২৫. যোহান উলফগ্যঙ ভন গ্যেটে (১৭৪৯–১৮৩২)
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে জার্মানিতে প্রকাশিত হল একখানি উপন্যাস, নাম “The sorrows of Werther” (তরুণ ভেক্টরের শোক)। উপন্যাস প্রকাশিত হবার সাথে সাথে সমস্ত জার্মানিতে আলোড়ন পড়ে গেল। ক্রমশই তার ঢেউ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আছড়ে পড়ল সমস্ত ইউরোপে, এমনকি সুদূর চীনেও।
কাহিনীর নায়ক ভের্টর এক ছন্নছাড়া যুবক। তার কবি মন স্বপ্নের জগতে বাস করে। মাঝে মাঝেই আঘাত পায়, বেদনায় ভেঙে পড়ে। আবার সব ভুলে নতুন করে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সে স্বপ্নও ভেঙে যায়। নতুন জীবনের আশায় শহরের কাছে এক গ্রামে এল। গ্রামের মুক্ত প্রকৃতি গছা ফুল পাখি মানুষ মুগ্ধ করে ভেক্টরকে, প্রিয়তম বন্ধু হেলমকে চিঠি লেখে ভেক্টর। এই চিঠির মালা সাজিয়েই সৃষ্টি হয়েছে উপন্যাস। জীবনে আঘাত ব্যর্থতা হতাশায় শেষ পর্যন্ত সব আশা হারিয়ে আত্মহত্যা করে ভের্টর।
ভেক্টরের আশা নিরাশা তার কল্পনা রোমান্স সমস্ত মানুষের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করল। যুবক-যুবতীদের কাছে ভের্টর হয়ে উঠল আদর্শ। উপন্যাসের পাতা ছাড়িয়ে ভেক্টর হয়ে উঠল এক জীবন্ত মানব। তার অনুকরণে ছেলেরা পরতে আরম্ভ করল নীল কোট, হলদে ওয়েস্ট কোট। মেয়েরা নায়িকার মত সাদা পোশাক আর পিঙ্ক বো-তে নিজেদের সাজাতে থাকে। সকলেই যেন ভেক্টরের জীবনের সাথে জীবন মেলাতে দলে দলে যুবক-যুবতীরা আত্মহত্যা করতে আরম্ভ করল।
শুধু একটি মানুষ নির্বিকার। ভেক্টরের জীবনের সেই বিষাদ, বিষণ্ণতা, অন্ধকার তার জীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি কারণ তিনি যে চির আলোর পথিক, ভেক্টরের স্রষ্টা, জার্মান সাহিত্যের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ পুরুষ যোহান উলফগ্যঙ ভন গ্যেটে।
গ্যেটের জন্ম জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট শহরে। তারিখটি ছিল ১৭৪৯ সালের ২৮ শে আগস্ট। গ্যেটের প্রপিতামহ ছিলেন কামার, পিতামহ দর্জি। পিতামহ চেয়েছিলেন সম্ভ্রান্ত নাগরিক হিসাবে ছেলেকে গড়ে তুলতে। গ্যেটের পিতা যোহান ক্যাসপার পড়াশুনা শেষ করে উচ্চপদস্থ কর্মচারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। যোহান ছিলেন যেমন শৃঙ্খলাপরায়ণ তেমনি সুপণ্ডিত। অন্যদিকে গ্যেটের মা ছিলেন সহজ সরল উদার হৃদয়ের মানুষ। গ্যেটের জীবনে পিতা এবং মাতা দুজনেরই ছিল ব্যাপক প্রভাব। গ্যেটে লিখেছেন, আমার জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল পিতার কাছ থেকে, মায়ের কাছে পেয়েছিলাম সৃষ্টির প্রেরণা।
ছেলেবেলা থেকেই গ্যেটে ছিলেন এক ভিন্ন চরিত্রের মানুষ। পিতা যোহান ক্যাসপার চেয়েছিলেন ছেলে তার মতই একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী হবে। চার বছর বয়েসে গ্যেটেকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। কিন্তু স্কুলের ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে অল্পদিনেই গ্যেটের প্রাণ হাঁপিয়ে উঠল। মাস্টারদের শাসন, অন্য ছেলেদের দুষ্টামি, কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার বেড়াজালে কিছুতেই নিজেকে মানিতে নিতে পারলেন না। অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাধ্য হয়ে পিতা তাঁকে বাড়িতে এনে গৃহশিক্ষক রেখে পড়াবার ব্যবস্থা করলেন। একদিকে চলতে লাগল ল্যাটিন, গ্রীক, ইটালিয়ান, ইংরাজি ভাষা শিক্ষা, অন্যদিকে ছবি আঁকা, গান শেখা। এরই মধ্যে শৈশব কালেরই গ্যেটের মনে গড়ে উঠেছিল এক ভিন্ন জগৎ। যা প্রচলিত জীবন পথ থেকে স্বতন্ত্র, মাত্র ছ বছর বয়েসে ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন গ্যেটে। দুচোখ ভরে দেখতেন প্রকৃতির অপরূপ শোভা। মানুষজন বাড়িঘর জীবনের নানা রূপ। যা কিছু একবার দেখতেন জীবনের স্মৃতিপটে তা অক্ষয় হয়ে থাকত। কৈশোরের এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে তার নানান রচনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে।
কৈশোরেই শুরু হয়েছিল তাঁর সাহিত্য জীবনের হাতেখড়ি। তিনি নিজের সম্বন্ধে লিখেছেন, “যখন আমার দশ বছর বয়েস তখন আমি কবিতা লিখতে শুরু করি যদিও জানতাম না সেই লেখা ভাল কিম্বা মন্দ। কিন্তু উপলব্ধি করতে পারতাম অসাধারণ কিছু সৃষ্টি করবার ক্ষমতা আমার মধ্যে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জন্ম থেকেই তিনি কবি। কবিতা ছিল তার সত্তায় আর সেই সত্তার সাথে মিশে ছিল তাঁর প্রেম। যে প্রেমের শুরু মাত্র পনেরো বছর বয়েসে। শেষ প্রেম চুয়াত্তর বছর বয়েসে।
একদিন গ্যেটে তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে সরাইখানায় গিয়েছেন, সেখানে দেখলেন সরাইখানার মালিকের কিশোরী কন্য মাগুরিতকে। তাঁর চেয়ে কয়েক বছরের বড়। কিন্তু প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হলেন গ্যেটে। অল্প দিনেই দুজনে পরস্পরের প্রতি গভীর প্রেমে আকৃষ্ট হলেন। গ্যেটে লিখেছেন তার প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ আমার মনের মধ্যে সৃষ্টি করল এক নতুন সৌন্দর্যের জগৎ আর আমাকে উত্তোরিত করল পবিত্রতম মহত্ত্বে।
গ্যেটের কৈশোর জীবনের প্রথম প্রেম দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাগুরিত ফ্রাঙ্কফুট ছেড়ে পিতার সঙ্গে গ্রামে চলে গেলেন।
বিচ্ছেদ বেদনায় সাময়িক ভেঙে পড়লেও ধীরে ধীরে আবার নিজেকে আনন্দ জগতে ভাসিয়ে দিলেন গ্যেটে। সমস্ত দিন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আমোদ আহ্লাদেই কেটে যায়। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন পিতা। স্থির করলেন আইন পড়বার জন্য গ্যেটেকে লিপজিগে পাঠাবেন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধুমাত্র পিতাকে সন্তুষ্ট করবার জন্য গ্যেটে লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। আইনের প্রতি সামান্যতম আকর্ষণ ছিল না তার। ক্লাস কামাই করে অধিকাংশ সময় তিনি ঘুরে বেড়াতেন পথে প্রান্তরে, বাজারে মানুষের ভিড়ে। “আমি মনে করি এই পৃথিবী আর ঈশ্বর সম্বন্ধে আমার জ্ঞান কলেজের শিক্ষকদের চেয়ে বেশি। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চার-দেওয়ালের ক্লাসঘরের মধ্যে থেকে আমি যা জানতে পারব, বাইরের উন্মুক্ত পৃথিবীর মানুষদের কাছ থেকে তার থেকে অনেক বেশি জানতে পারবে।”
তাঁর এই জীবনবোধের অনুপ্রেরণায় মাত্র সতেরো বছর বয়সে রচনা করলেন নাটক Lover’s Quarrels এবং The fellow Sinners। শেষ নাটকটির বিষয়বস্তু হচ্ছে বিবাহিত জীবনের ব্যভিচার। এক বৃদ্ধ যিনি যৌবনের পাপের জন্য নিয়ত অনুশোচনায় যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, এক নৈতিক প্রশ্ন তাঁর জীবনে বড় হয়ে উঠেছে। তরুণ গ্যেটের মনে হয়েছে। আমরা সকলেই অপরাধী। অপরাধবোধের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ অন্যকে ক্ষমা করা, অতীতকে বিস্মৃত হওয়া।
গ্যেটে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পা দিয়েছেন। তাঁর স্বপ্নলু চোখ সুদর্শন চেহারা, প্রাণের উচ্ছলতা সকলকে আকৃষ্ট করে। এক অজানা আকর্ষণে যে তার সংস্পর্শে আসে, সেই মুগ্ধ হয়ে যায়।
উচ্ছ্বাসের রঙিন ফেনায় লিপজিগের দিনগুলো কাটতে থাকে। এই সময় গ্যেটের পরিচয় হল বাড়িওলার মেয়ে এনেৎ-এর সাথে কয়েকদিনের মধ্যেই তার প্রেমে পড়ে গেলেন গ্যেটে। কিন্তু অল্প দিনেই প্রেমের জোয়ারে ভাটা পড়ল গ্যেটের। এনেৎ-এর আচরণে তাঁর প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়লেন। নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় ভেঙে পড়লেন গ্যেটে। উপরন্তু বেহিসেবী উদ্দাম জীবনযাত্রার কারণে তার স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়েছিল। গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বন্ধুরা তাঁর জীবনের আশা ত্যাগ করল। কিন্তু অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর গ্যেটে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। আর লিপজিগ ভাল লাগছিল না। ফিরে এলেন ফ্রাঙ্কফুটে। যোহান ক্যাসপার চেয়েছিলেন ছেলে আইনজ্ঞ হয়ে ফিরে আসবে। গ্যেটে পিতার কাছে ফিরে এলেন তবে আইনজ্ঞ হয়ে নয়, কবি হয়ে।
ছেলের পরিবর্তন পিতা-মাতার চোখ এড়াল না। তবুও তারা আশা হারালেন না। এই সময় গ্যেটে মায়ের এক বন্ধু তাকে এ্যালকেমির (মধ্যযুগের রসায়ন শাস্ত্র) ভর্তি করে। দিলেন। শুরু হয় গ্যেটের এ্যালকেমি শিক্ষা। এই এ্যালকেমি বিদ্যাকেই তিনি রূপ দিয়েছেন তাঁর ফাউস্টে।
গ্যেটের পিতা চেয়েছিলেন পুত্র এ্যালকেমিস্ট হিসাবে নয়, আইনজ্ঞ হিসাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করুক। পিতার ইচ্ছা অনুসারে ১৭৭০ সালে গ্যেটে ফ্রাঙ্কফুট ত্যাগ করে এলেন স্ট্যাটসবুর্গে। আইনের অসমাপ্ত পাঠ শেষ করবার জন্য ভর্তি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্যেটে যেখানে থাকতেন তারই সংলগ্ন ঘরে ছিল কয়েকজন ডাক্তারির ছাত্র। অল্প দিনেই তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন গ্যেটে। শুরু হল তাঁর শরীরতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা। এখানেই পরিচয় হল বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের রচনাবলীর সাথে। ভর্তি হলেন সঙ্গীত শিক্ষার স্কুলে। দেখতে দেখতে অল্পদিনের মধ্যে গ্যেটে হয়ে উঠলেন স্ট্যাটসবুর্গের শিক্ষিত সমাজের মধ্যমণি।
গ্যেটের জীবনে ঘটল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গেটের পাশের কক্ষে থাকতেন ওয়েল্যান্ড নামে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক ছাত্র। একদিন গ্যেটেকে নিয়ে গেলেন স্ট্যাটসবুর্গের অদূরে এক গ্রাম্য যাজকের বাড়িতে। সেখানে দেখা হল যাজকের ১৮ বছরের তরুণী কন্যা ফ্রেডরিখ ব্রিয়নের সাথে। তার হাঁটু পর্যন্ত স্কার্টে ঢাকা রয়েছে। মুখে এক গ্রাম্য সরলতা। চোখে উজ্জ্বল স্বচ্ছ দৃষ্টি। প্রথম দর্শনেই ভালবাসার গভীর বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেলেন দুজন। গ্রাম্য প্রকৃতির মাঝে ব্রিয়নের সহজ সরলতা, অনুপম সৌন্দর্য গ্যেটের জীবনের এক নতুন দিগন্তের দ্বারকে উন্মোচিত করল। এই প্রথম গ্যেটে অনুভব করলেন প্রকৃত প্রেমের স্বরূপ। বিবাহের কথা উঠল। কিন্তু গ্যেটে বুঝতে পারলেন সামাজিক কারণে তাদের মধ্যে বিবাহ হওয়া সম্ভব নয়। তখন আইন পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। ভাগ্যক্রমে গ্যেটে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। বাড়ি থেকে পিতার ডাক এল।
গ্যেটে বুঝতে পারছিলেন ফ্রেডরিখের সাথে তাঁর মিলন সম্ভব নয়। বিষণ্ণ হৃদয়ে গ্যেটে ফিরে গেলেন ফ্রাঙ্কফুটে। গ্যেটের জীবনে বহু নারীর আগমন ঘটেছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র ফ্রেডরিখ সারা জীবন অবিবাহিত থেকে যান। নিজের সম্বন্ধে ফ্রেডরিখ বলেছিলেন, যে মন আমি গ্যেটেকে উৎসর্গ করেছি তা আর কাউকে দিতে পারব না।
ফ্রাঙ্কফুটে ফিরে আসতেই গ্যেটের পিতা তাঁকে পাঠালেন সুপ্রীম কোর্টে। মনের ইচ্ছা পুত্র আইনের জগতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করুক। সুপ্রীম কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করলেন গ্যেটে। কিন্তু আদালতের কাজকর্মের অবস্থা অল্পদিনেই আইন ব্যবসায়ের উপর সব শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেললেন গ্যেটে। স্থির করলেন আর আইন নয়, সাহিত্যই হবে তার জীবনের একমাত্র পেশা।
গ্যেটের প্রিয় লেখক ছিলেন শেকস্পীয়র। তাঁর অনুকরণে তিনি লিখলেন একটি পঞ্চম অঙ্কের নাটক। সাহিত্য হিসাবে এর সামান্যই মূল্য আছে।
সুপ্রীম কোর্টে কাজ করবার সময় গ্যেটে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই পরিবারের কুড়ি বছরের তরুণী কন্যা লটিকে দেখেই তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। গ্যেটে। কিন্তু অল্পদিনেই গ্যেটে জানতে পারলেন লটি অন্য পুরুষের বাগদত্তা। শুধু তাঁর সাথে প্রেমের অভিনয় করেছে। আকস্মিক এই আঘাতে মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন গ্যেটে। মনে হল আত্মহত্যা করবেন। কিন্তু ধীরে ধীরে মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে আবার উঠে দাঁড়ালেন গ্যেটে।
লটির প্রতি ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতি, তার প্রেমিকের প্রতি ঈর্ষা গ্যেটের মনোজগৎকে এত গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল, চার সপ্তাহের মধ্যে রচনা করলেন তাঁর অবিস্মরণীয় উপন্যাস The sorows of Werther. তরুণ ভেক্টরের শোক। সমস্ত জার্মানি তথা ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল সেই উপন্যাসের প্রতিক্রিয়া। চব্বিশ বছরের অখ্যাত যুবক গ্যেটে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন।
সেদিনকার কিছু সমালোচক এঁকে সেন্টিমেন্টাল রোমান্স বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, তরুণ সমাজের কাছে এই বই চিরদিনের।
এই বইয়ের নায়ক এক তরুণ, নাম ভের্টর। স্বপ্নের জগতে বাস করে ভের্টর। তার মন পাখা মেলে উড়ে বেড়ায়। কিন্তু জীবনের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে সব স্বপ্ন তার ভেঙে গেল। একদিন পথে বেরিয়ে পড়ল। ঘুরতে ঘুরতে ভের্টর এসে পড়ল একটা ছোট গ্রাম ভালহাইমে। বসন্তকাল, সমস্ত প্রকৃতি নতুন সাজে সেজে উঠেছে। মুগ্ধ হয়ে গেল ভেক্টর। সেখানেই রয়ে গেল। মনে হল এখানেই জীবনের সব দুঃখকে ভুলতে পারবে।
ধীরে ধীরে তার মন শান্ত প্রকৃতিস্থ হয়ে আসছিল। এমন সময় দেখা হল শারললাটের সাথে। সে অ্যালবার্টের বাগদত্তা। তবুও তাকে দেখে মুগ্ধ হল ভের্টর। ভালবাসার বাঁধনে বাঁধা পড়ল সে। পরিচিত হল অ্যালবার্টের সাথে। অ্যালবার্টের শান্ত ভদ্র আচরণে বিভ্রান্ত ভের্টর। কেমন করে শারলোটকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে আনবে, আবার শারলোটকে না পেলেও যে তার জীবন অন্ধকার।
মানসিক যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ে ভের্টর। শেষে ঠিক করল সে চলে যাবে অন্য কোথাও। বন্ধু তার জন্যে একটা চাকরি ঠিক করল। কিন্তু চাকরি নিয়েও সুখী হতে পারল না। একদিন সব ছেড়ে আবার ফিরে এল ভালহাইমে। শারলোট তখন অ্যালবার্টের স্ত্রী। সমস্ত অন্তর ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে ভেক্টরের। হতাশার বেদনায় আত্মহত্যা করল ভেক্টর। লাইম গাছের নিচে তার দেহ সমাধি দেওয়া হল।
সমস্ত উপন্যাসটি পত্রগুচ্ছের সংকলন। অনেকে বিদগ্ধ সমালোচকের অভিমত উনিশ শতকে ইংরেজি সাহিত্যে যে রোমান্টিক মুভমেন্টের বিকাশ ঘটেছিল তার মূল অনুপ্রেরণা তরুণ ভেক্টরের শোক।
তরুণ ভেক্টরের শোক যখন প্রকাশিত হল, গ্যেটে তখন আইন ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই উপন্যাসের খ্যাতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্থির করলেন সাহিত্যকেই জীবনের একমাত্র অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করবেন। সম্ভবত এই সময় থেকেই গ্যেটের মনের মধ্যে ফাউষ্টের ভাবনা জন্ম নেয়।
১৭৭৪ সালে তিনি লিখলেন তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় নাটক Clavigo। এই নাটকের বিষয়বস্তু তিনি পেয়েছিলেন কোরআন থেকে।
গ্যেটের খ্যাতি জনপ্রিয়তা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছিল। যদিও অভিজাত সম্প্রদায়কে তিনি তার বহু রচনায় বিদ্রূপ করেছেন তবুও তাদের প্রতি ছিল এক সহজাত আনুগত্যবোধ আর শ্রদ্ধা। তার এক বন্ধু রাজদরবারে চাকরি নেওয়ার পর তিনি লিখেছিলেন, “ক্ষমতাবান প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, তাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মধ্যে আমি কোন দোষ দেখি না। যদি শ্রেষ্ঠ মানুষদের সাথে সম্পর্ককে যথার্থভাবে কাজে লাগান যায় তবে তা সব সময়েই কল্যাণকর।”
যখন যুবরাজ কার্ল লুডউইগ তাঁকে ওয়েমারে আমন্ত্রণ করলেন, গ্যেটে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে যুবরাজের আতিথ্য গ্রহণ করলেন। তখন তার বয়স ছাব্বিশ। অবশিষ্ট জীবন তিনি এখানেই অতিবাহিত করেন।
প্রাসাদের কাছেই একটি উদ্যান বাড়িতে তার থাকার ব্যবস্থা হল। এখানে পরিচয় হল দুই কিশোর রাজকুমারের সঙ্গে। এই পরিচয় ভবিষ্যৎ জীবনে এক বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
কার্ল ছিলেন শিক্ষা জ্ঞান শিল্প সংস্কৃতির গভীর পৃষ্ঠপোষক। গ্যেটের জ্ঞান সৃজনীশক্তি ব্যক্তিত্ব দেখে মুগ্ধ হলেন কার্ল। তাকে অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নির্বাচিত করলেন। গ্যেটে উপলব্ধি করেছিলেন তার দায়িত্বের কথা। তাই সমস্ত কাজকে দুভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। একদিকে রাজনীতি অন্যদিকে সাহিত্য সৃষ্টি। কনফুসিয়াসের মত তিনিও তরুণ যুবরাজকে নানান বিষয়ে শিক্ষা দিতেন, পরামর্শ দিতেন। এর জন্যে নিজেকে স্বাধীনতা বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হতেন না। সাহিত্যে যিনি ছিলেন চির বিদ্রোহী, ব্যক্তিজীবনে তিনি তার সম্পূর্ণ বিপরীত, রাজশক্তির প্রতি চরম অনুগত।
একদিন তিনি ও সুরকার বিঠোফেন রাজপথ দিয়ে হাঁটছিলেন। সেই সময় যুবরাজ সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সকলে রাজপথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল। বিঠোফেন কোন ভ্রূক্ষেপ না করে যুবরাজের সামনে দিয়েই পথ অতিক্রম করে গেলেন। কিন্তু গ্যেটে মাথার টুপি খুলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
এই আনুগত্যের পেছনে আরো একটি কারণ ছিল। তিনি যেমন সাহিত্য সংস্কৃতিকে ভালবাসতেন তেমনি চাইতেন সুখ বিলাসিতা। যুবরাজের সভাসদ হলেও প্রকৃতপক্ষে তার উপর কোন দায়িত্ব ছিল না। তার অধিকাংশ সময় কাটত জ্ঞানের চর্চায়।
এখানেই পরিচয় হল এক অভিজাত পরিবারের সুন্দরী তরুণীর সাথে। Lili Schonemann. অল্পদিনের মধ্যেই গভীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠল দুজনের মধ্যে। বিবাহের প্রস্তাব দিলেন গ্যেটে। কিন্তু Lili-এর পরিবারের লোকজন গ্যেটের প্রতিষ্ঠার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে চাইলেন। ক্ষুব্ধ গ্যেটে নিজেই এই সম্পর্ক ছিন্ন। করলেন। কিন্তু এই প্রেম কালজয়ী হয়ে আছে ফাউস্টের বহু দৃশ্যে।
একদিকে যখন ফাউস্ট রচনার কাজ চলেছে, তারই পাশাপাশি আমেরিকান বিপ্লবের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে রচনা করলেন তাঁর নাটক, এগৰ্মত। এই নাটকের বিষয়বস্তু হল স্পেনের অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডবাসীদের বিদ্রোহ। এই নাটকের নায়ক কাউন্ট। এগৰ্মত ছিলেন দেশপ্রেমিক কিন্তু বাস্তব জ্ঞানহীন। নিজের সামর্থ্য শত্রুর শক্তিতে বিচার না করেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সংগ্রামে। এই হটকারিতার জন্যেই শেষ হল তার জীবন।
১৭৭৯ সাল নাগাদ অসুস্থ হয়ে পড়লেন ডিউক কার্ল। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য ডিউক এবং গ্যেটে গেলেন সুইজারল্যান্ডে। এখানকার শান্ত পরিবেশ, মনোরম প্রাকৃতিক নিসর্গ দৃশ্য। গ্যেটের মনে এক গভীর প্রশান্তি নিয়ে আসে। ওয়েমারে প্রত্যাবর্তন করে গ্যেটে গভীর অধ্যয়ন শুরু করলেন। মূলত বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ছাড়াও তিনি পড়তেন ইতিহাস, দর্শন, চিত্রকলা। গ্যেটের উদ্দেশ্য ছিল ওয়েমারের কৃষি, খনিজ উত্তোলন, সামরিক উন্নয়নের জন্য এই জ্ঞানকে কাজে লাগানো। তাছাড়া নিজেরই অন্তহীন জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পাওয়া ফাউস্টের মত গ্যেটেও ছিলেন চির জ্ঞান-অন্বেষী।
একদিকে চলছিল তাঁর জ্ঞান সাধনা অন্য দিকে সাহিত্য সাধনা। এগতের পর রচনা করলেন ভিন্নধর্মী উপন্যাস উইলেম মেস্তার। এই উন্যাসে গ্যেটের নিজের জীবনই অনেকাংশে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। গ্যেটে যাদের ভালবেসেছিলেন তাদের কাউকেই জীবন সঙ্গী হিসাবে পাননি। ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রনা তাঁকে আহত করলেও চলার পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি। উপন্যাসের নায়ক মেস্তারের জীবনেও বারে বারে প্রেম এসেছিল কিন্তু প্রতিবারই সে ব্যর্থ হয়েছে। তবুও তার চলার ছন্দ বিনষ্ট হয়নি। কিন্তু ঘটনর আধিক্যে উপন্যাসের ছন্দ অনেকাংশে বিঘ্নিত হয়েছে।
তবে গ্যেটের সার্থক উপন্যাস কাইন্ডার্ড বাই চয়েস’ বা ‘সিলেকটিভ এ্যাফিনিটি’। একই পরিবেশের মধ্যে গড়ে উঠেছে কয়েকটি নরনারী-এডওয়ার্ড ও ওতিলে, শার্লোতে ও ক্যাপ্টেন। একদিকে নায়ক-নায়িকাদের ইচ্ছাশক্তি অন্যদিকে নিয়তি, এই দুই-এর দ্বন্দ্ব, তার বিস্তারই এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু।
উপন্যাস লিখলেও গ্যেটে অনুভব করেছিলেন উপন্যাসে নয়, নাটকেই তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটা সম্ভব। একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুললেন নাটকের দল লিটলট থিয়েটার। এই দলের প্রয়োজনে কয়েকটি অসাধারণ নাটক রচনা করেছিলেন। প্রথম পর্বের নাটকে দেখা যায় তারুণ্য আর যৌবনের উদ্দামতা। তার Stella নাটকে দেখা যায় নায়ক তার স্ত্রীর সাথে বাস করে, অন্যদিকে তার প্রেমিকাকেও ভালবাসে। তিনজনের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক পারস্পরিক সম্পর্ক। এ পরোক্ষভাবে দুই পত্নী গ্রহণের মতবাদ। এর বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে ওঠে। নিরুপায় হয়ে গ্যেটে নাটকের শেষ অঙ্কের পরিবর্তন ঘটালেন। নায়ক স্থির করতে পারে না কাকে বেছে নেবে স্ত্রী না প্রেমিকাকে? মানসিক দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে।
কিন্তু ক্রমশই গ্যেটের মধ্যেকার এই বিদ্রোহ মনোভাব প্রশমিত হয়ে আসে। যৌবনের উদ্দামতায় যিনি বিদ্রোহী হয়ে সব কিছুকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, এখন হয়ে ওঠেন প্রজ্ঞাবান দার্শনিক, যিনি সব কিছুর মধ্যে অন্বেষণ করেন সৌন্দর্যের প্রজ্ঞার, তিনি জানতেন অভিজাতদের বাইরের সৌন্দর্যের মধ্যে প্রকৃত সৌন্দর্যকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একদল কয়লা খনির শ্রমিক, রুটি তৈরির কারিগরকে দেখে বলেছিলেন তথাকথিত এই নিচু সমাজের মানুষেরাই ঈশ্বরের চোখে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে সুন্দর।
মানুষের প্রতি এই অন্তহীন ভালবাসাই ছিল তাঁর সৃষ্টির মূল উৎস। একবার ডিউক কার্ল ফরাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ডিউক যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করবার জন্যে ডেকে পাঠালেন গ্যেটেকে। গ্যেটে এলেন কিন্তু মানুষের এই বীভৎসতা তাঁর ভাল লাগল না। তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে এক নির্জন অঞ্চলে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন ফুল, প্রকৃতি। দেশকে তিনি ভালবাসতেন। যখন তাঁকে বলা হয়েছিল যুদ্ধের জন্য গান লিখতে, তিনি বলেছিলেন, যে বিষয়ে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই, সেই বিষয়ে আমি একটি শব্দও উচ্চারণ করি না। আমি যা ভালবাসি শুধু তারই গান গাইতে পারি।
১৭৮৮ সাল, তখন গ্যেটের বয়স ৩৯। তারুণ্যের প্রান্তে পৌঁছে পরিচয় হল ক্রিস্টেন ভারপাইনের সাথে। ক্রিস্টেন তার ভাইয়ের জন্য একটি সুপারিশপত্র নিয়ে এসেছিলেন গ্যেটের কাছে। ক্রিস্টেনের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য শান্ত স্বভাব, সম্বপূর্ণ ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হলেন গ্যেটে। ক্রিস্টেনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। দীর্ঘ আঠারো বছর তারা একত্রে রয়ে গেলেন। ১৮০৬ সালে শুধুমাত্র সন্তানের পরিচয়ের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দুজনে বিবাহ করেন।
গ্যেটের জীবনের আরেকটি ঘটনা, কবি শীলারের সাথে পরিচয়। এই পরিচয় অল্পদিনের মধ্যেই গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হল। যদিও দুজনে ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের মানুষ। গ্যেটের বয়স তখন ৪৫, শীলারের ৩৫। গ্যেটে প্রাণবন্ত সজীব, শীলার অসুস্থ। ধর্মের প্রতি গ্যেটের প্রাণবন্ত সজীব, শীলার অসুস্থ। ধর্মের প্রতি গ্যেটের কোন আগ্রহ ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন অন্তরের প্রকৃতির সৌন্দর্যে। অন্যদিকে শীলার ছিলেন ধর্মভীরু, তিনি বিশ্বাস করতেন ন্যায়বিচারে। গ্যেটে পেয়েছেন ভাগ্যের অকৃপণ সহায়তা, নারীর প্রেম কিন্তু শীলার পেয়েছেন শুধু দারিদ্র্য আর বঞ্চনা। এত বৈষম্য সত্ত্বেও দুজনের বন্ধুত্ব ছিল অকৃত্রিম। এই বন্ধুত্ব দুজনের সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। শীলার Horen নামে একটি পত্রিকা সম্পাদন করতেন। গ্যেটে এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। এই সময় তাদের লেখার একাধিক বিরূপ সমালোচনা হতে থাকে। দুজনে সরস বুদ্ধিদীপ্ত কবিতায় তার জবাব দিতে থাকেন। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে। যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ Musen Almanach।
১৮০৫ সালে যখন শীলারের মৃত্যু হয়, গ্যেটে শিশুর মত কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। এক বন্ধুকে লিখেছিলেন আমার অর্ধেক অস্তিত্ত্ব চলে গেল।
মাত্র ৪৫ বছর বয়েসে বন্ধু দেহরক্ষা করলেও ঈশ্বরের আশীর্বাদে দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন গ্যেটে। ১৭৪৯-১৮৩২ প্রায় তিরাশি বছর-এই সুদীর্ঘ জীবনে অনেক কিছু হারাতে হয়েছে তাঁকে-প্রিয় বন্ধু, আদরের বোন, প্রিয়তমা স্ত্রী, একমাত্র সন্তান। এত বেদনার মধ্যেও তাঁর জীবনের অপ্রতিহত গতি কখনো রুদ্ধ হয়নি। তিনি তাঁর সমস্ত যন্ত্রণা বেদনাকে ব্যর্থতাকে রূপান্তর ঘটিয়েছেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে। এমন বিস্ময়কর বহুমুখী প্রতিভা মানব ইতিহাসে দুর্লভ। কি ছিলেন না তিনি? কবি, নাট্যকার, চিত্রকর, সঙ্গীতজ্ঞ, বিজ্ঞানী, দার্শনিক।
তিনি প্রায় ৬০টি বই লিখেছেন-এর মধ্যে আছে গাথা, গীতিকবিতার ব্যঙ্গনাটক, কাব্য, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস, মজাদার কাহিনী, ভূত-দৈত্যদানার গল্প। তার এই বহুব্যাপ্ত প্রতিভার নির্যাস দিয়ে সমস্ত জীবন ধরে সৃষ্টি করেছেন ফাউস্ট, যার প্রথম খণ্ড লিখতে লেগেছিল ত্রিশ বছর, দ্বিতীয় খণ্ড শেষ করতে লেগেছিল পঁচিশ বছর।
ফাউস্টের কাহিনী প্রচলিত কাহিনী থেকেই নেওয়া। স্বর্গে ঈশ্বর ও দেবদূতেরা। মিলিত হয়েছেন। সকলে যখন ঈশ্বরের বন্দনা গান গাইছে, শয়তানদের প্রভু মেফিস্টোফিলিস বলল, ঈশ্বরের সৃষ্ট মানবের চরম ব্যর্থতার কথা।
ভগবান বললেন, তার অনুগত সেবক ফাউস্টের কথা।
শয়তান বলল, আমি তার বুদ্ধি বিনাশ করে আমার দলে নিয়ে আসব।
ভগবান বললেন, মানুষ হয়ত ভুল করতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখবে তার অন্তরে এক সৎ আত্মা জেগে উঠছে।
ঈশ্বরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতার অহংকার নিযে মেফিস্টোফিলিস পৃথিবীতে ফিরে আসে। ফাউস্টকে সে জয় করবেই।
ফাউস্ট মহাজ্ঞানী। মানুষের সমস্ত জ্ঞানকে সে আত্মস্থ করেছে, তবুও তার মনে হয়েছে এই বিশ্বের রহস্য তার কাছে অজ্ঞাত। তাই সব জ্ঞান বর্জন করে আশ্রয় নিয়েছে জাদুবিদ্যার।
ফাউস্টের শিষ্য ভাগনার। সেও গুরুর মত জ্ঞানের সন্ধানী।
ফাউস্ট নিজের পাঠাগারে রাশি রাশি পুঁথির মধ্যে বসে অস্থির হয়ে ওঠে। মনে হয় এই প্রাণশূন্য শুষ্ক পুঁথি তার দুঃখ, মানসিক যন্ত্রণাকেই যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। জীবনের কোন অর্থই খুঁজে পায় না ফাউস্ট। বিষের শিশি তুলে নিয়ে স্থির করে এই যন্ত্রণাময় জীবনকে শেষ করবে।
এমন সময় কানে আসে ইস্টারের সঙ্গীত। প্রভু যীশুর পুনরভ্যুত্থান, তাঁর প্রেমের বন্দনা। মুহূর্তে ফাউস্টের সমস্ত অন্তর এক অজানা আনন্দে পূর্ণ হয়ে ওঠে। তার দু চোখ বেয়ে নামে অশ্রুধারা।
পরদিন ইস্টার। ফাউস্ট তাঁর শিষ্য ভাগনারকে নিয়ে নগর প্রাকারে আসে। নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ আনন্দ করছে। ফাউস্টও তাদের সাথে যোগ দেয়। এই প্রথম সে উপলব্ধি করে সকলের আনন্দের সাথে নিজের আনন্দকে মিশিয়ে দেবার আনন্দ।
সন্ধ্যেবেলায় গৃহ পথে ফেরার সময় চোখে পড়ে একটা কুকুর তাদের অনুসরণ করছে। কুকুরটা সামনে এসে বিরাট আকার ধারণ করল, তারপর পরিণত হল এক ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে। সেই ধোয়া থেকে বেরিয়ে এল শয়তান মেফিস্টো ফিলিস। ফাউস্টের সামনে এসে বলল, প্রভুর কি হুকুম?
ফাউস্ট জানতে চায় তার পরিচয়। শয়তান ফাউস্টকে বলে সে ফাউস্টের দাসত্ব করবে। ফাউস্টের সকল আকাঙ্ক্ষাকে তৃপ্ত করবে।
কিন্তু তার বিনিময়ে ফাউস্টকে কি দিতে হবে?
শয়তান জবাব দিল জীবনে সে হবে ফাউস্টের ভৃত্য মৃত্যুর পর ফাউস্ট হবে তার ভূত।
জীবনের পর অনন্ত অন্ধকার। সেই অন্ধকারের কথা ভাবে না ফাউস্ট। তার চাই জীবনের সুখ।
রক্তের অক্ষরে চুক্তি লেখা হয় তাদের।
দুজনে বেরিয়ে পড়ল পথে। প্রথমে এল এক সরাইখানায়। সেখানকার আনন্দ উল্লাস ভাল লাগে না ফাউস্টের। তখন শয়তান তাকে নিয়ে এল ডাকিনীদের কাছে। তারা দিল জাদু পানীয়। সেই পানীয় খেতেই বয়োবৃদ্ধ ফাউস্ট হল সজীব উজ্জ্বল এক তরুণ।
দুজন পথে বেরিয়ে পড়ল। সেই পথে চলেছিল একটি মেয়ে, নাম মার্গারেট, নিষ্পাপ কুমারী। তাকে ভাল লাগে ফাউস্টের। এমন পবিত্র হৃদয়কে স্পর্শ করবার ক্ষমতা নেই শয়তানের। কিন্তু মার্গারেটের প্রেমে মুগ্ধ ফাউস্ট তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে চায়। কিন্তু তার সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দেয় মার্গারেট। তার বাড়িতে গিয়ে এক বাক্স অলঙ্কার রেখে আসে। এমন বহুমূল্য গহনা দেখে কি করবে ভেবে না পেয়ে মার্গারেট পাদ্রীর কাছে দিয়ে আসে। তাই দেখে পরের দিন আরেক বাক্স গহনা রেখে এল শয়তান। আজ আর গহনা পাদ্রীর কাছে ফেরত দেয়া না। সে পাড়ার এক কাছে লুকিয়ে রেখে আসে। ইচ্ছে সেখান থেকেই মাঝে মাঝে এক-আধটা গহনা পরবে, মা কিছুই জানতে পারবে না।
শয়তান মেফিস্টোফিলিস আর ফাউস্ট আসে কাছে। শয়তান তরুণের বেশে প্রলুব্ধ করে অন্যদিকে নিয়ে যায়। আর ফাউস্ট মার্গারেটের কাছে আসে। মুগ্ধ হয় মার্গারেট। ফাউস্টের অন্তরে জাগে ভালবাসা। কোন কলুষতার স্পর্শ লাগে না সেখানে। কিন্তু শয়তান চায় কামনার আগুন জ্বালিয়ে দিতে। মার্গারেট শয়তানকে দেখে ভয় পায়। কিছুতেই ভেবে পায় না ফাউস্টের মত এমন একজন ভদ্র মানুষের কি করে সে অনুচর হল।
ফাউস্টের কামনার আগুন একদিন জ্বলে উঠল। শয়তান মার্গারেটের মাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিল। সেই ওষুধে মারা গেল মার্গারেটের মা। সন্তানসম্ভবা হল মার্গারেট।, মার্গারেটের ভাই ছিল সৈনিক। সে বোনের এই অধঃপতন সহ্য করতে পারল না। একদিন আক্রমণ করল ফাউস্ট আর শয়তানকে। শয়তানের প্ররোচনায় ফাউস্ট আঘাত করে হত্যা করল মার্গারেটের ভাইকে।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফাউস্ট জানতে পারল মার্গারেট তার শিশুসন্তানকে বিসর্জন দিয়েছিল, তাই তাকে বন্দী করা হয়েছে। তাছাড়া মা-ভাইয়ের মৃত্যুর জন্যেও তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিচারে তার প্রাণদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। দুঃখে অনুশোচনায় ভেঙে পড়ল ফাউস্ট। তার সমস্ত ক্ষোভ ফেটে পড়ল শয়তানের উপর। স্থির করল যেমন করেই হোক সে উদ্ধার করবেই মার্গারেটকে। শয়তান তাকে কারাগারে নিয়ে গেল। মার্গারেট তখন উন্মাদ। অসহায়ের মত কারাগার থেকে বেরিয়ে এর ফাউস্ট। মৃত্যু হল মার্গারেটের।
এখানেই শেষ ফাউস্টের প্রথম খণ্ড।
দ্বিতীয় খণ্ডে ফাউস্টকে দেখা গেল এক সমাটের দরবারে জাদুকররূপে। সমাট ভোগবিরাসে মত্ত। রাজ্যে কোন শৃঙ্খলা নেই। শয়তান মেফিস্টোফিলিস উৎসবের আয়োজন করেছে। একের পর এক দৃশ্য সৃষ্টি করে চলেছে ফাউস্ট। তার পেছনে কাজ করছে শয়তান। সম্রাট চাইলেন জাদুবিদ্যার দ্বারা ট্রয়ের রানী হেলেন আর তার অপহরণকারী প্যারিসকে নিয়ে আসতে হবে। শয়তানের সাহায্যে কুয়াশার মধ্যে আবির্ভূত হল হেলেন আর প্যারিস। সকলে বিস্ময়ে মুগ্ধ হতবাক। কি অপরূপ এই নারী হেলেন। প্যারিস যখন তার প্রণয়ী হেলেনকে অপহরণ করে নিয়ে চলেছে, নিজেকে সংযত রাখতে পারল না ফাউস্ট। সে চাবি ছুঁড়ে আঘাত করে। সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যায় সেই ছায়ামূর্তি। আর জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ফাউস্ট।
চারদিকে ধিক্কারধ্বনি উঠল। শয়তান ফাউস্টকে নিয়ে এল তার পুরনো পাঠাগারে। সেখানে সব কিছুই আগের মত আছে। ভাগনার সেখানে গবেষণা করে চলেছে কৃত্রিম। মানুষ সৃষ্টির। তৈরি হয়েছে এক ক্ষুদ্র মানুষ।
ফাউস্টের জ্ঞান ফিরে আসতেই সে বলল, হেলেনকে ছাড়া জীবনে সে কোন কিছুই চায় না। শয়তান নিয়ে এল হেলেনকে। ফাউস্ট তখন আর্কেডিয়া রাজ্যের রাজা। মিলন হল দুজনের। একটি সন্তান জন্মাল কিন্তু তাকে মৃত্যুবরণ করতে হল। পুত্রের মৃত্যুর বেদনায় মারা গেল হেলেন। স্ত্রী-পুত্রের মৃত্যুতে ফাউস্টের মনোলোকে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিল। সকল তুচ্ছতা সংকীর্ণতার ঊর্ধের উঠে যায় তার মন। সে এক মহত্তর পরিপূর্ণতার ধ্যানে আত্মমগ্ন হতে চায়। সমুদ্রের তীরে এক নির্জন অনুর্বর প্রান্তরে গড়ে তুলতে চায় শস্যক্ষেত্র, নতুন জনবসতি।
ফাউস্টের চিন্তা-ভাবনায় অস্থির হয়ে ওঠে শয়তান। এ ফাউস্টযেন তার ইচ্ছাশক্তির দাস নয়। শয়তানের সাহায্যে গড়ে ওঠে নতুন জনপদ। সেখানে তৈরি হয়েছে প্রাসাদ, বাগান, বাড়ি, ঘর। তৈরি হয়েছে জলাশয়, খাল।
ফাউস্ট এখন বৃদ্ধ, ধীর শান্ত। নিজের মধ্যেই আত্মমগ্ন হয়ে থাকে। সেই প্রাসাদের কাছেই থাকত এক বুড়ো-বুড়ি। তাদের কুটিরে বসে উপাসনা করত। তাদের উপসনার ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠত। মাঝে মাঝে এত তন্ময়তার গভীরে ডুব দিত ফাউস্ট, যে সেই মৃদু ঘণ্টাধ্বনিও তার তন্ময়তা ভঙ্গ করত। ফাউস্ট আদেশ দিল ঐ বুড়ো-বুড়িকে সরিয়ে দিতে।
সাথে সাথে শয়তান গিয়ে আগুন জ্বানিয়ে দিল কুটিরে। এই দৃশ্য দেখে রাগে ফেটে পড়ল ফাউস্ট। সে তো দুই বুড়ো-বুড়িকে হত্যা করতে চায়নি চেয়েছিল অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে।
বয়েসের ভারে ক্রমশই স্থবরি আসে ফাউস্ট। চোখের দৃষ্টি কমে আসে। কিন্তু তবুও কাজ করে চলে ফাউস্ট। তার অপর কোন কামনা নেই, স্বর্গের কোন ভাবনা নেই তার, যা কিছু কাজ এই পৃথিবীতে শেষ করে যেতে হবে।
শ্রমিকেরা কাজ করে। তাদের বিচিত্র শব্দ ভেসে আসে। ফাউস্টের মনে হয় কর্মের মধ্যে যেন সঙ্গীতের সুর। এক অপার্থিব আনন্দে তার সমস্ত অন্তর ভরে ওঠে।
গড়ে উঠেছে নতুন জনপদ, কৃষিক্ষেত্র, জীবনের প্রবাহ। ফাউস্টের মন আনন্দে ভরে ওঠে। মনে তার সব কাজ শেষ হয়েছে। পরম শান্তিতে মৃত্যুবরণ করে।
শয়তান আসে ফাউস্টের আত্মাকে দখল করতে। কিন্তু তার আগে এসে দাঁড়াল দেবদূতের দল। শয়তান চেয়েছিল সুখ আর ভোগের বিলাসে ফাউস্টকে ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু সেই সুখ আর ভোগবিলাসকে অতিক্রম করে ফাউস্ট খুঁজে পেয়েছিল এক মহত্তর জীবন। তাই শয়তানের কোন অধিকার নেই তার উপর। দেবদূতের দল তার আত্মাকে নিয়ে গেল ঈশ্বরের কাছে।
সংক্ষেপে এই ফাউস্টের কাহিনী। মহাকবি গ্যেটে তাঁর জীবনব্যাপী সাধনা দিয়ে গড়ে তুলেছেন এই ফাউস্টের। ফাউস্ট যেন তাঁরই আত্মার প্রতিরূপ। সে সমস্ত জীবন কর্মের সাধনায়, জ্ঞানের সাধনায় নিজেকে ব্যাপ্ত রেখেছিল। ফাউস্টের মধ্যে ফুটে উঠেছে। মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি। মানব জীবনের সব আশা-নিরাশা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, পাপ-পুণ্য নিয়ে আত্মিক-আধ্যাত্মিক সংকটের বিচিত্র রূপ এখানে ফুটে উঠেছে। এই কাব্য পৃথিবীর সাহিত্য জগতের এক অনন্য সম্পদ।
ফাউস্টের রচনাপর্বেই গ্যেটে রচনা করেন তার আত্মজীবনীমূলক রচনা “কাব্য এবং সত্য”। যদিও এতে তিনি সঠিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেননি তবুও তাঁর জীবন সম্বন্ধে। অনেক কিছু জানা যায়।
জীবনের শেষ পর্বে এসে প্রাচ্যের কবি হাফিজের কাব্যের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং তারই প্রভাবে রচনা করেন বেশ কিছু কবিতা।
বৃদ্ধ হয়েও যৌবনের মত তারুণ্যের দীপ্তিতে ভরপুর হয়ে থাকতেন গ্যেটে। শোনা যায় ভাইমারের যুদ্ধের পর যখন নেপোলিয়নের সৈন্যবাহিনী জার্মানি দখল করে, নেপোলিয়ন আদেশ দিয়েছিলেন গ্যেটের প্রতি সামান্যতম অমর্যাদা যেন না করা হয়। তিনি গ্যেটেকে আমন্ত্রণ করেছিলেন তাঁর প্রাসাদে।
গ্যেটে যখন এলেন, নেপোলিয়ন বিস্ময়ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন, একটা মানুষ আপনি!
বৃদ্ধ গ্যেটের ব্যক্তিত্ব, তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন নেপোলিয়ন। তার সাথে নানান বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। বহু বিষয়ে গ্যেটে নেপোলিয়নের মতের সাথে একমত হতে পারেননি। গ্যেটে স্পষ্টভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করেছিলেন। গ্যেটে যখন চলে : যান, নেপোয়িন গভীর শ্রদ্ধায় আবার বলেছিলেন একটা মানুষ বটে।
গ্যেটে সম্বন্ধে নেপোলিয়নের এই মন্তব্য যথার্থই সত্য। একজন পরিপূর্ণ মানুষ।
জীবনের অন্তিম লগ্নে এসেও এই মানুষটি বিস্মৃত হননি তিনি মানুষ, ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ জীব-যে প্রতিমুহূর্তে নিজেকে উত্তরণ করে চলেছে অন্ধকার থেকে আলোকে।
১৮৩২ সালের ২২শে মার্চ। কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন গ্যেটে। অনুরাগীরা তাঁকে এনে বসিয়ে দিল তাঁর পাঠকক্ষের চেয়ারে। সকলেই অনুভব করছিল কবির জীবনদীপ নির্বাপিত হয়ে আসছে। এক বিষণ্ণ বেদনায় আচ্ছন্ন হয়েছিল তাদের মন। দিন শেষ হয়ে এসেছিল। বাইরে অন্ধকারের ছায়া নেমে এসেছিল।
গ্যেটে চোখ মেলে তাকালেন। অস্ফুটে বলে উঠলেন, “আরো আলো।”
তারপরই স্তব্ধ হয়ে গেল চির আলোর পথিক গ্যেটের মহাজীবন।