কয়েকজন বন্ধু ও ভক্ত পরিবৃত হয়ে সুরেন্দ্রনাথ তাঁর বৈঠকখানায় নানান আলোচনায় ব্যস্ত, এই সময় ভৃত্য এসে জানাল যে একজন আগন্তুক তাঁর দর্শনপ্রার্থী। সকাল থেকেই বহু ধরনের মানুষ আসে তাদের অভাব-অভিযোগের কথা শোনাতে, সুরেন্দ্রনাথ কারুকেই ফেরান না। সকলের সমস্যা দূর করার ক্ষমতা তাঁর নেই, তবু মন দিয়ে শুনে দু-একটা পরামর্শ দিলেই অনেকে সান্ত্বনা পায়। সুরেন্দ্রনাথ ভৃত্যটির দিকে সম্মতিসূচক মাথা হেলালেন।
অল্প পরেই দ্বার দিয়ে প্রবেশ করল সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যক্তি। তার চেহারা ও পোশাকে ঠিক যেন সামঞ্জস্য নেই। বয়েস মনে হয় ছাব্বিশ-সাতাশ, কৃশকায় শ্যামলা রং, সারা মুখে বড় নাকটিই বেশি চোখে পড়ে, পরনে সাহেবি পোশাক, পাক্কা থ্রি পিস সুট, কিন্তু মাথায় একটি বিশাল পাগড়ি। যুবকটি হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে একটি ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিল সুরেন্দ্রনাথের দিকে।
দেখলেই বোঝা যায় যে যুবকটি বাঙালি নয়, তাই সুরেন্দ্রনাথ তাকে একটি চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?
লোকটি বেশ ধীরে সুস্থে গুছিয়ে বসল। তারপর নম্র, শান্ত গলায় বলল, আমি একটি বিশেষ কাজের উদ্দেশ্যেই আপনার কাছে এসেছি বটে, কিন্তু প্রথমত আমি আপনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই। আমি দূর থেকে আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনি একজন অসাধারণ বাগ্মী। দেশের মানুষ আপনার কাছ থেকে প্রেরণা পায়।
প্রশংসা শুনতে সকলেরই ভাল লাগে, কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ এই ধরনের কথা প্রতিনিয়তই শুনতে পান। অনেকেই এসে এইভাবে কথা শুরু করে, তারপর ব্যক্তিগত কোনও সংকটের কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে বলতে অনেকখানি সময় নিয়ে নেয়।
সুরেন্দ্রনাথ এবার ভিজিটিং কার্ডটি দেখলেন। নাম এম কে গান্ধী, তলায় লেখা বার-আট-ল। নামটি তো সম্পূর্ণ অচেনা বটেই, লোকটি একজন ব্যারিস্টার জেনেও সুরেন্দ্রনাথ কোনও আগ্রহ বোধ করলেন না। ইদানীং ব্রিফ-লেস ব্যারিস্টারের সংখ্যা প্রচুর বেড়েছে, সচ্ছল পরিবারের ছেলেরা বিলেতে দ-তিন বছর কাটিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে আসে। কোনও রকমে ইংরিজি বলতে পারা আর সাহেবি ধরনের খানা-পিনা করতে শেখাটাই ব্যারিস্টার হবার প্রধান যোগ্যতা। এই লোকটির ঠিকানা লেখা আছে নাটাল, দক্ষিণ আফ্রিকা। ও দেশে তো ভারত থেকে নিয়মিত শ্ৰম-দস পাঠানো হয়, ইংরেজরা যাদের বলে কুলি। এই লোকটি তা হলে সেইসব কুলিদের ব্যারিস্টার।
কথায় কথায় গান্ধী নামে যুবকটি জানাল যে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সে সেখানকার সম্পাদক।
এতেও সুরেন্দ্রনাথ আকৃষ্ট বোধ করলেন না। কংগ্রেসের সংগঠন বেশ অগোছালো, বড় বড় কয়েকটি শহরে একটি করে কমিটি থাকলেও সমস্ত রাজ্যে, কিংবা জেলাস্তরে নানা রকম অব্যবস্থা। বছরে একবার কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদান করার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, আঞ্চলিক প্রতিনিধি সাজার জন্য অনেকে নিজ নিজ এলাকায় কংগ্রেসের শাখা গঠন করে, নিজেরাই সভাপতি, সম্পাদক বনে যায়। কংগ্রেস অধিবেশনের সময় এইসব উটকো প্রতিনিধিদের আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বছরের অন্য সময় এদের কোনও পাত্তাই পাওয়া যায় না।
নামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস হলেও এই কংগ্রেস এখনও প্রকৃতপক্ষে সর্বভারতীয় সংস্থা হয়ে উঠতে পারেনি। বোম্বাই-কলকাতা-মাদ্রাজেই অনেকখানি সীমাবদ্ধ। দক্ষিণ আফ্রিকা ভারতেরবাইরে এবং অনেক দূরে, সেখানকার কংগ্রেসের শাখা নিয়ে কে মাথা ঘামাতে যাবে!
সুরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ গান্ধী, আপনি ঠিক কী প্রয়োজনে আমার কাছে এসেছেন, তা বুঝতে পারলাম না তো!
গান্ধী তার কোর্টের পকেট থেকে একটি ছোট্ট পুস্তিকা বার করল, সেটাতে সবুজ মলাট দেওয়া। পুস্তিকাটি সুরেন্দ্রনাথের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনি যদি এটা দয়া করে পড়ে দেখেন।
সুরেন্দ্রনাথ পুস্তিকাটি হাতে নিলেন বটে কিন্তু উল্টেও দেখলেন না। এক্ষুনি পড়তে হবে তার কোনও মানে নেই। তিনি গান্ধীর দিকে সরাসরি চেয়ে থেকে যেন বলতে চাইলেন, এহ বাহ্য, আগে কন্তু আর।
গান্ধী বলল, হ্যাঁ, এবার আসল কাজের কথাটা বলি। মিঃ বানার্জি, আমি একটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই। আপনি একটি জনসভা সংগঠনের ব্যবস্থা করুন, সেখানে আমি দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের অবস্থা সবাইকে জানাব। সেখানকার ভারতীয়রা যে কতরকমভাবে বর্ণবৈষমোর শিকার, কত অবিচার হয় তাদের ওপর, সে সব বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে।
সুরেন্দ্রনাথ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। এই পাগড়ি পরা উটকো ব্যারিস্টারটির দাবি তাঁর কাছে অনেকটা স্পর্ধার মতন শোনাল। তিনি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অতিশয় ব্যস্ত মানুষ, একটা কলেজের অধ্যক্ষ, বেঙ্গলি নামে পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব, তা ছাড়া কংগ্রেসের অনেক কাজের ভার তাঁর ওপর, তিনি একটি অজ্ঞাত কুলশীল ব্যক্তির জন্য সভার ব্যবস্থা করতে যাবেন?
সুবেন্দ্রনাথ নীরসভাবে বললেন, আমি তো সভা সংগঠন করি না, অনারা সভা ডেকে অনুরোধ জানালে আমি সেখানে বক্তৃতা দিই।
গান্ধী বলল, আমি তো এখানে কারুকে চিনি না, আমার পক্ষে সভা ডাকা সম্ভব নয়। আপনি স্বনামধন্য পুরুষ, সেই জন্যই আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি।
সুরেন্দ্রনাথ বললেন, সভা ডাকা হলেই যে লোকে শুনতে আসবে তার কি কোনও মানে আছে? গান্ধী বলল, আমি বোম্বাই, পুণা ও মাদ্রাজে কয়েকটি সভায় এ বিষয়ে বলেছি, লোকে মন দিয়ে শুনেছে। আমার এই পুস্তিকাটিও লোকে আগ্রহের সঙ্গে পড়ে দেখেছে। কলকাতার মতন একটি প্রাণবন্ত শহরের মানুষ দূরের আত্মীয়দের সম্পর্কে জানতে চাইবে না?
সুবেন্দ্রনাথ আর অসহিষ্ণুতা গোপন করতে পারলেন না। শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, মিঃ গান্ধী, এ বিষয়ে আমি আপনাকে কোনও সাহায্য করতে পারছি না। আপনি রাজা পিয়ারীমোহন মুখার্জি কিংবা মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, এই ধরনের ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করুন। এবা প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন পরিচালনা করেন, এঁরা ইচ্ছে করলে সভা-টুভা ডাকতে পারেন।
সুরেন্দ্রনাথ স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেও গান্ধী তৎক্ষণাৎ স্থানত্যাগের ইচ্ছে প্রকাশ করল না। সে পকেট থেকে একটি নোট-বুক বার করে বলল, কী কী নাম বললেন, আমি একটু লিখে নিই? ওদের ঠিকানা?
সুরেন্দ্রনাথ তাঁর এক সহচরের দিকে নির্দেশ করে বললেন, ওর কাছ থেকে জেনে নিন, আমি একটু ব্যস্ত আছি।
তারপর তিনি পাশ ফিরে রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেবের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে দিলেন।
সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল গান্ধী। সে উঠেছে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে, এখান থেকে বেশ দুর, কিন্তু সে হাঁটতে ভালবাসে। না হেঁটে ঘুরলে একটা শহরকে ঠিকমতন চেনাও যায় না।
কলকাতা শহরে প্রকৃতপক্ষে এই তার প্রথম আসা। এর আগে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরার সময় জাহাজ এসে ভিড়েছিল কলকাতা বন্দরে। কিন্তু সেখানে নেমেই সে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরেছিল, শহরের কিছুই দেখা হয়নি!
এবারে সে হেঁটে হেঁটে ঘুরছে এই শহরের নানান অঞ্চলে। বড় সুন্দর এই শহর, পথ-ঘাট পরিচ্ছন্ন, রাজপথের দৃধারের বাড়িগুলির গড়ন নানারকম, ঝকঝকে রং করা, যেন নতুনের মতন। মাঝে মাঝে উদ্যান ও জলাশয়। এত জুড়িগাড়ি সে ভারতের আর কোনও শহরে দেখেনি।
এ শহরটিকে ঠিক জনবহুল বলা যায় না। কোনও কোনও অঞ্চলে রাস্তায় বেশ কিছু পথচলতি মানুষ দেখা গেলেও কোনও কোনও অঞ্চল একেবারে ফাঁকা। অধিকাংশ বাড়ির সঙ্গে কিছুটা খালি জমি কিংবা বাগান, যেগুলি খুব বড় বাড়ি, ধনীদের প্রাসাদ, সেগুলির বাগানে বিভিন্ন মর্মরমূর্তি ও ফোয়ারা। এক-একটি রাস্তায় গিয়ে গান্ধীর চমক লেগে যায়, মনে হয় অবিকল লন্ডন শহরের মতন। এসপ্লানেডের ময়দান আর লন্ডনে হাইড পার্কও যেন একই রকম।
গান্ধীর যেখানে জন্ম, গুজরাতের সেই পোরবন্দর কলকাতা থেকে বহু দূরে, বলা যেতে পারে ভারতের দুই প্রান্তে। তবু সেখানে বসেও কলকাতার অনেক গল্প সে শুনেছে ছেলেবেলায়। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা, আধুনিক শিক্ষার পীঠস্থান। ব্যবসা বাণিজ্যেও যেমন উন্নত, তেমনি কত রকম সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়েছে এখান থেকে। রাজা রামমোহন, দ্বারকানাথ, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এঁদের নাম সারা ভারতে কে না জানে! বাঙালি যুবকরা কত রকম সংস্কারের বেড়ি ভেঙেছে বহু বছর আগে, তার ঢেউ সুদুব গুজরাতেও গিয়ে লেগেছে।
হাঁটতে হাঁটতে গান্ধীর মনে পড়ল তার স্কুলজীবনের কথা। হাই স্কুলে পড়তে পড়তেই তার বিয়ে হয়ে যায় এক অক্ষরজ্ঞানহীনা বালিকার সঙ্গে। তাতে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও প্রশ্ন ছিল না। কাথিয়াওয়াড়ের সামাজিক রীতিতেই বাড়ির লোকরা তার বিয়ে দিয়ে দেয়। ইস্কুলের উঁচু ক্লাসে সে যখন পড়তে যাচ্ছে, তখন সে বীতিমতন একজন স্বামী। সেই সময়ে তার একজন বন্ধু বাল্যবিবাহ নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করত, শুধু তাই নয় গুজৱাতিদের নিরামিষ খাওয়ার অভ্যেসও তার কাছে মনে হত হাস্যকর। সে বলত, মোহনদাস, নিরামিষ খাই বলেই আমরা এত দুর্বল আর আমিষাশী ইংরেজরা সবল বলেই আমাদের শাসন করে। আমাদের কবি নর্মদই তো লিখেছেন,
Behold
the mighty Englishman
He rules the Indian Small
Because being a meat-eater
He is five cubits tall…
সুতরাং ইংরেজদের সমকক্ষ হতে গেলে আমাদেরও মাংস খেতে হবে, মদ্যপান করতে হবে। বাঙালি শিক্ষিত সমাজ তা কত আগেই শুরু করেছে। ইয়ং বেঙ্গল প্রকাশ্যে আহার করেছে গোমাংস, বাবার সঙ্গে এক টেবিলে বসে ঠোকাঠুকি করেছে মদের গেলাসে। সেই দৃষ্টান্তে গুজরাতেও অনেকে মদ্য-মাংস গ্রহণ করছে। বন্ধুটি বোঝাল, স্কুলের শিক্ষকরাও কেউ কেউ এখন ওসব খায়, ছাত্ররাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন?
সংস্কারমুক্ত হবার জন্য গান্ধী সেই বন্ধুটির কথায় উৎসাহের সঙ্গে সায় দিয়েছিল। নদীর ধারে একটি নির্জন জায়গায় একদিন হল সেই আধুনিকতার দীক্ষা। এর আগে গান্ধী কখনও রান্না মাংস চোখেই দেখেনি। পাঊরুটি জিনিসটাও তার কাছে নিষিদ্ধ বস্তু। জন্মের পর থেকেই শুধু নিরামিষ খাবারে অভ্যস্ত, প্রথমবার পাঊরুটি বা মাংস কিছুই তার ভাল লাগেনি, প্রায় বমি এসে গিয়েছিল, সারা রাত দুঃস্বপ্ন দেখেছে। একটা জ্যান্ত ছাগল যেন ঠুসোর্টসি করছে পেটের মধ্যে। কিন্তু সংস্কার ভাঙার উত্তেজনায় ক্রমশ সে অভ্যস্ত হয়ে উঠল, মাংস-পাঊরুটি ভালই লাগতে লাগল। এক বছর ধরে সে এসব খেয়েছে লুকিয়ে লুকিয়ে।
শুধু এইটুকুই নয়, বন্ধুটি তাকে নিয়ে গিয়েছিল আর এক ধাপ এগিয়ে। নৈতিকতাও তো একটা সংস্কার। বিয়ে করেছে তো কী হয়েছে, তা বলে কি অন্য রমণীর সংসর্গ উপভোগ করা যাবে না?
বন্ধুটি একদিন কিশোর গান্ধীকে নিয়ে গিয়েছিল এক বেশ্যালয়ে। সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে বন্ধুটি একা তাকে ঢুকিয়ে দিল একটি স্ত্রীলোকের ঘরে। গান্ধী ধীর পায়ে তার খাটের এক পাশে বসল। তার সারা শরীর কাঁপছে, কিন্তু লজ্জায় সে নারীটির মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। এমনিতেই সে লাজুক, তখন একটাও কথা ফুটছে না তার মুখে। নারীটি বলল, কী গো, ঘরে এসেছ, একবার আমার মুখের পানে চাও। আমিও তোমার বনখানি একটু দেখি। মেয়েটি দুতে এলে গান্ধী সরে সরে বসে, কোনও কথাই বলে না। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে মেয়েটি তাকে ঘর থেকে বার করে দেয়।
গান্ধীর ধারণা, সেদিন ঈশ্বর তাকে রক্ষা করেছেন। ঈশ্বরের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। তবু সেদিনের সেই ঘটনার কথা মনে পড়লে গ্লানিতে তার মন ভরে যায়। বেশ্যাটির সঙ্গে তার শারীরিক সংসর্গ ঘটেনি বটে, কিন্তু সে তো স্বেচ্ছায় ওই ঘরে ঢুকে খাটে বসেছিল। অর্থাৎ তার মনের মধ্যে লোভ ও কাম ছিল ঠিকই। এর পরেও আর একবার, ইংলন্ডে থাকার সময় সে আর এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে বারবণিতালয়ে গিয়েছিল, সেবারেও শেষ পর্যন্ত কিছু ঘটেনি, ঈশ্বর তাকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু দুবারই সে যে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাও ঠিক।
গান্ধী এখন আবার সম্পূর্ণ নিরামিষাশী। আধুনিকতার সঙ্গে মাছ-মাংস খাওয়ার যে কোনও সম্পর্ক নেই, তা সে বুঝেছে। তবে, আমিষ সে বর্জন করে সত্যের খাতিরে। মাংস জিনিসটা যখন তার বেশ মুখরোচক হয়ে উঠেছিল, তখনও তার মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করত। বাড়ির কেউ কিছু জানে না, সব কিছুই চলছিল গোপনে। কোনও দিন জানতে পেরে মা যদি সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, তা হলে সে কী উত্তর দেবে? অল্প বয়েস থেকেই গান্ধী নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে, কখনও, কোনও অবস্থাতেই সে মিথ্যে কথা বলবে না। মাকেও সে মিথ্যে কথা বলতে পারবে না। আর সত্য কথা স্বীকার করলে মা প্রচণ্ড আঘাত পাবেন। সেই কথা ভেবেই সে তার আমিষ-আহারের গোপন অভিযান বন্ধ করে দিয়েছিল। বিলেতে যাবার সময় সে তার মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল, কখনও মদ্য পান করবে না, মাছ-মাংস স্পর্শ করবে না, কোনও রমণীর ঘনিষ্ঠ হবে
গান্ধীর বিলেত যাওয়াটা অনেকটা আকস্মিক।
ম্যাট্রিক পাস করার আগেই তার বাবার মৃত্যু হয়, সংসারের অবস্থাটা খারাপ হয়ে যায়। তার পিতা-পিতামহরা দেশীয় বাজ্যের দেওয়ানি করেছে, কিন্তু এখন সেই পদের জন্য অনেক উমেদার। বি.এ পাস করা ছেলেরা বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। গান্ধী ভাবনগর কলেজে ভর্তি হয়েছে, সেখানেও শহুরে ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সে পিছিয়ে পড়ছে। তার ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট। এই সময় তাদের এক পারিবারিক বন্ধু এসে তার মাকে বললেন, ছেলেকে সাধারণ বি এ পাস করিয়ে আজকালকার দিনে কোনও লাভ নেই। বিলেত গিয়ে বরং ব্যারিস্টার হয়ে আসুক। ব্যারিস্টারি পাস করা সহজ, বছর তিনেক থাকতে হবে, সব মিলিয়ে খরচ পড়বে বড় জোর চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। বিলেত থেকে ফিরে এসে সাহেবি আদর কায়দায় থাকবে, তখন যে-কোনও দেশীয় রাজ্য ওকে দেওয়ানি দেবার জন্য লুফে নেবে। গান্ধীর দাদাও উৎসাহ দিলেন, কোনওক্রমে টাকার জোগাড়ও হয়ে গেল।
প্রায় একটি গ্রাম্য কিশোব হিসেবেই বিলেত গিয়েছিল গান্ধী। ইংরিজি বলতে পারে না, ঠিকমতন পোশাক পরতে জানে না। ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত কিছু কিছু গুজরাতি ব্যক্তির ঠিকানা ছিল তার কাছে। তাঁরাই প্রথম প্রথম তাকে সাহায্য করেন গুছিয়ে নিয়ে বসতে। ডাক্তার মেহতা নামে একজন তাকে শেখালেন, অন্য লোকের টুপি বা পোশাকে হাত দেবে না, লোকের সামনে হাই কিংবা সেঁকুর তুলবে না, শব্দ করে চা খাবে না, চেঁচিয়ে কথা বলবে না। আমাদের দেশের মতন প্রথম আলাপেই কারুকে কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবে না, কারুকে স্যার বলবে না ইত্যাদি।
বিলেতে কয়েক বছরেই গান্ধীর মধ্যে একটা বিপুল পরিবর্তন আসে। যত্ন করে, মন দিয়ে সে ইংরিজি শোখে। পৃথিবীটাকে জানবার জন্য নানা রকম বই পড়ার আগ্রহ জন্মায়, বিলিতি পপাশাক-পরিচ্ছদ ও আদর-কায়দা রপ্ত করে, এমনকী নাচতেও শেখে। ব্যারিস্টারির জন্য পড়াশুনো করতে হয় না বিশেষ, বারবার ইংরেজদের সঙ্গে খানা খেতে হয় আর সহবত শিখতে হয়, পরীক্ষায় বসলেই পাস করা যায়।
যথাসময়ে পাস করে দেশে ফিরে এল গান্ধী। ইংল্যান্ডে থাকার সময় সে ইংরেজদের ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছে এবং ইংরেজ জাতির ভক্ত হয়ে গেছে। তার ধারণা, ইংরেজদের শাসন ভারতের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয় এবং উপকারী। রাজভক্ত প্রজা হিসেবে ভারতীয়দের উচিত ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা। ইংরেজদের অত্যাচারের অনেক কাহিনী সে জানে, সে নিজেও প্রত্যক্ষদর্শী বা ভুক্তভোগী, ফার্স্ট ক্লাসের ট্রেনের টিকিট কাটা সত্ত্বেও তাকে সে কামরায় বসতে দেওয়া হয়নি, দক্ষিণ আফ্রিকায় এক রাস্তায় ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার অপরাধে এক ইংরেজ সেপাই তাকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে, তাতেও তার রাগ হয় না, সে মনে করে ওসব কিছু কিছু ইংরেজের ব্যক্তিগত চরিত্রের দোষ, জাতিগত ত্রুটি নয়। অনেক জায়গায় ভারতীয়দের ওপর যে অবিচার বা পীড়ন হয়, সেগুলিও আইনের ত্রুটি বা আইনের অপপ্রয়োগ। আইনসঙ্গত পথেই তার সুরাহা করতে হবে।
গান্ধীর কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই। সে চায় ভারতবাসীরা স্বাস্থ্যরক্ষা ও পরিচ্ছন্নতার আদর্শ শিখুক, সততা, নিয়মানুবর্তিতা ও কর্তব্যকর্মকে ধর্ম জ্ঞান করুফ, তা হলেই ইংরেজরা আর ভারতীয়দের নিচু চোখে দেখবে না। দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের সে সাধ্যমতন এই সবই শেখাচ্ছে। সংঘবদ্ধ হওয়াটাও সভ্যতার লক্ষণ, তাই সে দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের নিয়েও একটি সমিতি স্থাপন করেছে এবং সেই সমিতির অন্য কিছু নাম দেবার বদলে কংগ্রেস নামটাই নিয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের সম্পর্কে মূল ভারত ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষদের তো বটেই, জননেতাদেরও বেশ ভুল ধারণা আছে। সবাই মনে করে, ওখানে বুঝি কুলি কামিন ছাড়া আর কোনও ভারতীয় নেই। হ্যাঁ, শ্রমদাস হিসেবেই এক সময় ভারতীয়দের ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক মানুষ বুদ্ধিবলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে, জমি বাড়ি কিনেছে, ব্যবসা বাণিজ্যও শুরু করেছে। কোনও কোনও ব্যবসায়ী এমনই প্রতিপত্তিশালী যে নিজস্ব জাহাজ পর্যন্ত চালায়। ইংরেজরা ভেবেছিল কুলিরা চিরকাল কুলিই থাকবে, ওখানকার আদিবাসী জুলু সম্প্রদায়কে তারা সেইভাবেই দেখতে অভ্যস্ত, ভারতীয়দের এই রকম সমৃদ্ধি, বিশেষত ব্যবসায়ের প্রতিযোগিতা তাদের চক্ষুশূল হয়েছে। এখন তারা নানান পাকেপ্রকারে ভারতীয়দের দমন করতে চায়, আর ভারতীয়দের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে গান্ধী প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিকারের জন্য সরকারের কাছে সবিস্তারে দরখাস্ত পাঠায় কিংবা আদালতে মামলা লড়ে। যদিও তার তরুণ বয়েস, তবু সে কখনও উত্তেজিত হয় না, তার শরীরে যেন রাগ নামে ব্যাপারটাই নেই, সে ধৈর্য ধরে ঠিকঠাক নিয়মসত পথে অগ্রসর হয় এবং বেশ কয়েক জায়গায় সে শেষ পর্যন্ত জয়ীও হয়েছে।
এই সব বৃত্তান্তই সে এখন ভারতের নানা অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে জানাতে চায়। সমস্ত বিষয়েই ইংরেজ সরকারের নির্দিষ্ট আইন আছে, আইনের পথেই মোকাবিলা করলে যে অনেক অধিকার আদায় করা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় তা প্রমাণিত হচ্ছে, এখানকার ভারতীয়রাই বা তা জানবে না কেন?
গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে ফিরে এসে মধ্যাহ্নভোজন সেরে গান্ধী আবার একটি ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে চলল উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করা যত সহজ, রাজা-মহারাজাদের দেখা পাওয়া অত সহজ নয়। প্যারীমোহন অতিশয় ব্যস্ত মানুষ, শুধু জমিদার নন, সার্থক আইনজীবী এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্তাব্যক্তি। সেদিন দেখা হল না, বিমুখ হয়ে ফিরে এসেও নিরুদ্যম হল গান্ধী, পরের দিন আবার গেল উত্তরপাড়ায়। প্যারীমোহন সংক্ষেপে ব্যাপারটা শুনসেন বটে, কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। তিনি বললেন, কেউ এসে বললেই কি হঠাৎ হুট করে মিটিং ডাকা যায়? আপনি বরং সুরেন বাড়জ্যের সঙ্গে দেখা করুন, তিনি যদি কিছু করতে পারেন।
যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরও ওই একই কথা বললেন। গান্ধীর মনে হল, সুরেন্দ্রনাথের কাছে আবার ফিরে যাবার কোনও মানে হয় না। তিনি স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন। তা হলে কী উপায়?
গ্রেট ইস্টার্ন হোটলে একজন ইংরেজ সাংবাদিকের সঙ্গে তার আলাপ হল। লোকটির নাম এলারধর্প, লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিনিধি। বিলেত ফেরত এই ব্যারিস্টারটির সঙ্গে এই সাংবাদিকটি কথা বলার অনেক বিষয় পেয়ে গেল। এলারথ ওই হোটলে লাঞ্চ খেতে এসেছিল, কিন্তু সে উঠেছে বেঙ্গল ক্লাবে। সে সেখানে গান্ধীকে নেমন্তন্ন করল পরদিন। কিন্তু হোটেল আর ক্লাবের মধ্যে অনেক তফাত আছে। বেঙ্গল ক্লাবে ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ। এলারথর্প সস মনে গান্ধীকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকতে যাচ্ছে, একজন এসে বলল, ওই নেটিভটিকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না! এলারথর্প হকচকিয়ে গিয়ে বলল, ভারতের মাটিতে এই ক্লাব, অথচ সেখানে একজন ভারতীয় ঢুকতে পারবে না, এ আবার কী অদ্ভুত নিয়ম! তা ছাড়া এই নেটিভ ভদ্রলোকটি ইউরোপীয় আদর-কায়দায় সম্পূর্ণ অভ্যস্ত!
কিন্তু নিয়ম হচ্ছে নিয়ম! রাগে গজগজ করতে করতে এলারথর্প বলল, ঠিক আছে, ড্রয়িং কম বা ডাইনিং রুমে ওর প্রবেশ নিষেধ হলেও আমার ঘরে নিশ্চিত আমি যাকে ইচ্ছে নিয়ে যেতে পারি!
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে এলারথ বলল, এ দেশের ইংরেজগুলি দেখছি চাষা!
গান্ধী মৃদু হাসল। ইংরেজ জাতির মধ্যে যেমন বেঙ্গল ক্লাবের কর্মচারীটির মত মাথামোটা লোক আছে, তেমনি এলারথর্পের মতন মানুষও তো আছে। সেই জন্যই তো ইংরেজ জাতির প্রতি তার কোনও বিদ্বেষ নেই।
এই এলারথর্পের সুত্রেই গান্ধীর পরিচয় হল স্থানীয় পত্রিকা দা ইংলিশম্যানের সম্পাদক মিঃ সন্ডার্সের সঙ্গে। সল্ডার্স গান্ধীর লেখা পুস্তিকাটি পড়ে ঠিক করল, সে এই দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যারিস্টারটির একটি সাক্ষাৎকার নিজের কাগজে ছাপাবে। দক্ষিণ আফ্রিকা বিষয়ে এখানকার পাঠকরা কিছুই জানে না। সাক্ষাৎকার নিতে নিতে সম্ভার্স মাঝে মাঝে অবাক হয়ে তাকাতে লাগল গান্ধীর দিকে। এই যুবকটির কণ্ঠস্বর নিরুত্তাপ তো বটেই, এমনকী দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের সম্পর্কেও কিছু কিছু ভাল কথা বলে যাচ্ছে। সন্ডার্স জিজ্ঞেস করল, মিঃ গান্ধী, তুমি শ্বেতাঙ্গদের অবিচার ও অত্যাচারের কথা জানাতে গিয়ে ওদের পক্ষ নিয়েও যে বলে ফেলছ মাঝে মাঝে।
গান্ধী মুচকি হেসে বলল, আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রতিপক্ষের কিছু কিছু প্রশংসা করলে সহজে মামলা জেতা যায়!
ইংরেজদের কাগজে গান্ধীর বক্তব্য প্রকাশিত হবে, অথচ বাঙালিদের কাছে পাত্তা পাওয়া যাবে না? গান্ধী হাল ছাড়তে রাজি নয়। বাঙালিদের সবচেয়ে বিখ্যাত পত্রিকা অমৃতবাজার, রাস্তা থেকে কিনে পত্রিকাটি কয়েকদিন পড়েও দেখেছে গান্ধী। সে একদিন হাজির হল ওই পত্রিকা অফিসে।
অমৃতবাজার পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক মতিলাল ঘোষ কংগ্রেসের একজন পাস্তা এবং সারা ভারতে পরিচিত। তিনি গান্ধীর ভিজিটিং কার্ডটি নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, গান্ধী? এরকম পদবি আগে শুনিনি! আমাদের এই কাগজ ইংরিজি ভাষায় বেরোয় বটে, কিন্তু পড়ে প্রধানত বাঙালিরা। তারা তোমার ওই দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে কেন? যে সব কুলি কামিন আর ব্যবসায়ীরা দক্ষিণ আফ্রিকায় গেছে, তারা গেছে ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে, ঠিক কি না! গুজরাতি, মারাঠি, মাদ্রাজি। বাঙালি একজনও গেছে? তুমি ওখানে একটিও বাঙালি কুলি বা ব্যবসায়ী দেখেছ?
গান্ধী স্বীকার করল, তা দেখিনি বটে!
মতিলাল বললেন, তবে? বাঙালিরা কুলিগিরিও করে না, ব্যবসাও জানে না। সবাই চাকরি চায়, আর না হলে বড়জোর মাস্টারি, ডাক্তারি, ওকালতি! তা বাপু, আমাদের এখানেই সমস্যার শেষ নেই, ওই ধাপধারা গোবিন্দপুর দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্যা নিয়ে আমাদের এখন ব্যস্ত হবার সময় কোথায়।
গান্ধী বলল, কিন্তু তারাও তো ভারতীয়। আর কংগ্রেস ভারতীয়দেরই প্রতিষ্ঠান।
মতিলাল বললেন, তা যখন কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন হবে তখন তোমার কথা সেখানে বলতে চাও তো বোলো। এখন মিটিং-ফিটিং-এর ব্যবস্থা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। গরম গরম কোনও বিষয় না থাকলে লোকে শুনতে আসবেই বা কেন?
গান্ধী বলল, আপনার কাগজেও ছাপবেন না, কোনও মিটিং-এরও ব্যবস্থা করা যাবে না?
মতিলাল বললেন, নাঃ! রাগ করলে নাকি, একটা চুরুট খাও।
গান্ধী সবিনয়ে বলল, ধনবাদ, আমি ধুমপান করি না।
মতিলাল নিজে একটা চুরুট ধরিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ওহে মোহনদাস, তুমি বিলেত-ফেরত ব্যারিস্টার হয়ে হঠাৎ দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতে গেলে কেন? অত দূরে?
গান্ধী বলল, আমি বোম্বাই আর রাজকোটে চেম্বার খুলে বসেছিলাম। পসার জমাতে পারিনি একেবারেই। এ দেশে তো ব্যারিস্টারের অভাব নেই। আমার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছিল। এই সময় আমার বড় ভাইয়ের মারফত দক্ষিণ আফ্রিকার একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবার প্রস্তাব পাই। দাদা আবদুল্লা আল্ড কোম্পানি ওখানকার খুব বড় ব্যবসায়ী, তাদের মামলা-মোকদ্দমা লেগেই থাকে, তারা সাহেব ব্যারিস্টার নিয়োগ করে। ঠিক ব্যারিস্টার হিসেবে নয়, আমাকে প্রায় একটি চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, প্রধানত ইংরিজিতে চিঠিপত্র লেখার কাজ। পরে অবশ্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আমি স্বাধীনভাবে প্র্যাক্টিস শুরু করেছি, ওখানকার অনেকের আস্থা অর্জন করেছি।
মতিলাল বললেন, ওখানে পসার বেশ ভালই জমেছে বোঝা যাচ্ছে। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে এসে উঠেছ, তার মানে পয়সাকড়ি ভালই করেছ। উকিল ব্যারিস্টারি মানে কথা বেচে খাওয়া আর মিথ্যের ফুলঝুরি ছড়ানো। কথার মারপ্যাচে উকিলরা রাতকে দিন করে দেয়। তোমায় দেখলে তো নিরীহ ভালমানুষটি মনে হয়। তুমি কী করে পায়রা?
গান্ধী রেখাহীন মুখে বলল, আমি সারা জীবনে একটাও মিথ্যে কথা বলিনি। আর এ পর্যন্ত একটাও মিথ্যে মামলা নিইনি। যে পক্ষ অন্যায় মামলা করতে চায়, আমি তাদের ফিরিয়ে দিই।
প্রচণ্ড শব্দে অট্টহাস্য করে উঠলেন মতিলাল। হাসতে হাসতে তাঁর কাশি এসে গেল। হাত তুলে কোনওক্রমে বললেন, তুমি তো ভারী মজার মানুষ দেখছি, আর হাসিও না, হসিও না।
ফিরে এসে গান্ধী আবার ভাবতে বসল, এর পর কার কাছে যাওয়া যায়। মুশকিল হচ্ছে, এখানে তার পরিচিত কেউ নেই। তবু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে যখন সে এসেছে, ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবার পাত্র সে নয়।
বোম্বাইয়ের নেতাদের তার কথা বোঝাতে এরকম অসুবিধে হয়নি। বোশ্বইতে সে প্রথম দেখা করেছিল বিচারপতি রানাড়ে এবং বিচারপতি বদরুদ্দিন তায়েবজির সঙ্গে। এরা তার কথা ধৈর্য ধরে শুনে বলেছিলেন, আমরা ঠিক সাহায্য করতে পারব না, তুমি স্যার ফিরোজ শা যেটার কাছে যাও। আমাদের সহানুভুতি রইল, কিন্তু ওঁর সম্মতিটা প্রথমে দরকার।
স্যার ফিরোজ শা মেটাকে লোকে বলে বোম্বাইয়ের সিংহ। কেউ কেউ বলে মুকুটহীন রাজা। দারুন তার প্রভাব-প্রতিপত্তি। গান্ধী ভয়ে ভয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছে, কিন্তু তিনি পিতার মতন স্নেহে গান্ধীকে গ্রহণ করেছিলেন এবং মিটিং-এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
বোম্বাই থেকে গান্ধী গিয়েছিল পুণায়। বাল গঙ্গাধর তিলক এখানকার প্রসিদ্ধ জননেতা। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে কিছুটা খোঁজখবরও রাখেন। তিনি গান্ধীর বক্তব্যের যৌক্তিকতা স্বীকার করে বললেন, গান্ধী, আমি তোমার মিটিং-এর ব্যবস্থা অনায়াসে করে দিতে পারি। কিন্তু এখানে রাজনীতিতে আমার বিরুদ্ধপক্ষ যথেষ্ট আছে। আমি মিটিং-এর ব্যবস্থা করলে তুমি আমার দলের লোক হিসেবে মাকামারা হয়ে যাবে। তাতে পরে তোমার অসুবিধে হতে পারে। তুমি তো রাজনীতির লোক নও, তুমি নিরপেক্ষ কারুকে সভাপতি করো। তুমি ভাণ্ডারকরের কাছে যাও। তিনি আপাতত কোনও দলে নেই।
ভাণ্ডারকরের কাছে যাবার আগে গান্ধী গেল অপর প্রখ্যাত নেতা গোখলের কাছে। গোখলে তখন ফাগুসন কলেজের অধ্যক্ষ, সেই কলেজেই দেখা করতে গেল গান্ধী। আগে থেকেই গোখলের নামডাক শুনেছে গান্ধী, কিন্তু তাঁর কাছে গিয়ে সে বিস্মিত হয়ে পড়ল। এমন শান্ত, সহৃদয় একজন মানুষ, অথচ তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে আছেন। গান্ধীর মনে হল, ফিরোজ শা মেটা যেন হিমালয়, আর তিলক যেন সমুদ্র। কিন্তু গোখলে যেন গঙ্গা নদী। হিমালয় কিংবা মহাসাগর অতিক্রম করা যায় না, কিন্তু গঙ্গা নদী সকলকেই অবগাহনের জন্য আহ্বান জানায়। কিছুক্ষণ কথা বলার পরই গোখলের দারুণ ভক্ত হয়ে গেল গান্ধী।
গোখগেও পরামর্শ দিলেন ভাণ্ডারকরকে সভাপতি করার জন্য। তা হলে ব দলের লোকই আসবে। ভাণ্ডারকর যখন শুনলেন যে তিলক আর গোখন্সের মতন দুই পক্ষের দুই নেতাই তাঁর নাম প্রস্তাব করেছেন, তখন তিনি সম্মতি জানাতে দ্বিধা করলেন না।
মহারাষ্ট্রের এই নেতাদের সুপারিশ নিয়ে মাদ্রাজে গিয়ে সভা করতেও অসুবিধে হয়নি। ওঁদের কাছ থেকেই গান্ধী কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথের নাম শুনে এসেছিল। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথের কোনও আগ্রহ নেই, তা স্পষ্ট বোঝা গেছে।
কলকাতায় কয়েক দিন থাকতে থাকতে গান্ধী জানতে পারল বঙ্গবাসী নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা এখানে খুব জনপ্রিয়। পত্রিকা বেরুনো মাত্র হু হু করে কাটতি হয়ে যায়। তা হলে একবার এই পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করা যাক।
বঙ্গবাসীর কার্যালয়ে গিয়ে গান্ধী বিস্মিত হয়ে গেল। প্রায় তিরিশ-বত্রিশ জন লোক সেখানে লাইন দিয়ে বসে আছে সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করার জন্য। সরকারি অফিসে যেমন লোকে যায়। দু-একজনের সঙ্গে গান্ধী কথা বলে দেখল, তাদের নানারকম ব্যক্তিগত সমস্যা আছে। কারও প্রতি পুলিশ দুর্ব্যবহার করেছে, কেউ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, কারুর সন্তান নিরুদ্দিষ্ট। একজন একজন করে সম্পাদকের ঘরে যাচ্ছে আর বেরিয়ে আসছে দু-এক মিনিটের মধ্যে। এক-একবার সম্পাদকের ঘরে শোনা যাচ্ছে ক্রুদ্ধ চ্যাঁচামেচি। একবার একজন কর্মচারী এসে বলে গেল, সম্পাদকমশাই আজ আর কারুর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। আপনারা আজ বাড়ি যান। কিন্তু কেউ ওঠার লক্ষণ দেখাল না; সবাই বসে রইল গ্যাঁট হয়ে। গান্ধী সেই কর্মচারীটিকে নিজের কার্ড দিয়ে বলল, আমি এসেছি অনেক দুর থেকে।
প্রায় দু ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল, তবু ডাক এল না। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সম্পাদকমশাই যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু, ধুতির কোঁচা লুটোচ্ছে মাটিতে, গায়ে একটি উত্তরীয় জড়ানো। গান্ধী সামনে গিয়ে বলল, মিস্টার বসু, আমি এসেছি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে—
যোগেন্দ্রচন্দ্র দু হাত ছুঁড়ে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে বলে উঠল, না, না, আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। তোমরা কি আমাকে পাগল করে দেবে? সবাই ভাবে, কাগজের সম্পাদক হয়েছি বলেই বুঝি আমাদের অনেক ক্ষমতা, সবার সব সমস্যা সমাধান করে দিতে পারি। আসলে আমার কোনওই ক্ষমতা নেই। কেউ কাজও করতে দেবে না। আমি কিছু শুনব না, কিছু পারব না, তোমরা সব যাও, এখন যাও তো এখান থেকে!
গান্ধীর মতন অক্রোধীও কয়েক মুহূর্তের জন্য অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপরই সহানুভূতি হল সম্পাদকের জন্য। সত্যিই তো, সবাই মিলে এত জ্বালাতন করলে তিনি কাজ করবেন কী ভাবে। এত লোকের ব্যক্তিগত সমস্য; উনি শুনতে যাবেনই বা কেন? গান্ধীর সমস্যাটা যে ব্যক্তিগত নয়, তা উনি বুঝতেও পারলেন না।
আজ আর এই সম্পাদকের কাছে যাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে সে বেরিয়ে এল বাইরে।
বাঙালিদের মনোজগতে কি কিছুতেই প্রবেশ করা যাবে না? দেশের রাজধানী এই কলকাতা, বুদ্ধিজীবীদের প্রধান কেন্দ্র, এখানে সে সম্পূর্ণ অপরিচিতই থেকে যাবে? বাঙালিদের নৈতিক সমর্থন পাওয়া তার পক্ষে জরুরি, কারণ ইংরেজরা বাঙালিদের মতামতের গুরুত্ব দেয়। বাঙালিদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করার বিশেষ কোনও উপায় আছে কী?
এর মধ্যে গান্ধী আরও কয়েকটি নাম সংগ্রহ করেছে। উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি, আনন্দমোহন বসু, জানকীনাথ ঘোষাল, এঁরাও এখানকার বিশিষ্ট নেতা। এঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা করতে হবে, কেউ না-কেউ তার কথা নিশ্চয়ই শুনবে।
হোটেলে ফিরে গান্ধী একটা টেলিগ্রাম পেল। দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান থেকে ডাক এসেছে, ‘পার্লামেন্ট শুরু হচ্ছে জানুয়ারি মাসে। আপনি এক্ষুনি ফিরে আসুন।’
মিটিং-এর ব্যবস্থা কিংবা বাঙালিদের সঙ্গে যোগাযোগ আর হল না, পরদিনই গান্ধীকে রওনা দিতে হল বোম্বাইয়ের দিকে।