বিশ্বনাথ দত্তের মধ্যমপুত্র মহেন্দ্রনাথ উচ্চশিক্ষার জন্য এসেছে ইংল্যাস্তে। এদেশে তার পরিচিত কেউ নেই, অর্থবলও নেই, তবে তার একমাত্র ভরসা এই যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন!
মহেন্দ্রকে জাহাজ-ঘাটা থেকে নিয়ে এসে একটি বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে কৃষ্ণ মেনন নামে তার দাদার এক ভক্ত! নতুন দেশ, সম্পূর্ণ অন্যরকম পরিবেশ, চতুর্দিকে রাজার জাতের লোক, প্রথম প্রথম খুব আড়ষ্ট হয়ে রইল মহেন্দ্র। দিন সাতেক কেটে গেছে, এখনও দাদার সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি নানা কাজে ব্যস্ত।
একদিন কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছে মহেন্দ্র। প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কেটে যাবার পর দেখতে দেখতে মনে হয়, ব্রিটিশ রাজত্বের এই রাজধানীর সঙ্গে ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরের বেশ খানিকটা মিল আছে। ইংরেজরা নিজেদের এই শহরের আদলেই তো কলকাতা শহরটা বানিয়েছে। অক্সফোর্ড সাকাস, পিকাডেলি সাকাস দেখতে দেখতে কলকাতার ডালহৌসি-পার্ক স্ট্রিটেব কথা মনে পড়ে। এখানে মস্ত মস্ত বাড়িগুলির দিকে ঘাড় উঁচু করে তাকাতে হয়, কলকাতার মল্লিক, শীল, ঘোষ, নোস, ঠাকুরদের প্রাসাদগুলিই বা কম কীসে!
হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে চলে এল চীপসাইড পল্লীর দিকে। এটা বাণিজ্য এলাকা, কলকাতার বড়বাজারেব মতন। অসংখ্য মানুষ পিলপিল করছে চতুর্দিকে, সবাই ছুটছে যেন কীসের তাড়ায়। রাস্তার ধারে ধারে দাঁড়িয়ে চ্যাঁচাচ্ছে ফেরিওয়ালারা, ঘরঘরিয়ে যাচ্ছে চার চাকার ঘঘাড়ার গাড়ি আর দ চাকার এক্কা, কিশোৱবয়েসী খবরের কাগজের হকাররা তারস্বরে শোনাচ্ছে সেদিনের গরম গরম খবর। রেস্তোরাঁগুলি থেকে ভেসে আসছে কফির গন্ধ।
একটা চৌমাথার কোণে এক ইংরেজের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন ভারতীয়, সেদিকে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে মহেন্দ্র চমকিত ও উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ভারতীয়দের মধ্যে একজন তার চেনা, সে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, ওই তো শরৎদাদা!
বরানগর মঠে দীক্ষা নেবার পর শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর যদিও সন্ন্যাস নাম হয়েছে সারদানন্দ, কিন্তু মহেন্দ্র তাঁকে পূর্ব নামেই ডাকে। সারদানন্দ খুব স্নেহ করেন তাকে। বরানগর-আলমবাজার মঠে মহেন্দ্র নিয়মিত যাতায়াত করে। শ্রীরামকৃষ্ণের সব শিষোরই সে স্নেহভাজন, কিন্তু সে দীক্ষা নেয়নি। ভুবনেশ্বরীদেবী তাঁর এক পুত্রকে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে সমর্পণ করেছেন, আর কোনও সন্তানকে ছাড়তে তিনি রাজি নন।
প্রবাসে একজন পরিচিত মানুষকে দেখলে বড় আনন্দ হয়। মহেন্দ্রর ইচ্ছে হল তখনই সারদানন্দের দিকে ছুটে যেতে। মেননকে সে জিজ্ঞেস করল, পাশের ভদ্রলোকটি কে?
মেনন পাশ ফিরে দারুণ বিস্ময়ের সঙ্গে চেয়ে রইল মহেন্দ্রর দিকে। তারপর অস্ফুট স্বরে বলল, আপনি চিনতে পারছেন না?
মহেন্দ্র আবার তাকিয়ে দেখল। সেই ব্যক্তিটি কালো রঙের প্যাস্টালুন, কালো রঙের ভেস্ট পরিহিত, গলায় টাই নেই বটে, কিন্তু জামার কলারটি স্বতন্ত্র, মাথায় কখনউয়ের জের মতন অর্ধচন্দ্রাকৃতি কালো, মোটা টুপি, সামনের দিকে সিঁথি কাটা চুল দেখা যায়। গায়ের রং বেশ ফর্সা, চক্ষু দুটি সাধারণ মানুষের চেয়ে বড় আকারের, দারুণ তেজসম্পন্ন দৃষ্টি। তিনি স্থির নেত্রে দূরের কিছু একটা লক্ষ করছেন।
মেননের বিস্ময় দেখেই মহেন্দ্র বুঝতে পারল, সে কী ভুল করেছে। নিজের অগ্রজকে সে চিনতে পারেনি। কিন্তু মানুষের এমন রূপান্তরও হয়! কলকাতার সেই নরেন দত্তের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের এত তফাত। মাত্র চার-পাঁচ বছর, তার মধ্যেই এমন পবিবর্তন!
নরেন দত্তই যে বিবেকানন্দ, সে কথা জানতে কলকাতার অনেকেরই বেশ সময় লেগেছিল। তারপর থেকে মহেন্দ্র এবং তার বাড়ির লোকজন সবাই স্বামী বিবেকানন্দের জয়যাত্রার সমস্ত কাহিনী অনুসরণ করেছে। মার্কিন মুলুকের দিকে দিকে বেদান্তের বাণী প্রচার করে তিনি এসেছেন ইংল্যান্ডে, কিন্তু এ যেন অন্য মানুষ। মানুষের চরিত্র রূপ ফুটে ওঠে তার চোখে, স্বামী বিবেকানন্দর চোখ দেখে আর বোঝাই যায় না, ইতি মহেন্দ্ৰর সহোদর ভ্রাতা। মহেন্দ্রর একটু ভয় ভয় করতে লাগল। তার মনে হল, তার অগ্রজ এমন একটা উচ্চ স্তরে পৌঁছে গেছেন, এখন আর তাঁর কাছাকাছি সে পৌঁছতে পারবে না।
বিবেকানন্দের পাশে যে ইংরেজ যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম গুডউইন। সে দ্রুত সংকেত লিপি বা শর্ট হ্যান্ড বিশেষজ্ঞ। সেই জীবিকা নিয়ে গিয়েছিল আমেরিকায়, পেশাগতভাবে বিবেকানন্দর বাণী লিপিবদ্ধ করার জন্য নিযুক্ত হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই সে অন্য সব ছেড়েছুড়ে বিবেকানন্দের সঙ্গে জুটে গেছে, এখনও সে ওই কাজই কবে। কিন্তু পয়সাকড়ির প্রশ্ন নেই, গুরুর ছিটেফোঁটা কৃপাই তার ভবসা।
সারদানন্দও ইংলন্ডে পৌঁছেছেন মাত্র দিন সাতেক আগে। বিবেকানন্দই তাঁকে আনিয়েছেন কলকাতার মঠ থেকে। দিনের পর দিন একা বহু শ্রোতাদের সামনে তাঁকে বক্তৃতা দিতে হয়। ক্লান্ত হয়ে পড়েন মাঝে মাঝে, তাই বিবেকানন্দ ঠিক করেছেন কলকাতা থেকে আবও কয়েক জন গুরুভাইকে আনিয়ে নিজেব আরব্ধ কাজ আরও বেশি প্রচারের দায়িত্ব দেবেন।
গুডউইন সারদানন্দকে কিছু বোঝাচ্ছিল, বিবেকানন্দ অনেকক্ষণ নীরব। মহেন্দ্র আর মেনন কাছে আসতেই সারদানন্দ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে মহেন্দ্রকে জড়িয়ে ধরলেন। যেন সমুদ্রে ডুবন্ত ব্যক্তি হঠাৎ পেয়ে গেছে একটি কাষ্ঠখণ্ড। সারদানন্দ বাংলায় মহেন্দ্রর কুশল সংবাদ নিতে নিতে বললেন, ওরে, কী দেশে এসে পড়েছি, সর্বক্ষণ ইংবিজিতে ক্যাচ-মাচ করতে হয়, কোনও খাদ্য মুখে রোচে না…
বিবেকানন্দ ভাইকে দেখে তেমন কিছু সাদর সম্ভাষণ করলেন না। গম্ভীরভাবে ইংরিজিতে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? কয়েকদিন পর তুমি আমার সঙ্গে এসে থাকবে।
কোটের পকেট থেকে পাঁচটি পাউন্ড বার করে মহেন্দ্রর হাতে দিয়ে তিনি মেননকে নির্দেশ দিলেন, আমি স্টার্ডির বাড়ি ছেড়ে আগামীকাল সেন্ট জর্জেস রোডে লেডি ফার্গুসনের বাড়িতে উঠে আসছি। তুমি মহেন্দ্রকে সেখানে পৌঁছে দিয়ো।
তারপর আর বিবেকানন্দ সেখানে দাঁড়ালেন না, এগিয়ে গেলেন।
মহেন্দ্রর মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। স্বামী বিবেকানন্দ নামে যাকে সে দেখল, ইনি যেন সত্যিই এক অপরিচিত দূরে মানুষ। এঁকে কি সে দাদা বলে ডাকতে পারবে, স্বামীজি বলতে হবে?
মেমন বলল, মহেন্দ্র, তুমি প্রথমে তোমার নিজের অগ্রজকে চিনতে পারনি, তাতে আমি অবাক হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমার নিজেরও ওই একই ব্যাপার হয়েছে। উনি আমেরিকা যাত্রা করার আগে মাদ্রাজে আমি ওঁকে দেখেছি। আলাসিঙ্গা আর আমি ওঁর সঙ্গে কত সময় কাটিয়েছি। আমিই তো ওঁর তামাক সেজে দিতাম। তখন অঙ্গে ছিল সন্ন্যাসীর সাজ, কিন্তু আমাদের সঙ্গে কত হাসিমস্করা করতেন, সাধারণ মানুষের মতন মিশতেন। কিন্তু এখন যেন উনি এক পৃথক ব্যক্তি, দারুণ এক মহাশক্তি ভর করেছে ওর ওপর। এক একদিন বক্তৃতার সময় এমন সিংহবিক্রম প্রকাশ পায় যে আমার গা ছমছম করে। আমরা ওঁর সঙ্গে কথা বলার সাহস পাই না।
পরদিন সেন্ট জর্জেস রোডের বাড়িতে এসে মহেন্দ্র সঙ্কোচে এক পাশে বসে রইল। বাড়িতে তখন অন্য দু’ চারজন অভ্যাগত রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছেন বিবেকানন্দ। সারদানন্দ কাছেই রয়েছেন, কিন্তু মুখ খুলছেন না। এরকম গম্ভীর পরিবেশে সময় যেন কাটতেই চায় না। এক সময় অনারা বিদায় নিলে বিবেকানন্দ উঠে গেলেন ওপর তলায়। খানিক বাদে আবার নেমে এলেন বৈঠকখানায়। এবারে যেন তিনি অন্য মানুষ।
সারা মুখে হাসি মাখা, তবু সারদানন্দকে এক ধমক দিয়ে বললেন, হ্যাঁ রে শরৎ, তুই শালা কাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভ্যাড় ভ্যাড় করে বাংলা বলছিলি কেন রে? কতবার বলে দিয়েছি না, কাছাকাছি কোনও ইংরেজ থাকলে নিজেদের ভাষায় কথা বলা অতি অভদ্রতা। যাতে সকলে বুঝতে পারে, সেই জন্য ইংরিজি বলতে হয়। মহানকে দেখেই তুই যে একেবারে উথলে উঠলি! তুই ইংলিশ বলা প্র্যাকটিস করবি। শালা, তোকে এখানে আনিয়েছি কি এমনি এমনি।
মহেন্দ্রর দিকে ফিরে বললেন, ও মহীন, তোর মুখখানা শুকনো কেন? খাওয়া হয়নি কিছু বুঝি? মা কেমন আছেন বল! আর সবাই কে কেমন আছেন? আসার পথে জাহাজের দুলুনিতে তোর কষ্ট হয়নি তো? তুই বুঝি ভাবছিস, কোথায় এসে পড়লুম রে বাবা! প্রথম প্রথম এমন মনে হয়। লোকের সঙ্গে কথা বলতে বাধো বাধো লাগে। সব ঠিক হয়ে যাবে। জিভের আড় ভাঙতে একটু সময় লাগবে। বেশি বেশি লজ্জা করবি না। এ দেশে তুই সজ্জা করে না খেয়ে থাকলে কেট পুঁছবেও না।
বুক পকেট থেকে একটি অতি সুদৃশ্য সোনার কলম বার করে বললেন, এটা তুই নে। আমার দরকার নেই, তুই এটা ব্যবহার করবি!
মহেন্দ্রর আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে এক গাল হেসে বললেন, এই পোশাক তোকে কে বানিয়ে দিয়েছে? ঠিক যেন নব কাত্তিকের মতন দেখাচ্ছে। এই গাঁইয়া জামা-পাস্ট এদেশে চলবে না।
এবার পাশ পকেটে হাত দিলেন, এগারোটি পাউণ্ড মুঠোয় উঠে এল, সেগুলো মহেন্দ্রর হাতে খুঁজে দিয়ে বললেন, এক প্রস্থ পোশাক কিনে নিবি।
একটা চুরুট ধরিয়ে শরতের কাছে গিয়ে বললেন, এই ঘঁৎকো, একটা গান গা না। এখন যত ইচ্ছে বাংলা বলে পেট খোলসা করে নিতে পারিস!
মহেন্দ্র এখনও কথা বলতে পারছে না। এ যেন ঠিক সেই আগেকার আমুদে নরেন দত্ত। এক শরীরে দুই সন্তা। যেন কিছুক্ষণের জন্য উচ্চ স্তর থেকে নেমে এসেছেন সাধারণ স্তরে।
কয়েক দিন পর স্বামী বিবেকানন্দ লন্ডন ছেড়ে কাছাকাছি একটি গ্রামে মিস মুলার নামে এক সম্রান্ত মহিলার বাড়িতে আতিথ্য নিলেন। প্যাডিংটন স্টেশন থেকে মেইডনহেড স্টেশনে নেমে ঘোড়ার গাড়িতে মাইল তিনেক গেলে পিংমিনিস গ্রিন গ্রাম। সেখানে মিস মুলারের বাগান বাড়িটি ভারী সুন্দর।
অক্ষয়কুমার ঘোয় নামে একটি বাঙালির ছেলেকে মিস মুলার প্রায় নিজের পুত্রের মতন গণ্য করেন। তিনি বেশ ধনী এবং বিবাহ করেননি। ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার প্রতি আকৃষ্ট। এই মিস মুলার ও ই টি স্টার্ডি নামে আর একজন ভদ্রলোকই স্বামীজিকে ইংলন্ডে আমন্ত্রণ করে এনেছেন।
মহেন্দ্র লন্ডনে একা থাকতে চায় না, সেও চলে এল সেই গ্রামে, কিন্তু মিস মুলারের বাড়িতে তার আশ্রয় জুটল না। আচার-ব্যবহার, আদর-কায়দা সম্পর্কে মিস মুলারের মনোভাব বেশ কঠোর। স্বামী বিবেকানন্দকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তিনি ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে বক্তৃতা করবেন সেই জন্য, কিন্তু তাঁর ভাই এসে থাকবে কেন? সারদানন্দ বক্তৃতার ব্যাপারে সাহায্য করবেন, তিনি থাকতে পারবেন। আর গুডউইন নামে ছোকরা ইংরেজ হলেও একেবারেই অভিজাত নয়, তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে তিনি রাজি নন। গুডউইন এক দিকে স্বামীজির ভক্ত হলেও প্রায়ই জুয়া খেলে টাকা ওড়ায়, নেশা ভাঙ করে। তারও এ বাড়িতে স্থান নেই।
যাই হোক, মিস মুলারের বাড়িতে অনেক জায়গা খালি পড়ে থাকলেও মহেন্দ্রকে পাশের একটা বাড়ি ঘর ভাড়া করতে হল। এ বাড়িতেই সে অধিকাংশ সময় কাটায়, এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়াও করে প্রায়ই।
প্রৌঢ়া মিস মুলারের প্রকৃতিটি বিচিত্র। তিনি উদার হৃদয়া এবং কৃপণ, সরল ও বদমেজাজি, ভারতের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্না কিন্তু ইংরেজের জাত্যাভিমান সম্পর্কে অতি সচেতন। একমাত্র স্বামীজি ছাড়া তিনি অন্যদের, যখন তখন বকাঝকা করতে ছাড়েন না। তাঁর চেহারাটি পুরুষালি, ওপরের ঠোঁটে বেশ স্পষ্ট গোঁফের রেখা আছে। সম্প্রতি এখানকার রমণীদের পুরুষের মতন পোশাক পরিধানের ফ্যাশান হয়েছে, সেই অনুযায়ী মাঝে মাঝে তিনি হাঁটু পর্যন্ত মোজা, তার ওপর অর্ধেক পা-ওয়ালা ইজের, গায়ে ডবল-ব্রেস্ট কোট ও মাথায় টুপি পরেন। পিংমিনিস গ্রিনে তিনি সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ান।
দুবেলা অনেক খরচ করে তিনি সবাইকে খাওয়াচ্ছেন, কিন্তু কেউ তাঁর কোনও বইতে হাত দিলেই ভারী চটে যান। একদিন বৈঠকখানা ঘরে মহেন্দ্র স্ট্যানলির লেখার হাউ আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন বইটা দেখে কয়েক পাতা ওলটাতে ওল্টাতে খুব আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ল।
একটু পরে সে জিজ্ঞেস করল, আমি এই বইখানা আজ নিয়ে যেতে পারি, কাল ফেরত দেব?
মিস মুলার ক্রুদ্ধভাবে বলে উঠলেন, না, রেখে দাও! আমি কারুকে বই দিই না। বই নিয়ে কোনও ব্যাটা ফেরত দেয় না।
মহেন্দ্ৰ ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বইটা রেখে দিল।
বিবেকানন্দ ফায়ার প্লেসের পাশে একটি সুখাসনে বসে চক্ষু বুজে কিছু চিন্তা করছিলেন। ধ্যান ভঙ্গ করে মৃদু হাস্যে বললেন, না, না। মহীন সে রকম ছেলে নয়, ও বই নিশ্চয়ই ফেরত দেবে।
মিস মুলার গজ গজ করতে করতে বললেন, বাটাছেলেদের বিশ্বাস নেই। বই পড়তে নিলে আর ফেরত পাওয়া যায় না। পুরুষদের এই এক দোষ। আর মাগিদের কথা যদি বলো তো নিড়বক্স, থিল, কাঁচি দেখতে পেলেই সুবিধে মতন নিয়ে সরে পড়বে। মাগিদের সামনে থেকে ওই সব জিনিস লুকিয়ে রাখতে হয়।
স্বামীজি এবার হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, কেন, তাদের বাড়িতে কি কাঁচি-নিড়লবক্স এ সব থাকে না?
মিস মুলার বললেন, থাকবে না কেন? মাগিদের তবু তো ওই এক রোগ! এ পাড়ার মাগিরা বাড়িতে এলেই আমার ভয় কবে।
স্বামীজি বললেন, ওগুলোর আর ক’ পয়সা দাম! তারা বাড়িতে এলে আপনি যে কত আদর-যত্ন করে খেতে দেন?
মিস মুলারের বাড়িতে ভোজ্য পদ নানা রকম থাকলেও তিনি কঠোরভাবে নিরামিষাশী। মহেন্দ্র, সারদানন্দের মতন সদ্য এদেশে আগত বঙ্গসন্তানদের শুধু নিরামিষ মুখে রোচে না। স্বামীজিও মাছমাংস পছন্দ করেন, তবু সবাই বাধ্য হয়ে মিস মুলারের নীতি মেনে নিয়েছেন। শুধু মহেন্দ্র মাকে মাঝে রেল স্টেশনের ধারে রেস্তোরাঁয় গিয়ে লুকিয়ে মাংস খেয়ে আসে।
আহারের স্থানটি অতি রমণীয়। বাড়িটি দোতলা ও কাঠের তৈরি। সামনে একটি ঘেরা বাগান। বাড়ির একতলায় একটি বড় বৈঠকখানা, আর একটি ছোট ঘর। মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি, ওপরে আরও তিনটি ঘর রয়েছে। বাড়ির পেছনে উঠোন, তাতে একটি লম্বা কাচের ঘরে অনেক রকম দুর্লভ ফুলের গাছ ও অর্কিড। আর একপাশে নানা রকম লতা কুঞ্জে সাজানো ঘর, সেখানে চেয়ার টেবিল পাতা। এখন বসন্তকাল, শীত খুব কম, এই ঘরটিতে বসে প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে খাওয়াদাওয়া করা যায়।
একদিন সেখানে সান্ধ্য আহারে বলা হয়েছে। প্রথমেই পরিবেশন করা হল দুধের মধ্যে মোটা মোটা ম্যাকারনির সুপ, তাতে আবার নুন দেওয়া। এক চামচ মুখে দিতে না-দিতেই সারদানন্দ বিটকেল করে ওয়াক তুলে ফেললেন। স্বামীজি ভুরু কুঁচকিয়ে তাকালেন তাঁর দিকে। সারদানন্দের বমি পেয়ে গেছে, কিন্তু বমি করার উপায় নেই, উঠে যাবারও নিয়ম নেই। অতি কষ্টে প্রায় দম বন্ধ। করে তিনি সেই সুপই গিলতে লাগলেন। শেষের দিকে সুপের বাটিটা কাত করে ধরতে হয়, সারদানন্দ সামনের দিকে এমনভাবে কাত করলেন যে গড়িয়ে পড়ে যাবার উপক্রম। স্বামীজি ফিস ফিস করে বাংলায় বললেন, ওরে শরৎ, ও রকম করে ধরে না। আমি যেভাবে করছি সেরকম কর। উল্টো দিকে উঁচু কর।
সুপের পর এল মেইন ডিশ। টমাটো ও আলু চটকানো বড় বড় দুটি চপ। সারদানন্দ কাঁটা-ছুরি ধরতে গোলমাল করে ফেললেন। স্বামীজি টেবিলের তলা দিয়ে সারদানন্দের পা নিজের পা দিয়ে চেপে ধরে বললেন, ডান হাতে ছুরি, বাঁ হাতে কাটা! ছুরি দিয়ে খাবার তোলে না, শুধু কাঁটা দিয়ে তুলতে হয়।
মিস মুলার কী জন্য যেন একবার টেবিল ছেড়ে উঠে যেতেই স্বামীজি অন্য দু’জনকে তাড়াতাড়ি শেখাতে লাগলেন, অত বড় বড় গরস করে না, ছোট ছোট গরস করবি। খাবার সময় জিভ বার করতে নেই। কখনও কাশবি না, ঢেকুর তুলবি না, আস্তে আস্তে চিবুবি। খাবার সময় বিষম খাওয়া বড় দুষণীয়। আর নাক ফোঁস ফোঁস করবি না কক্ষনও!
মিস মুলার ফিরে আসতেই আবার ইংরিজি শুরু হল। সারদানন্দের মুখে একটিও কথা নেই, কোনও রকমে গিলছেন! মহেন্দ্র কম বয়েসী ছেলে, তার খিদে বেশি, স্বাদ ভাল না লাগলেও সে খেয়ে যায়। টেবিলের ওপর একটি প্লেটে তিনটি মাত্র কাঁচা লঙ্কা রয়েছে। স্বামীজি কাঁচা লঙ্কা ছাড়া খেতে পারেন না, তাই কৃষ্ণ মেনন অনেক দোকান খুঁজে খুঁজে ওই তিনটি মাত্র লঙ্কাই জোগাড় করতে পেরেছে। অতি কচি লঙ্কা, ঝাল নেই, শুধু একটু গন্ধ আছে। তার এক একটার দাম প্রায় এক টাকা! স্বামীজি কৃপণের মতন তারিয়ে তারিয়ে সেই একটি লঙ্কা খেলেন, বাকি দুটি রেখে দেওয়া হবে। সারদানন্দ আর মহেন্দ্ররও লঙ্কা দেখে লোভ হয়, কিন্তু দাম শুনে হাত দেবার উপায় নেই।
আরও কিছু শাক-চচ্চড়ি খাওয়ার পর পুডিং এসে গেল। তখনও মহেন্দ্রর ক্ষিদে মেটেনি। সে মৃদু স্বরে বলল, আমি আর এক টুকরো রুটি নিতে পারি?
মিস মুলার অমনি মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন, কে তোমায় বারণ করেছে? অমন মিনমিন করে চাইলে কেন? আমরা কি কৃপণ না নিষ্ঠুর? নাকি তোমায় আধপেটা খাইয়ে রাখতে চাই! রুটি চাইলে, তা অমন ভয়ে ভয়ে চাওয়ার কী আছে?
স্বামীজি প্রোটিকে সামলাবার জন্য বললেন, ভয়ে বলেনি। আমাদের ভারতবর্ষে ছোট ভাই বড় ভাইয়ের সামনে কিছু চাইবার বেলা নম্রভাবে কথা বলে।
মিস মুলার তাতেও ক্ষেপে উঠে বললেন, এ তোমার ভারতবর্ষ ন্য! এ ইংল্যান্ড, এখানে ছোট ভাই, বড় ভাই সব সমান! যা খেতে ইচ্ছে হয় খাবে, কেউ জোর করবে না, বারণও করবে না। ওর কথা শুনলে লোকে ভাববে, আমি ওকে খেতে দিই না।
এত বকুনির পর মহেন্দ্রর খাবার ইচ্ছেটাই উপে গেল। স্বামীজি আর মিস মুলার এর পর লন্ডনে বক্তৃতা-ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগলেন। সারদানন্দ ও মহেন্দ্র উঠে চলে গেল বৈঠকখানা ঘরে। সারদানন্দ ধপাস করে একটা কেদারায় বসে পড়ে হাত-পা ছুঁড়ে বললেন, ওরে বাপ রে বাপ। এর নাম খাওয়া! এটা কোরো না, সেটা কোরো না, কথায় কথায় ধমক! কোথায় হাতে করে বড় বড় থাবা করে খাব, তা না একটু-একটু করে দুচ বিধে খাওয়া। আর দেখ দেখি হিন্দুর ছেলেকে দুধে নুন মিশিয়ে খাওয়ালে! ও খেয়ে আমার পেট গুলিয়ে উঠল, কিন্তু ভয়ে বমিও করতে পারি না, উঠতে পারি না। এ দেশের দুধ কেমন সুন্দর ঘন, মোটা ভারমিশেলি পাওয়া যায়, কমলালেবুও এ দেশে আছে, তা দিয়ে চিনি মিশিয়ে কী দিব্য ক্ষীর বানানো যেতে পারে, তা নয়, দ্যা ছা ছা, দুধে নুন মিশিয়ে নষ্ট করছে।
সারদানন্দের অবস্থা দেখে হাসতে লাগল মহেন্দ্র। সারদানন্দ আরও বলতে লাগলেন, কী কুক্ষণেই এ দেশে এলুম রে! বাবাঃ, চব্বিশ ঘণ্টা আটে-কাটে বন্ধ থাকা, এ কি আমার সাধ্যি। অষ্টবক্রে বন্ধন করে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা। এ বাপু নরেনের সাধ্যি, নরেন করুক গে! নরেনের হাপরে পড়ে প্রাণটা আমার গেল। কোথায় বাড়ি ছাড়লুম মাধুকরী করব, নিরিবিলিতে জপ-ধ্যান করব, না এক হাপরে ফেলে দিলে। না জানি ইংরিজি, না জানি কথাবার্তা কইতে, অথচ তাঁইশ হচ্ছে লেকচার কর, লেকচার কর। আরে বাপু, আমার পেটে কি কিছু আছে। আবার নরেন যা রাগী হয়েছে, কোন দিন না মেরে বসে। তা চেষ্টা করব, দাঁড়িয়ে উঠে যা আসবে তাই একবার বলব; যদি হয় তো ভাল, না হয় এক চোঁচা দৌড় মারব, একেবারে দেশে গিয়ে উঠব। সাধুগিরি করব, সে আমার ভাল। কী উপদ্রবেই না পড়েছি। এমন জানলে কি এখানে আসতুম। শুধু নরেনের অসুখ শুনে, তার সাহায্যের দরকার শুনে এলুম! নরেন তো দেখি সারাদিন বকছে তো বকছেই, মুখের আর বিরাম নেই। নরেন কিনা উকিলের ব্যাটা, তাই অত বকতে পারে… হ্যাঁ রে, ওর কি মুখ বাথা করে না, মাথা ধরে না?
এই সময় স্বামীজি এ ঘরে আসতেই সারদানন্দ হঠাৎ একেবারে চুপ করে গিয়ে ভাল মানুষের মতন একটা খবরের কাগজ পড়তে শুরু করে দিলেন।
স্বামীজি বললেন, শরৎ, খাওয়াদাওয়া তো হল, কিন্তু এক্ষুনি শুতে গেলে তো চলবে না। অনেক কাজ পড়ে আছে। কী রে, কাজ করার ইচ্ছে আছে এখন?
সারদানন্দ বললেন, হ্যাঁ, আমার মোটেও ঘুম পায়নি। কোন কাজটা ধরবি বল?
স্বামীজি বললেন, তোর সেই লেখাটা শেষ হয়েছে? সেটা আজ রাত্তিরের মধ্যে ঠিকঠাক করে নিলে কেমন হয়?
মাদ্রাজ থেকে ব্রহ্মবাদিন নামে একটি ইংরিজি পত্রিকা বেরুচ্ছে, স্বামীজি মাঝে মাঝে সে পত্রিকার জন্য অর্থ প্রেরণ করেন। আমেরিকায় তিনি কতদূব কাজ করে এসেছেন তার একটা রিপোর্ট ওই কাগজে ছাপা হবে। সারদানন্দ ওপর থেকে সেই লেখাটি নিয়ে এলেন। স্বামীজি তাঁর নির্দিষ্ট সুখাসনটিতে বসে পাইপে তামাক খুঁজে ধরিয়ে বললেন, পড়ে যা।
সারদানন্দ পড়ছেন, স্বামীজি শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে সংশোধন করে দিচ্ছেন। ইয়েস্টারডে নাইট ঠিক হয় না, এটা কেটে দিয়ে লেখ লাস্ট নাইট… ফর অ্যামেরিকানস নয়, লেখ ফর দা অ্যামেবিকন্স।
সারদানন্দের মনমেজাজ ভাল নেই, তাই গলায় তেজ নেই, মাঝে মাঝে চুপসে যাচ্ছে কণ্ঠস্বর! স্বামীজি এক সময় ব্যঙ্গচ্ছলে বলে উঠলেন, দুর শালা, অমন এত্যাঁ এত্যাঁ করে পড়ছিস কেন? তোর চণ্ডীপাঠ করা অভ্যেস কিনা, তাই মনে করিস যেন চণ্ডীপাঠ কচ্ছিস! এটা ইংরিজি! ভাল করে, স্পষ্ট করে পড়।
সারদানন্দ আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। তারপর লেখাপড়ার কাজ চলল গভীর রাত পর্যন্ত।
এই গ্রামের বাড়িতে অনেকেই স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে আসে। শিগগিরই বক্তৃতা শুরু হবে, তার উদ্যোগ চলছে। বক্তৃতার ব্যাপারে স্টার্ডির উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। খ্রিস্ট ধর্মের ওপর স্টার্ডির দারুণ বিবাগ জন্মে গেছে। পাদরিদের টাকা সংগ্রহের অত্যুৎসাহ, বিলাসবহুল জীবনের প্রসঙ্গ উঠলে স্টার্ডি আফশোসের সঙ্গে বলে ওঠেন, খ্রিস্ট ধর্মটা একেবারে পচে গেছে, এটা এখন নিতান্ত মিলিটারি আর কমর্শিয়াল ধর্ম হয়েছে। সর্বত্র খ্রিস্টানরা লড়াই আর কারবারকেই জীবনের সার বলে ধরে নিযেছে। গিজালো হয়েছে টাকা রোজগারের দোকান। যাদের মধ্যে শ্রদ্ধা ভক্তির নামগন্ধ নেই, তাবাও যদি গিজায় অনেক টাকা ঢালে, অমনি ধর্মপরায়ণ হিসেবে তাদের নাম রটে যায়। একেবারে গোড়া বদলে নতুন ধর্ম স্থান করতে হবে।
স্বামীজি বললেন, খ্রিস্ট ধর্মে অনেক মহান ভাবের কথা আছে। যিশু কোথায় মহা ত্যাগ বৈরাগ্য দেখিয়ে গেলেন, এক কম্বল গায়ে দিয়ে পথে পথে ঘুরে ভগবানের নাম শুনিয়ে গেলেন, আর পাদরিগুলো কেবল টাকা টাকা করে বেড়াচ্ছে। আমেরিকাতেই এসব বেশি দেখেছি। পাদরিদের দপদপানিতে কেউ মুখ খুলে ধমকানিও দিতে পারে না। আমি মাঝে মাঝে দু’চার কথা শুনিয়ে দিয়েছি।
স্টার্ডি বললেন, বেদান্ত ধর্মের কথাই এখন সকলকে শোনানো দরকার।
স্বামীজি বললেন, অন্যান্য ধর্মগুলিতে আচার-আচরণের কথা, নিজস্ব গৌরবের কথাই বেশি বলা হয়। ধর্মের দর্শনের কথা কেউ বলে না। বেদান্তের দর্শন হচ্ছে সর্ব ধর্মের সমম্বয়। সেই একটা বিশ্বধর্মের আদর্শের কথাই আমি মানুষকে জানাতে চাই।
এই বিশ্বধর্মের প্রসঙ্গে যখন কথা চলে, তখন স্বামীজি নিজেও যেন স্থান কালের ঊর্ধ্বে উঠে যান। ইতিহাস-ধর্মতত্ত্ব-দর্শন মর্থিত করা যেন এক বাণী-মূর্তি। ফলে মাঝেই মাঝেই তিনি বলে ওঠেন, আই অ্যাম আ ভয়েস উইদাউট ফর্ম!
সেই সব সময় মহেন্দ্র সত্যিই যেন এই মানুষটিকে চিনতে পারে না। এক টানা দু’দিন তিন দিন এই রকম ভাব চলে, কখনও কখনও গভীর ভাবনায় ডুবে থাকেন, অথবা একা একা অধ্যয়ন করেন। সেইসময় অন্যরা কেউ অতি সাধারণ কথা নিয়ে তাঁকে বিরক্ত করতে সাহস পায় না। এমনকী মিস মুলার, যিনি সব সময় কথা বলতে ভালবাসেন, তিনিও ধারে কাছে এখোন না।
আবার হঠাৎ হঠাৎ স্বামীজি নেমে আসেন সাধারণ মানুষের স্তরে। তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের মতনই তিনি রঙ্গপ্রিয়, একেবারে কৌতুক বর্জিত হয়ে তিনি বেশিদিন থাকতে পারেন না। সন্ন্যাসী হলেও তিনি স্নেহপ্রবণ, ছোট ভাইটির সুবিধে অসুবিধের প্রতি তিনি দৃষ্টি রাখেন। সারদানন্দকে তিনি মাঝে মধ্যেই খোঁচা মারেন ও বকুনি দেন বটে, আবার ইংল্যান্ডের পরিবেশে তাঁকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার ব্যাপারেও তিনি বিশেষ মনোযোগী।
মহেন্দ্র একদিন নিজের ঘরে বসে চিঠিপত্র লিখছে, হঠাৎ দরজায় টোকা মারার শব্দ হল। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখল, স্বামীজি দাঁড়িয়ে আছেন। পাশের বাড়ি থেকে তিনি মহেন্দ্রর ঘরখানা দেখতে এসেছেন। তার বিছানাখানি কেমন, জানলা দিয়ে শীতের বাতাস ঢোকে কি না তা পরীক্ষা করে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, কী খেয়েছিস? কাল থেকে তো তুই ও বাড়িতে খেতে যাস না!
মহেন্দ্র অপরাধীর মতন মুখ করে বলল, অনেক দিন ভাত খাইনি, খুব ইচ্ছে করছিল, তাই হোটেলে গিয়ে ভাত আর মাংস খেয়ে এসেছি।
স্বামীজি হেসে বললেন, বেশ করেছিস। ভেতো বাঙালি! ভাত ছাড়া খিদে মেটে না। আমারও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়। গ্রামের দিকে খোঁজ করলে ভাত পাবি। নিরামিষ তোর মুখে রোচে না তা বুঝি। রান্নার মাগিটাকে বলবি, ডিমের পোচ কিংবা ওমলেট ভেজে দেবে। চুল উসকোখুসকো কেন তোর? চান করিস না?
মহেন্দ্র বলল, কী করে নাই? স্নানের ঘর নেই, কল-চৌবাচ্চা নেই যে!
স্বামীজি বললেন, এ দেশে অমনভাবে স্নান করে না। ঘরেতে বাথটাবে গরম জল মিশিয়ে নিবি। একখানা স্পঞ্জ ভিজিয়ে গায়ে বুলিয়ে নিতে হয়, তারপর সাবান দিয়ে গা-টা ঘষে নিতে হয়। ওই বাথটাবে বসে মগে করে মাথায় জল ঢেলে গা-টা পুছে নিবি। মাথার চুল সব সময় বুরুশ করে রাখবি, চুল উসকোখুসকো থাকলে এদেশের লোক বড় ঘেন্না করে। সব সময় ফিটফাট হয়ে থাকতে চেষ্টা করবি। একেই তো ইন্ডিয়ানস বলে লোকে অবজ্ঞা করে। তার ওপর ফিটফাট না থাকলে লোকে আরও ঘেন্না করবে। আর শোন, নাকের শিকনি ফ্যাত ফ্যাত করে হাত দিয়ে ফেলতে নেই, দুখানা রুমাল পকেটে রাখতে হয়, নাক ঝাড়তে হলে রুমাল দিয়ে নাক মুছে পকেটে রাখতে হয়। শিকনি-থুতু যেখানে সেখানে ফেললে এরা বলে তাতে অপরের ব্যামো হবে।
মহেন্দ্র মনে মনে বলল, শিকনি মাখানো রুমাল পকেটে রাখতে হবে? হায় রে কপাল!
স্বামীজি আবার বললেন, অমন ছাগল দাড়ি রাখাও চলবে না। কালই গুডউইনের সঙ্গে নাতের দোকানে গিয়ে একেবারে গাল পরিষ্কার করে আসবি। এখন চল আমার সঙ্গে, শরৎকে সাইকেল চড়া শেখাব। এদেশে এখন অনেকেই এই সাইকেল নামে জিনিসটা বেশ ব্যবহার করছে।
মিস মুলারের বাড়ির সামনে বেশ একটি প্রশস্ত মাঠ রয়েছে। বিকেল বেলা, আজ আকাশ বেশ পরিষ্কার। এ দেশে সব সময়ই মেঘ-মেঘ আর কুয়াশা থাকে। হঠাৎ এক দিন চড়া বোদ দেখলে দেশের কথা মনে পড়ে যায়। মিস মুলারের বাড়ির ছোকরা মালি গ্রিন হাউজ থেকে সাইকেলটা এনে মাঠে পৌঁছে দিয়ে গেল। প্রথমে স্বামীজি নিয়ে এহেন্দ্র ও সারদানন্দের কাঁধে ভর দিয়ে উঠে চালাতে লাগলেন। আজ তাঁর মন খুব প্রসন্ন, তিনি গাইতে লাগলেন।
সাধের
তরণী আমার কে দিল তরঙ্গে
ভাসালো তরী সকালবেলা ভাবিলাম এ জলখেলা
মধুর বইছে সমীর, ভেসে যাবো রঙ্গে।
খানিকবাদে তিনি নেমে পড়ে বললেন, শরৎ, এবার তুই চেষ্টা কর দেখি।
সারদানন্দের চেহাবাটি বেশ মোটাসোটা। জীবনে কখনও সাইকেলে চড়েননি। মহেন্দ্র ও স্বামীজি দু’দিক দিয়ে ধব রইলেন, তবু সারদানন্দ টাল সামলাতে পারেন না, ভয়ে চেঁচাতে লাগলেন।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে তিন বিদেশিব কাণ্ড দেখে মালিটি হেসে একেবারে লুটোপুটি খাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে স্বামীজি বললেন, ওবে, আমাদের চড়া দেখে মালি ছোঁড়া হাস করছে। আরে এত হাস করছিস ক্যানে?
মহেন্দ্র বলল, তাও তো সেদিনের মতন পাড়ার যাবতীয় ছোঁড়াগুলিন জড়ো হয়নি।
অন্য একদিনের ঘটনা মনে পড়ায় তিনজনেই অট্টহাস্য করে উঠলেন।
সেদিন মিস মুলার ও স্টার্ডি দম্পতি তিনখানা বাইক নিয়ে গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। একটু গিয়ে স্টার্জি পত্নী আছাড় খেয়ে উল্টে পড়ে যান। একদল ছেলেমেয়ে তাদের ঘিরে হাততালি দিচ্ছিল। মিস মুলার সাইকেল চালনায় কৃতিত্ব দেখালেও ছেলেমেয়েরা তাকেই টিটকিরি দিচ্ছিল বেশি। মিস মুলারের পোশাক পুরুষদের মতন, সেই জন্য ওরা বলছিল, দ্যাখ দ্যাখ এক বুড়ি মেয়েছেলে মদ্দর পোশাক পরেছে!
সারদানন্দকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করে গলদঘর্ম হয়ে স্বামীজি বললেন, দ্যাখ শরৎ, তুই এত মোটা, তুই তো হাত-পা চালাতেই পাবছিস না। মহীন রোগা পাতলা আছে, ও সহজে শিখে যাবে।
সারদানন্দ ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থায় করুণ সুরে বললেন, ভাই নরেন, তোমার এ দেশের যা খাওয়াদাওয়ার অবস্থা, এ চেহারা আর থাকবে না, দু’দিনেই শুকিয়ে চিমসে হয়ে যাব।
স্বামীজি তার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, আহা রে! এদের রান্না খেতে পারিস না, তাই না? আস্তে অভ্যেস করে নিতে হবে, দ্যাখ না, আমি তো সবই খেতে পারি। রোজ রোজ একঘেয়ে খাবার খেলে রুচি নষ্ট হয়ে যায়। আচ্ছা চল, তোদের জন্য আমি আজ একটা কিছু রান্না করে খাওয়াব।
মিস মুলার বাড়িতে নেই, রাঁধুনীটিও পাড়া বেড়াতে গেছে। সবাই মিলে রান্নাঘরের দিকে এগোতেই স্বামীজি বাধা দিয়ে বললেন, বেশি লোক রান্নাঘরে ঢুকতে নেই, তাতে এ দেশে বড় নিন্দে হয়। তোরা বাইরে থাক।
স্বামীজি রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন, শুধু কিছু আলু ছাড়া উপস্থিত কিছুই নেই। মিস মুলার সন্ধের বাজার কবে আনরেন। স্বামীজি আলু, মাখন আর গোলমরিচ দিয়ে একটা বেশ ঝালঝাল চচ্চড়ি বেঁধে আনলেন।
যেন একটা গোপন খেলা হচ্ছে, এইভাবে তিনজনে বাগানের এক কোণে খেতে বসে গেলেন। শুধুই আলু-চচ্চড়ি, মহেন্দ্র আর সারদানন্দ তাই-ই গরম গরম টপাটপ মুখে পুরতে লাগলেন হ্যাংলার মতন।
সারদানন্দ বললেন, ভাই নরেন, কী অপূর্ব স্বাদ যে হয়েছে কী বলব! অনেক দিন পর ঠিক যেন দেশের মতন রান্না। খাচ্ছি আর মনে হচ্ছে, আমি যেন দেশে ফিরে গেছি!
আনন্দে জল গড়াতে লাগল সারদানন্দের দুই চক্ষু দিয়ে।