1 of 3

২৭. শচীন অনেকক্ষণ কাজ করল

॥ ২৭ ॥

শচীন অনেকক্ষণ কাজ করল। কাছারিঘরে মস্ত আলো জ্বেলে দিয়ে গেছে চাকর। কর্মচারীরা তটস্থ হয়ে অপেক্ষা করছে। একটা কারুকাজ করা তেপায়ায় ভারী রুপোর থালায় ঢাকা দেওয়া খাবার আর রুপোর গেলাসে জল অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ।

শচীন বুঝতে পারছে, জমিদারীর অবস্থা খুব খারাপ নয়। কিন্তু ঠিকমতো তদারকী হয়নি বলে আদায়পত্র ভীষণ কম হচ্ছে কয়েকবছর। একটু চেষ্টা করলে এবং সতর্ক থাকলে সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু কাজটা করবে কে? শচীন জানে, হেমকান্ত আপনভোলা লোক। বিষয় আশয়ে মন নেই। তাঁর ছেলেরা জমিদারীতে আগ্রহী নয়। জমিদারী হল ভাগের মা। হেমকান্তর সম্পত্তি ভাগ বাঁটোয়ারা হয়ে যে হিস্যা তারা পাবে তা লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই তারা অন্যান্য কাজ কারবারে নেমে পড়েছে।

শচীন আর একটা ব্যাপারও বুঝতে পারছে। হেমকান্ত তাকে জামাই করতে চান সম্ভবত এই জমিদারী দেখাশোনা করার জন্যই। এ বাড়ির জামাই হয়ে বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনা করতে শচীনের আপত্তি নেই। বিশাখাকে সে বাল্যকাল থেকে দেখে আসছে। ভারী সুন্দর ফুলের মতো মেয়ে। মুখখানা মনে পড়লেই বুক তোলপাড় করে। শচীন অবশ্য খুব ভাবালু নয়। বরং বাস্তববাদী। কিন্তু পুরুষ তো। সুন্দরী মেয়ে দেখে কোন পুরুষের না বুক তোলপাড় হয়?

শচীন তাই খুব আগ্রহ আর নিষ্ঠার সঙ্গে হেমকান্তর জমিদারী জরীপ করছে। টাকার জন্য নয়, বিশাখার মুখ চেয়েই। এ বাড়ির মান সম্মান রাখা তারও কর্তব্য।

বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা দুনিয়াতেই একটা মন্দা চলছে। এ দেশের লোকের হাতে বিশেষ টাকা নেই। নগদ টাকার টানাটানি থেকেই বোধহয় খাজনা আদায়েও মন্দা চলছে। উপরন্তু হেমকান্ত পাওনা আদায়ে পটু নন। গত বছর দুয়েকের মধ্যে কম করেও তিনটে মহাল হেমকান্ত প্রায় জলের দরে ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন কোনও বন্দোবস্তও হয়নি। কয়েকটা মোকদ্দমা হেরে গেছেন। তদবিরের অভাবে।

শচীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মুহুরি রাখাল বলল, শচীনবাবু, এখনও কিছু মুখে দিলেন না।

দিচ্ছি। শচীন হাসিমুখেই বলে। তারপর আবার কাগজপত্রে ডুব দেয়। হেমকান্তর নায়েবমশাই বুড়ো মানুষ। রাতে চোখে ভাল দেখেন না বলে এসময়টায় আসেনও না। একটা ছুটির দিনে এসে তার সঙ্গে সকালের দিকে বসা দরকার।

শচীন কাজ রেখে খাবারের ঢাকনা খুলল। বিশাল আকারের গোটা আষ্টেক মিষ্টি, কমলা লেব, ক্ষীর, নাড়ু, এক বাটি পায়েস। এত খেতে পারে নাকি কেউ! রোজই সে অর্ধেকের ওপর পাতে ফেলে রেখে যায়। কমিয়ে আনতে বললে কেউ গা করে না। অপচয় এদের গায়ে লাগে না। বোধহয়। কিন্তু সে গরীব ঘরের ছেলে, তার লাগে।

বড় কষ্টে মানুষ হয়েছে তারা। শচীনের বাবার আইনের ব্যবসা জমতে সময় লেগেছিল অনেক। সে যে-বাড়ির জামাই হতে চলেছে সেই বাড়ির অনেক দাক্ষিণ্য তাদের এক সময় হাত পেতে নিতে হয়েছে।

শচীন সেসব ভোলেনি।

খাওয়া শেষ করে কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতে বলে শচীন ওঠে।

রাখাল বলে, একবার মনুদিদির সঙ্গে দেখা করে যাবেন। ঠাকুরবাড়িতে আপনার জন্যই বসে আছেন।

শচীন অবাক হল না। মনুদিদি অর্থাৎ রঙ্গময়ীর সঙ্গে তার বেশ সহজ সম্পর্ক। ইদানীং বিয়ের সম্বদ্ধ হওয়াতে মনুদিদি প্রায়ই যায় তাদের বাড়িতে। বয়সে তার চেয়ে বেশী বড় নয়, তাই তাদের মধ্যে কিছু ঠাট্টা ইয়ার্কিও হয়।

শচীন ঠাকুরমণ্ডপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে একবার বাড়ির দিকে চাইল মস্ত বাড়ি। অনেক জানালা দরজা, বহু ঘর। কোথায় বিশাখা আছে কে জানে। বুকের মধ্যে একটা উদ্বেল রহস্যময় আনন্দ সে টের পায়। বিশাখা কি তাকে লক্ষ্য করে?

আরতি হয়ে গেছে। ঠাকুর মণ্ডপ জনশূন্য। সামনের বিশাল বারান্দায় একা রঙ্গময়ী বসে আছে। মুখখানা গম্ভীর। শচীনকে দেখে অবশ্য মুখে হাসি ফুটল। বলল, এসো।

শচীন জুতো খুলে বারান্দায় উঠে সিঁড়িতে পা রেখে বসল।

দু চারজন এসময়ে চরণামৃত আর ঠাকুরের আশীর্বাদী ফুল নিতে আসে। রঙ্গময়ী পাশে তামার কোষাকুষি আর পরাত নিয়ে বসা। অভ্যাসবশে একটু চরণামৃত দিল শচীনকে। তারপর বলল, এস্টেটের অবস্থা কি খুব খারাপ?

খুব নয়। তবে খারাপই। ঠিকমতো দেখাশোনা হচ্ছে না।

রঙ্গময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এরকমই তো হওয়ার কথা। কৃষ্ণর বাপের তো বিষয়ে মন নেই।

তা জানি।

এখন তুমি ভরসা। যদি একটু সামলে দিতে পারো।

শচীন হেসে বলল, আমি উকিল মানুষ। জমিদারীর কী বুঝি? এসব সামলানোর জন্য পাকা লোক দরকার।

সে আর কোথায় পাওয়া যাবে? কৃষ্ণর বাপ তোমার ওপরেই নির্ভর করে আছে।

শচীন মাথা নীচু করে বলে, আমি যতটুকু সাধ্য করব।

কোরো। কৃষ্ণর বাপের পক্ষে কিছুই সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এমন মানুষ কাছা দিতে কোঁচা খুলে পড়ে। দায়-দায়িত্বও কিছু কম নয় মাথার ওপর। মেয়ের বিয়ে বাকি, একটা ছেলে এখনো মানুষ হয়নি। ঠাটবাটও তো রাখতে হয়।

তা তো ঠিকই। তবে এখনই খুব একটা দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আদায়টা ঠিকমতো করতে হবে। মাঝে মধ্যে ওঁর একটু মহালে যাওয়া উচিত। প্রজারা এতে খুশি হয়।

সে কি আর উনি যাবেন?

যেতে পারলে ভাল।

তুমি বুঝিয়ে বোলো। উনি তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

শচীন পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে দেখে নিল। রাত হয়েছে।

রঙ্গময়ী বলল, একটু বোসো। তোমার সঙ্গে আমার দু একটা কথা আছে।

বলুন।

এখানে যদি তোমার বিয়ে হয় তাহলে কি রাজেনবাবু খুব বেশী দাবী-দাওয়া করবেন?

শচীন একটু অবাক হয়। এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কথা তার নয়। মাথাটা নামিয়ে বলল, বাবার সঙ্গেই এ নিয়ে কথা বলবেন।

সে তো বলবই। তবে তুমি নিজে তো এস্টেটের অবস্থা দেখতেই পাচ্ছো। উনি কতটা খরচ করতে পারবেন তার একটা আন্দাজও নিশ্চয়ই হয়েছে।

শচীন একটু হেসে মাথা নেড়ে বলে, মনুদি, এসব নিয়ে কথা বলতে আমি পারব না।

রঙ্গময়ী একটু চুপ করে থেকে বলে, আমার ভয় কী জানো? দাবী-দাওয়া বেশী হলে না আবার বিয়েটাই ভেঙে যায়।

শচীন খুব গম্ভীর মুখে নিজের হাতের তেলো দেখতে লাগল।

রঙ্গময়ী হঠাৎ বলে, কোকাবাবুর এক নাতি আছে। শরৎ। তাকে চেনো?

শরৎকে চিনব না কেন? আমার চেয়ে বয়সে কিছু ছোটো। খুব চিনি।

কেমন ছেলে?

ভালই তো।

শুনি, ছেলেটার স্বভাব তেমন ভাল নয়।

কেন, খারাপ কিসের?

শুনেছি, মদ-টদ খায়।

সে জমিদারের ছেলেদের একটু ওসব দোষ থাকেই।

কই, এই বংশের কেউ তো খায়নি।

শচীন বলে, এ বাড়ি হয়তো অন্যরকম। হঠাৎ শরতের কথা উঠছে কেন?

রঙ্গময়ী কথাটার জবাব চট করে দিল না। সময় নিল। তারপর আস্তে করে বলল, শরতের সঙ্গে কি তোমার ঘনিষ্ঠতা আছে?

না। ওর দাদা আমার সঙ্গে পড়ত। কখনো কখনো ওদের বাড়িতে গেছি।

রঙ্গময়ী একটা শ্বাস ফেলে বলে, ও তরফ থেকেও বিশাখার সম্বন্ধ এসেছে। আমাদের কারো ইচ্ছে নেই অবশ্য।

শচীনের বুকের মধ্যে একটু দুরদুর করে উঠল। শরতের সঙ্গে বিশাখার বিয়ে? এ কি ভাবা যায়?

শচীনের মুখখানা ম্লান হয়ে গেল। শুধু বলল, ও।

তুমি কর্তার সঙ্গে দেখা করে যাও।

শচীন উঠে দাঁড়াল। অপমানে তার মুখচোখ গরম। গায়ে জ্বালা। যদিও সে জানে, রঙ্গময়ী তাকে অপমান করার জন্য কথাটা বলেনি। কিন্তু পণের কথাটাই বা উঠছে কেন! এরা কি শরতের কথাই ভাবছে তাহলে?

শচীন অন্ধকার বারবাড়ির মাঠটা পেরোতে পেরোতে খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বিয়ে তার অনেক আগেই হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করবে না বলে জিদ ধরায় হয়নি। এতদিন বাদে সে তৈরি হয়েছিল সংসারী হতে। বিশাখার সঙ্গে প্রস্তাব আসায় খুশি হয়েছিল সে। বড় সুন্দরী মেয়ে। সেই প্রস্তুত মনটাকে কি ভেঙে দেবে এরা?

ভারী দোলাচল তার মনের মধ্যে।

হেমকান্ত নীচের মস্ত বৈঠকখানায় বসে আছেন। নিষ্কর্মা পুরুষদের শচীন সহ্য করতে পারে না। কিন্তু হেমকান্ত সম্পর্কে তার একটু দুর্বলতা আছে। এ লোকটাও নিষ্কর্মা বটে, কিন্তু এঁর হৃদয়ের রংটি শুভ্র। রঙ্গময়ীর সঙ্গে এঁর প্রেম নিয়ে কিছু মুখরোচক গুজব বাজারে চালু আছে বটে, কিন্তু সেই গুজবও বুড়ো হয়ে মরতে চলল। এখন আর ও নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

হেমকান্ত একটা মস্ত ডেক চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। অবসর সময়ে বসে বইটইও বড় একটা পড়েন না। চুপচাপ বসে থাকেন। কাজ ছাড়া একটা লোক কী করে আয়ুর বিপুল সময় কাটায় তা শচীন ভেবেই পায় না।

হেমকান্ত একটু নড়ে বসে বললেন, এসো।

শচীন বসার পর হেমকান্ত জিজ্ঞেস করেন, কাগজপত্র সব দেখেছো?

সব দেখা হয়নি। তবে কাজ অনেকদূর এগিয়েছে।

কেমন বুঝছো?

শচীন বলল, আপনার দুই ভাই না থাকায় জমিদারীটা ভাগ হয়নি। তা সত্ত্বেও অবস্থা কেন এত খারাপ হল সেটাই প্রশ্ন।

হেমকান্ত বললেন, আমি আমার বউদিকে কিছু দিতে চেয়েছিলাম। সেটা কি সম্ভব?

দিতে চাইলে দেবেন। তাতে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। তবে তদারকি দরকার।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বলেন, কে করবে? ছেলেরা কাছে থাকে না। আমার ওসব ভাল লাগে না। বেচে দিলে কিরকম দাম পাওয়া যাবে বলতে পারো?

বেচে দিতে চাইছেন?

রেখে কী হবে? নগদ টাকাটা ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে কাশী-টাশী কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবছি।

শচীন চুপ করে রইল।

হেমকান্ত আবার জিজ্ঞেস করেন, কত দাম উঠবে বলে মনে হয়?

ঠিক এখনই বলা যাবে না। অ্যাসেসমেন্ট করাতে হবে। তবে যা মনে হয় দাম খুব খারাপ হবে না।

হেমকান্ত চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ বাদে বললেন, সংসার বড় খারাপ জায়গা। বুঝলে; আমি যে এত গা বাঁচিয়ে চলি তবু সংসারের ধুলো কাদা নিত্যদিন আমার গায়ে এসে লাগে।

শচীন এ-কথার কী জবাব দেবে। এ তো বিক্ষুব্ধ মনের স্বভাবোক্তি। সে বড় জোর প্রতিধ্বনি করতে পারে। কিন্তু সেটা মিথ্যাচার হবে। সংসার সম্পর্কে অতটা তিক্ততা তার এখনো আসেনি।

হেমকান্ত শচীনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার বাবাকে আমি একবার আসতে বলে পাঠিয়েছি। আমার খুব ইচ্ছে, তোমার সঙ্গে বিশাখার বিয়ে হোক। এ বিয়েতে তুমি বাজি?

শচীন মাথা হেঁট করে বইল। ভিতরটা দুলছে। বিশাখা যদি তার বউ হয় তবে খুবই খুশি হয় সে। কিন্তু কথাটা তো মুখ ফুটে বলা যায় না। উপরন্তু রঙ্গময়ীর কথার মধ্যে একটু অন্যরকম আভাস পাওয়ায় কাজটা আরও শক্ত হয়েছে। কী জবাব সে দেবে।

হেমকান্ত বললেন, লজ্জা পেও না। আমি সনাতনপন্থী বটে, কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকেই জানি পাত্র পাত্রীর অমতে তাদের বিয়ে হওয়া উচিত নয়।

শচীন বুদ্ধিমান ছেলে। জবাবটা ঘুরিয়ে দিল। বলল, আপনি বাবার সঙ্গে কথা বলুন।

তোমার তাহলে অমত নেই?

না।

আমার মেয়েটি বোধ হয় দেখতে খারাপ নয়। তুমিও তাকে দেখে থাকবে। কিন্তু চেহারাই তো সব নয়। লেখাপড়া শেখেনি, ঘরবন্দী জীবন কাটিয়েছে। কাজেই মনটাও হয়তো একটু সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি কানে কবি, উদারচেতা, চরিত্রবান পাত্রের হাতে পড়লে তার মনের পরিবর্তন ঘটতে দেরী হবে না।

শচীন এ বিষয়ে কী আর বলবে? চুপ করে রইল।

হেমকান্ত নিজেই আবার বলেন, আমার রক্ত তো ওর গায়ে আছে। তুমি অনেকক্ষণ পরিশ্রম করেছো। এবার এসো। গাড়িটা বরং তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসুক।

তার দরকার নেই। আমার সাইকেল আছে।

বিষয় সম্পত্তি বিক্রি করে দেবো না রাখব তা নির্ভর করছে তোমার মতামতের ওপর। আমার খুব ইচ্ছে, বিশাখার সঙ্গে তোমার বিয়ে হওয়ার পর এই এস্টেটের সবরকম ভার তুমিই নাও। ছেলেরা যদি কখনো আগ্রহী হয় ভাল। না হলে বরাবর তুমিই সব দেখবে, ভোগ করবে।

শচীন নিজের ভিতরে খানিকটা রক্তোচ্ছ্বাস টের পেয়ে ধীরে ধীরে উঠল। একটু মাতাল-মাতাল লাগছিল তার।

বার বাড়িতে এসে সে অন্ধকারে তার সাইকেলে উঠে পড়ল।

শচীন লক্ষ্য করল না দোতলার বারান্দা থেকে এক জোড়া চোখ খুব সর্পিল দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল তাকে। বিশাখা।

বিশাখা জানে, আজ শচীন বাড়ি ফিরেই সুফলার কাছে বিকেলের বৃত্তান্ত শুনবে। বিয়েটা হয় তো তবু ভেঙে যাবে না। কিন্তু ধাক্কা খাবে। দ্বিধা দেখা দেবে, সন্দেহ আসবে।

একজন দাসী এসে খবর দিল, কর্তাবাবু ডাকছেন।

বিশাখার মুখটা শুকিয়ে গেল। কিন্তু বুক দুর দুর করল না। প্রকৃত পক্ষে ইদানীং তার ভয়টয় কমে যাচ্ছে। বাবার প্রতি তার কিছু সমীহ ছিল। কিন্তু আজ কাল আর ততটা নেই। বাবার কান্ডজ্ঞান সম্পর্কে তার সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তার দিদিদের দুজনেরই জমিদার বাড়িতে বিয়ে হয়নি বটে, কিন্তু যোগ্য ঘরে হয়েছে। শুধু তার বেলাতেই বাবা কেন যে হাঘরে একটা পরিবারকে বেছে বের করলেন তা কে জানে।

বিশাখা নীচের বৈঠকখানায় কুন্ঠিত পায়ে ঢুকে বলল, আমাকে ডেকেছেন?

হেমকান্ত স্নেহের স্বরে বললেন, এসো বোসো আমার কাছে।

বিশাখা ডেকচেয়ারের পাশে একটা টুল টেনে এনে বসে।

হেমকান্ত হেসে বললেন, আর একটু কাছে এসো। আমার মাথাটা একটু চুলকে দাও।

বিশাল একটু অবাক হয়। জীবনেও বাবা তাকে বা আর কাউকে নিজের কোনোরকম সেবা করতে ডাকেননি। এই প্রথম।

বিশাখা একটু হাসল। বাবা খুব দূরের মানুষ। অচেনার এক অস্পষ্ট ঘেরাটোপে আবৃত। কখনো কখনো বাবাকে তার রক্তমাংসের মানুষ বলেই মনে হয় না। ব্যথা, বেদনা, ক্লৈব্য, আকাঙক্ষা কিছুই যেন নেই। এ কেমন পাথরের মানুষ!

আজ সে বাবার মাথায় ঘন চুলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে এক অদ্ভুত আনন্দ পেল। রক্ত যেন কথা বলে উঠল রক্তের সঙ্গে। সে যে এই মানুষেরই অভ্যন্তর থেকে জন্মলাভ করেছে সেই সত্য সামান্য এই স্পর্শে যেন উন্মোচিত হয়ে গেল।

সযত্নে সে বাবার চুলের গোড়ায় নরম আঙুলে চুলকে দিতে লাগল। হেমকান্ত আরামে চোখ বুজলেন। তার পর বললেন, পাকা চুল হয়েছে নাকি? মাথাটা খুব চুলকোয় আজকাল।

বিশাখ মাথা নেড়ে বলে, না তো! আপনার মাথায় একটাও পাকা চুল নেই।

কী করে বুঝলে? খুঁজে তো আর দেখনি!

কাল দেখে দেবো। দুপুরে। কিন্তু অমনিও মাঝে মাঝে চুলের গোড়া চুলকোয়। খুসকি হয়েছে বোধ হয়।

তাও হতে পারে। তবে বয়সও হল, চুল পাকলেও বলার কিছু নেই।

হেমকান্ত কথাটা বলে একটু প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন। বিশাখার হাতের চুড়ির মৃদু শব্দ হচ্ছে।

হেমকান্ত বললেন, এবার তোমাদের একটা ব্যবস্থা করে ফেলতে পারলেই আমি নিশ্চিন্ত হই। বুঝলে, তোমার মা নেই, তার কর্তব্য তো আমাকেই করতে হবে।

বিশাখা কী বুঝল কে জানে; তবে তার চুড়ির শব্দ বেড়ে গেল।

হেমকান্ত বললেন, বয়সকালে মেয়েদের পাত্রস্থ করা অবশ্যই কর্তব্য। সে কাজে আর দেরী হওয়া উচিত নয়।

বিশাখা চুপ।

হেমকান্ত মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রেখে বললেন, বিয়েতে আমি পাত্র ও পাত্রী দুজনেরই মতামতে বিশ্বাস করি। তবে মত দেবে খুব ভেবে চিন্তে, সব দিক বিবেচনা করে। বর্ণ, বংশ, বিদ্যা, চরিত্র, স্বাস্থ্য সব দিক দিয়েই বিচার করা দরকার। তোমার কোষ্ঠী আমি বিচার করতে পাঠিয়েছি। সেটার ফলাফলও জানতে হবে। যোটক বিচার সবার আগে।

বিশাখার ভ্রূ কুঁচকে যাচ্ছে। মুখে রক্তোচ্ছ্বাস। বাবা কি এবার পাত্রর কথা তুলবেন?

হেমকান্ত তুললেন। আস্তে করে বললেন, পাত্রের জন্য আমি বেশী খোঁজাখুঁজি করিনি। শেষ অবধি সর্বত্রই ভাগ্য জয়ী হয়। মানুষ তার সাধ্যমতো বিচার বিবেচনা করে বটে, তবু ভাগ্যের হাতেই পরিণতি। তুমি অবশ্য প্রশ্ন তুলতে পারো, আমি কেন কোনো জমিদার বাড়িতেই তোমার বিয়ের সম্বন্ধ করলাম না। তার কারণ, আমি নিজে জমিদার। আমি জানি, জমিদারীর আয় সম্পর্কে এখন আর নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। একটা সংকট চলছে। আমাদেরও চলছে। সেদিন কোকাবাবুদের নায়েবের কাছে শুনলাম, ওদেরও মহাল বিক্রি হবে। কারোই অবস্থা খুব ভাল যাচ্ছে না।

বিশাখা চুপ করে রইল। হাত কিছু শ্লথ।

হেমকান্ত বললেন, তাই আমি নিউ জেনারেশনের মধ্যে পাত্র খুঁজছিলাম। এমন পাত্র যে স্বনির্ভর, লড়াই করতে জানে, দুনিয়াটাকে চেনে। বুঝেছো?

বিশাখা ‘হুঁ’ দিল।

হেমকান্ত খুশি হয়ে বললেন, আমি আর একটা জিনিসকেও খুব মূল্য দিই। চরিত্র। পুরুষ মানুষের ওটা বড়ই দরকার।

বিশাখা চুপ করে রইল। তবে মনে মনে খুশি হল না। সে তার বাবাকে জানে। চরিত্রবান হিসেবে একসময়ে তাঁর খ্যাতি ছিল। এখন নেই। পুরুষ মানুষের চরিত্রটা কোনো স্থায়ী সত্য নয়। তা বদলায়।

হেমকান্ত বললেন, আমি রাজেনবাবুর ছেলে শচীনকে পাত্র হিসেবে স্থির করেছি। এখনো কথা দিইনি। তুমি একটু ভেবে আমাকে মতামত দিও। আগেই বলেছি, আবার বলছি, অমত থাকলে আমার শত পছন্দ হলেও বিয়ে দেবো না। নিজের মুখে যদি জানাতে লজ্জা পাও তো মনুকে বোলো।

বিশাখা শ্বাসটুকু পর্যন্ত ভাল করে ছাড়ছিল না।

হেমকান্ত বললেন, ছেলেটি কতদূর ভাল তা হয়তো এখনই বোঝা যাবে না। ঘর করলে বুঝতে পারবে। এখন যাও মা, আমার মাথা আর চুলকোতে হবে না।

বিশাখা ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ওপরে উঠে এল।

আজকাল কৃষ্ণকান্ত তাকে ‘শচীরানী’ বলে খ্যাপায়। সে রাগে। কৃষ্ণকান্ত মাষ্টারমশাইয়ের কাছে পড়া শেষ করে সদ্য ওপরে উঠে এসেছে। বইপত্র টেবিলে ঝড়াক করে ফেলে দিয়ে বলল, এই শচীরানী, গোছা তো!

বিশাখা আচমকা ঠাস করে তার গালে একটা চড় কষাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *