২৭ জুন, রবিবার ১৯৭১
সকাল থেকে শরীর খারাপ। সেই সঙ্গে থেকে থেকে পাঁজরে ব্যথা। লোহার সাঁড়াশি দিয়ে পাজর চেপে ধরার ব্যথা। নিঃশ্বাস নিতে পারি না।
ডি.সি.জি.আর-এ (ঢাকা ক্লাব জিমখানা রেসেস) কি যেন কাজ পড়েছে, শরীফ নাশতা করে সেখানে গেছে। আমার কিছু ভালো লাগছে না, তাই একটা নতুন কাজ নিয়ে বসেছি। বাড়ির যত তালা–নতুন, পুরনো, ছোট, বড়, জংধরা, বিকল–সব নিয়ে বসেছি। প্রায়, প্রায়ই গুজবের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে–মোহাম্মদপুর-মিরপুর থেকে বিহারিরা দলে দলে বেরিয়ে পড়ে এদিকপানে আসবে। একটা তাৎক্ষণিক হৈচৈ পড়ে যায় চারপাশে। বন্ধুবন্ধব, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ফোন করা বেড়ে যায়, সবাই নিজ নিজ বাড়ির দরজা-জানালার হুক-হুড়কো দেখে, ঠিক না থাকলে মিস্ত্রি ডেকে মেরামত করায়। আমাদের বাড়ির দুটো সদর দরজার পাল্লাই বেশ পলকা ওগুলো ফেলে ভারি পাল্লা বানানো দরকার। আমাদের পুরনো কাঠমিস্ত্রি চৈতন্যকে খবর দেওয়া হয়েছে কিন্তু তার কোনো হদিস নেই। মনেহচ্ছে নিউ মার্কেট থেকে মুসলমান কাঠমিস্ত্রি এনে কাজ করাতে হবে। এখন তালাগুলো নিয়ে বসেছিল। জংধরা তালায় তেল দিয়ে, চাবি ঠিকঠাক করে, ডুপ্লিকেট চাবি আলাদাকরেসব হিসাবমতো বিভিন্ন রিঙয়ে লাগিয়ে সিজিল করে রাখলাম।
শরীফ ফিরল সন্ধ্যা পার করে। এসেই বলল, তৈরি হও। বাঁকার বাসায় যেতে হবে।
কেন, কি ব্যাপার?
বাঁকা ফোন করেছিল। কি যেন জরুরি ব্যাপার। ফোনে বলা যায় না।
বাঁকার বাসায় গেলাম। খালেদ মোশাররফের চিঠি নিয়ে দুটি মুক্তিযোদ্ধা ছেলে গতকাল বিকেলে বাঁকার বাসায় এসেছিল। সিগারেটের প্যাকেটের ভেতর যে পাতলা কাগজের মোড়ক থাকে, সেই কাগজ বের করে তাতে ছোট্ট একটা চিঠি লিখে আবার সেটা প্যাকেটের মধ্যে রেখে সিগারেট ভরে রাখা হয়েছিল। এই রকম সাবধানতার সঙ্গে ছেলে দুটি খালেদের চিঠি নিয়ে এসেছিল।
শরীফ জিগ্যেস করল, হাতের লেখা চিনেছেন?
বাঁকা বললেন, হ্যাঁ, মণিরই হাতের লেখা।
কি লিখেছে মণি?
বাঁকা চিঠিটা দেখালেন। মাত্র দুটো লাইন, পত্রবাহক দুজনকে দরকার হলে কিছু সাহায্য করবেন। আমি ভালো আছি।-মণি।
শরীফ আবার জিগ্যেস করল, কি ধরনের সাহায্য চায় ওরা?
আপাতত টাকা-পয়সা।
দিয়েছেন কিছু?
না, কাল সন্ধ্যেয় এসেছিল। আজ তো রোববার। তাছাড়া তোমার সঙ্গে পরামর্শ করাও দরকার।
শরীফ বলল, মণির হাতের লেখা যখন চিনেছেন, তখন ওদের বিশ্বাস করা যায়। টাকার তো খুবই দরকার এখন ওদের।
আমি কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করলাম, ওরা দেখতে কি রকম? বয়স কত হবে? কেমন পোশাক পরে ছিল?
একজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের মনে হলো। আরেকজন একটু কম বয়সী। সাধারণ প্যান্ট-সার্ট পরা। লম্বা-লম্বা চুল, জুলফি, গোফ।
নাম বলেছে।
বলেছে। একজনের নাম শাহাদত চৌধুরী। সে আরেকটা হোট স্লিপ দেখাল, তাতে মণি তাকে অথরিটি দিয়েছে–সেক্টর টু-এর তরফ থেকে সে ঢাকায় প্রয়োজনমত সব ধরনের যোগাযোগ করতে পারবে। স্লিপটাতে আবার খালেদের সিল মারা আছে। কমবয়সী ছেলেটার নাম আলম।
শরীফ বলল, তাহলে তো সন্দেহ করার কোনো অবকাশই নেই। কিছু টাকার যোগাড় রাখতে হবে। যখনই আসে, দিয়ে দেবেন।
বাড়ি ফিরে সারারাত ঘুম হলো না। সেক্টর টু থেকে দুজন মুক্তিযোদ্ধা এসে বাঁকার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে! খালেদ মোশাররফ সেক্টর টুতে যুদ্ধরত। মনে হচ্ছে–এতদিনে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আমাদেরও একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে গেল।