1 of 2

২৫. প্রচণ্ড অবিশ্বাসে অর্ক

 পঁচিশ

‘যাঃ, হতেই পারে না।’ প্রচণ্ড অবিশ্বাসে অর্ক ছবিটার দিকে ফিরে তাকাল।

ঊর্মিমালা অবাক, ‘হতে পারে না মানে? ওটা রবীন্দ্রনাথের ছবি বিশ্বাস হচ্ছে না?’ এতক্ষণে অবশ্য অর্কর খেয়াল হয়েছে। রবীন্দ্রনাথেরও তো অল্প বয়স ছিল। সেই সময় তিনি কি রকম দেখতে ছিলেন সেটা সে জানে না। সাধারণ সাদা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধের কথাই রবীন্দ্রনাথ শুনলে মনে ভাসে। সে আর একটু এগিয়ে প্রশংসার চোখে বলল, ‘এতো সুন্দর দেখতে ছিলেন! আমি ভাবলাম—।’

অর্ককে থেমে যেতে দেখে ঊর্মিমালা জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ভাবলেন?’

‘এ বাড়ির কোন ছেলে হয়তো, কোন আত্মীয়।’

‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের সবার আত্মীয়।’ ঊর্মিমালা পরিষ্কার হাসল।

‘সবার মানে?’

‘যারা ভালবাসতে চায় ভালবাসা পেতে চায় তাদের সবার। আপনি গীতবিতানের গানগুলো আলাদা করে পড়েছেন?’ ঊর্মিমালা কেমন ভারী গলায় প্রশ্ন করল। হঠাৎ অর্কর মনে হল সে আবার ছোট হয়ে যাচ্ছে। ঊর্মিমালা পড়াশুনা এবং বোধে যে তার চেয়ে অনেক বড় তা আর একবার প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হল তার। সে রবীন্দ্রনাথ পড়েনি তো কি হয়েছে? কত লোক তো কত কিছু পড়ে না। একটা এরোপ্লেন কিভাবে চালাতে হয় ঊর্মিমালা কি জানে? শোলের আমজাদ খাঁর পুরো ডায়ালগ কি ও বলতে পারবে? রাস্তাঘাটে লক্ষ লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের কয়জন রবীন্দ্রনাথের একটা পুরো কবিতা মুখস্থ বলতে পারবে? সে মাথা নেড়ে বলল, ‘নাঃ, পড়ার বই-এর বাইরে রবীন্দ্রনাথের কোন বই আমি পড়িনি। ওসব পড়তে আমার ভাল লাগে না। নির্মল তরুণ ঊষা, শীতল সমীর, শিহরি শিহরি উঠে শান্ত নদী নীর। সকালবেলার এইসব বর্ণনা এখন আমরা পড়ে কি করব! যাদের কোন কাজ নেই তারা ওইসব পড়ে।’

ঊর্মিমালা হেসে ফেলল। এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, ‘তাহলে আমার আঁকা ছবি দেখে কি করবেন। যাদের কোন কাজ নেই তারাই ছবি আঁকে।’

অর্ক বুঝতে পারল তার কথা ঊর্মিমালা ভালভাবে নেয়নি। সে হেসে বলল, ‘দূর! ছবি তো বিক্রি হয়। সেদিন কাগজে বেরিয়েছে কার একটা ছবি কয়েক লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ওটা অকাজ হবে কেন?’

‘তাই? আর যারা সেই ছবি কিনে দেওয়ালে টাঙায় তারা কি পায়?’

‘কি পাবে আর! দেখে ভাল লাগে তাই কেনে।’

‘তাহলে স্বীকার করছেন মানুষ তার ভাল লাগার জন্যে অনেক পয়সা খরচ করতে পারে। ভাল লাগার তাহলে দাম আছে বলছেন?’

‘বাঃ, ভাল লাগার দাম থাকবে না? তবে আমার যেটা ভাল লাগে তা আমার মার নাও লাগতে পারে, তাই না?’

‘নিশ্চয়ই, আবার আপনার বাবার লাগতে পারে। কিন্তু জন্তু-জানোয়ারদের শুধু খাওয়া আর ঘুমানোই ভাল লাগে এবং এ-ব্যাপারে তাদের সবার মত এক। তাদের মনের খুব পার্থক্য নেই। আমাদের আছে।’

‘নিশ্চয়ই।’ অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না ঊর্মিমালা কি বলতে চাইছে।

‘তাই কারো কথা শুনলে আমাদের ভাল লাগে। অসুখ হলে মা যখন কপালে হাত বোলায় তখন ভাল লাগে। সেটা কোন কাজে লাগছে? না, আমার মনটাকে তৃপ্তি দিচ্ছে। আমরা যখন কষ্ট পাই তখন কেউ সান্ত্বনা দিলে ভাল লাগে। ওতে কি কাজ হয়? না, আমার মনটা আরাম পায়। এসব মানেন তো?’ বড় বড় চোখে তাকাল ঊর্মিমালা।

‘হুঁ।’ মাথা নাড়ল অর্ক।

‘রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়লে আমি মনে জোর পাই, আমার অনেক সময় কষ্ট হয় দুঃখ হয় আবার খুশি লাগে। আমার চারপাশের মানুষকে আমি অন্যরকম চোখে দেখতে পাই। আমার কাছে তার দাম নেই?’

অর্ক দেখল ঊর্মিমালা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এইভাবে ভেবে কেউ তার সঙ্গে কখনও কথা বলেনি। সে মাথা নাড়ল, ‘আছে, কিন্তু আমার তো নাও থাকতে পারে।’

এবার হেসে ফেলল ঊর্মিমালা, সামান্য শব্দ হল, বলল, ‘যে মানুষ কখনও গান শোনেনি, ফুল দ্যাখেনি তাকে সেসব বললে হয়তো একই গলায় বলবে ওসবের কি দাম? কিন্তু যদি ভুলেও একবার কোন গান তার কানে যায় তাহলে—।’ বলতে বলতে ঊর্মিমালা চকিতে তাকাল, ‘আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন!’

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘না। আমার পড়ার বইতে রবীন্দ্রনাথের যেসব কবিতা আমি পড়েছি তা শুধুই বর্ণনা। ওইসব পড়ে এরকম কিছুই মনে হয়নি।’

‘আপনি গল্পের বই কবিতার বই পড়েন না?’

‘কয়েকটা ডিটেকটিভ বই পড়েছি। আর হ্যাঁ, কিছুদিন আগে মা একটা বই এনেছিল, পথের পাঁচালি, কয়েক পাতা পড়েছিলাম।’

‘পড়েছিলেন? কেমন লেগেছে?’

‘ভাল্লাগেনি। শুধু বর্ণনা আর গ্রামট্রামের ব্যাপার—। মা বাবার ওই বইটাকে আবার খুব ভাল লাগে। কি জানি।’

‘আপনি পড়ার সময়ের বাইরে কি করেন?’

অর্ক হাসল, ‘আগে আড্ডা মারতাম। পাড়ার রকে।’

‘আপনার সহপাঠীদের সঙ্গে?’

‘না। ওরা কেউ পড়াশুনা করে না। অবশ্য এখন আর রকে বসতে ভাল লাগে না।’

ঊর্মিমালা একটা নিঃশ্বাস ফেলল যেটা অর্কর কান এড়াল না। তারপর ছবিগুলো টেবিল থেকে তুলে বলল, ‘আমি তো তেমন আঁকতে পারি না, তবু দেখুন।’ প্রথম ছবিটা উঁচু করে ধরল সে। অর্ক দেখল, একটা বড় রাস্তা তাতে ট্রাম চলছে। দুপাশে বড় বড় বাড়ি দাঁড়িয়ে। একটা ঘুড়ি উড়ছে। পরের ছবি একটি ভিখারিনী হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর তার ছেঁড়া আঁচলের আড়ালে একটা ন্যাংটো ছেলে মুখ লুকিয়ে আছে। তৃতীয়টি একটি নদীর ছবি। আকাশে মেঘ এবং একটা হালভাঙ্গা নৌকো মাঝ নদীতে ভাসছে। কোন মাঝি বা যাত্রী নেই। নৌকোটার দিকে তাকালেই মনটা কিরকম হয়ে ওঠে। চতুর্থ ছবিটি দেখে থতমত হয়ে গেল অর্ক। বড় রাস্তা, একটা ট্রাম সদ্য স্টপেজ ছেড়ে যাচ্ছে এবং তার পেছনের ফুটপাথে তিনটি গুণ্ডা ধরনের লোক একটি ছেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মারছে। বেশ কিছুটা দূরে নিরাপদে দাঁড়িয়ে কতগুলো লোক দৃশ্যটা উপভোগ করছে। ছবিটা থেকে চোখ তুলতেই ঊর্মিমালা মাথা নামাল। আর এই সময় দরজায় ঊর্মিমালার মা এসে দাঁড়ালেন, ‘কিরে, ওকে এখানে আটকে রেখেছিস কেন? এসো বাবা, সামান্য কিছু মুখে দাও।’ অর্ক মহিলার দিকে তাকাল, তারপর বসবার ঘরে চলে এল। সেখানে টেবিলের ওপর কয়েকটা প্লেটে খাবার দেওয়া হয়েছে। মাধবীলতা চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে ঊর্মিমালার বাবার কথা শুনছিল। পরমহংসর হাতে প্লেট, তার মুখ চলছে। ঊর্মিমালার বাবা বলছিলেন, ‘অতুলপ্রসাদের নিজের গলার রেকর্ড। একটা বিশাল সূর্যের ঠিক পাশে দাঁড়িয়েও উনি এখনও আমাদের কাছে বেঁচে আছেন, ক্ষমতা না থাকলে এরকমটা হতে পারে না। ওঁর গলাটিও ভারী মিষ্টি।’

পরমহংস মিষ্টিটা মুখে নিয়ে বলল, ‘রবীন্দ্রনাথের চেহারার সঙ্গে কিন্তু গলাটা একদম মানায় না। ওরকম বিশাল চেহারার কণ্ঠস্বর মেয়েদের মত—।’

‘আপনি ভুল করছেন।’ ঊর্মিমালার বাবা পরমহংসকে থামিয়ে দিলেন, ‘ওঁর গলা মোটেই মেয়েদের মত ছিল না। ওরকম তেজোদীপ্ত কণ্ঠস্বর খুব কম পুরুষের দেখা যায়। এমনিতেই বুড়ো বয়সে রেকর্ডিং হয়েছিল তার ওপর অযত্নে ওই হাল হয়েছে। আকাশবাণীর রেকর্ড শুনলে ভুল ধারণা হতে বাধ্য। আমি একবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে কবির গলায় আবৃত্তির রেকর্ড শুনেছি। সম্পূর্ণ আলাদা। কি স্বরক্ষেপণ, কি উদাত্ত কণ্ঠ।’

ঊর্মিমালার মা বললেন, ‘তুমি একটু চুপ করো তো! নাও অর্ক, তুমি খাও, আপনি যে হাত গুটিয়ে বসে আছেন। না বললে শুনব না।’

মাধবীলতা বলল, ‘আমি শুধু চা খাব। এগুলো তুলে নিন।’

‘কেন? না না, ওসব চলবে না—।’ ঊর্মিমালার মা আপত্তি করলেন।

‘খুব অবেলায় খেয়েছি আজ। এমনিতেই আমার লিভার ভাল নয়। এখন খেলে অম্বল হয়ে যাবে আর—। আমি চা নিচ্ছি।’

ঊর্মিমালার বাবা বললেন, ‘জোর করছ কেন, শরীরকে কষ্ট দিয়ে খেয়ে কি দরকার। আপনি চা খান।’

অর্ক দেখল ঊর্মিমালা এসে বাবার পেছনে দাঁড়িয়েছে। চোখাচোখি হতেই ঠোঁটের কোণে ভাঁজ পড়ল। ওটা কি হাসির! হঠাৎ ঊর্মিমালা মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার পথের পাঁচালি খুব ভাল লাগে, না?’

‘হ্যাঁ।’ মাধবীলতা অবাক হল।

‘আমারও।’ ঊর্মিমালা বলল, ‘আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।’

ঊর্মিমালার বাবা বললেন, ‘মানুষমাত্রই কাঁদবে। কেউ প্রকাশ্যে কেউ মনে মনে।’

মাধবীলতা বলল, ‘ওটা আমার প্রিয় বই। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?’

ঊর্মিমালা অর্ককে দেখাল, ‘তখন শুনলাম।’

মাধবীলতা এবার ছেলের দিকে বিস্ময়ে তাকাল। তার ভাল লাগা বা মন্দ লাগার খবর কখনও ও রেখেছে বলে মনে হয়নি। তাছাড়া, পথের পাঁচালি যে তার ভাল লাগে একথা কখনও জানায়নি অর্ককে। তারপরেই খেয়াল হল অনিমেষের সঙ্গে কখনো কথা হয়েছিলো হয়তো যেটা ও শুনেছে। হেসে বলল, ‘তুমি বুঝি খুব পড়?’

ঊর্মিমালার মা বললেন, ‘ওই তো জ্বালা। স্কুল থেকে এসে বই মুখে নিয়ে বসে আছে নইলে রঙ তুলি।’

মাধবীলতা বলল, ‘খুব ভাল। আমার ইনি আবার মুখ্যুসুখ্যু লোক। বই পত্তরের ধার ঘেঁষে চলেন না। আচ্ছা, আজ আমরা চলি। খুব ভাল লাগল আপনাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে।’

ঊর্মিমালার মা বললেন, ‘আবার কবে আসবেন?’

মাধবীলতা বলল, ‘আমরা তো আপনাদের পাড়ায় চলে আসছি। একটু গুছিয়ে বসলে আমি খবর দেব। তখন আপনাদের আমার ওখানে আসতে হবে। বেশী দূরে নয়।’

ঊর্মিমালার মা বললেন, ‘নিশ্চয়ই যাব।’

ওরা দরজা ছাড়িয়ে কয়েক পা এগোতে মাধবীলতা বাধা দিল, ‘না, না, আপনাদের আসতে হবে না, কি আশ্চর্য।’

ঊর্মিমালার মা বললেন, ‘অর্কর বাবাকে বলবেন এখানে এলে আমরা গিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ করে আসবো। উনি কি কখনই সুস্থ হবেন না?’

মাধবীলতা চোখ তুলে তাকাল। হঠাৎ যেন শূন্য হয়ে যাচ্ছিল দৃষ্টি। খুব দ্রুত নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, ‘জানি না।’

ঊর্মিমালা কিন্তু ফুটপাথ অবধি নেমে এল। মাধবীলতা তাকে বলল, ‘তোমাকে আমার খুব ভাল লাগল। আর হ্যাঁ, যত পার বই পড়বে। পৃথিবীতে এত বই আছে যে না পড়লে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। যতদিন মাথার ওপরে অন্য চাপ না আসছে ততদিন সুযোগ ছেড়ো না।’ কথাগুলো বলতে বলতে সে আর একবার ছেলের দিকে তাকাল। অর্কের নজর তখন দূরের বাসস্টপের দিকে। সেখানে সেই তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সেই তিনজন যারা তাকে মারতে এসেছিল। হঠাৎ একটা সিরসিরানি ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আজ তার সঙ্গে সেই কলম-ছুরি নেই। এবং মা সঙ্গে রয়েছে। মাধবীলতা তখন বলছিল, ‘এলাম।’

অর্ক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ঊর্মিমালা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল কিন্তু তার চোখ ওর দিকে। মাধবীলতা এবং পরমহংস তখন হাঁটতে শুরু করেছে। অর্ক কোনরকমে বলল, ‘চলি।’ নিজের গলার স্বর নিজের কানেই বেসুরো ঠেকল।

ঊর্মিমালা হেসে বলল, ‘চলি বলতে নেই।’

অর্ক দ্রুত পা চালিয়ে মায়ের পাশে চলে এল। ওরা যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই ছেলে তিনটে।

এখনও ওরা এদিকে নজর দেয়নি কিন্তু এবার দেখতে বাধ্য হবে। ওরা যদি আজ ঝামেলা করতে চায় তাহলে সে কি করবে? একা তিনজনের সঙ্গে হাতাহাতি করা মুশকিল এবং সবচেয়ে বড় কথা মা রয়েছে সঙ্গে। মাকে কি ওদের কথা বলবে? ছেলে তিনটে নির্ঘাৎ এপাড়ার এবং এখানে বাড়িভাড়া নেওয়ায় এদের সঙ্গে প্রায়ই তার দেখা হবে। অর্ক খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিল।

মাধবীলতা তখন বলল, ‘এঁরা কিন্তু সত্যি খুব ভদ্রলোক।’

পরমহংস বলল, ‘হ্যাঁ। তবে একটু বেশী বেশী ভদ্রলোক। এতটা এখন বড় একটা দেখা যায় না। এমন ব্যবহার করলেন যেন আমরা ওঁদের কত বড় আত্মীয়। আর এইটেই আমার কাছে খটকা লাগছে।’

মাধবীলতা হাসল, ‘দিন দিন এমন অবস্থা হয়েছে যে আমরা আর কোন ভাল জিনিসকে ভাল মনে গ্রহণ করতে পারি না। তোমার দোষ নেই, এইটেই এখন আমাদের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। ওখানে বসে একসময় আমারও তাই মনে হচ্ছিল। সন্দেহ করার রোগ আমাকেও ধরেছে।’

পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘তাই মিষ্টি খেলে না?’

‘যাঃ,’ মাধবীলতা সলজ্জ হাসল, ‘আমার খেতে ভাল লাগে না।’

এইবার তিনটে ছেলে একসঙ্গে বাঁ দিকে মুখ ফেরাতেই অর্ক সিঁটিয়ে গেল। ওর মনে হচ্ছিল মা সঙ্গে না থাকলেই ভাল হত। মায়ের উপস্থিতি যে তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে এটা বুঝেই সে নিজেকে জোর করে শক্ত করতে চাইল। হঠাৎ মাধবীলতা ওকে কিছু বলবার জন্যে মুখ ফেরাতেই অবাক হল, ‘একি কি হয়েছে তোর?’

‘কিছু না।’ এবং ওটা বলবার পরই অর্ক স্থির করল ওরা যদি আক্রমণ করে তাহলে সে ছেড়ে দেবে না। তিনজনেই অর্ককে চিনতে পেরেছে। একজন মুখ খুলতে যাচ্ছিল কিন্তু তৎক্ষণাৎ আর একজন বলল, ‘এই, না!’

এই সময় অর্ক শুনল পরমহংস বলছে, ‘কিরে, এখানে কি করছিস?’

দলের একজনের মুখ একটু কাঁচুমাচু হল। অর্ক চিনতে পারল, এই লোকটাই তাকে মারতে এসেছিল রাস্তা পেরিয়ে। ট্রামের অপরাধীটি ওর পাশে দাঁড়িয়ে, কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। যাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল সে জবাব দিল, এই এমনি গল্প করছি।’ পরমহংস মাধবীলতাকে বলল, ‘এ হচ্ছে আমার জ্যাঠতুতো দাদার ছেলে। খুব হেল্পফুল। লোক্যাল ট্যালেন্ট বলতে পার। সুবীর, এরা হল আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রী এবং ছেলে। ওরা আমাদের পাড়ায় বাড়ি নিয়ে উঠে আসছে।

অর্ক দেখল লোকটার মুখ ফুটো বেলুনের মত হয়ে যাচ্ছে। যদিও বয়সে পরমহংসের চেয়ে অনেক ছোট তবু চেহারায় লোক লোক হয়ে গিয়েছে।

সুবীর কিছুটা জড়তা নিয়ে বলল, ‘আমাদের পাড়ায়?’

‘হ্যাঁ, ওই গলিটায়।’

মাধবীলতা বলল, ‘ভালই হল ভাই। তুমি যখন ওর ভাইপো তখন আমাদেরও। যদি আপদে বিপদে দরকার হয় তাহলে সাহায্য করো।’

সুবীর ঘাড় নাড়ল, ‘নিশ্চয়ই।’

পরমহংস আর কথা বাড়াল না। রাস্তা পেরিয়ে এদিকের ট্রামস্টপেজে চলে এল। অর্কর খুব হাসি পাচ্ছিল। ও বুঝতে পারছিল ওরা এখন নিস্ফল আক্রোশে এদিকে তাকিয়ে আছে। যতই রাগ থাক আর ওদের কিছু করা সম্ভব নয়। ভাগ্যিস পরমহংসকাকু সঙ্গে ছিল নইলে—। কিন্তু পরমহংসকাকুর ভাইপো এ পাড়ার ভাল মস্তান। কাকার ব্যবহার এবং চেহারা দেখে ভাইপোর এই স্বরূপের কথা ভুলেও কল্পনা করা যায় না। সে হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠতেই মাধবীলতা বলল, ‘কিরে, হাসছিস কেন? একটু আগে দেখলাম মুখচোখ কাঠ হয়ে গেছে আবার এখন হাসি হচ্ছে, মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি!’

‘মাথা খারাপ হবে কেন?’ অর্ক আবার হাসল। মাধবীলতা একবার ভ্রূকুটি করে মুখ ফিরিয়ে নিল। নাঃ, অর্ক ভাবল, এসব কথা মা কিংবা পরমহংসকাকাকে বলা যাবে না। হয়তো এপাড়ায় এলে পরমহংসকাকার ভাইপোর সঙ্গে আলাপ হয়ে যেতেও পারে। তবে কিছুতেই ওই ট্রামের অপরাধীটির সঙ্গে সে কথা বলবে না। এক নম্বরের নোংরা লোকটা।

একটা বেলগাছিয়ার ট্রাম আসছিল। মাধবীলতা পরমহংসকে বলল, ‘চল।’

‘যাবো? কোথায় যাবো?’ পরমহংস আঁতকে উঠল।

‘আমাদের ওখানে চল। তোমাকে দেখলে ও খুশি হবে।’

‘আর একদিন হবে, আজ নয়। আমি অবশ্য ট্রামে উঠছি, হাতিবাগানে নামব। ওঠ ওঠ।’ প্রায় তাড়া দিয়ে পরমহংস ওদের ট্রামে তুলল। বেশ ফাঁকা ট্রাম। মাধবীলতা মেয়েদের জায়গায় বসল। সেখানে আর কোন মহিলা না থাকায় অর্ক মায়ের পাশে বসল কিন্তু পরমহংস দাঁড়িয়ে রইল। মাধবীলতা তাকে বলল, ‘কি হল, বসো।’

পরমহংস ঘাড় নাড়ল, ‘মাথা খারাপ। এর পরে একটি মহিলা উঠবেন আর আমাকে সুড়সুড় করে সিট ছেড়ে দিতে হবে। যেচে কেউ গলাধাক্কা খায়!’

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ‘কিন্তু তুমি চললে কোথায়?’

পরমহংসের উঁচু দাঁতের সামনে থেকে ঠোঁট সরে গেল। গোল মুখটি লজ্জা মেশানো হাসিতে উদ্ভাসিত হল। বলল, ‘সিনেমায়।’

‘অ্যাঁ, কি সিনেমা?’

‘প্যার কা তুফান!’

মাধবীলতা যেন মুখ বন্ধ করতে ভুলে গেল। অর্ক অবাক চোখে এখন পরমহংসকে দেখছে। মাধবীলতা কোনরকমে সামলে নিয়ে বলল, ‘তুমি হিন্দী সিনেমা দ্যাখো?’

পরমহংস মাথা নাড়ল, ‘সপ্তাহে একবার, ছুটির দিন। ওই একটি নেশা। অন্যদিন অফিস থেকে তাস খেলে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায় বেশ। এই ছুটির দিনটাই কাটতে চাইতো না তাই এই ব্যবস্থা করে নিয়েছি। তিন দিন আগে অ্যাডভান্স কেটে রাখি। ফার্স্ট ক্লাশ চলে যায়।’

মাধবীলতা বলল, ‘আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। তুমি হিন্দী সিনেমা প্রত্যেক সপ্তাহে দেখতে পারো? বাংলা দ্যাখো না?’

‘বাংলা? ওরে বাপ, নেভার। বাংলা ছবি কোন ভদ্রলোক দ্যাখে না। শালা সেই প্যানপাননি, গল্পের মাথাআগা নেই, একটা ভাল অ্যাকট্রেস নেই যে বসে থাকব, ফটোগ্রাফি যাচ্ছেতাই। তার ওপর যদি ইনটেলেকচুয়াল ডিরেক্টার হয় তো দফারফা। আঁতুড়ঘরের ঘুম এসে যাবে চোখে। সাধ করে পয়সা নষ্ট আর যন্ত্রণা পেতে কে যাবে বল? তার চেয়ে হিন্দী ছবি দ্যাখো। কি পাবে না, দারুণ দারুণ দৃশ্য, হিট গান, ফাইটিং, আর রাজকন্যেদের মত সুন্দরী, কি করে সময় কেটে যায় টের পাই না।’ কথা শেষ করে পরমহংস সামান্য ঝুঁকে বাইরেটা দেখল। ট্রামটা তখন হাতিবাগানে বাঁক নিচ্ছে। মাধবীলতা দ্রুত বলে উঠল, ‘তোমার আজ সিনেমা দেখা চলবে না।’

‘অ্যাঁ?’ পরমহংস অবাক হয়ে তাকাল।

‘হ্যাঁ। আজ আমাদের ওখানে গিয়ে আড্ডা মারবে।’

‘কিন্তু—।’

‘কিন্তু কিন্তু নয়। তোমার তো সময় কাটানো নিয়ে কথা।’

‘তাহলে, আমার জলজ্যান্ত চার পঁয়ষট্টি নষ্ট করে দেবে?’

‘ও তো দেখলেও নষ্ট হতো।’

‘মোটেই নয়। ওটা দেখে বাড়ি গেলে চমৎকার ঘুম আসতো।’

‘আমি কিছু জানি না। যা ভাল বোঝ কর।’

‘মাইরি, এই তো মুশকিলে ফেললে। এখন এটা নিয়ে কি করি?’

পকেট থেকে একটা সবুজ টিকিট বের করে দেখাল পরমহংস। একটি মধ্যবয়সী লোক ট্রাম থেকে নামবে বলে দাঁড়িয়েছিল এবার সে মাথা বাড়িয়ে বলল, ‘দাদা, টিকিটটা কি প্যার কা তুফানের?’

‘হ্যাঁ। পরমহংস বিমর্ষভঙ্গীতে মাথা নাড়ল।

চট করে ভেতরে চলে এল লোকটা। ওর হাতে তখন পাঁচ টাকার নোট। সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘সকালে হাউসফুল দেখে গিয়েছি, এখন ফ্লাইং টিকিট ধরতে এসেছিলাম। কপালে ছিল বলে আপনার দেখা পেলাম।’ টাকাটা গছিয়ে দিয়ে টিকিটটা হাতিয়ে নিয়ে লোকটা দরজার দিকে এগোল। পরমহংস এমন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল যে অসাড় চোখে চেয়ে রইল। ট্রামটা যখন সিনেমা পাড়া ছাড়িয়ে যাচ্ছে তখন ওর খেয়াল হল, ‘আরে, লোকটা যে পঁয়ত্রিশ পয়সা ফেরত পাবে! কি আশ্চর্য।’

মাধবীলতা হেসে উঠল, ‘এ মা তুমি টিকিট ব্ল্যাক করলে?’

মুখ ভেটকে পরমহংস কণ্ডাক্টরকে ভাড়া দিতে দিতে বলল, যাই হোক, লোকটা আমায় তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার ভাড়া দিয়ে গেল। যাচ্ছি যখন তখন বেশ ভাল করে খাওয়াতে হবে।’

‘কি খাবে বল?’

‘কড়া করে পেঁয়াজ ভেজে তেল মাখা মুড়ি আর লঙ্কা।’ পরমহংস চোখ বুজে বলল।

ট্রাম থেকে নেমে মাধবীলতা ইঙ্গিতে অর্ককে কাছে ডাকল। তারপর হাঁটতে হাঁটতেই একটা পাঁচ টাকার নোট ওর হাতে দিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘তেলেভাজা আর মুড়ি নিয়ে আয়।’ অর্কর মাথায় কিছুতেই আসছিল না যে ঊর্মিমালার বাড়িতে অত খেয়েও কি করে পরমহংসকাকুর আবার খিদে পাচ্ছে। ওই বেঁটে খাটো মানুষটির পেটে কত খিদে কে জানে! তার নিজের তো একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না।

ট্রাম ডিপোর ঠিক উল্টো দিকে চমৎকার তেলেভাজা ভাজে। মাধবীলতা এবং পরমহংস ঈশ্বরপুকুরে ঢুকে গেলে অর্ক তিনজনের মত তেলেভাজা আর মুড়ি কিনে নিল সেখান থেকে। তারপর গলির মধ্যে ঢুকতেই অশ্লীল খিস্তি শুনতে পেল। কয়েক পা এগোতেই নজরে এল একটা রকের ওপর দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে কোয়া সামনের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বাপ-বাপান্ত করে যাচ্ছে। কোয়ার ঠিক পাশেই এ পাড়ার কয়েকটা ছোকরা হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে। এদের বোধহয় হাতেখড়ি দিচ্ছে কোয়া। অর্ককে দেখেও কোয়া তোয়াক্কা না করে চেঁচালো, টেংরি ভেঙ্গে দেব। কোঠাবাড়িতে বাস করছে বলে মাথা কিনে নিয়েছে! রকে বসেছি বলে ইংরেজিতে গালাগালি দিচ্ছে। বেরিয়ে আয় শালারা।’

অর্ক বুঝতে পারল কোয়া তাকে ইচ্ছে করেই চিনতে পারছে না। খুরকি-কিলা মারা যাওয়ার পর কোয়া এখন ঈশ্বরপুকুরের এক নম্বর হতে চাইছে। এরকম দু-একটা কেস করতে পারলেই হয়ে যাবে। হাতে তেলেভাজা তাই মেজাজটা গরম হয়ে গেলেও কোনরকমে নিজেকে সামলালো অর্ক। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘কি হয়েছে?’

‘রকে বসেছি বলে ননসেন্স বলল। ইংরেজিতে গালাগালি। আমরা নাকি এখানে বসে খিস্তি করছি। তুই যা, আমি এটা বুঝে নেব।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে শেষ কথাটা বলে কোয়া আবার ওপরের দিকে তাকাল।

অর্ক আর দাঁড়াল না। ফালতু ঝামেলায় এখন জড়াতে ইচ্ছে করছে না। হন হন করে তিন নম্বরের সামনে আসতেই একটা ছোট জটলা দেখতে পেল। ওকে দেখে নিমু বলে উঠল, ‘ওই যে, ওর বাবা, ওর সঙ্গে যান।’

অর্ক দেখল একটা লোক সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘অনিমেষ মিত্র আপনার বাবা?’ অর্ক মাথা নাড়ল।

‘টেলিগ্রাম আছে। চলুন।’

হতভম্ব হয়ে গেল অর্ক। তাদের টেলিগ্রাম করবে কে? গলিতে পা দিয়ে দেখল মোক্ষবুড়ি পাথরের মত বসে আছে। ঘরের দরজা খোলা। অর্ক অনিমেষকে ডাকল, ‘বাবা, তোমার টেলিগ্রাম এসেছে।’

লুঙ্গি পরে খাটের ওপর অনিমেষ বসেছিল। চমকে উঠে বলল, ‘টেলিগ্রাম?’

হঠাৎ যেন চারধার শব্দহীন হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *