1 of 2

২৫. একজন জটাজুটধারী সন্ন্যাসী

একজন জটাজুটধারী সন্ন্যাসী বসবার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বড়বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, জামাইবাবু, চিনতে পারছেন?

বড়বাবু অবাক হয়ে তাকালেন। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভেতরে আসুন, ভেতরে আসুন।

চিনতে পারলেন না?

না তো!

সেই ফুলবাড়িতে আমাকে দেখেছিলেন।

বড়বাবুর তবু মনে পড়ল না। ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন। সন্ন্যাসীটি বেশ লম্বা, মধ্যবয়স্ক, অসম্ভব সুপুরুষ। গাওয়া ঘিয়ের মতন গায়ের রং, টিকোলো নাক, টানা টানা চোখ–অক্ষিপল্লবগুলি বড় বড়। ঘাড় ছাড়িয়ে নেমেছে চুল, দাড়ি বুক পর্যন্ত–এখনও পাক ধরেনি। তিনি হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন বড়বাবুর দিকে।

পূর্ণিমা আমার দিদি ছিল।

বড়বাবু চমকে উঠলেন। প্রবল উৎসাহে বললেন, ও নিখিল! সেই কত দিন আগে তোমাকে দেখেছিলাম! চিনব কী করে বলো! যে রকম ভোল পালটেছ—

সন্ন্যাসী এবার চেয়ারে আসন গ্রহণ করলেন। মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বললেন, আপনাকে কিন্তু চেনা যায়। চেহারা বিশেষ পালটায়নি।

আমি তো আর ভেক ধরিনি তোমার মতন। শুনেছিলাম বটে তুমি কোন আশ্রমে আছ। হঠাৎ সংসারীদের কাছে এলে যে!

আশ্রম থেকে একটি কাজে আমাকে কলকাতায় পাঠিয়েছে।

কোথায় যেন আশ্রম তোমার?

আসামে। গৌহাটির নিকটবর্তী।

কলকাতায় এসে কোথায় উঠেছ? এখানেই এসে থাকো–অনেক জায়গা আছে।

উঠোনের কল খুলে আমি তখন জল ছিটোবার খেলা খেলছিলাম। বড়বাবু ডেকে বললেন, এই বাদলা, এদিকে আয়। এঁকে প্রণাম কর। তোর কাকা হন।

আমি গিয়ে ঝুপ করে প্রণাম করলাম। সন্ন্যাসী আমার মাথায় আশীর্বাদের হাত ছুঁইয়ে বড়বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, ইটি কে?

চিরুর ছেলে, তোমার মেজদার ছেলে।

আমি এর জন্মের কথাই শুনিনি।

তা আর কী করে শুনবে। তুমি তো আমাদের কোনও খোঁজখবর রাখে না।

বছর দশেক আগে বড়দা একটা চিঠি লিখেছিলেন। তাতেই এ বাড়ির ঠিকানা পেয়েছিলাম। দিদি তো মারা গেছেন, তাই না?

বহুকাল আগে।

আমি সন্ন্যাসীর কাছ থেকে সরে আসতে চাইছিলাম, কিন্তু উনি ধরে রেখেছিলেন আমাকে। আমায় গায় হাত বুলোচ্ছিলেন। ইনি আমার সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ, যদিও আমার আপন কাকা। পারিবারিক সূত্রে জেনেছিবহু দিন আগে কোনও একটা অত্যন্ত গর্হিত কাজের জন্য জ্যাঠামশাই এঁকে খুব মেরেছিলেন, সেই অভিমানে ইনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান এবং কোনও একটা আশ্রমে ঢুকে পড়েন। এঁর নাম নিখিলরঞ্জন।

তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?

বাদলরঞ্জন মুখার্জি।

মুখার্জি নয়, মুখোপাধ্যায় বলতে হয়। তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?

বড়বাবু বললেন, চলো, নিখিল, ওপরে চলো।

বড়দা আছেন বাড়িতে?

প্রিয়রঞ্জন এখন এখানে থাকে না। সে তালতলায় বাড়ি করেছে। ঠিকানা দেব অখন– বিকেলে যেয়ো।

বাবা সদ্য অসুখ থেকে সেরে উঠেছেন। এখনও শরীর দুর্বল, ঘর থেকে বেশি বেরোন না। বাবা কিন্তু নিখিলকাকাকে দেখেই চিনতে পারলেন। একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই এসেছিস? কত দিন তোকে দেখিনি!  

দুর্বল শরীর বলেই বোধহয় বাবার চোখে জল এসে গেল। কিংবা তিনি অন্য কথা ভাবছিলেন।

কাকা মা-কে প্রণাম করে বললেন, বউদি, আপনি অনেক রোগা হয়ে গেছেন।

আমার দিদি সান্ত্বনাকে বললেন, তোকে বোধহয় আমি দেখেছিলাম, নারে! এইটুকুনি!

বড়বাবু বললেন, আমার চোখে কিন্তু নিখিলের সেই চেহারাটা এখনও ভাসছে। রোগা। পাতলা একটা ছেলে-খুব শান্ত আর লাজুক।

আমাদের চোখে যিনি একজন সৌম্যকান্তি সন্ন্যাসী, বাবা আর বড়বাবু তাকেই দেখেছেন রোগা পাতলা সাধারণ একটি যুবক হিসেবে মাঝখানে সময়ের ব্যবধানে যে অভাবনীয় পরিবর্তন–সেটা তাঁরা ঠিক মেলাতে পারছেন না। অনেকক্ষণ বসে বসে পুরনো কালের গল্প হল–সেই ফুলবাড়ি, বরিশাল-সেখানকার মানুষজন, পূর্ণিমা পিসিমার বাল্যকাল–আমরা হাঁ করে শুনতে লাগলাম।

নিখিলরঞ্জন এ বাড়িতে কয়েক দিন থেকে গেলেন, তারপর গিয়ে উঠলেন তালতলায় জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে। এই ক’দিনে বাড়ির ছোটদের সঙ্গে তার বেশ ভাব হয়ে গেল। নতুন রকমের মানুষ দেখলেই আমার খুব কৌতূহল হয়। এত কাছাকাছি আমি কোনও সন্ন্যাসীকে আগে দেখিনি। আমার কেন যেন ধারণা ছিল সন্ন্যাসীরা বড় গম্ভীর আর রুক্ষ স্বভাবের হয়। আর কথায় কথায় অভিশাপ দেয়। কিন্তু আমাদের এই কাকা আমাদেরই মতন সাধারণ মানুষ–বেশ মজার মজার কথা বলতে পারেন। আমরা তার নাম দিলাম সাধুকাকা।

সূর্যদা গম্ভীর প্রকৃতির ছেলে, প্রথম প্রথম আমার এই কাকাকে বিশেষ পাত্তা দিতে চায়নি। কিন্তু কাকাই জোর করে ভাব জমিয়ে নিলেন তার সঙ্গে। সূর্যদাকে দেখে প্রথমটায় তিনি যেন একটু অবাক হয়েছিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি ছবি আঁকতে জানো?

সূর্যদা বলেছিল, না।

মূর্তিটুর্তিও বানাও না?

না তো!

কেন জানি না, তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমি একজন শিল্পী। তোমার মধ্যে একটা কিছু সম্ভাবনা আছে–তুমি ঠিক সাধারণ মানুষ হবে না।

আমি সোৎসাহে জানালাম, সূর্যদা পড়াশুনোয় দারুণ ভালো। প্রত্যেক পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়!

সূর্যদা আমাকে এক ধমক দিয়ে বলল, এই বাদল, কেন মিথ্যে কথা বলছিস! জানেন, এইটুকু ছেলে, কিন্তু বড্ড মিথ্যে কথা বলে আজকাল।

সাধুকাকা আমার দিকে ফিরে বললেন, তাই বুঝি?

আমি চুপ করে রইলুম। সূর্যদা বলল, আজকাল ও কথায় কথায় মিথ্যে কথা বলতে শিখেছে। কদিন আগে ও নাকি রাস্তায় একটা গাধা দেখেছে, তার দুটো শিং আছে। এ রকম কখনও হয়?

আমি প্রতিবাদ করে বললাম, কেন, সেদিন তুমি একটা গোরু দেখলেনা, যেটার পাঁচটা পা? গোরুটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে একটা লোক পয়সা নিচ্ছিল। গোরুর পাঁচ পা হয়?

সাধুবাবা হাসতে হাসতে বললেন, আমি আসামে থাকি জানো তো–সেখানে অনেক জন্তুজানোয়ার আছে? হাতি, গন্ডার এসব তো প্রায়ই দেখা যায়। একদিন আমরা একটা কচ্ছপ দেখলাম–সেটার ঠোঁট ঠিক বকের মতন। নদীর ধারে লম্বা ঠোঁট দিয়ে ধরে ধরে মাছ খাচ্ছিল। আমরা সেটার নাম দিয়েছি বকচ্ছপ!

আমি বুঝতে পারলুম, এটা ডাহা মিথ্যে গল্প। আমি ততদিনে সুকুমার রায় পড়ে ফেলেছি–আমাকে ঠকানো অত সহজ নয়। সাধুরাও তা হলে মিথ্যে কথা বলে।

আর একদিন সাধুকাকা সূর্যদাকে বললেন, তোমাকে দেখে রোজই আমার কী যেন মনে পড়বে মনে পড়বে ভাব হচ্ছিল–আজ সেটা মনে পড়েছে। তোমার সঙ্গে একজনের চেহারার খুব মিল আছে।

আমি বলে উঠলাম, আমি বলব? চার্লস লিন্ডবার্গ!

সাধুকাকা অবাক হয়ে বললেন, তিনি কে?

লিন্ডবার্গ এর কিছুকাল আগে একলা এরোপ্লেন চালিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে একটা কীর্তি স্থাপন করেছিলেন। যেমন রূপবান তিনি, তেমনই সাহসী। মৌচাক পত্রিকায় আমি এঁর সম্পর্কে পড়েছি–উনিই তখন আমার হিরো। আমিও একদিন এরোপ্লেন চালিয়ে সমুদ্র পার হব–বিষ্ণুর সঙ্গে সব ঠিক হয়ে আছে।

সাধুকাকা শুনে বললেন, না, উনি নন। ওনার ছবিও আমি দেখিনি। সূর্যর চেহারা আর হাবভাবের সঙ্গে মিল আছে আমার এক ভাইয়ের। তার নাম বিশ্বরঞ্জন।

তিনি এখন কোথায়?

তার যখন সূর্যর মতনই বয়স, কিংবা আর একটু বড়–তখন সে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।

আপনার মতন?

আমি তো নিরুদ্দেশ হইনি। আমি তো আশ্রমে থাকি–তোমার বাবা-জ্যাঠামশাই সবাই জানেন। কিন্তু আমাদের সেই ভাই রঞ্জু কোথায় আছে কেউ জানে না। ও একটা সাহেবকে মেরেছিল।

শেষ কথাটা শুনে সূর্যদা খরচোখে তাকাল। তারপর বলল, তার কথা তো কখনও শুনিনি।

আমিও ভালো করে জানি না আমার এই কনিষ্ঠ কাকার কথা। বললাম, সাধুকাকা তার গল্প বলো। কী করে সাহেবকে মারল?

সাধুকাকা সূর্যদার প্রসঙ্গ নিয়ে বড়বাবুর সঙ্গেও আলোচনা করেছিলেন। বড়বাবুকে বলেছিলেন, জামাইবাবু, আপনার রঞ্জুকে মনে আছে?

খুব মনে আছে। ও যখন মারা যায় তখন আমি গোয়ালিয়রে।

ও তো মারা যায়নি। ও নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।

বলো কী? তুমি জানো? তোমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

না, তা নেই। কিন্তু আমি জানি, সে মরেনি।

এত বছর কেউ নিরুদ্দেশ হয়ে থাকতে পারে?

দেশ থেকে এখনও তো ইংরেজ রাজত্ব যায়নি!

তা বটে। যদি বেঁচে থাকে, খুব আনন্দের কথা। বড় তেজি ছেলে ছিল। ও রকম ছেলে বেশি দিন আত্মগোপন করে থাকতে পারে না।

আপনার ছেলে সূর্যর সঙ্গে কিন্তু রঞ্জুর দারুণ মিল আছে। শুধু চেহারায় না, চরিত্রেও।

হুঁ। একথা আগেও কে যেন বলেছিল আমাকে। অবশ্য সেটা ঠিক চোখে পড়ে না।

যেন মনে হয় সেই রঞ্জুই এ-পরিবারে আবার ফিরে এসেছে।

সে কথা তুমি বলতে পারো না। ও তো তোমাদের পরিবারের কেউ না। আমি তোমাদের পরিবারের বাইরের লোক–আর ও তোমার দিদিরও ছেলে নয়।

তবে কার ছেলে?

আমি দ্বিতীয় বার বিবাহ করেছিলাম। অবশ্য গন্ধর্ব মতে। তোমার দিদির কোলে শুধু একটি মেয়ে এসেছিল–সে বেশি দিন বাঁচেনি। তোমার দিদিই একে মানুষ করেছে ওর মা আত্মহত্যা করেছিল। যাক, সে কথা তোমার শোনার দরকার নেই।

ছেলেটার দিকে একটু লক্ষ রাখবেন। ও ঠিক সাধারণ ছেলেদের মতন হবে না।

আমার ছেলেটা একটু পাগলাটে ধরনের হয়েছে। ওর নিজের ভালো-মন্দ ওকেই বুঝতে হবে। আমি আর কদিন!

আপনি কি এর মধ্যে মৃত্যুচিন্তা করছেন নাকি?

বয়স তো হল। যাকগে, তোমার নিজের কথা বলো! তুমি শান্তি পেয়েছ?

হ্যাঁ পেয়েছি।

আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্য! এ রকম মানুষ খুবই কম দেখেছি যে এককথায় বলতে পারে যে শান্তি পেয়েছে। সত্যিই পেয়েছ তা হলে?

হ্যাঁ, পেয়েছি।

কী করে পেলে? আমিও কিছুদিন সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ঘুরেছি। আমি শান্তি পাইনি। তুমি কী করে পেলে? ঈশ্বরের দর্শন পেয়েছ?

না। তেমন ভাবে ঈশ্বরের দর্শন পাবার কখনও চেষ্টাও করিনি। আমি যাঁর আশ্রমে আছি–সেই যতীন মহারাজ-তিনিও জপতপ সম্পর্কে খুব একটা উৎসাহী নন। একটা ইস্কুল, একটা ছোট হাসপাতাল চালাই–সবজি বাগান করি। আসামে যেখানে আছি– তার আশেপাশে মানুষ বড় গরিব হিন্দু, মুসলমান, পার্বত্যজাতি–এদের মধ্যে যেমন অশিক্ষা, তেমনই দারিদ্র। খ্রিস্টান মিশনারিরা কিছু কিছু কাজ করে–আমরাও সাধ্যমতন কিছু করার চেষ্টা করি। এই কাজের মধ্যেই শান্তি আছে।

তোমরা কি খ্রিস্টান মিশনারিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওই সব গরিব লোকদের সাহায্যের নাম করে ধর্মান্তরিত করো নাকি?

আজ্ঞে না। যার যা ধর্ম আছে থাক। আমরা শুধু সেবা করার চেষ্টা করি। ঈশ্বর দর্শনের চেয়ে এতে আনন্দ কম নয়।

কিন্তু দারিদ্র্য তো সব জায়গায়। এই বাংলাদেশে দারিদ্র্য নেই? আমি বহু জায়গায় ভ্রমণ করেছি–মধ্যপ্রদেশ আর উড়িষ্যার কোনও কোনও অঞ্চলের মতন এত ভয়ংকর দারিদ্র্য আর কোথাও দেখিনি। কত জনকে তুমি সেবা করতে পারবে? বেছে বেছে শুধু আসামেই কেন?

যার নিয়তি যাকে যেখানে নিযুক্ত করে।

তুমি নিয়তি মানো দেখছি। আচ্ছা নিখিল, আমাকে তুমি একটা রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারো? আমার এতটা বয়স হল, এখনও আমার ধর্মেকর্মে রুচি হল না। কীসে শান্তি পাই বলতে পারো? সারাটা জীবন শুধু এর পেছনে ওর পেছনে দৌড়োদৌড়ি করেই মরলাম, কিছুই পেলাম না। আমার মতন মানুষ কীসে শান্তি পাবে?

জামাইবাবু, আপনাকে পথ দেখাবার ক্ষমতা আমার নেই।

তুমি ধর্ম মানে?

মানি। কিন্তু গীতায় যে ধর্ম সংস্থাপন করার কথা বলা হয়েছে, সেটা বিশেষ কোনও ধর্ম নয়। মানুষের ধর্ম। আমি সেই ধর্ম মানি।

তা হলে তুমি ঈশ্বর মানো?

ঈশ্বর ছাড়া এই সৃষ্টি কার?

তার অনেক উত্তর আছে। সে কথা নয়। গীতা ফিতাও বাদ দাও। সাধারণ মানুষ যে ঈশ্বরকে খোঁজে–সে তো কোনওনা-কোনও ধর্মকে অবলম্বন করেই খোঁজে। সব ধর্মেই তো ঈশ্বরের চেহারা আলাদা। এমনকী ঈশ্বরের চেহারা না-থাকাও একটা ধর্মবিশ্বাস।

‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’–আমি এইটাই ভালো বুঝি!

পরোপকার? হু, পরোপকারের মধ্যে খানিকটা অহংকারের তৃপ্তি হয় বটে। সেটাতে ভালোই লাগে। কিন্তু একথাও তো ঠিক–পরোপকারের মধ্যে খানিকটা ক্লান্তিও আছে। যে ডাক্তার বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে–সে বেশ ভালোই লোক। কিন্তু প্রত্যেক দিন পঞ্চাশ জন রুগিকে চিকিৎসা করতে হলে তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় না?

আপনি যদি আমাদের যতীন মহারাজকে দেখতেন—

তিনি হয়তো মহাপুরুষ, তার কথা আলাদা। আমি বলছি, সাধারণ মানুষের কথা। তোমাকে আর একটা কথাও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সাহস পাচ্ছি না।

বলুন না।

তুমি তো এখন আর শুধু আমার ছোট শ্যালকটি নও, তুমি একজন সন্ন্যাসী। তোমাকে কি সব কথা বলা যায়?

সন্ন্যাসীর কাছেই বরং সব কথা বলা যায়।

আশ্রমবাসী হয়ে তুমি কি কোনও অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়েছ?

তার মানে?

অর্থাৎ বিশেষ কোনও শক্তি তোমার হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের নেই? যেমন কোনও মানুষের মুখ দেখলেই তার মৃত্যু কবে হবে সে কথা বলে দেওয়া কিংবা দুরারোগ্য রোগ সারিয়ে দেওয়া–অনেক সন্ন্যাসীর তো সে রকম থাকে শুনেছি।

না, আমার সে রকম কোনও শক্তি নেই।

তা হলে তুমি কামনা বাসনা দমন করলে কী করে? সাধারণ মানুষ তো পারে না! তোমার বয়স এখনও বেশি না, চেহারা সুন্দর–তোমার নারীসঙ্গ পেতে ইচ্ছে করে না? আমি বুড়ো হয়েছি, তবু সত্যি কথা বলতে গেলে কী–সে রকম কোনও সুন্দরী নারী। দেখলে আমার মন আনচান করে–আর তোমাদের করে না? এর রহস্যটা কী?

আমরা মনটা অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখি। ওসব কথা চিন্তা করারই সময় পাই না।

মন কি তোমার হুকুম মতন চলে? নাকি এখনও মাঝে মাঝে মন উতলা হয়– তোমরা কৃত্রিম ভাবে চেপে রাখো। সেটা কি স্বাভাবিক? সন্ন্যাসীরা প্রেম করে না? এলোইস আর আবেলার সেই বিখ্যাত কাহিনীর কথা শোনোনি? নাকি তোমরা মেয়েদের দেখলেই চোখ ঢেকে রাখো?

আপনি এ ব্যাপারটা সম্পর্কে এত বেশি কৌতূহলী কেন?

তোমাকে দেখার পরই মনে হচ্ছে। কিছু মনে এলে আমি বলে না ফেলে পারি না। অবশ্য তোমাকে বলতেই ইতস্তত করছিলাম। আমি যতদূর জানি, বরিশালের এক। অধ্যাপকের স্ত্রী তোমার সঙ্গে গৃহত্যাগ করে যাচ্ছিলেন। সেই অবস্থায় তোমরা ধরা পড়ে। যাও! আমার শুধু জানতে ইচ্ছে করে কী করে তোমার মনে এই পরিবর্তন এল—

নিখিলরঞ্জনের মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল। দুটি হাত তুলে বুকের কাছে রাখলেন। দৃষ্টি। নিবদ্ধ হল মাটিতে। তারপরই নিজেকে সামলে নিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললেন, সন্ন্যাসীর পক্ষে পূর্বাশ্রমের কথা আলোচনা করতে নেই। নইলে আপনাকে এ কথার উত্তর দিতাম।

নিখিলরঞ্জনের মুখের চেহারা দেখে বড়বাবু অনুতপ্ত বোধ করলেন। তাড়াতাড়ি উঠে এসে ওঁর হাত ধরে বললেন, আমাকে মাপ করো। আমি তোমার মনে আঘাত দিতে। চাইনি। আমার ঔৎসুক্য বড় বেশি–তাই মাঝে মাঝে অবান্তর কথা বলে ফেলি–।

.

সাধুকাকাকে তালতলার বাড়িতে আমিই নিয়ে গেলাম। এর আগে এ বাড়িতে আমি দু’বার এসেছি–মায়ের সঙ্গে। এ বাড়িতে এখনও একটা এলোমেলো অবস্থাযত বড়। বাড়ি সেই তুলনায় আসবাবপত্র বেশি নেই। বড় বড় ঘর খালি পড়ে আছে। বাড়িটা অত্যধিক ফাঁকা ফাঁকা লাগবে বলে জ্যাঠামশাই তার দোকানের এক কর্মচারীকে সপরিবারে স্থান দিয়েছেন নীচের তলায়।

ছাদটা প্রকাণ্ড। এখানে এসেই আমি ছাদে উঠে যাই। কত দূর দেখা যায়। বাড়িটার খুব কাছেই একটা গির্জা কী অদ্ভুত শান্ত শব্দে সেখানে ঘণ্টা বাজে।

ছাদে একা দাঁড়িয়ে আমি আকাশে ঘুড়ির প্যাঁচ দেখছিলাম–এমন সময় বৃষ্টি নামল। আমি তখনও নীচে নেমে না-গিয়ে দেওয়াল সেঁটে দাঁড়িয়ে রইলাম। এক ঝক পায়রা ডানা ঝটপটিয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে ঢুকে গেল গির্জার মধ্যে। কাকগুলো ডাকাডাকি করতে লাগল। বৃষ্টির ঝাঁপটায় একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ নাকে আসে।

বড়দি ছাদে উঠে এসে বলল, এই, তোকে নীচ থেকে এত ডাকাডাকি করছে, তোর। কানে যাচ্ছে না?

শুনতে পাইনি তো!

কানের মাথা খেয়েছিস? দেখি কী হয়েছে কানে।

বড়দি কাছে এসে আদর করে আমার বাঁ কানটা ধরে টানতে লাগল। আমিও কুটুস করে বড়দির পিঠে একটা চিমটি কেটে দিলাম।

বড়দি একটু রোগা হয়ে গেছে। ইস্কুলে যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে। একদিন ইস্কুল যাবার পথে বড়দির কাছ থেকে পয়সা নিয়ে লজেঞ্চস কিনতাম। এখন আর তা হয় না। আমি আর বড়দি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলাম। একটু বাদে বড়দি জিজ্ঞেস করল, হারে, সূর্যদা কেমন আছে রে?

ভালো। বেশ ভালো আছে।

আবার অন্য কোথাও যায়নি তো? বাড়িতেই আছে?

হ্যাঁ।

আমার কথাটথা কিছু বলে?

না তো!

বলে না?

একদম না। সূর্যদা তোমাকে একদম ভুলে গেছে।

বড়দির মুখখানা একটু লাল হয়ে গেল। আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল, ও তো এমনিই গম্ভীর, কারওর সঙ্গে কথা বলে না। আজ তুই এ বাড়িতে আসবার সময় তোকে কিছু বলেনি?

কিছু না।

শোন, সূর্যদাকে বলবি, আমাকে ভুলে যেতে।

বাঃ, এ আবার বলার কী আছে? এমনিতেই তো তোমাকে ভুলে গেছে। একদম ভুলে গেছে, সত্যি!

বড়দি হঠাৎ রেগে গেল। আমাকে একটা চাপড় মারার চেষ্টা করে বললে, তুই সব জানিস, না? পাকা ছেলে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *