২৩. শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩)
মধ্যযুগে মুসলমানরাই ছিলেন এ দেশের শাসক। ইসলাম ছিল রাজধর্ম। ইসলাম ধর্ম ছিল উন্মুক্ত। ধর্মের মধ্যে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ, জাতিভেদ ছিল না। মসজিদে ছিল সকলের প্রবেশাধিকার। মক্তব-মাদ্রাসায় যে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত।
অপরদিকে হিন্দুসমাজ ছিল একেবারে বিপরীত। ধর্মের এক অচলায়তন। জাতিবেদ আর সংকীর্ণ গোঁড়ামিতে সমস্ত সমাজ শতবিভক্ত। শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব, সৌর, ব্রাহ্মণ সকলেই অন্যের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। পরস্পরের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ আর ঘৃণা। মন্দির, পূজামণ্ডপের দ্বার শুধু মাত্র উচ্চবর্ণের মানুষদের জন্যেই উন্মুক্ত। সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষের কোন স্থান নেই সেখানে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনে কোন সুখ ছিল না, শান্তি ছিল না। হিন্দুদের উপর চলত সুলতানী সৈন্যদের অত্যাচার। লুঠতরাজ ছিল সাধারণ ঘটনা। সুন্দরী মেয়েদের উপর ছিল না তার। সমাজ তাকে রক্ষা করত না শাস্তি দিতে দ্বিধা করত না।
জীবনের সর্বস্তরে ছিল হাজার ছাত্মার্গের বেড়াজাল। ব্রাহ্মণদের জন্যেই শুধু ছিল শিখার সুযোগ। তাদের প্রবল প্রতাপে অতিষ্ঠ হয়ে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষ দলে দলে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। হিন্দু সমাজের এই সর্বনাশা অবক্ষয়ের যুগে শ্রীচৈতন্যর আবির্ভাব।
১৪৮৬ খৃস্টাব্দের ১৯ শে ফেব্রুয়ারি। বাংলা ফাল্গুন মাসের দোলপূর্ণিমা। সেদিন ছিল চন্দ্রগ্রহণ। নবদ্বীপের মায়াপুর পল্লীতে নিমাইয়ের জন্ম হল। পিতা জগন্নাথ মিশ্র, মাতা শচীনদেবী। সেই সময় দাদা বিশ্বরূপের বয়স ছিল দশ। ছেলেবেলা থেকেই বিশ্বরূপ ছিলেন শান্ত, সংসারের প্রতি উদাসীন। মাত্র ষোল বছর বয়েসে সংসারের সব বন্ধন ছিন্ন করে সন্ন্যাস নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আর তাঁর কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি।
জ্যেষ্ঠপুত্রের এই বিচ্ছেদ ব্যথা কিছুতেই ভুলতে পারেন না জগন্নাথ মিশ্র। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। বালক পুত্রকে নিয়ে সংসারের সব ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন শচী দেবী।
বালক নিমাই ভর্তি হলেন গঙ্গাদাস পণ্ডিতের চতুম্পাঠীতে। যেমন মেধাবী তেমনি চঞ্চল। কৈশোর উত্তীর্ণ হতেই হয়ে উঠলেন। নানা শাস্ত্রে সুপণ্ডিত। কিন্তু যেমন তার্কিক তেমনি অহংকারী। কূট প্রশ্ন তুলে মানুষকে বিব্রত করতে আনন্দ পেতেন।
সংসারে অভাব অনটন, তাই নিজেই টোল স্থাপন করলেন নিমাই পণ্ডিত। তার খ্যাতি আর পাণ্ডিত্যের আকর্ষণে অল্প দিনেই টোল ভরে উঠল। পুত্রকে উপার্জনক্ষম দেখে শচীমাতা লক্ষ্মী নামে সুলক্ষণা এক কন্যার সাথে তার বিবাহ দিলেন।
এই সময় কেশব নামে কাশ্মীরের এক পণ্ডিত বিভিন্ন স্থানের পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে নবদ্বীপে এলেন। তার পাণ্ডিত্যের কথা শুনে স্থানীয় কোন পণ্ডিতই তার সাথে বিচারে অবতীর্ণ হতে সাহসী হলেন না। অবশেষে কেবশ নিমাই পণ্ডিতের দর্শন পেয়ে তাঁকেই বিচারে আহ্বান করলেন। কেশব মুখে মুখে গঙ্গার স্তব রচনা করলেন। সকলে মুগ্ধ। কিন্তু নিমাই প্রতিটি শ্লোকের অশুদ্ধি আর অপপ্রয়োগ নির্ণয় করে কেশবকে পরাজিত করলেন। নিমাইয়ের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
কিছুদিনের জন্য পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে গেলেন নিমাই। সেখানে যথেষ্ট খ্যাতি সম্মান অর্থ পেলেন। নবদ্বীপে ফিরে এসে এক বেদানাদায়ক সংবাদ পেলেন। স্ত্রী লক্ষ্মী সাপের কামড়ে মারা গিয়েছে। শোকের আবেগটা স্তিমিত হয়ে আসতেই শচীদেবী পুনরায় নিমাইয়ের বিবাহের ব্যবস্থা করলেন। কন্যার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
পিতা জগন্নাথ মিশ্র বহুদিন মারা গিয়েছেন। তাঁর পিণ্ডদান করতে গয়ায় গেলেন নিমাই। সেখানে বিষ্ণুপাদপদ্ম দেখে তার মধ্যে জেগে উঠল এক পরিবর্তন। চঞ্চল উদ্ধত অহংকারী নিমাই চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন। তার মধ্যে জন্ম নিল কৃষ্ণ অনুরাগী এক প্রেমিক সাধক। দিন রাত শুধু কৃষ্ণের বিরহে ব্যাকুল। যা কিছু দেখেন তাকেই কৃষ্ণ বলে আলিঙ্গন করেন। তার এই আকুলতা দেখে সকলে বিস্মিত। এতো পরম সাধকের লক্ষণ।
টোলে অধ্যাপনায় আর কোন আগ্রহ নেই। সামনে খোলা পুথি পড়ে থাকে। ছাত্ররা কলরব করতে থাকে। নিমাই তাদের নিয়ে নামকীর্তন আরম্ভ করেন। এক এক সময় ভাবে বিভোর হয়ে যান। বাহ্য জ্ঞান থাকে না। তার এই অপ্রকৃতিস্থ ভাব দেখে শচীদেবী, বিষ্ণুপ্রিয়া ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
সেই সময় বৈষ্ণবদের সমাজে তেমন কোন প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল না। সংখ্যাতেও তারা ছিল নগণ্য। নিমাইকে পেয়ে বৈষ্ণব সমাজের বুকে যেন প্রাণের জোয়ার বয়ে যায়।
অদ্বৈত আচার্য ছিলেন বৈষ্ণব সমাজের প্রধান। জ্ঞান ভক্তিতে তার কোন তুলনা ছিল না। নিমাইকে দেখা মাত্রই তার মনে হল মানব যেন তার আরাধ্য দেবতার আবির্ভাব ঘটেছে। এতদিন তিনি যেন এই মানুষটিরই প্রতীক্ষা করছিলেন। বৃদ্ধ দ্বৈত পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে নিমাইকে বরণ করে নিলেন। সমস্ত বৈষ্ণব সমাজ তাকে নেতা হিসেবে স্বীকার করে নিল।
একদিন নগর কীর্তন করতে করতে নিমাই এসে পড়লেন নন্দন আচার্যের গৃহে। সেখানে ছিলেন সুদর্শন এক অবধূত। বয়সে, তরুণ, মুখে স্নিগ্ধ ভাব, নাম নিত্যানন্দ। নিত্যানন্দের জন্ম রাঢ় অঞ্চলের একচাকা গ্রামে। বাবার নাম হাড়াই ওঝা। মায়ের নাম পদ্মাবতী। এঁরা ছিলেন রাঢ়ীয় শ্রেণীর ব্রাহ্মণনি বৃন্দাবন থেকে বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করতে করতে এলেন নবদ্বীপে। নিমাইয়ের দর্শন পেতেই আকৃষ্ট হলেন তাঁর প্রতি। তিনি হয়ে উঠলেন নিমাইয়ের প্রধান পার্ষদ।
শ্রীবাসের গৃহপ্রাঙ্গণে চলে নিত্যদিন নামগান আর কীর্তন। সেখানেই শুধুমাত্র গৃহপ্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সর্ব মানুষের দ্বারে দ্বারে। তিনি নামগান করার ভার দিলেন তার দুই প্রধান ভক্ত নিত্যানন্দ আর যবন হরিদাসকে। একজন হিন্দু অন্যজন মুসলমান। সেই যুগে এ এক দুঃসাহসিক কাজ। সমস্ত ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে একজন মুসলমানকে দিয়ে বৈষ্ণবধর্মের প্রচার-মধ্যযুগে এ ছিল কল্পনীয়।
নগরের পথে পথে ঘুরে ঘুরে তারা কীর্তন করতনে। অনেকে ভাবরসে আপ্লুত হয়ে তাদের সঙ্গী হত। অনেকে বিদ্রূপ করত, উপহাস করত। বিশেষত ব্রাহ্মণ সমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকে। নীচ ধর্মের মানুষেরা যদি এভাবে অপর সকলের সাথে সমমর্যাদা পায় তবে যে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি রসাতলে যাবে। জগাই আর মধ্যেই নামে দুই পাপাচারী ব্রাহ্মণ, যারা সকল পাপকর্মে সিদ্ধ, তারেদ প্ররোচিত করে। একদিন নগরের পথে নামগান করছেন নিমাই আর নিত্যানন্দ। মদ্যপ অবস্থায় দুই ভাই নামকীর্তন বন্ধ করার জন্য চিৎকার করে ওঠে। আত্মহারা নিমাইয়ের কোন কথাই কানে যায় না। রাগেতে মাধাই কলসীর ভাঙা টুকরো তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারে। নিত্যানন্দের মাথায় এসে আঘাত লাগে। অঝোরে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ে। সেই দৃশ্য দেখে ক্রদ্ধ হয়ে ওঠেন নিমাই। তার সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে বহু কষ্টে শান্ত করান নিত্যানন্দ। দুই ভাই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতাপে লজ্জায় শিষ্যত্ব গ্রহন করেন নিমাইয়ের। জয় হয় প্রেমধর্মের।
এই ঘটনা নবদ্বীপের মানুষের মনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। চারদিকে বেড়ে চলে সমবেত কীর্তন আর নামগান। তখন বাংলার সুলতান ছিলেন হোসেন শাহ। বৈষ্ণবদের এই ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ভাল চোখে দেখলেন না। তাছাড়া কিছু গোড়া মুসলমানও এর বিরুদ্ধে নালিশ জানাল। চাঁদ কাজী প্রকাশ্য পথে সমবেত কীর্তন বন্ধ করার হুকুম দিলেন।
ভক্তমণ্ডলী ভীত হয়ে পড়ল। কিন্তু শ্রীগৌরাঙ্গ আদেশ দিলেন সন্ধ্যাবেলায় নগরের পথে কীর্তন হবে। শুদু বৈষ্ণবরা নয়, সাধারণ মানুষও দলে দলে যোগ দিল সেইনগর কীর্তনে। প্রকৃত পক্ষে সেদিন নিমাই যে জনজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, ইতিহাসে তা বিরল। তাঁর এই শক্তির উৎস ছিল জনগণের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ। তিনি ধর্ম বর্ণ বৈষম্য মুছে ফেলে সকল মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে উঠেছিলেন। তাই মানুষ তার ডাকে অমন করে সাড়া দিয়েছিল।
নিমাইয়ের ডাকে বার হতেই সস্নেহে নিমাই তার সাথে কথা বললেন। নিমাইয়ের মধুর সম্বোধন, তার আন্তরিকতা, অকৃত্রিম ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন কাজী। হরিনাম সংকীর্তনের উপর থেকে সব বাধানিষেধ তুলে নিলেন। প্রকৃতপক্ষে নিমাই তার প্রেমের শক্তিতে মুসলমান শাসকের কাছ থেকে অবাধ ধর্মাচরণের স্বাধীনতা অর্জন করেছিলেন।
গয়াধাম থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নিমাইয়ের জনপ্রিয়তা শুধু বৃদ্ধি পায়নি, তার অনুগামী বৈষ্ণবদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করতে পারছিলেন শুধু নবদ্বীপ নয়, তাঁর কর্মক্ষেত্রকে ছড়িয়ে দিতে হবে আরো বৃহৎ জগতের মাঝখানে।
তার এই ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলেন নিত্যানন্দ ও আরো কয়েকজন অন্তরঙ্গ পার্ষদের কাছে। জননী শচীদেবীর কাছেও প্রকাশ করলেন নিজের মনের ইচ্ছা। কিন্তু কোন্ মা তাঁর পুত্রকে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দেয়?
১৫১০ খ্রীস্টাব্দে ২৬ মাঘ গভীর রাত্রে গৃহত্যাগ করলেন নিমাই। সকলে গভীর ঘুমে অচেতন। নিমাই গঙ্গা পার হয়ে অপর পারে কাটোয়ায় গেলেন। সেখানে ছিলেন কেশব ভারতী। তার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে সন্ন্যাস নিলেন। তার নতুন নাম হল শ্রীচৈতন্য।
শ্রীচৈতন্যের লক্ষ্য নীলাচল। তার অনুগামী ভক্তরা দলে দলে এসে হাজির হয় কাটোয়ায়। প্রভুর বিরহ তারা কেমন করে সহ্য করবে! সকলের অনুরোধে শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈতের গৃহে কয়েকদিনের জন্য রয়ে গেলেন। শচীদেবী এসে পুত্রের সাথে দেখা করলেন। সকলের কাছে বিদায় নিয়ে শ্রীচৈতন্য এবার যাত্রা করলেন উড়িষ্যায় পথে। নীলাচলে প্রভু জগন্নাথের দর্শন পাবার জন্যে তার সমস্ত মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।
উড়িষ্যা যাত্রা পথে তার সঙ্গী অল্প কয়েকজন ভক্তশিষ্য আর অনুগামী। জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ করতেই ভাবে বিহল চৈতন্যদেব জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। প্রহরীরা বাধা দিতে ছুটে এল। সেই সময়ে সেখানে এসেছিলেন উকলরাজ প্রতাপরুদ্রের গুরু মহাপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম। তিনি শ্রীচৈতন্যের অপরূপ দেহলাবণ্য প্রেমবিহল ভাব দেখে তাকে নিজের গৃহে নিয়ে গেলেন।
বাসুদেব সার্বভৌম শুধু যে উৎকলের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈদান্তিক। তার এই আত্মসমর্পণ শুধু যে উড়িষ্যায় আলোড়ন তুলল তাই নয়, সমস্ত দেশের পণ্ডিতরা বিস্মিত হল। মাত্র ২৪ বছরের এক তরুণ কোথা থেকে পেল এমন ঐশীশক্তি যার বলে বাসুদেব সার্বভৌমের মত মানুষ নিজের সব সত্তা বিসর্জন দিয়ে শ্রীচৈতন্যের পাদপদ্মে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। অল্প দিনের মধ্যেই নীলাচলের মানুষ প্রভুর প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেল।
কিছুদিন পর শ্রীচৈতন্য স্থির করলেন দক্ষিণ ভারতে যাবেন। সেখানকার সব তীর্থ : দর্শন করবেন। কোন সঙ্গী নেই সাথী নেই, একাই রওনা হলেন।
বিদ্যানগরের শাসক ছিলেন রামানন্দ রায়। উত্তল রাজ্যের প্রতিনিধি পরম ধার্মিক বৈষ্ণব। শ্রীচৈতন্যকে দেখামাত্রই ভাবে আবিষ্ট হয়ে গেলেন রামানন্দ রায়। মনে হল শ্রীচৈতন্যই তার ধ্যানের দেবতা। রামানন্দ রায়ের অনুরোধে সেখানে কয়েক দিনের জন্য রয়ে গেলেন শ্রীচৈতন্য।
দশ দিন পর আবার শ্রীচৈতন্য যাত্রী করলেন দক্ষিণের পথে। একের পর এক তীর্থ দর্শন করতে থাকেন। গেলেন শ্রীরঙ্গক্ষেত্রে, রামেশ্বর, ত্রিবাঙ্কর, আরো বহু স্থান। যেখানেই যান সেখানেই কৃষ্ণনামের জোয়ার বয়ে যায়। শ্রীচৈতন্যের এই দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ ঐতিহাসিক দিক থেকেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যে প্রেমধর্মের প্রচার করেছিলেন তা দীর্ঘদিন স্থায়ী ছিল।
প্রায় দু বছর দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ করে আবার নীলাচলে ফিরে এলেন শ্রীচৈতন্য। তার বিরহে ভক্ত শিষ্যরা সকলেই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। শ্রীচৈতন্যকে ফিরে পেয়ে সমস্ত নীলাচল যেন উৎসব নগরী হয়ে উঠে।
যে সব ভক্ত শিষ্যরা যারা নবদ্বীপ ছেড়ে প্রভুর সাথে নীলাচলে এসেছিল, দীর্ঘ দিন পরবাসে থেকে সকলেরই মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। শ্রীচৈতন্য ও উপলব্ধি করেছিলেন। তাছাড়া তার অবর্তমানে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারের জন্য উপযুক্ত মানুষের প্রয়োজন। সে কাজের ভার তুলে দিলেন নিত্যানন্দের উপর। শুধু তাই নয়, তিনি বললেন সংসারী হয়ে তুমি গৃহী মানুষের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার কর।
নিত্যানন্দ ছিলেন ব্রাহ্মচারী ও অবধূত। শ্রীচৈতন্যের চেয়ে প্রায় আট বছরের বড়। তবুও শ্রীচৈতন্য গভীর অন্তদৃষ্টি দিয়ে অনুভব করেছিলেন সংসারের প্রতি নিত্যানন্দের আকর্ষণ রয়েছে। তাই তাকে সংসার জীবন গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। বাংলায় ফিরে এসে নিত্যানন্দ জাহ্নরী দেবী নামে এক মহিলাকে বিবাহ করেন। জাহ্নরী দেবী ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ ধার্মিক। তিনি খেতুড়ি মহোৎসবের সময়ে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন এবং বহু ভক্ত তার কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।
গৌড় ত্যাগ করবার পর চার বছর অতিক্রান্ত হয় প্রতি বছর নবদ্বীপ শান্তিপুর থেকে ভক্তরা আসত তাকে দর্শন করবার জন্য।
১৫১৪ সালে বিজয়া দশমীর দিন নীলাচল ত্যাগ করে যাত্রা করলেন নবদ্বীপের পথে। প্রথমে এলেন কটকে। স্থানীয় মুসলমান শাসকরাও তার প্রেমগানে এতখানি মুগ্ধ হয়েছিলেন যে নদী পার করে গৌড়ে পৌঁছবার সকল ব্যবস্থা করে দিলেন।
শ্রীচৈতন্য এলেন কুমারহট্ট গ্রামে শ্রীবাসের গৃহে। তারপর শান্তিপুর হয়ে এলেন নবদ্বীপে। তার শৈশব কৈশোর যৌবনের কিছু অংশের লীলাভূমি এই নবদ্বীপে। নবদ্বীপ্রবাসীরাও শ্রীচৈতন্যের নামগানে বিভোর।
শচীমাতা এলেন পুত্র দর্শনে। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া কুলবধূ, তাছাড়া সন্ন্যাস গ্রহণের পর তো সন্ন্যাসীর স্ত্রীমুখ দর্শন নিষিদ্ধ। তবুও তার সমস্ত অন্তর স্বামী দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সব দ্বিধা-সংকোট দূর করে বিষ্ণুপ্রিয়া এলেন। শ্রীচৈতন্যের কাছে এসে প্রণাম করতেই প্রভু বললেন, তুমি কৃষ্ণুপ্রিয়া হও।
কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়ার জগৎ যে চৈতন্যময়। চৈতন্য ছাড়া যে তার আরাধ্য কেউ নেই। শ্রীচৈতন্য নিজের পাদুকা দিয়ে বললেন, এই পাদুকা গ্রহণ কর। এর মধ্যেই তুমি আমাকে খুঁজে পাবে।
কয়েক দিন নবদ্বীপে থেকে নগরবাসীর সাথে কীর্তন কৃষ্ণনামে মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন শ্রীচৈতন্য। বৰ্ণহিন্দুর অত্যাচার যখন হাজার হাজার মানুষ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করছিল, শ্রীচৈতন্যই তাদের মধ্যে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সেদিন যদি শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব না হত, বাংলার হিন্দু সমাজ সংস্কৃতি ধর্ম ভাষা সাহিত্য যা কিছু গৌরব সব কিছু চিরদিনের মত বিনষ্ট হয়ে যেত।
কয়েক দিন নবদ্বীপে থাকার পর তিনি যাত্রা করলেন, কৃষ্ণের লীলাভূমি বৃন্দাবনের পথে।
বৃন্দাবন থেকে শ্রীচৈতন্য যাত্রা করলেন প্রয়াগের পথে। সাথে দুজন ভক্ত। হঠাৎ পথপ্রান্তে এক রাখালের বাঁশির সুর শুনে জ্ঞান হারালেন শ্রীচৈতন্য। স্থির নিস্পন্দ দেহ। মনে হয় যেন প্রাণের সাড়া নেই। একদল পাঠান সেনা সেই পথ দিয়ে কোথাও চলেছিল। পাঠান সেনাপতি ছিলেন ধার্মিক লোক। অচেতন শ্রীচৈতন্যকে দেখে মনে হল নিশ্চয়ই তার দুই সঙ্গী তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। সেনাপতি দুই ভক্তকে বন্দী করবার হুকুম দিলেন। তারা যতই বলে প্রভু বেঁচে আছেন, কেউ তাদের কথায় কান দেয় না। তাদের হাত-পা বাধা হতেই জ্ঞান ফিরে পেলেন শ্রীচৈতন্য। তার কথায় দুই ভক্তকে মুক্ত করে দেওয়া হল। শুধু তাই নয়, পাঠান সেনাপতি চৈতন্যের প্রেমভাব তার দিব্যকান্তি দেখে এতখানি আবিষ্ট হলেন, তিনি শ্রীচৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। তার নতুন নাম হল রামদাস।
বাংলার নবার হুসেন শাহর দুই প্রধান কর্মচারী ছিলেন সাকর মল্লিক আর দবীর খাস-দুজনেই ছিলেন পণ্ডিত, বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী। শ্রীচৈতন্যের আকর্ষণে প্রথমে সাকর মল্লিক সব কিছু ত্যাগ করে এসে পৌঁছলেন প্রয়াগে। কৃষ্ণনামে তিনিও বিভোর। শ্রীচৈতন্য তাকে দীক্ষা দিয়ে নতুন নাম দিলেন শ্রীরূপ। রূপ বৈষ্ণব ধর্মের একজন প্রধান স্তম্ভ হয়ে ওঠেন। শ্রীচৈতন্য তার উপর ভার দেন বৃন্দাবনে ধর্মপ্রচার করতে।
উত্তর ভারত ভ্রমণ পর্ব শেষ করে শ্রীচৈতন্য ফিরে আসেন নীলাচলে। তাঁকে ফিরে পেয়ে ভক্ত শিষ্যদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়।
শ্রীচৈতন্য নিজে কোন ধর্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেননি। নিজে কোন ধর্মগ্রন্থও রচনা করেননি। সচরাচর উপদেশও দিতেন না তবুও হাজার হাজার মানুষ এক অদৃশ্য আকর্ষণে বার বার তাঁর কাছে ছুটে এসেছে। কারণ তার মত এমন করে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে কেউ প্রেমের মন্ত্র প্রচার করেনি। তিনি সে যুগের অধিকাংশ সাধু-সন্তের মত মানবতা-বিমুখী সন্ন্যাসী ছিলেন না। তার মধ্যে ছিল মানবীয় চেতনা, তাই তিনিই প্রথম দক্ষিণ ভারতের ঘৃণা দেবদাসী প্রথা বিলোপ করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। নারীদের প্রতি তার ছিল অপরিমেয় শ্রদ্ধা। তিনি পারস্পরিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ক্ষত-বিক্ষত ভারতবর্ষের বুকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন শান্তি আর ঐক্য। প্রধানত তারই চেষ্টায় হোসেন শাহ ও রাজা প্রতাপরুদ্র পারস্পরিক যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হয়েছিলেন।
তিনি মানুষকে মর্যাদা দিয়েছেন মানুষ হিসেবে। তার মধ্যেই বাংলার মানুষ খুঁজে পেয়েছিল একসাহসী ব্যক্তিত্বপূর্ণ পুরুষকে যিনি অত্যাচারী শক্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, সৃষ্টি করেছিলেন গণ প্রতিরোধ। কিন্তু তিনি যে ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের সূচনা করেছিলেন, যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে সেই মহৎ সম্ভাবনা পূর্ণ হয়নি।
১৫২২ খৃস্টাব্দে, শ্রীচৈতন্যের তখন ৩৬ বছর বয়স প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকেই তার মধ্যে শুরু হয় দিব্যোন্মাদ অবস্থা। বাহ্য জগতের সাথে সম্পর্ক ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসে। অধিকাংশ সময়ই কৃষ্ণনামে বিভোর হয়ে থাকতেন।
১৫৩৩ খৃস্টাব্দের ২৯ শে জুন,আশাঢ় মাস। শ্রীচৈতন্য তখন অধিকাংশ সময়ই ভাবে বিহ্বল হয়ে থাকতেন। এক এক সময় বাহ্য জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত পথে বার হয়ে পড়তেন। শিষ্যরা প্রতিনিয়ত তাকে পাহারা দিত।
প্রতিদিন প্রভু একবার করে জগন্নাথের মন্দিরে যেতেন। সেদিনও মন্দিরে গিয়েছেন। তিনি সাধারণত নাটমন্দিরের গরুর স্তম্ভের নীচে গিয়ে দাঁড়াতেন, সেখান থেকে দর্শন করতেন প্রভু জগন্নাথকে। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে প্রবেশ করলেন। সাথে সাথে মন্দিরের দরজা বন্ধ হইল। সেই সময় মন্দিরের মধ্যে কি ঘটেছিল তা জানা যায় না। কিন্তু যখন মন্দিরের দরজা খোলা হল তখন ভেতরে প্রভু নেই। চারদিকে প্রচার করা হয় তিনি জগন্নাতের সাথে লীন হয়ে গেছে। ভক্তজনের কাছে একথা বিশ্বাসযোগ্য হলেও প্রকৃত সত্য কি তাই?
বহু ঐতিহাসিকের অনুমান নীলাচলে শ্রীচৈতন্যের প্রভাব জনপ্রিয়তা দেখে জগন্নাথ মন্দিরের পূজারীরা চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন। বহু মানুষ জগন্নাথদেবকে না দেখে শুধুমাত্র শ্রীচৈতন্যকে দর্শন করতেন। এতে ক্ষুব্ধ পূজারীরা তাকে মন্দিরের মধ্যে হত্যা করে কোন গোপন পথে দেহ অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায়।
তাই বোধ হয় সাহিত্যিক কালকূট লেখেন–কোথায় গেলেন শ্রীচৈতন্য? কাদের হাতে তোমার রক্ত লেগে রইল? আমরা কি সেই সব রক্তক্ত হাতে পূজার ডালি সাজিয়ে দিই?