1 of 2

২৬. আজ কলকাতার প্রতিটি খবরের কাগজ

আজ কলকাতার প্রতিটি খবরের কাগজের হেডলাইন লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে একটি শব্দের হেরফেরে কোন ঘটনা সম্পর্কে কাগজের বক্তব্য প্রচ্ছন্ন থেকে যেতে পারে। যেমন, নিজ বাসভবনে মন্ত্রী দেহরক্ষীসমেত নিহত। দেহরক্ষী এবং মন্ত্রীকে গুলি করে হত্যা। মন্ত্রী নিহত, সঙ্গে দেহরক্ষী। নৃশংস হত্যাকাণ্ড, উগ্রপন্থী কর্তৃক মন্ত্রী নিহত।

গেস্টহাউসে বসে ওরা কাগজগুলো দেখছিল। কাল রাত্রে জয়িতা এক সেকেন্ড ঘুমাতে পারেনি। এই গেস্টহাউসটাকে আপাতনিরীহ বলেই মনে হয়েছিল। এয়ারপোর্টে প্লেন ধরতে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে শহরে যাওয়ার আগে এখানে থেকে যাওয়ার কাজে বিমানযাত্রীরা এটাকে কাজে লাগায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল যে-কোন মুহূর্তে পুলিশ এসে পড়লে কিছু করার থাকবে না। পুলিশের ভয় তো ছিলই, তার ওপরে সুদীপ-আনন্দের জন্যে চিন্তাও হচ্ছিল। কোন দরকার ছিল না বোলপুর পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে গিয়ে ট্রেন ধরার। অবশ্য দার্জিলিং মেল বেরিয়ে গেছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা বর্ধমানে দাঁড়ায় না। তবু এই ঝুঁকি নেওয়াটায় দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। এই ঘরে টেলিফোন আছে। খুব ইচ্ছে করছিল রামানন্দ রায়ের সঙ্গে কথা বলতে। অন্তত বাবা আমি চলে যাচ্ছি অনেক দূরে, হিমালয়ের কোলে, এই কথাগুলো বলতে। কিন্তু পুলিশ যদি টেলিফোনও নজরে রাখে তাহলে। হঠাৎই জয়িতার মনে হচ্ছিল সবকটা শেকড় আজ ছিঁড়ে যাচ্ছে। যতই মাটি আলগা থাকুক না কেন এতকাল আজ সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। কল্যাণ খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। ওর হাতের অসুবিধে এবং আরামদায়ক বিছানা ওকে ঘুমাতে সাহায্য করেছে। এতদিন একঘরে ওরা চারজন শুয়েছে। নিশ্চিন্তে ঘুমাতেও পেরেছে। এখন সত্যিই আর এক ধরনের অস্বস্তি হচ্ছিল। এই প্রথম একজন যুবকের সঙ্গে শুচ্ছে সে। হয়তো এক বিছানায় নয় কিন্তু সারাটা রাত ঘরের আলো নিবিয়ে দরজা বন্ধ করে—জয়িতা ঘুমন্ত কল্যাণের দিকে তাকিয়ে এই চিন্তাটার জন্যে লজ্জিত হল না। সে নিজে একটি যুবতী বয়সের রমণী, এই চিন্তাটা মাথায় এসে এক ধরনের ভাল লাগা তৈরি হল। অথচ ঘুম এল না। ঘরের গায়েই যে ব্যালকনিটা সেখানে বসলে ভি আই পি রোড দেখা যায়। জয়িতা সেই রাতটার অনেকখানি ব্যালকনিতে বসে রইল। রাত যত বাড়ছে তত ছুটন্ত গাড়ির সংখ্যা কমে আসতে লাগল। একসময় সব চুপচাপ। এয়ারপোর্টে নিশ্চয়ই কোন প্লেন নামছে না। একটা রাত কেমন করে নিঃসাড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে শেষ হয়ে যায়, চোখের সামনে দেখল জয়িতা।

প্রতিটি কাগজে হত্যাকাণ্ডের বিশদ বিবরণ বের হয়েছে। বিশদ তো বটেই, এমন অনেক তথ্য পরিবেশিত হয়েছে যার সঙ্গে সত্যের কোন সম্পর্ক নেই। তবে সর্বাধিক প্রচারিত কাগজটি মন্তব্য করেছে, দেখে শুনে মনে হচ্ছে প্যারাডাইস এবং বড়বাজারে যে দল কাজ করেছে তারাই এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। মন্ত্রীর নামে বিভিন্ন সময় অনেক অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু তাঁকে তাঁর দল এবং সরকার সবসময় আড়াল করে রেখেছিল। দেহরক্ষী হিসেবে যাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে সেই লোকটির নাম নানুভাই। ওই অঞ্চলের ব্যাপক স্মাগলিং হত নানুভাই-এর নেতৃত্বে। বস্তুত নানুভাই-এর নির্দেশেই ব্যালটবক্সে ডোট পড়ত, কারণ প্রতিটা পরিবারের অর্থনৈতিক স্থিতি নির্ভর করত নানুভাই-এর ওপর। কলকাতায় কয়েকটি সাম্প্রদায়িক ঘটনার পেছনে নানুভাই-এর হাত ছিল বলে কারও কারও অনুমান। এইরকম একটি সমাজবিরোধী কিভাবে মন্ত্রীর দেহরক্ষী হিসেবে নির্বাচিত হল সেটাই বিস্ময়। হত্যাকারীদের এই কাজের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ধিক্কার উঠেছে। সমস্ত রাজনৈতিক দল একসঙ্গে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। তারা অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবী জানিয়েছেন। ঘটনা শোনামাত্র মুখ্যমন্ত্রী হাসপাতালে ছুটে যান। সহকর্মীর এই শোচনীয় মৃত্যুকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। রাত্রেই হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার সম্পর্কে তিনি আই জি এবং সি পি-র সঙ্গে জরুরী বৈঠক করেন। প্যারাডাইস এবং বড়বাজারের ঘটনার পরেও এতদিন হত্যাকরীরা ধরা না পড়ায় পুলিশ কমিশনারের অপসারণ দাবী উঠেছে। এই ঘটনা মন্ত্রীসভায় সংকট সৃষ্টি করতে পারে। মন্ত্রীর এলাকায় যাতে কোন হাঙ্গামা না শুরু হয় তাই বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

খবরগুলো পড়ার পর কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, তুই দেখেছিস?

জয়িতা সিগারেট ধরাল, কি?

কোন খবর বেরিয়েছে কিনা ওদের সম্পর্কে? যেভাবে এখান থেকে গেল ওরা!

না। কাল রাত্রে তোর ঘুম দেখে অবশ্য মনে হয়নি এত চিন্তা করেছিস!

কল্যাণ কোন জবাব দিল না। একথা ওকে বোঝানো অসম্ভব, জ্ঞান হবার পর সে এত আরামে থাকেনি। এমন নরম বিছানা, ঝকঝকে টয়লেট, ভাল খাবার কোনদিন পায়নি। নিজেকে খুব সুখী সুখী মনে হয়েছে আজ সকাল পর্যন্ত। এই খবরের কাগজগুলো আসার পর থেকেই আবার উদ্বেগ, আবার। কল্যাণ জয়িতার দিকে তাকাল। যতই না ভাবতে ইচ্ছে করুক কিন্তু এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে জয়িতা একটি মেয়ে। তাদেরই সমবয়সী। মেয়ে বলতে যে সব আকর্ষণীয় ব্যাপারগুলো চট করে চোখের সামনে ভাসে সেগুলো বাদ দিয়েই কিন্তু ওর অস্তিত্ব এবং তা সত্ত্বেও প্রমাণ করা যাবে না জয়িতা মেয়ে নয়। আর সে কাল গোটা রাত একটি মেয়ের সঙ্গে এক ঘরে কাটাল অথচ মনে কোন প্রতিক্রিয়া ঘটল না। নিজেকে বোঝাল কল্যাণ, ওকে দেখলে তার কেবল জয়িতা বলেই বোধ হয়, মেয়ে বলে কোন অনুভূতি আসে না। জয়িতা নিজেই যেন তার সমস্ত নারীত্বকে আড়াল করে বসে আছে। সে ভাবনাটাকে অন্যদিকে সরাতে চাইল। সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, ধরা পড়লে তুই কি করবি জয়িতা?

বলব শহীদ করুন মশাই, সাত আট বছর ঘানি টানতে পারব না। ফালতু ব্যাপার।

তোরা সবাই কেমন সব ব্যাপার সহজ ভাবে নিতে পারিস। কল্যাণ নিঃশ্বাস ফেলল, এই যে আজ আমরা কলকাতা ছেড়ে, পশ্চিমবাংলা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, কোনদিন এখানে ফিরব কিনা তাই জানি না মনটা কেমন লাগছে, বুঝলি?

কথাটা তারও, কিন্তু জয়িতা বলল, আহা রে, যাও না, মায়ের কাছে বসে ড়ুডু খাও।

কল্যাণ মাথা ঝাঁকাল, তুই আর সুদীপ মানুষের সেন্টিমেন্ট বুঝিস না।

আনন্দ বোঝে? জয়িতাকে হাসি থামাতে কষ্ট করতে হচ্ছিল।

হঠাৎ কল্যাণ চিৎকার করে উঠল, আমি এতদিন কত কষ্ট করে পড়াশুনা করলাম, ভাল রেজাল্ট করলাম, কি লাভ হল? তিনটে অ্যাকশান করে এখন কুকুরের মত পালাতে হচ্ছে। কেন? নিজেদের নষ্ট করে আমরা কার কি উপকার করলাম?

জয়িতা উঠে দাঁড়াল, তুই চিৎকার করছিস কেন?

একশবার করব। তোদের কি? বড়লোকের বাড়িতে জন্মেছিস, তোরা এসব বুঝবি কেন? আমাকে টিউশুনির পয়সায় চালাতে হয়েছে। আমি জানি কষ্ট কাকে বলে।

কল্যাণের গলার স্বরে বাম্প ছিল কিন্তু সেটা উঁচু পর্দায় ধরা ছিল। জয়িতা বলল, তুই আর একবার চেঁচা, আমি এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাব। ইউ আর আসকিং ট্রাবলস্। তোর এইসব কথা কারও কানে গেলে পুলিশ এখানে পৌঁছে যাবে। বহুৎ ধুর পাবলিক তুই।

কল্যাণ মাথা নাড়ল। যদিও তার গলা এবার নিচুতে, এটাও তোর কথা নয়। সুদীপের ভাষা তুই বলছিস, দ্যাখ তোদের মধ্যে কি মিল।

জয়িতার চোয়াল শক্ত হল, কল্যাণ, তুই কি বাগডোগরা যেতে রাজী হচ্ছিস না?

কল্যাণ জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেল। ও তখনও বসেছিল ব্যালকনিতে। জয়িতা ঠিক করল ব্যাপারটা আনন্দর ওপরে ছেড়ে দেবে। সে ঘরে ঢুকে বলল, শোন, আমাদের একসঙ্গে বের হতে হবে। কারণ আমরা একসঙ্গে এখানে ঢুকেছি। তোর টিকিট নিয়ে তুই আলাদা ফ্লাই করবি। আমার সঙ্গে বাগডোগরাতে পৌঁছনো পর্যন্ত তোর কোন সম্পর্ক নেই।

কিছুক্ষণ কথা বলল না কল্যাণ। জয়িতা যখন তৈরি হবার জন্যে বাথরুমে ঢুকছে তখন সে বলল, আমি কখনও প্লেনে যাওয়া আসা করিনি।

এমন কোন হাতি ঘোড়া ব্যাপার নয়। ভেতরে ঢুকে সোজা ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের বাগডোগরা কাউন্টারে চলে যাবি। আই সি দুশো একুশ। টিকিট এভর্স করিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নিবি। সবাই যখন সিকিউরিটি চেকিং-এ যাবে তুইও যাবি। তারপর ফ্লাইট রেডি হলে প্লেনে উঠে বসবি। এত পরিশ্রম করেছিস সারা জীবন, এটুকু নিশ্চয়ই জলভাত। জয়িতা বাথরুমে ঢুকে গেল। এবং তখন কল্যাণের নিজেকে খুবই পাতি বাঙালী বলে মনে হতে লাগল।

জয়িতা তার কথা রেখেছিল। কল্যাণের মনে পড়ল আনন্দর নির্দেশও এরকম ছিল। ওরা আলাদা বোডিং কার্ড নিয়ে আলাদা বসেছে। যেন কেউ কাউকে চেনে না। কল্যাণের চোখ চারপাশে ঘুরছিল। এসব জায়গায় নিশ্চয়ই পুলিশের চর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্দেহ করলে আর প্লেনে উঠতে হবে না। প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছিল তার। কেউ সঙ্গী হলে তার সঙ্গে কথা বলে বেশ সময় কাটানো যায়। কিন্তু বোডিং কার্ড নেওয়ার পর অনেক সময় চলে গেছে কিন্তু এখনও ডাক পড়ছে না। অনেক দূরে একটা রঙিন চেয়ারে বসে জয়িতা দেশ পড়ছে। যেন কিছুই জানে না এমন ভঙ্গি। দূরে একজন লোক তার দিকে অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতরটা সিরসির করে উঠল। আতঙ্ক এতটা বাড়ছে যে কল্যাণ প্রথমবার প্লেনে উঠতে যাওয়ার উত্তেজনা অনুভব করতে পারছিল না। সে দেখল লোকটা এবার জয়িতাকে লক্ষ্য করছে। কল্যাণের মনে হল জয়িতাকে একবার সাবধান করা উচিত। সেইসময় জয়িতা উঠল। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে হাতড়াল। তারপর অলস ভঙ্গিতে কিছুটা হেঁটে লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলল। কল্যাণ দেখল, লোকটা চটপট উঠে একটা লাইটার জ্বেলে ওর সিগারেট ধরিয়ে দিল। জয়িতা এখন হেসে হেসে লোকটার সঙ্গে গল্প করছে। এবং এই গল্প করার ভঙ্গিটি ভারি মিষ্টি। একসঙ্গে ভয় এবং ঈর্ষায় আক্রান্ত হল কল্যাণ। জয়িতা যখন তাদের সঙ্গে কথা বলে তখন এই ভঙ্গিটা একদম থাকে না।

প্লেনে উঠে বসার প্রাথমিক আড়ষ্টতা কেটে যাওয়ার পর কল্যাণ লক্ষ্য করল চারপাশে যারা বসে আছে তাদের প্রত্যেকের চেহারা ঠিকঠাক বড়লোকদের মত নয়। কেউ কেউ এমন সাধারণ যে ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণীতে মানিয়ে যায় বেশি। অবশ্য পশ্চিমবাংলার এক শ্রেণীর মানুষ প্রচুর টাকা জমিয়েও নিজের পরিমণ্ডলের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করেন না অভ্যেসে। ওই যে সামনের লোকটা, এয়ার হোস্টেসের বাড়ানো থালা থেকে যেভাবে এক থাবা লজেন্স তুলে নিল তাতে লোকটিকে বুঝতে অসুবিধে হয় না। কল্যাণ দেখল বেশ কিছুটা দূরে জয়িতা সেই লোকটার সঙ্গে উচ্ছ্বসিত গল্প করছে। এয়ারপোর্ট থেকেই ওর দিকে একবারও তাকায়নি মেয়েটা। এখন আর রাগ নেই কিন্তু এক ধরনের কষ্ট তৈরি হচ্ছে বুকের মধ্যে। মেয়েরা কি সহজে উপেক্ষা করতে পারে! শুধু উপেক্ষা করাই নয়, সেটা বুঝিয়ে দিতে পারার পটুত্বও তাদের অসাধারণ। অথচ এই মেয়েটি যদি বড়বাজারে গ্রেনেড না ড়ত তাহলে সুদীপের ভাষায় সে এতক্ষণে ছবি হয়ে যেত। কিন্তু সে-কারণে যে কৃতজ্ঞতা তা চাপা পড়ে যাচ্ছে ঈর্ষাপ্রসূত কষ্টে। কল্যাণ ব্যাপারটাকে ভোলার জন্যই জানলার দিকে তাকাল। মেঘের ওপর লঞ্চের মত ভেসে যাচ্ছে প্লেন। সাদা মেঘের শরীরে বোদ কত রকম রঙের নকশা বুনছে। নিচের পৃথিবীটা এখন আড়ালে। কল্যাণ আবার প্লেনের ভেতরটা দেখল। চারপাশে খুব স্বচ্ছন্দ মানুষজন। এখানে আর কাউকে পুলিশ বলে মনে হচ্ছে না। এমনকি জয়িতার সঙ্গে গল্প করা লোকটা হঠাৎ খুব নিরীহ হয়ে গেছে। এখন মাথার ওপর সিগারেট নেভানো কিংবা বেল্ট বাঁধার নির্দেশ নেই। কল্যাণ আচমকা সিট থেকে উঠে পড়ল। যদিও এয়ার হোস্টেস ছাড়া কেউ প্যাসেজে হাঁটছে না তবু সে কঁপা পায়ে জয়িতার কাছে চলে এল। তারপর কথা বলতে গিয়েও ঠোক গিলল। লোকটা জয়িতার হাতের রেখা বিচার করছে। যেন ভুল করে চলে এসেছে এমন ভঙ্গি করে সে আবার নিজের সিটে ফিরে এল। যে মেয়ে বোমা ছেড়ে সে হাতের রেখা গোনাতে চায়? কল্যাণের সব উলটো-পালটা হয়ে যাচ্ছিল। সিগারেট ধরাতে গিয়ে তার মনে পড়ল কেউ না ধরিয়ে দিলে এক হাতে দেশলাই জ্বালাবার কায়দাটা সে রপ্ত করতে পারেনি এখনও। আর তখনই নো স্মোকিং নির্দেশটা জ্বলে উঠল। কল্যাণ স্বস্তি পেল। ওটা না জ্বললে তাকে চেষ্টা করতেই হত সিগারেট ধরাতে। তখন যদি হার হত সেটা বেশি লজ্জার। লজ্জাটা পেতে হল না।

দমদমের কাছে বাগডোগরাকে এয়ার পোর্ট বলে মনে হয় না। এমন কি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুব হালকা। জয়িতাকে লক্ষ্য রেখে কল্যাণ প্লেন থেকে নেমে ছোট্ট বিল্ডিংটায় চলে এল। তার একটা হাত এখনও অকেজো, অন্যটায় মাল বইতে হবে। এখান থেকে শিলিগুড়ি কত দূর? এসব অঞ্চলে সে কখনও আসেনি। ঘড়িতে দুটো পনেরো। আনন্দদের ট্রেন নিউ জলপাইগুড়িতে পৌঁছবে চারটের পর। ওদের ওপর নির্দেশ আছে সোজা সিনক্লেয়ার নামের একটা হোটেলে গিয়ে উঠতে। কিন্তু ওদের বলতে আর যাকে বোঝাচ্ছে তিনি তো এখনও চেনার ভান করছেন না। মালপত্র খালাস করে কাঁধে স্ট্র্যাপ ঝোলানো যেহেতু এক হাতে সম্ভব নয় তাই ভারী হলেও হাতেই নিল কল্যাণ। তারপরেই জানল এখান থেকে একটা বাস সোজা ওই হোটেলটাতেই নিয়ে যায়। অনুসরণ করে সেই বাসটায় উঠে বসল সে। মোটামুটি ভরতি হলে বাসটা যখন ছাড়ল তখন জয়িতা নেই। এবার উদ্বিগ্ন হল কল্যাণ। সে শুনেছে রাগ করলে মেয়েরা নাকি অন্ধ হয়ে যায়। তখন কোন যুক্তি বা সম্পর্কের কথা খেয়ালেই রাখে না। সে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যতটা দেখতে পেল তার মধ্যে জয়িতার অস্তিত্ব নেই। গুম হয়ে বসে রইল সে। সুন্দর পিচের রাস্তা দিয়ে বাস ছুটছে। দুপাশে এয়ারফোর্সের ক্যান্টনমেন্ট। সাইকেলে সৈনিকরা আসা যাওয়া করছে। হঠাৎ জয়িতাকে ছাপিয়ে কল্যাণের মাথায় অন্য চিন্তা প্রবল হল। এইসব তরুণ যারা এখানে য়ুনিফর্ম পরে সাইকেলে কর্তব্য করতে যাচ্ছে তারা কি শুধুই পেটের জন্য চাকরি করতে এসেছে না দেশের প্রতি ভালবাসাও কাজ করছে?

শিলিগুড়ি শহরে ঢোকার আগেই বাঁ দিকে হোটেলটা। সুন্দর সাজানো। দেখলেই বোঝা যায় দক্ষিণা কম হবে না। আনন্দরা যে টাকা দিয়েছিল তা ওরা ভাগ করে নিয়েছিল কিন্তু ভি. আই. পি. রোডের গেস্ট হাউসের টাকা কল্যাণই মিটিয়েছিল। এখন পকেটে পড়ে রয়েছে সামান্য এবং এখানকার ভাড়াটাও অজানা। বাস থেকে নেমে ইতস্তত করল কল্যাণ। তারপর ব্যাগটাকে বয়ে রিসেপশনের দিকে এগোতেই জয়িতাকে দেখতে পেল। খুব সহজ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কাউন্টারের পাশে। ওকে দেখে যে কায়দায় হাই বলে হাত তুলল তাতে ঘাবড়ে না গিয়ে পারল না। যেন কতকাল পরে দেখা হয়েছে, সেই ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলল, ওঃ, শেষ পর্যন্ত তোমাকে দেখলাম। আমি ভাবছিলাম যদি তুমি না আসো ওই ফ্লাইটে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে রিসেপশনের লোকটিকে বলল, ওয়েল! হি ইজ হিয়ার।

লোকটি তার শেখা হাসিটি হাসল। নিজেরা নয়, বেয়ারা তাদের ঘরে মালপত্র পৌঁছে দিলে জয়িতা বলল, বাঃ, তুই বেশ সাবালক হয়ে গেছিস তো!

বেয়ারা চলে গিয়েছিল। কল্যাণ বলল, এভরিথিং হ্যাজ লিমিট জয়িতা। তুই আমাকে অকারণে এভাবে অপমান করতে পারিস না। আমি ওদের কাছে সমস্ত ব্যাপারটা বলব।

জয়িতা হাসল, কি বলবি? কলকাতা থেকে পালাতে হচ্ছে বলে তোর আফসোস হচ্ছিল! কেন এই অ্যাকশনে জড়িয়ে পড়লি! তাই নিয়ে আমি তোকে ঠাট্টা করেছিলাম। তুই এত জোরে চেঁচিয়েছিলি যে পুলিশ আসতে পারত। তারপর তোর সঙ্গে আমি কথা বন্ধ করেছিলাম, এই তো?

কল্যাণ হতভম্ব হয়ে তাকাল। সে যে এতক্ষণ অভিমান এবং ঈর্ষা থেকে অসহায় হয়ে পড়েছিল এবং তার জন্যেই এক ধরনের ক্রোধ বড় হয়ে উঠছিল আচমকা সেটা গুটিয়ে গেল। কোনরকমে সে বলতে পারল, জয়িতা, আমি তোকে খুব মিস করছিলাম।

জয়িতা কাঁধ নাচাল। তারপর বলল, ঘণ্টাখানেক চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাক, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। যেন কোথাও বেড়াতে এসেছে এমন ভঙ্গি করে সে বাথরুমে ঢুকে গেল। নরম বিছানায় বসে কল্যাণের শরীরে হঠাৎ কাঁপুনি এল। সে কি খুব ভীরু? খুব মেরুদণ্ডহীন? জয়িতার ভাষায় নাবালক? মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তদের যাবতীয় দোষ তার মধ্যে? কেন কলকাতা থেকে পালাতে গিয়ে তার মনে হল যা করেছে তার কোন মানে হয় না মানে কি সত্যিই হয়? আর করবে বলে যখন নেমেছিল, রাজী হয়েছিল, তখন করার পর তাই নিয়ে আফসোস কেন এল মনের মধ্যে? সেটা কি কাপুরুষতার জন্যে? আর এখানেই আনন্দ-সুদীপ-জয়িতার থেকে সে পিছিয়ে! কি অভিযোগ করবে সে জয়িতার বিরুদ্ধে? গেস্ট হাউস থেকে বের হবার পর কথা বলেনি, না চেনার ভান করেছে, একা হোটেলে চলে এসেছে? কিন্তু হোটলে তো এসেছে, আগে থেকে ঘর বুক করে রেখেছে। অভিযোগ টিকবে? সত্যি কি কারও বিরুদ্ধে তার অভিযোগ করার কিছু আছে? যদি কাউকে অভিযুক্ত করতেই হয় তাহলে–! মুখ তুলল কল্যাণ। আর তখনই আয়নায় নিজেকে দেখতে পেল। এই মুখ সে কখনও দ্যাখেনি।

 

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে ওরা শুনতে পেল জলপাইগুড়ি থেকে যে ট্রেনটা এইমাত্র এসেছে সেটা শিলিগুড়ির জংশন স্টেশনে যাচ্ছে। শিলিগুড়িতে যেতে হলে মিনিবাস অথবা রিকশা ভরসা। এই ট্রেনটাকে সবসময় পাওয়া যায় না। কাঞ্চনজঙ্ঘা ঠিক সময়ে আসায় ছাড়ব-ছাড়ব ট্রেনটাকে দেখা যাচ্ছে। পুরোনো আমলের ইঞ্জিন, কামরা আরও খারাপ। তবে মিনিট কুড়ি পঁচিশের বেশি যাত্রা নয়, ওরা ওতেই উঠে বসল। সুদীপ এখন ফিট। সমস্ত ট্রেনে ওরা দুজন পাশাপাশি বসেনি। এখানেও বেশ কিছুটা দুরত্ব রেখে এক কামরায় বসল। এবং তখনই আলোচনা শুনতে পেল। রেডিওতে খবর হয়ে গেছে। বারংবার মন্ত্রীর মৃত্যুর খবরটা বলছে। রাজ্য মন্ত্রীসভার জরুরী মিটিং বসেছে আজ দুবার। মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে সতর্ক করেছেন, অবিলম্বে হত্যাকারীদের ধরার জন্যে। প্রধানমন্ত্রী নার্কি মুখ্যমন্ত্রীকে টেলিফোন করে ব্যাপারটা জানতে চেয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, এটা কোন সুগঠিত রাজনৈতিক দলের কাজ নয়। চারজন বিপথগামী তরুণ এই কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। তার মতে বিকৃত রাজনৈতিক চিন্তার ফসল। এদের পেছনে কোন দল বা জনসাধারণের সমর্থন নেই। শুধুই ঘাতক ছাড়া কোন আখ্যা দেওয়া যায় না। দুপুরের খবরে বলা হয়েছে ডায়মন্ডহারবার থেকে আনন্দ নামে একটি যুবকের মাকে পুলিশ আরও জেরা করার জন্যে লালবাজারে নিয়ে এসেছে। ওই মহিলার স্বামী নকশালপন্থী ছিলেন। পুলিশের অনুমান চারজনের ওই দলের নেতা হল আনন্দ। মহিলাকে তার ছেলের হোস্টেলে যেতে দেখা গিয়েছে। পুলিশের ধারণা হত্যাকারীরা এখনও শহরে আছে। তাদের সম্ভাব্য আস্তানা খুঁজে বের করা হচ্ছে। জনসাধারণকে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে যারা ওই রকম তিনটে ঘটনা ঘটিয়েছে এবং দুটো ঘটনা ঘটাবার পরও শহর ছেড়ে যায়নি তাদের সম্পর্কে সামান্য সংবাদও পুলিশকে জানাতে হবে। এরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। অনুমান করা হচ্ছে সব সকমের ভারী অস্ত্র এদের কাছে আছে।

আনন্দর মুখের কোন পরিবর্তন হল না। মাকে ওরা লালবাজারে নিয়ে গিয়ে নিশ্চয়ই অত্যাচার করবে। এখান থেকে সে তার কোন প্রতিকারই করতে পারবে না। একমাত্র ধরা দেওয়া ছাড়া। কলকাতায় থাকলেও অবস্থার কোন হেরফের হত না। আর এ ব্যাপারে সহানুভূতি দেখানো সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করবেন মা নিজে। যে মানুষটা সারাজীবন কারও সহানুভূতির তোয়াক্কা না করে একা সংগ্রাম করে গেল তার এসবে কোন প্রতিক্রিয়া হবে না। তিনি স্বামীর কর্মকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, পুত্রের কাজের জন্যেও নিজেকে ছিবড়ে করতে হচ্ছে। কিন্তু আনন্দ নিজেকে অপরিবর্তিত রাখল। হঠাৎ সে শুনল সুদীপ তার পাশের লোককে বলছে, এসব নকশালরা করছে না তো!

লোকটা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল, দূর! এসব করার হিম্মত কজনের আছে? পাবলিকলি বলা উচিত নয় কিন্তু ওদের কাজকে আমি সমর্থন করি। শালা, এদেশে আইনফাইন আন্দোলন করে কিছু হবে না। ওরা প্যারাডাইস পুড়িয়েছে ঠিক করেছে। বড়বাজারে বোমা ফেলার হিম্মত দেখিয়েছে জাল ওষুধের কারখানা ধ্বংস করে। কোন অন্যায় করেনি। নিজেদের স্বার্থে কিছু করেনি। আর মন্ত্রী-হত্যা? লোকটা সময় নিল একটু, এই হত্যাকাণ্ড অবশ্য বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে কিন্তু মন্ত্রীমশাই সুবোধ বালক ছিলেন না।

সুবোধ বালক কি মশাই! বহুৎ দুনম্বরি লোকছিল! পার্টি কি করে ওকে এতদিন সহ্য করেছিল তাই বিস্ময়ের ব্যাপার! স্বনামে বেনামে যা সম্পত্তি করেছে, সাতপুরুষ খেয়ে যাবে।

আর একজন বলল, ওটা পার্টির ব্যক্তিগত ব্যাপার। কোনরকম রাজনৈতিক শিক্ষা ছাড়া ধরে ধরে মানুষ খুন করলেই হল? কি না, পাবলিকের উপকার করতে চান! রবিনহুড। এরা বিপ্লবের শত্রু।

সঙ্গে সঙ্গে আর একজন চিৎকার করে উঠল, রাখুন মশাই বিপ্লব! ওই কথাটা শুনতে শুনতে কান পচে গেল। এদেশে বিপ্লব করবে কে? আপনারা? টাটা বিড়লাকে আদর করে ব্যবসা করতে ডাকছেন, এক লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের মানুষকে গরিব বলছেন, এয়ারকন্ডিশনড অফিস না হলে পাটির মিটিং করতে পারবেন না যারা তারাই বিপ্লব বিপ্লব করে চেঁচাবেন। লাস্ট লোক ছিলেন প্রয়োদ দাশগুপ্ত, তার পরে আর কেউ নেই। এ ছোকরাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যাই থাক না কেন, এরা প্রমাণ করছে এদের মেরুদণ্ড আছে। দেশটা কেন্নোয় ভরে যায়নি।

তপ্ত আলোচনার মাঝখানে টাউন স্টেশন এল। সেখানে নেমে গেল বেশিরভাগ মানুষ। জংশন স্টেশনে এলে ওরা প্লাটফর্মে নামল। অযত্ন শব্দটা স্টেশনের সঙ্গে পোস্টারের মত সাঁটা। এমনকি টিকিট চেকার নেই টিকিট নেবার জন্যে। ওরা একটা তিন চাকার রিকশা নিল। সুদীপ প্রথম কথা বলল, মাসিমাকে অ্যারেস্ট করেছে বোধ হয়।

আনন্দ জবাব দিল, শুনলাম। কালকের কাগজ দেখলে বোঝা যাবে।

তোর কোন চিন্তা হচ্ছে না? সুদীপ আনন্দর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

হচ্ছে। একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করল আনন্দ।

দিল্লি হোটেলে ওরা একটা ঘর নিল। মধ্যবিত্তদের হোটেল। খাতায় উলটোপালটা নামধাম লিখে ঘরে ঢুকে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এখনই বের হবি?

আনন্দ মাথা নাড়ল, না। সন্ধ্যে হোক তারপর। ওরা দুজন ঠিকঠাক এলে হয়।

সুদীপ বলল, কল্যাণটাকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই। ওর মধ্যে টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত ভালমানুষী আছে যেটা ক্যামোফ্লেজ করবে। কিন্তু জয়িতার চেহারার বর্ণনা পেলে ওকে লোকেট করতে একটা হাবা কনস্টেবলেরও অসুবিধে হবে না।

আনন্দ বলল, চিন্তা করে কোন লাভ নেই। ফ্রেস হয়ে নে, তোর সঙ্গে আলোচনা আছে।

সুদীপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একবার ওদের হোটেলে টেলিফোন করবি?

না। সন্ধ্যের পর গেলেই ভাল। তুই যাবি?

আপত্তি নেই। তুই যাবি না?

দুজনে একসঙ্গে ওদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। খোলাখুলি বলছি, ওরা যদি কলকাতায় ধরা পড়ে থাকে তাহলে আমাদের পক্ষে এই শহরে থাকাটাই বিপজ্জনক। চাপের মুখে কল্যাণ কতটা স্থির থাকবে বলা মুশকিল। আমিই ওদের হোটেলে উঠতে বলেছি, শেষ মুহর্তে পুলিশ আমাদের জন্যে সেখানে অপেক্ষা করতে পারে। এক্ষেত্রে তোর যদি যেতে আপত্তি থাকে তাহলে। আনন্দ কথাটা শেষ করল না।

আগেই বলেছি আপত্তি নেই। সুদীপ উঠে পড়ল। স্নান করা দরকার। সমস্ত শরীর বড় নোংরা হয়ে রয়েছে। গায়ে জল না দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাওয়া যাবে না।

সন্ধ্যের পর আনন্দ আর সুদীপ একসঙ্গে বের হল। আনন্দ গেল রকেট বাস স্টেশনের কাছে। কাল খুব ভোরে একটা জিপ ভাড়া করতে হবে। যদি অন্ধকার থাকতেই বেরিয়ে পড়া যায় তাহলেও ঘণ্টা সাড়ে তিন-চার লাগবে। সুদীপের সঙ্গে কথা হল যে কোন অবস্থাতেই ও রাত নটায় হোটেলে ফিরে আসবে। সময়টা অতিক্রান্ত হলে আনন্দ নিজের মত সিদ্ধান্ত নেবে। সুদীপ একটা রিকশা নিল। মনে হল এদিকটা যেহেতু শহরের প্রান্ত তাই ব্যাপক হারে জনবসতি গড়ে ওঠেনি। নেপালী-পাঞ্জাবী একটু বেশি চোখে পড়ছিল। শহর থেকে বেরিয়ে ডানদিকে ঘুরতেই হোটেলটা দেখতে পেল সুদীপ। রিকশা ছেড়ে দিয়ে সে পায়ে পায়ে হোটেলে ঢুকতেই জয়িতাকে দেখতে পেল। এ মেয়ে জয়িতা না হয়ে যায় না। এখন রাত। বাতাসে গরম ভাবটা নেই। হোটেলের সামনেও লনে টিমটিমে আলো জ্বলছে। সেই লনে চুপচাপ পায়চারি করছে জয়িতা। একা একা। সুদীপের বিরক্তি হল। মেয়েটা গর্দভ নাকি! এইভাবে লনে ঘুরে ঘুরে নিজেকে পাঁচজনের সামনে তুলে ধরছে।

সুদীপ জয়িতার কাছে এগোল না। সে দূর থেকে জয়িতাকে লক্ষ্য করতে লাগল। মাঝে মাঝে গাড়ি ঢুকছে এবং বেরুচ্ছে। হোটলের বাইরেটায় আপাতত কোন চাঞ্চল্য নেই। বোধ হয় কিছুটা ক্লান্তি অনুভব করায় জয়িতা সিঁড়ি ভেঙে বারান্দার একটা চেয়ারে বসল। আর ঠিক তখনই ভেতর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। ভাল স্বাস্থ্য, কাঁধদুটো বেশ চওড়া, সিগারেট খেতে খেতে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে অলস ভঙ্গিতে একবার জয়িতার দিকে তাকাল। তারপর সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গাড়িতে উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। সুদীপ লোকটার এই পরিবর্তন লক্ষ্য করল। দরজাটা আবার বন্ধ করে লোকটা ফিরে দাঁড়াল। সেখানে থেকেও জয়িতাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যদিও আলোটায় তেমন তেজ নেই তবু বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। কিন্তু লোকটা যদি শুধু মেয়ে দেখবার বাসনায় দাঁড়ায় তাহলে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। যে ধরনের নারী শরীরের দিকে একবার তাকালে পুরুষমানুষ মাছির মত আটকে যায় জয়িতা তা থেকে অনেক দূরে। ধীরে ধীরে লোকটা আবার হোটেলের সিড়ি ভাঙল। একটু ইতস্তত করে সোজা জয়িতার সামনে দাঁড়িয়ে লোকটা হাসল। জয়িতা যে একটু অবাক হয়েছে বোঝা গেল। লোকটা হেসে হেসে কথা বলছে। জয়িতা বারংবার মাথা নাড়ছে। হাসছে সেও। তারপর লোকটা চটপটে পায়ে ফিরে গেল তার গাড়ির কাছে। গাড়িটা যখন গেট পেরিয়ে সুদীপকে অন্ধকারে রেখে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন খুব কাছাকাছি স্পষ্ট দেখতে পেল সে। এবং তৎক্ষণাৎ মনে হল এই লোকটা পুলিশ না হয়ে যায় না। ওই চোয়াল ওই শারীরিক গঠন পুলিশদেরই হয়। গাড়ির নম্বরটা দেখে কিছুই মনে হচ্ছে না। সুদীপ দেখল জয়িতা উঠে ভেতরদিকে এগোচ্ছে। সে আর দেরি করল না। যতটা সম্ভব দৌড়ে দূরত্ব কমিয়ে হোটলে ঢুকে পড়ল। রিসেপশনের লোকটা মাথা নিচু করে হিসাব করছি। একটা দারোয়ান এসে সিঁড়ির নিচে দাঁড়াল। সুদীপ গতি কমিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গি করে হাঁটতে লাগল। জয়িতাকে দোতলার সিঁড়ির শেষ প্রান্তে দেখা যাচ্ছে। কেউ তাকে কিছু বলল না বোধ হয় তার সহজ অভিব্যক্তির জন্যেই। ডানদিকের একটা ঘরের দরজা খুলে একবার পেছন ফিরতেই জয়িতার মুখ উজ্জ্বল হল। সুদীপ ইশারায় তাকে ভেতরে ঢুকতে বললে জয়িতা মুখের হাসিটা মুছল। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সুদীপ দেখল কল্যাণ শুয়ে আছে। ওকে দেখেই সে নিজের হাত বাঁচিয়ে উঠে বসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, সব ঠিক আছে?

ঠিক ছিল। কিন্তু মনে হলে বেঠিক শুরু হল। তুই একা একা লনে কি করছিলি?

সুদীপের প্রশ্নটায় জয়িতার ঠোঁটে হাসি ফুটল, হাওয়া খাচ্চিলাম।

ইউ হ্যাভ ইনভাইটেড বাম্বু। লোকটা তোকে কি জিজ্ঞাসা করছিল?

কোন্ লোকটা?

উঃ, একটু আগে যার সঙ্গে তুই কথা বলছিলি!

ওঃ! ভদ্রলোক বললেন আমাকে ওর খুব চেনা-চেনা লাগছে। আমি কি বাই এনি চান্স শিলং-এ থাকতাম! আমি না বলতে উনি বললেন, দুঃখিত আপনাদের চেহারায় ভীষণ মিল। তখন উনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার নামটা জানতে পারি? আমি বললাম ইটস অ্যান ওন্ড ট্রিক। আপনি সোজাসুজি জানতে চাইলে পারতেন। শোনার পর চলে গেলেন। দ্যাটস্ অল। জয়িতা দুটো হাত নেড়ে কথা শেষ করল।

সুদীপ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, প্যাক আপ। তোদের এখনই হোটেল ছাড়তে হবে। আমার বিশ্বাস লোকটা পুলিশ। তোকে দেখার পর ওর ভাবভঙ্গি দেখে আর যাই হোক কোন রোমিওকে আমার মনে পড়েনি। হি ইজ পুলিশম্যান। আই অ্যাম সিওর, আধঘণ্টার মধ্যে এখানে পুলিশ ফোর্স এসে যাবে। কুইক কুইক।

কল্যাণ ততক্ষণে তার ব্যাগ তুলে নিয়েছে একহাতে, উনি আমার সঙ্গে ঝগড়া করে বাইরে গেলেন হাওয়া খেতে। একেই বলে যেচে বাঁশ নেওয়া।

আমি তোর সঙ্গে ঝগড়া করিনি কল্যাণ। তোর কমপ্লেক্স থেকে এসব বলছিস।

ওঃ স্টপ ইট! বলছি সময় নেই। সুদীপ জয়িতাকে থামাল, তারপর হাত লাগাল ওদের জিনিসপত্র গুছিয়ে দেবার জন্যে। তৈরি হয়ে জয়িতা বলল, হোটেলকে কি বলব? হঠাৎ কেন ছেড়ে চলে যাচ্ছি? আমরা মাত্র কয়েক ঘণ্টা এখানে এসেছি।

আমরা কতক্ষণ হোটেলে থাকব সেটা আমাদের ইচ্ছে। একদিনের টাকা ওদের দিয়ে দে। লেটস গো। কল্যাণ তোর ব্যাগটা আমাকে দে। সুদীপ হাত বাড়াল।

কল্যাণ আপত্তি করল, আমিই নিতে পারছিলাম। সুদীপ আপত্তি শুনল না।

রিসেপশনের লোকটাকে জয়িতা সুন্দর বুঝিয়ে দিল। ওর ভাই খবর পেয়ে বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছে। কিছুতেই হোটেলে থাকতে দিতে রাজি নয়। সুতরাং তাদের ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। একদিনের ভাড়া মিটিয়ে দিল সে। কল্যাণ দেখল টাকাটা কম নয়। বাইরে বেরিয়ে সে বলল, তোর জন্যে ঝামেলা হল। বেশ আরামদায়ক ঘর ছিল।

যেহেতু কেউ কোন কথা বলল না তাই শব্দগুলোকে বড্ড ফাঁকা শোনাল। ওরা বাইরে কোন রিকশা পেল না। অতএব হাঁটা ছাড়া কোন উপায় নেই। খানিক পরে দুপাশে দোকান রেখে হাঁটছিল ওরা। এটাই একমাত্র সড়ক। সুদীপের খেয়াল হল এইভাবে হাঁটা ঠিক হচ্ছে না। পুলিশ নিশ্চয়ই এই পথেই হোটলে আসবে। সেক্ষেত্রে সামনাসামনি পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া চারজন একসঙ্গে থাকাও উচিত নয়। নিজেদের হোটেলে এদের নিয়ে যেতে সাহস হল না ওর। পুলিশ হোটলে গিয়ে জানতে পারবে এরা হোটল ছেড়ে গেছে। আর সময় নষ্ট করবে না ওরা। সন্দেহটা সত্যি বোঝা মাত্র পুলিশ ব্যাপক তল্লাসি চালাবে। কোন হোটেল বাদ দেবে না। সেক্ষেত্রে আনন্দ এবং তারও বিপদে পড়ার সম্ভাবনা। সুদীপ চটপট সিদ্ধান্ত নিল, তোরা রাত্রের খাওয়া খেয়েছিস?

জয়িতা উত্তর দিল, না। এই সন্ধ্যেবেলায় কি কেউ রাতের খাওয়া খায়?

বাঁ দিকে একটা চাইনিজ খাবারের দোকান নজরে পড়েছিল। সেটা দেখিয়ে সুদীপ বলল, তোরা ওখানে গিয়ে টিপিক্যাল খাবারের অর্ডার দিবি যাতে সার্ভ করতে বেশ সময় নেয়। আমি আর আনন্দ না আসা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করবি।

ওরা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে সুদীপ পা বাড়াল। মিনিট পাঁচেক লাগল তার হোটলে পৌঁছতে। আনন্দ তখনও ফেরেনি। হোটেলের ম্যানেজারকে সে সেই মিথ্যেটাই বলল যা জয়িতা ওর রিসেপশনে বলেছিল। টাকাপয়সা মিটিয়ে সে আবার রিকশটা নিয়ে শহরের দিকে যেতেই দেখতে পেল তিনটে পুলিশের গাড়ি হর্ন বাজাতে বাজাতে শহর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে। তিনটেতেই পুলিশ ভর্তি। আর সময় নেই। সুদীপের মনে হল ঈশরটিশর না থাকলেও ভাগ্য বলে একটা ব্যাপার আছে।

রকেট বাস স্টেশনের সামনে বেজায় ভিড়। কলকাতার অনন্য রকেট বাস ছাড়ছে। সুদীপ কলকাতা শটা পড়তে পারল। আর তখনই বুকের মধ্যে সামান্য নড়াচড়া হল তার। এখানে আনন্দকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। দাঁড়িয়ে থাকা একটা জিপকে দেখে তার ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করল, দার্জিলিং যাবে কিনা।

লোকটা মাথা নাড়ল। বলল, কাল সকাল সাতটায় যেতে পারে। তারপর হেসে বলল, আপনি এখন যেতে চাইছেন আর একজন এসেছিল চারটের সময় যাবে বলে। অত ব্যাপার হচ্ছে আজ।

প্রায় মিনিট পনেরো ঘোরার পর একটা মিষ্টির দোকানের সামনে আনন্দকে দেখতে পেল। একটি নেপালী ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। সুদীপ কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? এনি প্রব্লেম?

আনন্দ কাঁধ ঝাঁকাল, কেউ ভোরে যেতে রাজি হচ্ছে না। সকাল ছটায় বেরুতে হবে।

এখন কেউ যাবে? সুদীপ প্রশ্ন করল।

এখন? এখন কেন? গোলমাল হয়েছে? সুদীপের দিকে তাকাল আনন্দ।

পরে বলছি। আগে চেষ্টা কর এখন যদি কেউ যায়।

নেপালী ছেলেটি কথা শুনছিল। সে বলল, এখন যদি দার্জিলিং যান তো বীরবাহাদুরের গাড়িতে যেতে পারেন। ওকে কাল ভোরে টাইগার হিলে প্যাসেঞ্জার নিয়ে যেতে হবে দার্জিলিং থেকে। কিন্তু সকাল ছটার আগে কেউ যাবে না।

সুদীপ জবাব দিল, তুমি বীরবাহাদুরকে খবর দাও। ভোরে যেতে না পারলে আমরা এখনই যাব। কথাটা শোনামাত্র ছেলেটা লাফিয়ে ছুটে গেল।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? ও এতক্ষণ আমাকে জপাচ্ছিল যাতে বীরবাহাদুরের গাড়িটা নিয়ে এখনই রওনা হই। রাত্রে পাহাড়ে ওঠায় রিস্ক অনেক বলে আমি রাজি হইনি। কল্যাণরা কি শিড়িগুড়িতে আসতে পারেনি?

পেরেছে। সুদীপ মাথা নাড়ল। তারপর সংক্ষেপে ঘটনাটা জানাল। এখন পুলিশ হোটেলে ছুটেছে জেনে ওর চোয়াল শক্ত হল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কল্যাণ আর জয়িতার মধ্যে কি নিয়ে লাগল?

কমপ্লেক্স। অন্তত জয়িতা বলেছে তাই। সুদীপ কথা শেষ করা মাত্র একটা ল্যান্ডরোভার সামনে এসে দাঁড়াল। নেপালী ছেলেটা বলল, দোশো লাগেগা।

আনন্দ সুদীপের দিকে তাকাল। সুদীপ বলল, রাজি হয়ে যা।

হোটেল থেকে মালপাত্র গাড়িতে তুলে নিয়ে ওরা সেই চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়াতেই দেখল পুলিশের জিপগুলো শহরে ফিরে যাচ্ছে। সুদীপ গিয়েছিল ওদের ডেকে আনতে। বীরবাহাদুর নামের লোকটার চেহারা প্রায় পাখির মত। আনন্দ তাকে জিজ্ঞাসা করল, এত রাত্রে পাহাড়ের রাস্তায় কোন ভয় নেই?

বীরবাহাদুর বলল, ভয় আছে বলেই তো রাত্রে কেউ দার্জিলিং-এ যায় না। আমি না গেলে মালিক ফাঁসিয়ে দেবে বলেই যাচ্ছি। তবে আমি যতক্ষণ স্টিয়ারিং-এ আছি ততক্ষণ আপনাদের কোন ভয় নেই।

নেপালী ছেলেটা ড্রাইভারের পেছনে বসে আছে। আনন্দ একটা কথা ভেবে আশ্বস্ত হল, শিলিগুড়িতে কেউ নেই যে জানাবে তারা আজ রাত্রে দার্জিলিঙ-এ যাচ্ছে। অবশ্য দার্জিলিঙ তাদের গন্তব্যস্থল নয়। ম্যাপ অনুযায়ী তাদের ঘুম থেকে ঘুরে যাওয়ার কথা। এই সময় সুদীপ ওদের নিয়ে ফিরে এল। গাড়িতে উঠে কল্যাণ প্রথম অভিযোগ করল, সবে খাবার সার্ভ করেছে এই সময় সুদীপটা টেনে আনল। পেটে এখন ছুঁচোয় ভন মারছে।

সুদীপ হাসল, এখন চিকেন চাউমেন খেতে গেলে বাকি জীবন জেলের লপসি খেতে হত।

রাত্রের অন্ধকারে শিলিগুড়ি থেকে ল্যাভরোভারটা ছুটে যাচ্ছিল শুকনার দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *