সারা দিন আকাশ থমথমে হয়ে আছে। শরীর পোড়ানো গ্রীষ্ম। এই বৈশাখ মাসে এ দেশের সমস্ত মানুষের মনই যেন চাতক পক্ষী হয়ে থাকে। বারবার চনু যায় আকাশের দিকে। এখন আকাশে নীলিমার চিহ্নমাত্র নেই। অথচ যে-মেঘ ঢেকে আছে দিগন্তু অবধি, তাও কেমন যেন বর্ণহীন। এ রকম গরমে কর্মোদ্যম নষ্ট হয়ে যায়।
রবির শীত এবং গ্রীষ্মবোধ দুই-ই যেন বেশ কম। শীতকালে যেমন তিনি খুব একটা উষ্ণ বস্ত্র অঙ্গে চাপান না, খুব গরমের সময়েও তাঁর তেমন অস্থিরতা প্রকাশ পায় না। ঘরে ঘরে টানা পাখার ব্যবস্থা আছে, ঠাকুরবাড়ির কতা ও গৃহিণীরা সারা দুপুর ঘরের বার হন না, রোরের আচ লাগলে গাত্রবর্ণ মলিন হয়ে যাবে বলে কুমারী ও তরুণী বধুরা সব ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে রাখে, ভূতেরা বাইরে বসে পাখার দড়ি টানে। রবি কিন্তু দ্বিপ্রহরেও বেরিয়ে পড়েন প্রায়ই, তাঁর ছাতার দরকার হয় না। সকালে কিংবা সহ্মের পর তিনি লিখতে বসেন তিনতলার মহলের ঢাকা বারান্দায়, সেখানে টানা-পাখার ব্যবস্থা নেই, তিনি হাতপাখাও ব্যবহার করেন না। দরদর করে সারা শরীরে ঝরতে থাকে ঘাম, তাতেও ভুক্ষেপ নেই রবির।
কোনও রাতেই রবির তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে না, বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন সেই নিস্তব্ধতা তিনি উপভোগ করেন সর্বাঙ্গ দিয়ে। সংসারের চিন্তা, বিষয় কর্মের চিন্তা যেন সম্পূর্ণ মুছে যায় মন থেকে, নদীর তরঙ্গের মতন ছুটে আসে কবিতার পঙক্তি। কোনও কোনও দিন কিছু না লিখলেও কাগজ-কলম নিয়ে টেবিলে বসে থাকতে ভাল লাগে। না-লেখা কবিতা নিয়ে খেলা করতেও যে কত আনন্দ পাওয়া যায়, তা অন্য কেউ বুঝবে না।
ছেলেমেয়েদের মধ্যে মাধুরী আর রথী কিছুটা বড় হয়েছে, তাদের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে আলাদা কক্ষ, বড় ঘরটিতে বাকি সন্তানদের নিয়ে শোয় মৃণালিনী। রাত ন’টার মধ্যে বাচ্চাদের বিছানায় পাঠাবার দৃঢ় নিয়ম আছে। ওরা অবশ্য তার পরেও খানিকটা হুটোপাটি করে তবে ঘুমোয়। তখন সেলাই নিয়ে বসে মৃণালিনী। রাতের বেলা সেলাই করা নিয়ে রবি অনেকবার নিষেধ করেছেন যদিও, মৃণালিনী শোনে না।
এ সময় স্বামীর পাশে গিয়ে বসে না মৃণালিনী, বাধা নেই কোনও, যদি যায়, গিয়ে কথা বলে, রবি ঠিকই উত্তর দেবেন, বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। তবু মৃণালিনী বুঝতে পারে, স্বামীর সেই সব কথার মধ্যে কোনও আন্তরিকতা নেই, যেন একজন অন্যমনস্ক, উদাসীন মানুষ। প্রশ্নের উত্তর দেন, নিজে থেকে কিছু বলেন না। এই স্বামী তার সন্তানদের জনক, কর্তব্য কোনও ত্রুটি নেই, কিন্তু ওর মনের কাছাকাছি কিছুতেই পৌঁছানো যায় না। মৃণালিনী লক্ষ করেছে, বাইরের লোকদের সঙ্গে রবি অতি নিখুত ভদ্রতা মেনে চলেন, বাড়ির মানুষের কাছেও যেন সেই স্টেকিকতা ও ভদ্রতার আবরণ পুরোপুরি ঘোচ না। একমাত্র মেজো ভাসুরের মেয়ে বিবির সঙ্গেই উনি প্রাণ খুলে কথা বলতে পারেন। এ বাড়ির অনেকেই বলে, বিবিকে উনি রাশি রাশি চিঠি লেখেন, শিলাইদহ কিংবা পতিসরে গিয়ে যখন বোটে থাকেন, তখন প্রায় প্রতি দিনই বিবির নামে একখানা করে চিঠি আসে, আর নিজের বউয়ের কাছে চিঠি আসে দু-একখানা মাত্র দায়সারা গোছের।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম উনি রাত্তিরবেলা নিজেই কাছে ডেকে সদ্য রচিত কবিতা শোনাতেন কিংবা কোনও বইয়ের গল্প শোনাতেন। দুএকবার সেসব শুনতে শুনতে মৃণালিনীর চোখে ঢুলুনি এসেছিল, সেই তার দোষ। সারা দিন সংসারের কত রকম কাজ থাকে, চতুর্দিকে গুরুঞ্জন, বাচ্চাদের দৌরাত্ম্য সামলাতে হয়, রাত্তিরে একটু শান্ত হয়ে বসলে ঘুম আসতে পারে না বুঝি? এখন আর ছবি কখন কী লিখছেন তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেন না স্ত্রীর সামনে। অথচ বিবি যদি আসে, তাকে নিয়ে যাবেন পাশের ঘরে, তখন আর দু’জনের কথা ফুরোয় না।
মৃণালিনী মেনেই নিয়েছেন, বিখ্যাত স্বামীর সেবাপরায়ণা স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের জননী হয়েই তাকে থাকতে হবে, ওঁর মামোজগতে তার ঠাই নেই।
মৃণালিনী ঘুমিয়ে পড়ার পরেও অনেকক্ষণ জেগে থাকেন রবি। কলম খোঙ্গা, লিখছেন না কিছু। পত্র-পত্রিকার চাপ থাকলেই তাঁর মাথায় লেখা বেশি আসে। সাধনার পৃষ্ঠা ভরাবার জন্য পরপর কতকগুলো ছোট গল্প লিখে ফেললেন, সেই সঙ্গে প্রবন্ধ, পুস্তক সমালোচনা, কবিতা তো আছেই। এখন ‘সাধনাট বন্ধ হয়ে গেছে, লেখার কোনও তাড়া নেই। গত এক-দেড় মাস কিছুই লেখেননি। তবে দু-একটা গান এসে যায়। একমাত্র গান রচনার ব্যাপারেই কোনও সম্পাদকীয় তাগিদের প্রয়োজন হয় না। গানের প্রথম পঙক্তিগুলি নিজেরা এসে ধরা দেয়। কথার আগে আসে সুর। দুর থেকে ভেসে আসা কোনও ফুলের সুগন্ধের মতন একটা কোনও নতুন সুর মাথার মধ্যে গুঞ্জরিত হয়, তারপর আপনি আপনিই যেন সেই সুর কথার অবয়বে ফুটে ওঠে।
মধ্য রাত্রি পার হয়ে গেছে, একটা হাম্বীর সুর গুন গুন করছেন রবি। একটু পরেই সুরটাতে তেওঁরা তাল এসে গেল। তাল যেফরতার সঙ্গে সঙ্গে তাতে বসে গেল শব্দের ডানা, ‘আরও কত দূরে আছে সে আনন্দধাম … আমি ক্লান্ত, আমি অন্ধ, আমি পথ নাহি জানি…’
হঠাৎ রবি বেশ চমকে উঠলেন, মাথার ঠিক পেছনে স্নিগ্ধ মধুর বাতাসের স্পর্শ! বাতাস এস কোথা থেকে? পরপর কয়েক দিন অসহ্য গুমোট চলছে, তবে কি ঝড় উঠল? রবি চোখে তুলে দেখলেন, বারান্দায় টবের গাছগুলোর একটা পাতাও কাঁপছে না, অন্ধকারে অদৃশ্য আকাশ, ঝড়ের আগমনের কোনও চিহ্নই নেই।
আর একবার ওরকম হাওয়া রবির চুলে যেন হাতের স্পর্শ বুলিয়ে দিতেই তাঁর কাছে শিহরন হল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে হল, নতুন বউঠান?
এক যুগ কেটে গেল, নতুন বউঠান চলে গেছেন। তারও আগে, সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ রবি এরকম গ্রীষ্মের দিনে ঘর্মাক্ত অবস্থায় লেখায় নিমগ্ন থাকলে কাদম্বরী চুপি চুপি পেছন দিক থেকে এসে পাখার হাওয়া করতেন, কিংবা হাত বুলিয়ে দিতেন রবির চুলে। এত বছর বাদেও সেই মনের ভুল?
জ্যোতিদাদা এ বাড়ি চিরকালের মতন তাগ করার পর রবি তিনতলার এই চমৎকার মহলটি নিজে নিয়েছিলেন। প্রথম প্রথম রবির এরকম মনের ভুল শুধু নয়, চোখের ভুলও হত প্রায়ই। সে নতুন বউঠানের ছায়া দেখতে পেত। ঠিক মনে হত, দরজার আড়ালে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। এক গভীর অসুখী, অতৃপ্ত হাহাকার ভরা নারীর আত্মা যেন মৃত্যুলোক থেকে ফিরে এসে আবার শরীর ধারণ করতে চাইছে, কিন্তু পারছে না, স্বচ্ছ কাচের মতন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে। রবি জানতেন, এটা সত্যি নয়, তবু তার ব্যগ্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, আর একবার নতুন বউঠান দেহ ধারণ করতে পারেন না?
এখন আর রবি তা চান না। যে একেবারেই হারিয়ে গেছে, তাকে আর আঁকড়ে ধরার বৃথা চেষ্টা কেন? তা ছাড়া, ওঁর কথা তো মাসের পর মাস মনেও পড়ে না। এই রবি তো আগেকার সেই রবি নন। তখন রবি ছিলেন প্রায় এই বাড়ি ও পরিবারের মধ্যেই আবদ্ধ এক ভীরু, কাব্য যশোপ্রার্থী, কাদম্বরী ছিলেন তাঁর একমাত্র বন্ধু ও কবিতার প্রধান সমঝদার ও প্রেরণা। এখন রবি বাংলার সাহিত্যাকাশে উদিত জ্যোতিষ্ক, কবিতা ও গদ্যে সসাচী, ঠাকুর পরিবারের এত বড় জমিদারির প্রধান পরিচালক, পাঁচটি সন্তানের জনক এবং পাবলিক ফিগার।
মৃতদের বয়েস বাড়ে না। কাদম্বরী যে বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন, সেই বয়েসেই আটকে আছেন, আর রবির বয়েস এখন হত্রিশ। এখন কি আর নিরিবিলিতে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃবধূর সঙ্গে খুনসুটি মানায়? বিশেষত যাঁর শরীরী অস্তিত্বই নেই!
রবির মনে পড়ল বছর দু’-এক আগেকার এমনই একটি রাতের কথা। সে রাতে রবি সত্যি বেশ উতলা হয়ে পড়েছিলেন।
মধ্য রাতে হঠাৎ ঝড় উঠেছিল। রবি একটি প্রবন্ধ রচনায় ব্যাপৃত ছিলেন, বারান্দা ছেড়ে ঘরের মধ্যে চলে এসে বন্ধ করে দিলেন সব কটি জানালা। আবার যে-ই লেখাতে মননানিবেশ করেছেন, একটু পরেই মনে হল কে যেন ঠকঠক করছে একটা জানলায়। শব্দ শুনলে মনে হয়, কেউ যেন ব্যাকুলভাবে বলতে চাইছে, খুলে দাও, দ্বার খুলে দাও, ঝড়ের মধ্যে আমি বাইরে থাকতে পারছি না, ভেতরে আসতে দাও আমাকে!
রবি অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন জানলাটার দিকে। কেউ নেই, তিনতলার বারান্দায় কারুর পক্ষে এসে দাঁড়ানো সম্ভবই নয়। তবু ঠকঠক শব্দ হচ্ছে ঠিকই এবং তার ভাষা যেন ওই রকম।
নিশ্চয়ই কোনও একটা ছিটকিনি আলগা আছে। রবি উঠে গিয়ে জানলাটা খুলে ঠিক করতে যেতেই এক ঝলক হাওয়া টুকে এল। বাইরে মাতামাতি করছে ঊনপঞ্চাশ পবন, ধারালো বৃষ্টির ফোঁটাও পড়তে শুরু করেছে।
হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে এল একটা জুঁই ফুল।
অতি সামান্য কোনও ব্যাপারও এক এক সময় কত গভীর তাৎপর্য মণ্ডিত হয়ে উঠতে পারে। বারান্দায় সার সার সাজানো ফুলের টব, তাতে অনেক জুঁই-বেল-রজনীগন্ধা ফুটে আছে। একটা দুই ফুল ঝড়ের তোড়ে ঘরের মধ্যে এসে পড়তেই পারে। কিন্তু রবির মনে হল, হাওয়া যেন কারুর আত্মা, আর ফুলটা সে-ই ছুঁড়ে দিয়েছে, যার ওই ফুল ছিল খুব প্রিয়।
সঙ্গে সঙ্গে রবির মনে পড়ল, ঠিক দশ বছর আগে, বৈশাখ মাসের এই দিনটিতেই নতুন বউঠান আম্মঘাতিনী হয়েছিলেন। এ কথা রবির সারা দিন মনে পড়েনি, ভুলে ছিলেন কী করে? এ বাড়িতে অন্য কারুর এ দিনটি স্মরণ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কেউ তাঁর নাম ভুলেও উচ্চারণ করে না, যেন কাদম্বরী নামে কোনও বধূ এ পরিবারে কোনও দিনই ছিল না।
অন্যরা না স্মরণ করুক, রবিও মনে রাখবেন না?
ফুলটি মেঝে থেকে তুলে নিয়েছিলেন রবি।
জানলা খোলা রাখা যায় না, ভেতরে বৃষ্টির ছট আসছে। বন্ধ করলেন বটে, কিন্তু ছিটকিনিটা সত্যিই নড়বড়ে, আবার খটাখট শব্দ শুরু হল। এবং সেই শব্দ শুনে রবির মনে হবেই যে নতুন বউঠান আবার ভেতরে আসতে চাইছেন।
অশরীরীর সঙ্গে মানুষের ভাষায় কথা বলা যায় না। আগের লেখাটি সরিয়ে রেখে রবি অন্য একটি কাগজে লিখলেন :
বিলম্বে
এসেছু, রুদ্ধ এবে দ্বার
জন শূন্য পথ, রাত্রি অন্ধকার
গৃহ হারা বায়ু করি হাহাকার
ফিরিয়া মরে।
জানলার বাইরে থেকে ব্যাকুল কণ্ঠে যেন কেউ এর উত্তর দিল। গৃহহারা বায়ু নয়, আমি সে, আমি সে, আমাকে চিনতে পারছ না? রবি আবার লিখলেন :
তোমারে
আজিকে ভুলিয়াছে সবে
শুধাইলে কেহ কথা নাহি করে
এ হেন নিশীথে আসিয়াছ তবে
কিসের তরে?
লিখতে লিখতে রবির চ জ্বালা করে উঠল। গলায় অবরুদ্ধ হল বাপ। ভূলিয়াছে সবে? এটা কি বড় বেশি কঠিন হয়ে গেল না? কেউ আর নাম উচ্চারণ করে না বটে, কিন্তু মন থেকে কি ইচ্ছে করলেই মুছে ফেলা যায়?
কত সাধ করে নতুন বউঠান সাজিয়েছিলেন এই তিনতলার মহল। এখনও অনেক কিছুতেই রয়ে গেছে তার হাতের চিহ্ন। সব কিছু ছেড়ে নিজেই তো চলে গিয়েছিলেন, তবে আর ফিরে আসা কেন? বিদেহী আত্মা কি পুরনো অধিকার ফিরে পেতে পারে?
এ দুয়ারে মিছে হানিতেছু কর…
রবির চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ছে কাগজের ওপর; তবু তিনি লিখে যাচ্ছেন :
যেথা
একদিন ছিল তোর গেহ
ভিখারীর মত আশে সেথা কে?
কার লাগি জাগে উপবাসী স্নেহ
ব্যাকুল
মুখে…
ঘুমায়েছে
যারা তাহারা ঘুমাক
দুয়ারে দাঁড়ায়ে কেন দাও ডাক
তোমারে হেরিলে হইবে অবাক
সহসা রাতে…
পাশের ঘরে দুধের শিশুটি হঠাৎ কেঁদে উঠতে রবির ঘোর ভেঙে গিয়েছিল। সহসা বাস্তব এসে যেন এক ফুয়ে উড়িয়ে দিল পরাবাস্তবতা। তখন জানলার খটখটানিতে স্পষ্ট বোঝা যায় আলগা ছিটকিনির শব্দ। বাইরের ঝড় শুধুই ঝড়, তাতে কারুর মুখ ভাসে না।
দু বছর বাদে আজ রাতে আবার সেই অনুভূতি। আজও সেই বৈশাখের বিশেষ দিন। মাঝখানের বছরটিতে বৈশাখের এ সময় রবি কলকাতায় ছিলেন না, তাই কিছু খেয়ালও হয়নি। শুধু এ বাড়ির তিনতলার এই বারান্দার আশেপাশেই সেই আত্মা ঘোরাফেরা করে এক যুগ কেটে গেছে, তার পরেও?
রবি উঠে গিয়ে বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। না নেই, সে কোথাও নেই, আত্মা বলে, যদি কিছু থাকেও, তবু তা পার্থিব কামনা বাসনা নিয়ে ফিরে আসে না। এ সবই রবির নিজের মনের রসায়ন।
দু-একবার বিদ্যুৎ চমক দিচ্ছে, দূর দিগন্তে। ঝড় ও বৃষ্টি আসন্ন। বৃষ্টির খুব প্রয়োজন এখন। শহরে এখন কলেরা ও পান বসন্তের খুব উপদ্রব চলছে। মহারাষ্ট্র থেকে ছড়াচ্ছে প্লেগের আতঙ্ক। এই সব রোগ-মহামারীর কাছে মানুষ অসহায়, একমাত্র প্রবল বর্ষণেই রোগের বীজাণু ধুয়ে যেতে পারে।
এই ধরনের বাস্তব কথা মনে এনে রবি নতুন বউঠানের অশরীরী অস্তিত্বকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেন।
দশ-বারো বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল, এখনও রবির অনেক রচনায় কাদম্বরীর হায়া এসে যায়। এক সময় রবি যেমন তার সদ্য লেখা কবিতা ওঁকে শোনাবার পর ওর মতামত শুনে কিছু কিছু পঙক্তি অদলবদল করতেন, এখনও তেমনই যেন, তিনি নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ান হঠাৎ হঠাৎ, রবির কলম দিয়ে তিনি তাঁরই বিলাপ, তাঁর মর্মবেদনা লিখিয়ে নেন।
ওই মুখ ওই হাসি কেন এত ভালবাসি,
কেন গো নীরবে ভাসি অশ্রুধারে!
তোমারে হেরিয়া যেন জাগে স্মরণে
তুমি চির-পুরাতন চির জীবনে!
অন্য কেউ এসব কবিতার সঠিক মর্ম বুঝবে না। তুলিয়া অঞ্চলখানি/ মুখ-’পরে দাও টানি/ ঢেকে দাও দেহ।/ করুণ মরণ যথা/ ঢাকিয়াছে সব ব্যথা/ সকল সন্দেহ… যে কবিতায় এই সব লাইন আছে, সেই কবিতাটি ‘মৃত্যুর পরে নাম দিয়ে ছাপা হবার পর অনেকে মনে করেছিল, ওটা বুঝি বঙ্কিমবাবুর স্মরণে লেখা। মুখ আর কাকে বলে? ভাবুক, যার যা খুশি ভাবুক।
যদি অন্তরে লুকাবে বসিয়া
হবে অন্তরজয়ী
তবে তাই হোক। দেবী, অহরহ
জনমে জনমে রহো তবে রহো
নিত্য মিলনে নিত্য বিরহ
জীবনে জাগাও প্রিয়ে…
পরদিন সকালে রবি ভূত্যদের ডাকিয়ে তাঁর লেখার টেবিলটি আনালেন দোতলার একটি ঘরে। এ ঘরখানি যেমন-তেমন, বাইরের কোনও দৃশ্য দেখা যায় না। তিনতলার অমন সুদৃশ্য জায়গা ছেড়ে রবি লেখার জন্য এ ঘর বেছে নিলেন বলে অনেকেই বিস্মিত। সঠিক কারণটি অন্যদের বলে বোঝানো যায় না। রবি বললেন, ওপর তলায় মৃণালিনীকে পাঁচটি বাচ্চা সামলাতে হয়, খোকা-খকর লেখার মধ্যে এসে কথা বলে, তাতে একাগ্রতা নষ্ট হয়, সেই জন্যই একটা নিরিবিলি স্থান দরকার।
একজনের স্মৃতিভার নিয়ে পড়ে থাকলে সাহিত্যের জগতে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া কী করে সম্ভব? লেখা ছাড়াও আরও কত কাজ আছে, জমিদারি পরিদর্শন ছাড়াও রবি বলেন্দ্রদের সঙ্গে পাট আর আখ মাড়াই কলের ব্যবসা শুরু করেছেন, তাতেও মনোযোগ দিতে হয়। অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকলে ভবিষ্যৎকে দেখা যাবে কী ভাবে? এক একবার ভাবের ঘোরে মনে হয়েছে, নতুন বউঠান যখন বারবার নিশীথ কালে এসে দুয়ারে আঘাত করছেন, তখন তাঁর সঙ্গে অচেনা অসীম আঁধারের জগতে ভেসে পড়লে কেমন হয়? কিন্তু না, তা কী করে হয়, নতুন বউঠান আত্মঘাতিনী হয়েছিলেন বলে রবিও কেন জীবন বিসর্জন দেবে? ওঁকে বিদায় দিতেই হবে মন থেকে। বলো শান্তি, বলো শান্তি–/ দেহ সাথে সব ক্লান্তি/ পুড়ে হোক ছাই…
এর পর রবি সত্যি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সম্পত্তি নিয়ে কিছু কিছু অশান্তি চলছিলই, এই সময়ে তা প্রকট হয়ে পড়ে। গুণেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যুর পর তাঁর তিনটি নাবালক পুত্রের ভাগের সম্পত্তির দেখাশোনার ভার দেবেন্দ্রনাথই নিয়েছিলেন। বার্ধক্যহেতু অশক্ত হয়ে পড়ায় তিনি সেই দায়িত্ব দিয়েছেন রবিকে। যদিও গুণেন্দ্রনাথরা কখনও ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেননি এবং তাঁদের বসতবাটিও আলাদা, তবু একই পরিবারের এই দুই শাখায় কখনও সৌহার্দ্যের অভাব হয়নি। গগনেন্দ্র, সমরেন্দ্র, অবনীন্দ্র এই তিন ভাই-ই রবির বিশেষ ভক্ত। কিন্তু বাইরে থেকে নানা লোকের উস্কানি দেবার অভাব হয় না। গুণেন্দ্রনাথের ওই পুত্রেরা এখন সাবালক, নিজেদের সম্পত্তি তাদের এখন বুঝে নেওয়াই তো উচিত, জমিদারিতে তাদের নায্য ভাগ কোথায় কতখানি তাও জানা দরকার, এরকম একটা গুঞ্জন তুলে দিল ওই পরিবারের শুভার্থীরা। এই নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা শুরু হলে অনেকেরই লাভ।
দেবেন্দ্রনাথের এতগুলি কৃতী পুত্র, তবু তিনি জমিদারি ও পারিবারিক বিষয়ে সব কিছু দেখাশুনো ও সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ কর্তৃত্ব দিলেন কনিষ্ঠ পুত্রকে। এই সময় তিনি রবিকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে দিলেন, যার ফলে দুই পরিবারের যে-কোনও খুঁটিনাটি সমস্যায় রবিকেই মাথা ঘামাতে হবে। এ জন্যে এখন রবিকে প্রায়ই উকিল-ব্যারিস্টারদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়, কখনও ছুটতে হয় আদালতে। কে বলে কবিদের সাংসারিক জ্ঞান থাকে না? এই সব বৈষয়িক কাজে দেবেন্দ্রনাথকে খুশি করা সহজ নয়, সামান্য গাফিলতিও তাঁর নজর এড়ায় না। দেবেন্দ্রনাথ এখন অবস্থান করছেন পার্ক স্ট্রিটের এক ভাড়া বাড়িতে, রবিকে সেখানে ঘন ঘন ছুটতে হয়, পিতার কাছে সব হিসেবনিকেশ দাখিল করতে হয়। রবির কাজকর্মে পিতা বেশ সন্তুষ্ট, তিনি অন্য পুত্রদের বাদ দিয়ে, জোড়াসাঁকো বাড়ির সংলগ্ন একখণ্ড জমি দান করেছেন রবিকে। রবি সেখানে নিজস্ব একটি বাড়ি বানাচ্ছে, সে রচও জোগাচ্ছেন দেবেন্দ্রনাথ।
রবির অবস্থা এখন বেশ সচ্ছ। পারিবারিক মাসোহারা ছাড়াও জমিদারি কাজ দেখার জন্য অতিরিক্ত মাসোহারা পান, তুপুত্রদের সঙ্গে পৃথক ব্যবসাতেও বেশ লাভ হচ্ছে। পাট ও আখ মাড়াই কল ছাড়াও এখন কাঁচা চামড়া কেনা-বেচা যুক্ত হয়েছে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে কাঁচা চামড়া কেনা হয়, সেগুলি বিক্রি হয় কলকাতায়। এর মধ্যে শেখ রহম আন্সি ও ফকির মহম্মদ নামে দুই ব্যক্তি রবিদের কোম্পানি থেকে প্রচুর চামড়া কিনে নিয়ে টাকা আটকে দিল। অনেক টাকার ব্যাপার, সুতরাং মামলা ঠুকতে ইল ওদের বিরুদ্ধে।
ব্যবসাতে জড়িয়ে পড়ে রবি বুঝতে পারলেন, ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশীয় বাণিজোর প্রসার ঘটাতে না পারলে এ দেশের মানুষের উন্নতির কোনও আশা নেই। তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠিক পথেই এগোচ্ছিলেন। কিন্তু বেহিসেবি ও হঠকারী ছিলেন বলেই তিনি সর্বস্বান্ত হলেন। দেশীয় ব্যবসায়ীদের অগ্রসর হতে হবে ধীরে ধীরে, ইংরেজ কম্পানিগুলি সহজে তাদের বাজারে ঢুকতে দেবে না। সেই জন্যই আগে দরকার দেশের মানুষদের সজাগ করা, তারা যদি স্বেচ্ছায় বিলিতি দ্রব্যের বদলে স্বদেশি দ্রব্য কিনতে শুরু করে, তা হলে বিদেশি ব্যবসায়ীরা পিছু হঠতে বাধ্য হবে। অবশ্য দিশি জিনিসের মান ও গুণেরও উন্নতি করতে হবে। অনেক গ্রামীণ কুটির শিল্পের কথা শহরের মানুষ জানেই না, সে কারণে শহরে শহরে স্বদেশি শিল্প ভাণ্ডার স্থাপনের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে।
জমিদারির কাজ, ব্যবসা, বৃহৎ পরিবারের সব কিছুর বিলিব্যবস্থা, এসব তো আছেই, কিন্তু কলমও থেমে নেই। এখন আর রবি দিনের বেলায় লেখার সময় প্রায় পান না, লেখেন রাত্তির বেলা। দিনের কর্মব্যস্ত মানুষটির সঙ্গে রাত্রির মানুষটির যেন কোনও মিলই নেই। সকলের থেকে আলাদা এক নির্জন মানুষ। নিজের মধ্যে বিভোর। এখন গদ্যের চেয়ে গানই আসছে বেশি। সভাসমিতিতে গেলে লোকে নতুন গান শুনতে চায়।
কখনও সখনও ফরমায়েশি গানও লিখতে হয়। আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে কারুর বিয়ে হলে রবি সেই উপলক্ষে নতুন গান বাঁধবেনই, সবাই ধরে নিয়েছে। ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করতে হয়। অনুবাদ-ঘেঁষা গানের দিকেও তাঁর ঝোঁক পড়েছে। বহুল প্রচলিত কোনও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গুন গুন করতে করতে তাতে বাংলা কথা বসাতে ইচ্ছে করে। কৌন রূপ বনে হো রাজাধিরাজ, তিলক কামোদের সুরে এই গানটি কয়েকবার গাইতে গাইতে কথাগুলো বদলে যায়, ‘মধুর রূপে বিরাজ হে বিশ্বরাজ,…’। মূল সুরের কাঠামোটা ঠিকই থাকে, তবু এমন কিছু একটা ঘটে যায় যে শেষ পর্যন্ত আর সেটা ঠিক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থাকে না, রবির নিজস্ব গান হয়ে যায়। রবির বন্ধু কবিবর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেন, আপনার গান এত শক্ত যে আমার গলায় ওঠে না কিছুতেই। আপনি সুরের মধ্যে কী একটা ঘটিয়ে দেন বলুন তো! দ্বিজেন্দ্রবাবু নিজে সুগায়ক, যে-কোনও আড্ডা-সম্মিলনে তিনি নিজস্ব অসির গান গেয়ে দারুণ জমিয়ে দেন, তাঁর রীতিমতন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেওয়া তৈরি গলা, বু তিনি রবি-রচিত গান কিছুতেই গলায় তুলতে পারেন না।
এই শীতে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন বসবে, সেই উপলক্ষেও রবিকে নতুন গান সচনার ফরমাস জানানো হয়েছে।
কংগ্রেস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বা কৌতূহল দিন দিন বাড়ছে। কংগ্রেসের অধিবেশন একটা বেশ বড় রকমেব ঘটনা। রবি এবং ঠাকুর পরিবারের অনেকেই কংগ্রেস সম্পর্কে বিশেষ উৎসাহী, আসন্ন অধিবেশনে রবি একজন প্রতিনিধি, তাঁর ওপর পড়েছে উদ্বোধন সঙ্গীতের ভার।
একদিন সকালে কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতা বিপিন পাল আরও কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে এলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। বিপিন পাল মশাই রবিকে একটি বিচিত্র অনুরোধ জানালেন। মহারাষ্ট্রে গণেশ পুজো খুব জনপ্রিয়, সেই উপলক্ষে বহু মানুষ সমবেত হয়। বিপিন পান্সের ইচ্ছে এখানে দুগ পৃজাও সেইভাবে প্রচলিত হোক, দিকে দিকে সর্বজনীনভাবে এই পূজা ছড়িয়ে পড়ক। তবে নিছক পূজা নয়, দেবীমূর্তিকে দেশমাতৃকার রূপ দিতে হবে, এই পূজা উপলক্ষে সবাই নিজের দেশকে জননী হিসেবে ভাবতে পারবে। সেইভাবে দেবীমূর্তির আদলে মাতৃস্তোত্র রচনা করা দরকার। রবীন্দ্রবাবু ছাড়া তেমন গান আর কে বাঁধতে পারবে? সেই গান পরিবেশিত হবে কংগ্রেসের মঞ্চে।
অনুরোধটি শুনে রবি বেশ অবাক হলেন। কংগ্রেসের মঞ্চে গা মূর্তির বন্দনা? কংগ্রেস কি শুধু হিন্দুদের? হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-পারসিক-খ্রিস্টান সবাইকে মেলাবার জন্যই তো কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা। হিন্দু ছাড়া আর কেউই তো ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাসী নয়।
বিপিন পাল বললেন, আমি তো ধর্মের গান চাইছি না, চাইছি দেশবনা। নিছক মানচিত্র দেখে দেশকে বোঝা যায় না। মাতৃমূর্তি হিসেবে কল্পনা করলে, সমগ্র দেশ চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ভক্তিতে আমাদের মাথা নুয়ে আসে। মুসলমান-খ্রিস্টানরা তো এখনও তেমন কোনও গান রচনা করেনি, দেশাত্মবোধক গান আর কোথায়? হিন্দুরা লিখতে গেলে একটা মূর্তির আদল এসে যাবেই। অত খুঁতখুঁতে হলে চলে না, রবিবাবু? আমরা তো মুসলমান-খ্রিস্টানদের দুগা পুজা করতে বলছি না, কিন্তু দেশকে মা বলে মেনে নিতে আপত্তি হবে কেন?
রবি বললেন, বঙ্কিমবাবুর বন্দে মাতরম গানটিই তো সেরকম গানের আদর্শ। সেটি গাইলেই হয়।
বিপিন পাল বললেন, আপনি নতুন করে সহজ ভাষায় লিখে দিতে পারতেন যদি, একই সঙ্গে ভক্তি উদ্দীপনা মিলিয়ে…
রবি বললেন, আমাকে মাপ করবেন, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
বিপিন পাল খানিকটা মনঃক্ষুন্ন হয়ে চলে গেলেন। রবি কিছুক্ষণ বসে রইগেন চুপ করে। কংগ্রেসের মঞ্চে দেবীবন্দনা গীতি সম্পর্কে তাঁর আপত্তি তো আছেই। তা ছাড়া তিনি নিজেও যে মুর্তিপুজায় বিশ্বাসী নন। অন্তরে যদি ভক্তি না থাকে তা হলে কলম দিয়ে ভক্তি রসের গান বেরুবে কী করে?
রবি বরং অন্যরকম একটি গান লেখার কথা ভাবলেন। বিভিন্ন রাজ্য থেকে কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা আসবেন, তাঁদের পৃথক পৃথক ভাষা। কংগ্রেসের মঞ্চে ভাষা একটা সমস্যা। ভারতের কোনও ভাষাই সর্বজনবোধা নয়, তাই ইংরিজিতেই সব বক্তৃতা ও প্রস্তাব পেশ হয়। এক একজনের বক্তৃতায় ইংরিজির ফোয়ারা ছোটে। যেখানে স্বদেশি ভাব জাগাবার এত প্রয়াস চলেছে, সেখানে রাজশক্তির ভাষাকে এতখানি গুরুত্ব দেওয়া রবির পছন্দ নয়। ইংরিজির প্রাধান্যের জন্যই কংগ্রেসের নেতৃত্বে যত সব বিলেত ফেরত ব্যারিস্টারদের আধিপত্য। যাঁরা ভাল ইংরিজি জানেন না, তারা তাঁদের মতামত ব্যক্ত করার সুযোগও পান না।
কলকাতায় অধিবেশন হলেও সব বাংলা গান হলে অনেক প্রতিনিধিই কিছুই বুঝবেন না। যদি অধিকাংশ তৎসম শব্দ মিশিয়ে কোনও গান রচনা করা যায়, তা হলে কেমন হয়। অধিকাংশ শিক্ষিত
নুষই সংস্কত কিছুটা বোঝেন। দক্ষিণ ভারতের তামিল-তেলুগুভাষীরাও সংস্কৃত
জানেন। যেমন শিক্ষিত হিন্দুরা ফার্সি ও উচচা করে, তেমনি শিক্ষিত মুসলমানরাও সংস্কৃত
শেখে। রবি লিখলেন, অয়ি ভুবনমনোমমাহিনী
অয়ি নির্মল সুর্য করোজ্জ্বল ধরণী
জনক জননী জননী
নীল
সিন্ধুজল ধৌত চরণতল
অনিল বিকম্পিত-শ্যামল অঞ্চল
অম্বর চুম্বিত ভাল হিমাচল, শুভ্রতুষার কিরীটিনী…
গানটি তৎসম শব্দবহুল বটে, কিন্তু অজ্ঞাতসারে এর মধ্যেও যে একটি মূর্তির আদল এসে গেছে, তা রবি তখন খেয়াল করলেন না।
শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের নেতারা ঠিক করলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরমই হবে উদ্বোধনী সঙ্গীত। রবিরই যুক্তিতে এই গানটিও সংস্কৃত সুতরাং সর্বনগ্রাহ্য হবে।
রবির ইচ্ছে ছিল, প্রথম গানটি হবে অঞ্চত দশ বারোজনকে নিয়ে সমবেতভাবে। তাতে বেশ জমজমাট হয়। বন্দে মাতরম গানটির প্রথম দুটি গুবকের সুর রবি নিজেই দিয়েছিলেন, কিন্তু অন্যদের শেখাতে গিয়ে দেখলেন, সবাই সু ঠিক তুলতে পারছে না। তেমন জমছে না গানটা। তখন রবি ভাবলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একটি গান দিয়ে উদ্বোধন করলে কেমন হয়? ‘চল রে চল সবে ভারত সন্তান, মাতৃভূমি করে আহ্বান…’ এ গানের কথা যেমন দেশাত্মবোধক, সুরও সহজ, অনেকটা মার্চিং সং-এর মতন।
কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য প্রকাণ্ড মণ্ডপ তৈরি হয়েছে বিডন স্কোয়ারে। এই দ্বাদশ অধিবেশনের সভাপতি বোম্বাইয়ের বিশিষ্ট আইনজীবী জনাব রহিমতুল্লা এম, সায়ানি, ভাবতের খ্যাতিমান সমস্ত ব্যক্তিই এখানে উপস্থিত। মঞ্চের ওপর একটা পিয়ানো ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র এনে রবির পরিচালনায় প্রথমে সমবেত স্বরে হল জ্যোতিরিন্দ্রনাথেব ওই গান। প্রচুব হাততালির পর কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠল, রবিবাবুর গান, রবিবাবুর গান।
রবিকে এককভাবে গাইতেই হবে জনতার দাবিতে। শ্রোতার সংখ্যা প্রায় দু’ হাজাব। মঞ্চ থেকে মনে হয় যেন এক বিপুল জলরাশি। রবি নিজের গানের বদলে বন্দে মাতবমই গাইবেন ঠিক করে বেখেছিলেন। সরলাকে বসতে বললেন অগানে। সে এই গানটির সুর ভাল জানে। তারপর রবি মঞ্চের একেবাবে সামনে এসে একক কণ্ঠে ধরলেন গান। অত মানুষ একেবারে নিঃশব্দ, তার মধ্যে গমগম কবতে লাগল রবি ভবাট কণ্ঠস্বর। সেই প্রথম সাবা ভারতের প্রতিনিধি বন্দে মাতরম গানটি শুনল এবং জাতি-ধর্ম–সম্প্রদায়নির্বিশেষে সমস্ত প্রতিনিধিই ধন্য ধন্য করতে লাগল।
এর পর আর অন্য গান জমে না। রবি তাঁব নতুন গান, অয়ি ভুবনমনোমোহিনী কয়েকজনকে শিখিয়ে তৈরি করেছিলেন, সেটা বাদ গেল। যারা গানটি শিখেছিল, তাদের মধ্যে একজনের নাম অতুলপ্রসাদ সেন, বিলেত প্রত্যাগত এই নবীন ব্যারিস্টারটির বেশ মিষ্টি, সুবেলা গলা। অতুল খানিকটা নিবাশ হয়ে জিজ্ঞেস করল, রবিবাবু, আমাদের গানটা হবে না?
কয়েক দিন পর ঠাকুরবাড়িতে কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের ভোজসভায় আপ্যায়িত করা হল। খাদ্য পরিবেশনের আগে গান। রবি তাঁর গায়ক-গায়িকাদের সবাইকে সাদা পোশাক পাবে আসতে বলেছিলেন। তিনি নিজেও পবেছেন শুভ্র ধুতি ও কামিজ, তার ওপর সিল্কের চাদব। তিনি মাঝখানে দাঁড়ালেন, দু পাশে অন্য যুবক-যুবতীরা। অযি ভুবনমনোমমাহিনী শুনে অন্য প্রদেশের শ্রোতারা স্বীকার করলেন, তাঁদের বুঝতে কোনও অসুবিধে হয়নি, এমন মধুর সুরের গানও তাঁরা। আগে শোনেননি।
পরপর কয়েক দিন বেশ ধকল যাওয়ায় রবি খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। মনটা কলকাতা ছেড়ে পালাই পালাই করছে। শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। এই সময় শিলাইদহের নাগর নদীতে বজরা ভাসিয়ে দিন কাটানোর মতন আনন্দের কোনও তুলনা হয় না। নদী হাতছানি দিয়ে ডাকছে, কিন্তু কলকাতার কিছু কাজ না চুকিয়ে যাওয়া যাবে না।
হই-হট্টগোলের মধ্যে প্রায় এক মাস লেখা হয়নি কিছুই। একম কিছুদিন না লিখলে তাঁব মন ছটফট করে। শিল্পরস ছাড়া তাঁর মন পরিশ্রত হয় না। রাত্তিরে দোতলার ঘরে গ্যাসের বাতি জ্বেলে রবি কাগজকলম নিয়ে বসলেন। মাথায় কিছু আসছে না। কলম নিয়ে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে এক সময় একটা ছবি ফুটে উঠল। একটি নারীর মুখের আদল।
রবি ভুরু কুঞ্চিত করে বললেন, আবার তুমি এসেছো? না, না, মিথ্যে মিথ্যে, তুমি কোথাও নেই। সব শেষ হয়ে গেছে, কতগুলি বছর কেটে গেল, আমি তোমায় মনে। রাখিনি—
হঠাৎ রবি হাহাকার করে ভেঙে পড়লেন, টেবিলে মাথা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন কুঁপিয়ে ফুপিয়ে। আপ্লুত স্বরে বলতে লাগলেন, না, না, নতুন বউঠান, সত্যি নয়, এ কথা সত্যি নয়, আমি তোমাকে একদিনের জন্যও ভুলিনি, আমি কি এত অকৃতজ্ঞ হতে পারি? সব সময় তোমার কথা মনে পড়ে… সেদিন বিডন স্কোয়ারে গান গাইবার পর যখন হাজার হাজার লোক আমার সুখ্যাতি করছিল, আমি তখনও শুধু ভাবছিলুম, নতুন বউঠান এই দৃশ্য দেখলে কত খুশি হত! অন্য লোক যতই সম্মান দিক, শিরোপা দিক, আমার তুচ্ছ মনে হয়, তুমিই তো আমাকে সম্রাট করেছ, তুমি আমার মাথায় পরিয়েছ। প্রেমের মুকুট…
বেশ কিছুক্ষণ বাদে রবি চোখ মুছে শান্ত হলেন। তারপর হঠাৎ সদ্য পাথর ভেদ করে উঠে আসা ঝনর মতন লিখতে লাগলেন :
আমার
সত্য মিথ্যা সকলই ভুলিয়ে দাও
আমায় আনন্দে ভাসাও
না চাহি তর্ক না চাহি যুক্তি
না জানি বন্ধ না জানি মুক্তি
তোমার বিশ্বব্যাপিনী
ইচ্ছা
আমার অন্তরে জাগাও…