আদালত থেকে ফিরে দোতলার গাড়ি বারান্দায় বসে চা পান করছিল যাদুগোপাল। প্রতিদিন এই সময় তার স্ত্রী তো বটেই, ছেলেমেয়ে দুটি, তাঁর বিধবা ভগিনী, এক দূর সম্পর্কের পিসিমা, পিসতুতে ভাই সবাই উপস্থিত থাকে। এই সময়টিতে পারিবারিক সম্মিলন হয়।
যাদুগোপাল এখন নামজাদা ব্যারিস্টার। যে-কোনও পেশাতেই যারা সার্থক হয়, তারা নিজের সংসারের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে পারে না। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয় কচিৎ। সকালে এবং সন্ধের পর যাদুগোপালকে চেম্বারে বসতে হয়, ক্রমেই মক্কেলদের ভিড় এমন বাড়ছে যে এক একদিন রাত এগারোটা বেজে যায়। তাই যাদুগোপাল বিকেলের এই সময়টায় বাইরের কাবাব সঙ্গে দেখা করে না। পরপর তিন কাপ চা খায়, তার স্ত্রী সুনেত্রা নিজের হাতে কিছু না কিছু খাবাব বানায়, যাদুগোপাল ছোট মেয়েটিকে কোলে বসিয়ে আদর করতে কবতে টুকিটাকি পারিবারিক কাহিনী শোনে। যাদুগোপালের এক সময় গান-বাজনার দিকে ঝোক ছিল, এখন একেবারেই সময় পায় না, তবে ছেলে আর মেয়েকে গান গাইবার উৎসাহ দেয়।
আর্দালি এসে একটা ভিজিটিং কার্ড দিতেই যাদুগোপাল ভুরু কোচকাল। এ সময় আবার কে এসে উৎপাত করে? যাদুগোপাল হাত নেড়ে বলতে যাচ্ছিল, না, না, এখন দেখা হবে না বলে দাও, তবু একবার নামটার ওপর চোখ বুলিয়ে থমকে গেল। এ যে তার কলেজের বন্ধু দ্বারিকা। সে বলল, বাবুটিকে বসিয়েছ তো, আমি এক্ষুনি আসছি।
আবার আর্দালিকে হাতের ইঙ্গিতে থামতে বলে সে সুনেত্রার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি তো আমার বন্ধু দ্বারিকাকে দেখেছ। তাকে এখানে আসতে বলি? তাকে বাইরের ঘরে বসিয়ে রাখাটা ভাল দেখায় না। আমাদের সঙ্গে এখানে বসে সে চা খাক!
সুনেত্রা ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যা, পুরোপুরি অন্তঃপুরিকা নয়; বাইরের লোকদের সঙ্গে মেলামেশার অভ্যেস আছে। সে সম্মতি জানাল। যাদুগোপাল তার পিসতুতো ভাইকে বলল, যা তো, ওঁকে ওপরে নিয়ে আয়।
দ্বারিকা সম্পর্কে যাদুগোপালের মনে একটা অপরাধবোধ আছে। মাস তিনেক আগে দ্বারিকার মাতৃবিয়োগ হয়েছে, দ্বারিকা নিজে এসে নেমন্তন্ন করে গেলেও যাদুগোপাল বন্ধুর মাতৃশ্রাদ্ধের দিন উপস্থিত হতে পারেনি। বিশেষ কাজে তাকে নাটোর যেতে হয়েছিল। তারপরেও যে একদিন দ্বারিকার সঙ্গে দেখা করে আসবে, আজ না কান্স করতে করতে যাওয়াই হয়ে ওঠেনি, কাজের এমনই চাপ। এটা একটা গর্হিত অসামাজিকতা। খাটি বন্ধু বলেই দ্বারিকা তবু নিজে থেকেই আবার এসেছে।
দ্বারিকাকে হঠাৎ চিনতে পারা যায় না। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বেশ বড় আকারের মানুষ, তার মাথায় ছিল বাবরি চুল ও নাকের নীচে পুরুষ্টু গোঁফ। শ্রাদ্ধের সময় মস্তক মুণ্ডন করতে হয়েছিল, এখন মাথাটি কদম ফুলের মতন। গোঁফটি অদৃশ্য। চোখে সে সদ্য সোনা ফ্রেমের চশমা নিয়েছে। চুনোট করা ধুতির ওপর জড়ির কাজ করা বেনিয়ান পরা, গলায় সোনার মফচেন। দু হাতের আঙুলে বেশ কয়েকটি মণি-মাণিক্যের আঙটি।
যাদুগোপাল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আয়, আয় দ্বারিকা, তোর কাছে আমি ক্ষমা চাইছি ভাই, তোর মাযেব কাজে আমি যেতে পাবিনি, সে জন্যে মবমে মরে আছি।
দ্বারিকা বলল, তুই তখন নাটোর গিয়েছিলি তা আমি শুনেছি। এ সময় উপস্থিত হয়ে ব্যাঘাত ঘটালাম না তো?
যাদুগোপাল বলল, মোটেই না, মোটেই না। বরং ভাল সময়ে এসেছিস। তুই আমাদের সঙ্গে চা-পান করবি তো।
দ্বারিকা বলল, চায়ে আমার কোনও সময়েই আপত্তি নেই।
যাদুগোপালেব পিসিমা, দিদি, অন্যান্যরা আস্তে আস্তে ভেতরে চলে গেল, ছেলে-মেয়েরাও থাকতে চাইল না। সুনেত্রা দ্বারিকাব সামনে প্লেট সাজিয়ে দিল, বিস্কিট, কাজু বাদাম, হ্যাম-স্যান্ডুইচ, বরফি। পোসিলিনের পেয়ালায় চা। দ্বারিকা বরাবরই ভোজন রসিক, সে অত খাদ্যদ্রব্য দেখে আপত্তি জানাল না। যাদুগোপাল সুনেত্রাকে বলল, ওকে হ্যাম-স্যান্ডুইচ দিয়ো না, শশার স্যান্ডুইচ বানিয়ে দাও বরং। দ্বারিকা মুখ তুলে বলল, কেন?
যাদুগোপাল বলল, কালার্শেীচ এক বছর থাকে না? এই এক বছর অন্যের বাড়িতে আমিষ ভক্ষণ কবতে নেই। তুই বুঝি এসব মানিস না?
দ্বারিক বলল, তুই একে ব্রাহ্ম, তায় বিলেত-ফেরতা ব্যারিস্টার, তুই এত জানিস, আমি তো জানিই না। এক বছর অনেক বাড়িতে আমিষ খেতে নেই, এটা কোন্ বইতে লেখা আছে রে?
যাদুগোপাল ইতস্তত করতে লাগল। এসব কোন বইতে লেখা থাকে সে ধর সে জানে না। তবে হিন্দুদের এই সব আচার-বিচার মানতে সে তো দেখে আসছে ছোটবেলা থেকে। দ্বারিকা কট্টর হিন্দু, পাছে এ বাড়িতে এসে তাকে আচারভ্রষ্ট হতে হয়, সেই জনাই যাদুগোপাল তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিল।
সমস্ত আহার্য পবিপাটিভাবে শেষ করে চায়ে চুমুক দিতে লাগল দ্বারিকা। যাদুগোপাল ভাবল, দ্বারিকা নিশ্চয়ই কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে। সে নিছক অলস জমিদার নয়। একটি পত্রিকা চালা, পাঁচটি স্কুল স্থাপন কবেছে, সম্প্রতি একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। তা ছাড়া আলও অনেক সামাজিক কর্মের সঙ্গে জড়িত। দ্বারিকাও বেশ ব্যস্ত মানুষ।
সুনেত্রার দিকে তাকিয়ে দ্বারিকা বলল, বড় তৃপ্তি পেলাম, বউঠান। আপনার হাতের চায়ের স্বাদ অপূর্ব।
সুনেত্রা জিজ্ঞেস করল, আর দু’খানা স্যান্ডুইচ আর বরফি দিই?
যাদুগোপাল বলল, দ্বারিকা, তোর মা চলে গেলেন, তাকে তো আমি দেখেছি, কী ব্যক্তিত্বময়ী ছিলেন, আমাদের কত যত্ন করে খাওয়াতেন, তিনি ছিলেন তোর মাথার ওপর… মায়ের স্থান আর কেউ নিতে পাবে না।
দ্বারিকা নিঃশব্দে মাথা নাড়তে লাগল।
যাদুগোপাল আবার বলল, শ্রাদ্ধে তুই যে বিরাট ধুমধাম করেছিস তা আমি শুনেছি। শহরের বহু লোক বলাবলি করেছে। একবার গ্রামের বাড়িতে, এবার কলকাতায়, পাঁচশো জন ব্রাহ্মণ আর দু’হাজার কাঙালিকে তুই বস্ত্র দান করেছিস, সবাই ধন্য ধন্য করেছে।
দ্বারিকা বলল, জমিদারদের এই সব আড়ম্বর করতেই হয়। জমিদারের রক্ত তো আমার শরীরে নেই, তুই তো জানিস, আমার বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে, কার্যগতিকে মামাদের জমিদারি পেয়ে গেছি। পাছে লোকে বলে আমি কৃপণ কিংবা জমিদারি আদপ কায়দা জানি না, তাই মায়ের শ্রাদ্ধে খরচ করেছি ঢালাও ভাবে। এসব লোক দেখানো ব্যাপার, নিজের মনের সায় ছিল না। এত অর্থ ব্যয়, এই অর্থ দিয়ে অনেক ভাল কাজ করা যেত।
যাদুগোপাল বলল, কিছু কিছু সামাজিকতা আর লোকাচার তো মানতেই হয়।
দ্বারিকা সুনেত্রাকে বলল, বউঠান, আপনার পতিদেবতাটি আমার বাল্যবন্ধু, তবু আমার সঙ্গে যান্ত্রিক ভদ্রতার সুরে কথা বলছেন কেন? মাতৃবিয়োগ, পিতৃবিয়োগ হলে সবাই ঠিক যেন একই ভাষায় সান্ত্বনা জানাতে আসে। এতে কি সান্ত্বনা সত্যিই পাওয়া যায়? আবার এমনও তো হতে পারে, জীবনের কোনও একটা সময়ে মা কিংবা বাবার মৃত্যু হলে কেউ কেউ খুশিও হতে পারে? আমার মা চলে গেছেন, তাতে আমি যেন একটা মুক্তির স্বাদ পেয়েছি। হ্যাঁ, সত্যি। মা আমাকে একটা অন্যায় শপথে বন্দি করে রেখেছিলেন।
সুনেত্রা ও যাদুগোপাল দুজনেই বেশ চমকে উঠল। দ্বারিকা বলল, মা চলে গেলে সকলেরই কষ্ট হয়। হঠাৎ সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগে, সে রকম অবশ্যই মনে হয়েছে। আমার মা দেড় বছর যাবৎ শয্যাশায়ী ছিলেন, শেষের দিকে বাকশক্তিও ছিল না, শুধু চেয়ে থাকতেন অসহায়ভাবে। কত যন্ত্রণা ভোগ করতেন কে জানে। সেবা-যত্নের কোনও ত্রুটি ছিল না, আমি নিজেও কত সময় শিয়রের কাছে বসে থেকেছি, তবু কি এক এক সময় মনে হয় না, এ রকম জীবনূতের মতন পড়ে থাকার চেয়ে মায়ের চলে যাওয়াই ভাল?
এই ধরনের কথার সম্মতি বা প্রতিবাদ দুটোই অসমীচীন। ওরা চুপ করে রইল।
ভেতরে ভেতরে কিঞ্চিৎ অস্থির বোধ করছে যাদুগোপাল। এক কালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এসেছে, তবু তার সঙ্গে প্রাণ খুলে গল্প করার সময় নেই। একটু পরেই মক্কেলরা আসতে শুরু করবে।
যাদুগোপাল জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে দ্বারিকা, তুই কি কোনও মামলা-মকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছিস? সম্পত্তির আর কোনও দাবিদার এসেছে?
দ্বারিকা বলল, হঠাৎ এ প্রশ্ন করলি কেন?
যাদুগোপাল লঘু স্বরে বলল, বন্ধুবান্ধবরা তো বিশেষ কেউ আর আসে না। সকলেই যে-যার কাজে ব্যস্ত। বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে যদি নিয়ে ঝাটে পড়ে, আমাকে জানালে… যথাসাধ্য সাহায্য করতে পারি… মানে, বন্ধুদের জন্য কিছু করতে পারলে ভাল লাগে।
দ্বারিকা বলল, বিষয়-সম্পত্তি থাকলেই তা নিয়ে খটাখটি লেগেই থাকে। আমার এমন কিছু ঘটেনি যার জনা তোর মতন বড় ব্যারিস্টারের সাহায্য চাওয়া যায়। না, আমি সে জন্য আসিনি।
যাদুগোপাল বলল, তোর ইরফানের কথা মনে আছে? আহা হা, কী যে বলছি আমি, তোর মনে থাকবে না কেন, তোর মানিকতলার বাড়িতেই তো সে ম্যানেজার ছিল! আমার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা। সেও একটা মামলার ব্যাপারে। বাগবাজারের দিকে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের একটা সম্পত্তি আছে। অনেক কাল ধরেই বেশ কয়েক ঘর মুসলমান সেই জমি ইজারা নিয়ে বাড়ি-ঘর বেঁধে আছে। সেখানে একটা মসজিদও তৈরি করেছে। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এখন সেই জমি থেকে ওদের উৎখাত করতে চান। ইরফানের কোনও এক আত্মীয়ের ইচ্ছে, ওদের পক্ষ নিয়ে আমি মামলাটা লড়ি। আমি ইরফানকে বললাম, হ্যাঁ রে, এরকম দরকারের সময় ছাড়া কি বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর দেখা করতে নেই?
দ্বারিকা বল, ইরফানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। সে নানা রকম ঝঞ্চাটের মধ্যে রয়েছে।
যাদুগোপাল বলল, একটা মজার কথা শোন, ইদানীং কয়েক বছর ধরে দেখছি আমার কাছে মুসলমান মক্কেল বেশি আসছে। মুসলমানদের মধ্যে উঁকি ব্যারিস্টারের সংখ্যা কম বটে, তবে ইদানীং ওমর আলি আর নুরুল হুদা বেশ নাম করেছে, বেশ পসারও জমিয়েছে। কিন্তু আমি মুসলমানদের মধ্যে হঠাৎ জনপ্রিয় হলাম কী করে? এখন বুঝেছি, ইরফানই ওই সব মক্কেলদের পাঠায় আমার কাছে। কয়েকটা শক্ত কেসে জিতে ওদের বিশ্বাস অর্জন করেছি। এর মধ্যে একটা মামলা নিয়ে খুব চক্ষুলজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম বুঝলি। ইরফানের পাঠানো মক্কেলদের একটা মামলা, চামড়া কেনা-বেচার দর নিয়ে বিরোধ, কেসটা টেক আপ করতে গিয়ে দেখি বিরুদ্ধ পক্ষে যারা রয়েছেন, তাঁদের একজনের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কে বুঝলি তো? কবি রবীন্দ্রবাবু! আমরা ছাত্র বয়েস থেকে তার কবিতা পড়ছি, হেমবাবু-নবীনবাবুর চেয়ে রবীন্দ্রবাবুর কবিতা বেশি ভাল লাগে, গোটা কতক মুখস্থও বলতে পারি, সেই রবীন্দ্রবাবুর বিরুদ্ধে আমি মামলা লড়ব? ভেবে দ্যাখ কী কাণ্ড! তা ছাড়া, ঠাকুরবাড়ির ওঁরা আমার কুটুম্ব হন। আমার স্ত্রীর মুখ ভার। শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষকে ডেকে আদালতের বাইরে মিউচুয়াল সেটেলমেন্ট হল।
বিশ্রম্ভালাপে এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে চলে যাওয়া যায় অনায়াসে। যাদুগোপালই বেশি কথা বলছে, দ্বারিকা হুঁ-হাঁ দিয়ে যাচ্ছে শুধু। দ্বারিকার ওঠার লক্ষণও নেই।
এক সময় দ্বারিকা বলল, যাদু, এখানে এসে যখন দেখলাম, তুই তোর একটি সন্তানকে কোলে বসিয়ে আদর করছিস, তোর বউ নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করছেন, আত্মীয়-পরিজন নিয়ে ভরা সংসার, দেখে আমার যেমন ভাল লাগল, তেমন একটু একটু হিংসেও হল। আমার আজও কোনও সংসার নেই।
যাদুগোপাল বলল, আ-হা-হা, এ কথার কোনও মানে হয়। তুই তো শখের বিবাগী। এতদিনেও বিয়ে করলি মা।
সুনেত্রার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দ্বারিকা বলল, এবারে বিবাহ করব মনস্থ করেছি। সেই কথাই জানাতে এসেছি তোকে। কিছু পরামর্শও চাই।
যাদুগোপাল উৎসাহিত হয়ে বলল, তাই নাকি, তাই নাকি! অতি সুসংবাদ। দিন-ক্ষণ স্থির করে ফেলেছিস? কিন্তু, কিন্তু, এই সেদিন জননী চলে গেলেন, কালার্শেীচ, এক বছরের মধ্যে তো বিয়ে করা চলে না।
দ্বারিকা জিজ্ঞেস করল, তাই নাকি? আমাদের কোন শাস্ত্রে এমন বিধি-নিষেধ লেখা আছে বল তো? অনেকের মুখেই এই কথাটা শুনি। কিন্তু কেউ কোনও শাস্ত্রের নাম বলতে পারে না।
যাদুগোপাল বলল, শাস্ত্রের নাম আমিও বলতে পারব না। বরাবরই এরকম শুনে আসছি। মনুসংহিতাখানা একবাব উল্টে দেখা যেতে পারে।
দ্বারিকা বলল, মনুসংহিতা মেনে কি হিন্দু সমাজের সব কিছু চলে এখন? ঘোড়ায় টানা ট্রাম গাড়িতে এক বামুনের পাশে যদি এক প্যান্ট কোট পরা চাড়াল এসে বসে, দু’জনের ছোওয়া-ছুয়ি হয়ে যায়, সে বিষয়ে মনুসংহিতাকারের কোনও বক্তব্য আছে?
যাদুগোপাল বলল, দ্বারিকা, তোর মুখে এ সব কথা শুনে খুব আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। আমি জাত-বিচার মানি না। কিন্তু তুই তো ছিলি কট্টর হিন্দু।
দ্বারিকা বলল, আমি হিন্দ ছিলাম, এখনও আছি। সকলের সামনে গড়িয়ে সগর্বে বলতে পারি, আমি হিন্দু। ভারতের এই চিরাচরিত মহানধর্মের আমি উত্তরাধিকারী। কিন্তু হিন্দুধর্মের কোথাও যা নেই, সেই সব কুসংস্থব ও লোকাচার আমাকে মানতে হবে কেন? এমনকী কোনও শাস্ত্র গ্রন্থে যদি এমন কিছু থাকেও, যা একালের উপযোগী নয়, বরং ঘৃণ্য এবং পরিত্যাজ্য, যেমন জাত-পাতের বিচার, সেগুলোও বদলাতে চাইব।
যাদুগোপাল বলল, অতি সাধু প্রস্তাব, কিন্তু এখন ওসব কথা থাক। পাত্রী নির্বাচন হয়ে গেছে। কোন পরিবারের কন্যা?
দ্বারিকা বলল, এ বিষয়ে অনেক কথা আছে। তোর স্ত্রীর সামনে বলতে সংকোচ বোধ করছি। নীচে গিয়ে বসলে হয় না?
সুনেত্রা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, না, আপনারা এখানেই বসুন।
যাদুগোপাল সুনেত্রাকে বলল, না, না, তুমিও বসো। দ্বারিকা, আমার স্ত্রী যথেষ্ট সাবালিকা, তার সামনে গোপন করার কিছুই নেই। বিয়ের ব্যাপার, মেয়েদের মতামত পেলে ভালই হবে। তুই বল।
দ্বারিকা একটু ইতস্তত করে মৃদু গলায় বলল, বউঠান, এই যাদুর মামাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েই এক সময় একটি কিশোরীকে আমার পছন্দ হয়েছিল। আমি তাকে বিবাহ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার বাবা ছিল এক অর্থপিশাচ ব্রাহ্মণ। টাকার বিনিময়ে সে সেই মেয়েটির বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল এক শ্মশানযাত্রী বুড়োর সঙ্গে। আমার প্রস্তাব কিছুতেই মানল না।
যাদুগোপাল বাধা দিয়ে বলল, আমার দিদিমাকে তো তুমি দেখেছ, সুনেত্রা, দারুণ তেজী মহিলা ছিলেন, তিনি নিজে সেই বুড়োর সঙ্গে বিয়ে ভেঙে দ্বারিকার সঙ্গে মেয়েটির যাতে বিয়ে হয়, সেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাও শেষ পর্যন্তু হল না। মেয়ের বাবা হরমোহন ভটচাজ রটিয়ে দিল যে দ্বারিকারা ভঙ্গ কুলীন, এই বিয়ে হলে তাদের জাত যাবে।
দ্বারিকা বলল, ভঙ্গ কুলীন টুলিন আসল কারণ নয়। আসল কারণ হল টাকা। আমি তখনও জমিদারির মালিক হইনি, সে রকম সুদূর সম্ভাবনাও ছিল না। আমার মায়ের মামাতো ভাইরা পরপর তিনজন কলেরায় মারা না-গেলে এ জমিদারি আমার পাবার কথা ছিল না। তখন আমি ছিলাম গরিব গৃহস্থের সন্তান, গাদা গুচ্ছে পণের টাকা দেবার সামর্থ্য ছিল না, মেয়ের বাপ সেই জন্যই আমাকে পছন্দ করেনি।
যাদুগোপাল বলল, বড় ভাল মেয়ে, আমাদের বাড়িতে খেলা করতে আসত, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের থেকে একেবারে আলাদা। বিয়ের পর বছর ঘুরল না, সেই ফুলের মতন নিস্পাপ মেয়ে বিধবা হল, তারপর কারা যেন তাকে লুট করে নিয়ে গেল।
দ্বারিকা বলল, সে একেবারে হারিয়ে যায়নি। আমি পরে তাকে আবার খুঁজে পেয়েছি। বউবাজারের একটা ভাড়া বাড়িতে সে থাকে। তার নাম এখন বসন্তমঞ্জরী।
সুনেত্রা বলল, এই বসন্তমঞ্জরীর কথা আমি ওঁর কাছে শুনেছি।
দ্বারিকা বলল, খুঁজে পাওয়ার পরই আমি ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। বিধবা বিবাহে এখন কোনও বাধা নেই। কিন্তু আমার মা বেঁকে বসেছিলেন প্রচণ্ডভাবে। এই মেয়েকে বিয়ে করলে তিনি আত্মঘাতিনী হবেন এই ভয় দেখিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন আমাকে দিয়ে। মা এখন আর নেই। সেই শপথের দায় থেকে আমি মুক্ত। এবারে বসন্তমঞ্জরীকে আমি সানন্দে বিয়ে করতে পারি।
যাদুগোপাল বলে ফেলল, সর্বনাশ!
দ্বারিকা চমকে উঠে বলল, সে কী, তুই সমর্থন করবি না?
যাদুগোপাল বলল, দ্বারিকা, তুই সাধারণ ঘরের ছেলে হলেও তোর মায়ের সঙ্গে জমিদার বংশের সম্পর্ক ছিল। তিনি বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী রমণী ছিলেন। তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন, জমিদারের পক্ষে কিছু কিছু বাহ্যিক চালচলন মেনে চলতেই হয়। জমিদারের পক্ষে একটা কেন পাঁচটা রক্ষিতা থাকলেও দোষ নেই, কিন্তু কোনও নষ্ট, পতিতাকে স্ত্রীর সম্মান দিয়ে গৃহিণীর পদে বসালে সমাজ তা মেনে নেবে না, প্রজারা ছি ছি করবে!
দ্বারিকা ধমকের সুরে বলল, বসন্তমঞ্জরী নষ্টও নয়, পতিতাও নয়!
যাদুগোপাল বলল, তুই কিংবা আমি তা মানলেও আর পাঁচজন তা মানবে কেন? বিধবা হবার পর দুতিন হাত ঘুরে সে হাড়কাটার গলিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, সুতরাং সমাজের চোখে সে পতিত। তুই হঠাৎ এরকম হঠকারিতা করতে গেলে বিরাট গোলমালের সৃষ্টি হবে। তুই বরং এক কাজ কর না। আমাদের বাসন্তীকে তুই যেমন দেখাশুনো করছিস, ওর কাছে যাওয়া-আসা করিস, সে রকম চলুক। তুই অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে কর। তাতে তোর বংশ রক্ষা হবে।
দ্বারিকা বলল, বাঃ, কী চমৎকার প্রস্তাব! আর একটি নির্দোষ মেয়ে, তাকে আমি বিয়ে করব কিন্তু তাকে আমি স্ত্রীর মর্যাদা দেব না, আর একটি নিরপরাধ মেয়ে, যে-তার বাপ-মায়ের দোষে খারাপ অবস্থায় পড়েছে, যাকে আমি সত্যি সত্যি নিজের স্ত্রী মনে করি, সে পাবে না স্ত্রীর অধিকার। আ-হা-হা, কী তোদের অদ্ভুত বিচার!
যাদুগোপাল বলল, তুই আমাকে ধমকাচ্ছিস কেন? এসব তত তোদের হিন্দু সমাজের ব্যাপার। মামলা-মকদ্দমা চালাবার জন্য আমাকে এসব জানতে হয়। আমাদের সমাজে এসব কিছু নেই। তোকে তো তোদের সমাজের রীতিনীতি মানতেই হবে, তাই বলছিলাম।
দ্বারিকা ভুরু তুলে বলল, ও, তোদর ব্রাহ্মরা বুঝি সবাই ধোয়া তুলসি পাতা? সবাই বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকে?
সুনেত্রা ফিক করে হেসে ফেলে বলল, যা বলেছেন।
দ্বারিকা বলল, হিন্দুত্ব নিয়ে আমার গর্ব আছে। তবে, যে-মানুষ নিজের ধর্মের দোষ-ত্রুটি সংশোধন কলাব চেষ্টা না করে, সে নিজের ধর্মকে ভালবাসে না! ধর্ম মানে তো কতকগুলি সংস্কারের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস নয়। বাপ-মায়ের দোষে যদি একটি মেয়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে, তবু যে সমাজ সেই মেয়েটিকে শাস্তি দিতে চায়, চিরকালের জন্য তাকে নরকে ঠেলে দেয়, তা হলে সেটা আবার কোনও সমাড় নাকি? সে সমাজ গোল্লায় যাক! সমাজের নির্দেশ আমি মানব না, তবু আমি হিন্দুই থাকব।
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে দ্বারিকা বলল, যাক, বোঝা গেল, আমার এ বিয়েতে তোর সমর্থন নেই। তবু বসন্তমঞ্জরীকে এবাব আমি বিয়ে করবই।
যাদুগোপাল সচকিত হয়ে বলল, সে কথা আমি বললাম কখন? আমার আপত্তি থাকবে কেন? তুই বিপদে পড়তে পাবিস, সে কথাই আমি ভাবছিলাম।
দ্বারিকা বলল, আমি কোনও বিপদ গ্রাহ্য করি না।
সুনেত্রা বলল, আমার কিন্তু খুব ভাল লাগছে আপনার কথা শুনে। রক্ষিত রাখলে সমাজ আপত্তি করে না। চোখ বুজে থাকে, অথচ সে মেয়েটিকে বিয়ে করতে গেলে সমাজ দাত কিড়মিড় করে তেড়ে আসে, এ আবার কেমন কথা!
যাদুগোপাল বলল, দ্বারিকা, তোকে আমি আগে যেমন দেখেছি, তার থেকে তোর যেন অনেক বদল ঘটে গেছে। তুই যখন বদ্ধপরিকর হয়েছিস, তোর সাহসও আছে, তখন একটা টস্ট কেস হিসেবে এটা দেখা যেতে পারে। বিয়ে হয় একজন পুরুষের সঙ্গে একজন রমণীর, তাদের যদি পুবশবেব সম্মতি থাকে, তা হলে সমাজ সেখানে মাথা গলাতে আসবে কেন?
হয়তো গোপনে গোপনে আগে হয়েছে, কিন্তু তুই যা প্রকাশ্যে কবতে যাচ্ছিস, স্মরণ কালের মধ্যে সে। বকম ব্যাপার ঘটেনি। একটা দারুণ শোরগোল পড়ে যাবেই। যদি আইনগত কোনও বাধা আসে, আমি অবশ্যই তোর পাশে থাকব, সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যাব। সামাজিক বাধাটা তোকে সামলাতে হবে।
দ্বারিকা বলল, কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না। তবু বন্ধুরা আমার পাশে থাকবে, এটাই শুধু চাই। পুনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। হ্যাঁ রে, ভরত ছোড়াটা এখন কোথায় থাকে বলতে পাবিস?
যাদুগোপাল বলল, কী জানি, বহুদিন তার কোনও পাত্তা নেই। তবে ভূমিসূতার সন্ধান পেয়েছি, আমাদের বাড়িতে সে কয়েকটা দিন কাটিয়েও গেছে।
দ্বারিকা জিজ্ঞেস করল, ভূমিসূতা কে?
যাদুগোপাল বলল, ভরত যখন ভবানীপুরে ছিল, সেই বাড়িতে ওই নামে একটি মেয়ে থাকত, তোর মনে নেই? ভাগ্যচক্রের অদ্ভুত পরিবর্তনে সে এখন থিয়েটারের নাম করা অভিনেত্রী। সেও অবশ্য ভারতের সন্ধান জানে না।
দ্বারিকা বলল, আমার বিয়েতে মাঠে ম্যারাপ বেঁধে, রোশন চৌকি বসিয়ে বিরাট একটা ভোজ দেব। শহরের মাথা মাথা লোকদের নেমন্তন্ন করব, যাতে কেউ মনে না করে আমি চুপিসাড়ে এই বিয়ে করছি। সে সময় ওই মেয়েটিকেও ডাকতে হবে। ভরতটা এমন নিমক হারাম, একটা চিঠি পর্যন্ত লেখে না!
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে জুড়ি গাড়িতে উঠতে যাবার আগে যাদুগোপালের দু’হাত জড়িয়ে ধরে দ্বারিকা বলল, তোর কথায় আমি যে কতখানি ভরসা পেলাম। যাদু, তোর স্ত্রীর সামনে আমি একটা কথা বলতে পারিনি। বসন্তমঞ্জরীকে আমি ছেড়ে থাকতে পারি না, সে আমার প্রাণাধিক কিন্তু সে যে আমায় কত কষ্ট দিয়েছে, তুই কল্পনাও করতে পারবি না। আমি প্রায় প্রতিদিনই তার কাছে যাই, তার ঘরে রাত্রিবাস করি, এক শয্যায় শুই, কিন্তু এতগুলি বছর গেল, আমরা একদিনের জন্যও উপগত হইনি। বসন্তমঞ্জরী কিছুতেই রাজি নয়। আমাদের মিলনে যদি কোনও সন্তান জন্মায়, সে হবে বেজন্মা, সে পিতৃপরিচয় পাবে না। এই কথা ভেবেই ওর আপত্তি। পৃথিবীতে ও এমন কোনও শিশুকে আনতে চায় না, যার জন্মের সঙ্গে জড়ানো থাকবে অপমান। এক বিছানায় শোওয়া, পাশে প্রিয় নারী, অথচ তাকে গ্রহণ করা যাবে না, এ যে কী যাতনা, কী কষ্ট, তুই বুঝবি না!
যাদুগোপাল মৃদু স্বরে বলল, এ মেয়ে যদি সতী না হয়, তা হলে জগতে সতী কে?
দ্বারিকার এই জেদি পরিকল্পনায় এক দারুণ বাধা এল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিক থেকে। বসন্তমঞ্জরী নিজেই এ বিয়েতে রাজি নয়।
দ্বারিকার একটা ভুল হয়েছিল, সে অনেকখানি প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল বসন্তমঞ্জরীকে কিছু না জানিয়েই। সে ভেবেছিল একেবারে বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে এনে তা দেখিয়ে বসন্তমঞ্জরীকে অবাক করে দেবে। সে ধরেই নিয়েছিল, বসন্তমঞ্জরী চমকিত তো হবেই, খুশির জ্যোৎস্নায় তার মুখখানি উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
কিন্তু নিমন্ত্রণপত্র তৈরি হবার আগেই সংবাদটা বসন্তমঞ্জরীর কানে পৌঁছে গেল। মুফি নামে তার দাসীর সঙ্গে বাবুর কোচোয়ানের বেশ ভাব। সেই কোচোয়ানের মুখেই মুফি জানতে পারল যে বাবুর বাড়িতে বিবাহের প্রস্তুতি চলছে। মুফি সঙ্গে সঙ্গে সে খবর জানিয়ে দিল বসন্তমঞ্জরীকে।
বসন্তমঞ্জরী সত্যিই খুশি হল। এই সংবাদ এনে দেবার জন্য সে মুফিকে পুরস্কার দিল দূটি টাকা। সেই সন্ধ্যায় দ্বারিকা আসার পর বসন্তমঞ্জরী তার পায়ের কাছে বসে হাসি মুখে বলল, হা গো, তুমি নাকি বিয়ে করছ? যাক, এতদিনে তোমার সুমতি হয়েছে। আমি তো তোমায় আগে কতবার বলেছি। তোমার মা বেঁচে থাকতে থাকতে কেন করলে না, উনি কত আনন্দ পেতেন। নাতি-নাতনির মুখ দেখে শান্তিতে স্বর্গে যেতে পারতেন। যাক, তবু তো বংশের মুখ রক্ষে হবে। তুমি আমার একটা কথা রাখবে? তোমার বিয়ের বাসরে তো আমার যাওয়া হবে না, কিন্তু মালা বদলের দুখানা মালা আমি গেঁথে দেব, সে দুটি মালা তোমরা পরবে বলো!
দ্বারিকা হা-হা করে হেসে উঠল। তারপর রঙ্গ করে বলল, আমার বিয়ের আসরে তোমার যাওয়া হবে না? তা হলে আমার বিয়েই হবে না!
বসন্তমঞ্জরী বলল, যাঃ, সে আবার কী কথা। না, না, তুমি আমার কথা কিছু ভেব না। বিয়ে বাড়িতে আমাদের যেতে নেই, তাতে অমঙ্গল হয়। আমি তোমাদের জনা মালা গেঁথে দেব, সেই মালা তোমরা গলায় দেবে, তাতেই আমার আনন্দ হবে।
স্বারিকা ঝুঁকে এসে বসন্তমঞ্জরীর একখানি হাত ধরে বলল, সত্যি যে, সত্যি কথা বলছি। বাসি, তুই না গেলে আমার বিয়ে হবে কী করে? আমি যে তোকেই বিয়ে করব।
বসমঞ্জরী চোখ কুঞ্চিত করে বলল, অমন অলক্ষুণে কথা বল না। আমার সঙ্গে তোমার যা হবার তা তো হয়েই গেছে!
দ্বারিকা বলল, বাসি, তুই কি ভাবছিলি, আমি গোপনে গোপনে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করবার ব্যবস্থায় মেতেছিলাম? আমি বুঝি এমন ফেরেপবাজ? এবার তুই আমার স্ত্রী হবি। তুই তো জানিস, মায়ের কাছে আমার শপথ ছিল। মা নেই, সে শপথেরও ইতি হয়ে গেছে।
বসন্তমঞ্জরীর মুখখানি ম্লান হয়ে গেল। খুব আস্তে আস্তে সে বলল, মানুষ মরে গেলেই সব কিছু শেষ হয়ে যায়? তিনি কি ওপর থেকে সব দেখতে পাচ্ছেন না?
উঠে দাঁড়িয়ে বসপ্তমঞ্জরী চলে গেল জানালার ধারে। সে সাজগোজ কতে ভালবাসে। আজও পরে আছে একটি রক্তবর্ণ রেশমি শাড়ি, খোপায় সাদা রঙের ফুল, পায়ে রুপোর মল। তার মুখমণ্ডল বিষাদে ভরে গেছে। আপনমনে সে বলতে লাগল, তোমার বউ হব, সে ভাগ্য করে আমি আসিনি। সে জন্য আমার মনে কোনও খেদও নেই। তুমি আমায় অনেক কিছু দিয়েছ, আমিও সাধ্যমতন তুমি গান ভালবাস, আমি তোমাকে গান শোনাই, তোমার গেলাসে মদ ঢেলে দিই, এক একদিন মনের আনন্দে নাচি, এই তো বেশ, আর কিছু চাই না। তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করো, তোমার বংশ রক্ষা হোক।
দ্বারিকা উঠে এসে বসন্তমঞ্জরীর দুই কাঁধ ধরে বলল, বাসি, আমি তোর ওপর কখনও জোব করিনি। মাতাল হয়ে দাপাদাপি করেছি, তবু তোর অনিচ্ছের জন্য তোর গায়ে হাত দিইনি। কিন্তু এবার আমি জোর করব। পুরুত ডেকে, মন্ত্র পড়ে আমি বিয়ে করব তোকে। দেখি কে আমাদের বাধা দিতে পারে। অনেকখানি ব্যবস্থা হয়ে গেছে, এখন তুই এমন কথা কেন বলছিস! এখন বিয়ে বন্ধ হয়ে গেলে লোকে হাসবে, সবাই বলবে, আমিই বুঝি ভয়ে পিছিয়ে গেলাম শেষ পর্যন্ত।
বসন্তমঞ্জরী মুখ ফিরিয়ে বলল, তুমি অনেককে জানিয়ে দিয়েছ, শুধু আমায় জানাওনি। তোমার জদ বজায় বাখার জন্যই তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও!
দ্বারিকা বলল, সে জন্য কেন হবে? আমি তোকে চাই, তোকে কতখানি চাই, তা কি তুই জানিস না।
বসন্তমঞ্জরী বলল, তুমি পিছিয়ে গেলে লোকে হাসবে। আর আমি রাজি হলে লোকে আমার সম্পর্কে কী বলবে? সবাই বলবে, আমি একটা লোভী পাপীয়সী, নরকে থেকে স্বর্গের দিকে হাত বাড়াচ্ছি। আমি একটা নষ্ট মেয়েমানুষ, মোহিনী মায়া দিয়ে একজন পুরুষের মাথা খেয়েছি, ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে বিয়ে কবতে রাজি কবিয়েছি, যার মা মারা গেছেন মাত্র কয়েক মাস আগে, এখনও বছর পেরোনি। ছি ছি ছি, এমন কাজ আমায় করতে বোলো না।
দ্বারিক কম্পিত গলায় বলল, বাসি, লোকে কী বলল আর কী ভাবল, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমবা কেন ওসব গ্রাহ্য করব। তোর গর্ভের সন্তানই হবে আমার বংশধর।
বসন্তমঞ্জরী জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। সদ্য সুর্যাস্তের আকাশে এখনও লাল রঙের আভা। এদিকে ওদিকে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। একটুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে সে বলল, আকাশে কোথাও আমার বিয়ের কথা লেখা নেই।
তারপর সে মুখ ফেল ঘরের একটা সাদা দেওয়ালের দিকে। এমনভাবে সে একদৃষ্টিতে চেয়ে বইল সেদিকে, যেন নগ্ন দেওল নয়, সে দেখছে একটি দর্পণ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, দেওয়ালেও কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ওগো, আমাদের মতন মেয়েদের আর বিয়ে হয় না, হতে নেই।
হু হু করে কান্না বেরিয়ে এল তার দু’চক্ষু দিয়ে।
দ্বারিকা তবু দৃঢ় স্বরে বলল, আমরা ভবিতব্যের কথাও চিন্তা করব না। বাসি, মুখ তোল, একবার আমার দিকে চেয়ে দেখ, আমার বুকে কী আগুন জ্বলছে দেখতে পাচ্ছিস না? যদি একদিনের জন্যও হয়, তুই সে আগুনে ঝাঁপ দিবি না? জোর করে নয়, গোপনে গোপনে নয়, পাপবোধ নিয়েও নয়, আমি সসম্মানে তোকে চাই!