শখের এই দলটির নাম বেশ জমকালো, ‘ভিকটোরিয়া ড্রামাটিক ক্লাব’। বছরে চার পাঁচটি নাটক এরা নামায়। শহরে বিশেষ পাত্তা পায় না, মফস্বলের গ্রামে গঞ্জে এদের ডাক পড়ে। দুটি-তিনটি ভাড়া করা অভিনেত্রীকে কিছু পয়সা দিতে হয়, এ ছাড়া বাকি সকলের ভালবাসার পরিশ্রম।
অর্ধেন্দুশেখর এদের নাট্য পরিচালক হয়ে বসলেন। তাঁর নিজের মঞ্চ ভাড়া করার কিংবা নতুন করে দল গড়ার মতন আর রেস্তর জোর নেই। কোনও প্রতিষ্ঠিত মঞ্চ থেকেও তাঁর কাছে ডাক আসেনি। হোক না এটা একটা নিতান্ত পাড়ার ক্লাব, তবু তো এখানে তিনি এক নম্বর। সবাই তাঁর কথা মানে।
এখানে তিনি নাট্য পরিচালক হতে রাজি হয়েছেন দুটি শর্তে। কোথাও তাঁর নাম থাকবে না, হান্ডবিল-পোস্টারে তো নয়ই, মুখে মুখেও জানানো চলবে না। কাগজে কলমে ছোনে মিত্তিরই পরিচালক। দ্বিতীয় শর্ত হল, তিনি এদের কাছ থেকে এক পয়সাও নেবেন না। শুধু গোটা দুৰ্ত্তিন বাংলা মদের বোতল জো নি দিলেই চলবে।
রিহাসলের স্থান পরিবর্তন হয়েছে, এখন আর সেখানে পাবলিক উঁকি ঝুকি মারতে পারে না। প্রতিদিন হল ঘরের মাঝখানে একটা বড় চেয়ারে তিনি বসেন, সঙ্গে সঙ্গে একজন তাঁর হাতে একটি গড়গড়ার নল তুলে দেয়। আর একজন একটি গেলাসে মদ সেজে এনে সামনে রাখে। অর্ধেন্দুশেখর সারাদিনই একটু একটু করে মদ্যপান করেন বলে কোনও সময়েই খুব বেশি নেশাগ্রস্ত হন না, তাঁর কথা জড়িয়ে যায় না।
গেলাসে একবার করে চুমুক দেন, গড়গড়ার নলে টান মারেন, আর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কণ্ঠস্বরের খেলা দেখিয়ে দেন। এক এক সময় চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে কখনও বীরদর্পে, কখনও কৌতুকের ভঙ্গিতে হাঁটা চলা করেন, গান গেয়ে ওঠেন কারুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে। এই আনা লোকগুলোকেই দারুণ ভাবে গড়ে পিটে নিতে তিনি বদ্ধপরিকর।
‘নীলদর্পণ’ প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে, আর দশ দিন পরেই চন্দননগরের ফরাসডাঙায় প্রথম মঞ্চস্থ হবে। তারপর শ্রীরামপুরেও আমন্ত্রণ আছে। মহলা শেষ হয়ে যাবার পরও কয়েকজন থেকে যায়, গল্প গুজব হয়। অর্ধেন্দুশেখরের বাড়ি ফেরার কোনও তাড়া নেই। ছোনে মিত্তির অর্ধেন্দুশেখরের কাছ থেকে রঙ্গমঞ্চের নানান কাহিনী যেন দুচোখ দিয়ে গিলে নেয়। অর্ধেন্দুশেখরের জনা সে গেলাসে মদ ঢেলে দেয়, তামাক সেজে দেয়, কিন্তু নিজে গুরুর কাছে ওসব কিছু ছোঁয় না।
একদিন ছোনে মিত্তির বলল, গুরুদেব, একটা কথা বলব, অপরাধ নেবেন না?
অর্ধেন্দুশেখর বললেন, সে আবার কী? যা ইচ্ছে হয় খোলসা করে বলো। মনের কথা কখনও চেপে রাখতে নেই, তাতে অসুখ করে। বলে ফ্যালো!
ছোনে মিত্তির মাথা চুলকে বলল, আজ্ঞে, আমি মাঝে মাঝে হরিদাসীর কাছে যাই। রাত্তিরে ওর ওখানেই থাকি।
হরিদাসী এই ক্লাবেরই একজন ভাড়া করা অভিনেত্রী। এই ধরনের অভিনেত্রীদের সঙ্গে নাট্য পরিচালকদের একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠবে, এরকম যেন একটা অলিখিত নিয়ম আছে।
অর্ধেন্দুশেখর বললেন, তা বেশ তো, যাও না। তুমি বিয়ে-থা করেছ তা জানি। মাঝে মাঝে পরনারীর কাছে গেলে রক্ত চলাচলের গতি বৃদ্ধি পায়, তাতে শরীর মেজাজ ভাল থাকে, এমনই তো অনেকে বলে। তুমি হরিদাসীর ঘরে যাবে, তার জন্য আমার অনুমতি নেবার প্রয়োজন আছে নাকি?
ছোনে মিত্তির বলল, আজ্ঞে তা নয়। হরিদাসী ভয়ে বা সঙ্কোচে একটা কথা আপনাকে জানাতে পারে না। তাই আমাকে বলেছে। শুনে আমিও দুদিন ধরে বড় উতলা হয়ে আছি। চেপে রাখতে পারছি না। গুরুদেব, আপনার জন্য একটি মেয়ের সর্বনাশ হতে যাচ্ছে।
অর্ধেন্দুশেখর চমকে উঠে বললেন, সে কী! এমন অপবাদ তো আমার নামে কেউ কখনও দেয়নি! আমি মদ-গাঁজা খাই সবাই জানে। শ্মশানে-মশানে পড়ে থাকি। কিন্তু কারুর ক্ষতি তো করি না বাবা। থিয়েটারের মাগিদের নিয়ে বেলেল্লা করা আমার ধাতে নেই। ভদ্রঘরের কোনও মেয়েকেও নষ্ট করিনি। তুমি এত বড় একটা কথা বললে?
—মিথ্যে বলিনি, আগে সবটা শুনুন। হরিদাসী যেখানে থাকে, তার কাছেই গঙ্গামণির বাড়ি। এককালে নাম করা অ্যাকট্রেস ছিল গঙ্গামণি…
–অত ব্যাখ্যান করে বলতে হবে না। গঙ্গামণিকে আমি চিনি না? ওর ডাক নাম হাঁদু। ওর বাড়িতে আমি কতবার গেছি।
—সেই বাড়িতেই থাকে নয়নমণি।
—হ্যাঁ হাঁ জানি। ওর আগে নাম ছিল ভূমিসুতো না মাটির দড়ি কী যেন। থিয়েটারে ওই নাম চলবে না বলে আমিই ওর নাম রেখেছিলাম নয়নমণি। তারপর বলো—
—লোকে বলে ওই নয়নমণি আপনার মানসকন্যা।
—আরে দূর, মানসকন্যা ফন্যা কিছু না। ওসব গালভরা কথা আমি বিশ্বাস করি না। ওকে আমি রাস্তা থেকে তুলে এনে গড়ে পিটে নিয়েছি। শেষের দিকে বেশ ভাল পার্ট করত, ও মেয়ের গুণ আছে। তা এমন তো আরও কতজনকে আমি শিখিয়েছি-পড়িয়েছি। বিমোদিনী আমার কাছে শেখেনি? কুসুমকুমারী, ক্ষেত্রমণি, বনবিহারিণী কে শেখেনি আমার কাছে? এত মানস পুত্রকন্যা হলে যে বিরাট সংসার হয়ে যায় হে আমার।
–নয়নমণি আপনাকে পিতার মতন জ্ঞান করে।
—তা করে তো করুক। নয়নমণির নাগর আমি যখন ছিলুম না, তখন তার মানসবাপ হতে দোষ কী? তা বাপের মতন যদি হয়ে থাকি, তা হলে আমি আবার তাকে নষ্ট কলম কী করে?
—আজ্ঞে নষ্ট করার কথা তো বলিনি। ছি ছি ছি ছি, এমন কথা আমার মুখেও আসবে না। বলছিলাম যে, আপনার জন্য, হয়তো আপনার অজ্ঞাতসারেই নয়নমণির সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে।
–কী রকম? কী রকম? আমার কৌতূহল বৃদ্ধি পাচ্ছে।
–আপনি এমারাল্ড তুলে দিলেন, আপনার দলের সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, চারজন ছাড়া অন্যরা সবাই কোনও না কোনও স্টেজে এখন ঢুকে পড়েছে। আর নয়নমণি, যে ছিল আপনার হিরোইন, পাবলিকের কাছে যার দারুণ ডিমান্ড, সে চুপচাপ বসে আছে বাড়িতে।
—আমি তার কী করব? দল ভেঙে গেছে, এখন যে যেখানে পারবে যাবে। সবার কাজ খুঁজে দেবার জন্য আমি দাসখ লিখে দিয়েছিলাম নাকি? এমন কথা বলা তোমাদের ভারী অন্যায়।
—আজ্ঞে, নয়নমণির বেলায় কাজ খুঁজে দেবার প্রশ্নই ওঠে না। মিনার্ভা তাকে ডেকেছে, স্টার ডেকেছে। ক্লাসিক থেকে সাধাসাধি করছে, তবু সে যায় না।
—সে কোথায় যাবে না যাবে, তার আমি কী জানি! ও ছেমড়িটার বরাবরই গুমোর বেশি।
–অমর দত্ত নিজে গিয়েছিলেন তার কাছে, তবু নয়নমণি দেখা করেনি। আপনি তাকে শপথে বেঁধে রেখেছেন। আপনি একদিন তাকে পা ছুঁইয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন যে আপনাকে ছেড়ে সে যেন কোথাও না যায়। তাই এখনও সে আপনার অনুমতি ছাড়া কোনও বোর্ডে যোগ দেবে না। শপথ সে ভাঙবে না! আপনার সন্ধানও কেউ জানে না।
অর্ধেন্দুশেখর হা-হা করে অট্টহাস করে উঠলেন। মদের গেলাসে আবার একটা চুমুক দিয়ে বললেন, শপথ না ঘোড়ার ডিম! ওহে থিয়েটারে আমরা নকল কথা বলি, নকল ভাবে হাসি, নকল ভাবে কাঁদি। আমাদের জীবনে আসল কিছু আছে নাকি? ওসব শপথ টপথের কোনও দাম নেই। থিযেটারের ভেতরের খবব তুমি কী জানো? আজ যে দু’জনের গলাগলি ভাব, কালকেই দেখবে দু’পাঁচটাকা বেশি রোজগারের লোভে একজন অন্য স্টেজে চলে গেল, শক্রতা শুরু করে দিল। গিরিশবাবুর হাতে গড়া শিষ্য অমৃতলাল, সেই দুজনের মধ্যে আকছা-আকছি হয়নি? ‘অসার এ সংসার, তুমি কার কে তোমাব।’ লোকে বাপ-মাকে পর্যন্ত ভুলে যায়। ওই নয়নমণি যদি থিয়েটার আর না করতে চায়, তা হলে শাঁসাল দেখে কোনও বাবু ধরুক! যেখানে খুশি যাক!
ছোনে মিত্তির বলল, হরিদাসী তো বলে মেয়েটা একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া। অমন রূপ-যৌবন, অমন নাম ডাক, তবু নাকি কোনও পুরুষের সঙ্গে মেশে না। রাত্তিরে কেউ ওর ঘরে যেতে পাবে না। ময়েবাও ওর গুণের প্রশংসা করে, এমনটি আগে কখনও শুনিনি। অমর দত্তকে ফিরিয়ে দেবার মতন হিম্মত কটা মেয়ের থাকতে পারে বলুন।
অর্ধেন্দুশেখর বললেন, ও মেয়েটা যেমন ঠেটি, তেমনি দেমাকি। একবার এক মস্তবড় মহারাজা ওর গান শোনার জন্য কত পেড়াপিড়ি করলেন, ও ঘুড়ি কিছুতেই গেল না। ও যদি নিজের পায়ে কুড়ল মারতে চায়, তবে আমি কী করব!
-ও কিন্তু থিযেটার ভালবাসে। থিয়েটাবে আবার যোগ দেবার ইচ্ছে আছে, শুধু আপনার জন্য পারছে না। হবিদাসী বলে, আর কিছুদিনের মধ্যে আপনার সন্ধান না পেলে ও কাশীতে চলে যাবে। তাতে থিয়েটারের কত ক্ষতি হবে বলুন! অমন প্রতিভাময়ী একজন অ্যাকট্রেস? আমি হরিদাসীকে বলে দিলুম একদিন তাকে এখানে নিয়ে আসতে। এসে আপনার পায়ে পড়ক। কিন্তু তা বোধহয় সে আসবে না। তাই বলছিলুম কী, আপনি যদি একদিন গিয়ে তাকে অভয় দেন! নয়নমণি ক্লাসিক থিয়েটারে যোগ দিলে যোলো কলা পূর্ণ হবে।
অর্ধেন্দুশেখর এবার ‘প করে জ্বলে উঠে বললেন, কী, আমি যাব তার বাড়ি? তোদের মুখের কোনও আড় নেই? আমার এমারাল্ড ঋণের দায়ে উঠে গেল, সেখানে দত্ত বাড়ির এক উটকো ছোকরা ক্লাসিক থিয়েটার খুলেছে, সেই ক্লাসিককে আমি সাহায্য করব? খবরদার এমন কথা আর আমার সামনে উচ্চারণ করবে না। নয়নমণি কাশী যাক বা উচ্ছ্বন্নে যাক, তাতে আমার কী?
মাথায় রাগ চড়ে গেলে রাত্তিরে ভাল করে ঘুম আসতে চায় না। অর্ধেন্দুশেখর বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলেন। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল নয়নমণির মুখ। কুমোরটুলির কুমোররা একতাল মাটি নিয়ে যেমন আস্তে আস্তে একটা মানুষের মুখ ফুটিয়ে তোলে, সেই ভাবে তিনি নয়নমণিকে গড়েছেন। প্রথম যখন মেয়েটিকে দেখেন, তখন শুধু তার গানের গলাটা ভাল ছিল। কিন্তু শুধু তা দিয়ে কি বড় অভিনেত্রী হওয়া যায়? মঞ্চের ওপর হাঁটা চলা, হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে তাকানো, প্রস্থানোদ্যত হয়ে উইংসের কাছে গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়ানো, এই গুলোও তো আসল। কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামা শেখানোর জন্য কি কম খাটতে হয়েছে? হ্যাঁ, একথা ঠিক, মেয়েটার শেখার আগ্রহ ছিল। দু’লাইন পার্ট দশবার ধরে বলালেও কখনও ক্লান্তির চিহ্ন দেখায়নি। ওর প্রধান সম্পদ ওর চক্ষুদুটি। শুধু নীরবে চেয়ে থাকার মধ্যেও অনেক রকম ভাষা ফোটে। থিয়েটারের অধিকাংশ মেয়েই তো গরুর মতন ভাবডোবে চোখে তাকিয়ে থাকে। ও মেয়ের চোখে কখনও নদীর চাঞ্চল্য কখনও আগ্নেয়গিরির ধারা। তাই তো ওর নাম রেখেছিলেন নয়নমণি।
নয়নমণি কবে তাঁর কাছে শপথ করল? মনে পড়ছে না তো! শপথ টপথের কোনও মূল্য আছে নাকি! তোমার জন্য প্রাণ দিয়ে দিতে পারি, তোমাকে ছেড়ে কখনও যাব না, এরকম কথা তো থিয়েটারের লোকেরা যখন তখন বলে, মুখস্থ করা সংলাপের মতন, কেউ কি তার গুরুত্ব দেয়? কবে সেরকম কী কথা হয়েছিল, ও মেয়েটা তাই আঁকড়ে ধরে বসে আছে? ক্লাসিক থেকে ডাকাডাকি করছে, তাও যোগ দিতে যাচ্ছে না, এই পাপে ভরা পৃথিবীতে এমন মেয়ে জন্মায়! মেয়েটা পাগল নাকি?
ক্লাসিক, ক্লাসিক। অর্ধেন্দুশেখরের এমারাল্ড থিয়েটার উঠে গেল, এখন ক্লাসিকেরই জয়-জয়কার। সবাই বলাবলি করছে, বাংলা রঙ্গমঞ্চে নতুন যুগের শুরু হয়েছে,—সেই যুগের প্রবর্তন করেছে এক দেবদূত, তার নাম অমর দত্ত। রেলি ব্রাদার্সের মুৎসুদ্দি দ্বারকানাথ দত্ত বিরাট ধনী, তার এক ছেলে হীরেন্দ্র কায়স্থ হয়েও সংস্কৃতে বড় পণ্ডিত আর পার্শনিক হিসেবেও নাম হয়েছে কিছুটা। আর এক ছেলে এই অমর, বাপের টাকা তো অনেক আছে বটেই, বাড়িতে লেখাপড়ারও চচা আছে।
ধনী পরিবারের সন্তান শখ করে থিয়েটার খুলে টাকা ওড়াচ্ছে, এমনটি যে আগে আর ঘটেনি তা তো নয়। কিন্তু এই অমর দত্তর ধরন-ধারণ সবই অন্য রকম। ছেলেটি যে অতিশয় সুপুরুষ তা স্বীকার করতেই হবে। কাশ্মীরিদের মতন গৌরবর্ণ, সুগঠিত শরীর, কপাট বক্ষ, ভরাট কণ্ঠস্বর। বাংলার রঙ্গমঞ্চে এরকম সত্যিকারের নায়কোচিত চেহারার অভিনেতা আগে আসেনি। শুধু অভিনেতা নয়, অমর দত্ত নিজেই নির্দেশক। ক্লাসিক থিয়েটার প্রবর্তনের পরই অনেক রকম পরিবর্তন ঘটাচ্ছে সে। স্টেজ থেকে শুরু করে হলের চেয়ার পর্যন্ত সব ঢেলে সাজাচ্ছে, সব কিছু ঝকঝকে তকতকে, কোথাও একবিন্দু ময়লা থাকবে না, নতুন করে আলো বসানো হয়েছে, পুরনো ব্যাক ড্রপ বাতিল। শুধু থিয়েটার বিষয়ে সে পত্রিকা বার করছে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছে, কাজে নিয়ম-শৃঙ্খলা এনেছে, তাই যে-কেউ এখন ক্লাসিকে যোগ দেবার সুযোগ পেলে ধন্য হয়ে যায়।
তা এসব হোক না, ভাল কথা। কেউ যদি থিয়েটারের উন্নতি ঘটায়, আরও বেশি সংখ্যক দর্শক টানতে পারে, তা হলে তো অর্ধেন্দুশেখরের মতন যাঁরা পাবলিক থিয়েটারের সঙ্গে প্রথম থেকে জড়িত তাঁদের তো খুশি হবারই কথা। কিন্তু অমর দত্ত যে চ্যাটাং চ্যাটাং বাকি শুরু করেছে। সে নাকি বলে, বুড়ো-ধুড়োদের দিয়ে আর চলবে না, ঘোষ-মুস্তাফিদের মতন টেনে টেনে আবৃত্তির ঢঙে অভিনয় আর চলে না! আবৃত্তির ঢঙে অভিনয়? অর্ধেন্দুশেখরের মতন একই নাটকে পাঁচটি ভূমিকায় পাঁচ রকম কণ্ঠস্বরের খেলা দেখাবার ক্ষমতা আছে ওই ছোকরার? হিস্টোরিকালে হিরো সাজছে চাষাভুষোর অভিনয় করে দেখাক তো।
নিদ্রাহীনতার জড়তা কাটাবার জন্য সকালবেলা ভাল করে তেল মেখে স্নান করলেন অর্ধেন্দুশেখর। তারপর চুপ করে বারান্দায় বসে তামাক টানতে লাগলেন। সংসারের কোনও ব্যাপারে তিনি মাথা ঘামান না। এই জন্মে আর সংসারী হওয়া হল না। কুল রাখি না মান রাখি, সেই অবস্থা। একবার থিয়েটারের নেশা রক্তে ঢুকে গেলে আর সংসারে মন বসে না।
বেলা দশটা আন্দাজ বেরিয়ে পড়ার মন করে পোশাক বদলালেন। আজ তিনি দাড়ি কামিয়েছেন, একটা কোঁচানো ধুতি ও সিল্কের বেনিয়ান গায়ে দিয়ে, একটা হড়ি হাতে নিয়ে বেরুলেন বাড়ি থেকে। হাঁটতে হাঁটতেই এক সময় তিনি উপস্থিত হলেন গঙ্গামণির বাড়িতে। সোজা উঠে এলেন দোতলায়।
গঙ্গামণি তখন পাড়ার চারটি অনাথ ছেলেমেয়েকে আবৃত্তি শেখাচ্ছিল, অর্ধেন্দুশেখরকে দেখেই তাদের ছুটি দিয়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে। অর্ধেন্দুশেখরের পায়ের কাছে গড় হয়ে সে প্রণাম করল বটে, কিন্তু রাগ রাগ গলায় জিজ্ঞেস করল, কী গো, সাহেব-দেবতা, হঠাৎ এদিকে এলে কী মনে করে?
অর্ধেন্দুশেখর বললেন, অনেকদিন তোকে দেখিনি হাঁ, তাই ভাবলুম এই চাঁদ বদনটি দেখে আসি।
গঙ্গামণি থুতনিতে আঙুল দিয়ে বলল, আহা, মরে যাই, মরে যাই! শুনে একেবারে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এই জলহস্তীকে তো আজকাল কেউ দেখতে আসে না! তোমার বাড়িতে চার-পাঁচবার লোক পাঠিয়েছি, বাবুর পাত্তাই নেই। কক্ষনও বাড়িতে পাওয়া যায় না। তা থাকো কোথায় সারাদিন?
অর্ধেন্দুশেখর মুচকি হেসে বললেন, শ্মশানে। এগিয়ে থাকচি, বুঝলি। একদিন তো যেতেই হবে!
গঙ্গামণি বলল, যেতে সকলকেই হবে, তা বলে আগে থেকেই এক পা বাড়িয়ে থাকতে হবে কেন গা?
—হাঁদু, অনেকদিন পর এলুম, দুটো মিষ্টি কথা বল। আগে তোর মুখ দিয়ে মধু ঝরত।
–তখন তোমার চেহারাটাও নব কান্তিকের মতন ছিল, এমন সিঁড়িতে পানা হয়নি।
—আমার বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলি কেন? প্রেম উথলে উঠেছিল বুঝি?
—হ্যাঁ গো, দুধের ফেনার মতন উথলে উঠেছিল। অনেককাল তোমায় না দেখে প্রাণটা আনচান করছিল। তুমি কেমন ধারা মানুষ, আমাদের নয়ন বলে মেয়েটাকে কী সব চুক্তি দিয়ে বেঁধে রেখেছ?
-চুক্তি, কীসের চুক্তি? আমার এমারাল্ড থিয়েটারে তো কোনও লেখাপড়ার কারবার ছিল না!
—তুমি নাকি তাকে কোন বাঁধনে বেঁধে রেখেছ, তোমার অনুমতি ছাড়া সে আর কোনও বোর্ডে নামতে পারবে না। কেলাসিকের অমর দত্ত নিজে তাকে সাধতে এসেছিলেন, মেয়েটা তার সঙ্গে দেখাই করল না।
—অমর দত্ত তোর এখানে এসেছিল? কেমন দেখলি রে?
—আহা, ঠিক যেন রাজপুত্তর। এমনটি আর দেখিনি। যেমন গায়ের রং, তেমনি মাথায় চুলের কী বাহার! কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায়, বড় বংশের ছেলে। একটুও ছাবলামি নেই। ছুঁড়িটাকে কত করে বললুম, একবার নীচে নাম, দুটো কথা অন্তত বলে যা, তা এলই না।
–মেয়েটা কোনও থিয়েটারে যায়নি, বাবু ধরেছে?
–অমন কথাটি মুখে এনো না। কত কত বড় মানুষের ছেলে ওকে চেয়েছে, ও কারুর পানে ফিরেও তাকায় না। এ মেয়ে অন্য ধাতুতে গড়া। তুমি আমি যে লাইনে আছি, সে লাইনে এমন মেয়ে কেউ কখনও দেখেনি।
—মেয়েটাকে একবার ডাক, তার সঙ্গে কথা বলি।
—দ্যাখো বাপু, কত টাকা পেলে তোমার ওই চুক্তির কাটাকুটিন হবে, বলে দাও তো। যেমন করে পারি, আমরা তা দিয়ে দেব। অমন একটা মেয়ে এস্টেজে নামবে না, এতে যে আমারই বদনাম।
—আরে মাগি, ছুঁড়িটাকে ডাক না। তোর চোপা একটু বন্ধ কর, আমি ওর সঙ্গে সরাসরি কথা কই।
নয়নমণি পুজোয় বসেছে। তার পুজোয় কোনও মন্ত্র নেই, ঠাকুরের কোনও ভোগও নেই। কৃষ্ণের মূর্তির সামনে সে অনেকক্ষণ চোখ বুজে নিঃশব্দে বসে থাকে।
গঙ্গামণি নিক্সে তাকে ডাকতে এল। অর্ধেন্দুশেখরের নাম শুনে নয়নমণি উৎফুল্ল হয়ে একটা টিনের তোরঙ্গ খুলে একটা পটুলি সঙ্গে নিয়ে দ্রুত নেমে এল নীচে।
চওড়া লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা, মাথার চুল খোলা, আর কোনও প্রসাধন নেই। মাটিতে বসে পড়ে অর্ধেন্দুশেখরের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে যখন সে উঠে দাঁড়াল, অর্ধেন্দুশেখর কয়েক মিনিট মুগ্ধ হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলেন। নয়নমণি সাতাশ বহু বয়েসে এখন পর্ণ যুবতী, শরীরে একটুও মেদ জমেনি, সিংহিনীর মতন কোমরের গড়ন।
অর্ধেন্দুশেখর বললেন, কেমন আছিস, নয়ন?
নয়নমণি বলল, আপনার আশীর্বাদে ভাল আছি।
অর্ধেন্দুশেখর জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে, তোর সঙ্গে নাকি আমার কী শপথের বন্ধন আছে? সবাই বলাবলি করছে, অথচ আমারই কিছু মনে নেই।
নয়নমণি মৃদু স্বরে বলল, একদিন আপনি আমাকে একটা নাচ শেখাচ্ছিলেন। সেদিন আপনার শরীর ভাল ছিল না, পরিশ্রমও হচ্ছিল যথেষ্ট। আপনি একসময় বললেন, এত কষ্ট করে তালিম দিয়ে কী আমার লাভ! একদিন ফুরুৎ করে পাখি উড়ে যাবে। অন্য থিয়েটার থেকে বেশি টাকার অফার দিলেই তুই পালাবি। আমি তখন আপনার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আপনার অনুমতি ছাড়া আমি কোনওদিনই অন্য থিয়েটারে যাব না।
অর্ধেন্দুশেখর হা-হা করে হেসে উঠে বললেন, ও, এই কথা! নেশার ঝোঁকে কবে কী বলেছি মনেই নেই। এমন কথা তো অনেককেই বলি, তারা তো মানেই না, আমি নিজেও মনে রাখি না।
নয়নমণি বলল, সেদিনের কথার প্রতিটি অক্ষর আমার মনে আছে। সারাজীবন তা আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলব।
অর্ধেন্দুশেখর এগিয়ে এসে নয়নমণির থুতনি ছুঁয়ে বললেন, তোর বুঝি থিয়েটার খুব ভাল লাগে? তুই কারুর সঙ্গে সোহাগ-পীরিত করিস না শুনেছি।
নয়নমণি বলল, আপনি কত কষ্ট করে শিখিয়েছেন, তা নষ্ট হতে দিতে চাই না। তাই থিযেটাব ভাল লাগে।
অর্ধেন্দুশেখর এবার নয়নমণির মাথায় একটা হাত রেখে বললেন, যা নয়ন, তোকে আমি মুক্তি দিলাম। কথার কথাই হোক বা পবিত্র শপথ হোক, সব এখন থেকে চুকে গেল। এখন থেকে তুই স্বাধীন, তুই যে-কোনও থিয়েটারে যোগ দিতে পারিস। যদি আমার নিজের দল গড়ার সামর্থ্য হয় কখনও, তখন তাকে আবার ডাকব। তখন তুই আসিস!
নয়নমণি আবার অর্ধেন্দুশেখরকে প্রণাম করে তাঁর পায়ের কাছে টাকা তোড়াটি বাখল। অনেকটা পিছিয়ে গিয়ে অর্ধেন্দুশেখর বললেন, এটা কী?
নয়নমণি বলল, এটা আমার প্রণামী। আপনি আমাকে কত টাকা দিয়েছেন, তার বেশির ভাগই খরচ হয়নি।
অর্ধেন্দুশেখর বললেন, তুলে নে, তুলে নে। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি যতই নীচে নামুক, কোনওদিন ভিখিরি হবে না। যাকে যে টাকা দিয়েছি, তা ফেরত নেবাব বদলে আমার মৃত্যুও ভাল। তবে এখনই মরছি না আমি। সবাই বুড়ো বুড়ো বলে, এই বুড়ো হাড়েই আবার ভেলকি দেখাব!
হঠাৎ তার চোখে জল এসে গেল। লজ্জা পেয়ে মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে ধরা গলায় বললেন, নয়ন, আমি আশীর্বাদ করছি, তুই খুব বড় অভিনেত্রী হবি। নিজের মান থেকে কখনও বিচ্যুত হবি না। এই বুড়োকে মনে রাখিস।