েছি আর একটাও চুরির ঘটনা ঘটলে আমি তাদের নাম প্রকাশ করে দেবো।
এর পর আপার ওপর অনেকেই অসন্তুষ্ট হল। শ্যামশ্রী বলল, তুই যদি জানিস তবে চোরকে ধরছিস না কেন আপা? বইটা না পেলে যে আমি ভীষণ মুশকিলে পড়ব! এটা তো অন্যায়।
আপা শ্যামশ্রীর কথার জবাবে খুব ভদ্র গলায় বলল, দেখ শ্যামশ্রী, বইটা তুই এনেছিলি বন্ধুদের ন্যুড ছবি দেখাবি বলে। বইটা আনার পর তোরা পিছনের বেঞ্চে বসে খুব হাসাহাসি করছিলি। কাজটা তোর ভাল হয়নি।
শ্যামশ্রী বলল, ন্যুড তো কী? ও তো ফাইন আর্ট, সব মাস্টারপীস।
ঠিক কথা। মাস্টারপীস দেখার চোখ কি তোর হয়েছে? চোরকে ধরে দিলেও বইটা তো পাবি না। চোর বই বেচে দিয়েছে।
সুজিতাও এসে ধরল আপাকে, চোরের নাম জানলে তোর বলে দেওয়া উচিত আপা। আমার বাবা তো পুলিশে ডায়েরি করেছে। আমি ততটা চাই না। বালা ফেরত পেলে পুলিশ কেস তুলে নেবে।
আপা গম্ভীরভাবে বলল, শোন, চোর আমাদের ক্লাসমেট। এত উঁচু ক্লাস অবধি আমরা সবাই একসঙ্গে এতদিন পড়ে এসেছি। অনেকটা আত্মীয়ের মতো। আমার পরিবারের কেউ এরকম করলে আমরা তো তাকে পুলিশে দিই না। আমি চোরদের আর একটা চান্স দিতে চাই।
আমার বালার কী হবে?
ওটা ডোনেশন বলে ভেবে নে।
তাহলে তুই বড় বড় কথা বললি কেন বক্তৃতায়?
বললাম আবার যাতে চুরি না হয় তার জন্য।
দুর! বলে রাগ করে চলে গেল সুজিতা।
পরদিন স্কুল ছুটির আগে আপা অনীশের কাছে এসে বলল, শোনো, তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরী কথা আছে।
বলো।
তুমি একটা সাহসের কাজ করতে পারবে?
কেন পারব না? কাজটা কিসের?
তুমি একা পারবে না। সুমিত, পিটার আর গুরমিককে সঙ্গে নাও।
নিচ্ছি। ওরা একস্ট্রা ক্লাস করছে। কিন্তু কাজটা কী বলবে তো?
আমি পনেরো মিনিট পরে বেরোবো। হেঁটে যাবো বড় রাস্তা অবধি।
সে তো রোজই যাও।
আজ তোমরা আমাকে ফলো করবে।
ফলো? কেন?
একটু দূরে থেকে ফলো করতে হবে। যেন আমার সঙ্গে কেউ আছে তা বোঝা না যায়।
অনীশ ধৈর্য হারিয়ে বলে ওঠে, বাট হোয়াই আপা? হোয়াই?
আজ হয়তো একটা ঘটনা ঘটবে। কিন্তু তোমরা চট করে এগোবে না। দূরে থাকবে। শুধু লোকগুলোকে চিনে রাখবে, যাতে পরে দেখলেও চিনতে পারো।
অনীশ রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে বলে, তুমি গ্রীক ভাষায় কথা বললে আমি কি করে বুঝবো?
আপা শান্ত চোখে অনীশের দিকে চেয়ে বলে, কাল যখন স্টুডেন্টস মিটিঙে বক্তৃতা দিয়েছিলাম তখনও কি বুঝতে পারোনি যে, আমি মৌচাকে ঢিল মেরেছি?
না তো!
এই জন্যই তো তোমাকে গুড বয় বলি।
একটু খুলে বলবে?
আমার সন্দেহ হচ্ছে, আমাদের ক্লাসে এবং অন্য সব ক্লাসেও কয়েকজন করে ড্রাগ অ্যাডিক্ট আছে। আমাদের ক্লাসে দুজনকে আমার খুব সন্দেহ হয়। আরও দু একজন থাকতে পারে।
আমার বিশ্বাস হয় না আপা।
তা জানি। কিন্তু আমি যে পচা ইঁদুরের গন্ধ পাই।
বুঝলাম।
কাল আমি যেই বললাম যে, চোরদের আমি চিনি, সঙ্গে সঙ্গে আমি চোরদের একটা চ্যালেঞ্জও তো জানিয়ে রাখলাম। তাই না?
অনীশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বলে, তাই তো! এটা আমার মাথায় আসেনি। এ কাজ কেন করলে আপা?
ইচ্ছে করেই করেছি। আমি ওদের চমকে দিয়েছি, ভয় পাইয়ে দিয়েছি।
অনীশ মাথা নেড়ে বলে, দ্যাটস রাইট।
ওরা যদি সাধারণ চোর হয় তাহলে কিছু করবে না। চুপচাপ থাকবে। বড় জোর আমার কাছে এসে অন্যায় স্বীকার করবে। কিন্তু ড্রাগ অ্যাডিক্ট হলে তা করবে না।
কী করবে আপা?
ওরা যাদের কাছ থেকে ড্রাগ কেনে তারা বাজে লোক। ব্যবসা মার খেলে তাদের চলবে না।
তারা এদের অনেক সময়ে প্রোটেকশন দেয়।
তুমি এত জানলে কী করে?
আমি পায়ে হেঁটে কলকাতা শহর ঘুড়ে বেড়াই, জানো তো!
তা আর জানি না!
অভিজ্ঞতায় আমি সত্যিই বুড়ি।
তারপর বলো। এ তো সাসপেন্স থ্রিলারের মতো ব্যাপার।
থ্রিলারই তো। আমার মনে হচ্ছে ওরা ড্রাগ পেডলারদের খবর দিয়েছে, তারা আজ হোক, কাল হোক আমাকে অ্যাটাক করবেই।
কি করে বুঝলে?
আমার অ্যান্টেনা আছে। ক্লাসে আজ আমার দিকে দুজন ছেলে খুনীর চোখে তাকাচ্ছিল। তাদের একজনকে আমি বলতে শুনেছি, শী উইল বি টট এ লেসন টু ডে।
তাদের নাম আমাকে বলছ না কেন?
সেটা পরে হবে। আমি আগে পেডলারদের চিনতে চাই।
অনীশ প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বলে, এত রিস্ক নিচ্ছ কেন?
খারাপকে আটকাতে গেলে রিস্ক থাকেই।
আমরা তোমাকে গার্ড দিয়ে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেবো।
দূর বোকা। তাতে আসল কাজটাই হবে না।
আপা, তোমাকে আমি রিস্ক নিতে কিছুতেই দেব না।
তাহলে আমি আর একদিন তোমাদের না জানিয়ে বেরোবো। ওরা তো তক্কে তক্কে থাকবেই।
ওরা তোমাকে কী করবে? মারবে?
আপা হাসল, আমি রোগা মেয়ে, কুংফু কারাটে জানি না। ওরা তো ধরেই নিতে পারে যে একটু চোখ রাঙালে বা দুটো থাপ্পড় মারলেই আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলব। আর তার পর থেকে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে যাবো। তাই না?
অনীশ মৃদু হেসে বলে, সে তোমাকে যারা চেনে না তারা তা ভাবতে পারে। কিন্তু ভাবলে ভুল করবে।
আমি চাইছি ওরা ভুলটা করুক।
তার মানে তুমি মার খাবে!
খাবো। কয়েকজন বন্ধুর ভালর জন্য মার খেতে আপত্তি নেই।
বাঃ, বেশ কথা আপা। চমৎকার প্রস্তাব। এতদিন তোমাকে বুদ্ধিমতী বলে জানতাম।
এখন আর তা মনে হচ্ছে না?
না। তুমি মেয়ে-গান্ধীজী হতে চাইছো। আজকাল ওরকম ভালমানুষীর কোনও দাম নেই।
ভালমানুষী কে বললে? এ হল স্ট্র্যাটেজি। তুমি কি ভাবছো চুপ করে মার খেয়ে যাবো? মোটেই তা নয়।
তা হলে কী করবে?
চিনে রাখবো। চাঁইদের ধরতে না পারলে ড্রাগ অ্যাডিক্টদের কাছে বক্তৃতা দিয়ে কোনও লাভ নেই। এত তো পাবলিসিটি হচ্ছে, তবু অ্যাডিকশন বাড়ছে তো?
তোমার ওপর মাঝে মাঝে আমার ভীষণ রাগ হয়। ইউ লাভ টু লিভ ডেনজারাস্লি।
না বাবা না। আমি ঠান্ডা মেয়ে। আমি শান্তিতে বেঁচে থাকতে চাই।
তোমার কাণ্ড দেখে তা মনে হয় না।
আমার কাজটা করবে কিনা বলো।
কী করতে হবে আবার বলে দাও।
একটু দূরে থেকে আমাকে ফলো করবে। বোকার মতো আমাকে বাঁচাতে যেও না। যদি কিছু হয় তো দূর থেকেই চিনে রাখবে। কথা দাও কিছু করবে না।
ঠিক আছে।
শোনো, কিছু ঘটতে পারে, নাও পারে। আগে থেকে খুব বেশী প্রত্যাশা রেখো না। অ্যান্টি ক্লাইমেক্সও হয়ে যেতে পারে।
অনীশ খুবই বিষাদ বোধ করল। কিন্তু আপা তার বন্ধু হলেও তার ওপর অনীশের প্রচণ্ড বিশ্বাস। তার আজকাল কেবলই মনে হয়, আপা কোনও ভুল করতে পারে না।
সে গিয়ে সুমিত, পিটার আর গুরমিককে ঘটনাটা বলল।
সুমিত বলল, গেম রুম থেকে কয়েকটা হকি স্টিক বের করে নিলেই তো হয়।
গুরমিক বলল, ঠিক কথা।
পিটার বক্সিং করে। সে বলল, নো প্রবলেম। আপার গায়ে হাত তুললে হাত ভেঙে দেবো, সে যতো বড় মস্তান হোক।
ছুটির পর আপা একটু অপেক্ষা করল। ছেলেমেয়েদের দঙ্গলটা কেটে যাক। গুণ্ডারা যদি তাকে মারে তাহলে এরা বিপদে পড়বে।
একটু পরে সে একা বেরোলো। রাস্তা ফাঁকা। নির্জনই বলা যায়। সে একবারও পিছন ফিরে তাকাল না। ভয় পেল না। স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যেতে লাগল বড় রাস্তার দিকে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটার পর একটা প্রাইভেট গাড়ি গা ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের স্কুল বাসও চলে গেল হুস করে।
সামনে ঝাউতলার নিচে তিনটে লোক দাঁড়িয়ে। কালো, বিচ্ছিরি চেহারা।
তাদের দিকে তাকালই না আপা। সোজা হেঁটে যেতে লাগল।
আচমকাই হোঁচটটা লাগল। আপা ‘মা গো’ বলে সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে উপুড় হয়ে পড়ল ফুটপাথের শানে। হাঁটুতে খটাং করে একটা শব্দ হল। কনুইটাতে এত লাগল যে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল তার। হাতের বই-খাতা ছিটকে গেছে রাস্তায়। বৃষ্টিভেজা পথে জলকাদায় মাখামাখি হল তার বই-খাতা, সে নিজে।
বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠার আগেই একটা লাথি এসে তার রোগা কোমর প্রায় ভেঙে দিল।
একটা বিচ্ছিরি অসংস্কৃত গলা চাপা গলায় বলল, এই শালী কুত্তি, কার নাম বলবি তুই? অ্যাঁ! কার নাম বলবি?
বলতে বলতেই একজন কে যে তার চুল ধরে টেনে তুলল।
চটাস করে একটা চড় পড়ল তার গালে, বল শালী খানকী, কার নাম জানিস তুই?
আপার দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছে টপ টপ করে। ঠোঁটের কষ বেয়ে লালা। জীবনে সে কারও কাছে কখনও মার খায়নি। কিন্তু নৃশংস পশু-মানুষদের ওপরেও তার রাগ নেই। তার মনে হয় এরা বড্ড বোকা, বড় দুর্বল, বড় অসহায়।
কথার জবাব দেওয়ার সাধ্য নেই তার। মার খেয়ে তার মাথা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। এখনই সে নির্বাপিত হবে। মারাও যেতে পারে।
ঠিক এই সময়ে তিন জোড়া পা দৌড়ে আসছিল। ওদের বারণ করেছিল আপা। তবে আসছে কেন? সে চায়নি ওরাও তার সঙ্গে মার খাক।
প্রথমে পৌঁছলো গুরমিক, তার পায়ে পায়ে পিটার, একটু পিছনে অনীশ। দুজনের হাতে হকি স্টিক।
অনীশের রাগ সবচেয়ে বেশী। তার হকি স্টিক এত জোরে একটা লোকের হাতে লাগল যে লোকটা ‘বাপরে’ বলে হাতটা চেপে ধরেই দৌড়ে পালাল।
দ্বিতীয় লোকটাকে গুরমিক মারল পায়ে। তারপর লোকটা পড়ে যেতেই সে দুমদাম মারতে লাগল দক্ষ হাতে।
তিন নম্বর লোকটাকে নেওয়ার কথা ছিল পিটারের। কিন্তু বেগতিক দেখে লোকটা দৌড় মেরে উল্টো দিকের একটা গলিতে ঢুকে গেল।
গুরমিকের মার খেয়েও ভূপাতিত লোকটা একটা ব্যাঙের মতো লাফ মেরে সরে গিয়ে পালাতে লাগল।
পথচারী লোকজন সব ছুটে আসছে চারপাশ থেকে। স্কুলের দরোয়ান, মিসরাও আসবে।
অনীশ আপাকে তুলল।
খুব লেগেছে তোমার আপা?
আপার মুখ দিয়ে টস টস করে রক্ত পড়ছে। চোখ ভরা জল। তবু সে বলল, বোকা।
কে বোকা?
তোমরা। বারণ করেছিলাম না?
করেছিলে। সেটা তুমিই বোকা বলে। খুব লেগেছে? রক্ত পড়ছে যে!
কিছু নয়; ঠিক আছি।
হাসপাতালে নেওয়ার দরকার।
না বাবা। মুখে জল দেবো। স্কুলে নিয়ে চলো।
চলো।
কাউকে ধরতে দিল না আপা। নিজে হেটে গেল স্কুল অবধি।
স্কুলের মিসরা বেরিয়ে এসেছিলেন ফটকে। ঘটনায় তারা হতবাক্।
আপাকেই একমাত্র নির্বিকার মনে হচ্ছিল। সে গিয়ে চোখে মুখে জল দিল। একটু বিশ্রাম নিল বসে।
তারপর প্রিনসিপাল এলেন, আপা, তুমি কিছু জানো?
কিছু নয় ম্যাডাম।
অনীশ বলেছে তুমি জানো কে এই ঘটনার পিছনে আছে। তাদের নামগুলো আমাদের দরকার।
ম্যাডাম, আমাকে আর দু-একটা দিন সময় দিন।
কী করবে তুমি?
আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলব।
কে বন্ধু?
যারা এই ঘটনার পিছনে আছে।
তারা কি তোমার বন্ধু! এটা কি বন্ধুর মতো কাজ?
মানুষ মাত্রই ভুল করে। তারা আমাকে শত্রু ভাবছে।
তুমি আর বিপদের মধ্যে থেকো না আপা। নাম বলে দাও। এটা আমার আদেশ।
নাম বলে দিলেই আমার এত প্ল্যান সব নষ্ট হয়ে যাবে। নাম তো আমি অনেক আগেই বলে দিতে পারতাম।
প্রিনসিপাল অসন্তুষ্ট হলেন। মুখটা গম্ভীর করে বললেন, এ স্কুলে এসব কী হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। তুমি গোঁ ধরে না থাকলেই ভাল করতে। যাকগে, আমি জোর করব না। ডাক্তার আসছে। ততক্ষণ অপেক্ষা করো। আমার গাড়ি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।
ডাক্তার এল। হাত পায়ের ক্ষতে ওষুধ ব্যাণ্ডেজ লাগানো হল। প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ কিনে আনল দারোয়ান। আপার বাড়িতে টেলিফোনে জানানো হল, আপা একটু কাজে আটকে আছে। ফিরতে দেরি হবে।
আপাকে পৌঁছোতে সঙ্গে গেল অনীশ, গুরমিক আর পিটার।
অনীশ বলল, কেমন লাগছে এখন আপা?
আপা হাসল, একটু ক্লান্ত। কিন্তু বেশ ভাল লাগছে।
গুরমিক বলল, একটাকে খুব পিটিয়েছি।
আপা বলল, মারাটাই তো ভুল। মারতে নেই।
তুমি একটি ইমপসিবল্ মেয়ে আপা। আরে বাবা, মানুষ বরাবর লড়াই করে বেঁচে আছে। উল্টে মার না দিয়ে কি বাঁচতে বলো!
আপা ক্লান্ত গলায় বলে, গুরমিক, তুমি গায়ের জোরে বিশ্বাস করো, আমি করি না। যারা আমাকে মেরেছে তাদেরও আমি ঘেন্না করতে পারি না।
গুরমিক ধমকে উঠল, হেট দেম আপা, হেট দেম। ঘেন্না না করলে এই দুনিয়াতে কি বেঁচে থাকা যায়? হ্যাঙ ইওর ফিলজফি আপা আন্টি। আজ যারা তোমাকে মেরেছে কাল তারা তোমাকে খুন করবে, যদি না তুমি উল্টে মারো।
ওরা ভীতু বলেই মেরেছে। ওদের অস্তিত্বে, রুজিরোজগারে যে আমি বিপদ ডেকে আনছিলাম।
ওসব ছাড়ো আপা।কেসটা আমাদের হাতে ছেড়ে দাও। ক্লাসমেটদের নাম বলে দাও আমাদের। আমরা দেখে নিচ্ছি।
জানি। তোমরা আমার ভালই চাও। আর আমি ওদেরও ভাল চাই। কয়েকদিন অপেক্ষা করো।
ইউ আর রিয়েলি ইমপসিবল্।
অনীশ মৃদু স্বরে বলল, আমি জীবনে কখনও মারপিট করিনি আপা। আজ প্রথম একজনকে হকি স্টিক দিয়ে মারলাম। খুব জোরে মেরেছি। লোকটার হাত ভেঙে যাওয়ার কথা।
আপা করুণ গলায় বলে, আহা রে! কেন যে ওরকম করলে!
অনীশ বলল, কিন্তু তুমি জানলে অবাক হবে, জীবনে প্রথম একটা বদমাশ লোককে মারতে পেরে আমার অদ্ভুত লাগছে। আই অ্যাম এনজয়িং ইট।
আপা সরু গলায় বলে, ওটাও একটা ড্রাগ অনীশ।
কোনটা?
মার দেওয়াটা। ওটাও নেশা। যারা একবার মারে এবং সেটা উপভোগ করে তারা আবার মারবে। হয়তো অকারণে মারবে। মারতে আনন্দ পাবে। পৃথিবী তো সেই কারণেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
তোমাকে আমি বুঝতে পারি না আপা। হয় তুমি কোনও গডেস ইন ডিজগাইস অথবা একটু লু্নাটিক।
আমি তোমাদের চোখে লুনাটিক হতেই পারি। কিন্তু আমার চোখ দিয়ে যদি তোমাকে পৃথিবীটা দেখাতে পারতাম!
পৃথিবীটাকে তুমি কিরকম দেখ আপা? ইজ’নট ইট এ হেল?
নোংরা, খারাপ, নিষ্ঠুর। তবু কী যে সুন্দর!
আপা, আজ রাতে ভাল করে ঘুমোও। আজ মাথা কাজ করছে না।
আমার মাথা তেমন কাজ কখনও করে না। কাজ করে আমার মন। আমার হৃদয়।
আপাকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে চার বন্ধু হেঁটে হেঁটে খানিক দূর এক সঙ্গে এল। কেউ কোনও কথা বলছিল না। তারা বীরের মতোই একটা কাজ করেছে। তবু নিজেদের বীরত্বটাকে অনুভব করছিল না। তারা আপা সম্পর্কে কোনও মন্তব্যও করতে পারছিল না। তারা খানিকটা বিহ্বল।
তারা ভাবছিল। শুধু ভাবছিল।