॥ ২৫ ॥
তোমার মুখখানা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
কোথায় শুকনো? বলে নিজের অজান্তে গালে একটু আঙুল বোলায় বিশাখা।
দেখাচ্ছে শুকনো-শুকনো। বলে একটু ইঙ্গিতময় হাসি হাসে চুনা, তোমার কিছু হল নাকি?
বিশাখা একটু লাল হয়। বলে, যাঃ।
আজ চলো, গাঙে গিয়ে খুব ডুবিয়ে স্নান করে আসি। কী সুন্দর টলটলে জল!
যেতে দেবে না। মনুপিসিকে তো চিনিস না।
কত মেয়ে তো করছে।
সকলের মতো কি আমরা? বললেই বলবে, ধিঙ্গি মেয়ে ড্যাং ড্যাং করে সকলের নাকের ওপর দিয়ে নাইতে যায় নাকি? এ বাড়ির মান-সম্মান নেই?
তাহলে ঝিয়েরা কাপড় আড়াল করে নিয়ে যাক।
দূর! সে আমার লজ্জা করে। দুধারে চারজন কাপড় টান করে আড়াল করবে আর মাঝখান। দিয়ে চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে যাওয়া, ও আমার ভাল লাগে না।
চুনী একটু মন-খারাপ গলায় বলে, তোমাদের অনেক ঝঞ্ঝাট। এটা বারণ, সেটা বারণ।
বিশাখা রাগ করে বলে, বারণ তো বেশ। আমরা কি আর সকলের মতো সস্তা নাকি?
কুলতলার নিবিড় ছায়ায় ঘাসের ওপর দুজন বসা। কিছু কড়ি চিৎ উপুড় হয়ে পড়ে আছে ঘাসে। চনী সেগুলো গুছিয়ে তুলছে একটা পুঁতির কাজ করা থলিতে। কত খেলনা আর কত সুন্দর সুন্দর জিনিস এদের। মাঝে মাঝে চুনীর ইচ্ছে করে এক-আধটা জিনিস কাপড়ের আড়ালে নিয়ে চলে যায়। এরা টেরও পাবে না। কিন্তু টের পায় আর একজন। সে হরি। হরিখুডোর যেন একশ জোড়া চোখ। চতুর্দিকে ঘুরছে আর হিসেব নিচ্ছে। একটা পানের বোঁটা পর্যন্ত ভাঙার উপায় নেই। চুনীর রাগ হয়। হরি এ বাড়ির চাকর ছাড়া আর কিছু তো নয়। তফাত শুধু এই যে, সে কাবাবুর চাকর। তার জোরেই সে এ বাড়ির আর সব ঝি-চাকরকে দাবড়ায়। এমন কি জুতো মারে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। তার ওপর কথা বলার লোক নেই। নতুন ঝি-চাকর রাখেও সেই। তার পছন্দ না হলে এ বাড়িতে কাজ পাওয়ার উপায় নেই।
চুনী কড়িগুলো তুলে থলির মুখে লাল টুকটুকে দড়ির ফাঁস টেনে বন্ধ করে বলে, তোমার বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে জানো?
বিশাখা দুখানা বড় বড় চোখ চুনীর মুখে স্থিরভাবে স্থাপন করে বলে, তোকে কে বলল?
চুনী একটু ভয় খেয়ে বলে, শুনেছি। কেন, তুমি জাননা না? রাজেনবাবুর ছেলে শচীনবাবু—সেই যে ভারী সুন্দর চেহারা!
সুন্দর না হাতি!
তোমার পছন্দ নয়?
ওকে পছন্দ হবে কেন?
তবে তোমার কাকে পছন্দ?
তা জেনে তোর কী হবে? তোর কাকে পছন্দ?
আমার! আমার আবার পছন্দের কী?
তবে আমার কথা তোকে বলব কেন?
টুনা হিহি করে হাসে। তারপর উঠে বলে, চলো, চান করি গে। আজ তোমার পায়ে ঝামা ঘষতে. হবে। মনু ঠাকরুণ বলে দিয়েছে।
বিশাখা নড়ল না। অলস আনমনে বসে চারদিককার ঝুরো ছায়ার দিকে চেয়ে কিরকম বিভোর হয়ে থাকে।
চুনী জানে সে বিশাখার সখি নয়, বন্ধুও নয়। সঙ্গী বটে, কিন্তু আসলে সে বিশাখার ঝি। কাজেই বেশী। ঘাটাতে সাহস পায় না সে। বিশাখা এমনিতে ঠাণ্ডা সুস্থির হলে কি হয়, রেগে গেলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ছাড়ে। রাগ পুষে রাখে। তবু চুনী নিজের মতো করে বিশাখাকে ভালবাসে। অত রূপ, ভাল না বেসে পারা যায়?
এই যে ঘন দুপুর, শেষ শীতের কবোষ্ণ রোদে এক ঝিমঝিম নেশারু মাদকতা ছড়িয়ে রেখেছে। ধরে তা বিশাখাকে টেনে নেয় বুকের মধ্যে। কুলতলার ঝুরো ছায়া আর চারদিককার গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ফসা চাদরের মতো টানটান রোদ তাকে এক অদ্ভুত পুরুষের স্বপ্ন দেখায়। সে পুরুষ সাধারণ নয়। অপাপবিদ্ধ, দুর্মর সাহসী, বিশ্বজয়ী সেই মানুষ বোধ হয় স্বপ্নেই বাস করে। তবু তার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বিশাখার উপায় কী?
অনেকক্ষণ আনমনে বসে থাকে বিশাখা। চুনী উসখুস করে। তার মাথায় উকুন কুটকুট করছে। পেটের মধ্যে নাচছে খিদের বাঁদর। বিশাখার মুখের থমথমে ভাব লক্ষ করে সে কিছু বলতে সাহস পায় না।
কিছুক্ষণ বাদে অবশ্য বিশাখা নড়ল। উঠল। একটা হাই তুলে বলল, চল যাই।
পুকুরঘাটে দাসী সব সাজিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তেলের বাটি, ঝামা, গামছা, কাপড়, সাবান। বিশাখা পৈঠায় বসে। চুনী সযত্নে তার পায়ে ঝামা ঘষতে থাকে। ঘষতে ঘষতে তারও রূপমুগ্ধতার বিভ্রম ঘটে। এত সুন্দর নিটোল পা, ঝামা ঘষার কোনো দরকার নেই। একটুও ফাটা নয়, ময়লা নয়। শুধু পুরোনো আলতার দাগ। সেটা উঠে যাওয়ার পরও টুকটুকে লাল দুখানি পাকে যেন মা দুগার পা বলে মনে হয়। কী সুন্দর! ইচ্ছে করে পা দুখানায় ঠোঁট ঘষে, কপালে চেপে রাখে কিছুক্ষণ।
চুনী!
বলো।
সুফলা তেকে কিছু বলেছে?
হু
কী বলেছে?
এর মধ্যে কবে যেন নায়েবমশাই গিয়েছিলেন ওদের বাড়ি।
কথা পেড়ে এসেছে, না?
তাই তো বলল। কর্তাবাবু রাজেন মোক্তারকে ডেকে পাঠিয়েছে।
কবে আসবে বুড়োটা?
তা অত জানি না।
এ বিয়ে হবে না।
ইস!
ইস আবার কিসের?
আমার যদি ওরকম বর জুটত তাহলে আনন্দে নাচতাম।
আমি আর তুই কি সমান?
তা বলিনি। কিন্তু শচীনবাবু কী ভাল দেখতে বলো!
তেমন কিছু নয়।
এ শহরে ওর মতো সুন্দর আর কেউ নেই।
আছে। তুই গগনবাবুর ছেলেকে দেখেছিস?
কোকাবাবুর নাতি? দেখব না কেন? সেও অবশ্য সুন্দর।
শচীনের চেয়ে ঢের সুন্দর।
চুনী একটু দ্বিধার গলায় বলে, কেমন যেন একটু গোঁয়ার মতো আছে!
তার মানে?
একটু বেশী লম্বা-চওড়া।
পুরুষ মানুষ তো ওরকমই ভাল।
চুনী ফের একটু দ্বিধায় পড়ে। খুব ভয়ে ভয়ে বলে, শরৎ কিন্তু তোক ভাল নয়।
শরৎ কী রে! শরৎবাবু বল।।
ওই হল। শরৎবাবু নাকি—হি হি—
হাসছিস কেন?
মদটদ খায়, জানো?
তোকে কে বলল?
সবাই জানে।
আর কী করে?
বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলে।
সেটা কি খারাপ?
তা নয়। মেয়েমানুষের দোষ আছে।
বাজে কথা।
তোমার কি শরৎকে পছন্দ?
তাতে তোর কি?
না, কিছু না। আমার কাছে শচীনবাবুকে বেশী ভাল লাগে। বেশ নরম সরম মানুষ। খেটে খায়।
খেটে খাওয়াটা কি খুব বড় কথা নাকি? ভীষণ গরীব ছিল ওরা।
জানি।
মনু পিসিই সব নষ্টের গোড়া। আপদ বিদেয় করার জন্য যা তা একটা ছেলেকে ধরে গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছে।
চুনী বিশাখার ভিতরকার গনগনে রাগের আঁচ টের পেয়ে ভয়ে চুপ করে গেল। এখন মতামত করতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। পা ঘষা শেষ করে ঝাঁঝালো সরষের তেল হাতের তেলোয় নিয়ে বিশাখার কোমল সুন্দর হাত আর পায়ে মাখাতে লাগল সে। মহেন্দ্রর ঘানিতে রাই সর্ষে পিষে তৈরি করা তেল। কী মিষ্টি গন্ধ। যে তেলটি চুলে দেয় বিশাখা, যে সাবানটি মাখে তাদের গন্ধ চুনীকে পাগল করে দেয়। এই রাজকন্যার মতো সুন্দরী মেয়েটিকে সে রোজ ছোঁয়, এর দামী সাবান আর তেল তার হাতে লেগে থাকে, এ সবই নিজের সৌভাগ্য বলে মনে করে চুনী। ভারী গৌরব বোধ করে। কিন্তু বিশাখার পছন্দ কি ভাল? শরৎকে সে চেনে। চেহারাটা খারাপ নয়, কিন্তু ভীষণ রাগী, বুনো লোক। আর শচীনবাবুর চেহারাটা কী মিষ্টি! কত লেখাপড়া জানে!
বিয়ের কথা ওঠার ফলেই বোধ হয় ইদানীং সুফলা খুব একটা আসে না।
বিশাখা জলে নামতে নামতে বলল, সুফলাকে একটা খবর দিস তো। ওর সঙ্গে কথা আছে।
চুনী বলল, দেব।
আজই কিন্তু। বলিস জরুরী দরকার।
বিকেলে সুফলা এল। জমিদারবাড়ির মেয়ের সঙ্গে দাদার বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে, এটা তাদের কাছেও খবরের মতো খবর। তার ওপর পাত্রী তার প্রাণের বন্ধু। সুফলার মুখেচোখে একটা চাপা আনন্দ ডগমগ করছিল। চোখের দৃষ্টিতে একটু লজ্জা লজ্জা ভাবও। এসেই বিশাখাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কেমন আছিস? কদিনে রোগা হয়ে গেছিস কেন?
বিশাখার মুখটা খুব খুশি দেখাল না। গম্ভীর মুখে বলল, ছাদে চল, কথা আছে।
তাদের ছাদটি বিশাল। মাঠের মতো বড় সেই ছাদে অনেক রকম বসার জায়গা আছে। স্বেতপাথরের আরামকেদারা, পাথরের বেদী। বড় বড় ফুলের টব আছে অনেকগুলো। আছে বড়ি আর আমসত্ব রোদে দেওয়ার জন্য জালের ঘর, যাতে পাখি এসে না ঠোকরাতে পারে।
সাদা বেদীটার ওপর দুজন পা তুলে বসে।
মানুষের মুখের ওপর স্পষ্ট কথা বলতে বিশাখা কখনোই সংকোচ বোধ করে না। এমন কি দাদা-দিদিদের মুখের ওপরেও সে অনেক কথা বলে দেয়। শুধু বাবার প্রতি তার এক ধরনের সমীহ আছে।
বিশাখা সুফলার দিকে তাকিয়ে বলল, তোদের এখন অবস্থা বেশ ভাল হয়েছে, তাই না?
সুফলা একটু থতমত খেয়ে বলে, কীসের অবস্থা?
সংসারের অবস্থার কথা বলছি। ন্যাকা, বুঝিস না কিছু?
সুফলা একটু গম্ভীর হয়ে বলে, সংসারের খবর অত জানি না।
খুব জানিস। কদিন আগেও তো খেতে পেতিস না ভাল করে। চেয়েচিন্তে চলত।
সুফলা চঞ্চল হয়ে ওঠে। মুখে থমথমিয়ে ওঠে কান্না। বলে, এসব কথা কেন বলছিস?
বিশাখার খুব ভাল লাগতে থাকে। নিষ্ঠুরতার মধ্যে সে এক রকম তীব্র আনন্দ বোধ করে। বলে, আমার মার কাছ থেকেও কতদিন চাল পয়সা নিয়ে তবে তোদের চলত, মনে নেই?
সুফলা ফোঁস করে ওঠে, সে সব মা শোধ দিয়েছে।
তা দিতে পারে। তোরা এখন বেশ পয়সার মুখ দেখেছিস, না?
তা জেনে তোর কী হবে?
আমার জানা দরকার বলেই জিজ্ঞেস করছি। তোর বাবা আর দাদা কত টাকা রোজগার করে রে?
সুফলার চোখে জল চিকচিক করতে থাকে। আকস্মিক এই অপ্রিয় প্রসঙ্গে সে কথার খেই হারিয়ে ফেলে। জবাব দিতে পারে না। শুধু অস্থিরভাবে এদিক ওদিক চাইতে থাকে।
বিশাখা বলে, উকিল মোক্তারদের খুব কাঁচা পয়সা হয় বলে শুনেছি। আমাদের জমিদারীটা কিনে নিতে পারিস তোরা? সে ক্ষমতা আছে?
সুফলার চোখে জল, ফোঁপানিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে বুক। তবু খুব তেজের সঙ্গে বলল, অত দেমাক করিস না। তোদের জমিদারীর অবস্থাও জানি।
কী জানিস?
অনেক জানি। আমার দাদা সব কাগজপত্র দেখেছে।
তাই নাকি? কী দেখেছে?
আমাদের জমিদারী নেই বলে তো আর না খেয়ে থাকি না। তোদের ক’দিন পরেই হাঁড়ির হাল হবে।
বিশাখার সুন্দর মুখটায় আক্রোশের হিংস্রতা দেখা দেয়। জমিদারীর অবস্থা যে ভাল নয় এটা সেও শুনেছে। সে বলল, তোর দাদাকে মাইনে দিয়ে রাখছি তো আমরা, সেই ক্ষমতা তো এখনো আছে।
আমার দাদা কি তোদের চাকর?
তাছাড়া আর কী?
দাদাকে তো তোর বাবা হাতে-পায়ে ধরে সেধে জমিদারী দেখার কাজ দিয়েছে। অতই যদি দেমাক তবে দাদার সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ করার দরকার কী ছিল?
বিশাখা একটু হাসল, বাবার মতিচ্ছন্ন হয়েছে বলে করেছে।
তাহলে আমাকে বলতে আসিস কেন? আমরা অত ল্যালা না। তোরাই ল্যালা। আজই আমি বাড়ি গিয়ে সব বলছি।
বলিস। আমি তাই চাই। কুঁজোর আবার চিত হয়ে শোবার সাধ! ইঃ!
ভারী তো তিন পয়সার জমিদারী, তাও খাজনা আদায় হয় না, ঠাটবাটই সার।
এ কথাও কি তোর দাদা বলেছে?
বলেছেই তো। জমিদারী রাখতে হলে তোর বাবাকেও ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে ধার করতে বেরোতে হবে।
বিশাখা বিভীষণ মুখে চুপ করে বসে রইল।
সুফলা কাঁদতে কাঁদতে এক ছুটে সিড়ি দিয়ে নেমে গেল নীচে।
আপনমনে বিশাখা একটু হাসে। বিয়েটা শেষ অবধি হবে না হয়তো। সুফলা গিয়ে বলবে। কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে।
ছাদ থেকে নেমে সে মুখে ভালমানুষী মাখিয়ে মনুপিসির কাছে চুল বাঁধতে বসল।
রঙ্গময়ী জিজ্ঞেস করে, সুফলা এসেছিল নাকি?
হুঁ।
রঙ্গময়ী চুপ করে থাকে। বোধ হয় ভয়ে।
বিশাখার বিষদাঁত একটু সুলসুল করে। বিষ ঢালার একটা জায়গা চাই তো! চুলের জট ছাড়ানোর ঝাঁকুনিতে মাথাটা পিছন দিকে হেলে যাচ্ছিল। মুখটা সামান্য বিব্রত। বলল, মোক্তারের মেয়ের খুব তেজ।
রঙ্গময়ী মন্তব্য করে না।
বিশাখা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, বলে কী জানো! বাবাকে নাকি খাজনার দায় মেটাতে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে বেরোতে হবে।
ও কথা বলল কেন?
কাঁচা পয়সা পাচ্ছে তো। ধরাকে সরা দেখছে।
কী থেকে কথাটা উঠল?
কী আবার! কথার পিঠে কথা।
মেয়েটার মুখ তো ভাল নয়।
সেই কথাই তো আমি তোমাকে বলি।
কী বলিস?
ওরা ভাল নয়।
রঙ্গময়ী মৃদু একটু হাসল। বলল, কী করে বুঝলি? শুধু সুফলার সঙ্গে ঝগড়া করলেই কি সব বোঝা যায়?
ঝগড়া আবার কিসের? ঝগড়া হয় সমানে সমানে।
মানুষকে ছোটো মনে করিস কেন? এই যে আমাকে পিসি বলে ডাকিস, আমিও তো তোদের সমান নই। গরীব পুরুতের মেয়ে, পিসি না বলে নাম ধরে ডাকলেই তো পারিস তাহলে।
তোমার কথা আলাদা।
কিছুই আলাদা নয় রে। মানুষকে অত পর ভাবতে নেই।
তুমি একটু অদ্ভুত আছছা পিসি। ওরা আমাদের সমান নয় সে কথাই বলেছি। নইলে সুফলা তো আমার বন্ধুই।
তুই সুফলার সঙ্গে কেন ঝগড়া করেছিস তা আমি জানি।
বিশাখা ঝামড়ে উঠে বলে, আমি মোটেই ঝগড়া করিনি। কেন করতে যাব? ওদের আমি মানুষ বলেই মনে করি না। ঝগড়া ও করেছে।
বিয়ের ব্যাপারে তোর মত নেই, সে কথা তোর বাবাকে না হয় আমি জানিয়ে দেব। তুই আর কিছু করতে যাস না।
বিশাখা চুপ করে রইল। কিন্তু তার মুখচোখ ফেটে পড়ছে অভ্যন্তরীণ রাগ ও উত্তেজনায়।
চমৎকার একটা খোঁপা করে চিরুনি গুঁজে দিল তাতে রঙ্গময়ী। আঙুলের নিপুণ চাপে খোঁপাটা ঠিকঠাক করে বসিয়ে দিল। তারপর বলল, এই তোর শেষ কথা তো!
কোনটা আবার শেষ কথা?
শচীনকে বিয়ে করবি না, এই তো?
ওকে করব কেন?
সেটাই ভাল করে জেনে গেলাম। তোর বাবাকে আজই বলব।
বিশাখার মুখ একটু বিবর্ণ হয়ে গেল। বলল, আমার কথা বলে বলবে নাকি পিসি?
তাহলে কার কথা বলব?।
বাবা যে আমার ওপর খুব রাগ করবে।
রাগ করবে কেন? তবে প্রস্তাবটা এক রকম দেওয়া হয়ে গেছে, সেটা ফিরিয়ে নিতে সম্মানে। লাগবে। তবু আমি বলি মেয়েদের অমতে বিয়ে দেওয়া ভাল নয়।
বিশাখার সুর অনেক নরম হয়ে গেল। বলল, বাবাকে আমার কথা বোলো না।
তবে কী বলব?
বোলো তোমার পছন্দ নয়। তোমার কথা তো বাবা খুব শোনে।
রঙ্গময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমাকে কেন নিমিত্তের ভাগী করতে চাস? এসবের মধ্যে আমি থাকতে চাই না। শচীনকে পছন্দ করেছিলাম আমিই।
শচীনকে তোমার কিসে পছন্দ বলো তো?
কী জানি, আমার হয়তো চোখ নেই।
নেইই তো পিসি। ও এমন একটা কী পাত্র?
ওকে তোর এত অপছন্দের কারণ কী বল দেখি! বলবি?
ওদের বাড়ি ভাল নয়। কেমন সব গরীব গরীব স্বভাব।
রঙ্গময়ী হেসে ফেলল। আবার গম্ভীর হয়ে গেল।
বিশাখা হঠাৎ রঙ্গময়ীর গলা জড়িয়ে ধরে বয়সোচিত অদুরে গলায় বলল, তুমি আমার ওপর রাগ করেছো পিসি?
রঙ্গময়ী মা-মরা এই বাচ্চাদের নিজের ছায়া দিয়ে তাপ দিয়ে বড় করেছে এতটা। তাই এই আদরে তার বুকের মধ্যে অভিমানের একটা তুফান উঠতে চাইছিল। কিন্তু রঙ্গময়ী জোর করে চাপা দিল সেটা।
বিশাখার থুতনিটা একটু নেড়ে দিয়ে বলল, না, আমার রাগ করতে নেই। আমি রাগ করলে যে ভূমিকম্প হয়ে যাবে। যা, খেলা কর গে।
বিশাখা আস্তে আস্তে উঠে বারবাড়ির দিকে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। জড়োসড়ো ভাব। শীত এখন যাই-যাই। বেলা চট করে পড়ে না। এখনো রোদ আছে।
ব্রহ্মপুত্রের দিকে অনেকগুলো কদম গাছ। মলিন চেহারা। তার ওপর পিঙ্গল আকাশ। চেয়ে ছিল বিশাখা।
একটা সাইকেল বড় রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে বাড়িতে ঢুকল।
বিশাখা ত্বড়িৎপদে একটা থামের আড়ালে সরে যায়।
শচীন এল। রোজ এ সময়ে আসে। কাছারিবাড়িতে বসে কাগজপত্র দেখে। পরণে উকিলের পোশাক।
থামের আড়াল থেকে বিষাক্ত দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগল বিশাখা।