1 of 2

২৬. ভিনোদের বাড়ি নিমন্ত্রণ ছিল

২৬

গতকাল রাতে ভিনোদের বাড়ি ওদের নিমন্ত্রণ ছিল। মানে, ককটেইলস এণ্ড ডিনার। মান্দলা, মুক্কী, মালাঞ্জখণ্ড থেকে হোমরা-চোমরা অনেকেই এসেছিলেন। সফিস্টিকেটেড ককটেল পার্টি অপছন্দ নয় রুষার। ও সহ্য করতে পারে না শুধু আজে-বাজে মানুষের সঙ্গে মদ খাওয়া। মেলা-মেশা। ওর মধ্যে একটা ‘ক্লাস’-এর ব্যাপার আছে, বরাবরই। আর পৃথু হচ্ছে ‘ক্লাসলেস’। মানুষে মানুষে প্রভেদ করার শিক্ষাটা পৃথু বাবার কাছ থেকে পায়নি। সেই ঔদার্যর দাম ওকে দিতে হয় প্রতি মুহূর্তে এই তথাকথিত শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, উচ্চবিত্ত শহুরে সমাজে।

পৃথু গেছিল। রুষার পীড়াপীড়িতে। ভিনোদ যে অবিশ্বাস্যরকম বড়লোক তাই-ই নয়, ছেলেটা কিন্তু ভালও।

একদিন হঠাৎই দেখে ফেলেছিল পৃথু। বর্ষার এক বিকেলে তাদের ড্রয়িংরুমের সোফাতে বসে ভিনোদের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল রুষা। পৃথুকে আসতে দেখে লজ্জা পেয়ে এক লাফে সরে গেছিল দু পাশে ওরা। প্রথমে রেগে গেছিল কিন্তু পরমুহুর্তে খুব ভাল লেগেছিল ওর। পরস্ত্রীদের ভালবাসাটা শীতের শেষ বিকেলের রোদের মতো। পরপুরুষকে উষ্ণতাতে একটুক্ষণ ভরে দিয়েই মরে যায়। তবু, তার দামও হয়ত অনেক। ওদের দুজনের মধ্যে যে এক মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে—এ কথা বুঝতে পেরে পৃথুর খুবই ভাল লেগেছিল। এই নিষ্ঠুর, নির্মম, প্রেমহীন পৃথিবীতে কারও বুকে যদি অন্য কারও প্রতি একটুও প্রেম থাকে তো তা জেনেই পৃথুর হৃদয় এক মহৎ বোধে ভরে ওঠে। ও জানে যে, ওর নিজের মধ্যে এমন রূপ বা গুণ নেই যে, রুষার শরীর-মনের সব চাওয়াকে সে পূর্ণ করতে পারে। শুধু ওরই কেন, পৃথিবীর কোনও স্বামীরই হয়তো নেই। তা কেউ স্বীকার করুন আর নাই-ই করুন।

ওদের দুজনের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক আছে একথা বিশ্বাস হয় না পৃথুর। শরীরকে এনে ফেলে সুন্দর প্রেমকে আবিল করে ফেলার মতো বোকা, রুষার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে কখনওই হবে না বলেই ওর মনে হয়। আগে আগে এসব ভেবে উত্তেজিত বোধ করত একটু। এখন খুশিই হয়। আহা! বেচারি রুষা! তুমি খুশি থাকো। তুমি খুশি থাকলেই আমি খুশি। কী ভাবে এবং কোন পথে তুমি খুশি হচ্ছ, তা আমার জানার দরকার পর্যন্ত নেই। খুশি থাকো গো। সবাই খুশি থাকুক। খুশিতে ভরে উঠুক এই খুশিহীন পৃথিবী। আনন্দম। আনন্দম। আনন্দম। দুদিনের এই জীবন। এসেই তো চলে যাওয়া। নিয়ে-দিয়ে, দিয়ে-নিয়ে ভরপুর করে রেখে সুধন্য করো সকলে, একে অন্যকে। প্রত্যেক তপতীরা আর সুধন্যরা। এবং বেড়ালরাও। শুধু বেড়ালরাই বা কেন? ইঁদুররাও। এমনকী শুয়োররাও। আনন্দম। আনন্দম। আনন্দম। এই-ই পৃথুর মনের কথা। অন্তরের কথা।

মেরী চা দিয়ে গেছিল।

লেখার টেবলেই বসে ছিল পৃথু। বৃষ্টির পরে বাড়ির পেছনের ঝাঁটি-জঙ্গল থেকে একা তিতির ডাকছে শীর্ণা গায়িকার মতো গলার শির ফুলিয়ে। দুটো ফ্লাই-ক্যাচার পাখি উড়ে উড়ে ফড়িং ধরছে। মনে হচ্ছে, চিতল হরিণের ঝাঁকে চিতা পড়েছে চকিতে। বৃষ্টির পরের উজ্জ্বল আলোয় শয়ে শয়ে ফড়িং উড়ছে আকাশ হলুদ করে। চামারটোলির দিক থেকে একটা মোষ ডেকে উঠল।

আজ সকাল থেকেই কুর্চিকে বড় মনে পড়ছে পৃথুর। ন’মাসে ছ’মাসে এরকম হয়। যখন হয়, তখন মন বড়ই উচাটন লাগে। ভেজা স্মৃতির ঝোড়ো হাওয়ায় উথাল-পাথাল গাছের মতোই উথাল-পাথাল করে ওর উদলা মন।

কুর্চি যে-ক’দিন একা ছিল এবং নিমন্ত্রণও জানিয়েছিল যাওয়ার জন্যে; তখন যায়নি পৃথু। যায়নি, কারণ ও নিজেকে জানে। কতখানি সংযম অথবা মহত্ত্ব ওর মধ্যে অকুলান হবে না সে সম্বন্ধে ওর স্পষ্ট ধারণা নেই। একা-বাড়িতে কুর্চিকে পেলে ও নিজেকে হয়তো হারিয়ে ফেলবে।

একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। ফিরে আসছে ওরা। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। এস ডি ও খাণ্ডেলওয়াল সাহেবের কালো কুচকুচে যুবতী আয়া, সাদা ধবধবে জোয়ান অ্যালসেশিয়ান কুকুরটিকে শীতের বৃষ্টি-ভেজা প্রকৃতির মধ্যে নিয়ে গেছিল মুক্তির স্বাদ দিতে। তারা এখন ফিরে আসছে। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। ভিজে-যাওয়া, পাতা-ঝরা শাল-সেগুনের শাখা-প্রশাখায় বৃষ্টি-শেষের শীতার্ত রোদের ছোঁয়া লেগেছে। লাল মাটির পথ থেকে হেমন্তর গায়ের সোঁদা সোঁদা গন্ধ উড়ছে। ঝাঁটি-জঙ্গলে তিতিররা পাগলের মতো ডাকাডাকি করে চলেছে। আর এই পটভূমির মধ্যে অনন্ত যৌবনের দুটি প্রতীকেরই মতো সাদা কুকুর আর কালো মেয়েটি যেন দিনান্তবেলার দিগন্তলীন কুয়াশার মেঘের মধ্যে দিয়ে ভেসে আসছে সন্ধ্যাতারার স্নিগ্ধসবুজ দীপজ্বালানো লালের ছোঁয়া-লাগা পশ্চিমাকাশের আঙিনা থেকে নেমে। দূর থেকে মনে হচ্ছে, ওরা যেন মর্ত্যলোকের কেউ নয়।

কখনও কখনও কোনও কোনও দৃশ্য মনের চোখে, অথবা চোখের মনে এমনি করেই গেঁথে যায়। গেঁথে থাকে। জীবনের শত আবিলতাতেও তা ম্লান হয় না। আজ বৃষ্টিশেষের শেষ বিকেলের এই দৃশ্যটি অনেকটা সেই রকমই। গেঁথে থাকবারই মতো।

লেখার প্যাডটি বের করে কলমের বাক্স খুলল পৃথু।

এই কলমগুলোই ওর প্রাণ। কুর্চির অদেখা, কিন্তু কল্পিত নগ্নতারই মতো এরা প্রত্যেকে খুব দামী ওর কাছে।

ওর প্রিয়তম কলমটি খুলে চিঠি লিখতে বসল পৃথু কুর্চিকে।

হাটচান্দ্রা, রবিবার

বাইশে

কুর্চি,

মালাঞ্জখণ্ড-এ যাওয়ার আগে তুমি আমাকে এবারে জানিয়ে যাওনি। তাই-ই, কালকে রায়নাতে গিয়েও ফিরে এলাম। বাসে করেই গেছিলাম। রুষারা মহিলা সমিতির তরফ থেকে জবলপুরে গেছিল গাড়িটি নিয়ে। ও এবং অন্য কয়েকজন। ওঁদের মধ্যে মিসেস সেনকে তুমিও চিনবে। অন্যদের নাও চিনতে পার।

রায়না থেকে ফিরে এসে খুবই খারাপ লাগছিল। ভেবেছিলাম, সারাটা দিন তোমার কাছেই কাটাব। অনেক গল্প শুনব। গান শুনব। গান গাইব দুজনে মিলে। পুরনো দিনের মতো।

তোমার জন্যে লাড্ডুর দোকানের লাড্ডুও নিয়ে গেছিলাম। দাঈ দিয়েছিল নিশ্চয়ই তোমাকে।

খুবই ইচ্ছে করে এক সন্ধেতে তোমার ওখানেও লাড্ডুর গানের মজলিস বসাই। তোমার পরিচিতদের মধ্যে মালাঞ্জখণ্ড, জবলপুর, মান্দলা, এবং সীওনীতেও ক্লাসিকাল গান যাঁরা ভালবাসেন, এমন অল্প কয়েকজনকে ডেকো। খুবই অল্প কয়েকজনকে। ভিড় হয়ে গেলে রাজনৈতিক সভা হয়, গানের ম্যায়ফিল হয় না। অন্য কেউ বুঝুক না বুঝুক, তুমি অন্তত বোঝো যে গানের সঙ্গে প্রাণের যোগ কতখানি। আমাদের পরিচিতদের মধ্যে অনেক মানুষকেই গান নিয়ে মাতামাতি করতে দেখি, বিজ্ঞর মতো ‘কেয়াবাৎ’ ‘কেয়াবাৎ’ বলে মাথাও নাড়তে দেখি কিন্তু অতি স্বল্পজনেরই মধ্যে গানকে হৃদয় দিয়ে ছোঁবার মতো গভীরতা আছে। অথচ এই কেয়াবাৎওয়ালারাই দলে ভারী। দুঃখ এটাই।

আমাদের লাড্ডু ওরফে, কুমার সরজুনারায়ণ কিন্তু ক্ষণজন্মা মানুষ। ওর গলার. এবং গায়কীর সঙ্গে বড়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেবের ছেলে মুনাব্বর খাঁ সাহেবের গলার এবং গায়কীর সঙ্গে আশ্চর্য মিল আছে। অথচ হতভাগা নাকি তালিম নেয়নি কারও কাছেই। বিশ্বাস করো। এযুগেও কি আরেকজন মৌজুদ্দিন এসে হাজির হল?

তুমি লাড্ডুর গান না শুনলে সত্যিই হারাবে কিছু জীবনে। আগামী মাসে গিরিশদার বাড়িতে নাকি আরেকদিন হবে ম্যায়ফিল। তুমি ও ভাঁটু যদি আসতে চাও তাহলে আগেই জানিও। রুষা অবশ্য যাবে না। এই সরজুনারায়ণই যদি ভোপালের রবীন্দ্রভবনে গাইত তবে রুষা প্রথম সারিতে বসে শুনত তার গান। গিরিশদার বাড়িতে লাড্ডুর গানের তো সামাজিক মূল্য নেই। যে-কোনও আলো-ঝলমল রঙ্গমঞ্চে প্রথম কয়েকটি সারিতে গান, বাজনা, নাটক দেখতে যাঁরা সেজেগুজে বসে থাকেন তাদের মধ্যে বেশিই রুষারই মতো। নামকরা মঞ্চর নামকরা শিল্পীর অনুষ্ঠানে সবচেয়ে দামি টিকিট কেটে দেখতে বা শুনতে না গেলে তাঁদের স্ট্যাটাস থাকে না!

বললে, হয়তো ভাববে, বানিয়ে বলছি; পরশু রাতে তোমাকে স্বপ্ন দেখেছিলাম বলেই কাল মিষ্টি নিয়ে গেছিলাম তোমার কাছে।

আমার মা বলতেন, কাউকে স্বপ্ন দেখলেই মিষ্টি খাওয়াতে হয় তাকে। রুষা বলে, শুধু মরার স্বপ্ন দেখলেই খাওয়াতে হয়। জানি না। তবে তোমার মরার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবি না কখনও। তুমি না থাকলে, আমার যে কী হবে, তাই-ই শুধু ভাবি মাঝে মাঝে। মনের মধ্যে যখন ঝড় ওঠে, আমার পরিবেশ, জীবন, জীবনযাত্রা, সব কিছু সম্বন্ধেই যখন বড়ই বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠি; তখন একমাত্র তোমার কাছে গিয়ে একটু বসলেই শান্তি পাই। তুমি নূতন প্রাণ দাও আমাকে। ফুরিয়ে-যাওয়া আমাকে নবীকৃত করো।

ক’দিন ধরেই খুব ইচ্ছে করে, অনেকদিন পর তোমার গলায় আমার প্রিয় দুটি গান শুনি। খালি গলায়। “তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, তখন ছিলেম বহুদূরে কিসের অন্বেষণে”, আর “কে বলেছে তোমায় বঁধূ এত দুঃখ সইতে/আপনি কেন এলে বঁধু আমার বোঝা বইতে”।

আরও অনেক গানই শুনতে ইচ্ছে করে। তোমার বিয়ের পর তেমন করে আর গান শোনা হয়নি। জানি না, কবে হবে আবার। ভাঁটু কি গান ভালবাসে? রবীন্দ্রসঙ্গীত তো বাসে না বুঝলাম। অন্য গান?

চিঠি লিখতে বসার একটু আগেই মণিবাবু এসেছিলেন। তুমি কি মণি চাকলাদারকে ভুলে গেছ? বিলাসপুরের? সেই যে! ব্রাহ্ম ভদ্রলোক, সামান্য ট্যারা, খদ্দরের পায়জামা, পাঞ্জাবি পরতেন, বেসুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন এবং নাক কুঁচকে কথা বলতেন।

গিরিশদার কাছেই শুনেছিলাম যে, শান্তিনিকেতনের একটি মেয়ে মণি চাকলাদারকে অনেকদিন আশা দিয়ে শেষে ডুবিয়ে দেওয়াতেই শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে মণি চাকলাদার প্রচণ্ড নস্টালজিক।

রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দর প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া আমাদের প্রজন্মর মানুষদের পক্ষে হয়তো মুশকিলই! তবে, কোনও যথার্থ কবি বা লেখকেরই উচিত নয়, কারও দ্বারাই প্রভাবিত হওয়া। সে ব্যক্তি যত বড় প্রতিভাবানই হন না কেন! কিন্তু সাক্ষাৎভাবে প্রভাবিত না হলেও অনবধানে, অবচেতনে এক ধরনের প্রভাব নিশ্চয়ই কাজ করে। এই প্রভাবের কথাও যাঁরা অস্বীকার করেন, আমি তাঁদের দলে নই। তোমার কী মত এ ব্যাপারে?

কিন্তু মণিবাবুর ব্যাপারটা উল্টো। উনি রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অস্বীকার তো করেনই না বরং উগ্র-রবীন্দ্রভক্ত। যেসব উগ্র-ভক্ত রবীন্দ্রনাথের প্রতি অশেষ অন্যায় করেছেন অন্ধতায়, মণিবাবু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। যতি যে কোথায় টানতে হয়, তা তিনি জানেনই না। এর পর যেদিন যাব, সেদিন এ নিয়ে আলোচনা করব।

এই দ্যাখো, কোন কথা থেকে কোন কথায় এসে গেলাম। কী স্বপ্ন দেখলাম, তাই-ই বলা হল না।

তোমার মনে আছে কি না জানি না, বাবা মা নিমুকাকা এবং কাকিমার সঙ্গে আমি আর তুমি একবার মাণ্ডুতে গেছিলাম। তুমি তখন বেশ ছোট ছিলে। বারো-তেরো বছরের হবে। ইন্দোর থেকে ধার-এর বাংলোয় গেছিলাম আমরা দুটি গাড়ি করে। তারপর ধার-এর বাংলোতে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে মাণ্ডু পৌঁছলাম। বাবা সঙ্গে থাকলে খাওয়া-দাওয়াটা কী রকম চেহারা নিত ভুলে যাওনি নিশ্চয়ই!

বর্ষাকাল ছিল। বাবা বলতেন, মাণ্ডুতে বর্ষাকালেই যেতে হয়। মাণ্ডুর রূপ উপভোগ করতে হলে। সেদিন আবার ছিল পূর্ণিমা। খুব সম্ভব আষাঢ়ের পূর্ণিমা। রূপমতী মেহাল-এ যখন আমরা পৌঁছলাম তখন সন্ধে হয়ে আসছে। কিউরেটর ছিলেন বাবার বন্ধু। বললেন, ওঁর ওখানে রাতের খাওয়া সেরেই ফিরতে হবে আমাদের। নইলে যেতেই দেবেন না।

রূপমতী মেহালের ছাদে দাঁড়িয়ে আমি আর তুমি হাত ধরাধরি করে দিগন্ত অবধি ছড়ানো নিমার-এর সমতলভূমির দিকে চেয়ে রইলাম। নর্মদার উপত্যকা। যে নর্মদার নাম ছিল বহু শো বছর আগে রেওয়া। দূরে, প্রায় দিগন্তরেখার কাছে শেষ সূর্যর আলো পড়ে নর্মদাকে লুকিয়ে-থাকা এক ধূসর শঙ্খিনীর মতো দেখাচ্ছিল।

নিমুকাকা দিলরুবা বের করে ভূপালীতে সুর দিলেন, বাবা গাইলেন। সেই গানটি! মনে আছে কি তোমার?

“সব গুণী গায়ে অব প্রভুকা নাম।

প্রভুকে নাম বিন কুছ নাহি কাম॥

চঞ্চল সৈঁয়া বৈঠে মন্দির দ্বারে,

রোবত রোবত আরজ করে,

মাঙ্গত বৈকুণ্ঠ ধাম॥

সব গুণী গায়ে অব প্রভুকা নাম॥”

“সব গুণী গায়ে অব প্রভুকা নাম॥

আহা! তবলা ছিল না। ত্রিতালে গেয়েছিলেন। তাল যেন সমাশ্রিত ছিল তাঁর ভিতরে। হাঁটা চলা কথা বলা, কোনও কিছুর মধ্যেই বাবার বেতাল ছিল না কোনও। বাবার গলার স্বর এখনও আমার কানে ভাসে। কী জুয়ারি! মাও ভাল গাইতেন, কিন্তু বাবার মতো নয়। আমার বাবার মধ্যে সত্যিই অনেকগুলো মানুষ বাস করত। পরস্পরবিরোধী, উজ্জ্বল, মেধাবী সব মানুষ; একই আধারে। বাবা যখন শিকারের পোষাক পরে শিকারে যেতেন হাতে রাইফেল নিয়ে, তখন তাঁর এক চেহারা ছিল। যখন ব্যারিস্টারের পোষাক পরে ভোপালের হাইকোর্টে সওয়াল করতেন, তখন তাঁর আরেক রূপ, আরেক ব্যক্তিত্ব। আবার সেই মানুষই যখন কলিদার সাদা পায়জামার উপর চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবি পরে খসস ঈত্বরের খুশবু উড়িয়ে মুশায়রা বা কভি-দরবারে বা গান-বাজনার ম্যায়ফিলে উপস্থিত হতেন, তখন আবার তাঁর রূপ ছিল একেবারেই অন্য। এই বিভিন্ন সত্তার মানুষটি যে একই ব্যক্তি তা বোঝার উপায় পর্যন্ত ছিল না।

বিভিন্ন পরিবেশে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে বিনা আয়াসে এমন মিলে যেতে, মিলিয়ে নিতে আমি খুব বেশি মানুষকে দেখিনি। সত্যিই বলছি, কুর্চি, আমার বাবা বলে নয়; এমন মানুষের সংস্পর্শে আসা যে-কোনও লোকের পক্ষেই সৌভাগ্যর ব্যাপার ছিল। যেসব মানুষ বাবাকে এক মুহুর্তের জন্যেও দেখেছেন, তাঁরাও তাঁকে আজীবন মনে করে রেখেছেন। এমনই ছিল তাঁর চৌম্বকী ব্যক্তিত্ব। আর বাবার হাসি! কী দরাজ হাসি যে হাসতেন! রসিকও ছিলেন তেমন। কোনও অবস্থাতে, কোনও পরিবেশেই তাঁকে নিষ্প্রভ মনে হত না। এতই বেশি সারল্য ও দয়া ছিল বাবার যে, মা তাঁকে বোকা বলতেন। বাবার চরিত্রের বেহিসেবি, বেসামাল দিকটা আমিও পেয়েছি পুরোমাত্রাতে। তাই-ই, রুষা; আমার মায়েরই মতো আমাকে নিয়ে সর্বদাই চিন্তা করে। কিন্তু আমি বাবার কোনও গুণই পাইনি। এক কণাও নয়। পেয়েছি, শুধু দোষগুলোই। মদ্যপান, সংসারবিমুখতা; উড়নচণ্ডী স্বভাব, অমিতব্যয়িতা, অকারণ বিষণ্ণতা, আত্মহত্যার দুর্মর প্রবণতা।

যা আজ অবধি কাউকেই বলিনি, তা শুধু তোমাকেই বলছি। আমার বিশ্বাস হয় না বাবার মতো শিকারিকে খেতে পারে এমন বাঘ মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে পয়দা হয়েছিল। অবহেলায় ছেলেবেলা থেকেই বাঘ মেরেছেন বাবা। দু চোখ খুলে ডাবল-ব্যারেল রাইফেল দিয়ে মারতেন। যাঁরা ভাল শিকারি তাঁরা একচোখ বুজে নিশানা নেন না। দুটি চোখের মধ্যে সকলেরই একটি মাস্টার আই থাকে। চোখের সামনে একটি আঙুল তুলে ধরে দেখলেই বুঝতে পারবে এ কথা। তাঁরা দু চোখ খুলে ওই মাস্টার আই দিয়েই নিশানা নেন। অব্যর্থ নিশানা ছিল। দিনে কি রাতে। মাটিতে দাঁড়িয়েও কম মারেননি। তাই-ই, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আত্মহত্যা করার জন্যেই বাবা ইচ্ছে করে বাঘকে আহত করে নীচে নেমেছিলেন মাচা থেকে। তুমি বলতে পারো, তাহলে তো নিজের রাইফেল দিয়েই মারতে পারতেন নিজেকে। হয়তো পারতেন! কিন্তু কার মাথায় আত্মহত্যার ভূত যে কখন চাপে তা তো যাঁরা তা করেছেন তাঁরা নিজেরাই একমাত্র বলতে পারতেন। বেঁচে থাকলে।

আমিও দশ বছর বয়স থেকে শিকারে যাচ্ছি বাবার সঙ্গে। প্রথম দিনেই শিখিয়েছিলেন বাবা আমাকে, অন্ধকার হয়ে যাবার পর বাঘ আহত হলে মাচা থেকে কখনওই নামবে না। কখনও না। আর বাবা নিজেই! বিশ্বাস হয় না আমার সে জন্যেই। উনি হঠকারী ছিলেন না।

মনে আছে, তোমার মা গান ধরলেই বাবা তাঁর পেছনে লাগতেন। কাকিমার গলায় পুরাতনী ও ব্ৰহ্মসঙ্গীত খুব ভাল লাগত আমার। তুমিও কিন্তু কাকিমার ব্রহ্মসঙ্গীতের ঝাঁপি থেকে তেমন কিছুই নিলে না। আহা! কী সব গান! কী সুর!

কাকিমা গান ধরলেই বাবা ঠাট্টা করে বলতেন, ও রাণী, কোন স্কেলে ধরলে বোন? এ তো শ্রুতি। তুমি যেখানে ‘পা’ বলছ সেখানে তো কোনও স্কেলই নেই। লজ্জায় কাকিমা লাল হয়ে যেতেন। বলতেন, আবারও!

কাকিমার ওই একটিই দোষ ছিল। ছোটবেলা থেকে খালি গলায় বাজনা-ছাড়া গান গেয়ে গেয়েই গান ধরবার সময় বোধহয় অনেক সময় শ্রুতিতেই ধরে দিতেন। সামান্য সময় পরে কিন্তু নিজেই বদলে নিতেন এবং নিকটতম স্বীকৃত স্কেলে ফিরে আসতেন অতি দ্রুত। এরকম অবশ্য ক্বচিৎ কদাচিৎই হত।

অবশ্য খালি গলার গানই তো গান! আজকাল অনেক শিল্পীকে দেখি, যাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত বা অতুলপ্রসাদের গান বা অন্যান্য হালকা গানও গাইতে বসে, পাঁচরকম যন্ত্র নিয়ে গাইছেন। তাঁদের গলাটা যে কী ধরনের তা বোঝারই উপায় থাকে না। প্রত্যেক যন্ত্রর সামনে মাইক, নিজের সামনে দুটি মাইক। গান তো না যেন গলা ঢেকে রাখার বোরখা। শুধু তানপুরা বা অন্য একটি তারের বাজনা নিয়ে গাইলে, কার গলা যে কেমন তার পরীক্ষা হয়ে যায়।

কাকিমার গলায় একটি ব্রহ্মসঙ্গীত শুনেছিলাম আমি। প্রথমবার শুনেই গানটি তুলে ফেলেছিলাম। মন খারাপ লাগলে এখনও গাই। তুমি কী জানো গানটি?

“চলো গাই সেই ব্রহ্মনাম/ যে নাম স্মরণে প্রাণারাম, মরণ ঘুচেরে/হৃদয়ে হৃদয়ে মিলিয়ে মধুর রাগিণী তুলিয়ে…” ইত্যাদি।

কাকিমা, আরেকবার আমাদের জবলপুরের বাগান বাড়িতে আমার মায়ের জন্মদিনে গেয়েছিলেন। বাড়ির ছাদে বসে। একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। মনে আছে কি তোমার? মায়ের জন্মদিন ছিল। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে। সামনে নর্মদা বয়ে যাচ্ছে। গরমের দিন। ফুল, ধুপ আর ঈত্বরের গন্ধে মস্ত করা সেই চাঁদের রাতে কাকিমা গেয়েছিলেন গানটি। বুকের মধ্যে গেঁথে আছে সে গান। মনে আছে, পিচ-পাইপ দিয়ে সুর বাঁধা হল। নিমুকাকা এস্রাজ বেঁধে নিলেন। আমি তানপুরা ছেড়েছিলাম।

“হৃদয়বাসনা পূর্ণ হল আজি মম পূর্ণ হল, শুন সবে জগতজনে॥

কী হেরিনু শোভা, নিখিল ভুবননাথ

চিত্ত-মাঝে বসি স্থির আসনে॥”

এক-একটি গান এমনভাবে কানে, হৃদয়ে বসে যায় যে, সেইসব গান আমাদের জীবনেরই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। কিছু মুহূর্ত, কিছু অনুভূতি, কিছু স্মৃতি, সেই সব গানেরই সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে গেঁথে যায় বিনিসুতোর মালায়। আমার মৃত্যুতেই সেই সব গানের রেশ বুঝি ছাই হয়ে যাবে এই অপদার্থ মানুষটার শরীরেরই সঙ্গে।

কুর্চি! কিছুই ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে তোমাকে দেখতে এত ইচ্ছে করে, তোমার সামনে গিয়ে বসার জন্যে এমন আকুলি-বিকুলি করে আমার সমস্ত মন যেন পাগল-পাগল লাগে। রায়নাতে ফিরেও খবর পাঠিও কিন্তু। বা চিঠি লিখো। চিঠি লিখলে, কারখানার ঠিকানাতেই লিখো। জীবনে ন্যূনতম শান্তির কারণে কখনও কখনও বক্ৰগতির বা মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া যে অন্যায় নয়, এ কথা আমি আজ মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি জীবনের ধুলোর পথে অনেক অনেকদিন হেঁটে এসে।

চলো, কুর্চি! আর একবার মাণ্ডু যাই। শুধু তুমি আর আমি। এখন মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট থাকার জায়গার বন্দোবস্ত করেছেন সুন্দর। মাণ্ডুতেই থাকব। ইন্দোর থেকে চলে যাব গাড়ি ভাড়া করে। জাহাজ ম্যেহাল, রাজবাহাদুর ম্যেহাল, রূপমতী ম্যেহাল, আসরফি মেহ্যাল। আরও কত সব ম্যেহাল, মসজিদ, তাবেলা। মাণ্ডুতে অতীত কথা কয়। রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণের কথা মনে হয়, সেখানে গেলেই। ঘুরে ঘুরে সব দেখাব তোমাকে নতুন করে। যখন আমরা গেছিলাম, তখন তুমি তো ছোটই ছিলে। তোমার সব কথা মনে থাকার কথা নয়।

মা, বাবা, নিমু কাকা, কাকিমা সকলের স্মৃতির সঙ্গে মাখামাখি হয়ে আছে রূপমতী ম্যেহাল। তুমিও আমাকে গান শোনাবে আসন্ন সন্ধ্যায় অথবা রাতের প্রথম প্রহরে রূপমতী ম্যেহালের ছাদে বসে। বাবার গানের কথা মনে পড়ে যাবে : “সব গুণী গায়ে অব্‌ প্রভূকা নাম…”।

ভাবলে, ভারি খারাপ লাগে, না?

মানুষের নিজের হাতে-গড়া প্রতিটি জিনিসই থাকে, শুধু মানুষই থাকে না। এই বিপুল রঙ্গমঞ্চে তার ভূমিকাটিই সংক্ষিপ্ততম। যদি যাও আমার সঙ্গে আমরা দুজনে দেখতে পাব, রূপমতী ম্যেহাল ঠিক তেমনই আছে, আছে নিমার্‌-এর বিস্তীর্ণ সমতলভূমির শেষের দিগন্তরেখায় নর্মদার শান্ত বিবাগী চাল; রোজ ঊষাকালে যে নদীদর্শন না করে রূপমতী জলস্পর্শ করতেন না। আর আছে আকাশভরা তারাদের স্নিগ্ধতা। আছে যুগ যুগান্ত ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই আফ্রিকান বাওবাব গাছগুলি। “আপ-সাইড-ডাউন” ট্রীজ। নেই শুধু বাবা, মা। আমার এবং তোমার। নিমুকাকা কোথায় বসে দিলরুবায় সুর দিচ্ছিলেন, মা এবং বাবা কোথায় বসেছিলেন—সে জায়গাটুকুও আমি আর তুমি হাত দিয়ে ছুঁতে পারব। পারব না শুধু তাঁদেরই ছুঁতে।

কিন্তু মাণ্ডুতে তোমার সঙ্গে একা যাওয়া হবে কি কুর্চি? এ জীবনে? আমি যে পরপুরুষ। আর তুমি যে পরস্ত্রী। যার যার খোঁটায় বাঁধা আছি আমরা। যার যার মুখের সামনে রাখা জাবনাতে অবোধ পশুর মতো মুখ ডুবিয়ে জীবনের জাব্‌না খাচ্ছি। মাপা খড়, মাপা গুড়, মাপা খোল। প্রয়োজনের সংসারে, দুধ বেশি করে দেব বলে। মাপা দুধ। মাপা নিয়মে। সকাল-সন্ধে। মৃতবৎসা গাভীদেরই মতো আমাদেরই পাশে, ব্যাঙের গায়ের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া আমাদের সব মানবিক বোধ, সূক্ষ্ম আশা-আকাঙ্ক্ষা, মৃত বাছুরের কাঠে-মোড়া চামড়া, দাঁড় করানো আছে। এই সংসারের গোয়ালে। হ্যাঁ। কুর্চি। ওই চামড়া-মোড়া কাঠটুকুই আমাদের জীবনের প্রতিভূ। আমাদেরই জীবন? হ্যাঁ। আমাদেরই। যে জীবন আমরা চেয়েছিলাম। হয়তো ভুল করে। তবু। আমরা প্রত্যেকটি মানুষ। আমি। তুমি। রুষাও। আমাদের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ বড় কাতর হৃদয়ে চেয়েছিলাম, অনেক বাসনায় কৈশোরের হালকা বেগুনি রঙা জীরহুল ফুলের মতো স্বপ্নে যে জীবনের ছবি এঁকেছিলাম, সেই জীবন! এই-ই আমাদের মনোমত জীবন কুর্চি।

একটাই জীবন। শুধুমাত্র একটা। অথচ, এই-ই আমাদের নিয়তি। এই কালে, এ সমাজে আমরা কেউই বেঁচে থাকি না, আমরা বাঁচতে জানি না। সংস্কার, লোকভয় আর অভ্যাসের দাসত্বই করি শুধু আমরা। প্রেমকে খুন করে তার রক্ত ছেনে অপত্যস্নেহের পুতুলদের নিয়ে পুতুলের ঘর করি। শুধুই প্রশ্বাস নিই আর নিঃশ্বাস ফেলি। ছিঃ। ছিঃ।

চলো কুর্চি। পালাই। বাঁধন ছিঁড়ে হাত ধরাধরি করে চলো, পালিয়ে যাই। বাইরে থেকে ভেতরের দিকে পালাই, বহিরঙ্গ থেকে অন্তরঙ্গে, আপাত থেকে সত্যের দিকে। চলো, চলো, রাত হয়ে আসছে, দিন ফুরিয়ে আসছে : পালাই চলো। পারবে? সাহস হবে কি পালাবার?

ভাল থেকো। নিজের জন্যে না হলেও, আমার জন্যে না হলেও অন্তত ভাঁটুর জন্যেও ভাল থেকো। তোমার অনাগত সন্তানের জন্যে ভাল থেকো। ভাল থেকো, সবসময়। আমরা যে কয়েদী। কয়েদীরা ভাল না থাকলে কয়েদখানার বাগানে আনাজ ফলাবে কারা গো?

ইতি তোমার পৃথুদা, এই কয়েদখানার একজন কয়েদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *