1 of 2

২২. ন্যায়-অন্যায়ের যে সূক্ষ্ম সীমারেখা

ন্যায়-অন্যায়ের যে সূক্ষ্ম সীমারেখা রয়েছে, সেটাও কী রকম হঠাৎ হঠাৎ বদলে যায়। পরিস্থিতি অনুযায়ী নতুন যুক্তি খাড়া করতে একটুও দেরি হয় না। একটু দূর থেকে, নির্লিপ্ত দর্শক হিসেবে লক্ষ করলে বোঝা যায়, মানুষের তৈরি করা নিয়মনীতি, বিবেক, আদর্শ–এগুলো শিশুর অযৌক্তিকতা থেকে বেশি দূরে নয়। এমনকী সত্যও এক ও অবিচল হতে পারে না।

যোগানন্দর রহস্যময় অনুপস্থিতিতে সকলের মুখে একটা অশুভ ছায়া পড়ল। যোগানন্দর অসীম সাহস, শারীরিক শক্তিও প্রচণ্ড, সুখী বিলাসী জীবন ত্যাগ করে সে বেরিয়ে এসেছে–অথচ আজ তার ব্যবহারের তো কোনওই ব্যাখ্যা করা যায় না।

শংকরবাবু জোর দিয়ে বললেন, তিনি যোগানন্দকে ও-বাড়ি থেকে প্রথম বেরিয়ে যেতে দেখেছেন। দরজা দিয়ে যোগানন্দ যখন বেরিয়ে আসে, তখন শংকরবাবুর সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে। সে চাপা গলায় বলেছিল, অ্যাকশন সাকসেসফুল! রিট্রিট! তারপর সে ছুটে বেরিয়ে যায়। তার হাতে থলিটা ছিল। সিরাজুল তারিখও বললেন, তিনি যোগানন্দকে অন্ধকারের মধ্যে থলি হাতে ছুটে যেতে দেখেছেন। তখনও লোকজন তাড়া করেনি। সুতরাং যোগানন্দর ধরা পড়ার প্রশ্নই ওঠে না!

তা হলে সে গাড়ির কাছে এল না কেন? সে পথভুল করবে, এটাও কল্পনা করা যায় না। আর কেউ করল না, শুধু একা তারই ভুল হবে? তা ছাড়া, ওই অঞ্চলটা যোগানন্দরই বেশি চেনা–সে-ই পুরো ব্যাপারটা পরিকল্পনা করেছিল। বাড়ির ভেতরের লোককে। হাত করে দরজা খোলাবার বন্দোবস্তও সে করেছে। কোথায় গেল যোগানন্দ?

সূর্য সবচেয়ে শেষে গাড়ির কাছে পৌঁছেছিল। সে জন্য ব্রজগোপাল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই যোগানন্দকে দেখিসনি?

সূর্য বলল, না। অন্য কোনও দিকে চেয়ে দেখার মতন মনের অবস্থা তার ছিল না।

তোর আসতে দেরি হল কেন?

আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।

ফায়ার করলি কাকে দেখে?

ওদের ভয় দেখাবার জন্য। ওপরের দিকে ফায়ার করেছি, কারওর গায়ে লাগেনি।

ব্রজগোপাল দু’-এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, যোগানন্দও আছাড় খেয়ে পড়ে যায়নি তো? হয়তো পা-টা ভেঙে গেছে।

শংকবাবু তৎক্ষণাৎ বললেন, অসম্ভব! যোগানন্দ পা ভেঙে পড়ে থাকার ছেলেই নয়।

জায়গাটায় বড় বড় ঘাস ছিল। যদি সাপেটাপে কামড়ায়।

ব্রজদা, আপনি কী বলছেন কী! এ কখনও হতে পারে?

তা হলে যোগানন্দ কোথায় গেল?

এই প্রশ্নটা বার বার ঘুরেফিরে আসছে সকলের মনে। যোগানন্দ কোথায় গেল? কোথায় যেতে পারে?

কিন্তু এটাও মূল প্রশ্ন নয়। সেই প্রশ্নটা এখনও কেউ উচ্চারণ করছে না। যোগানন্দের চেয়েও বড় তার হাতের টাকার থলি। টাকাপয়সা ও গয়না মিলিয়ে অন্তত তিরিশ হাজার টাকার কম নয়।

গাড়ি এসে থামল চন্দননগরের সেই বাগানবাড়ির সামনে। ননীমাধব ও বনলতা তখনও জেগে আছেন, ব্রজগোপালের সঙ্গে আর একজন এসেছিল, বাণীকণ্ঠ, সেও তৈরি। হয়ে আছে–মালপত্র নিয়ে রাত্তিরেই কলকাতায় রওনা হয়ে যাবার জন্য।

গাড়ি থেকে নেমে শংকরবাবুই প্রথম দু’হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, দূর, দূর! ডাকাতি করার পাপও করলাম, অথচ কিছুই হল না! শুধু শুধু নিরপরাধ লোককে মারা

সিরাজুল বললেন, আমরা দাগী হয়ে রইলাম!

ডাকাতি করা যে একটা পাপ কাজ এটা যাত্রা শুরুর সময় কারওর মনে হয়নি। বরং মহৎ আদর্শের আবরণটাই ছিল প্রধান। সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা দরকার। সুতরাং কোনও কঞ্জুষ বৃদ্ধের সিন্দুকে বন্ধ করে রাখা টাকা কেড়ে নেওয়ার মধ্যে কোনও গ্লানি নেই। এবং এ কাজে বেরিয়ে যদি দু-এক জন বাধাদানকারীকে মারতে হয় কিংবা নিজেদের মধ্যে কারওকে মরতে হয়–সেটাও গৌরবের। কিন্তু সেই ডাকাতিই সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ করেও খালি হাতে ফিরে আসার পর ওরা নিজেদের মনে করতে লাগল সাধারণ ক্রিমিনাল। অদৃশ্য টাকার থলিটা মস্ত বড় ছায়া ফেলে দুলতে লাগল ওদের মাথার ওপর।

শংকরবাবু হতাশ ভাবে বললেন, সব গেল! সব নষ্ট হয়ে গেল!

বাকি তিন জন নেমে এসেছে নীচে। দারুণ ব্যগ্র ভাবে জিজ্ঞেস করল, কী হল? যোগানন্দ কোথায়?

সূর্যর হাঁটু থেকে রক্ত পড়ছে, টনটন করছে বেশ–এখন তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। বনলতা বললেন, কী করে লাগল? ইস, অনেকখানি কেটে গেছে যে!

ওপরে আসবার পর বনলতা শুকনো ন্যাকড়া দিয়ে সূর্যর হাঁটুর রক্ত মুছে ব্যান্ডেজ করে দিতে গেলেন। সূর্য কিছুতেই রাজি হচ্ছে না–হাত দিয়ে আড়াল করে বার বার বলছে, ও কিছু না–এমনিই সেরে যাবে! অন্যের কাছ থেকে সেবাশুশ্রূষা নেবার অভ্যেস নেই তার। তা ছাড়া, আর কারওর কিছু হয়নি, শুধু তারই পা কেটে গেছে এটা তার পক্ষে একটা লজ্জার ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত বনলতা তাকে এক ধমক দিয়ে বললেন, বেশি বাড়াবাড়ি করতে হবে না, চুপ করে বসে থাকো তো! যদি সেপটিক হয়, তখন বুঝবে!

সে রাত্রে কারওর আর ঘুমোনোর প্রশ্ন ওঠে না। রীতিমতন তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল। যোগানন্দকে স্পষ্ট করে কেউ বিশ্বাসঘাতক বলছে না, যদিও অনেকেরই মনের কথা তাই। একমাত্র ননীমাধব বলতে লাগলেন, তা কখনও হতে পারে? কামারপুকুর কেসে যোগানন্দ যে রকম নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে এগিয়ে গিয়েছিল—

ব্রজগোপাল বললেন, তা ছাড়া টাকাপয়সার ওপর ওর কোনও লোভ নেই! ওর বাপ জমিদার, কত সম্পত্তি–সে-সব ছেড়েছুঁড়ে এসে–

শংকরবাবু বললেন, ওর বাপ ওর সম্মায়ের ছেলের নামে সব সম্পত্তি লিখে দিয়েছে–

তা হলেও, ও নিজে যেটুকু পেত–

একটা কথা বলুন তো। আমাদের যখন টাকাপয়সার এত দরকার–তখন যোগানন্দ তার নিজের বাড়িতে ডাকাতি করার পরামর্শ দিল না কেন? অন্যের বাড়িতে–

সব ব্যাপারেই সুবিধে অসুবিধে আছে তো! ওদের বাড়িতে নেপালি দরওয়ান।

আপনারা একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন কি না জানি না–এদানি ওর মাথায় নিশ্চয়ই একটু গোলমাল দেখা দিয়েছিল। কথাবার্তা যেন কী রকম কী রকম–

বনলতা বললেন, তা কিন্তু ঠিক। আমারও আজকাল ওকে দেখলে কী রকম পাগল পাগল মনে হত! মুখ-ভরতি গোঁফ-দাড়ি–ওগুলো নাকি ওর মানত করা–হঠাৎ কাল দেখলাম সব কামিয়ে ফেলেছে–

সূর্য অবাক হয়ে সব কথা শুনছিল, কিন্তু কোনও থই পাচ্ছিল না। যোগানন্দকে যতুটুক সে দেখেছে, তার ভালোই লেগেছে-ও রকম একটু পাগলা পাগলা ভাব তো অনেক মানুষেরই থাকে কিন্তু সে এ রকম ভাবে সকলকে ঠকিয়ে যাবে–এটা কি বিশ্বাস করা যায়? মানুষ এ রকম হতে পারে? যোগানন্দর পিঠে সেই চাবুকের লম্বা লম্বা দাগের কথা তার মনে পড়ল। অবশ্য যোগানন্দর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যাও সে খুঁজে পায় না।

শংকরবাবুর অনুশোচনাই সবচেয়ে বেশি। বার বার কৃতকর্মের জন্য আপশোস করতে লাগলেন। হঠাৎ সিরাজুল তারিখের দিকে ফিরে তীব্র গলায় বললেন, তারিখ সাহেব, আপনি যে ওই বুড়ো লোকটাকে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে অত জোরে মারলেন, লোকটা যদি মরে গিয়ে থাকে?

সিরাজুল থতমত খেয়ে বললেন, লোকটা যে যোগানন্দকে আইডেন্টিফাই করে ফেলেছিল!

তা হোক! কিন্তু খুনি কে হবে, আপনি না যোগানন্দ?

মানে, আমি তো ঠিক—

ব্রজগোপাল হাত তুলে বললেন, চুপ! এসব কথা আর না। তারিখ সাহেব মারেননি–আমরা সবাই মিলে মেরেছি। আজকের প্রত্যেকটা কাজের জন্য আমরা সবাই একসঙ্গে দায়ী।

সামান্য চোরডাকাতের মতন এখন আমাদের পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে! আমি প্রথম থেকেই এর বিরুদ্ধে ছিলাম।

শংকর, তুমি তো আগে এ কথা বলেনি!

বলার সুযোগ পাইনি! এখন বলুন, এত সব খরচ চালানো হবে কী করে? এই বাড়িটা রাখার একটা খরচ আছে কলকাতার খরচ, এক ডজন ডিটোনেটার পাওয়া যাচ্ছিল, তার জন্য ছ’ হাজার টাকা লাগবে।

মাথা ঠান্ডা করে আবার আমাদের নতুন ভাবে পরিকল্পনা করতে হবে।

আবার? ব্রজদা, আমাদের দিন শেষ।

কথাটা শুনে ঘরের সবাই এক মিনিট চুপ করে রইল। যদিও বোঝা যায়, সকলের মনের মধ্যে অনেক কথার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একে বলা যায় আসন্নপ্রসবিনী: স্তব্ধতা।

ব্রজগোপাল তার লম্বাটে মুখখানায় বিষণ্ণ হাসি ফুটিয়ে বললেন, এত সহজেই ভেঙে পড়ছ, শংকর?

শংকরবাবু বললেন, ভেঙে পড়ার কোনও প্রশ্ন নয়। সতেরো বছর বয়স থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি। এখন আমার বয়স ছত্রিশ। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা জেলখানার মধ্যে কিংবা বাইরে থেকেও পালিয়ে পালিয়ে কাটালাম। কত দিন হয়ে গেল নিজের বাড়িতে নিজের বালিশ মাথায় দিয়ে শুইনি। সে জন্য আমার কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, কী করলাম? দেশের কোন কাজে লাগলাম? এটা শুধু আমাদের একটা নেশা না আর কিছু? সামান্য কিছু বোমা পিস্তল নিয়ে আমরা ইং, বজকে তাড়াব? ভারতের সব জায়গায় আমাদের সংগঠন নেই বাংলাদেশেও নানা দল–এ আমরা কী করছি? আমরা শুধু চোরডাকাত আর খুনের মতন–

ব্রজগোপাল তাকে বাধা দিয়ে বললেন, তুমি শুধু নৈরাশ্যের দিকই দেখছ। কিন্তু চরম মুহূর্ত এসে গেছে–এই আমাদের শেষ সুযোগ। ইয়োরোপে যুদ্ধ বেধে গেছে– এবার ইংরেজকে শেষ ধাক্কা দিতে পারলেই–

ননীমাধব যুদ্ধের কথাটা হালকা ভাবে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ব্রজ, তুমি ওই যুদ্ধের ওপর বেশি ভরসা কোরো না। এ যুদ্ধ দু’ দিনেই শেষ হয়ে যাবে। পোন্ড নিয়ে ঝগড়া–এ-যুদ্ধ হবে ইংরেজ-ফরাসির বিরুদ্ধে জার্মানির। জার্মানির সাধ্য কী একা ইংরেজ-ফরাসির বিরুদ্ধে লড়ে?

হিটলারকে হেলাফেলা কোরো না! ওনার পাওয়ার আর অ্যামবিশন দুটোই অনেক বেশি। যে ভাবে চেকোস্লোভাকিয়াকে পকেটে পুরল, দেখলে না? নাৎসিদের অভ্যুত্থান যদি লক্ষ করো–

হিটলারের যতই ক্ষমতা থাক–ফ্রান্সের ম্যাজিনো লাইন ভেদ করার সামর্থ্য তার হবে না। তা ছাড়া ইংরেজদের নৌশক্তি–তার বিরুদ্ধে জার্মানি? ফুঃ! ইংরেজ রাজত্বে সূর্য ডোবে না–সেই তুলনায় ওইটুকু জার্মানি কী করবে? আর একটা কথাও তোমাকে বলে দিচ্ছি–ঘরের পাশে হিটলারের এত বাড়াবাড়ি স্ট্যালিন সহ্য করবে না।

স্ট্যালিনের কথা ছাড়ো! তুমি ভুলে যাচ্ছ–স্ট্যালিন হিটলারের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি করেছে। রাশিয়ার যদি মুরোদ থাকত তা হলে নাৎসি জার্মানির সঙ্গে এ রকম ভাবে হাত মেলাত না। হিটলারের দেখাদেখি চুপে চুপে ফিনল্যান্ডের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

কিন্তু হিটলার রুশদের ঘৃণা করে। ওর মতে রুশরা খাঁটি আর্য নয়–তা ছাড়া কমুনিজমের সঙ্গে নাৎসিবাদ কখনও পাশাপাশি চলতে পারে?

চলছে তো দেখতে পাচ্ছি। রুশদের যদি ঠেকিয়ে রাখা যায় তা হলে হিটলার দুর্ধর্ষ হয়ে উঠবে, সঙ্গে ওই মুসোলিনি গুন্ডাটা আছে–ইংরেজদের এবার শেষ করবে।

আমেরিকা ইংরেজদের পক্ষে আসবে।

রুজভেল্ট? অসম্ভব! রুজভেল্ট যুদ্ধে যোগ দেবে না কিছুতেই। তার কী দায় পড়েছে সাধ করে ইয়োরোপের যুদ্ধ ঘাড়ে নেবার। আমেরিকার জনমতও যুদ্ধের বিরুদ্ধে তারা বরং এই মওকায় কিছু ব্যবসা করে নেবে।

শংকরবাবু এতক্ষণ ননীমাধব আর ব্রজগোপালের আলোচনা শুনছিলেন। এবার গম্ভীর ভাবে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু ইয়োরোপের যুদ্ধে আমাদের কী সুবিধে হবে?

ব্রজগোপাল বললেন, এই যুদ্ধে ইংরেজ ঘায়েল হলে ভারতে ব্রিটিশ শক্তি দুর্বল হয়ে যাবে। আমরা ওদের শেষ আঘাত দেব।

জার্মানি যদি জেতে?

যদিটদি নয়, জার্মানি জিতবেই।

আমার কথাটা শুনুন। জার্মানি যদি জেতে–তখন কি আমরা ইংরেজদের বদলে জার্মানির অধীনে চলে যাব?

জার্মানি এত দূর এসে কলোনি করতে চায় না। তা ছাড়া, জার্মানরা ভারতীয়দের বন্ধু মনে করে–আমরাও বিশুদ্ধ আর্য। আমাদের সাহিত্য, দর্শনকে ওরা শ্রদ্ধা করে। আমার কাছে সিক্রেট খবর আছে, জার্মানি আমাদের সাহায্য করবে। আমেরিকাও ভারতের স্বাধীনতা চায়। প্রথম মহাযুদ্ধে আমরা পুরো সুযোগ নিতে পারিনি–এবারেও যদি না পারিতা হলে স্বাধীনতা আর কোনও দিন আসবে না।

 আপনার কথা মতন না হয় ধরেই নিচ্ছি–এবারেই আমাদের বড় সুযোগ। কিন্তু নেতৃত্ব দেবে কে? কংগ্রেস এখন পুরোপুরি কনস্টিটিউশনাল রাজনীতির দিকে চলে গেছে। আমাদের ওরা ঘৃণা করে। ওরা চায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতার ভাগ পেতে। আমাদের দাদারাও অনেকে কংগ্রেসে গিয়ে ভিড়েছে। আমাদের কী আছে এখন? এখানে-ওখানে কয়েক জন ছড়িয়ে আছি-সংগঠন ভেঙে গেছে, অস্ত্র নেই, বিশ্বাসঘাতক ঢুকেছে–এই শক্তি নিয়ে আমরা ইংরেজ তাড়াব?

উত্তেজিত হয়ো না। ঠান্ডা মাথায় বুঝবার চেষ্টা করো। সুভাষবাবু কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এখন সুভাষবাবুকে আমরা দলে পাব। সারা ভারতের যুবশক্তি এখন সুভাষবাবুর দিকে তাকিয়ে আছে মোহনদাস গান্ধীর দিন শেষ! ত্রিপুরি কংগ্রেসেই তিনি কংগ্রেসি ঐক্যের কবর দিয়েছেন।

সুভাষবাবুকে ইংরেজ জেলে পুরেই রাখবে। ইংরেজ কি বোকা যে এই অবস্থায় সুভাষবাবুকে বাইরে ছেড়ে দেবে? ব্রজদা, রাজনীতি এখন অন্য দিকে যাচ্ছে। ইংরেজের সবচেয়ে মারাত্মক চালটা আপনারা এখনও ধরতে পারছেন না। মুসলিম লিগের কথা ভুলে যাচ্ছেন? ইংরেজ এখন মুসলিম লিগকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। এখন আর স্বাধীনতা বড় প্রশ্ন নয়–এখন হিন্দুর স্বাধীনতা, মুসলমানের স্বাধীনতা? সারা দেশ জুড়ে এখন চলবে মন কষাকষি, দরকষাকষি–আমরা পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাব ক্রমশ।

শংকরবাবু গাঢ় চোখে তারিখ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী, ঠিক বলছি না?

তারিখ সাহেব হাত নেড়ে বললেন, মুসলিম লিগকে অত গুরুত্ব দেবেন না। ও সব জিন্না সাহেবের খেয়াল। নিজের হাতে পাওয়ার রাখবার জন্য।

মুসলিম লিগকে গুরুত্ব না দিয়ে আপনারাই ভুল করছেন। কংগ্রেস এই ভুল করেছে। গোড়া থেকেই জিন্না সাহেবের সঙ্গে আঁতাত করেনি। এখন কংগ্রেস সারা ভারতে একজনের বেশি ন্যাশনালিস্ট মুসলমানকে ভোটে জেতাতে পারল না। মুসলমানদের মনে বিশ্বাস জেগেছে যে তাঁদের অধিকার আদায় করার জন্য মুসলিম লিগ ছাড়া গতি নেই। কংগ্রেসি স্বাধীনতা এলে হিন্দুদেরই আধিপত্য হবে। আবুল কালাম আজাদ এ বিশ্বাসে একটুও চিড় খাওয়াতে পারলেন না। কংগ্রেস শুধু জোড়াতালি দিয়ে চালাবার চেষ্টা করছে–গান্ধীজি শুধু কোরান পাঠ করে মুসলমানদের মন জয় করার কথা ভাবছেন।

তারিখ সাহেব বললেন, কংগ্রেস শুধু ফাঁকা আইডিয়ালিজম দেখাচ্ছে। মুসলমান সমাজে বহুত অভাব আর অভিযোগ তো আছেই! গরিব চাষিদের মহাজন আর। জমিদাররা রক্ত নিংড়ে নিচ্ছে–মুসলমান সমাজে এখনও শিক্ষার সুযোগ নেই, চাকরি-নোকরির সুযোগ নেই—

ব্রজগোপাল অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, এটা সামাজিক সমস্যা! সামাজিক! এর সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্নটা জুড়ে দেওয়া বোকামি! হিন্দুদের মধ্যেও অনেক শ্রেণি আছে-যারা খুবই গরিব, খুবই নির্যাতিত, শিক্ষার সুযোগ নেই! গরিবের আবার জাত কী? হিন্দু জমিদার কি হিন্দু প্রজাদের ছেড়ে কথা কয়? মুসলমান মহাজন মুসলমান চাষির কাছে সুদ নেয় না? জাতের ভিত্তিতে সমস্যাটা তুলে ধরাই ব্রিটিশ চক্রান্ত।

শংকরবাবু বললেন, তারিখ সাহেব, এমন দিন আসছে–সে-দিন আপনি আর আমি এ রকম ভাবে পাশাপাশি বসে আর কথা বলতে পারব না। আপনি আমাকে অবিশ্বাস করবেন, আমি আপনাকে অবিশ্বাস করব!

তারিখ সাহেব বললেন, আপনি কী বলছেন কী? আপনি এত পেসিমিস্ট হয়ে যাচ্ছেন কেন?

আমি বুঝতে পারছি, আমাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমরা ওলড ফ্যাশানড় বিপ্লবী। আমরা এখনও চোরা গোপ্তা আর দু’-একটা খুনজখম করে দেশ স্বাধীন করতে চাইছি! আমি আর আপনাদের দলে নেই। আমার মতে মার্কসবাদই একমাত্র পন্থা। ধর্মের প্রশ্নটা যে হঠাৎ এ রকম মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে, আমরা কি আগে ভেবেছি? সারাদেশে একটা শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে না তুলতে পারলে এ প্রশ্ন আর এখনও মিটবে না। সে জন্য অনেক ধৈর্য নিয়ে কাজ করতে হবে। সারা দেশব্যাপী একটা অভ্যুত্থান ঘটাতে না পারলে সে-সমাজ কখনও আসবে না।

ব্রজগোপাল বললেন, শংকর আমি বলছি, বিশ্বাস করো, শিগগিরই একটা দারুণ বড় রকমের ঘটনা ঘটবে। খুবই সাংঘাতিক ঘটনা। তখন আমাদের প্রত্যেককে সৈনিক হতে হবে।

শংকরবাবু পকেট থেকে পিস্তলটা বার করে মাদুরের ওপর রেখে বললেন, এই নিন। আমাকে আর আপনার দলে পাবেন না। আমি মনস্থির করে ফেলেছি।

কোথায় যাবে? তুমি কি এতদিন বাদে নিজের বাড়িতে ফিরবে?

ক্লান্ত বিপ্লবী এবার করুণ ভাবে হাসল। তারপর বলল, না, দেখি! বাড়ি আর ফিরব কী করে! আমি তো এখন ফেরারি ডাকাত! লুঠের বখরা পাইনি, তবু তো ডাকাত!

ব্রজগোপাল কঠোর স্বরে বললেন, শংকর, হুটপাট করে কিছু কোরো না। আমাকে দু’-এক দিন ভেবে দেখতে দাও। আর একটা কথাও আমি বলে রাখছি, যোগানন্দ যদি সত্যিই আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে তবে তার রক্তদর্শন না করে আমি থামব না। আজ না হোক দু-চার বছর বাদে দেশ স্বাধীন হবেই-ইতিহাসের গতি সেই দিকে–কিন্তু সেই স্বাধীন দেশে বিশ্বাসঘাতকদের কোনও স্থান হবে না। আমার সেই স্বাধীন ভারতবর্ষ হবে সমস্ত রকম অন্যায়, অবিচার থেকে মুক্ত। আমি সেদিন না বেঁচে থাকলে ক্ষতি নেই–তবু আমার পরের মানুষরা যেন সত্যিকারের মানুষের অধিকার পায়। সেই জন্যই তো এত বছর ধরে এত কষ্ট সহ্য করলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *