1 of 2

২৩. ফিটন থেকে একজন

ফিটন থেকে একজন রোগা মতন প্রৌঢ় নামলেন। নেমেই ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,

অনুকূলরা এখনও আসেনি?

বড়বাবু দরজা থেকে এগিয়ে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে বললেন, আসুন, আসুন! না, ওনারা তো কেউ এখনও এসে পৌঁছোননি!

প্রৌঢ়টির পরনে একটি বড় পাড়ের ধুতি, বেনিয়ান ও সিল্কের উড়নি। ধুতিটি কিন্তু প্রায় হাঁটুর কাছে তোলা। চুল ও ভুরু কঁচা-পাকা। মুখোনি শুকনো নারকোল মালার মতন, সব সময় রাগী রাগী ভাব। জামার ঘড়ি-পকেট থেকে চেনবাঁধা গোল ঘড়ি বার করে দেখে বললেন, আমাকে বলেছিল, সাড়ে পাঁচটার সময় আসবে–এখন পঁয়তিরিশ হয়ে গেল–এরপর আলো পড়ে আসবে—

চিররঞ্জন বড়বাবুর দিকে চোখাচোখি করলেন। অর্থাৎ এই রাগী প্রৌঢ়টির মনোরঞ্জন করা খুব সহজ হবে না।

বসবার ঘরটি আজ অন্য রকম ভাবে সাজানো হয়েছে। টেবিল-চেয়ার সোফা-কৌচ দেওয়ালের দিকে হঠিয়ে দিয়ে মাঝখানে পাতা হয়েছে কার্পেট–সেই কার্পেটের ডিজাইন–একটি সিংহ লাফিয়ে পড়ছে হরিণের ওপর। কার্পেটের ওপর পিতলের বড় ফুলদানিতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। জানলার পরদাগুলি সব নতুন।

পাম্পশু খুলে প্রৌঢ়টি বসলেন কার্পেটে–চিররঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে একটি তাকিয়া এগিয়ে দিলেন। তাতে হেলান দিয়ে বসে প্রৌঢ় বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কন্যা আপনার?

বড়বাবু বললেন, আজ্ঞে না। আমিও এ বাড়ির জামাই। চিররঞ্জনকে দেখিয়ে বললেন, ইনি পাত্রীর কাকা। পাত্রীর বাবা একটু বাদেই এসে পড়বেন।

প্রৌঢ় বললেন, পাত্র আমার মেজভাইয়ের বড়ছেলে।

বড়বাবু বললেন, ও হ্যাঁ, আপনার কথা শুনেছি। মহাশয়ের নামই তো রাজীবলোচন হালদার?

হ্যাঁ। কালীঘাটের হালদারদের কেউ নই। আমরা নেবুবাগানের হালদার–আমাদের তিনপুরুষ ধরে আয়না কাঁচের কারবার।

আপনার জন্য একটু চা? কিংবা শরবত?

এখন না, এখন না—

রাজীবলোচন আবার ঘড়ি দেখলেন এবং জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। দিনের আলো কমে আসছে–এটা তার একদম পছন্দ নয় মনে হচ্ছে। ইলেকট্রিক আলোয় মেয়ে দেখার ব্যাপারে তাঁর বিশ্বাস নেই। শ্যামলা মেয়েকেও পমেটম পাউডার ঘষে ফরসা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

বড়বাবু ও চিররঞ্জন খানিকটা তটস্থ হয়ে বসে আছেন। একে পাত্রপক্ষ, তাও পাত্রের জ্যাঠামশাই, এঁকে খুশি করার কী কী উপায়–চিন্তা করছেন দু’জনে। ওঁরা আগেই শুনেছেন যে, এই রাজীবনোচন নিঃসন্তান। এঁর বিষয়-সম্পত্তি ওই ভাইপোই পাবে সুতরাং এঁর কথার ওপর কেউ কথা বলবেন না। প্রিয়রঞ্জন জরুরি ব্যবসার কাজে আটকে পড়েছেন–ফিরতে একটু দেরি হবে–পই পই করে বলে গেছেন যেন পাত্রপক্ষের অভ্যর্থনায় পান থেকে চুন না খসে। ও-বাড়ির মেয়েরা একবার দলবেঁধে দেখে গেছে– মোটামুটি পছন্দও হয়েছে–আজ আসছেন বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা–এঁদের মর্জির ওপরেই সব নির্ভর করছে। পাত্র সুদর্শন, বি. এ. ফেল, পৈতৃক ব্যবসা দেখাশুনা করে, প্রচুর সম্পত্তি।

রাজীবলোচন চিররঞ্জনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, মশাইদের আদিবাস কোতায়?

আজ্ঞে, ফরিদপুরে।

কোন মহকুমা?

মাদারিপুর সাব-ডিভিশনে।

কোন গ্রাম? বলুন, বলুন, আমার ও-সব জায়গা ঘোরা আচে।

ফুলবাড়ি, মামুদপুরের পাশেই।

ঘুরিচি, সব জায়গায় ঘুরিচি। বড় এঁদো পচা সব জায়গা। আমরা জানেন তো, বাঙাল বাড়ির সঙ্গে এর আগে কখনও সম্বন্ধ করিনি। আমার মশাই খোলাখুলি কতা। বাঙালদের হালচাল আলাদা–আমাদের আলাদা। তা, এর আগে চোদ্দো-পনেরোটি মেয়ে দেখা হলকারওর সঙ্গেই আমাদের ছেলের কুষ্ঠির মিল হয় না। লগ্ন মেলে তো রাশি মেলে না। এদিকে আমার মায়ের বয়স বিরাশি বছর–তিনি বায়না ধরেছেন যে, নাতির বিয়ে দেখে যাবেন। আপনাদের মেয়ে মানিয়ে চলতে পারবে তো?

চিররঞ্জন বললেন, নিশ্চয়ই! মেয়ে আমাদের ভারী ঠান্ডা। যেমনটি আপনারা শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন।

আমরা কিন্তু বাড়ির বউদের বাপেরবাড়ি পাঠাই না।

তা, মানে, আপনারা যা—

আপনারা শুঁটকি মাছ খান?

বড়বাবু হেসে বললেন, আমি খাই। এ বাড়ির অন্য আর কেউ খায় না। সব বাঙালরা খায় না।

কী পান বলুন তো ওতে? গন্ধে নাড়িভুড়ি উলটে আসে! কুকুর-বেড়ালেও ছোঁয় না। দেশে কি মাছের অভাব আছে যে শুকিয়ে আমসি করে খেতে হবে?

বড়বাবু কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। পাত্রের গুরুত্বপূর্ণ জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে তর্ক করা যায় না। কিছু না বলে তাকিয়ে রইলেন হাসি হাসি মুখ করে।

এই সময় আর একটা গাড়িতে আরও পাঁচ জন এসে উপস্থিত হলেন। এঁদের মধ্যে আছেন পাত্রের বাবা, এক কাকা, ওবাড়ির দুই জামাই ও এক শ্যালক। ভদ্রতা, নমস্কার ও কুশলাদি বিনিময়ের পর খাবার আসতে আরম্ভ করল, প্রথমে সকলের জন্য প্লেটে প্লেটে ফল-বাতাবিলেবু, আম, আনারস, আপেল, খেজুর। তারপর আলাদা প্লেটে লুচি, আলুরদম ও ক্ষীর। আবার আলাদা প্লেটে সন্দেশ, শোনপাপড়ি ও দই। এই বিপুল খাদ্যের অধিকাংশই নষ্ট হল। পাত্রের পেটুক কাকা শুধু নিজের সবকিছু চেটেপুটে খেলেন, বাকিরা নাড়াচাড়া করলেন মাত্র। জ্যাঠামশাইটি শুধু এক টুকরো ফল তুলে মুখে দিলেন। নুচি খেলেই তাঁর অম্বল হয়’– এ কথা জানালেন–এবং অম্বল হলে কী কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়–এসব বিশদ ভাবে আলোচিত হল।

খাবার পর্বের শেষ দিকে উপস্থিত হলেন প্রিয়রঞ্জন। দেরি হবার জন্য ক্ষমা চাইলেন বার বার–এবং সকলকেই আর একটু খাবার মুখে ভোলার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। সম্পূর্ণ নির্লজ্জ ভাবে জানিয়ে দিলেন যে–এই সব খাবারই তাঁর মেয়ের তৈরি। কেউ কোনও প্রতিবাদ করলেন না। মেয়ের সুচকর্ম, রন্ধনপটুতা, সেবাপরায়ণতা সম্পর্কে বিস্তারিত বলার পর প্রিয়রঞ্জন অকস্মাৎ ঘোষণা করলেন, তবে হ্যাঁ, আর একটা কথাও জানানো দরকার। আমার মেয়ে নাচ-গান জানে না। ওসব শেখাবার চল নেই বাড়িতে।

এ-সংবাদে পাত্রের জ্যাঠামশাই বেশ সন্তুষ্ট হলেন। তিনি বললেন, বাড়ির বউ তো আর থিয়েটারে অ্যাকটো করতে যাবে না! ও-সবের দরকারটা কী?

পান চিবোতে চিবোতে আরও কিছু কথা হল। কিন্তু দেনা-পাওনার বিষয়টা ঘুণাক্ষরেও তুললেন না পাত্রপক্ষ। তাঁরা অত কঁচা নন, ওই আলোচনা তারা করবেন নিজের বাড়িতে বসে–যেখানে পাত্রীর বাবা কৃপাপ্রার্থী হয়ে যাবেন। নিজের বাড়িতে বসে দর কষাকষি অনেক সুবিধে।

কিছুক্ষণ পর রাজীবলোচন বললেন, তা হলে এবার—

প্রিয়রঞ্জন ব্যস্ত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! ওরে, পাঠিয়ে দে না—

রাজীবলোচন খুঁত খুঁত করে বললেন, বেলা পড়ে গেল একেবারে–

অন্দরমহলে শ্রীলেখাকে সাজানো শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। আজ দুপুরে তাকে জোর করে ঘুম পাড়ানো হয়েছে–যাতে চোখদুটি বেশ ভরাট দেখায়। স্নান করেছে ব্যাসন ও কাঁচা হলুদ মেখে। পায়ে আলতা, চোখে কাজল, সারা শরীরে ফেস পাউডার। শ্রীলেখার গায়ের রং তেমন ফরসা নয়–কিন্তু আজ এত প্রসাধন তার সর্বাঙ্গের চামড়ার একটা চিক্কণ ঔজ্জ্বল্য এসেছে। তার চক্ষুদুটির চাপা উদবেগের জন্য তাকে আজ আরও মোহময়ী মনে হয়।

শ্রীলেখা এর আগে আরও চার বার বিভিন্ন পাত্রপক্ষের সামনে হাজির হয়েছে। তবু তার লজ্জা ও শঙ্কা কাটেনি। ডাক আসতেই সে যেন কেঁপে উঠল। চেপে ধরল তার মায়ের হাত। তখন শ্রীলেখাকে দু’দিকে দু’জন ধরে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে আসা হল, যেন সে মানুষ নয়, একটা পুতুল।

অন্য মেয়েরা দরজার কাছে এসে থেমে গেল, ভেতরে যেতে হবে শ্রীলেখাকে একা। সে দরজা থেকে দু’পা গিয়ে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, চিবুক বুকে ঠেকানো। অন্য কেউ কিছু বলছে না দেখে বড়বাবুই উঠে গিয়ে তার হাত ধরে এনে বসিয়ে দিলেন।

দরজার ওপাশে মেয়েদের ভিড়। সান্ত্বনাকে শুধু নীচে নামতেই দেওয়া হয়নি তার গায়ের রং বেশি ফরসা–যদি তাকে দেখেই পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে যায়। বাদল হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল–চিররঞ্জন তাকে চোখ দিয়ে বকলেন। বাদল তবু গেল না–দরজার চৌকাঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল।

পাত্রের পেটুক কাকাই প্রথম প্রশ্নটা করলেন। তোমার নাম কী মা?

শ্রীলেখা চুপ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করাতেও শ্রীলেখা উত্তর না দেওয়ায় প্রিয়রঞ্জন একটু চঞ্চল হলেন। বললেন, বল, নাম বল!

শ্রীলেখা কার্পেটের সিংহের দিকে তাকিয়ে খুবই আস্তে আস্তে নিজের নাম বলল।

অনেকেই শুনতে পেলেন না, তবু কেউ অপ্রসন্ন হলেন না। পাত্রীর লাজুকতা তার গুণেরই পরিচয়।

এর পরের প্রশ্নগুলোও মামুলি ধরনের। কোন ক্লাসে পড়ো, ইতিহাস ভালো লাগে না অঙ্ক ভালো লাগে, যুদ্ধ কোন কোন দেশের সঙ্গে বেধেছে ইত্যাদি। শ্রীলেখা অধিকাংশ প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারল না কিংবা লজ্জায় দিল না।

তারপর রাজীবলোচন মূল ভূমিকা নিয়ে ফেললেন। রাজীবলোচনের কথায় নম্রতা বা বিনয় নেই। তিনি প্রথমেই ভূমিকা করলেন, ছেলেমেয়ে হলে মায়ের কাছ থেকেই লেখাপড়া শুরু করা দরকার। সেই জন্যই আজকালকার মেয়েদের লেখাপড়া কিছুটা জানা উচিত। এবং লেখাপড়া বলতে ইংরেজিই তো প্রধান। শ্রীলেখা কি এক ডজন ভেড়ার ইংরেজি জানে? এক ডজন জাহাজ?

রাজীবলোচন এমন কড়া গলায় প্রশ্ন করছিলেন যে উত্তর না দিয়ে উপায় নেই। এ যেন ইস্কুলের রাগী মাস্টারমশাই।

এবার বলো তো মা গন্ডার ইংরেজি কী?

রাইনোসেরাস।

রাইনোসেরাস বানান কী?

এটা রাজীবলোচন একটা কাঁচা কাজ করে ফেললেন, কেন না, রাইনোসেরাস, কনসান্স আর হাইজিন–এই বানানগুলো প্রত্যেকেই এসে জিজ্ঞেস করে বলে শ্রীলেখাকে ভালো করে মুখস্ত করিয়ে দেওয়া আছে। এর উত্তর শুনে তৃপ্ত হয়ে রাজীবলোচন বললেন, আচ্ছা বেশ! এবার দু’লাইন বাংলা পদ্য বলছি–পর পর দশবার বলে যাও তো! তাড়াতাড়ি বলো!

জলে চুন তাজা।
তেলে চুল ভাজা!

শ্রীলেখা একবার ঠিকঠাক বলল। তারপর তাড়াতাড়ি বলতে গিয়েই বুঝতে পারল, এটা মোটেই সহজ নয়। জিভ জড়িয়ে যায়। দু-এক বার বলার চেষ্টা করেই শ্রীলেখা মুখ লাল করে চুপ করে বসে রইল।

শ্রীলেখার প্রত্যেকটি ব্যর্থতাই তার গুণপনা বলে গণ্য হল। সেইটাই আসল পরীক্ষা। কেন না, যে-মেয়ে গুরুজনদের সামনে টরটর করে কথা বলে, তার চরিত্র ভালো হয় না। রাজীবলোচন যখন রীতিমতন নরম সুরে শ্রীলেখার সঙ্গে ঘরোয়া কথা আলোচনা করতে লাগলেন, তখন সকলেরই মনে হল, মেয়ে পছন্দ হয়ে গেছে। পাত্রপক্ষ যাবার সময় সেই রকম স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন। অবশ্য পাত্র-পাত্রীর কোষ্ঠী যে একেবারে রাজযোটক– সেটাও খুব বড় কথা।

সূর্য ফিরল সন্ধ্যার পর, যখন বাড়ি থেকে অতিথিরা চলে গেছেন। তার পোশাক-পরিচ্ছদ অত্যন্ত মলিন, চোখ ভেতরে বসা। বাড়ি ফিরে সে কারওর সঙ্গে বিশেষ কথা বলল না, নিজের ঘরে চলে গেল। সূর্য বড়বাবুর হাতে দু-এক দিন মার খাবার পর সবাই তার আশা ছেড়ে দিয়েছে। সে কখন কোথায় যায়কখন বাড়ি ফেরে–এ নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না। বড়বাবু বাড়ি থেকে তখন বেরিয়ে গেছেন। অন্যরা বেশ একটা আনন্দে গল্পে মশগুল। শ্রীলেখার বিয়ে প্রায় ঠিক–এতে তার বাবা-মায়ের মন খুব উৎফুল্ল। শ্রীলেখা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে–আর সান্ত্বনা তাকে খুঁজে খুঁজে রাগাচ্ছে।

বাদল সূর্যর ঘরে গিয়ে বলল, সূর্যদা তুমি এতদিন আসোনি কেন? পরশু আমাদের পাড়ায় টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স সাইকেল রেস হয়ে গেল?

সূর্য জিজ্ঞেস করল, তুই সবটা দেখেছিলি?

হ্যাঁ। সারা রাত জেগে–কত আলো—

মিথ্যে কথা। সূর্য সেটা বুঝতে পেরে হাসল। বাদল ইদানীং বেশ বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলতে শিখেছে। সে দিনেরবেলা ভূত দেখে, রাত্তিরে চাঁদের গায়ে একটা ছায়া নড়তে দেখে, বড়দের গলার আওয়াজ নকল করে অন্যদের চমকে দেয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বাদল সূর্যকে এই ক’দিনের যাবতীয় খবর পরিবেশন করে দিল। সূর্য সম্পর্কে বাড়ির কে কী বলেছে, তা-ও বাদ গেল না। মোক্ষম খবরটি জানাল সবার শেষে। জানো সূর্যদা বড়দির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

সূর্য বিশেষ উৎসাহ দেখাল না। নির্লিপ্ত গলায় বলল, আচ্ছা!

জামাইবাবু না, খুব লম্বা। জ্যাঠামশাই বলেছেন!

হুঁ।

জামাইবাবুদের বাড়িতে তিনটে বড় বড় কুকুর আছে। আমি কিন্তু বরযাত্রী যাব– ছোটরাও যায়। আমি সেদিন কাপড় পরব।

আটটা বাজতে-না বাজতেই সূর্য রান্নাঘরে গিয়ে বলল, ঠাকুর আমার খাবার দাও। একলা একলা খাবার খেয়ে নিয়ে সূর্য আবার নিজের ঘরে ফিরে গেল। অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বলল তার ঘরে। একসময় আলো জ্বেলে রেখেই সূর্য বেরিয়ে গেল তার ঘর থেকে।

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় শ্রীলেখা উঠে এল ছাদে। পাজামা ও গেঞ্জি পরে সূর্য বসে আছে টিনের চেয়ারে রাস্তার দিকে মুখ করে। শ্রীলেখা আস্তে আস্তে তার পেছনে পঁড়াল, সূর্য মুখ ফেরাল না। শ্রীলেখা হাত রাখল সূর্যর কাঁধে, সে তবু নিঃসাড়।

শ্রীলেখা ডাকল, এই?

উঁঃ?

আমার সঙ্গে কথা বলবে না?

কেন?

কথা বলছ না যে?

কী বলব?

তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?

কাজে গিয়েছিলাম।

তোমার সেই জিনিসটা আর আমার কাছে রাখবে না?

তার আর দরকার নেই।

কেন?

তুই তো এ বাড়িতে আর থাকবি না।

বাঃ, আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি বুঝি?

কবে যাচ্ছিস?

সে সব এখনও কিছু ঠিক নেই।

সূর্য চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে ছাদের আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়াল। স্পষ্টত বোঝা যায়, তার মেজাজ ভালো নেই–এমনকী শ্রীলেখার সঙ্গেও সে মনোযোগ দিয়ে কথা বলছে না। হঠাৎ মেঘ সরে গিয়ে আলগা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে সারা শহরে, মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া। এত রাত্তিরেও কোন বাড়িতে কলের গান বাজছে।

শ্রীলেখা সূর্যর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, আমার বিয়ে হচ্ছে বলে তুমি রাগ করেছ?

কেন তোর বিয়ে হবে?

বাঃ হবে না? বাবা, মা—

আমি তোকে বিয়ে করব।

শ্রীলেখার মুখখানা অরুণবর্ণ হয়ে গেল। চাপা গলায় ধমক দিয়ে বলল, কী পাগলের মতো যা-তা বকছ?

অন্য কেউ বিয়ে করতে পারে, আর আমি পারি না?

অন্য কেউ আর তুমি বুঝি এক?

কাজি ক্যান অলওয়েজ ম্যারি।

এটা বিলেত পাওনি।

লোকে যেমন বেড়ালছানা আদর করে, সূর্য এক হাতে সেই রকম ভাবে শ্রীলেখার কোমর আঁকড়ে ধরল। তারপর বলল, শ্রীলেখা, তোকে যদি অন্য কেউ বিয়ে করে, তা হলে আমি গুলি করে তার মাথার খুলি উড়িয়ে দেব!

সূর্যদা, প্লিজ, এ রকম অদ্ভুত কথা বোলো না। আমার ভয় করে। তোমার সেই জিনিসটা আমার কাছে দিয়ে দাও।

সূর্য শ্রীলেখাকে টেনে সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, আমি সত্যি মেরে ফেলব! বিশ্বাস কর! একটু বানিয়ে বলছি না!

শ্রীলেখা কোনও উত্তর দেবার আগেই সূর্য তার ডান হাতের তর্জনি শ্রীলেখার ঠোঁটে ঠেকাল। তারপর আঙুলটা শ্রীলেখার সারা মুখে বোলাতে লাগল–যেন সে কোনও ছবি আঁকছে। শ্রীলেখা কোনও বাধা দিল না। সে বিহ্বল ভাবে চেয়ে রইল সূর্যর মুখের দিকে।

সূর্য আঙুল দিয়ে শ্রীলেখার কচি পেয়ারার মতন থুতনিটা উঁচু করে ধরে চেয়ে রইল, দু’-এক মুহূর্ত–তারপর সেখানে নিজের ঠোঁট চেপে চুষতে লাগল। শ্রীলেখা এস্তে তাকাল ছাদের সিঁড়ির দিকে।

সিঁড়ির পাশেই বড়বাবুর ঘর। বড়বাবু নিশ্চিত ঘুমিয়ে পড়েছেন এতক্ষণে কিন্তু যে-কোনও মুহূর্তেই তো জেগে উঠতে পারেন। শ্রীলেখা প্রাণপণে চেষ্টা করল জানলার সীমানা থেকে সরে যাবার। কিন্তু সূর্যর বজ্রমুষ্টি ছাড়াবার সাধ্য কী তার! থুতনি ছেড়ে সূর্য শ্রীলেখার গলায় ঠোঁট নিয়ে এল–তারপর আরও নীচে। শ্রীলেখা জোরে শব্দ করতেও পারছে না। আঁচল সরিয়ে শ্রীলেখার বুকে মুখ গুঁজে সূর্য বলল, তোর বুকে কী সুন্দর গন্ধ!

সূর্যদা ছেড়ে দাও!

তোকে আমি এক্ষুনি বিয়ে করব।

শ্রীলেখার বুকের জামা জোর করে টেনে খুলে ফেলে সূর্য অদ্ভুত ব্যগ্র ভাবে তাকিয়ে রইল সে-দিকে। যেন সে কোনও মানুষের শরীর দেখছে না–দেখছে কোনও অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। এক জোড়া অনাস্বাদিত ফল, অল্প অল্প কম্পমান। যেন নরম’ শব্দটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে তার চোখের সামনে। এর থেকে বেশি কোমলতা আর কোথায় আছে পৃথিবীতে?

খুব আলতো ভাবে সূর্য সেখানে হাত রাখল, আঙুল দিয়ে ছবি আঁকতে লাগল, মধুর উত্তাল তার রং। জিভটা নিয়ে এসে ছোঁয়াল, তাও খুব আলতো ভাবে। ফিসফিস করে বলল, আমি তোকে বিয়ে করব।

দিশেহারা হয়ে শ্রীলেখা বসে পড়ল মাটিতে। ভারী অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে বলল, সূর্যদা, আমি ঠিক মরে যাব!

সূর্যও বসে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। শ্রীলেখাকে নিজের বুকের ওপর টেনে এনে পাগল হয়ে গেল। শ্রীলেখার শাড়ি-সায়া-ব্লাউজের বন্ধন ছাড়াবার জন্য এলোমেলো চেষ্টা করে বার বার বলতে লাগল, আমি তোকে বিয়ে করব! আমি তোকে বিয়ে করব! এক্ষুনি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *